ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৯
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
প্রণয় রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তার প্রাণটার দিকে চেয়ে ছিল। তার নিঃস্ব জীবনের একমাত্র সুখ, প্রিয়তা—
প্রনয় গভীর চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন ছিল। হঠাৎই অনুভব করল, কেউ তার টি-শার্ট ধরে টানাটানি করছে।
প্রণয় ভ্রু কুঁচকালো। সামনে থেকে নজর সরিয়ে পিছন ফিরে নিচে চাইল। তন্ময়, কিউট মুখভঙ্গি করে তার টি-শার্টের কোণা ধরে টানাটানি করছে। প্রণয় হেসে তন্ময়ের মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
— “কি হয়েছে, পিচ্চু?”
তন্ময় বলল,
— “কোলে নাও, বড় দাদান।”
প্রণয় পুনরায় হেসে তন্ময়কে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
— “কি ব্যাপার, ছুট্টু? এখনো যাওনি কেন?”
তন্ময় গাল ফুলিয়ে কাঁদো-কাঁদো চোখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রণয় ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “আবার কি ব্যাপার? নতুন কিছু চাই, মনে হচ্ছে?”
তন্ময় ঝটপট প্রণয়কে জড়িয়ে ধরল। প্রণয় বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “গতিক তো সুবিধার নয়। কি চাই, বল?”
তন্ময় ধীরে ধীরে বলল,
— “বললে তুমি বকবে না তো, দাদান?”
প্রণয় হেসে গাল টেনে দিয়ে বলল,
— “আমাদের ছোট্ট কর্তার কে কি আমি বকতে পারি? বল, কি চাই?”
তন্ময় একটু সাহস জুটিয়ে প্রণয়ের বাঁ গালে টুপ করে আরেকটা চুমু খেয়ে বলল,
— “তুমি আর বড় আপুও আমাদের সাথে চলো না, দাদান! অনেক মজা হবে।”
প্রণয়ের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, সেখানে খানিকটা গম্ভীরতা এসে ভর করল। তবুও আগের মতোই স্বাভাবিক গলায় বলল,
— “আমার কাজ আছে, বাচ্চা। তুই তোর বড় আপুকে নিয়ে যা।”
তন্ময় এবার আবারও দুঃখী মুখ করে বলল,
— “তোমাকে ছাড়া যাব না, দাদান। ওরা সুযোগ পেলেই আমার মান-সম্মান শেষ করে দেয়!”
প্রণয় ভাবলো, এতটুকু ছেলের আবার মান-সম্মান! সে হাসবে না কাঁদবে, বুঝতে পারল না।
প্রণয় এসব ভাবতে না ভাবতেই তন্ময় ডান গালে আরেকটা চুমু খেয়ে বলল,
— “ওহ দাদান! চলো না।”
প্রণয় হাসলো। চশমার কোণা ঠিক করে দিয়ে বলল,
— “বাচ্চা! আমার কাজ আছে, না হলে যেতাম। জেদ করে না, তোর আপুকে নিয়ে যা।”
তন্ময় মুখ ছোট করে ফেললো, তার নাক ফুলে উঠেছে। তার সব ভাই-বোনগুলো আস্ত এক একটা শয়তানের নাতি-নাতনি। সুযোগ পেলেই তাকে নিয়ে মজা করে। তাই ওই বেয়াদবগুলোকে সে মোটেই পছন্দ করে না। তবে বড় দাদান, মেজো দাদান আর বড় আপু তাকে অনেক ভালোবাসে। তাই সেও তাদের খুব ভালোবাসে। এজন্যই সে সবার সঙ্গে যেতে চাইছে।
প্রণয় দেখলো, তন্ময় ভাবভালো না কেঁদে দেবে-দেবে ভাব। কয়েক সেকেন্ড গড়ানোর আগেই প্রণয়ের ভাবনাকে সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে তন্ময় “বে… বে…” করে কেঁদে দিল। আর একবার যদি তন্ময় নিজের মাইক বাজানো শুরু করে, তবে শিকদার বাড়ি না কাঁপানো পর্যন্ত থামে না।
প্রণয় শান্তনা দিয়ে আদর করে বললো, “জেদ করে না, ভাই।”
কিন্তু প্রণয়ের কথা তার কান অব্দি পৌঁছালোই না সে আরও জোরে তন্ময় হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। প্রণয় পড়লো ফাঁপরে। পুনরায় সান্ত্বনা দিয়ে পুনরায় বললো, “চুপ কর, ভাই। কাঁদিস না।”
কিন্তু ‘দ্য গ্রেট তন্ময় শিকদার’-এর কান্না থামানো এত সহজ নয়। এসব কথা তন্ময়ের কান অব্দি পৌঁছালে তবে তো থামবে। এমন পরিস্থিতিতে এবার প্রণয়েরও কাঁদতে ইচ্ছে হলো।
তন্ময় “বে… বে…” করে প্রণয়ের টি-শার্টে নাকের পানি, চোখের পানি মুছতে লাগলো। পাক্কা দশ মিনিট কাঁদার পর প্রণয় আর সহ্য করতে পারলো না। বাধ্য হয়ে বললো, “ঠিক আছে, ভাই। থাম। এবার থাম, যাব আমি ।”
প্রণয়ের সম্মতি-বাণী তন্ময়ের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে যতটা সময় নিল, তার অর্ধেক সময়ও লাগলো না তন্ময়ের কান্না থামাতে। তার কান্না পুরো ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেল।
প্রণয় ভাবলো, “শিকদার বংশকে কোনো প্রতিভাই পিছে ফেলতে পারেনি!”
