অন্তঃদহন পর্ব ১৯

অন্তঃদহন পর্ব ১৯
DRM Shohag

আকাশের ডাকে সন্ধ্যার গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল। কারণ সে জানেনা। আবার-ও আকাশের কণ্ঠ ভেসে আসে,
– সন্ধ্যা কোথায় তুমি?
সন্ধ্যা বা হাতে মুখ চেপে রেখেছে। ওপাশ থেকে আকাশ আবার-ও অসহায় কণ্ঠে ডাকে,
– সন্ধ্যা?
সন্ধ্যার কি হলো কে জানে, সে দ্রুত কান থেকে ফোন নামিয়ে কল কেটে দেয়। চোখ থেকে টুপ করে কয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। সন্ধ্যা সেদিকে তাকালো না। কাঁপা হাতে ফোনের ভেতর থেকে সিম বের করে, চোখের পলকে সিমটি দু’খন্ড করে ফেলে।
সৃজা অবাক হয়ে চেয়ে আছে সন্ধ্যার পানে। সন্ধ্যাকে ঝাঁকিয়ে বলে,

– সন্ধ্যা এটা কি করলে তুমি?
সন্ধ্যা ভেজা, নির্জীব চোখে সৃজার পানে তাকালো। সৃজা বুঝতে পারছে না সন্ধ্যার কি হয়েছে। সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে বলে,
– বুঝেছি তোমার কোনো কারণে মন খারাপ। একদম মন খারাপ কর না। একটু নিজেকে স্বাভাবিক কর বোন। সৌম্য ভাইয়া এসে তোমাকে এভাবে দেখলে কত ক’ষ্ট পাবে জানো?
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নেয়। সৌম্য টিউশন থেকে ফিরে মাত্র ঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছিল। সৃজার বলা লাস্ট কথাটা শুনতে পেয়ে সৌম্য দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে বলে,
– কি হয়েছে আমার বোনুর?
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে রাখলো। সৃজা ভাঙা সিমের টুকরো দু’টি সৌম্য’র দিকে বাড়িয়ে দিলে সৌম্য অবাক হয়। সৃজা বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– আপনার ফোনে আকাশ ভাইয়া নামে সেভ করা ছিল। সে কল করেছিল। আর তাই….
সৌম্য মাঝপাথে শ’ক্ত কণ্ঠে বলে,
– এখান থেকে যাও।
সৃজা মাথা নিচু করে নিল। খারাপ লাগলো তার। সৌম্য সবসময় তার সাথে অকারণেই এরকম করে। সে তো সৌম্য, সন্ধ্যাকে আপন ভাবে। কিন্তু সৌম্য তার উপর বরাবর-ই বিরক্ত হয়। সৌম্য আবার-ও ধমকে বলে,
– সৃজা এখান থেকে যাও।
সৃজা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে, সাথে সন্ধ্যা-ও। সন্ধ্যা তার ভাইয়ের দিকে একবার তাকায়, আরেকবার সৃজার দিকে। সৃজা বেড থেকে নেমে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সৌম্য চোখ বুজল। একে তো তার বোনকে এই ট্রমা থেকে বের করতে পারছে না, তার উপর আরেক ঝামেলা এসেছে। সৌম্য’র ধারণা সৃজা ফোন অন করে সন্ধ্যাকে দিয়েছিল। ভাবার কারণ-ও আছে। সন্ধ্যা কখনো তার ফোন ছুঁয়ে-ও দেখেনা। তার বোনটা এ জগতে থাকে কি-না, সেটাই সন্দেহ, আর আজ আকাশের কল রিসিভ করে নিল? সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যার পাশে বসে। সন্ধ্যার মাথায় হাত রেখে মৃদুস্বরে ডাকে,

– বোনু?
সন্ধ্যা ঝাপসা চোখে তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। সৌম্য মৃদু হেসে বলে,
– আমি চেয়েছিলাম, আমার বোনু ভীষণ স্ট্রং হবে। কিন্তু তুই তো আমার কথা রাখছিস না। আমার ইচ্ছের কথা এভাবে ভুলে গেলি?
সন্ধ্যা সৌম্য’র ফোন হাতে নিয়ে কিছু টাইপ করে সৌম্য’র দিকে তাক করে। সৌম্য ফোনের স্ক্রিনে তাকায়।
– আকাশ আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে ভাইয়া। এজন্য হয়তো কল দিয়েছিল।
লেখাটি পড়ে সৌম্য অবাক হয়ে তার বোনের দিকে তাকালো। আকাশের কথাটি মনে পড়ল – ডিভোর্স পেপার হাতে পেলে তোমাকে কল করব।

সন্ধ্যার চোখের পানি গালে গড়িয়ে পড়েছে। সৌম্য হয়তো বোনের মনের কথা বুঝতে পারলো। সে এতোটা-ও অবুঝ নয়। তার ইরাবতীকে ছাড়া থাকছে, সে বোঝে এই য’ন্ত্র’ণা’দায়ক অনুভূতি। তার বোনটা কত বড় হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ তার বোনুর একজনের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। সময়ের ব্যবধানে তার বোনু ভালোবাসা নামক অসুখ-ও বাঁধালো। কিন্তু সে কি করবে? একটি সম্পর্ক গড়তে যেমন পরিবারের সম্মতি প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় সমাজের সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো অবস্থা, তেমনি প্রয়োজন হয় সম্পর্কে জড়ানো দু’জন মানুষের সম্মতি। কিন্তু তার আর তার বোনুর ক্ষেত্রে এসব কিছুই নেই। তার আর ইরাবতীর এক হওয়ার পিছনে কোনো অনুকূল পরিবেশ ছিল না, ছিল না কারো সম্মতি। আর তার বোনুর ক্ষেত্রে হয়েছে, দু’টো মানুষের মাঝে একজন আরেকজনকে চায় না।
সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নেয়। নরম গলায় বোঝায়,

