ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৬
মিথুবুড়ি
একই সময়, একইসাথে দু’টো মানুষের কাছে পৌঁছালো একটি জায়গার লাইভ লোকেশন। এমন এক কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে থেকে বার্তাটি এসেছে, যে তাদের কারোর পক্ষেই তা উপেক্ষা করা অভাবনীয়। দুই প্রান্ত থেকে দু’জন মানুষ উন্মত্ত ছুটে চলল সে-ই স্থানে। কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য সে-ই স্থানে?
‘আজ বুঝি অমাবস্যা। তারাভরা আকাশ হঠাৎই ঢেকে গেছে অদ্ভুত এক আঁধারে। যেন ভয় জাগানো অশুভ কোনো ইশারা। ইতালির UniCredit Tower–এর মাথায় প্রতিদিনের মতো ঝুলে নেই সেই থালার মতো জোছনার চাঁদ। চারপাশে ছড়িয়ে নিঃসীম কালো। শুধু পাশের নিচু ভবনের ম্লান আলোয় উঁকি দিচ্ছে UniCredit Tower–এর বিশাল ছাদ নীরব, রহস্যময় ছন্দে।
‘এক পায়ে, ওয়াকারের সাহায্য ছাড়াই কয়েকটি সিঁড়ি অতিক্রম করে ছাদে পৌঁছে এক মুহূর্তের জন্য ঝুঁকে হাঁপাতে থাকে তাকবীর দেওয়ান। শরীর থেকে টপটপ করে লবণাক্ত ঘাম ঝরছে, ঠিক তখনই চম্বুকের মতো ঠাণ্ডা লোহার শিকল আচমকা এসে তার পা জড়িয়ে ধরে। বিস্ময়ে হতবুদ্ধি তাকবীর চোখ মেলে সামনের দিকে তাকাতেই আবিষ্কার করল রিচার্ডকে। তার অপর প্রান্তে থাকা রিচার্ড, শিকলের কর্কশ ঘর্ষণের শব্দে পিছন ফিরে তাকিয়েছে। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায় সে নিজেও আবদ্ধ দু’টি ভারী শিকলে। দু’জনের বিস্মিত চোখ একে অপরের দিকে আটকে থাকে। সুচারু দৃষ্টি এবং তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের দ্বারা চারিপাশ অবলোকন করে পরিস্থিতি বোঝায় চেষ্টা চালায়।
ঠিক তখনই ছাদে ছড়িয়ে পড়ে চিকন, ধারালো, আত্মগরিমায় বেষ্টিত মেয়েলি কণ্ঠ। যেন একটি ভয়ংকর উপস্থিতির পূর্বাভাস। সে এগিয়ে আসছে হিমশীতল বাতাসে কাঁপন ধরানো এক সুরে গান গেয়ে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
That they will love me forever, love me true
But i don’t need a shining star
And i don’t wanna be rescued
No neither frog nor charming prince
Nor my summers barbequed
‘দেবীর আবির্ভাব যেন সুরের প্রতিটি ছন্দে গেঁথে থাকা এক মোহময় দৃশ্য। সাদা ধবধবে সিল্কের শাড়িতে মোড়া এলিজাবেথকে লাগছে আজ আকাশ থেকে নেমে আসা আগুনরঙা কোনো দেবী। স্লিভলেস ব্লাউজে তার দীপ্ত শরীর ঝলমলে আলো ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক, চোখে গভীর কাজলের রেখা। দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত শীতলতা আর উত্তাপের সহাবস্থান। রক্তিম কেশরাশি পিঠে নেচে বেড়াচ্ছে। হুটোপুটি খাচ্ছে। বাতাসে উড়ছে অলস হাওয়ার মতো। দুই হাত জুড়ে লাল রেশমি কাঁচের চুড়ি ঝঙ্কার তুলছে। বাঁ হাতে ধরা ছোট ছোট ধারালো ছুরিগুলো সেই কাঁচের রেশে তির্যক প্রতিফলন তৈরি করে খেলছে আলোছায়ার খেলা।
‘এক ঝলক রিচার্ডের অগ্নিদৃষ্টিকে ছুঁয়ে এলিজাবেথ নিরুদ্বিগ্ন পায়ে এগিয়ে এল তাকবীরের সামনে। সম্মুখের চোখের কৃষ্ণাভ তারায় থইথই করা আকুলতা ও চিকচিকে জলের বিপরীতে নারীর কণ্ঠে অপূর্ব অশরীরী স্নিগ্ধতা,
“বহুদিন পর মিনিস্টার সাহেব।”
‘উত্তাল সমুদ্রের প্রবল স্রোতের মতো প্রলয়কারী ধাক্কা খেলে গেল তাকবীরের বুকে যখন সে ‘ভালো মানুষ’ নয়, ‘মিনিস্টার সাহেব’ নামে সম্বোধিত হলো। সে ব্যাথায় ভেজা নিমগ্ন স্বরে বলল,
“এলোকেশী।”
‘তীক্ষ্ণ ফলার ধারে চামড়া ছিঁড়ে যাওয়ার খচখচ শব্দ বাতাসে ভয়াল নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে দেয়। বুক-পাঁজরের মাংস চিরে, পেশির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা উষ্ণ রক্তের কয়েক ফোঁটা আঁচড়ে পড়ে তাকবীরের ঠৌঁটে। বাঁ কাঁধ থেকে ডান কোমর পর্যন্ত আড়াআড়ি কাটা দগদগে ক্ষত থেকে ফিনকির মতো র-ক্ত বেরোচ্ছে। এলিজাবেথের হাতে ধরা ছু-রির ফলার ডগা থেকে টপ করে এক ফোঁটা র-ক্ত পড়ল মেঝেতে। তাকবীর স্তব্ধ। বিমূর্ত মূর্তির মতো এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে আছে। ছুরির আঘাত যেন তাকে ছুঁতেই পারেনি। সে কেবল দেখছে আক্রমণকারীকে। দেখছে সেই মানুষটিকে, যার হাতে ছুরি।
‘রিচার্ড পর্বতের মতো গম্ভীরতা নিয়ে পিছন থেকে তাকিয়ে আছে। তার মস্তিষ্ক অতি অল্প সময়েই বুঝে নিতে সক্ষম হয় আজ অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার রাতে ঠিক কী ঘটতে চলেছে।
‘এলিজাবেথ কঠিন মুখে, ঠান্ডায় ঘৃণা চেপে গলায় বলল,
“খুনি!”
