ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১০

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১০
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শুরু হলো। তাই আশেপাশে তেমন লোকজন নেই বললেই চলে। প্রিয়তা একাই বসে ছিল, তখন একটা বাচ্চা এসে প্রিয়তার হাত ধরে বললো,
—আপু, আপু!
প্রিয়তা তাকালো। একটা বছর পাঁচেকের গুলফ্রক পরা বাচ্চা মেয়ে ওর হাত ধরে টানাটানি করছে। হঠাৎ বাচ্চাটা ওর হাতে কিছু একটা দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। প্রিয়তা অবাক হয়ে দেখল, সেটা একটা ভাঁজ করা চিরকুট। কাগজের ভাঁজ খুলে সে দেখলো, সেখানে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা—
“আমি ৩ তলার কর্নারের রুমটাতে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
ইতি, প্রণয়।”

প্রিয়তা একটু অবাক হলো। প্রণয় ভাইয়া এভাবে ওকে কখনোই ডাকবে না। কিন্তু কিশোরী মন এত কিছু ভাবলো না। প্রণয় ডেকেছে—মানে হয়তো বড় কোনো দরকার হবে! সে গুটি গুটি পায়ে ৩ তলায় চলে গেল। কর্নারের রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো—
রুমটা গুটগুটে অন্ধকার! অন্ধকারে প্রিয়তার ভীষণ ভয়! তাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে চাইল, ঠিক তখনই একটা শক্ত সামর্থ্য পুরুষালী হাত তাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলো!
ভয়ে প্রিয়তার গলদেশ শুকিয়ে গেল। মাথার ওপর, ঘাড়ে, গলায় আছড়ে পড়া কারও গরম নিঃশ্বাসের স্পর্শ টের পেল। ওর মাথাটা কারও শক্ত বুকের সাথে ঠেকে আছে, ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
সামনের মানুষটা যে প্রণয় নয়, সে বিষয়ে প্রিয়তা শতভাগ নিশ্চিত, কারণ প্রণয়ের গায়ের গন্ধ, স্পর্শ—সবকিছু ওর বড্ড চেনা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রণয় দশ হাত দূরে থাকলেও প্রিয়তা তাকে অনুভব করতে পারে, তাহলে, তাহলে ওর সামনের মানুষটা কে?
প্রিয়তার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো ভয়ে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না, কারণ এখানে যদি ওকে মেরে ফেলা হয়, তাহলে কেউ জানতে পারবে না। লোকটা আরও কাছে চলে এলো। প্রিয়তার নরম, কোমল দেহের সাথে নিজের বলিষ্ঠ, পুরুষালী দেহটা চেপে দাঁড়িয়ে প্রিয়তার কোমর চেপে ধরল । প্রিয়তার ঘাড়ের কাছে নাক নিয়ে গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিলো। এভাবে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে প্রিয়তার দেহের মনমাতানো ঘ্রাণ নিজের নাসারন্ধ্রে টেনে নিলো।
প্রিয় নারীর দেহের ঘ্রাণ পুরুষটির শিরা-উপশিরায় মাদকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। কোনো অপরিচিত লোক হুট করে এত কাছে আসায় প্রিয়তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

— ক… ক… কে?
লোকটা কিছু বললো না, শুধু এক হাত দিয়ে প্রিয়তার মুখ চেপে ধরলো। অন্য হাত দিয়ে প্রিয়তার মাখনের মতো নরম, তুলতুলে গালে স্লাইড করছে । তারপর ওর কেনের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— সুইটহার্ট!
প্রিয়তার মনে চরম ভয়ের দানা বেঁধেছে।
এমন অপরিচিত লোকের অযাচিত স্পর্শ সে নিতে পারছে না।
প্রিয়তা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। চোখের পাতায় ভেসে উঠছে প্রণয়ের মুখটা। সে মনে মনে প্রণয়কে ডাকল—
“প্রণয় ভাইয়া, আপনি কোথায়? প্লিজ আসুন!
আমার ভীষণ ভয় করছে।”
লোকটা আবার ফিসফিস করে বলল—

— শুনো মেয়ে, তোমার লজ্জা করে না?
একজন বিবাহিত পুরুষকে ভালোবাসতে! যে পুরুষ প্রতিনিয়ত অন্য নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়, তার প্রতি এত ভালোবাসা আসে কীভাবে তোমার ? সে ডেকেছে বলেই তুমি নির্জন অন্ধকার ঘরে চলে এলে?
তুমি জানো না, পুরুষ সবসময় পুরুষই হয়। তাদের ওপর এত বিশ্বাস করতে নেই।
এমন জঘন্য কথা শুনে প্রিয়তা আরও জোরে কেঁদে উঠল! কারন তার মাথায় কেউ বন্ধুক ঠেকিয়ে ও এই কথা বললে সে বিশ্বাস করবে না।

লোকটা মুখের কাছে ঠোট নিয়ে গভীর ভালোবাসায় প্রিয়তার গালে চুমু খেল।
তার মনে হলো, নরম, মসৃণ কিছুতে ঠোঁট দেবে গেছে।
প্রিয়তাকে সামান্য একটা চুমু খেতেই তার নিজের বুকটা কেপে উটল।
এটা তার প্রিয়সিকে করা প্রথম ভালোবাসার স্পর্শ!
প্রিয়তা এটা বুঝতে পেরেই ছটফট করে উঠল।
কিন্তু কিছুতেই প্রিয়তাকে ছাড়ছে না!
অসহায় প্রিয়তা লোকটার চুল টেনে মাথা নিচু করে তার ঘাড়ে জোরে কামড় বসাল, যাতে ব্যথা পেয়ে লোকটা তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু উল্টো হলো!
লোকটা তো ছাড়লই না, বরং আরও শক্তভাবে কোমর জড়িয়ে ধরল!
কানের কাছে মুখ নিয়ে হাস্কি টোনে বলল—