– একটা কথা শুনবি বোনু?
সন্ধ্যা সৌম্য’র পানে আগ্রহী চোখে চেয়ে। সৌম্য একটু হেসে বলে,
– কেউ যদি আমাদের না চায়, সেখানে থেকে নিজেদের সম্মান খোয়াতে নেই। বরং সে প্রকাশ করার আগেই সেখান থেকে কেটে পড়তে হয়। একটা কথা মনে রাখবি,, মানুষের মান পরিমাপ হয়, তার মাঝে বিদ্যমান আত্মসম্মানের মাপকাঠি দ্বারা।
সন্ধ্যা ভাইয়ের কথার অর্থ বুঝতে পেরেছে। জোরপূর্বক একটু হাসে। সত্যি-ই তো, সে কেন নিজের সম্মান খুইয়ে আকাশকে চায়? আকাশ তাকে চায় না, তাছাড়া তার তো গুণ খুঁজে পাওয়া যায় না, আর আকাশের গুণের শেষ হয়না। তবুও সন্ধ্যা জোর করে কেন থাকতে চাইছে? সন্ধ্যা-ও আর চাইবে না আকাশকে। আবার ভাবে সে তো চায় না আকাশকে। সে শুধু ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে চায় না। কথাটি ভাবতেই সৌম্য’র দিকে চেয়ে বোঝালো,
– সে আকাশকে চায় না, কিন্তু ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে চায় না।
সৌম্য নিরবে চেয়ে রইল। তার বোনু এখনো ছোট। আরেকটু বড় হলে হয়তো নিজেই বুঝতে পারবে। তাই আর কিছু বললো না। তাছাড়া আকাশের টপিক আসায় সন্ধ্যা আগের চেয়ে একটুখানি স্বাভাবিক আচরণ করছে। এজন্য সৌম্য’র ভালো লাগলো। সন্ধ্যার গালে হাত রেখে বলে,

– আমাদের কাউকে প্রয়োজন নেই বোনু। আমার তুই আছিস। তোর আমি আছি। মনে থাকবে তো?
সন্ধ্যা মলিন মুখে মাথা নাড়লো। সৌম্য উঠে দাঁড়িয়ে পরনের শার্ট খুলতে খুলতে বলে,
– আজ তুই ভাত খেতে দে। অনেক ক্ষুধা লেগেছে। কতদিন হলো তো আমাকে ভুলেই থাকলি। মনে হচ্ছে আজ একটু-আধটু মনে পড়েছে, তোর একটা অভাগা ভাই আছে।
সন্ধ্যার মন খারাপ হলো। সে যে মাঝে মাঝে কি করে, এটা নিজেই বুঝতে পারে না। কি করবে সে। বিছানার উপর থেকে নেমে ঘরের কোণায় গিয়ে প্লেটে ভাত বাড়ে। সৌম্য আড়চোখে সন্ধ্যার কাজ দেখে মৃদু হাসলো।

আকাশ প্রায় অনেকক্ষণ যাবৎ সন্ধ্যাকে ডেকে কোনো সাড়া পায় না। হঠাৎ কল কেটে যাওয়ার পর থেকে সমানে কল দেয়, প্রতিবার ফোন বন্ধ দেখায়। আকাশের চোখেমুখে অসহায়ত্ব ঘিরে ধরে। রা’গে হাতের ফোন আছাড় দিতে গিয়ে-ও থেমে যায়। নিজেকে শান্ত করে সময় নিয়ে। মাথায় কিছু খেলল। সময় নষ্ট না করে দ্রুত কাউকে ফোন করে। রিসিভ হতেই আকাশ বলে ওঠে,
– একটা নাম্বার পাঠিয়েছি। লাস্ট লোকেশন কোথায় ছিল, আমাকে পাঠা।
ওপাশ থেকে আকাশের পরিচিত এক ফ্রেন্ড বলে,
– এক ঘণ্টা টাইম দে।
আকাশ চেঁচিয়ে বলে,

– পা’গ’ল না-কি! এক মিনিট-ও দিতে পারবো না। এক্ষুনি দে। নয়তো বউকে ভুলে যা।
ওপাশ থেকে ছেলেটি কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে,
– কয়েকদিন আগেই বিয়ে করলাম।
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– এজন্য ভুলতে সময় লাগবে না।
ওপাশ থেকে ছেলেটি অসহায় কণ্ঠে বলে,
– তোর কাজ করে দিচ্ছি। পাঁচমিনিট সময় দে অন্তত।
আকাশ ছোট করে হুম বলে কল কেটে দেয়। ফোন টেবিলের উপর রেখে টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটি কাগজ বের করে। ডিভোর্স পেপার এটা। সন্ধ্যা যাওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় আসমানী নওয়ান তাকে এই ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিয়েছিল। কিছু কথা-ও শুনিয়েছিল, – এবার ডিভোর্স পেপারে সাইন করে তুমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নাও। খুশি হয়েছ তো তাই না?