‘সমাজে একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে যে, চোরের মন পুলিশ, পুলিশ। তাকবীরের বেলায় যেন সেই প্রবাদটাই নিখুঁতভাবে মিলে গেল। ‘খুনি’ শব্দটা শোনা মাত্রই তার চোখের রঙ পাল্টে যায়। কৃষ্ণগহ্বরের মতো গভীর দৃষ্টি হয়ে ওঠে দীঘির কালো জলের মতো। র-ক্তপাতের যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে সে এগিয়ে যেতে চায় এলিজাবেথের দিকে। কিন্তু পায়ের শিকল টেনে ধরে তাকে। সে থেমে যায়, কিন্তু থেমে থাকে না। নিজ জায়গা থেকে চোখ, মুখ, ভঙ্গিতে বোঝাতে চায়,
“এলোকেশী, বিশ্বাস কর আমি তোমার ড্যাড কে খুন করিনি। উনি, উনি তো,,,,
‘হঠাৎ উচ্চশব্দে হেসে উঠল এলিজাবেথ। কি ভয়ংকর সে-ই হাসি। হাসির তালে কাঁপছে দেহ। এলিজাবেথ শাড়ির আঁচলের নিচে কুচিতে গুঁজে রাখা একটি রিপোর্ট বের করল। ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট টি তাকবীরের মুখের সামনে তুলে ধরতেই সে বিদুৎস্পষ্টের মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। শান্ত, দূরদর্শী চোখ দু’টো নিষ্প্রভ তাকিয়ে থাকে রিপোর্টের এক কোণে ঝলঝল করতে থাকা—তাকবীর দেওয়ান’ নামটির দিকে। গৌরবদীপ্ত চোখ দু’টোতে নিমিষেই নেমে আসে কুঁড়ে, কুঁড়ে খাওয়া নির্মম অপরাধের ছায়া। পরাস্ত সৈনিকের ন্যায় মাথা নিচু করে ফেলল সে। আনত র-ক্তশূণ্য মুখটি বিষ দৃষ্টিতে একনজর পরখ করে প্রসন্নবদনে ফিক করে হাসি দিয়ে উঠল এলিজাবেথ।
“কি মিনিস্টার মসাই, এখন কি বলবেন?”
‘শীতল বাতাসের ঝাপটায় আলতো করে চেপে ধরা রিপোর্ট টি উড়ে গিয়ে পড়ল রিচার্ডের পায়ের নিচে। রিচার্ড নির্ভীক কঠিন মুখে রিপোর্ট টির দিকে তাকায়। এটি সে-ই শিশিটার রিপোর্ট; যা এলিজাবেথ তার চাচার বাড়ি থেকে সন্দেহের উপর ভিত্তি করে উদ্ধার করেছিল। শুরু থেকেই তার মাতৃ মনে সন্দেহের দানা বাসা বেঁধেছিল। মনে ছিল নানান প্রশ্ন।
অবর্ণনীয় চিন্তাগুলো শূলের মতো কাটা দিচ্ছিল তার গায়ে। কারণ সেদিনের সে-ই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার পূর্বেই তার ব্লিডিং শুরু হয়েছিল। তবে তলপেটের অসহনীয় ব্যাথার কারণে তা কাউকে জানান দেওয়ার পূর্বেই সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এবং র্ববরতার মাধ্যমে ইস্তফা ঘটে সকল জুলুমের।
‘সে-ই মরণ যন্ত্রণা ব্যাথা আপনা-আপনি শুরু হয়নি। মানুষরূপী দানব—চাচার দেওয়া দুধ খাওয়ার পরই শুরু হয়েছিল পেটের মধ্যে ধ্বংসাত্মক তান্ডব। সেজন্যই এলিজাবেথ ন্যাসোকে শিশি টা দিয়েছিল টেস্ট করতে। তবে, আশ্চর্যজনক ভাবে সেটি ল্যাব থেকে গায়েব হয়ে গেলেও এতোদিন পর অদ্ভুতপূর্ব ভাবে আজ তা এলিজাবেথের কাছে কি করে এলো সেই ভাবনা মস্তিষ্ক প্যাঁচ দিয়ে দৃষ্টি ফেরাল রিচার্ড। এছাড়া বিশেষ কোনো অভিব্যক্তি ধরা পড়েনি তার পর্বতসম গম্ভীর অবয়বে। তার ভাবলেশহীন আচরণের মানে কি এই দাঁড়ায়—সে শুরু থেকেই সবটা জানত? এজন্যই ভাইয়ের প্রতি ছিল এতো ক্ষোভ!
‘তাকবীরের দুই চোখ বাষ্পাকুল হয়ে উঠল৷ হতোদ্যমে শ্বাসটা নীরবেই ছাড়ে সে। কিছু বলতে চাইলেও পারে না। তার কণ্ঠরোধ। কয়েকবার ঢোক গিলে শুকনো চৌচিরে গলাটা সিক্ত করে কিছু বলতে চাইল,”এলোকেশী আম,,,” কিন্তু বাক্য সম্পূণ করার আগেই, আবারও চামড়া ছিঁড়ার সে-ই নির্মম শব্দ। এবার বাতাসে র-ক্তের তপ্ত তরঙ্গ ভাসল। ডান কাঁধ থেকে বাঁ কোমড পর্যন্ত নতুন আরেকটি রেখা তৈরি হল। সুবিস্তৃত,শক্তপোক্ত সুঠোম বুকে ক্রস চিহ্নের মতো দাগ। চুইয়ে, চুইয়ে ঝরা র-ক্তে, নিচে র-ক্তের রক্তি-মা নদী বয়ে যাচ্ছে। তাকবীরের চোখ দু’টোতে এতোক্ষণে ব্যাথারা ধরা দিল। নিখিল কৃষ্ণ চোখের কোল ঝাপিয়ে প্লাবন হল। তবুও ধূসর মেঘের ছায়ায় বিষণ্ণ মুখটি ছলছলে নয়নে তাকিয়ে নারীমূর্তির দিকে।
‘অনুভূতির ধ্বংসস্তুপে এক পায়ে দীর্ঘক্ষণ এই রক্তক্ষয়ী শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে অসহনীয় ব্যাথায় নীলাভ আভা ফুটে উঠেছে কৃষ্ণগহ্বরে। তাকবীর একপলক তার কাটা পায়ের দিকে তাকাল। অতঃপর ফের জড়োসড়ো মুখভঙ্গিতে এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে, সমস্ত অসহায়ত্বের বিনাশ ঘটিয়ে বলল,
“এলোকেশী দেখো না আমার একটা পা নেই। ওরা না, আমার পা কেটে ফেলেছে।”
‘বলে উদ্বেলিত চিত্তে ছুটে যেতে চাইল তার এলোকেশীর কাছে। তবে আজ এলিজাবেথ যেন নাগাসাকির বোমা। সে ধাক্কা দিয়ে তাকবীরকে সরিয়ে দিয়ে রণমুর্তির ন্যায় চিৎকার করে উঠল,
“আমি আপনাকে বলেছিলাম, আমার জন্য গাড়ির সামনে ঝাপ দিতে?”
