তাজমহল পর্ব ৯
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
শাইনা কিছু বুঝে উঠার আগেই তাজদার তাকে ভিড়ের মধ্যে থেকে টেনে নিয়ে গেল জুয়েলারির দোকানে।
শাইনা শুধু পুরুষালি হাতের মধ্যে জিম্মি হওয়া তার হাতদুটোর দিকে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ।
তাজদার সিদ্দিকীর ঘৃণা হচ্ছে না তার হাত ধরতে?
দোকানে প্রবেশ করার পর কৌশলে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল শাইনা।
জুয়েলারি কেনার সময় তাজদার সিদ্দিকী শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। শাইনা মিনিমাল কিন্তু প্রিমিয়াম ডিজাইনগুলি চুজ করেছে। দামটাও চড়া। বাপ ভাইয়ের টাকায় কিনতে হলে সে এত দামী জুয়েলারি কখনোই কিনতো না।
কিন্তু আজ সে দাম কত হবে সেটা ভাবেনি। এখন সে যদি দামের কথা চিন্তা করে সবচেয়ে সুন্দর জুয়েলারিটা না নেয় তাহলে পরে দেখা যাবে রটে যাবে বউয়ের পছন্দ ভালো না।
তাসনুভা সবার আগে বলবে তারা ক্লাসি নয় বলে সে ফালতু জুয়েলারি চুজ করেছে।
মানুষ সবসময় নিজের জন্য ভালো জিনিসটা কিনতে চায়। কিন্তু টাকার কথা চিন্তা করে কিনতে পারেনা। তেমন শাইনা সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটা চেনে। বাপ ভাইয়ের উপর জুলুম হবে ভেবে কখনো সে কারো উপর নিজের পছন্দ চাপিয়ে দেয়নি। তাকে যা কিনে দেয়া হয়েছে সে তা পরেছে। যা খেতে দিয়েছে সে তা খেয়েছে। যা বলা হয়েছে তা করেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অবশ্য তার পরিবার তার সাথে জুলুম করেছে। তাদের মনের মতো চলতে গিয়ে, ভালো মেয়েটা হতে গিয়ে সে নিজের ক্ষতিটাই বেশি করে বসেছে।
সেইসব মনে পড়তেই আবারও তার মন খারাপ হচ্ছে। সে ঠিক করেছে তাজদার সিদ্দিকীর সামনে সে জীবনেও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করবেনা।
শাড়ি, লেহেঙ্গার জন্য জুয়েলারি কেনা শেষে সে গায়ে হলদুের অনুষ্ঠানে পরার জন্যও জুয়েলারি কিনে নিল সে। তাজদার সিদ্দিকী পেছনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে সব। শাইনা মাঝেমধ্যে নিজেকে সামলে নিচ্ছিল। কারণ তার মনে হচ্ছে সে বেশি কথা বলে ফেলছে।
জুয়েলারি কেনা শেষ হতেই তাজদার বিল মিটিয়ে পকেট ফোন ভরে নিতে নিতে শাইনার দিকে তাকালো। শাইনা শপিং ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছে। শাড়ির ব্যাগগুলো ওই দোকানেই রাখা। আবার সেখানে যেতে হবে।
তাজদার কিছু ব্যাগ নিতে চাইলে শাইনা ব্যাগগুলো নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেল তাজদার।
মেকআপ কেনার কথা শাইনা ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু তাজদার তাকে মনে করিয়ে দিল।
সে কসমেটিকস শপের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সোজা। ইনিয়েবিনিয়ে শাইনাকে বোঝালো এটা কসমেটিকস শপ।
শাইনা তাড়াহুড়ো করছিল বাড়ি ফেরার জন্য। তাজদারকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে, সে মেয়ে হয়ে মেকআপের কথা ভুলে গেছে দেখে খানিকটা লজ্জিতও হলো। এজন্যই কয়েকজনকে সাথে করে নিয়ে আসতে হয়। একা আর পারছেনা সে।
কসমেটিকসের দোকানে ঢুকে সে একটা চেয়ারে বসলো আগে। ঠান্ডা পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিল। খুব ক্লান্ত লাগছে।