আকাশ চুপচাপ পেপারটির দিকে তাকিয়ে ছিল। মায়ের কোনো কথাই কানে নেয়নি। কোনো উত্তর-ও করেনি। এরপর পেপারটি একটি ড্রয়ারে অবহেলে ফেলে রেখেছিল। আজ হঠাৎ পেপারটির কথা মনে পড়ল। রা’গ হলো আকাশের। পেপারটি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলল।
ফোনে টুং করে নোটিফিকেশন আসলে আকাশ দ্রুত ফোন হাতে তুলে নেয়। কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে আকাশের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। অতঃপর দ্রুত রেডি হয়ে নিল। প্যান্টের উপর একটি সাদা পাঞ্জাবি জড়ালো। আয়নায় কখনো নিজেকে সেভাবে দেখা হয়নি। আজ দেখল তার পোষাকের দিকে। সন্ধ্যার শুভ্র পাঞ্জাবিওয়ালা সম্মোধন টি মনে পড়তেই আকাশ আরেকটু হাসলো। সন্ধ্যা যাওয়ার পর কখনো শার্ট পরেছে বলে মনে পড়েনা আকাশের। আকাশ শার্ট পরতে গিয়ে-ও আবার রেখে দিয়ে পাঞ্জাবি পরেছে। এরকম-ও হয়েছে, রাস্তার পাশে ফুটপাতে নিয়ে বসে থাকা সাদা পাঞ্জাবির দিকে নজর পড়লে সেখান থেকে সব সাদা পাঞ্জাবি বেছে বেছে কিনে নিত। ফুটপাতের বলে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে-ও রেখে দিত। তার মনে হতো, ব্যাপার না। পাঞ্জাবি তো সাদা। এতেই তার চলবে।
এখন ঘড়িতে সময় পাঁচটা। সিলেট যেতে যেতে কম হলে-ও দশটা বাজবে। রাত হলে-ও আকাশ যাবে৷ অতঃপর ফোন পকেটে রেখে গাড়ির চাবি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। গ্যারেজের দিকে যেতে নিলে কোথা থেকে অরুণ দৌড়ে এসে আকাশকে জড়িয়ে ধরে বলে,

– বাতাস ওরফে সভাপতি বাবু কংগ্রেস। মিষ্টি খাওয়া চল।
আকাশ অরুণকে ঠেলে বিরক্ত হয়ে বলে,
– দূরে থাক। চিপকাস ক্যান?
অরুণ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এসবের হিসাব পরে করিস। তুই কি আদো-ও বুঝতে পারছিস যে তুই ঢাকা উত্তর মহানগরের সভাপতি হিসেবে সিলেক্ট হয়েছিস। এটলিস্ট একটা এক্সপ্রেশন দে।
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– আপাতত মুড নেই।

কথাটা বলে অরুণকে পাশ কাটিয়ে তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। অরুণ অবাক হয় আকাশের কান্ডে। এটা কে রে? আকাশ সভাপতি হয়েছে, এই খবর পেয়ে আকাশ নিশ্চিত একটা লাফ দিত, নয়তো নিজেই তার উপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কিন্তু এ তো সামান্য খুশি খুশি এক্সপ্রেশনটা-ও দিচ্ছে না। ভাবনার মাঝেই আকাশকে গাড়ি ঘুরিয়ে অরুণের দিকে আসছে দেখে অরুণ লাফ দিয়ে সাইডে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
– কি রে বাবা! মা’রা’র প্ল্যান করছিস না-কি? কোথায় যাচ্ছিস এখন?
আকাশ এক সাইডে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কাউকে কল করে। অরুণ জানালার কাছে এসে ঝুঁকে বলে,
– মিষ্টি কিনতে গেলে আমাকে নিয়ে যা। মিষ্টি আমার ফেবরিট।
আকাশ ফোনে ওপাশের ব্যক্তি বলে,

– কাজ আছে আমার। কোথাও যেতে পারবো না। আগামীকাল দেখা হবে। বাই।
এরপর কল কেটে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অরুণের উদ্দেশ্যে বলে,
– মাকে বলবি কাজে গিয়েছি। আজ নাও ফিরতে পারি।
এরপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চোখের পলকে জায়গাটি প্রস্থান করে।

সৌম্য খাবার খেয়ে ঘরের কোণায় বসে কিছু কাগজপত্র নেড়েচেড়ে দেখছে। বিভিন্ন জায়গার দলিল। এখানে আসার পর পর সৃজার বাবা তাকে এগুলো বের করে দিয়েছে। আর বলেছে, এগুলো সব সৌম্য’র মা উনাকে দিয়েছিলেন। তার মায়ের নামে সব জায়গা। অবাক করা ব্যাপার হলো জায়গা গুলোর প্রায় সবগুলো ঢাকায়। একটি মাত্র জায়গা বাংলাদেশের কোনো এক কোনায়, সৌম্য নিজে-ও বুঝতে পারছে না এটা ঠিক কোথায়। তবে ঢাকার জমিগুলোয় অনেক ঝামেলা আছে। অর্থাৎ বলা যায়, এসব মানুষের দখলে চলে গিয়েছে। সৃজার বাবা আফসোস করে বলেন,
সৌম্য’র মা কিছু না বলেই তার কাছে এসব রাখতে দিয়েছিল।