— উফ, সুইটহার্ট! এভাবে কামড়ালে আমি কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারব না! তখন উল্টোপাল্টা কিছু হয়ে গেলে আমার দোষ দিতে পারবে না!
বলে আবারও প্রিয়তার গালে নিজের নাক ঘষল।
প্রিয়তা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলল!
লোকটা মনে হয় একটু বিরক্ত হলো। ধমক দিয়ে বলল—
— এই মেয়ে, আমি কি তোমাকে মারছি?
এমন মরা কান্না কাঁদছ কেন?
একটু আদরই তো দিচ্ছি!
এই সামান্য আদর সহ্য করতে পারো না পরে তোমার কি হবে হ্যাঁ।
বলে আবারও তার গলায় চুমু খেতে নিল…
ঠিক তখনই, হঠাৎ দরজায় বিকট শব্দে লাথি পড়ল!
লোকটা বিরক্ত হয়ে মনে মনে তেতে উঠে বলল,

—কে রে ভাই, এমন সময় ডিস্টার্ব করতে চলে এলো!
দরজার সামনে প্রণয়কে দেখে লোকটার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল। সে প্রিয়তাকে ছেড়ে দিল, কারণ সে জানে—এটা লড়াই করার সঠিক সময় নয়।
প্রণয় দুই পা ভেতরে ঢুকেই চিৎকার করে ডাকল,
—রক্তজবা!
এই মুহূর্তে সে এখানে প্রণয়কে ভীষণভাবে কামনা করছিল। প্রণয়কে দেখে ওর কলিজায় পানি এলো। ঝড়ের গতিতে কাঁপতে কাঁপতে সে প্রণয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল!
এই দৃশ্য দেখে কারো চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল।
প্রিয়তা প্রণয়ের শার্টের কলার খামচে ধরে প্রণয়ের বুকে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে উঠলো । কাঁদার তালে তালে ছোট্ট শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠছে।
প্রিয়তার অবস্থা দেখে প্রণয় যেন নিজের খেই হারিয়ে ফেলল! তার বুকের ভেতরটা অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল।

নিজের ভালোবাসায় তিল তিল করে গড়ে তোলা ছোট্ট পাখিটাকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে, চুলে, মুখে, কপালে একের পর এক চুমু খেয়ে বলল,
—এই তো জান, আমি এসে গেছি! কোনো ভয় নেই তোর! দেখ, আমি তোর সামনে আছি! তাকা আমার দিকে!
প্রিয়তা কোনো কথাই কানে তুলল না, শুধু পুরুষালি প্রশস্ত বুকে মুখ গুঁজে নিরন্তর কেঁদে চলল।
প্রণয়ের বুকটাও অসম্ভব কাঁপছে! অজানা আশঙ্কায় যেন কেউ ওর কলিজাটা কামড়ে ধরেছে!
ও প্রিয়তার মুখ নিজের হাতে আজলায় তুলে ধরে কাঁপা গলায় বলল,
—তুই এখানে কেন? কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন? কিছু বল, পাখি!
প্রিয়তা কিছুই বলছে না!

আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। তার শরীরের কাঁপন বাড়ছে।
প্রণয় ওকে কোলে নিয়ে রুমের বাইরে এসে আলোয় দাঁড় করাল। কান্নার চাপে লাল হয়ে যাওয়া ফরসা গোলাপি মুখের দিকে তাকাল! নীলাভ চোখের দিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল—ঠিক কী হয়েছে?
কিছুটা বুঝতে পেরে ওর মুখের রঙ বদলে গেল!
ওর হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। কপালের শিরা ফুলে নীলবর্ণ ধারণ করল!
তবুও সে চুপ! কারণ সে প্রিয়তার মুখ থেকে শুনতে চায়।
সে প্রিয়তাকে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। শান্ত হওয়ার সময় দিল। ওর বলিষ্ঠ বুকের উষ্ণতায় কাঁপতে থাকা নরম শরীরটা ধীরে ধীরে স্থির হলো।
২০ মিনিট পর প্রিয়তা মুখ খুলল। প্রণয়কে সব খুলে বলল—যা যা ঘটেছে, সব!
প্রণয় যা ভাবছিল, তাই!
তার চোখে হিংস্রতা ফুটে উঠল।

ও প্রিয়তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কপালে গভীর চুমু খেয়ে বলল,
—এভাবে আর কেউ কখনো ডাকলে যাবি না! মনে থাকবে? তোর যদি কিছু হয়ে যায়…
আর কিছু না বলে সে আবারো প্রিয়তাকে শক্ত করে ঝাপটে ধরল।
প্রিয়তা মাথা নাড়ল।
প্রণয় ফোন বের করে পরিণীতাকে কল দিল।
একবার রিং বাজতেই পরিণীতা ফোন ধরল।
প্রণয় কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা বলল,
—তাড়াতাড়ি ৩ তলায় আয়!
পরিণীতা একটু অবাক হলো, কিন্তু দেরি না করে দ্রুত ছুটে এলো। এসে প্রিয়তার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে হতবাক হলো!
কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই প্রণয় বলল,

—ওকে নিয়ে যা! আর একা ছাড়বি না!
ভাইকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। সে প্রিয়তাকে নিয়ে চলে গেল।
প্রণয় ঠোঁট কামড়ে হিংস্র স্বরে বলল,
—আজ তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না!
প্রিয়তার পিছনে সব সময় সিকিউরিটি কার্ড পাহারা দিতে থাকে সাধারণভাবে দেখে তাদের চেনা সম্ভব নয়,,,ওরা সবসময় প্রিয়তার সকল খবর প্রণয় কে দেয় আর ওরাই প্রিয়তার কিডন্যাপ হওয়ার বিষয়টা প্রণয়কে জানিয়েছিল আর ওরাই আজকে প্রিয়তাকে তিনতলায় উঠতে দেখে প্রনয় কে জানিয়েছে।
সন্ধ্যা ৬টা। তালুকদার বাড়ি থেকে সবাই শিকদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। প্রিয়তা আর পরিণীতাও চলে এসেছে। সাদাফ কৌশল করে পরিণীতাকে তার পাশের সিটে বসিয়েছে। পরিণীতা তো মহাখুশি! সাদাফ ভাই তাকে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দিয়েছে। পরিণীতা আবার এতো এঁচোড়ে পাকা মেয়ে নয় যে ছেলেদের চোখ দেখে মনের কথা বুঝে ফেলবে। তাই সাদাফ তাকে নিয়ে কী অনুভব করে, তার শূন্য শতাংশ সম্পর্কেও পরিণীতার কোনো ধারণা নেই।