‘শরীরি ধাক্কার চেয়েও বড় ধাক্কা অন্তরে খেল তাকবীর। কিছু মুহুর্তের তার চারপাশের বায়ু চলাচল যেন থমকে যায়। ভেতরে অজস্র শব্দ থাকলেও, ভেতরের বেদনা শব্দকে আটকে রাখে। গলা দিয়ে কিছুই বেরোতে চায় না। অথচ, বুক ফেটে কষ্টের ঢেউ, সমস্ত প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মনের অজান্তেই আবারও তাঁর হঠাৎই চোখ ভিজে উঠল। গলার ভেতর দলা পাকানো, শব্দহীন আর্তনাদ শক্ত ঢোকে গিলে সে শুধু নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল,
“অথচ তোমার ভালোবাসার লোভেই ছিল আমার সকল আয়োজন।”
‘অকস্মাৎ সকল নিস্তব্ধতা, গুমোটতা চিরে যায় এলিজাবেথের চিৎকারে,
“নিষ্পাপ, পবিত্র ছিল ও।”
‘তাকবীর নিশ্চুপ। তাঁর কাছে এসবের জবাব নেই। সে-ই ঘৃণিত কাজটি করে সে নিজেও শান্তি পায়নি। আত্মগ্লানি তাঁর ভেতরটা খুবলে, খুবলে খেয়েছে। চোয়ালে ফুটে উঠেছে অসহায়ত্বতার করুণ ছাপ। হাহাকারে ডুবে থাকা হৃৎস্পন্দন প্রতিনিয়ত টের পেয়েছে মৃত্যুর সাধ—চিৎকার করতে না পারার এক ধরনের মৃত্যুর। নিজের বুকের সে-ই মৃত্যুগুলো চাপা চলছে সে৷ এটা সত্য, ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। কিন্তু, ভালোবাসার মানুষকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা তাকে উন্মাদ বানিয়ে ফেলেছিল। প্রিয় মানুষটার কোলে অন্যকারোর সন্তান, সে-ই জঘন্যতম অনুভূতির সম্মুখে পরতে চায়নি তাকবীর দেওয়ান।
‘এলিজাবেথের ভেতরের নিস্তব্ধতা আবারও চিৎকার করে উঠল,
“আমি আবারও ঠকেছি, কষ্টটা সেজন্য হয়নি। কষ্টটা তখন লেগেছে, যখন জানতে পারলাম মানুষটা আপনি ছিলেন। যে ছিল আমার কাছে অতুলনীয়।”
‘এবারও তাকবীর চুপ। তার আনত চোখদুটোতে অপ্রকাশিত কান্নার ভার। ঠৌঁটে জমাটবাঁধা কষ্টের থকথকে স্তর। এবার যেন এলিজাবেথের কণ্ঠস্বরও ভেঙে আসে,
“ভিলেনের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি গিয়েছিলাম এক মহা মানবের কাছে। সে ছিল আমার আস্থা, ভরসা। যে আমায় ব্যাথায় কাঁদত, ছটফট করত। অথচ সে-ই ছিল আমার সন্তানের খুনি। যার জন্য আমি হারিয়েছি আমার মাতৃত্ব। যে দিনের পর দিন, আমার মাকে একটা বন্ধ কুঠুরিতে আঁটকে রেখেছিল। অথচ, আপনি নিজের চোখেই সবটা দেখেছেন, দেখেছেন—কীভাবে আমি ছটফট করতাম আমার মমের জন্য।”
‘পিছন থেকে সুদীর্ঘ উচ্চতার রিচার্ডের নখদর্পনে ঘটছে সবকিছু। তার দূর্ভেদ্য চোখদুটো কোপদৃষ্টি বর্ষণ করে রেখেছে, ভাই নামক সন্তানের খুনির ওপর। চোয়ালে পাথর খচিত দৃঢ়তা, দু’চোখে যুদ্ধংদেহী নিষ্ঠা। তাকবীর তখনও জড়বৎ মূর্তির মতো নিশ্চল নীরবমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে। বুক ভেসে যাচ্ছে র-ক্তে। তবুও সে ছটফট করছে না, চিৎকার করছে না৷ নীরব আত্মধ্বংসের অন্তরাল ব্যাথা যেন শরীরের ব্যাথাকে ছুঁতে পারছে না।
‘এলিজাবেথ এই নিঃসাড় মুখটির দিকে ঘৃণিত চোখে চোখ রেখে ক্ষীণ, দমকাহারে ওঠা স্বরে বলল,
“খবরদার এখন কান্না করে কোনোরূপ নাটক করবেন না। আপনার কান্নাগুলোও মিথ্যে। আপনার সব, সব, সব ছিল মিথ্যে।”
‘কথায় আগুন বর্জন করল এলিজাবেথ। চোখের রুদ্রতেজী ছাঁচটা তখনও তীব্র। নিঃসীম নিরবতার চাদরে মোড়ানো মুখটিতে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল। চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসের ভারে থেমে যাওয়া শব্দটা এবার বেরোয়,
“অথচ আমার চোখের প্রতিটা ফোঁটা-ই ছিল কষ্টের।”
‘সন্তান হারা মা আজ তার সন্তানের খুনির সামনে উন্মাদ। আলোছায়া মেশানো চোখ দুটোতে সম্মুখের লোকটার জন্য রয়েছে শুধু নির্মমতা। হিংস্রতা প্রভাবে এলিজাবেথ গগনচুম্বী চিৎকার দিয়ে বলল,
“আমার বাচ্চাটার কি দোষ ছিল? ওকে কেন মারলেন আপনি? আপনি একটা নরখাদক।” এলিজাবেথ খামচে ধরল তাকবীরের র-ক্তভেজা কলার,”কেমন মায়ের সন্তান আপনি? আরেক মায়ের কোল খালি করে দেন? একটুও হাত কাঁপল না?”
‘তাকবীর কেমন যেন একটা গলায় বলল,”আমি তো নিজ মায়ের ভালোবাসা পাইনি এলোকেশী।”
‘এলিজাবেথ থমকাল। তাকবীরের কণ্ঠটা বড্ড অদ্ভুত শোনালো। অজান্তেই তার হাতদুটো ঝড়ো হাওয়ার মতো আলগা হয়ে গেল। ঠোঁট কামড়ে সে চোখ বন্ধ করল। মনের পর্দায় তখন ভেসে উঠছে পুরনো সেই সময়ের বিভীষিকাময় দৃশ্যগুলো। মুহূর্তেই সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। চোখ খুলে তাকাল তাকবীরের দিকে। যন্ত্রণায় দুমড়ে ওঠা মুখে ঘৃণার বিস্ফোরণ নিয়ে একরাশ থুতু ছুড়ে দিল তাকবীরের সামনে। তাকবীর গ্রীবা নিচু করে, নিস্পৃহ চোখে তা দেখল। এক মুহূর্ত নীরবতা তারপর যেন ভেতরের সব জিজ্ঞাসা একসাথে ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো। তাকবীর আচরণে এক পাগলামী ছায়া দেখা দিল। সে এলিজাবেথের ডান হাতটা দুই হাতের আঁজলায় চেপে ধরে ফ্যালফ্যাল চোখে বলতে লাগল,
“ও এলোকেশী,, আমি মানছি আমার দ্বারা অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস কর, আমি এতোটা নির্দয় কখনোই হতাম। আমি এটা করেছি, জাস্ট বিকজ আমি তোমাকে ভালোবাসি৷ আমি জানি আমার ভুলের ক্ষমা নে,,,,
‘এলিজাবেথ হাত সরিয়ে নিল। ঠাট্টার ছলে হেসে বলল,
“ভালোবাসা? মায়ের বুক খালি করে দিয়ে ভালোবাসার কথা বলছেন? আবার ক্ষমাও চাইছেন?”