তাজদার সিদ্দিকী সেখানে কর্মরত মানুষদের সাথে কি কথাবার্তা বলছে কে জানে? শাইনা ইচ্ছে করে খেয়াল করেনি। কানে এসেছে কথাগুলো। মনোযোগ দিয়ে শোনেনি সে।
পরে অবশ্য তার কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হলো। সেখানে কর্মরত সেলস পার্সন তাকে একটা কম্বো দিয়ে দিল। তাজদারকে দেখিয়ে বলল,
“আপনি যেমনটা বলেছেন তেমনটা এখানে আছে। সব অথেনটিক মেকআপ প্রডাক্টস এন্ড স্কিন কেয়ার প্রডাক্টস একসাথে।”
শাইনার পরিশ্রম কমে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই দুটো কম্বোর দাম শুনে তার মাথায় হাত।
এসব কিনে নিলে বাড়ি পৌঁছে তার ইজ্জত সম্মান আর থাকবে না। ওই বাড়ির মানুষ বলবে কোনোদিন দেখেনি তাই আজ যা পেল সব একসাথে নিয়ে ফেলেছে। একটা ভয় ঝেঁকে ধরলো তাকে। সে অন্য সবকিছু সহ্য করতে পারলেও মানুষের কটু কথা একদম নিতে পারেনা। সে যা নয় তা বললে তার সারাদিন অশান্তি লাগে।
সে বলল,”আমি সবগুলো ব্র্যান্ড থেকে বেছেবেছে নিতে চাই। L’Oréal Paris এর সব প্রডাক্টস আমার লাগবেনা।”
দোকানে বিউটি অ্যাডভাইজার ছিলেন। তিনি বললেন,”স্যার প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের প্রডাক্টস চেয়েছেন ম্যাম। আমরা L’Oréal Paris এর প্রডাক্টস সাজেস্ট করছি। আর কসমেটিকসের ক্ষেত্রে ম্যাক। এগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্র্যান্ড। L’Oréal Paris রূপচর্চার নির্ভরযোগ্য নাম। স্টাইল আইকনদের প্রথম পছন্দ। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।”
শাইনা আর কিছু বলবে তার আগেই তাজদার বলল,”আপনারা প্যাকেজিং শুরু করুন। একটু তাড়াতাড়ি।”
“জি স্যার। আমাদের কিছুক্ষণ সময় দিয়ে সাহায্য করুন।”
শাইনার মন কেমন কু গাইছে। টাকার অংকগুলো এত দ্রুত কষছে যে তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। এটা তো সত্যি যে সে ধনী পরিবারে বড় হয়নি।
ভাইদের পয়সা হওয়ার পরও আহামরি বিলাসিতা সে করেনি।
সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে পরের পয়সা নিয়ে বাহাদুরি করতে তার অনেক ভয়।
মেকআপ আর স্কিন কেয়ার প্রডাক্টসের প্যাকেজিং কমপ্লিট। কার্টনে প্যাক করে দিয়েছে। কার্টনটা এত বড় হয়েছে যে সবার চোখে লাগবেই।
শাইনার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। শান্তি লাগছেনা। পরে সে নিজেকে সান্ত্বনা দিল এই বলে তাজদার সিদ্দিকী নিজেই তো সব কিনছে। সে তো জোর করে কিনেনি।
বিল মিটিয়ে তাজদার সবগুলো কার্টন নিয়ে বেরিয়ে এল। শাড়ির দোকানে সবগুলো ব্যাগ রেখে বেরিয়ে গেল। শাইনা শাড়ির দোকানে দাঁড়িয়ে রইলো।
সবগুলো ব্যাগ কার্টন দেখে সে মনে মনে হিসেব কষছে কত টাকার জিনিস কিনেছে সে। কত লাখ কষেছে এখানে? শাড়ি আর লেহেঙ্গাই তো লাখ ছুঁয়েছে।
কিছুক্ষণ পর একটা লোক এল। তিনিও সাথে করে ব্যাগ, কার্টন সব নিয়ে বেরিয়ে গেল তাজদারের আগে আগে। তাজদার শাইনার দিকে তাকালো একপলক। তারপর দোকানদারদের সাথে হাত মিলিয়ে বলল,”তবে আসি।”
“আবার আসবেন। বিয়েতে আমরা থাকছি।”
“অবশ্যই।”