ভদ্রলোক সব কাগজগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। সৌম্য’র মা তার থেকে কাগজগুলো সময় করে ফেরত নিবে। কিন্তু তার আগেই তার মা মা’রা যায়।
সৃজার বাবা এসব কাগজপত্রের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। অনেক বছর পর যখন কাগজগুলো বের করে খোঁজ লাগায়, তখন জানতে পারে,, এসব মানুষের দখলে চলে গিয়েছে। কখনো পাবে কি-না, তাও জানেনা। এককথায় অনেক ঝামেলার এসব। তবে একটি জায়গায় প্রায় দশশতক এর মতো জায়গা আছে, যেখানে কোনো ভেজাল নেই।
সৌম্য’র অবাক লাগছে, তার মা এতো জমির মালিক কিভাবে ছিল? মা-বাবার কোনো আত্মীয়কে সৌম্য ছোট থেকে দেখেনি। যেন তাদের দাদা-দাদি, নানা-নানি কেউ-ই নেই। এতো বড় হলো, অথচ কেউ কোনোদিন খোঁজ-ও নিতে আসেনি। সৌম্য এসব নিয়ে কখনো ভাবেনি। তবে এই কাগজগুলো পাওয়ার পর ভেবেছে। ভাবনা অনুযায়ী সৌম্য’র মনে হলো, তার মা অনেক বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে ছিল। তাহলে তার মা এতো ক’ষ্ট কেন করত? সৌম্য’র হিসাব মেলে না।

আরেকটি ব্যাপার সে বুঝেছে তার মা তার বাবার থেকে বাঁচিয়ে রাখতে এই কাগজগুলো তার এই বিশ্বস্ত মামার কাছে দিয়েছিল।
সৌম্য’র ভার্সিটিতে ফাইনাল এক্সাম আছে কয়েকদিন পর। এজন্য ঢাকা যেতে হবে একবার। তারপর সৌম্য’র মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে যাবে। সে ভাবলো, তখন এই জমিগুলোর খোঁজ করবে গিয়ে। আর সৃজার বাবার টাকাগুলো কিভাবে দিবে তার মাথা কাজ করছিল না, তবে সে কোনো না কোনো এক উপায় বের করতো-ই। কিন্তু একটি জমির কাগজ নির্ভেজাল পেয়ে সৌম্য সিদ্ধান্ত নিল তার এক্সাম শেষে সে এই জমিটা বিক্রি করে মামার টাকা শোধ করে দিবে। বাকি জমিগুলো হয়তো নিলামে ওঠার উপক্রম।
হঠাৎ শুনতে পায়, মেয়ে কণ্ঠে সন্ধ্যা নাম নিয়ে অনবরত কেউ ডাকছে আর এদিকেই আসছে। সৌম্য কাগজগুলো ভাঁজ করে ব্যাগে ভরে রাখল। সন্ধ্যা বিছানার উপর বসে ছিল। তার নাম শুনে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। হঠাৎ-ই একটি মেয়ে দৌড়ে এসে সন্ধ্যাকে জাপ্টে ধরে। সন্ধ্যা বুঝতেই পারেনি। তাল সামলাতে না পেরে পিছনদিকে হেলে ঠাস করে মেয়েটি সহ সন্ধ্যা মেঝেতে পড়ে যায়। সন্ধ্যার মাথার পিছনটা খাটের সাথে গিয়ে লাগে। সৌম্য দৌড়ে আসতে আসতে ডাকে, – বোনু?

সোহা নিজে-ও হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। পিছন থেকে সাধন বড় বড় পা ফেলে এসে তার বোন সোহাকে সন্ধ্যার উপর থেকে টেনে তুলে সোহার গালে ঠাস করে থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। রে’গে বলে,
– এই তোর কমনসেন্স নাই? মেয়েটা ব্য’থা পেল না?
সোহা অসহায় চোখে সন্ধ্যার দিকে তাকালো। সৌম্য সন্ধ্যাকে উঠিয়ে বসিয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– বোনু কোথায় ব্য’থা পেয়েছিস?
সন্ধ্যা সোজা হয়ে বসে মাথা নাড়িয়ে বোঝায়, তেমন ব্য’থা পায়নি। সোহা অনুতপ্ত স্বরে বলে,
– স্যরি সন্ধ্যা! আমি এক্সাইটমেন্টে ভুল করে জড়িয়ে ধরে ফেলেছি তোমাকে।
কথাটা বলতেই পিছন থেকে সাধন সোহার মাথায় জোরে চাটি মে’রে বলে,
– তোর তো জীবনে-ও শিক্ষা হবেনা।
সোহা রে’গে সাধনের বাহুতে থা’প্প’ড় দিয়ে বলে,

– এই তুমি সবসময় আমাকে মা’রো কেন? তোমার হাত চুপ করে থাকে না? অসহ্য ভাই একটা।
সাধন রে’গে বলে,
– আবার বে’য়া’দ’বি করছিস? কঞ্চি এনে আজ শিক্ষা দিব বলে দিলাম।
সোহা মুখ কেলিয়ে বলে,
– যাও তো এখান থেকে। সারা রাস্তা মে’রে মে’রে এনে-ও শান্তি হয়নি তোমার?
সাধন আবার-ও সোহার মাথায় থা’প্প’ড় মারে। সোহা-ও রে’গে সাধনের হাতে কা’ম’ড়ে ধরে। সাধন সমানে সোহার পিথে থাপড়াচ্ছে।