‘তাকবীর শক্ত ঢোক গিলল। এলিজাবেথের কথাগুলো বিষমাখা তীরের মতো গিয়ে বিঁধছে তার অন্দরের সবথেকে স্পর্শকাতর স্থানে। হৃদয়ের গহীনে কাঁদতে থাকা ছোট্ট শিশুটির অসহায় আত্মচাপা হাহাকারে অনবরত কাঁপছে তার ওষ্ঠপুট। কান্নাহীন কান্নার জোয়ারে ভাসছে লোকটার অম্তকঃকরণ। অজানা ভয়ে ডানা ঝাপটাতে থাকা চড়ুইগুলো ঘন কুয়াশার মতো চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে তাকে। তবে কি আজ সত্যিই তাঁর বিনাশ অনিবার্য? তাকবীর আবারও দু’হাতে জাপ্টে ধরল এলিজাবেথের হাত। লোকটা এবার হুরহুর করে কেঁদে ফেলল,
“মানুষ মাত্রই ভুল। আমারও ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম সে-ই সময়টাতে। নিজের হুঁশে ছিলাম না, কাজটা করার সময়। আমাকে ক্ষমা করে দাও এলোকেশী। আমি দুনিয়ার সমস্ত শাস্তি মাথা পেতে নিতে পারব এলোকেশী, কিন্তু তোমার চোখের ঘৃণা আমি কখনোই সহ্য করতে পারব না। আমাকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি দাও। তবুও, পায়ের পড়ছি, এই চোখে তাকিও না আমার দিকে। আমি ভেতর থেকে মরে যাই। বিশ্বাস করে, আমি মরে যাই। সে-ই দিনের পর থেকে রাতে ঘুমাতে পারি না আমি। সারাক্ষণ একটা বাচ্চার কান্না আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। নিজ কাজে অনুতপ্ত আমি। আমি পাপ করেছি, মহাপাপ। আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না? খোদার কাছে মন থেকে মাফ চাইলে খোদা মাফ করে দেয়। তুমি তো তাঁর-ই সৃষ্টি। তোমার কাছে কি আমার ক্ষমা নেই? ভাই, বল না ওকে আমাকে ক্ষমা করে দিতে। আরে কামন ইয়ার, একটু বোঝায় চেষ্টা কর।”
‘এলিজাবেথ শব্দ করে হাসল। কি বিচ্ছিরি সে-ই ভয়ংকরী হাসি। হাসতে, হাসতে চোখে পানি চলে এল। তবুও থামে না হাসি। ভেতরে প্রতিশোধের আগুন নিয়ে, চোখে পানি সমেত কটাক্ষ করে বলল এলিজাবেথ,
“ক্ষমা? আমি তো আপনার মৃত্যু নিয়ে হাজির হয়েছি জনাব।”
‘পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে গেল তাকবীর। এক মুহূর্তে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল।চোখে জমে থাকা অপূর্ণ কান্না ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যায়। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে বসে,
“মৃত্যু?এলোকেশীর হাতে আমার মৃত্যু?”
‘বিস্ময়ে হতবুদ্ধি মস্তিষ্ক সচল হতেই সর্বসুখ প্রাপ্তির হাসি ফুটল তার অধরকোণে। সে হৃষ্ট চিত্তে বলে উঠল,
“কবুল জান, কবুল। তোমার হাতে মৃত্যুও কবুল।”
“এবার বুঝতে পারছিস, আমার হাতে ক্ষমতা থাকা সত্বেও কেন তোকে মারিনি। বলেছিলাম না, সবচে নৃশংস হবে তোর মৃত্যু। তোর আত্মা মারা যাবার আগেই তোর মন মরে যাবে।”
‘ছাদের অপর প্রান্ত হতে আগত রাশভারি কণ্ঠে প্রস্তর বুকের বাঁ-দিকে অসহনীয় ব্যাথা অনুভব করল তাকবীর। দাম্ভিক পুরুষটা অকাট্য গম্ভীর মুখে সটান দাঁড়িয়ে। তার কি একটু পুড়ছে না ভাইয়ের জন্য? হয়ত না! পুড়লে নিশ্চয়ই এগিয়ে আসত। পুরুষমূর্তি বলিষ্ঠ বুকে সদ্য সৃষ্টি ক্ষতস্থানে সুবলিত পুরুষ্টু হাতে চেপে ধরে রক্তক্ষরণ রোধ করত। কিন্তু সে তো এগিয়ে এল না। সত্যিকারের অর্থে, তাঁর আছে-ই বা কে? যে তাঁর জন্য এগিয়ে আসবে? একটু উষ্ণ ছোঁয়ায় মাখিয়ে দিবে তাকে। লোমহীন বুকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরবে, আর সে নির্দ্বিধায় মোমের ন্যায় গলে যাবে সেখানে।
‘কিয়ৎক্ষণ অবুঝ ভঙ্গিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইল তাকবীর। চিরন্তন সত্য যা, তা হলো তাঁর সত্যিই কেউ নেই। সে একা। তাকবীর প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ঘাড় উঁচিয়ে নিরুত্তাপ, উদাসীন চেহারায় চোখ রাখল রিচার্ডের বাজপাখির মতো শাণালো দৃষ্টিতে। নাহ! ক্ষিপ্ত, দূরদর্শী চোখ দু’টোতে মায়ার ছিটাবেড়াও নেই। হতোদ্যমে শ্বাসটা সকলের অগোচরেই ছাড়ল সে। ঠৌঁটে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে প্রসন্নবদনে বলল,
“তাহলে, তুই তো সেই কবেই জিতে গিয়েছিস। মন তো আমার সেইদিনই মরে গিয়েছিল, যেদিন এলোকেশী মত্ত হয়েছিল অন্যতে।”
‘রিচার্ডের কণ্ঠনালী বেয়ে বিদ্ঘুটে হাসির উদগীরণ ঘটল কালচে ঠৌঁটে। সে রাগারুণ, হাসি মুখে আপাত ক্ষোভে গজগজ করে শুধায়,
“ইউ ডির্জাব ইট।”
‘হাড়ভাঙা ক্লান্তির ছায়া নামে তাকবীরের নিখিল কৃষ্ণ চোখের কার্নিশে। বুকটা হিম হয়ে আসে। ক্ষণিকের এই জীবনে, অপ্রাপ্তির সকল দুঃখ কি শুধু তাকেই বহন করতে হয়? নিস্পৃহ চোখে সে চেয়ে থাকে এলিজাবেথের দিকে আজকের অপরূপ সাজে সে যেন নৈসর্গিক দেবী, অথচ দু’চোখে গনগনে অগ্নিশিখা। পাষাণ হৃদয়গুলোতে আজ একটুও কি মায়া জাগে না তার জন্য?
