হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ২৩

হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ২৩
সানা শেখ

চোখের কোণে জমে থাকা পানি টুকু আঙ্গুলের সাহায্যে মুছে নেয় মায়া। আলভী মায়া কে টেনে নিজের দিকে ফেরায়।
“কি হয়েছে কাদঁছো কেন?”
আলভীর হাত সরিয়ে দিতে দিতে বলে,
“কোথায় কাদছি?”
“এই যে এখনো চোখের কোণে পানি জমে আছে।”
“এমনি ছাড়ুন। কত বার বলতে হয় ছোঁবেন না আমাকে?”
“আমি ছুঁয়ে দিলে খারাপ লাগে? আমার ছোঁয়া ভালো লাগে না তোমার?”
মায়া কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দুই চোখ আবার পানিতে টুইটুম্বর হয়ে গেছে। আলভী কিছু সময় মায়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
কিছু না বলে নিঃশব্দে এগিয়ে যায় ডোরের কাছে।
আলভী চলে যেতেই মায়া ঘাড় ঘুরিয়ে ডোরের দিকে তাকায়। দুই চোখ বেয়ে আবার টুপ টাপ গড়িয়ে পড়ে পানি। এখন ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে জানালার দিকে ঘুরে বসে।

বিকেল সাড়ে পাঁচ টা।
আলভী নিজের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে গিটারের সুর ভেসে আসছে। মায়া গিটার বাজাতে পারে?
ডোর খোলে নিঃশব্দে। ভেতর থেকে লক করে ডোরের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। মায়া ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে গিটার বাজাচ্ছে। আলভী রুমে এসেছে বুঝতেই পারেনি বোধহয়। বুঝতে পারলে অন্তত একবার মুখ তুলে তাকাতো।
“ভ্রমর কইও গিয়া…….
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে…………..
অঙ্গ যায় জলিয়ারে ভ্রমর কইও গিয়া।
ভ্রমর কইও গিয়া……
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে…………..
অঙ্গ যায় জলিয়ারে ভ্রমর কইও গিয়া।
কইও কইও কইওরে ভ্রমর কৃষ্ণ রে বুঝাইয়া,
কইও কইও কইওরে ভ্রমর কৃষ্ণ রে বুঝাইয়া।
মুই রাধা মইরা যাইমু রে……..
কৃষ্ণ হারা হইয়া রে…
ভ্রমর কইও গিয়া..।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গান বন্ধ করতেই হাত তালি দেয় আলভী। চমকে ওঠে মায়া। ঘাড় ঘুরিয়ে আলভীর দিকে তাকায়। আলভী বাহবা দিয়ে বলে,
“আমার বউ দেখি আমার চেয়েও ভালো গান গায়। এই কন্ঠে তো যাদু আছে। কিন্তু বউ তুমি এমন একটা গান কেনো গাইছো?”
মায়া কিছু না বলে আলগোছে কোল থেকে গিটার নামিয়ে বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে।
“পালিয়ে গেল?”
আলভী বেডে বসে। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট পেরিয়ে যায় মায়া বের হয় না।
প্রায় পনেরো মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বের হয় মায়া।
আলভীর দিকে একবার তাকিয়ে সোফায় বসে। মায়ার চোখ মুখ ফুলে গেছে। ওয়াশরুমের ভেতরে এতক্ষণ কাদলো বোধহয়।

আলভীর ভীষণ খারাপ লাগে। ওর ভুলের জন্য আজ এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ওর জন্যই মায়া আজ ওর থেকে এত দূরে। সেই আট বছর বয়স থেকে মানুষের কটু কথা শুনতে হয়েছে যখন বিয়ে, সম্পর্ক মানে বুঝতই না কিছু।
ওই নিজেরই বা দোষ কোথায়? যে কোনো ছেলের সাথে অমন ঘটনা ঘটলে সে রাগ করবেই। সেখানে আলভী হয়তো একটু বেশিই রাগ রিয়েক্ট করে ফেলেছিল। আর সেই রাগ জেদ ধরে রেখেছিল এত গুলো বছর পর্যন্ত।
সোফায় বসে থাকা মায়ার দিকে তাকায়। খুলে রাখা গোছানো চুল গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে চুপ চাপ।
আলভী বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে।
এই দূরত্ব কত দিনে মিটবে?