এদিকে সৌম্য আর সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে সোহা আর সাধনের দিকে চেয়ে আছে। কথার ধরনে তো বোঝা যাচ্ছে ভাই-বোন। কিন্তু এভাবে মা’রা’মা’রি করতে দেখে সৌম্য, সন্ধ্যা অবাক না হয়ে পারলো না। দু’জনে ঘাড় ফিরিয়ে দু’জনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কি মনে করে দু’জনেই একসাথে হেসে ফেলল। সৌম্য গাল চুলকে বলে,
– তুই এরকম মা’র খেতে চাস বোনু?
সন্ধ্যা গাল ফুলিয়ে তাকায়। সৌম্য হেসে আবার-ও সাধন আর সোহার দিকে তাকায়। দু’জনের অবস্থা সেইম। এ ওকে মারছে, ও ওকে মারছে। সৌম্য জীবনে-ও সন্ধ্যা একটা থা’প্প’ড় দেয়নি। জীবনে পারবে বলে-ও মনে হয়না।
সৃজা দৌড়ে এসে সোহাকে টেনে সরিয়ে এনে বলে,
– আরে সাধন ভাইয়া তুমি ওকে মারছ কেন এভাবে?
সাধন হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল কা’ম’ড়ে পুরো মাংস বের করে দিয়েছে। রে’গে বলে,
– একে বিয়ে দিয়ে আমার শান্তি হবে। রা’ক্ষ’সীর মতো কা’ম’ড়ে মাংস তুলে নিয়েছে।
সোহা রে’গে বলে,

– আর তুমি যে আমার মাথার চান্দিতে মে’রে মে’রে জখম করে দিলে!
এরপর সৃজার দিকে তাকিয়ে বলে,
– আপু ও আমায় সারা রাস্তা মাথায় চাটি মা’র’তে মা’র’তে এনেছে।
সাধন রে’গে বলে,
– ভালো করেছি। আরও মা’রা উচিত তোকে।
সৃজা কপাল চাপড়ায়। এরা এতোবড় হয়ে-ও আর ভালো হলো না। সৃজা হতাশ কণ্ঠে বলে,
– দয়া করে তোমরা থামো। মেহমানদের সামনে দুইভাইবোন মা’রা’মা’রি শুরু করে দিয়েছ।
সৃজার কথায় সোহা আর সাধন দু’জনেই সৌম্য আর সন্ধ্যার দিকে তাকালো। সৌম্য সন্ধ্যাকে উঠিয়ে বিছানায় বসিয়েছে। সোহা, সাধন দু’জনেই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তারা ভুলেই বসেছিল এখানে অপরিচিত দু’জন আছে। মা’রা’মা’রির সময় কিছু মনে থাকে না। সৃজা সন্ধ্যার দিকে চেয়ে বলে,

– সন্ধ্যা পরিচয় করিয়ে দিই,, এর নাম সোহা, আর ওই ভাইয়ার নাম সাধন। অনেক আগে আমাদের এখানে থাকতো। তখন থেকে ওরা আমার একদম নিজের ভাইবোন হয়ে গিয়েছে।
চঞ্চল সোহা এগিয়ে এসে সন্ধ্যার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
– আমি তোমার জন্যই এসেছি। তুমি কেমন আছো সন্ধ্যা?
সন্ধ্যা, সৌম্য দু’জনেই ভারী অবাক হয়। মেয়েটি এমনভাবে কথা বলছে যেন কতই না চেনা তাদের। সোহা হেসে বলে,
– আমি জানি তুমি ভালো নেই। তোমার মন ভালো করতেই আমি এসেছি। আমি যেখানে থাকি সেখানে কারো মন খারাপ থাকতেই পারেনা।
সন্ধ্যা মেয়েটির কথায় একটু হাসলো। সাধন এগিয়ে এসে সৌম্য’র উদ্দেশ্যে বলে,
– তুমি সৌম্য তাইনা?
সৌম্য উঠে দাঁড়িয়ে সাধনের দিকে হাত বাড়িয়ে কুশলাদি করে। ছোট করে বলে,
– জ্বি।
সাধন হেসে বলে,

– সৃজার আব্বু আঙ্কেল আমাদের সাথে তোমাদের গল্প অনেক আগে থেকেই করতো। তোমরা এসেছ শুনে আমরা দেখা করতে চলে আসলাম।
সৌম্য মৃদু হাসলো। সোহা, সাধনের সাথে পরিচিত হয় তারা দুইভাইবোন। তাদের মাঝে শুধু বয়সের মিল ছাড়া আর কোনো মিল নেই। সোহা, সাধন দু’জনেই অনেক ফর্সা। আর ভীষণ চঞ্চল। কিন্তু সৌম্য, সন্ধ্যা এর বিপরীত।
সোহা ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে সেই যে সন্ধ্যার পাশে গল্প করতে বসেছে। এরপর থেকে একটু-ও ওঠেনি। মেয়েটি এতো হাসায়, সন্ধ্যা না চাইতে-ও হেসে ফেলে। সৃজা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অবশেষে সন্ধ্যাকে একটু হলে-ও স্বাভাবিকভাবে পাচ্ছে সোহার জন্য। সৌম্য সন্ধ্যাকে হাসতে দেখে, স্বাভাবিক হয়ে ইশারায় অনেককিছু বোঝাতে দেখে ভীষণ শান্তি পায়। তার এই পাতানো মামার ঋণ সৌম্য কখনো শোধ করতে পারবে না। না চাইতে-ও তার কতশত সমস্যা সমাধান করে দেয়।