বলেই তাজদার বেরিয়ে এল বাকি ব্যাগগুলো নিয়ে। শাইনাও তার পিছু পিছু বের হলো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখলো ছোট ভাইয়া ফোন দিচ্ছে। সে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে তাজদারের পেছন পেছন গেল। শাওন তাকে সবটা খুলে বললো। বাড়িতে অনেক ঝুটঝামেলা হয়ে গেছে। আনিস তাসনুভাকে বেয়াদব বলায় শাইনার শ্বশুর খেপে গিয়েছে আনিসের উপর।
আনিস বলেছে আকদ ভেঙে দিতে।
এখন আবার আকদ ভাঙার কথা শুনে উল্টো ওরা খেপে উঠেছে।
যদিও পরিস্থিতি এখন ঠান্ডা হয়েছে। কারণ বড় আম্মা এসে আনিসের সাথে কথাবার্তা বলেছে। তাজদার আসার আগে পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে চাইছেন তিনি। ভাইয়ের কথা চুপচাপ শুনলো শাইনা। ভাইয়া আরও কিছু বলতো। শাইনার ইচ্ছে নেই দেখে কিছু বলেনি।
কথা বলা শেষ হয়েছে। বাইরে বেরিয়ে এল তারা। বাইরে এসে দম নিল শাইনা। বাড়ি গিয়ে কবে সে বিছানায় শুয়ে পড়বে। শরীর আর কূলোচ্ছেনা।
ওই লোকটা ড্রাইভার ছিল। সব ব্যাগগুলো গাড়িতে তোলা শেষে শাইনার দিকে তাকিয়ে বলল,”গাড়িতে উঠে বসুন। স্যার বোধহয় কাছে কোথাও গিয়েছেন।”
শাইনা গাড়িতে উঠে বসলো। সিটে বসে মাথা এলিয়ে চোখ বুঁজলো। হঠাৎ কেউ একজন নিজের উপস্থিতি জানানোর জন্য গলা ঝাড়লো। শাইনা চট করে চোখ মেললো। তার সামনে আইসক্রিম বাড়িয়ে দিল তাজদার। পোলার কার্নিভাল আইসক্রিম। মুচমুচে কোনের ভিতরে ভ্যানিলা আইসক্রীমের সাথে চকোলেট টপিং আর বাদাম। শাইনা অপ্রস্তুত হয়ে আইসক্রিমটা নিল।
তাজদার ডাকলো,
“ড্রাইভার সাহেব।”
ড্রাইভার হেসে তাকালো তার দিকে। বাড়িয়ে দেয়া আইসক্রিমটা নিল হাত থেকে। শাইনা আইসক্রিম খাওয়া শুরু করেছিল একটু আরাম করে। ঠিক তখুনি ঘটলো বিপত্তি। সে তার পাশের সিটে দুটো শপিং রেখে দিয়েছিল। সেগুলো সরিয়ে তাজদার সিদ্দিকী তার পাশ ঘেঁষে বসে পড়লো। পাশ ঘেঁষে না যদিও। কিন্তু পাশাপাশি বসাটাও এখন শাইনার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। তার ইচ্ছে করলো আইসক্রিমটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে। তার আইসক্রিম খাওয়ার বারোটা বাজিয়ে দিল।
শাইনা একটু সরে বসে আইসক্রিমটা খেল জানালার বাইরে তাকিয়ে। তাজদার সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে রেখেছে। শাইনা আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে আঁড়চোখে একবার তাকালো নড়াচড়া টের না পেয়ে। কপাল কুঁচকে গেল তার। সাথে সাথে তাজদার সেভাবে মাথা এলিয়ে রাখা অবস্থায় তাকালো চোখ মেলে। শাইনা ভড়কে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল।
কতশত ভাবনা উদয় হলো মনে। একসময় সে আর আপারা এই লোকটার পায়ের আওয়াজ শুনলে পর্যন্ত লুকিয়ে পড়তো ভয়ে। ছেলেটা যেদিকে হাঁটতো তারা সেদিকেও পাও মাড়াতো না। পুকুরঘাটে বসে আছে দেখলে তারা একটা বালতি পানি আনার জন্যও নামতো না। কলপাড়ে যেত না।
সারাক্ষণ তারা আতঙ্কে থাকতো ছেলেটা কখন কি বলে বসে, কখন না জানি অপমান করে বসে। ছোটবেলায় তো আর এত বুঝ ছিল না। টিভি দেখতে সে আল্লাহকে ডাকতো যাতে ওই ছেলেটা না আসে সিনেমা শেষ হওয়ার আগে। তাজদার সিদ্দিকীও তখন ধুরন্ধর চালাক ছিল। এমনভাবে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়তো যে তারা আগেভাগে বুঝতেও পারতো না। তাদের দেখামাত্রই চেহারাটা এত ভয়ংকর হয়ে উঠতো তা মনে পড়লে শাইনার দমবন্ধ হয়ে আসে।