রাতের খাবার খাওয়ার জন্য মায়া কে নিয়ে নিচে নেমে আসে আলভী। সারা দিন পর এখন বের হয়ে সকলের সামনে আসলো মায়া। আলতাফ মাহমুদ মায়ার মুখের দিকে তাকান। আলভী বাপ আর বউ দুজনের দিকে নজর বুলায়।
খাবার খাওয়ার জন্য ডাকলে সকলেই খাবার খাওয়ার জন্য ডাইনিং রুমে এসে চেয়ার টেনে বসে।
ঐশী রহমান সকলের প্লেটে ভাত বেড়ে দিয়ে আলভীর প্লেটে দেওয়ার জন্য উদ্যত হন। আলভী মাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“আম্মু তোমাকে তো দুপুরে ভাত নিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেলাম রাতে আমি রুটি খাব।”
“এখন সকলের সাথে ভাত খাও। সকালে রুটি বানিয়ে দেব। এখন এক বেলা ভাত খেলে কিছু হবে না।”
“এক বেলা? বাড়িতে এসেছি আজ এগারো দিন। তার মধ্যে আট দিন তিন বেলা ভাত খাইয়েছো। এভাবে তেল-মসলা যুক্ত তরকারি আর তিন বেলা ভাত খেয়ে খেয়ে অল্প দিনে আমি হ্যান্ডসাম বয় থেকে ভুঁড়ি ওয়ালা কাকু হয়ে যাব।”

আলভীর কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে। মাহিদ বলে,
“তুমি তো কাকুই ভাইয়া।”
“এখন তো হ্যান্ডসাম কাকু, কত দিন পর ভুঁড়ি ওয়ালা কাকু হয়ে যাব।”
মাহির বলে,
“আমি তো প্রায় দিন তিন বেলা ভাত খাই, আমার ভুঁড়ি কই? তিন বেলা ভাত খেয়েও তোর চেয়ে চিকন আমি।”
“তুমি তিন বেলায় যা খাও, সেগুলো এক বেলায় আমাকে খাওয়ায়।”
মেহবুবা মেহের বলেন,
“এত গুলো বছর পর বাড়িতে এসেছো, এই টুকু তো খেতেই হবে।”
“হ্যাঁ, খাইয়ে খাইয়ে ফুটবল বানিয়ে দাও তারপর এই বাড়ির বাইরে বের করার সময় যেন গেট ভেঙ্গে বের করতে হয়।”

আলভীর কথা আর বলার ধরণ দেখে আরেক দফায় হেসে ওঠে সবাই।
ঐশী রহমান আলভীর প্লেটে ভাত বেড়ে দেন। মেহবুবা মেহের মচমচে ইলিশ মাছ ভাজি তুলে দেন প্লেটে। আলভী মা আর শাশুরি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একযোগে যেন খাবারের প্রতিযোগিতা শুরু করেছে দুজন মিলে। আসার পর থেকেই দিনে তিন বেলা নতুন নতুন মেন্যু রান্না করে আর ওকে সেসব গিলতে হয়। না করেও পাড় পায় না। মায়ের ইমোশনাল কথা শুনে আর নাও করতে পারে না। এত গুলো বছর পর ছেলে কে কাছে পেয়েছেন আদর যত্ন করে তো খাওয়াবেনই।
নিজের ফিটনেস নিয়ে ভীষণ সচেতন আলভী। কার্ব ক্যালোরি হিসাব করে। মিষ্টি-তেল-মসলা ওর ডায়েটে নেই বললেই চলে। এখানে আসার পর থেকে তেল-মসলা যুক্ত খাবার খেলেও মিষ্টি খায় না। মিষ্টি ওর একদম অপছন্দ ছোট বেলা থেকেই।

বাড়ির ছেলে এত গুলো বছর পর বাড়িতে এসেছে ওকে কি এখন শুকনো রুটি, ব্রেড, টোস্ট, ওটস খাইয়ে রাখবে নাকি? কখনোই না। একটু স্বাস্থ্য বাড়লে, ভুঁড়ি বাড়লে, ফ্যাট জমলে কিছু হবে না। জার্মানিতে ফিরে জিম, জুম্বা, এক্সারসাইজ করে ঠিক করে নেবে ভুঁড়ি। তখন তো এভাবে এই সব খাবার রান্না করে খাওয়ানোর জন্য কেউ থাকবে না।
আলভী ভাত মাখতে মাখতে বলে,
“সকালে কিন্তু আর ভারী খাবার খাব না।”
নাহার বেগম বলেন,
“এক মাসের জন্য এসেছো, আরো চার দিন আমরা যা দেব তাই খেতে হবে। পরের পনেরো দিন তোমার যা খেতে ইচ্ছে হবে তাই খাবে।”
“এটা কেমন নিয়ম? এই নিয়ম আমি মানি না। পনেরো দিন খাইয়ে পনেরো মাসের পরিশ্রমের মাধ্যম তৈরি করে দিতে চাইছো তাইনা?”