‘সে অবুঝ নয়। জানে, সব পাপের ক্ষমা হয় না। যে পাপ সে করেছে, তা ক্ষমার অতীত। তবুও, এক উন্মাদ প্রেমিক হয়ে তাকবীর দেওয়ান মৃত্যুকে মানতে পারে না। মানতে পারে না, তার এলোকেশীকে ছেড়ে যেতে হবে চিরতরে। সে তো শুধু দূরে থেকে, একই আকাশের নিচে বাঁচতে চেয়েছিল। বুকের গভীরে এক ঝড় উঠে। সমস্ত পুরুষোচিত অহং ভেঙে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে এলিজাবেথের সামনে। দু’হাতে আঁকড়ে ধরে এলিজাবেথের পা। গলা কাঁপে, শব্দে জড়িয়ে থাকে পুরো পৃথিবীর আকুলতা,
“আমাকে মাফ করে দেওয়া যায় না এলোকেশী?”
‘এলিজাবেথ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, তবুও চোখদুটি কেন জানি সজল হয়ে ওঠে। বুকের ভেতর থেকে ভাঙাচোরা কান্না উঠে আসে। সে তাকায় না তাকবীরের দিকে। অথচ, তাকবীরের বুকে ঝরে পড়া র-ক্তে তার শাড়ির আঁচল ভিজে যাচ্ছে। তবুও সে তাকায় না, কেবল ভেজা গলায় বলে,
“মাফ? কিভাবে করি আমি? ও তো আমার এখানে ছিল।”তলপেটে হাত রাখে এলিজাবেথ,”ঘাপটি মেরে ছিল এখানে। নিশ্চয়ই ভেবেছিল, ‘মাম্মা বাঁচিয়ে নেবে’। কিন্তু… কিন্তু মাম্মা তো পারেনি। ওপারে যখন ওর মুখোমুখি হবো, তখন তাকে কী বলবো আমি?”
‘তাকবীর এলিজাবেথের হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে উঠল,
“তোমার গর্ভে অন্য কারও সন্তান—তা আমি মানতে পারিনি। ও… ও তো আমারই হওয়ার কথা ছিল, তাই না এলোকেশী?”
‘পিছন থেকে রিচার্ড হুংকার দিয়ে উঠল,
“খবরদার। তোর জবান আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব।”
‘তাকবীর মাথা তুলে এক ঝলক তাকায় রিচার্ডের দিকে, তারপর গ্রীবা উঁচিয়ে এলিজাবেথের দিকে। চোখে অব্যক্ত এক মিনতি নিয়ে শেষ বারের মতো বলল,
“আমাকে মেরো না এলোকেশী।”
‘এলিজাবেথ মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাকবীর সবটা বুঝে যায়। বুঝে যায়, এরা তাকে আর মাফ করবে না। এলিজাবেথের শরীরে ভর দিয়েই সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। শরীরের সমস্ত র-ক্ত যেন ইতোমধ্যেই ঝরে গেছে, এখন আর কিছু বাকি নেই। মুখ ফিরিয়ে রাখা এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে সে ফিসফিস করে বলল,
“শেষটা যদি এতটাই ভয়ংকর হওয়ার ছিল, তবে শুরুটা কেন এতটা স্বপ্নের মতো ছিল?”
‘জবাব আসে না। সে বেহায়ার মতো আবার বলে,
“নিঃসার্থ ভালোবাসার শেষ পরিণতি কি তবে এটাই?”
‘এলিজাবেথের বুকের ভেতর কান্না ধাক্কা মারে। ঘৃণা আর ঋণের গভীরে তলিয়ে যেতে থাকে সে। আঁচলে মুখ চেপে ধরে ঠুকরে উঠল। তাকবীর এবার হালকা হাসে। রক্তমাখা ঠৌঁটে বিষাদ মিশে যায়।
“এটা পাপের নয়, ভালোবাসার শাস্তি, বুঝলে এলোকেশী। পাপ তো আমি অনেক করেছি, তবুও বেঁচে থেকেছি বছরের পর বছর। কিন্তু ভালো আমি একবারই বেসেছিলাম। তাঁরই করুন পরিণতি আজ, আমার মৃত্যুর রায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”
‘চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার এবার চারদিককে আরও গিলতে শুরু করেছে। তাকবীরের কণ্ঠ এবার একেবারেই ভেঙে পড়ে। নিঃশেষ কণ্ঠে বলল,
“মন থেকে খুঁজলে সৃষ্টিকর্তাকেও পাওয়া যায়, একত্ববাদের নিষ্ঠায় আরশের মালিকও সাড়া দেন। কিন্তু তোমার পিছে ছুটতে ছুটতে আমার প্রাণ পুড়ে ছাই হয়ে গেল, তবুও তোমায় আমি পেলাম না, এলোকেশী। তুমি কি তবে আমার নিয়তির অভিশাপ, না সেই শূন্যতা যা কোনোদিনই পূর্ণ হতে চায় না?”
‘এলিজাবেথ তাকায় তাকবীরের দিকে। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নিরবে। মোমের মতো নরম গালে শুষ্ক অশ্রুর কারুকার্য। কণ্ঠ বুজে এলো কান্নায়। ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে এলিজাবেথ বলল,
“আপনাকে মারতে আমার খুব কষ্ট হবে, ভালো মানুষ। আপনি যদি এমনটা না করতেন তাহলে আমাদের মাঝেও সুন্দর একটা বন্ধুত্ব হতো। সব ঠিক করে নিতাম আমি। কিন্তু আপনি?”
‘বহুদিন পর ‘ভালো মানুষ’ কথাটা শুনে তাকবীরের বুকের ভেতর এক প্রশান্তির নরম ঢেউ খেলে যায়। স্মিত হেসে সে বুড়ো আঙুল দিয়ে খুব আদরে মুছে দেয় এলিজাবেথের চোখের অশ্রু। এই দৃশ্য দেখে ছুটে আসতে যায় রিচার্ড, কিন্তু শিকলে আটকে গিয়ে পড়ে যায়। ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে রিচার্ড,
“আহহ
‘এলিজাবেথ ঘুরে তাকায় চমকে। বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে ওঠে। তাকবীর আবারও এলিজাবেথের মুখখানি নিজের দিকে ঘুরিয়ে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অতি সন্তপর্ণে জিজ্ঞেস করে,
“এই চোখে আমার জন্য এত টান দেখতে পাইনা কেন, এলোকেশী?”