কান্নার তোপে তন্ময়ের ফর্সা মুখ টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। চোখের পানিতে চশমা ঝাপসা হয়ে গেছে। প্রণয় চশমা খুলে নিজের টি-শার্টে মুছে আবারও পরিয়ে দিলো। তারপর বললো, “চল।”
তন্ময় তো মহা খুশি!
প্রণয় তন্ময়কে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। পাঁচ মিনিটের কথা বলে পনেরো মিনিটেও তন্ময় ফেরেনি দেখে নিচে অপেক্ষমাণ জনতা বিরক্ত হয়ে উঠলো। অরণ্য, রাজের কানে কানে বললো,
— “সেঝদা কি দরকার এই লেটে-লতিফকে নিয়ে যাওয়ার? চলো, ওকে ফেলেই চলে যাই!”
রাজও ওর মতো নিচু স্বরে বলল,
— “ওর জন্যই তোর যাওয়া হচ্ছে। ওকে ফেলে গেলে বড় দাদান পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে ফেলবে! ভাই, তোমার জন্য শহীদ হতে পারবো না, সরি।”
চিত্রা, ইনায়া, পূর্ণতা, পরিণীতা, প্রিয়তা—ওরা সবাই তন্ময়ের অপেক্ষায় বসে নেই। কারণ তারা জানে, তন্ময় গিয়েছে মানে এত সহজে আসবে না। তাই সবাই ড্রয়িং রুমের সোফা দখল করে বসে পড়েছে।
শুদ্ধ কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। তার পরনে কফি কালার টি-শার্ট আর ব্ল্যাক ট্রাউজার। চুলগুলো একটু এলোমেলো—এই সুদর্শন চেহারায় কোনো মেয়ে না পটে থাকতে পারে! তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে।
তাকে দেখে প্রিতম বিনয়ের সুরে হেসে বলল, “ভাইয়া, তুমি-ও চলো না আমাদের সাথে!”
শুদ্ধও হেসে জবাব দিল, “নিশ্চয়ই যেতাম, কিন্তু আমার কিছু জরুরি কাজ পড়ে গেছে। নাহলে আমিও অবশ্যই জয়েন করতাম।”
প্রিতম হালকা হাসল। শুদ্ধ সোজা সদাফের দিকে তাকাল। সদাফও ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। শুদ্ধ বাঁকা হেসে ধীর পায়ে সদাফের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কফির মগে চুমুক দিয়ে ধীরে বলল, “অল দ্য বেস্ট, ব্রাদার!”
সদাফ আন্তরিকভাবে হেসে শুদ্ধকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ!”