সাদাফ পরিণীতার উদ্দেশ্যে বলল, “ফুলপরী।”
পরিণীতা বলল, “হুম?”
সাদাফ বলল, “এবার তো আমার গিফটটা অ্যাকসেপ্ট করে নাও।”
প্রিয়তা সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওটা তো আমি সেদিন নিয়েই গুছিয়ে রেখেছি।”
সাদাফ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, “ওটা গুছিয়ে রাখার জন্য দেইনি “ফুলপরী
পরিণীতা বলল, “তাহলে কী করব?”
সাদাফ বলল, “কেন, পরবে।”
পরিণীতা বলল, “ঠিক আছে।”
সাদাফ পরিণীতার দিকে তাকিয়ে বলল, “ফুলপরী, তোমার সবচেয়ে বেশি কী ভালো লাগে?”
পরিণীতা মনে মনে বলল, আমার মাস্টারমশাইকে…
সাদাফ বলল, “কি হলো, কী ভাবছো?”
পরিণীতা বলল, “উহু, কিছু না।”
হঠাৎ সাদাফ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, “আজকে তোমার একটা কল এসেছিল তখন।”
পরিণীতা ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমার কল?”

সাদাফ বলল, “হুম।”
পরিণীতা ছটফটিয়ে বলল, “কে ফোন দিয়েছিল?”
সাদাফ বলল, “তোমার স্যার।”
পরিণীতা বলল, “কখন?”
সাদাফ বলল, “দুইটার দিকে।”
পরিণীতার মনে মনে ঢোঁক গিললো। মাস্টারমশাই ফোন দিয়েছিলেন, কিন্তু সে জানেই না!
সে ফোন বের করে কল লিস্ট চেক করল। সত্যি ফোন এসেছিল। WhatsApp-এ একটা মেসেজও দেখল, যেখানে গুটিকয়েক অক্ষরে লেখা— “গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, ফোন দাও।” আর কিছু লেখা নেই।
পরিণীতা অস্থির হয়ে গেল। সাদাফ পুরো বিষয়টা লক্ষ্য করে বলল, “Any problem, ফুলপরী?”
পরিণীতা সাদাফের মুখের দিকে তাকাল। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল, “কিছু না।”
সাদাফ বলল, “ওহ!”

তার ভীষণ ইচ্ছে করছিল পরিণীতার হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখার। কিন্তু পরিণীতা কী ভাববে! তাই ভেবে সে তার তীব্র আকাঙ্ক্ষাটা চেপে গেল।
প্রিয়তা অনুশ্রী বেগমের বুকে চেপে আছে। কারণ, অনুশ্রী বেগম সব ছেলে-মেয়েকেই একটু বেশি আদর করেন। তার কাছে সবাই সমান। তিনি দেখলেন, চুপচাপ মেয়েটা আরও গুটিয়ে গেছে কোনো কারণে। তাই প্রিয়তাকে নিজের কাছে বসিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই মেয়েটা বড় আম্মুর বুকে লেপ্টে চোখ বন্ধ করে নিল।
অনুশ্রী বেগম অপার মমতায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে, ছোট আম্মু?”
প্রিয়তা আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল।
অনুশ্রী বেগম আর কিছু বললেন না।
কিছু সময়ের মধ্যেই তারা শিকদার বাড়িতে পৌঁছে গেল। ইনায়া, কুহু, চিত্রা—ওরা নিজেদের বাড়ি চলে গেছে। প্রণয় তালুকদার বাড়ি থেকেই অন্য কোথাও চলে গেল।
তনুশ্রী বেগম ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বললেন,

— “সবাই ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে সোজা ডাইনিং টেবিলে আসবে। একজনও কোনো রকম তালবাহানা দেবে না! আমি ডিনার রেডি করছি। এক রাত না খেলে এক পাখির মাংস কমে!”
ওরা অসহায় চোখে মা-চাচিদের দিকে তাকালো।
প্রেরণা অসহায় মুখ করে বলল,
— “মেঝ আম্মু, আমি খাব না!”
অনুশ্রী বেগম চোখ রাঙালেন। ওরা বুঝে গেল, না খেয়ে রক্ষা নেই!
অগত্যা সবাই নিজেদের রুমের দিকে গেল।
পরিণীতা নিজের রুমে ঢুকে ফটাফট দরজা বন্ধ করে দিল। চেঞ্জ না করেই তাড়াহুড়ো করে বারান্দায় গেল। পর্দা সরাতেই কারও ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, সুদর্শন মুখশ্রীতে নজর আটকালো।
আবিদ প্রণয় কুঞ্জের পেছনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। পরিণীতাকে দেখতেই সে ফোন ধরার জন্য ইশারা করল।
পরিণীতার কলিজা লাফিয়ে উঠল। ওর কপালে যে আজকে দুঃখ আছে, সেটা সে বেশ বুঝল।
সঙ্গে সঙ্গেই ওর ফোন বেজে উঠল।
ফোনটা কানে দিতেই উচ্চস্বরে ধমক ভেসে এলো—