তাদের দেখলে ঠাস করে টিভি বন্ধ করে দিত তাজদার সিদ্দিকী। তারপর ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালে শাইনার মনে হতো এই গোটা পৃথিবীতে এমন জঘন্য, ভয়ংকর মানুষ আর নেই। মাথা নিচু করে সে বেরিয়ে যেত তখন। বেরোতে একটু দেরী হলে মাথা ঠেলে বের করে দিয়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিত। অবশ্য তার মা থাকলে এমন করতো না। তখন শুধু ঘাড় বাঁকাতো। আর চোখ রাঙিয়ে ইশারা করতো বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। এত বিশ্রীভাবে অপমান! এরচেয়ে তো মৃত্যুও ভালো।
আল্লাহ ওইরকম একটা লোকের সাথে কেন তার ভাগ্য জুড়ে দিল? সে এই প্রশ্নের উত্তর পেল না হাজার খুঁজেও। কোনো উত্তর নেই তার কাছে।
বাড়ির উঠোনে গাড়ি এসে থামলো। শাইনা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সোজা তাদের ঘরে চলে এল। গাড়ি থেকে ব্যাগ, কার্টন নামিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে তৌসিফ, তাশফিন। এত বড় বড় ব্যাগ, কার্টন সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। কিন্তু চারপাশ এত নীরব দেখে শাইনা বুঝে গেল অনেক ঝড় গেছে তার আসার আগে।
রওশনআরার কানে এল মেঝ ননদের কথা।
“আমার ভাইপোকে তো মনে হয় ঝাঁজরা করে দিয়েছে ওই মেয়ে। কত লাখ খেয়েছে কে জানে?”
রওশনআরা কিছু না বলে সরে পড়লেন। তাজদার আসায় বাড়ির সবাই আরও চুপ হয়ে গেছে। রওশনআরা তাসনুভাকে ঘরে বসে থাকতে বলেছেন। বাড়ি ফেরার সাথে সাথে কেউ যেন কোনো বাড়তি কথা না তোলে।
তাসনুভাকে তিনি ইচ্ছেমতো বকেছেন। আকদ ভাঙার কথা পর্যন্ত উঠে গেছে তার কারণে। তাজদারের কানে এসব গেলে কি হবে?
বউয়ের জিনিসপত্র সব রওশনআরা নিজের ঘরে এনে রেখেছেন। সবাই শাড়ি লেহেঙ্গা জুয়েলারি দেখা শুরু করেছে।
তাজদার নিজের ঘরে চলে গিয়েছে। যাওয়ার সময় তাসনুভাকে দেখলো। তাসনুভা ভাইকে দেখামাত্রই মাথা নামিয়ে নিল। রওশনআরা তাজদারের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। তাসনুভার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন তিনি। তাকে এখনি ঘর থেকে বের হতে হলো?
তাজদার ঘরে যেতে যেতে বলল,”জিনিসগুলো গুছিয়ে ওই বাড়িতে দিয়ে এসো।”
তাসনুভা মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের ইশারা বুঝে বলল,”আচ্ছা।”
বউয়ের জিনিসপত্র বাড়ির সবাই মিলে দেখছে। বড় ফুপু বলল,”এত দামী শাড়ি দিয়েছে সেখানে আবার লেহেঙ্গার কি দরকার ছিল? ওয়ালিমায় সেকেন্ড শাড়িটা পরলেই তো হয়ে যেত। ওর দুই বোনকে তো শ্বশুরবাড়ি থেকে দশ হাজার টাকার শাড়ি দিতেও বাঁধছে। মেঝটাকে তো বাপে এককাপড়ে বিয়ে দিয়েছিল।”
একেকজন একেক কথা বলতে লাগলো। সবাই মিলে আনুমানিক ভাবে হিসেব মিলিয়ে দেখলো তিন লাখ টাকার উপরে বাজার হয়ে গিয়েছে। তার কম বেশি হতে পারে। শাড়িটা আর লেহেঙ্গা লাখ পার করেছে।
যারা সরাসরি বলছেনা তারাও গাইগুই করে বলছে বাজার অনেক বেশি হয়েছে। এত দামী জিনিস খুব জরুরি ছিল না।
বিশেষ করে তাসনীম যে সবসময় মুখ গোমড়া করে রাখে সেও হেসে ফেলে উপহাস করে বলল,
“বাড়ির সব মেয়েদের মধ্যে তো শাইনা জিতে বসে আছে। আমরা বিয়ের বাজারে নাকও গলাতে পারিনি।”
মেঝ ফুপু বলল,”মেকআপ তো মনে সব তুলে আনছে। ও নুভা দেখ তো। এগুলোতে কত টাকা আসবে?”