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
সদাফ জবাব দিল, “তুমি যে আইডিয়া দিয়েছ, ওটা আমার মাথায় কোনো দিনও আসত না।”
শুদ্ধ বাঁকা হেসে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “ধন্যবাদ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি জানি, তুমি পরিণীতাকে কতটা ভালোবাসো। ভালেই, তুমি আমার শত্রু-বন্ধু হও না কেন, আমার তো আর শত্রু নও। আর তাছাড়া, তোমার ভালোবাসায় তো কোনো ভেজাল নেই—একদম ‘পিওর লাভ’। আর ভালোবাসার মানুষদের মিলিয়ে দিতে আমার ভালোই লাগে। আমি আমার ভালোবাসাকে কাছে পাচ্ছি না বলে কি অন্যরাও পাবে না? যাই হোক, তুমি আমার থেকে সব সময় সব রকম সাহায্য পাবে। তোমার যখন যেমন সমস্যা হবে, চলে এসো আমার কাছে—বাকিটা আমি সামলে নেব।”
সদাফ কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল শুদ্ধের দিকে। শুদ্ধর জন্য সদাফের মনে হালকা খারাপ লাগা কাজ করল। সে ভাবল, “একটা মানুষের একতরফা ভালোবাসা এতটা শক্তিশালী হতে পারে? সত্যি, শুদ্ধকে না দেখলে বুঝতাম না। হয়তো শুদ্ধ প্রণয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে, কিন্তু এখন বুঝি—এটা শুধু নিজের ভালোবাসাকে অন্যের না হতে দেওয়ার জন্য। ভালোবাসাকে নিজের করার জন্য অন্যের থেকে পাকাপারি দূরে সরিয়ে দিয়েছে—এটা অন্যায় নয়। ভালোবাসা আর যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছু নেই। ভালোবাসাকে প্রাপ্ত করার জন্য যে কোনো সীমা অতিক্রম করা যায়। জানি না, ভবিষ্যতে কী হবে। স্রষ্টা ওদের ভাগ্যে কী লিখে রেখেছেন—তিনিই জানেন। শেষ পর্যন্ত প্রিয়তা যারই হোক, যেই পাক—অপরজন যেন নিঃশেষ না হয়ে যায়।”
শুদ্ধ একবার সদাফের ব্যথিত মুখের দিকে, আরেকবার পরিণীতার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বাঁকা হেসে মনে মনে বললো, “Plan A successful, now start Plan B.”
শুদ্ধ একবার শান্ত দৃষ্টিতে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে সোফায় বসে থাকা শুভ্র সুন্দর নারীর দিকে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড পর চোখ নামিয়ে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো, “Wish you all the best, guys. Enjoy!”—বলে সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় চলে গেল।
কেটে গেছে আরও দশ মিনিট। সমুদ্র আর ধৈর্য ধরতে পারলো না বিরক্ত হয়ে প্রীতমকে বললো,
— “মেজো দাদান, আর দুই মিনিট দেখবো। এর পরে ও যদি না আসে, তাহলে ফেলেই চলে যাব। তুমি কিছু বলতে পারবে না!”
প্রীতম শান্ত গলায় বললো,
— “এতো কম ধৈর্য্য কেন তোর?”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রীতম সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল। প্রীতমকে চুপ হয়ে যেতে দেখে সমুদ্রও তার দৃষ্টির অনুসরণ করে পেছনের সিঁড়ির দিকে তাকালো। প্রণয় আর তন্ময় নেমে আসছে।
তন্ময়ের চোখে-মুখে প্রবল উত্তেজনা—আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের চাপ স্পষ্ট। তন্ময়ের কথার শব্দ শুনে মেয়েরাও চলে এলো।
প্রিয়তা সামনে আসতেই তার হৃদপিণ্ড থেমে গেল। নয়ন স্থির হয়ে গেল এক নিষিদ্ধ পুরুষের ওপর।
প্রণয় সাদা রঙের ফর্মাল শার্টের সাথে কালো ফর্মাল প্যান্ট পরে আছে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো। সাদা শার্টের ভাঁজে-ভাঁজে জিম করা পেশির বহুল হাত স্পষ্ট। শার্টের উপরের দিকে দুইটা বোতাম খোলা ফর্সা বুকের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। হাতে Rolex ব্র্যান্ডের ঘড়ি। হাতের ফর্সা ত্বক ভেদ করে ভিতরের সবুজ শিরা দৃশ্যমান । গম্ভীর, সুদর্শন চেহারায় প্রখর ব্যক্তিত্বের চাপ স্পষ্ট।
প্রণয়কে দেখে প্রীতম খুশি হয়ে বললো,
— “তুমি ও যাবে, দাদা?”
প্রণয় শান্ত স্বরে বললো,
— “হুম।”
প্রিয়তা দেখলো, কথা বলার সাথে সাথে প্রণয়ের গলার Adam’s apple নড়ছে। উফ্! প্রিয়তার হৃদপিণ্ডে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। সে নিজেকে সামলাতে দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। নিজের মনকে শাসিয়ে বললো, “নিয়ন্ত্রণে থাকো! সে নিষিদ্ধ, তার প্রতি এত কিসের ঝোঁক?”