‘এলিজাবেথ এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল৷ ক্রদনরত অবস্থায় কাঁপতে কাঁপতে বলল,”আমার মনে অন্য কেউ ছিল। আমি কীভাবে আপনাকে ভালোবাসতাম?”
‘তাকবীরের বিরহবিধুর মনে এক সমুদ্র বিতৃষ্ণা ঢেউ তুলল। ভালোবাসার মানুষের ঠোঁট থেকে অন্য কারও ভালোবাসার স্বীকারোক্তি—এর চেয়েও নির্মম কি কিছু হয়? পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত নিঃশ্বাস যেন ওই মুহূর্তে তাকবীরের ফুসফুস ভরে দিল। সে শেষবারের মতো মনমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল এলিজাবেথের দিকে। নিঃশব্দে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। ঠোঁট কেঁপে উঠলে সে নিজেই কামড়ে তা থামাল। এলিজাবেথ মাথা নিচু করে কাঁদছিল। এক খুনির চোখে করুণা, অপরাধবোধ, প্রেমের সবটুকু অপূর্ণতা। এমন খুনি যদি ভালোবাসে, তবে তার ছুরিতেই মরে যাওয়াই তো পরম প্রাপ্তি।
‘তাকবীর শব্দ করে গভীর এক নিঃশ্বাস টানল। ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলল সেই চিরচেনা, অমায়িক, মায়াবী হাসিটা শেষবারের মতো। হঠাৎ করেই কবির মতো তীব্র এক সুরে বলে উঠল,
“না হইল মিলন, না হইল অমর
তবুও প্রিয় মানুষের হাতে মরণ।
আহা! সুখ আর সুখ!”
‘অকস্মাৎ, তাকবীর ঝাঁপিয়ে পড়ল এলিজাবেথের ছুরি ধরা হাতের ওপর। এলিজাবেথ চমকে উঠে তাকবীরের চোখে তাকাতেই, তাকবীর এক অদ্ভুত শান্ত, হাসিমাখা কণ্ঠে বলল,
“তুমি স্নিগ্ধ,পবিত্র। তোমার হাতে রক্ত, মানায় না। এই বোঝাটা আমি হালকা করে দিচ্ছি, এলোকেশী।”
‘এলিজাবেথ চিৎকার করে উঠল, “না! না—না৷” হাত সরাতে চাইছে, হাত থরথর করে কাঁপছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জিতে যাওয়ার জেদে পাথর হয়ে যাওয়া তাকবীর আর শুনল না কিছুই। চোখে একরাশ শান্তি নিয়ে, সে এলিজাবেথের হাতে ধরা ছুরিটা নিজের বুকের বাঁ পাশে সজোরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। এক ঝলক উষ্ণ রক্ত ছিটকে এসে পড়ল এলিজাবেথের মুখে। এলিজাবেথ চোখ মুখ শক্ত করে খিঁচে ফেলল। তবু কেঁপে উঠল ভিতরটা। টের পাচ্ছে, তাকবীর তার চেপে ধরেই ছুরিটা তাঁর বুকের ভেতর মোচড়াচ্ছে। মানুষটার কি জীবনের প্রতিটি এতোটাই বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল যে, সে নিজেকে এতোটা কষ্ট দিয়ে মারছে? মোটা কাটা দাগটা থেকে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। মৃত্যুপথযাত্রী তাকবীর তখনও শুধু তাকিয়ে ছিল তাঁর না পাওয়া শখের নারীর দিকে। তার শরীরটা শব্দ করে নিচে পড়ল।
‘তাকবীর পড়ে গিয়ে ফাঁপা দৃষ্টিতে একবার তাকাল তার ভাইয়ের দিকে। ভাইয়ের চোখে ওটা কী? এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? মুখটাকে এমন কঠিন করে রাখার মানে কী? কোনো উত্তর নেই তাকবীরের কাছে। ব্যাথাতুর সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। রক্তের তপ্ত তরঙ্গে শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে। শেষ শ্বাসগুলোর মাঝে সে চোখ ঘুরিয়ে চাইল এলিজাবেথের দিকে। ভেবে নিল এটাই শেষ দৃশ্য। কিন্তু যদি আর মাত্র এক সেকেন্ড সে তাকিয়ে থাকত তার ভাইয়ের দিকে,তাহলে হয়তো দেখতে পেত ভাইয়ের হাত কেঁপে, কেঁপে এগিয়ে এসেছিল। সেই পাথরভেজা মুখের নিচে লুকিয়ে ছিল একরাশ দগ্ধ যন্ত্রণা। চোখে না-ফোঁটা অশ্রুর এক চিলতে আলো। যা শুধু তাকবীরের তা দেখার সময় আর ছিল না।
‘এলিজাবেথ ছলছলে চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
তাকবীর দেখল ওই ভেজা চোখদুটো কী ভয়ংকর সুন্দর! মৃত্যুর প্রান্তে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো, জীবনের সবচেয়ে অপার্থিব দৃশ্যটা হয়তো এটাই। এলোকেশীর চোখে জল। তাকবীর শেষ নিঃশ্বাস টানল। পায়ের নিচ থেকে শক্তি সরে যাচ্ছে, সমস্ত দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। শেষ বারের মতো সে হাত বাড়িয়ে এলিজাবেথকে ছুঁতে চাইল। তবে আর ছোঁয়া হলো না এলোকেশীকে। তার বিদায়ের সময় হয়ে গিয়েছে।
চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুর মতোই তার হাতটা পড়ে গেল নিস্তেজ হয়ে। ঠোঁটের কোণে রেখে গেল একটুকরো স্নিগ্ধ হাসি। ২৯-০৭-২৫—এই তারিখে পৃথিবীর মঞ্চ ছাড়ল এক ব্যর্থ প্রেমিক—তাকবীর দেওয়ান।
‘তাকবীরের হাত শব্দ করে আঁচড়ে পড়তেই চমকে উঠল এলিজাবেথ। হুঁশ ফিরে এলো ঘোর ভাঙা এক দুঃস্বপ্ন থেকে। সে ছুটে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল তাকবীরের বুকের ওপর। গভীর ক্ষতের দাগ থেকে তখনও রক্ত ঝরছে ধীরে ধীরে। শাড়ির আঁচলটা খুলে এলিজাবেথ চেপে ধরল সেই জায়গায়, আর অন্য হাতে তাকবীরের গালটা মৃদু ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কাঁপা কণ্ঠে বলতে লাগল,
“উঠুন! উঠুন আপনি…এতো সহজে আপনি মরতে পারেন না। এটা আপনার প্রাপ্য নয়। এতোটা সহজ মৃত্যু আপনি কাম্য করতে পারেন না! উঠুন বলছি… আমি এখনও শান্তি পাইনি। আপনি আবারও আমাকে ফাঁকি দিলেন। আমার কথা তো শেষ হয়নি! এভাবে চলে যেতে নেই।যে ভুল করেছেন, তার শাস্তি এত সহজ হয় না। এত তুচ্ছ নয় আমার যন্ত্রণা।”
‘তাকবীর আর উঠল না। সে এখনো আগের মতোই হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। কিন্তু দেহে প্রাণ নেই। নিঃশ্বাস থেমে গেছে। এলিজাবেথের ভেতরটা কেন যেন ফেটে যাচ্ছে। এক অদৃশ্য ঝড় বয়ে চলেছে বুকের গভীরে।
সে দু’হাতে ধাক্কাতে থাকে তাকবীরের দেহটা, আর আর্তনাদ করে বলে যায়,
“উঠুন না! বলুন!আজকে আপনাকে বলতেই হবে কেন এমনটা করলেন? কী দোষ করেছিল আমার বাচ্চা?