মেহবুবা মেহের হেসে বলেন,
“তুমি যা খাবে তাই দেওয়া হবে আগামী কাল থেকে। এমনিতে রোজ সকালে আমরাও ভারী খাবার খাই না কেউ। তুমি আসার পর থেকেই এমন হচ্ছে।”
“আমি স্পেশাল কেউ নাকি? আমার জন্য তোমরা নিজেদের রুটিন চেঞ্জ করে ফেলেছো দেখছি।”
“একটু তো স্পেশাল বটেই।”
“হুম, বাড়ির ছেলে আবার মেয়ের জামাই। আদর যত্ন তো একটু বেশিই হবে। ভুল টা আমারই, আমিই ভুলে গিয়েছিলাম।”
সবাই আলভীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“এভাবে তাঁকিয়ে আছো কেন সবাই? খাবার খাও ঠান্ডা হয়ে গেল।”
“আম্মু জামাইয়ের প্লেটে আরো কিছু দাও। জামাই টা না খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে শুটকি হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।”
বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায় আলভী। মাহির একটা হাসি দিয়ে খাওয়ায় মনোযোগী হয়।

দ্রুত নিজের খাওয়া শেষ করে মায়া।
“মায়া আরো কিছু নে।”
মায়ের কথা শুনে সেদিকে নজর দেয় মায়া।
“খাব না খাওয়া শেষ।”
তাড়াহুড়ো করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
আলভী কোনো রকমে হাত ধুতে পানি না খেয়েই ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
ততক্ষণে মায়া সিঁড়িতে উঠে গেছে। আলভী দৌড়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসে।
পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। আলভী কে দেখে নিজেও দৌড় শুরু করে।
দৌড়ে রুমে এসে ডোর লক করবে তখনই ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায় আলভী।

“পায়ের জোর আছে দেখছি।”
“এখানে এসেছেন কেন?”
“বউ কে নিতে।”
“যাব না আমি ওই রুমে।”
“যাবে না?”
“না।”
হঠাৎ করেই আলভীর রূপ বদল হয়। চোখে মুখে রাগী কাঠিন্য ভাব ফুটে ওঠে। রাগী গম্ভীর স্বরে বলে,
“যাবে কি না?”
হঠাৎ এভাবে রূপ বদল হতে দেখে মায়া একটু ঘাবড়ে যায়।
“কি বলছি কানে যাচ্ছে না?”
“যাব না।”
“যাও রুমে।”

এমন জোরে ধমক দিয়ে বলে যে ভয়ে কেঁপে ওঠে মায়া।
“তোমার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে কোনো লাভ নেই। তাড়াতাড়ি ওই রুমে চলো নয়তো আমার আসল রূপ দেখাতে বাধ্য হব।”
মায়ার হাত ধরে টেনে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে আসে। জোর করে নিজের সাথে না রাখলে এই মেয়ের মধ্যে জীবনেও মায়া জন্মাবে বলে মনে হয় না। সকাল থেকে রাত অব্দি থেকেই কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আর দুদিন এভাবে রাখতে পারলেই হলো। না ভালোবেসে যাবে কোথায়? ভালোবাসতেই হবে।
রুমে এসে হাত ছেড়ে দিয়ে ডোর লক করে দেয় আবার। দুপুরের ঘটনা স্মরণ করে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য নিচে নিয়ে গিয়েছিল। আর রুমে খাবার নিয়ে আসলে খাবার নষ্টও হয়।
মায়া বেডের উপর বসে চোখ মুছতে শুরু করে। আলভীর নিজের উপর নিজেরই রাগ হয়। তখন রেগে কেনো ধমক দিল অত জোরে? এখন কাদঁছে।

অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে দাঁড়ায় মায়ার সামনে।
“সরি আর জীবনেও ধমক দেব না। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে আজকে।”
মায়া কিছু না বলে বেড থেকে নেমে বেলকনিতে চলে আসে। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকায়। মেঘলা আকাশে অল্প কিছু তারা টিপ টিপ করে জ্বলছে। শীতল বাতাস বইছে বাইরে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় ভালো ভাবে। বড় বড় শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।
মায়ার পাশে এসে দাঁড়ায় আলভী। মায়া দেখে তবে মুখে কিছু বলে না।
“আমি অনেক খারাপ একজন মানুষ?”
আলভীর মুখের দিকে তাকায় মায়া।
“কথা বলছো না কেন? আমি অনেক খারাপ একজন মানুষ তাই না?”
মায়া বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,

“এমন কেনো মনে হচ্ছে?”
“এই যে আমার জন্য তোমাকে এত কষ্ট পেতে হয়েছে?”
“আপনার জন্য পেতে হয়েছে?”
“হুম।”
“ভুল ধারণা।”
“ভুল ধারণা কেন?”
“আপনার জন্য আগে কষ্ট পাইনি আমি, আপনার জন্য কষ্ট তো পেয়েছি পরে। যেদিন আপনি ফিরে আসলেন। আমি আগের পরিস্থিতির জন্য কখনোই আপনাকে দোষী ভাবীনি।”
“আমার ফিরে আসাতে তুমি কষ্ট পেয়েছো?”
“আপনার ফিরে আসায় কষ্ট পাইনি আমি। কষ্ট তো পেয়েছি ফিরে আসার কারণ জানার পর।”
আলভীর চেহারায় অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে। কিছু সময় চুপ হয়ে থেকে বলে,
“তুমি মাফ করবে না আমাকে?”

“আপনাকে আমি আগেই বলেছি আজকে আবার বলছি, আপনি যদি ওই একটা কারণ বাদে অন্য কোনো কারণে বাড়িতে আসতেন আর আমার সাথে সংসার করতে, বাকি জীবন পাড় করতে চাইতেন আমি নির্দ্বিধায় নিজেকে বিলিয়ে দিতাম আপনার কাছে। আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলাম অনেক গুলো দিন, দীর্ঘ দিন অপেক্ষায় ছিলাম আপনার জন্য। সব সময় ভাবতাম আপনি একদিন ফিরে আসবেন আমার জন্য। এই বাড়ির প্রত্যেক টা মানুষ আমার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছিল আপনি আমার হাসবেন্ড। বিয়ে হয়েছিল বুঝতামও না কিছু তখন। বড় হতে হতে আপনাকে না দেখেও আপনাকে ভালোবেসেছি। পথ চেয়ে থাকতাম আপনার ফেরার আশায়।

আপনি তো ফিরলেন তবে আমাকে তালাক দেওয়ার জন্য। যখন জানতে পারলাম আপনি কেনো ফিরে এসেছেন আর কি কি বলে এসেছেন। বিশ্বাস করুন তখন নিজেকে এত ছোট মনে হচ্ছিল যা কল্পনার বাইরে। আমার তখন কত কষ্ট হচ্ছিল কিভাবে বোঝাবো আপনাকে? আপনি অনুভব করতে পারবেন না সেই কষ্ট। আমি এত কাল যার অপেক্ষায় অবশেষে সে এসেছে আমাকে ভালবাসতে নয় সারা জীবনের জন্য দূরে ঠেলে দিতে। আমার মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে কেউ আমার হৃৎপিণ্ড টা টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে। হঠাৎ আপনি নিজের মত পরিবর্তন করলেন। যখন দেখেছেন মায়া আগের মায়া নেই। তখন আপনার মনে হয়েছে মায়ার সাথেই সংসার করবো। আমি যদি সেই আগের মায়া থাকতাম আপনি দুই মিনিট না ভেবেই আমাকে সারা জীবনের জন্য দূরে ঠেলে দিতেন।”

মায়া থেমে যায়, বড় বড় করে শ্বাস টেনে নেয় আবার। কথা বলতে গিয়ে কন্ঠস্বর কাপছে এখন।
“আপনি বলতে পারবেন আপনি আমার সৌন্দর্য, পরিপাটি রূপ দেখে ভালোবাসেন নি?”
মায়া কে টেনে নিজের দিকে ফেরায় আলভী। বেলকনিতে থাকা লাইটের আলোয় দুজনের চেহারাই স্পষ্ট। মায়ার চোখে চোখ রেখে বলে,