অরণ্য ডেকে বললো,
— “এই সাকচুন্নি! তোর কি যাওয়ার ইচ্ছে নেই? তাহলে তুই থাক, আমরা চলে যাচ্ছি।”
প্রিয়তার ধ্যানভঙ্গ হলো। সে দেখলো, সবাই সদর দরজা পর্যন্ত চলে গেছে। কিন্তু প্রণয় এখনো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সে এক পলক প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে সদর দরজার দিকে হাঁটা দিল।
প্রণয় তার বোকা হরিণী-চোখের গভীরতা মেপে হাসলো। তিনটি গাড়ি নেওয়া হয়েছে। প্রথম গাড়িতে প্রীতম, প্রেম, প্রণয় আর অরণ্য। দ্বিতীয়টিতে সদাফ, পরিণীতা, প্রিয়তা, চিত্রা আর ইনায়া। তৃতীয়টিতে থিরা, থোরি, তন্ময়, প্রেরণা আর রাজ।
সদাফ গাড়িতে উঠতে উঠতে পরিণীতা কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
— “শর্তের কথা মনে আছে তো, ফুলপরি?”
চুপচাপ। আমর পাশের সিটে বসো।
পরিণীতা তার দিকে অসহায় চোখে তাকালো। সদাফ এসব পাত্তা না দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। পরিণীতা ও অগত্যা তার পাশে সিটে বসলো। সদাফ মুগ্ধ হাসলো নিজের ফুলপরির দিকে তাকিয়ে।
৪৫ মিনিট পর তারা পৌঁছালো রায়পুরের দক্ষিণ সীমান্তে। রায়পুরের দক্ষিণে এই বিশাল মেলা সাজের মেলা নামে পরিচিত, যা প্রতি পাঁচ বছর পরপর একবার হয়। এই মেলার মাঠ প্রায় ১৬০ স্কয়ার ফিট জায়গা জুড়ে বিস্তৃত, বা হয়তো আরও বড়।
তারা সবাই গাড়ি থেকে নামলো। সামনের অতিরিক্ত লোক সমাগম দেখে পরিণীতা আর প্রিয়তা ভয় পেয়ে গেলো। এত লোকের ভিড়ে একবার হারিয়ে গেলে এই রাতের বেলায় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এই বিশাল মেলায় শুধু রায়পুর নয়, তার আশেপাশের আরো আঠারোটি গ্রামের লোকও আসে। এই মেলার সূচনা করেন স্বয়ং সাদমান শিকদার।
প্রণয় একবার তীক্ষ্ণ নজরে প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো। তার রক্তজবাকে গাভড়ে যেতে দেখে, সে ধীরে পায়ে প্রিয়তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আলতো হাতে প্রিয়তার ডান হাতের তুলতুলে নরম আঙুলগুলো নিজের আঙুলের ভাঁজে নিয়ে নিলো।
হঠাৎ এমন সুপরিচিত, অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। তড়িৎ গতিতে সে নিজের হাতের দিকে তাকালো। তার ছোট্ট হাতটা শক্ত, সামর্থ্য পুরুষালি হাতে মুঠোয় আবৃত। সে মাথা তুলে সামনের মানুষটার চোখের দিকে তাকালো।
প্রণয় ওর দিকেই চেয়ে ছিল। সে চোখের ইশারায় বললো, “একদম ভয় পাবি না, আমি তো আছি।”
প্রিয়তার মনের সমস্ত ভয় নিমেষেই গায়েব হয়ে গেল। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। হ্যাঁ, এটাই ওর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। সবচেয়ে ভরসার জায়গা, শান্তির জায়গা, সুখের ভালোবাসার জায়গা, আবদারের জায়গা— এই একটা মানুষ তাকে নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও আগলে রাখে।
প্রণয় হাত টেনে প্রিয়তাকে আরও একটু কাছে টেনে নিলো।
এদিকে, পৃথমও চুপিচুপি ইনায়ার হাতটা ধরে রেখেছে। ইনায়া লজ্জায় খানখনেই লাল, নীল, বেগুনি হয়ে যাচ্ছে।
অরণ্য প্রেরণাকে বললো, “মুটকি, তুই এদের সবার বড়ো, তাই এই পুচকেগুলোকে তুই দেখে রাখবি।”
অরণ্যের কথা শুনে প্রেরণা রেগে গিয়ে ওর হাতে জোরে চিমটি কাটলো।
অরণ্য চিৎকার দিয়ে উঠলো। তার চিৎকার শুনে সবাই ওদের দিকে তাকালো।
রাজ, অরণ্যের মাথায় গাট্টা মেরে বললো, “একদম কোনো বান্দরামি করবি না,!”