তাসনুভা ঘরের এককোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল। সব এক্সক্লুসিভ জিনিস নিয়েছে। দামও তেমন। সে নড়লো না। বলল,
“স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টসগুলো একটা তিন হাজার টাকার উপরে। এবার সবগুলো কত আসে হিসেব করো।”
রওশনআরা বলল,”সব তোমার পছন্দমতো হয়েছে কিনা বলো।”
তাসনুভা এবার সাহস পেয়ে শাড়ি, লেহেঙ্গা, আর গায়ে হলুদের শাড়িটা, দোপাট্টা সবগুলো দেখল। জুয়েলারি মিলিয়ে দেখলো। সব দেখা শেষে বলল,
“মোটামুটি।”
রওশনআরা বলল,”এতেই যথেষ্ট। এতকিছু দেয়ার দরকার ছিল না। তবুও তাজদার যখন নিজে দাঁড়িয়ে কিনেছে তখন তো আর কিছু বলার নেই। এখন এসব নিয়ে কথা না বলায় ভালো। তিতলি সব গুছিয়ে নাও। একটা জিনিসও যাতে নড়চড় না হয়। ওদের বাড়িতে পাঠানোর আগে তোমার মেঝ ভাইয়াকে একবার দেখিয়ে নেবে।”
তিতলি বলল,”আচ্ছা। শাড়ি লেহেঙ্গাগুলো এত জোশ হয়েছে। শাইনার পছন্দ সুন্দর।”
তাসনুভা তাকে সংশোধন করে দিয়ে বলল,”শাইনা নয় ভাইয়ার পছন্দ।”
তিতলি বলল,”তুমি সবসময় ভেজাইল্যা কথা বলো।”
তিতলি, তাসনুভা আর তৌসিফ নিয়ে এসেছে বিয়ের সব জিনিসপত্র। তাজদারকে দেখিয়েছে আনার সময়। সব ঠিকঠাক আছে দেখে তাজদার অনুমতি দিল। তাসনুভা এসেছে দেখে সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো কিছু একটা। শাহিদা বেগম বললেন, কি এক ঝামেলা পাকিয়ে দিল মেয়েটা। এত ডেয়ারিং মেয়ে।
তাসনুভা দাঁড়ায়নি। ব্যাগগুলো রেখে সোজা বেরিয়ে গিয়েছে। ভাইয়া বলেছে তাই আসতে হয়েছে। নইলে এই বাড়িতে পা রাখারও ইচ্ছে নেই তার।
তিতলি আর তৌসিফ চা খেতে খেতে
শাইনাকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে চলে এল। শাইনার ঘরে এসে ভীড় জমালো তার চাচী, চাচাতো বোন, আপা, ভাবি সবাই। বড় আপা সব খুলে খুলে দেখালো সবাইকে।
শাইনা ঘরের এককোণায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। শাহিদা বেগম অবাক চোখে শাইনার দিকে তাকালেন। বললেন,
“তুই এসব কি করলি? এত দামী দামী জিনিস কিনে নিলি? ওরা তো এখন যা তা বলবে। হাভাতে ঘরের মেয়ে বলবে।”
শাইনা মায়ের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
“তুমি কি বলতে চাইছো? আমি সস্তা?”