— “এই মেয়ে, তুমি সারাদিন কোথায় থাকো, হ্যাঁ? ফোন ধরার সময় পর্যন্ত হয় না তোমার? আমাকে জ্বালাতে খুব ভালো লাগে তোমার? কী সুখ পাও তুমি আমাকে পুড়িয়ে? কেন করো এমন? তুমি জানো, তোমাকে আজ সারাদিনে কতগুলো ফোন দিয়েছি? ব্লা ব্লা…”
পরিণীতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার বলল—
— “মনে তো চাচ্ছে, থাপড়িয়ে গাল লাল করে দিই!”
এই কথা শুনে পরিণীতার অটোমেটিক হাত গালে চলে গেল। মনে পড়ল, আবিদের সপাট সপাট চড়ের কথা!
পুরুষালী, শক্ত-সমর্থ হাতের অত্যাচার কতবার যে তার নরম, তুলতুলে গালকে সহ্য করতে হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই! কতবার যে নিষ্ঠুর মানুষটা তার গালের ওপর হামলা করেছে, তারও হিসেব নেই! তাই আবার দু-একটা চড় লাগিয়ে দেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়…

অবশ্য রাগ কমে যাওয়ার পর আহা, কতগুলো চুমু যে দিত, তারও হিসেব নেই! তাই তো এই মানুষটার হাতে চড় খেতেও তার মন্দ লাগে না, মিষ্টিই লাগে!
পরিণীতা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “সরি, মাস্টারমশাই!”
রিনরিনে নারী কণ্ঠস্বরটা কানে আসতে আবিদের বক্ষে শীতল হওয়ার স্রোত বয়ে গেল। হঠাৎ করেই রাগটা নিভে গেল। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে দুই তলার ব্যালকনির দিকে তাকাল। পার্পেল রঙের শাড়িতে পরী লাগছে!
কিছু একটা মনে হতেই হঠাৎ করেই আবার রাগটা মাথায় চেপে বসল।
সে ঠান্ডা স্বরে বলল, “পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিচে আসো, পরিণীতা!”
আবিদ তাকে তার সম্পূর্ণ নাম ধরে ডাকছে, তার মানে মানুষটা ভীষণ রেগে আছে! তার ভয় হলো!
পরিণীতা বলল, “এখন কীভাবে আসব? যদি কেউ দেখে ফেলে?”
আবিদ বলল, “এত কিছু বুঝি না! এক্ষুনি… মানে এক্ষুনি!” বলে কট করে ফোন কেটে দিল।
পরিণীতা ফেঁসাদে পড়ে গেল। সে এখন কী করবে?

সে ভাবল, এখন সবাই নিশ্চিত নিজ নিজ ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। তাকে কেউ দেখতে পাবে না।
সে কোনো রকমে শাড়িটা টেনে-টুনে খুলে ফেলল, একটা লং ওয়ান পিস পরে নিল। তার মাস্টারমশাইয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে!
“এইভাবে কি যাওয়া যায়?”
সে চটপট ফ্রেশ হয়ে এসে বাদামি বর্ণের চোখে হালকা কাজল দিল। কপালে একটা ছোট টিপও পরল। আয়নায় তাকিয়ে দেখল—বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে!
সে পা টিপে টিপে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শিকদার বাড়ির গেটের সামনে আসল।
সেখানে চারজন দারোয়ান পাহারা দিচ্ছে।
“এরা বেরোতে দেখে নিলে সমস্যা হবে?”
মনে মনে সে আবিদের গুষ্টি উদ্ধার করল।

সে গেট দিয়ে যেতে পারবে না। তাই পেছনের পুকুরপাড় দিয়ে ভয়ে ভয়ে এগোতে লাগল।
“কেউ যদি আবার উপরের জানালা দিয়ে দেখে নেয়, তাহলে আরেক কেলেংকারী হবে!”
কোনোরকমে উঁচু পাঁচিলের কাছে পৌঁছে জামাটা শক্ত করে ধরে কোনো মতে পেয়ারা গাছে উঠে পড়ল।
শিকদার বাড়ির সুউচ্চ পাঁচিল থেকে লাফ দিলে কোমরের হাড়ে প্রচুর ব্যথা পাবে জানে , তা সত্যেও…!
“বিসমিল্লাহ!”
আল্লাহর নাম নিয়ে লাফ দিল!
কলিজাটা পানি হয়ে গেল!
“এই বুঝি কোমরের হাড্ডি ভাঙল!”
কিন্তু…

সে অনুভব করল, সে ব্যথা পায়নি!
তাকে কেউ ক্যাচ ধরে নিয়েছে!
সে মিটমিট করে চোখ খুলে দেখল—সে সামনের শ্যামবর্ণের সুদর্শন মানুষটার কোলে চেপে আছে!
সে ওকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকেই চেয়ে আছে!
আবিদ ওকে আস্তে করে নামিয়ে দিল।
চোখের চশমাটা ঠেলে দিয়ে, কপাল কুঁচকে দাঁত চেপে বলল, “তোমার সমস্যা কী, পরিণীতা?”
পরিণীতা নিচু স্বরে বলল, “আমার আবার কিসের সমস্যা?”
সে মনে মনে ভয়ে জমে যাচ্ছে!
আবিদ বলল, “তোমাকে না সেদিন বারণ করেছিলাম মানুষের সামনে শাড়ি না পরতে?”
পরিণীতা আবারও আঁতকে উঠল! সত্যি! তাকে বারণ করেছিল!
তাই সে বিয়ের দিন শাড়ি পরেনি।
কিন্তু…

“আপুর শ্বশুরবাড়িতে শাড়ি পরলে তো আর সে দেখতে পারবে না! তাই ওখানে পরেছিল!”
কিন্তু ওর নিজের বোকামির জন্যই ধরা খেয়ে গেল!
আবিদ আবারও অশান্ত গলায় বলল,
— “তুমি আমার কোনো কথাই শোনো না, অ্যাঞ্জেল! তাই তোমাকে আর কিছু বলতে চাই না! তুমি নিজের মতো থাকতে পছন্দ করো? ওকে, ফাইন! নিজের মতোই থাকো!”
বলে ধাক্কা দিয়ে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করল।
আবিদের এমন কঠিন কথা শুনে পরিণীতা ভীষণ কষ্ট পেল!
সাথেসাথেই চোখে জল চলে এলো!
সে এই মানুষটার কথা শোনে না?
এই কথা… এই লোকটা বলতে পারল!
সে তো সকল কথাই শোনে!