তখন পৃথম বলল, “আমাদের একসাথে থাকা সম্ভব নয়। তাই কেউ কাউকে খুঁজে না পেলে দ্রুত ফোন করবে।”
সবাই সম্মতি জানিয়ে লোকেদের ভিড়ে হারিয়ে গেল, শুধু পরিণীতা দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। মনে পড়লো কিছুদিন আগের কথা—সে কত কিছুই না বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আবিদকে রাজি করিয়েছিল এই মেলায় একসঙ্গে ঘুরতে আসার জন্য।
কিন্তু আজ পরিণীতা আসলেই বুঝতে পারছে না, সে কোন অপরাধের শাস্তি পাচ্ছে! তার মাস্টারমশাই কেন এমন করছেন? পরিণীতা মনে মনে বললো, “আপনি কি জানেন না, মাস্টারমশাই? আপনার ছাড়া আপনার অ্যাঞ্জেল কতটা অসহায়! সে থাকতে পারে না আপনাকে ছাড়া! আপনার সাথে কথা না বলতে পারলে তার দম বন্ধ লাগে। আপনি তো আমার সমস্ত সুখ-শান্তির আধার, মাস্টারমশাই। আপনি কষ্ট দিলে আপনার অ্যাঞ্জেল বাঁচবে কীভাবে?”
পরিণীতা একা একা দাঁড়িয়ে আছে দেখে সাদাফ তার কাছে এসে বলল, “কি ভাবছ, ফুলপরী?”
পরিণীতা চমকে উঠল। সাদাফ অবাক হয়ে ভাবল, মেয়েটা সারাক্ষণ কী এত ভাবে যে কথা বললেই চমকে ওঠে?
পরিণীতা দৃষ্টি নামিয়ে বলল, “কিছু না।”
ঠিক তখন পাশ দিয়ে একজন লোক হেঁটে যাওয়ার সময় আচমকা পরিণীতার পিঠে ধাক্কা দিল। হয়তো ইচ্ছে করে দেয়নি, ভিড়ের চাপে লেগে গেছে। কিন্তু ধাক্কার ভারসাম্য সামলাতে পারল না পরিণীতা তাল হারিয়ে সাদাফের ওপর আছড়ে পড়ল। তার মাথা ঠেকল সাদাফের বুকে।
সাদাফ থমকে গেল। কী ঘটল, সেটা বুঝে উঠতে পারল না। পরিণীতা দ্রুত সরে দাঁড়াল, কিন্তু ততক্ষণে সাদাফের হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম। এই মেয়েটির সামান্য স্পর্শও যেন তার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়!
পরিণীতা মাথা নিচু করে বলল, “সরি ভাইয়া।”
সাদাফ প্রশস্ত হেসে কিছু বলল না, শুধু পরিণীতার দিকে এগিয়ে গেল।
পরিণীতা মাথা তুলে তাকাল। সাদাফ এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, এত মানুষের ভিড়ে ধাক্কা লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আজ প্রথমবারের মতো কোনো রকম দ্বিধা-সংকোচ ছাড়াই সাদাফ পরিণীতার কোমল, তুলতুলে হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
পরিণীতা চমকে উঠে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “কি করছেন, ভাইয়া?”
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বলল, “একদম চটফট করোনা, ফুলপরী। দেখছ না, কি ভিড়! কখন কে গায়ের ওপর উঠে আসবে, বলা যায় না!”
পরিণীতার মন কেমন যেন অস্বস্তিতে ভরে উঠল। সে আবার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “কিছু হবে না, আমি সামলে নেব।”
সাদাফ এবার একটু অধিকার দেখিয়ে বলল,
— “তাই তাহলে? এখুনি যে পড়ছিলে!”