কী দোষ ছিল আমার মায়ের? আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে… আপনি কোথাও যেতে পারবেন না! না, পারবেন না। বলুন। কেন ঠকালেন আমাকে? কেন এই বন্ধুত্বের মাঝে ভালোবাসা আনলেন? আপনি কেন সেদিন তাকওয়ার সাথে পালিয়ে গেলেন না? তাহলে হয়তো আপনিও সুন্দর একটা জীবন পেতেন। নিজে হাতে ধরে কেন ধ্বংস করলেন জীবনটা?”
‘ভালো মানুষ আজ সে তার এলোকেশীর কথাও শুনল না। পিছন থেকে রিচার্ড স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের নিথর দেহের দিকে। এমন অনুভূতি থেকে বাঁচতেই কি সে সবসময় দ্বিধায় থাকত? এজন্যই কি এই মৃত্যুই বারবার তার হাতে বিলম্বিত হয়েছিল?এলিজাবেথ ধীরে তাকবীরের একটা হাত ধরে সোজা করতে চাইল৷ কিন্তু হাতটা সোজা হয় না, ঝুলে পড়ে। এলিজাবেথ থমকে তাকায় তাকবীরের দিকে। স্বচ্ছমেদুর মুখটা নীলচে হয়ে গেছে। সুদীর্ঘ শরীরটা
নিঃশ্বাসহীন, নিস্তব্ধ। ঠোঁট কামড়ে চোখ টলমল করে উঠল এলিজাবেথের। রক্তস্নাত নির্থর দেহের পাশে বসে গুনগুন করে কাঁদল কতক্ষণ। অতঃপর সন্তপর্ণে তাকবীরের খোলা চোখ দুটো বন্ধ করে দিয়ে মুখের ওপর ঝুঁকে নিঃশব্দে, ফিসফিস করে বলল,
“আমাদের মধ্যেকার বন্ধুত্ব ভাঙার জন্য আপনাকে আমি কোনোদিন মাফ করব না, ভালো মানুষ।”
‘হঠাৎ, শাড়ির কুচি থেকে রিভলভারটা টেনে বের করল এলিজাবেথ। বিদ্যুতের মতো দ্রুততায় ঘুরে তাক করল রিচার্ডের দিকে। রক্তে ভেজা ধবধবে সাদা শাড়ির আচল বাতাসে উড়ছে। উড়ছে তার আগুনরঙা চুল। এ যেন এক দেবীমূর্তির অভিসম্পাত জেগে উঠেছে। রিচার্ড নির্বিকার। তার চোয়ালে একরত্তিও টান পড়ল না, চোখেমুখে কোনও চমক নেই। সবই তাঁর জানা, সবই প্রত্যাশিত।
‘ঘাড় কাত করে, প্রস্তর মুখে এলিজাবেথ বলল,
“ভালোবাসলেই কি দুর্বল হতে হয়?
যেমন নদী তার পথ খুঁজে পায়,
তেমন ভালোবাসাও শক্তি এনে দেয়।
ভালোবাসলেই কি পাপ বা ভুলে যেতে হয়?
যেমন ছায়া অন্ধকারে হারায় না,
তেমনই ভালোবাসা কখনো ভুলে যেতে শেখায় না।
ভালোবাসলেই কি মনুষ্যত্ব খোয়াতে হয়?
যেমন আগুন পোড়ায়, তবে আবার আলোকিত করে,
তেমন ভালোবাসা কখনো মানুষ থেকে কিছু নেয় না, বরং আরও বড় করে।”
‘রিচার্ডের ক্ষিপ্ত, দূরদর্শী চোখদুটো স্থির হয়ে আছে এলিজাবেথের চোখে। নির্ভীক কণ্ঠে বলল,
“ভালোবাসলে সাহসী হতে হয়।”
“আমি স্বামীর বুকে গুলি চালাতে চাই না। আপনি সত্যিটা বলুন।”
“কিসের সত্যি?”
“রিচার্ড কায়নাত কখনও উদ্দেশ্যহীন কিছু করে না। আপনি কেন আমার মা’কে মারলেন? এর পিছনে আপনার উদ্দেশ্য কী ছিল?”
‘রিচার্ডের চোয়ালে পাথর খচিত দৃঢ়তা। সে জবাব দেয় না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। এলিজাবেথ হেসে উঠল একটা ঠান্ডা, ব্যঙ্গাত্মক হাসিতে।
“সত্যের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে কেবল কাপুরুষরাই।”
‘রিচার্ড তবু নিশ্চল। শিলাপতের মতো দাঁড়িয়ে। এলিজাবেথ এবার কণ্ঠে বিষ মিশিয়ে বলল,
“সন্তানের খুনিকে মারলে যদি ন্যায় হয়, তবে মায়ের খুনিকে বাঁচিয়ে রাখলে তা দুর্নীতি হয়, মি. কায়নাত।”
‘রিচার্ড এবার মুখ তুলে তাকাল। একটা দীর্ঘ ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমার বুকে তোমাকে গুলি চালাতে দিব একটা শর্তে—তোকে আমার মৃত্যুর তো নিজেকে আগলে রাখতে হবে। আমার স্মৃতি-স্মরণ ছাড়া তোর চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রুও ঝরাতে পারবি না। আর ইউ ফাকিং এগ্রি উইথ মি, ওয়াইফি?”