“আমাকে একটা কথা বলো, যে কোনো ছেলে মেয়ে প্রেমে পড়ে কি দেখে? কেউ নিশ্চই নিজের অপছন্দের বা বিরত স্বভাবের কারো প্রেমে পড়ে না বা ভালোবাসে না প্রথমে। কেউ যখন প্রেমে পড়ে তখন নিশ্চই গোছানো, পরিপাটি, সুন্দর চেহারার অধিকারী কারো প্রেমেই পড়ে। হতে পারে সে কৃষ্ণবর্ণের বা শ্যামবর্ণের কিন্তু মায়াবী অবশ্যই। তুমি কি কখনো নিজের অপছন্দের বা নিজের বিপরীতে চলা কোনো ছেলের প্রেমে পড়বে? ধরো তুমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছো রাস্তায় দুটো ছেলে দাড়িয়ে আছে একজন গোছানো, পরিপাটি, স্মার্ট তবে শ্যামবর্ণের বা কালো। আরেক জন ফর্সা, গায়ের পোশাক নোংরা, অপরিস্কার, অপরিপাটি, মাথার চুল উস্কখুস্ক এলোমেলো কাকের বাসার মতন। এখন দুজন ছেলের মধ্যে তোমার নজর আটকাবে কার দিকে?

তুমি যদি প্রেমে পড়ো ওই দুজনের মধ্যে কার প্রেমে পড়বে? তোমাকে যদি বলা হয় ওই দুজনের মধ্যে থেকে একজন কে জীবন সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করতে তুমি কাকে করবে? নিশ্চই শ্যামবর্ণের ছেলে টা কে নির্বাচন করবে বা ওর প্রেমেই পড়বে। কারণ ফর্সা ছেলেটার তুলনায় শ্যামবর্ণের ছেলে টা কে বেশি ভালো দেখাচ্ছে, সে গোছানো, পরিপাটি, স্মার্ট। তুমি যদি সারা পৃথিবী ঘুরে দেখো তাহলে প্রতি একশো জন মানুষের মধ্যে নিরানব্বই জন মানুষ খুঁজে পাবে যারা নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে ওই শ্যামবর্ণের ছেলে টা কে নির্বাচন করবে। তাহলে তুমি কি বলবে তারা সবাই সৌন্দর্যের পূজারী নয়? তুমি সৌন্দর্যের পূজারী না? ছেলে হোক বা মেয়ে সবাই প্রথমে সৌন্দর্য দেখেই প্রেমে পড়ে। সৌন্দর্য যে শুধু ফর্সা সাদা চামড়ায় তা কিন্তু নয়।

আমার বেলায় কেন এই কথাটা উঠছে তাহলে? হ্যাঁ আমি প্রথম তোমার সৌন্দর্য, পরিপাটি রূপ দেখেই প্রেমে পড়েছি, ভালোবেসেছি। একবার কাউকে মন থেকে ভালোবেসে ফেললে পরে তার সব রকম রূপ কেই ভালোবাসা যায়, মেনে নেওয়া যায়। রাস্তার সেই ফর্সা এলোমেলো স্বভাবের ছেলে টা কেও কেউ একজন বিয়ে করবে, হয়তো নিজের মতো করে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করবে যেটা আমি করিনি, এখানে আমার ব্যর্থতা।”
একটু চুপ করে থেকে বলে,

“পৃথিবীতে কি তোমার চেয়ে সুন্দরী, গোছানো, পরিপাটি মেয়ে নেই? অবশ্যই আছে, তুমি রূপ সৌন্দর্যের দিক থেকে তাদের কাছে নগণ্য। তবে আমার কাছে তুমি পৃথিবীর সেরা সুন্দরী নারী। তোমাকে আমার কাছে যতটা সুন্দরী আর মায়াবী মনে হয়েছে-হচ্ছে অন্য কোনো মেয়ে কে দেখে এমন মনে হয়নি কোনো দিন। আমি যেখানে এত গুলো বছর ছিলাম, এখন কাজ করছি সেখানে আমার চারো পাশে সারা দিন সুন্দরী স্মার্ট মেয়েদের আনাগোনা। বলা যায় মেয়েদের মাঝখানেই সারা দিন পাড় করতে হয় আমাকে। আমি যদি সৌন্দর্যের পূজারী হতাম তাহলে কেনো তাদের ভালোবাসতে পারিনি? কেনো তাদের ডাকে সাড়া দিতে পারিনি? আমার বিজনেস পার্টনারের মেয়ে, তাকে তুমি দেখলে মেয়ে হয়েও নজর ফেরাতে পারবে না। গত তিন বছর ধরে আমার পেছনে পড়ে আছে। তিন বছরে হাজার বার বলে ফেলেছে সে আমাকে ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়। সে এত আগুন সুন্দরী হওয়ার পরেও আমি তার মধ্যে সেই মায়া দেখতে পাইনি যা তোমার মধ্যে দেখেছি। আমি যদি সৌন্দর্যের পূজারীই হতাম তাহলে নিশ্চয়ই ওই মেয়ের প্রেমে পড়তাম। ওই মেয়ের প্রেমে না পড়ার জন্য কোনো কারণ নেই।