কিন্তু একটা কথা শোনেনি বলে এভাবে বলবে?
তার অভিমান হলো, কিন্তু সে সব অভিমান ছুড়ে রাস্তায় পাশে ফেলে দিয়ে আবিদের পিছু নিল।
এই লোক রেগে আছে, আর দোষটা ওর নিজের!
এখন সে কী করবে?
লোকটা তো ওর সঙ্গে কথা বলছে না!
আর এই লোকের সঙ্গে কথা বলতে না পারলে পরিণীতার প্রাণটা ছটফট করে!
সে দৌড়ে গিয়ে আবিদের পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
আবিদ ওর দিকে তাকাল।
নিশুতি রাত, গ্রামের পথঘাট—এতো বড় চুল খুলে হাঁটা উচিত নয়!
তাই আবিদ দাঁড়িয়ে পড়ল।
পরিণীতা ওর দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকাল।

আবিদ কিছু না বলেই পরিণীতার হাত টেনে কাছে আনল।
কোমর অবধি খোলা চুলগুলো নিজের হাতে পেঁচিয়ে খোঁপা করে দিল।
মাথায় ওড়নাটা সুন্দর করে দিয়ে দিল।
পরিণীতা মুগ্ধ চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু সে কিছু বলার আগেই আবিদ আবার হাঁটা শুরু করল।
পরিণীতা দৌড়ে গিয়ে আবিদের বাঁ হাতটা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে হাঁটতে লাগল।
আবিদ কোথায় যাচ্ছে, সেটা জানার কোনো আগ্রহই নেই তার!
ওরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে এল।
নদীর পাড়ের ঠান্ডা বাতাস ওদের দুজনকেই ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
আজকে বোধহয় পূর্ণিমা!

পূর্ণচাঁদের আলো নদীর বালির উপর পড়ে হীরের মতো চিকচিক করছে।
আশপাশ জোৎস্নার আলোয় আলোকিত।
পরিণীতার সৌন্দর্যও সেই চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে!
আবিদ গভীর দৃষ্টিতে ওর বাদামি রঙের কাজল পরিহিত টানা টানা চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
পরিণীতা ভারী চোখের পল্লব একবার ঝাপটাল।
আবিদের মনে হলো, এ যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর দৃশ্য!
পরিণীতা করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,
“স্যরি, মাস্টারমশাই! এই কান ধরছি! প্লিজ, আমার সাথে কথা বলুন!
আপনি কথা না বললে আমার ভীষণ কষ্ট হয়!”
আবিদের মায়া হলো, কিন্তু সে গলল না।
সেখান থেকে সরে গিয়ে বালির উপর বসল।
এবার আবার পরিণীতার কান্না পাচ্ছে!
সে ঝাপসা চোখে আবিদের দিকে তাকিয়ে বিনা বাক্যে বুকে মাথা রাখল।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

“মাস্টারমশাই…
আমি আপনাকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি! আমি… আমি, আপনি ছাড়া কারও সামনে শাড়ি পরব না!
তবু আপনি আমাকে দূরে ঠেলে দেবেন না!
আমার যে খুব কষ্ট হয়, আপনি রাগ করে থাকলে!”
বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আবিদ এবার সম্পূর্ণ গলে গেল।
সে কি তার অ্যাঞ্জেলের ওপর রাগ করে থাকতে পারে?
এই মেয়েটার চোখের পানি তার বুকে তীরের মতো আঘাত আনছে!
সে বুক থেকে পরিণীতার চাঁদের মতো মুখটা হাতের আজলায় নিল।
গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা চোখের পানিগুলো নিজের ঠোঁট ধারা শুষে নিল।
পরিণীতা চোখ বন্ধ করে আবিদের টিশার্টের গলা খামচে ধরল।
আবিদ ওর তুলতুলে নরম গালে গভীর চুমু খেল।
পরিণীতার সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠল!
সে যে এই মানুষটাকে বড্ড চায়!
কিন্তু সে কাছে আসলেই দম বন্ধ হয়ে যেতে চায়!
অতিকাঙ্কিত পুরুষের কাঙ্ক্ষিত স্পর্শ গুলো তারা সহ্য হয় না। দম বন্ধকর অনুভূতি হয়।
আবিদ তাকে নিবিড়ভাবে নিজের কাছে টেনে নিয়ে পরপর কপালে চুমু খেল।
মনে মনে বলল—

“অ্যাঞ্জেল, তোমার হয়তো আপনজনের অভাব নেই, কিন্তু আমার কাছে আমার মা-বাবার পর তুমিই সেই, যে আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ! তুমি যে আমার কাছে বড্ড দামি! যাকে হারালে আমি বাঁচতে পারব না!”
“লোকে বলে, প্রিয় মানুষ হারালে নাকি কেউ মরে যায় না, বেঁচে থাকে মরার মতো! কিন্তু আমি সত্যি মরে যাব! তাই আমি তোমাকে কোনো কিছুর বিনিময়ে হারাতে চাই না!”
“তুমি আমাকে কী মায়ায় বেঁধেছ জানি না! শুধু এতটুকুই জানি— তুমি আমার নিঃশ্বাস! আর নিঃশ্বাস ছাড়া কেউ কিভাবে বাঁচবে !”
বলে আবারও পরিণীতার কপালে চুমু খেল।
কিছু না বলেই যেন ওরা দুজন অনেক কিছু অনুভব করে নিল!
পরিণীতা শক্ত করে আবিদের বুকে মাথা রাখল।
আবিদের গা থেকে ছুটে আসছে পরিচিত পুরুষালি সুঘ্রাণ, যা সে নিশ্বাসের সাথে ভেতরে টেনে নিচ্ছে।
তার প্রচুর সুখ-সুখ অনুভূতি হচ্ছে!