“দেখো মেয়ে কি বলে। এত দামী বিয়ের শাড়ি, লেহেঙ্গা কিনলি। ওরা আবার তোকে চার ভরি স্বর্ণও দিচ্ছে।”
“একবারই তো দিচ্ছে। সারাজীবনের জন্য চাকরাণি নিয়ে যাচ্ছে। একবার সব ঢেলে দিলে মন্দ কি? সারাজীবন আমাকে খোঁটার তলে রাখতে পারবে। ওদেরই লাভ।”
সবাই তার দিকে চেয়ে রইলো। দাদীমা বলল,
“আরেহ ওদের স্বর্ণ আগে থেকে ছিল। ওখান থেকে দেবে রায়হানের মা। কোটি টাকা আছে ওদের। দশ লাখ খরচ করে বিয়ে করলে ওদের সম্পত্তির এককোণও নড়বে না। মেয়েটার সামনে ফালতু কথা বইলো না।”
শাহিদা বেগম চুপ করে গেলেন।
শাড়ি, গয়না সব দেখে খুশি হলে সবাই। শাইনা সব যথাস্থানে রেখে দিচ্ছিল একে একে। ঘর খালি। শুধু দাদীমা আছেন। তিনি ব্যাগ ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন,
“বাবাগো ব্যাটা দেখছি ওইসবও কিনেছে।”
শাইনা জানতে চাইল,”কীসব?”
দাদীমা হাসলেন,”ওইসব আর কি। ব্যাটা ভালোই জানে বউয়ের আর কি কি লাগতে পারে।”
শাইনা কপাল কুঁচকে বলল,”কীসের কথা বলছো?”
দাদীমা ব্যাগের ভেতর থাকা অন্তর্বাস আর অন্যান্য জিনিসগুলো দেখাতেই শাইনা জোরে একটা চিৎকার দিল।
দাদীমা কোনোমতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। আফসার সাহেব মাকে হাসতে দেখে বললেন,
“তুমিও ওর পেছনে লেগেছ।”
দাদীমা হাসতে হাসতে বললেন,”তোর মেয়ে আস্ত একটা বজ্জাত।”
শাইনা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,”তুমি আমার সাথে কোনো কথাই বলবেনা বুড়ি।”
মেহেদী পাতা তোলার জন্য বাড়ির সব চাচীদেরকে ডেকে আনা হয়েছে। বর কনের মেহেদী একসাথে তোলা হচ্ছে। শাইনার ভাবি সাবিনার হাতে একটা কুলা। সেখানে একটা মোমবাতি জ্বলছে। কিছু ঘাস, একমুঠো চাল, কয়েকটা খুচরো পয়সা, কিন্তু পান সুপারি আর কত কী। সাবিনা কুলা নিয়ে সবার আগে দাঁড়িয়ে রইলো। তৌসিফ আর শাওন ক্যামেরা নিয়ে হাজির। শাহিদা বেগম আর রওশনআরাকে ঘিরে সবাই হাসিঠাট্টা করছে। শাইনা জানালা দিয়ে সব দেখছে। বড় আপার বিয়ের সময়ও এভাবে মেহেদী পাতা তোলা হয়েছিল। খুব আনন্দ করেছিল সে।
মেহেদী গাছটা শাইনাদের বাড়ির সামনেই। বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখা যায়। সবাই একসাথে মেহেদী পাতা তুলতে যাচ্ছে। বাচ্চা কাচ্চারা সাথে সাথে হাঁটছে।
তাজমহল পর্ব ৮
শাইনা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। দাদীমা বললেন, “ঘরে বসে থাকতে মন চাইছেনা না?”
কথাটা ঠিক। নিজের বিয়ে তাই নইলে সে একদৌড়ে চলে যেত সেখানে।
হঠাৎ পাশ ফিরতেই সে দেখলো ওই বাড়ির বারান্দায় তাজদার দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ফোন।
শাইনার হাতে তার নতুন ফোনটা। হঠাৎ টুং করে একটা মেসেজ ঢুকলো হোয়াটসঅ্যাপে। গ্রুপে এসেছে মেসেজটা। শাইনা হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকতেই দেখলো, মেহেদী পরা মেয়েলি হাত। হাতের তালুতে বরের নামের প্রথম অক্ষর।
শাইনা মেসেজটা দেখে কপাল কুঞ্চিত করে তাজদারের দিকে তাকালো। তাজদার ফোনে চোখ ডুবিয়ে রেখে হেঁটে হেঁটে বারান্দা ছাড়লো। শাইনা বিড়বিড় করে বলল, জীবনেও লিখব না।