রাত তখন প্রায় আটটা। সাধন কোথা থেকে এসে সোহার মাথায় একটি চাটি মা’রে। সোহা কথার মাঝে মাথায় ব্য’থা পেয়ে মাথা ডলতে ডলতে বা হাতে সাধনের পেট বরাবর একটি ঘুষি মা’রে। সাধন রে’গে বলে,
– আমি তোর বড় ভাই, আবার মা’রলি আমাকে?
সোহা-ও রে’গে বলে,
– আর তুমি যে এসে মা’রলে তার বেলায়?
সাধন দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– বাড়ি যাবি না? কত রাত হয়েছে দেখেছিস? কখন থেকে আন্টি খেতে ডাকছে।
বলতে বলতে সোহার মাথায় আরেকটা চাটি মা’রে। সোহা আবার-ও সাধনকে মা’রতে গেলে সন্ধ্যা সোহাকে আটকে দেয়। ইশারায় না করে। সোহা কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে,
– তুমি নিষেধ করছ? তুমি জানো এই ভাইটা আমাকে মে’রে মে’রে আমার জীবনটা পুরো ভেজে দিয়েছে।
সৌম্য এগিয়ে এসে বলে,
– তোমরা কি সবসময়-ই এরকম মা’রা’মা’রি কর?
সাধন একটু আমতা আমতা করে বলে,
– তুমি চেনো না একে। ওর থেকে বাঁদর-ও ভালো আছে।
সোহা ভেঙচি কাটে। সৌম্য কি বলবে বুঝলো না। সে তো পদে পদে শুধু অবাক হচ্ছে। সে সন্ধ্যাকে একটু টাচ-ও আস্তে করে, তার বোন যেন ব্য’থা না পায়। আর এই ছেলে তার বোনকে দিব্যি মে’রে যাচ্ছে।

রাতের খাবার শেষে সোহা আর সাধন আরও বেশ কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করে সবার সাথে। কখন ১০ টা বেজে গিয়েছে গল্পের তালে কেউ বুঝতে পারেনি। সৃজার বাবা সাধনকে থাকতে বললে সে জানায়, আজ কোনোভাবেই থাকা যাবে না, তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। সোহা-ও রেডি হয়ে আসে। হঠাৎ মাথায় কিছু আসতেই সৃজার বাবার কাছে গিয়ে বলে,
– আঙ্কেল, সন্ধ্যাকে আমার সাথে নিয়ে যাই? প্লিজ আঙ্কেল!
সৃজার বাবা কিছু বলার আগেই সৌম্য বলে,
– না, আমার বোনু কোথাও যাবে না।
সোহা অসহায় চোখে তাকায়। সন্ধ্যার ভাই কেমন অদ্ভুদ! তার ভাই তো তাকে দু’চোখে সহ্য করতে পারেনা। আর এদিকে সন্ধ্যার ভাই সন্ধ্যাকে দু’চোখের আড়াল হতে দেয় না। হাহ! সন্ধ্যার কি কপাল! এসব ভাবনা রেখে সোহা সন্ধ্যার হাত ধরে সৌম্য’র সামনে এসে বলে,

– ভাইয়া আপনার বোনকে অনেক যত্নে রাখবো। প্লিজ যেতে দিন।
সৌম্য বিরক্ত হয়ে সন্ধ্যাকে টেনে তার পাশে দাঁড় করিয়ে বলে,
– কোনো দরকার নেই। আমি আমার বোনুর যত্ন করতে পারি।
সৌম্য’র কথা শুনে সৃজারা সব হাসছে। এক বোন পা’গ’লার কাছে এই সোহা কিসব ভুলভাল আবদার করছে। সোহা সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে,
– সন্ধ্যা তোমার ভাইকে বোঝাও প্লিজ! তোমাকে আমি অনেক কিছু রান্না করে খাওয়াবো।
সন্ধ্যা সোহার কথায় হেসে ফেলল। মনে হচ্ছে সে ছোট বাচ্চা, তাকে খাবারের লোভ দেখিয়ে যেতে বলছে। ইশারায় বলে,

– তোমরা আজকে যাও, আবার এখানে আসবে কেমন?
সন্ধ্যার বোবা কথা সোহা বুঝতে পেরে মন খারাপ করে বলল,
– ওহ, তুমি-ই আমার সাথে যেতে চাইছ না? তোমাকে আমি আমার বোন ভাবলে-ও তুমি ভাবতে পারছ না।
সন্ধ্যা মন খারাপ করে তাকালো। মেয়েটি ভীষণ ভালো। কয়েক ঘণ্টার পরিচয়ে মনে হচ্ছে কত যুগের চেনা। সন্ধ্যা তার ভাইকে ডেকে ইশারায় বোঝায়,
– ভাইয়া আমি যাই ওর সাথে?
সৌম্য সাথে সাথে বলে ওঠে,
– তুই আবার আমাকে রেখে চলে যেতে চাইছিস বোনু?
সন্ধ্যা অসহায় চোখে তাকালো ভাইয়ের দিকে। সে যেদিকেই যাচ্ছে, সবাই তাকে ভুল বুঝছে। সৃজার বাবা হেসে বলে,