এই মানুষটার আশেপাশে থাকার জন্য তার কত বাহানা!
তার স্পর্শ, তার গায়ের গন্ধ ছাড়া পরিণীতা বেশি সময় থাকতে পারে?
এই শ্যামবর্ণের পুরুষে সে বড়ই আসক্ত!
লোকে বলে, শ্যামবর্ণের মানুষ নাকি সুন্দর হয় না!
অথচ পরিণীতা এই মানুষটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতেই পারে না!
লম্বা, পুরুষালি দেহের গঠন, ওই তামাটে মুখের আদলে কত মায়া!
যা চুম্বকের মতো পরিণীতাকে আকর্ষণ করে প্রতিনিয়ত!
আবিদ তার প্রাণের থেকেও প্রিয় অ্যাঞ্জেলকে বুকে নিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।
একজন পুরুষের কাছে এর থেকে বেশি সুখের আর কী হতে পারে?
সে তার ভালোবাসার মানুষকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছে!
এত সুখের পর যদি মৃত্যু আসে, ওর আক্ষেপ থাকবে না!
সে জানে, আজ না হোক, কাল মৃত্যু তো আসবেই!

তেলে-জলে যে মিশ খায় না, সেটা আবিদ খুব ভালো করেই জানে!
আর শিকদাররা কেমন, সেটাও সে ভালো করেই জানে!
সব জানার পরও এই মেয়েটার ভালোবাসায় সে নিজেকে হারিয়েছে!
মাশুল যে তাকে দিতেই হবে!
কিন্তু সে ভেবে নিয়েছে—
“যাই মাশুল দিতে হোক না কেন, নিশ্বাস বন্ধ হওয়া আগ পর্যন্ত সে তার পরিণীতার হাত শক্ত করে ধরে রাখবে!”
“তাদের পরিণয় হবে কিনা, সেটা তার জানা নেই! কিন্তু সে এই মেয়েটার জন্য এতটাই উন্মাদ যে— মৃত্যু আসলে আসবে! তবুও পরিণীতা ছাড়া থাকতে পারবে না!”
এসব ভেবেই সে পরিণীতার চুলের খোপায় মুখ গুঁজল।
প্রাণভরে প্রিয় ঘ্রাণটা ফুসফুসে টেনে নিয়ে আদুরে সুরে বলল,

— “অ্যাঞ্জেল?”
পরিণীতা বুকে মুখ গুঁজেই বলল,
— “হুঁ?”
আবিদ বলল,
— “জিজ্ঞেস করলে না কেন এত ফোন দিয়েছিলাম?”
পরিণীতা উৎসাহী কণ্ঠে বলল,
— “কেন?”
আবিদ মনে মনে বলল,
— ‘গাধা!’
কিন্তু মুখে বলল,
— “আমি চাকরি পেয়েছি!”
পরিণীতা খুশিতে লাফিয়ে বলল,
— “সত্যি? কবে?”
আবিদ বলল,

— “দুই দিন পর জয়েনিং!”
পরিণীতা বলল,
— “তাহলে এই আনন্দে আমাকে কোলে নাও!”
বলে হাত দুটো বাড়িয়ে দিল।
আবিদ ভ্রু নাচিয়ে বলল,
— “কোলে নেব?”
পরিণীতা কোনো জবাব না দিয়েই নিজেই গলায় ঝুলে পড়ল!
আবিদ তাকে কোলে নিয়ে কয়েক চক্কর দিল।
নামিয়ে দিতে নিলেই পরিণীতা চিৎকার করে বলল,
— “একদম নামাবে না!”
আবিদ দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বলল,

— “তুমি যা ওজন! আমার হাত এখনই খুলে পড়ে যাবে!”
পরিণীতা রেগে গিয়ে আবিদের গলার কাছের টি-শার্ট সরিয়ে জোরে একটা কামড় বসাল!
আবিদ ঠোঁট কামড়ে ব্যথা হজম করে নিল।
আরও কিছুক্ষণ পরিণীতাকে কোলে রাখার পর হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই নামিয়ে দিল।
পরিণীতা মুখ কুঁচকাল।
আবিদ পকেট থেকে কাগজে মোড়ানো কিছু একটা বের করল।
পরিণীতা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
— “এটা কী, মাস্টারমশাই?”
আবিদ হাসল, জিনিসটা পরিণীতার হাতে দিল।
পরিণীতা দেখল, এক ডজন লাল রঙের কাচের চুড়ি!
সে খুশিতে লাফিয়ে উঠল!

আবিদ দেখল, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো মেয়েটা পঞ্চাশ টাকার অতি সাধারণ জিনিসেও কতটা খুশি!
এই জন্যই তো সে এই মেয়েটাকে ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছিল!
আর এখন তো প্রেমে পাগল হয়ে গেছে!
পরিণীতা আবিদের পায়ের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়াল।
কষ্ট করে আবিদের চুলগুলো টেনে মুখটা নিচে নামিয়ে কষে একটা চুমু খেল!
আবিদ মুচকি হাসল।
পরিণীতা লজ্জায় লাল হয়ে চুড়িগুলো আবিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল—

— “আনরোমান্টিক বেডা মানুষ! পরিয়ে দাও!”
বলে নিজের হাতটা এগিয়ে দিল।
আবিদ মুগ্ধ হলো।
নিজের হাতে এক এক করে যত্ন নিয়ে চুড়িগুলো প্রিয়তমার হাতে পরিয়ে দিল।
তারপর দু’হাতের তালুতে গভীর চুমু খেল।
পরিণীতা আরও লজ্জায় লাল হলো।
আবিদ বলল,
— “বাড়ি যাবে না? অনেকক্ষণ হলো!”
পরিণীতা আতকে উঠল!
সে বাড়ির কথা ভুলেই গিয়েছিল!
এখন যদি কেউ খুঁজতে আসে, তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে!
আবিদ ফোন বের করে সময় দেখল— রাত আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি!
পরিণীতা বলল,