পরিণীতা কিছু বলতে পারল না। সাদাফ আবার বলল,
— “আমাদের শর্তের কথা ভুলে গেলে চলবে না! মেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি আমার, তাই আমি যা ইচ্ছে, তাই করবো।”
পরিণীতা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সাদাফের দিকে। ওসব মায়াময় দৃষ্টিকে গুরুত্ব না দিয়ে সাদাফ তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল।
প্রিয়তার মন আবারও ভালো লাগার মৃদু মন্দ বাতাসে ভেসে যাচ্ছে। মনের মধ্যে রঙিন প্রজাপতিরা ডানা মেলে উড়ছে। চোখ-মুখ উচ্ছ্বাস আর আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। চারপাশের সবকিছু তার কাছে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। তার মনের সাগরে পুনরায় সুখের জোয়ার এসেছে।
প্রিয়তার মন প্রিয়তাকে প্রশ্ন করল,
— “কী ব্যাপার? তুই তো আসতেই চেয়েছিলি, তাহলে এখন এত লম্ফ-জম্ফ করছিস কেন?”
প্রিয়তা দায়সারা ভাবে জবাব দিল,
— “জানি না, শুধু জানি খুব ভালো লাগছে।”
প্রিয়তার মন আবারো খোঁচা দিয়ে বলল,
— “জানি, জানি! তুই যে কতটা বেহায়া, তুই কোনোদিনও ভালো হবি না।”
প্রিয়তার মুখ তেতো হল।
কিন্তু প্রিয়তা ওসব পাত্তা দিল না। তার হাতটা এখন প্রণয়ের বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয়। আজ প্রিয়তার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। হোক না সেটা মিথ্যে, হোক না সেটা ক্ষণিকের— তবুও ভীষণ ভালো লাগছে।
সত্যিকারের ভালোবাসা মনের কঠিন থেকে কঠিন অসুখের একমাত্র ওষুধ। কাউকে যখন কেউ ভালোবাসার সকল সীমানা পেরিয়ে তীব্রভাবে চায়, আর তাকে পায় না বা হারিয়ে ফেলে— সেই মানুষগুলো সেই হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার জন্য কাঙাল হয়ে যায়। তীব্র আসক্তির দহনে জ্বলতে থাকে প্রতিনিয়ত ।
প্রিয়তারও বর্তমানে সেই অবস্থা!
প্রণয় মুগ্ধ চোখে দেখছে তার রক্তজবার দিকে। আজ কতদিন পর আবারো তাকে এভাবে প্রাণ খুলে হাসতে দেখল। প্রণয় তাকে নিজের আরেকটু কাছে আগলে নিলো, যেন কেউ ধাক্কা দিতে না পারে।
প্রিয়তা হঠাৎ প্রণয়ের হাত ঝাঁকিয়ে ডাকল,
— “প্রণয় ভাই!”
প্রণয় সাথে সাথেই উত্তর দিল,
— “হুঁ?”
প্রিয়তা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
— “ওই দেখুন, সবাই ফুচকা খাচ্ছে!”
প্রণয় তার আঙুল অনুসরণ করে সামনে তাকালো। একটা দোকানের সামনে ভীষণ জটলা। প্রণয় স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল,
— “দেখে লাভ নেই। তোকে এসব খেতে দেব না।”
প্রিয়তা মুখটা এইটুখানি করে ফেলল। কিন্তু প্রণয় ওসবে পাত্তা দিল না।
প্রিয়তা আবার অনুনয়ের সুরে বলল,
— “প্লিজ, চলুন না, প্রণয় ভাই!”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখল, তার প্রিয় সমুদ্র-নীল চোখে ওইসব ছাই পাশ অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা। সে প্রিয়তার চোখের মায়াময় দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই বলল,
— “বাড়ি যাওয়ার পর রাতেই তোকে বানিয়ে দেব, hygienic way তে। এগুলো কত unhygienic, ছিঃ!”
প্রিয়তার মন খারাপের মেঘে ভালোলাগার আকাশ ঢেকে গেল , সে ফুচকার দোকানের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
প্রণয় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। সে জানে, মেয়েরা প্রচণ্ড জেদি— এখন না খেতে দিলে পাক্কা এক সপ্তাহ গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। তাই সে প্রিয়তার হাত ধরে এগিয়ে গেল ফুচকার স্টলের দিকে।
প্রণয়কে ফুচকার দিকে এগোতে দেখে প্রিয়তার মন খারাপের মেঘ কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যেই উধাও হয়ে গেল। মনটা আনন্দে লাফিয়ে উঠল।
প্রণয় ফুচকাওয়ালাকে হাজার টাকার একটি চকচকে নোট এগিয়ে দিয়ে বলল,
— “এক প্লেট ফুচকা দিন!”