– সৌম্য চিন্তা কর না। সাধন আর সোহা সন্ধ্যার অনেক আপ্যায়ণ করবে। সোহা মায়ের সন্ধ্যাকে খুব পছন্দ হয়েছে।
সোহা খুব খুশি হলো। সৌম্য মানবে না। পা’গ’ল না-কি! সে রাতে ঘুমাতেই পারবে না তার বোন অন্যকোথাও গেলে। সাধন এগিয়ে এসে বলে,
– সৌম্য তুমি-ও আমাদের সাথে চলো। আমাদের ওখানটা তোমাদের ঘুরিয়ে দেখাবো।
সৃজার বাবা-ও সাধনের সাথে একমত। অচেনা, অজানা কারো বাড়ি যেতে সৌম্য যদিও ভীষণ ইতস্ততবোধ করছিল, কিন্তু সন্ধ্যার দিকে চেয়ে রাজি হলো। সন্ধ্যা সোহার সাথে খুব সুন্দর মিশে গিয়েছে। তার জীবনে চাওয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম চাওয়া, তার বোনু ভালো থাকুক। একারণে সৌম্য রাজি হয়।
এরপর সকলে রেডি হয়ে সাধনদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সাধন, সৌম্য আগে আগে হাঁটছে, সোহা, সন্ধ্যা আর সৃজা পিছে পিছে হাঁটছে।
ঘড়িতে প্রায় ১০:৩০।

আকাশ মাত্র ভানুগাছ গ্রামে এসে নেমেছে। মেইন রাস্তা থেকে গাড়ি আর ভেতরদিকে আসেনা। বিরক্ত হলো সে। কোন অজপাড়া গ্রাম এটা কে জানে। গাড়ি সাইড করে রেখে মেইন রাস্তা থেকে কাঁচা রাস্তায় নেমে পড়ে। চারিদিকে কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশ পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্লাশ জ্বালিয়ে রাস্তার দিকে তাক করে হাঁটতে থাকে। বাম পাশটায় পাঞ্জাবির সাথে কি যেন বেঁধে যাওয়ায় আকাশ দাঁড়িয়ে গিয়ে বামদিকে ফিরে তাকায়।
তখন-ই আকাশের পাশ দিয়ে সৌম্য, সাধন পাস করে যায়। পিছু পিছু সন্ধ্যা, সোহা আর সৃজা আকাশের পাশ দিয়ে পাস করতে গিয়ে সন্ধ্যা আকাশের ডান বাহুর সাথে ধাক্কা খেয়ে ঠাস করে পড়ে যায়। রাস্তাটি ছোট, একসাথে তিনজন আবার পাশে আকাশ দাঁড়িয়ে থাকায়, সন্ধ্যা আকাশের সাথে বেঁধে গিয়েছে। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা-ও যায় না। সন্ধ্যা কোমরে ব্য’থা পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে নিয়েছে।
আকাশ বিরক্ত হলো। পাঞ্জাবি ছুটাতে পেরে সে আর এখানে দাঁড়ালো না। যে পরার পরেছে, তার মাথায় আপাতত সন্ধ্যা ঘুরছে। সে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে তবে দম নিবে। পায়ের গতি বাড়িয়ে দ্রুতপায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
এদিকে সন্ধ্যাকে পরে যেতে সোহা দ্রুত সন্ধ্যার পাশে বসে বলে,

– হায় হায় পড়লে কিভাবে?
সৃজা ফোনের আলো ধরেছে। সোহা সামনে তাকালে দেখল একটি পাঞ্জাবি পরা ছেলে গটগট পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রা’গ হলো তার। কিছু বলতে নেয়ার আগেই সৌম্য দৌড়ে এসে বলে,
– তোমরা আমার বোনুকে ফেলে দিয়েছ কেন?
সোহা আর সৃজা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারা আবার কখন ফেলে দিল সন্ধ্যাকে? সৌম্য সন্ধ্যাকে ধরে ধরে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– বোনু কোথাও ব্য’থা পেয়েছিস?
পিছন থেকে সাধন বলে,

– তুমি এতো হাইপার হও কেমনে ভাই?, মানুষের সোনা হারিয়ে গেলে-ও এতো হাইপার হয় না।
সন্ধ্যা ঝাপসা চোখে সৌম্য’র পানে চেয়ে আছে। যদি-ও অন্ধকার, তবুও একটু-আধটু যা দেখতে পেল। সন্ধ্যার মনে হয়, তার ভাই এতো ভালো কেন?
সৌম্য সন্ধ্যার কাপড় ঝেড়ে দিয়ে বা হাতে আগলে নিয়ে সামনে এগোতে এগোতে বলে,
– সোনা হারালে সোনা পাওয়া যায়। আমার বোনু হারালে কোথায় পাবো ওকে?
সন্ধ্যা ডান হাতে সৌম্য’র পিছন থেকে হাত পিঠে রাখে। বা হাতে আবেগী অশ্রু মুছে নেয়। পিছন পিছন সাধন, সোহা, সৃজা এগিয়ে যায়। সৃজা যদি-ও অবাক হয়না তেমন। এইকয়দিনে এদের ভাই-বোনের সম্পর্কে ধারণা হয়েছে তার। তবে সাধন আর সোহা ভীষণ অবাক হয়। সৌম্যকে যত দেখছে শুধু অবাক-ই হচ্ছে তারা।