— “আমাকে বাড়ি যেতে হবে!”
আবিদ ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
— “একটু আগেই না কোলে চড়তে চেয়েছিলে? চলো, তোমাকে কোলে করেই নিয়ে যাই!”
পরিণীতা আবার ও বাড়ির কথা ভুলে গেল!
লজ্জায় রাঙা মুখটা প্রিয় পুরুষের বুকে লুকাল।
আবিদ পরিণীতাকে আগের মতো পেছনের পাঁচিলে তুলে দিল। তারপর বলল,
— “সাবধানে! যদি একটুও ব্যথা পাও, হাড্ডি গুঁড়া করে ফেলব!”
পরিণীতা আবার আবিদের দুই গালে কষে দুটো চুমু খেয়ে লাফ দিল।
আবিদ তৃপ্তির হাসি হাসল।
পরিণীতা চোরের মতো বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে সদর দরজায় সাদাফের সাথে ধাড়াম করে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিল।
সাদাফ হাত ধরে টেনে তুলল, তারপর বলল,

— “সামলে, ফুলপরী!”
পরিণীতা আতকে উঠল।
সাদাফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সাদাফ বলল,
— “কোথায় গিয়েছিলে?”
পরিণীতার গলা শুকিয়ে গেল।
ভয়ে মেয়েটার বুক ধুকধুক করছিল।
কোনো রকমে বলল,
— “ঘরে গরম, তাই বাইরে বাতাস খেতে গিয়েছিলাম।”
সাদাফ ভ্রু কুঁচকাল।
— “সে হতবাক কন্ঠে বলল সব জায়গাতেই তো এসি লাগানো! গরম কোথায়?”
পরিণীতা বিরক্ত হয়ে বলল,
— “এইসব কৃত্রিম বাতাস আর ভালো লাগে না, ফ্রেশ এয়ার খেতে গিয়েছিলাম!”
সাদাফ বলল,
— “তাহলে আমাকে বলতে? দু’জন মিলে যেতাম!”
পরিণীতা বলল,

— “আমার প্রচুর মাথাব্যথা করছে।”
এটা বলে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কেটে পড়ল।
সাদাফ সন্দেহজনক চোখে তাকিয়ে রইল।
মনে মনে বলল—
“কিছু তো নিশ্চয়ই হয়েছে…! বোকা মেয়েটা গুছিয়ে মিথ্যাও বলতে পারে না! ও যে এতক্ষণ মিথ্যা কথা বলছিল, সেটা ওর চোখই বলে দিচ্ছিল! কী খিচুড়ি পাকাচ্ছে, কে জানে… নজরে রাখতে হবে!”
বলে চলে গেল।
রাত ৯টা।

হাসপাতাল থেকে ইমারজেন্সি কল আসায় শুদ্ধকে দুপুর ২টার দিকে বিয়ে বাড়ি থেকে চলে আসতে হয়েছিল। একজন রোগীর অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক, ইমিডিয়েট সার্জারি করাতে হবে, তাই সে আসার আগেই ওটি রেডি রাখতে বলেছিল। এসেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পড়ে।
টানা ৬ ঘণ্টা অপারেশন শেষে ওটি থেকে বের হলো শুদ্ধ।
সে কানাডার শীর্ষস্থানীয় হার্ট সার্জনদের একজন। তাই বাংলাদেশে তার চাহিদা তুঙ্গে। তবে সে সব রোগীর অপারেশন করে না—শুধুমাত্র যাদের অবস্থা একেবারে সংকটজনক, কেবল তাদের অপারেশনই করে।
সে ওটি থেকে বেরিয়েই পেশেন্ট পার্টির উদ্দেশে বলল, “Now he is out of danger.”
রোগীর বাড়ির লোকজন শ্রদ্ধার চোখে তাকিয়ে ছিল তার দিকে।

তুহিনা তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ডক্টর আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধর দশজন স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্টের মধ্যে সে একজন। তুহিনা সব সময় শুদ্ধর সঙ্গে লেগে থাকে। তার এই গায়ে পড়া স্বভাবে শুদ্ধ যে কতটা বিরক্ত, তা তো আপনারা জানেনই! তবে হাসপাতালের লেডি ডাক্তার ও নার্সরা তাদের ক্রাশের সঙ্গে তুহিনার এমন চেপে থাকা মোটেও পছন্দ করে না। তারা প্রচণ্ড জেলাস।
তাদের স্বস্তির বিষয় একটাই—ডক্টর চৌধুরী মেয়েটাকে মোটেও পাত্তা দেয় না! ফলে তারাও তুহিনাকে ভালো চোখে দেখে না। তবে এতে তুহিনার বিশেষ কিছু যায় আসে না, কারণ সে তো ডাক্তার হয়েছেই শুদ্ধর আশেপাশে থাকার জন্য!

রাত ৮:৩০-এর দিকে শুদ্ধ ক্লান্ত হয়ে নিজের কেবিনে গেল। এপ্রোনটা খুলে পাশে রেখে মাথা নিচু করে বসেছিল। ক্লান্তিতে সারা শরীর জড়িয়ে আসছে। এক কাপ স্ট্রং ব্ল্যাক কফির অর্ডার করল।
এর মধ্যেই কী যেন মনে পড়তেই তার ফর্সা মুখ ক্ষোভে লাল হয়ে গেল! ক্রোধ ছড়িয়ে পড়ছে শিরা-উপশিরায়।
টেবিলে বাড়ি মেরে বলল,
“তুই আমার গলায় কাটার মতো আটকে আছিস, প্রণয়! আমি না পারছি তোকে তুলে ফেলতে, আর না পারছি আমার সুইটহার্ট থেকে সরাতে! উফফ! ব্রেনের এত চাপ আর নিতে পারছি না!”
এমন সময় ঝড়ের গতিতে কেউ কেবিনে প্রবেশ করল।
শুদ্ধ কিছু বোঝার আগেই কলার ধরে নাক বরাবর ঘুষি মারল! শুদ্ধ সামলাতে না পেরে ছিটকে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ল।