‘এলিজাবেথ ঠোঁট বাঁকিয়ে তুষ্ট হেসে বলল,”খুব সম্ভবত, আপনার স্মৃতি আমি মুছে ফেলব আমার জীবন থেকে। আফটার অল, পাস্ট ইজ পাস্ট।”
‘তৎক্ষনাৎ রিচার্ডের ভেতরের পশুটা জেগে উঠল। সমুদ্রনীল চোখদুটোতে জ্বলে উঠল আগ্নেয়গিরির আগুন। পকেট থেকে রিভলভার বের করে সরাসরি তাক করল এলিজাবেথের কপালে। গাঢ় হাতের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। রিচার্ডের কণ্ঠে বজ্রধ্বনি:
“কুত্তার বাচ্চা—তোর পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার সবটায় আছি আমি! আমাকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করিস না। আমি মরলে, তোকে নিয়েই মরব।”
‘এলিজাবেথ ঠান্ডা তাচ্ছিল্যে বলল,”তাই নাকি? দেখা যাক, কে কতদূর এগোতে পারে।”
‘এই বলেই সে রিভলভারের সেফটি আনলক করল। রিচার্ডও শব্দ করে নিজের রিভলভার আনলক করল।
এলিজাবেথ নিঃশব্দে হেসে বলল,
“বিদায়, মি. কায়নাত।”
‘রিচার্ডও নিশানা ঠিক রেখে, একই ছন্দে বলল,
“বিদায়, মিসেস কায়নাত।”
‘ঠাস! ঠাস!
দু’টি বিকট শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। এলিজাবেথের অদক্ষ হাত নিশানা ভুল করেনি, কিন্তু রিচার্ডের গুলি এবার প্রথমবারের মতো লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। এলিজাবেথের গুলির ঝাঁজ গিয়ে বিধল রিচার্ডের কাঁধে। মুহূর্তেই রিচার্ড মুখ রক্তশূন্য, বিবর্ণ হয়ে উঠল। শরীর দুই কদম পেছিয়ে গেল।
‘রিচার্ডের কাঁধ বেয়ে অঝোর রক্ত ঝরতে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারল না এলিজাবেথ। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
‘গুলিটা লেগেছে সরাসরি রগে। অতিরিক্ত রক্তপাত আর যন্ত্রণায় রিচার্ড যে যেকোনো মুহূর্তে অচেতন হয়ে পড়বে, সে তা বুঝে গেছে। তবু এক হাতে এলিজাবেথকে আঁকড়ে ধরে এক মুহূর্ত ভাবল কিছু। তারপর হঠাৎই এলিজাবেথের ঘাড়ের পেছন থেকে এক মুঠো চুল খামচে ধরে মুখটা টেনে তোলে উপরের দিকে। অতঃপর কামড়ে ধরল এলিজাবেথের অধর। এলিজাবেথ রিচার্ডের কলার খামচে ধরতেই, পেটের চামড়ায় ঠান্ডা ধাতব কিছু স্পর্শ টের পেল। ঠিক তার আগ মুহূর্তেই—ঠাস! গুলির ঝাঁঝ পেটের মাংস ফুঁড়ে ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। চিৎকারও করতে পারল না এলিজাবেথ। কারণ রিচার্ড তখনও দখল করে রেখেছে তাঁর ঠোঁট।
‘রিচার্ড জানে, যে জায়গায় গুলি লেগেছে, অন্তত তিন দিন জ্ঞান ফেরবে না। আর এই তিন দিনের ফাঁকে যদি তার বউ রাগ করে ডিভোর্স ঠুকে দেয়? তারপর নিরুদ্দেশ হয়ে আবার কোথাও চলে যায়? জীবনের অনেক কিছু নিয়ে রিস্ক নেওয়া যায়, কিন্তু স্ত্রী নিয়ে নয়। এটাই রিচার্ড কায়নাতের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
‘রিচার্ড এলিজাবেথের ঠোঁট ছেড়ে দিতেই ওর গলা ফেঁসে ওঠা কর্কশ এক গোঙানির মাঝে ভাঙা স্বরে এলিজাবেথ জিজ্ঞেস করল,”আপনি কি মানুষ?”
“আমি ভিলেন।” নিরুদ্বেগ, অবিচল গলায় জবাব দিল রিচার্ড। তারপর নিজের কোট খুলে দ্রুত এলিজাবেথের কোমরে শক্ত করে বেঁধে দিল। ততক্ষণে দুজনেই ক্লান্ত, রক্তশূন্য। এলিজাবেথ ঢলে পড়ল রিচার্ডের বুকে। রিচার্ড নিজেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কাঁধ থেকে থেমে থেমে ঝরছে রক্ত। সে এলিজাবেথকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ধীরে ধীরে বসে পড়ল। তারপর তাল রাখতে না পেরে শুয়ে পড়ল মাটিতে। এলিজাবেথের চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। শেষবার জ্ঞান হারানোর আগে ফিসফিস করে বলে গেল,
“জানোয়ার।”
“শুধুই তোর।”
‘চেতনা হারাল এলিজাবেথ। ব্যথায় রিচার্ডের মুখ নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে। রিচার্ড এলিজাবেথের মাথাটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে একটানা চুমু খায় ওর চুলের মাঝে। তারপর কাঁপতে থাকা হাতে পকেট থেকে ফোনটা বের করে ন্যাসোর নাম্বারে ডায়াল করে। কল রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে ন্যাসোর উৎকণ্ঠিত কণ্ঠ ভেসে আসে,
“বস, আপনি ঠিক আছেন? আমরা আপনার কমান্ডের অপেক্ষায় আছি। মিস এলিসার অবস্থা ভালো না, হসপিটাল থেকে বারবার ফোন আসছে। আপনি কি সুস্থ আছেন, বস?”
‘রিচার্ডের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। চারপাশ ঘন অন্ধকারে ঢেকে যায়। অজ্ঞান হওয়ার আগ মুহূর্তে সে ফিসফিস করে বলল শুধু,
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৫ (৩)
“ন্যাসো… রেসকিউ আস। ওর পেটে একটা মাইনর ইনজুরি হয়েছে। শি নিডস ট্রিটমেন্ট। মেক শিওর দ্য ডক্টর ইজ ফিমেল। কাম ফাস্ট, মাই বয়েজ…
‘সহসাই চোখ বন্ধ হয়ে গেল। ইতালির বুকে সবচেয়ে উঁচু সেই বিল্ডিংয়ের ছাদে পড়ে রইল তিনটি নিথর দেহ। নিচে ব্যস্ত শহর, আলো, শব্দ, গাড়ির হর্ণ, অথচ কেউ টের পেল না তাদের নিঃশব্দ পরিণতি। কেউ জানল না, মিনিস্টার তাকবীর দেওয়ান ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। কেউই জানল না, কিভাবে এলিচার্ড রক্তে ভেজা ভালোবাসায় একে-অপরের বুকে ঢলে পড়েছিল। মিনিট কয়েক বাদেই হেলিকপ্টারের পাখার গর্জন শোনা যায়৷