আবার তাকে বিয়ে করার জন্য কিন্তু আমার চেয়েও বড় বড় বিজনেস ম্যান, হ্যান্ডসাম ছেলেরা পাগল হয়ে আছে। ওই মেয়ে তাদের বিয়ে করতে রাজি না, সে আমাকেই বিয়ে করবে। কারণ সে আমার মধ্যে হয়তো এমন কিছু দেখেছে যা অন্য কারো মধ্যে দেখেনি।”
মায়া বাইরের দিকে তাঁকিয়ে শুনছে আলভীর কথা। আলভী আবার বলতে শুরু করে,

“যখন আমাদের বিয়ে হয় তখন আমার বয়স মাত্র ষোলো আর তোমার আট। তখন তুমি আমার সবচেয়ে অপছন্দের একজন মানুষ। ওই সময় টায় আমি অন্য একজন মেয়ে কে ভালোবাসি, হোক সেটা আবেগ বা অন্য কিছু। আমি তো জানতাম আমি তাকে ভালোবাসি। তখন সবাই কি করলো! আমাকে জোর করে ধরে অপছন্দের মেয়ে মানে তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিল। তখন আমি ছোট হলেও কিন্তু অতটাও অবুঝ না। ভালো মন্দের পার্থক্য বুঝতাম ভালো ভাবেই। এমন একটা ঘটনা ঘটার পর আমার রাগ হওয়া টা কি অস্বাভাবিক ছিল? আমার জায়গায় তুমি থাকলে কি করতে? তুমি তো আমাকে ভালোবেসেও মেনে নিতে পারছো না এখন। তাহলে আমি ভালো না বেসেও সবচেয়ে অপছন্দের একজন কে কিভাবে মেনে নেব, ভালোবাসবো? হ্যাঁ আমার রাগ বেশি, জেদ বেশি।

এই রাগ, জেদ আর এই পরিবারের জন্য তো কম কষ্ট পেতে হয়নি আমাকে। তুমি তো পুরো পরিবারের সাথেই ছিলে। আর আমি! পরিবার থাকা সত্ত্বেও এতিমের মতন জীবন যাপন করেছি। দিনের পর দিন একা একা থেকেছি পরিবার আপন জন ছেড়ে। তোমার কথা স্মরণ হলে এলোমেলো হয়ে যেতাম। ভালো লাগতো না, অস্থির হয়ে উঠতাম। বারো বছর পেরিয়ে তেরো বছর চলছে। এত গুলো দিন আমি একটা রাত নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারিনি। আব্বু যখন বললো আমি যেন তোমাকে তা লাক দিয়ে দেই, তখন আমিও ভেবে দেখলাম। আমার মনে হচ্ছিল এসব থেকে মুক্তি পাওয়া দরকার আর তোমাকেও মুক্ত করা দরকার।

এমন একটা সম্পর্কের মধ্যে দুজনের আটকে থাকার কোনো মানেই হয় না। ভালোবাসা থাকলেও দূরত্ব বাড়তে বাড়তে, না দেখতে দেখতে মায়া চলে যায়, ভালোবাসা বিলীন হয়ে যায়। সেখানে তো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ছিল না, না ছিল মায়া। আমি কখনো বোঝার বা ভাবার চেষ্টাই করিনি তোমার কথা। যদিও কখনো ভেবেছি তখন তোমার সেই ছোট বেলার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠতো।

হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ২২

আমার মন বিষিয়ে উঠতো আবার। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি, সব ভুল আমার, সব দোষ আমার। কিন্তু তার পরেও আমিই তোমাকেই চাই। তুমি যেমন এতকাল কষ্ট পেয়েছো তেমন আমিও পেয়েছি। কষ্ট পাওয়ার ধরন আলাদা হলেও পেয়েছি তো। তুমি যা বলো, যেই দোষ বা শাস্তি দাও সবই মেনে নেব। তার পরেও আমি তোমাকেই চাইবো।”

হৃদয় মাঝে হঠাৎ তুমি পর্ব ২৪