প্রণয় পুনরায় তার কলার ঝাঁকিয়ে কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে বলল,
“তোর সাহস কেমন করে হয় আমার রক্তজবার গায়ে স্পর্শ করার? বিশ্বাস কর, আমার হাত-পা বাঁধা না থাকলে তোকে এক্ষুনি খুন করে ফেলতাম!”
ক্রোধে প্রণয়ের কপালের সবুজ শিরা ফুলে উঠেছে।
শুদ্ধরও রাগ চড়ে গেল! সেও প্রণয়ের নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল—
“কেন? তোর ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছে হয়, আমার হয় না বুঝি? তোর রাতবিরেতে ঘরে সুন্দরী বউ রেখে অন্য নারীর তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যায়, আর আমি তো বেচারা—আমার তো ঘরে বউও নেই!”
প্রণয় শুদ্ধর বুক বরাবর লাথি মেরে বলল,
“তোর জন্য আমাদের জীবনটা নরক হয়ে গেছে! তোর জন্য আমাকে আমার রক্তজবার থেকে দূরে যেতে হয়েছে! তুই আমার লাইফ হেল করে দিয়েছিস!”
শুদ্ধ পাগলের মতো হেসে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,

**”জীবন কই নষ্ট করলাম? ছোট্ট একটা প্রতিশোধ নিয়েছি! তুই আমাকে আমার সুইটহার্টের থেকে আলাদা করেছিলি, কত বছর আমি তোড়পেঁচি শুধুমাত্র একবার আমার সুইটহার্টকে দেখার জন্য! কিন্তু তুই দেখতে দিসনি। তাই আমি তোকে তোর রক্তজবা থেকে পার্মানেন্টলি আলাদা করে দিলাম! সিম্পল লজিক!
তুই বেঁচে থাকবি ঠিকই, কিন্তু তোর বুকে যে আগুন জ্বালিয়েছি, এজন্য তুই মরতেও পারবি না, বাঁচতেও পারবি না! খুব জ্বলছে, না? ছুঁইছি বলে?
আমারও এতটাই জ্বলে, যখন তুই আমার সুইটহার্টকে টাচ করিস!”**
শুদ্ধ আবারও ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, “সালা! তুই আমার চিরশত্রু! তারপরও দেখ, তোর আর আমার দুর্বলতা এক জায়গায়! এর থেকে দুঃখের আর কী হতে পারে?”
প্রণয়ও একই ভঙ্গিতে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,
**”আগেও তোকে আলাদা করেছি, ভবিষ্যতেও করব! বিকজ সে শুধুই আমার! শুধুমাত্র এই আবরার শিকদার প্রণয়ের!

সে আমার কাছে আছে কি দূরে আছে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি তাকে বিয়ে করতে পারলাম কি পারলাম না, তাতেও কিছু যায় আসে না। তবে সে তার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত শুধুমাত্র আমারই থাকবে!
প্রণয় শিকদার তার জিনিসে অন্যের অধিকার বরদাশত করে না!”**
দুজনকেই দেখতে সাইকোপ্যাথ লাগছে—হিংস্র তাদের চোখ, মুখ ও ব্যবহার!
প্রণয় রিভলভার বের করে শুদ্ধর কপালে তাক করল।
শুদ্ধ পাগলের মতো হেসে বলল, “আমি মরে গেলে তোর প্রাণভোমরা চিরতরে হারিয়ে যাবে!”
“ভুলে যাস কেন? তোর প্রাণভোমরার সিন্দুকের চাবি আমার হাতে!”
প্রণয় এগিয়ে গিয়ে শুদ্ধর বাঁ হাতে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, “ভুলে যাস না, ওটা আমার একার প্রাণভোমরা নয়!”
শুদ্ধের হাত বেয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।
শুদ্ধ হাসল। ডান হাতে নিজের ড্রয়ার থেকে রিভলভার বের করে প্রণয়ের ডান হাতে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দিয়ে একই ভঙ্গিতে বলল,

“ভুলে যাইনি! তবে প্রাণভোমরা যদি আমার না হয়, তবে তাকে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ?”
প্রণয়ের হাত থেকেও ঝরঝর করে রক্ত বেরোচ্ছে।
শুদ্ধ আবার হেসে বলল,
“তুই আমাকে মেরে ফেলতে পারবি না! কিন্তু আমি চাইলেই তোকে মেরে ফেলতে পারি! উহু! হাতে মারব না! জানিস তো কীভাবে মারব?”
প্রণয় বাঁকা হেসে বলল,
**”যেমন আছিস, তেমনই থাক! বেশি লোভ করিস না, নাহলে তুই মারার আগে আমি মেরে ফেলব!
সে আমার না হয়ে দূরে থাকুক, ভালো থাকুক, কিন্তু অন্যের হওয়ার চেষ্টা করলে আমি নিজেই তাকে শেষ করে দেব!
প্রণয় শিকদার তার জিনিসে অন্যের অধিকার বরদাশত করে না!
তুই আমার দুর্বলতার খোঁজ পেয়ে গেছিস, তার মানে এটা নয় যে আমি দুর্বল!”**
শুদ্ধ কিছুটা দমে গেল, কিন্তু দমল না তার রাগ!

দুজন আবারও একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল!
শরীরের এখানে-ওখানে ছিঁড়ে গেছে, থেঁতলে গেছে।
দুজনের হাত থেকেই গড়িয়ে পড়া রক্তে পুরো কেবিন পিচ্ছিল হয়ে গেছে।
দুজনের হাতেই দুটি গুলি ঢুকে রয়েছে!
যন্ত্রণার তীব্রতায় ছিঁড়ে যাচ্ছে শরীর!
তবুও, দুই বলিষ্ঠ পুরুষ—নিজেদের মধ্যে রক্তের খেলায় মেতে উঠেছে!
মাত্র ১৬-তে পা দেওয়া এক কিশোরী কন্যার জন্য, যে তাদের দুজনের তুলনায় ছোট্ট এক মুরগির ছানা,
শত শত লোকের জান নিয়ে নিতে একবারও ভাববে না দুজন!

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৯

দুজনেই ক্লান্ত হয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ল।
কী হবে এই দুই পুরুষের?
প্রণয়ের ভবিষ্যৎ?
কে ভালোবাসা পাবে, আর কে ভালোবাসা হারাবে?
তা তো সময়ই বলে দেবে!

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১১