আকাশ একদম সন্ধ্যাদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সৌম্য’র ফোনের লাস্ট লোকেশন এই ঘর। বাড়িটা কাঠের। একটু অদ্ভুদ টাইপ। আকাশ হাত দিয়ে দরজায় নক করে। সৃজার বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, সৌম্য’দের ঘরের সামনে একজনকে দেখে এগিয়ে এসে বলে,
– কে ওখানে?
আকাশ উল্টো ঘুরে ফোনের লাইট তাক করে। আকাশের দিকে-ও সৃজার বাবা টর্চ লাইট তাক করে আছে। আকাশ চোখমুখ কুঁচকে তাকায়। সৃজার বাবা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় আকাশকে দেখে। খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস তার অনেক আগে থেকে। আর সেই সূত্রে আজকের পেপারে বড় করে লেখা ছিল, আজকে আকাশ নওয়ান ঢাকা উত্তর মহানগরের সভাপতি হিসেবে সিলেক্ট হয়েছে। আকাশের ছবি বড়সড় করে দেয়া ছিল। ভদ্রলোকের আকাশকে চিনতে অসুবিধা হয়না। এগিয়ে এসে বলে,

– তোমার নাম আকাশ নওয়ান না?
আকাশ অবাক হয়। এই লোক তাকে কিভাবে চেনে? এরপর তার অবস্থানের কথা মনে পড়লে বুঝল। আজ অনেক জায়গায় হঠাৎ হঠাৎ সবার জিজ্ঞাসায় সে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। এসব রেখে বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– সন্ধ্যা কোথায়?
সৃজার বাবা আগের চেয়ে-ও বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। এই ছেলে সন্ধ্যাকে খুঁজছে কেন? সৌম্য, সন্ধ্যার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপারে সে অবগত। আকাশের সন্ধ্যার খোঁজ তার কাছে মোটে-ও ভালো লাগলো না। বরং ভ’য় পেল সে। আকাশ নিজেকে শান্ত করে বলে,
– আপনার বাসা হয়তো পাশে। সন্ধ্যা আর সৌম্যকে ডেকে দিন। আর্জেন্ট।
সৃজার বাবা সাথে সাথে বলে,

– এই নামের কেউ থাকে না এখানে।
কথাটা বলে সে উল্টো ঘুরে তার ঘরের দিকে যায়। আকাশ জহুরি চোখে চেয়ে আছে সৃজার বাবার দিকে। মনে হচ্ছে লোকটি পালিয়ে গেল। আকাশ কিছু বলতে গিয়ে-ও বলল না। উল্টো ঘুরে ঘরের দরজায় খেয়াল করলে দেখল, বাইরে থেকে দরজা আটকে রাখা। তবে তালা দেয়া নয়। আকাশ একটু-ও সময় ব্যয় না করে দ্রুত দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলে। তার ফ্রেন্ড তাকে এই লোকেশন-টিই দিয়েছে। সন্ধ্যা, সৌম্য এইঘরেই নিশ্চয়ই থাকে। হয়তো বাইরে গিয়েছে। এসব ভাবনা থেকে দরজা খুলল।
ওদিকে সৃজার বাবা দরজা খোলার শব্দ পেয়ে দ্রুত এগিয়ে আসে। আকাশ ঘরের ভেতর গিয়ে ফোনের ফ্লাশ চারিদিকে ঘোরায়। সুইচবোর্ড চোখে পড়লে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। পিছন থেকে সৃজার বাবা বলে,
– এসব কি ধরনের অ’স’ভ্য’তা’মি? রাত-বিরেতে অচেনা মানুষদের ঘরে এভাবে ঢুকছ কেন? আমার এখানে তোমার ক্ষ’ম’তা চলবে না।

সৃজার বাবার কথা আকাশের কানে গিয়েছে কি-না! তার দৃষ্টি ঘরের কোণায় টেবিলের উপর। আকাশ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল, টেবিলের কোণায় একটি শুকনো বকুল ফুলের মালা। পাশে-ই সেই সেইম ছবি, যেটা সন্ধ্যা নিজ হাতে এঁকে তাকে দিয়ে এসেছিল। আকাশ কাগজটি, আর বকুলের মালা দু’টো-ই ডান হাতে তুলে নেয়। এই দু’টি জিনিস সন্ধ্যা তাকে দিয়েছিল, আকাশ আজ-ও রেখে দিয়েছে। সন্ধ্যা-ও রেখে দিয়েছে এগুলো?
আকাশ দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘরের আশেপাশে তাকায়। সন্ধ্যা এই ঘরে নেই কেন? ঘরের কোণায় সন্ধ্যার একটি পরিচিত শাড়ি দেখতে পেয়ে আকাশ ঢোক গিলল।
সৃজার বাবা রে’গে বলে,

– আমি তোমাকে কিছু বলছি।
আকাশ চোখ বুজল। এই লোকটি তাকে মিথ্যা বলছে কেন? দ্রুত উল্টো ঘুরে শ’ক্ত কণ্ঠে বলে,
– সন্ধ্যা কোথায়?
সৃজার বাবা ঢোক গিলে বলে,
– এই নামে এখানে কেউ থাকে না।

অন্তঃদহন পর্ব ১৮

আকাশ তীক্ষ্ণ চোখে ভদ্রলোকটির দিকে তকায়। এই লোকের মুখ দেখেই বোঝা যায়, কিছু লুকাচ্ছে।
আকাশ পা দিয়ে একটি চেয়ার তার সামনে এনে চেয়ারে বসে বাম পায়ের উপর ডান পা তুলে রাখে। বা হাত ডান পায়ের উপর রেখে সৃজার বাবার দিকে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– ভুলে-ও মিথ্যা বলবেন না আঙ্কেল। আমি বাবার বয়সী লোকদের সম্মান করি। আপনি সন্ধ্যাকে আনুন, নিজের সম্মান বাঁচান।

অন্তঃদহন পর্ব ২০