লোকটা অবাক হয়ে বলল,
— “এক প্লেট ফুচকার দাম তো হাজার নয়, বাবা, মাত্র তিরিশ টাকা!”
প্রিয়তা এক প্লেট ফুচকার জন্য এত টাকা দিতে দেখে চোখ গোল গোল করে ফেলল।
প্রণয় স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
— “জানি, এটা ফুচকার বিল নয়।”
লোকটা আরও অবাক হয়ে বলল,
— “তাহলে কিসের?”
প্রণয় আগের মতোই গম্ভীর স্বরে বলল,
— “আপনি ভালো করে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে, হাত স্যানিটাইজ করে, গ্লাভস পরে, সম্পূর্ণ অন্য পরিষ্কার পাত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ভাবে কম ঝাল দিয়ে এক প্লেট বানিয়ে দিন।”
প্রিয়তা আর ফুচকাওয়ালা দু’জনেই থ হা করে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
প্রিয়তা অবাক কণ্ঠে বলল,
— “এত ঝামেলা করার দরকার কী? অন্যরাও তো খাচ্ছে!”
প্রণয় গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— “খাওয়ার ইচ্ছে না থাকলে বল, চলে যাচ্ছি।”
প্রিয়তা লাফিয়ে উঠে বলল,
— “না, না! যাবেন না। যে ভাবেই হোক, খাব আমি!”
প্রণয় গম্ভীর দৃষ্টিতে প্রিয়তার নীল চোখের গভীরে চাইল। প্রিয়তাকে এত খুশি দেখে তার বুকের দহন জালাটা কিছুটা শান্ত হলো।
দশ মিনিট পর লোকটা গ্লাভস পরা হাতে এক প্লেট ফুচকা প্রিয়তার সামনে রাখল।
প্রিয়তা ফুচকা দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠল।
প্রণয় তার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝল— এক প্লেটে কিছুই হবে না।
তাই সে লোকটার হাতে আরও দুই হাজার টাকা দিয়ে বলল,
— “আরও দু’প্লেট দেবেন।”
লোকটা ভীষণ খুশি হয়ে টাকা নিয়ে বলল,
— “এখনই দিচ্ছি, সাহেব!”
প্রিয়তা বিশাল বড় করে হাঁ করে প্রথম ফুচকাটা মুখে দিল।
প্রিয়তা মনে মনে বলল, “এই স্বাদের ভাগ হবে না!” সে চরম তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে নিল। সামনের চেয়ারে বসে থাকা প্রণয় তার বদলে যাওয়া মুখের প্রতিটি অভিব্যক্তি মন দিয়ে দেখল। আজ কতদিন পর তার হৃদয়ে তুষারপাত হচ্ছে।
প্রিয়তা হালুম-হুলুম করে একের পর এক ফুচকা খেয়েই যাচ্ছে। হঠাৎ তার নজর পড়ল প্রণয়ের দিকে। দেখল, প্রণয় ভাই তার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে আছে। প্রিয়তা ভাবল, “প্রণয় ভাইয়ের হয়তো খেতে ইচ্ছে করছে,” আর সে তাকে না দিয়ে খেয়েই চলেছে— এটা ভেবেই কেমন যেন লাগল তার।
সে একটা ফুচকা প্রণয়ের মুখের সামনে ধরে বলল,
— “হা করুন!”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে তেতো মুখে বলল,
— “আমি এসব ছাইপাঁশ খাই না।”
কিন্তু প্রিয়তা তো ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নয়। সে জেদ করেই বলল,
— “প্লিজ, একটা ট্রাই করেই দেখুন। এত্ত মজা! একটা খেলে ফ্যান হয়ে যাবেন!”
প্রণয় শীতল দৃষ্টিতে উচ্ছ্বসিত প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে “হা” করল।
প্রিয়তা খুশিতে আত্মহারা হয়ে প্রণয়কে একটা ফুচকা খাইয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “ভালো না?”
প্রণয় গিলে নিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— “হুম, ভালো।”
প্রিয়তা খুশি হয়ে বলল,
— “আরেকটা দেব?”
কিন্তু এবার প্রণয় স্পষ্ট জানিয়ে দিল ,
— “আমি এসব খাই না। তুই খা।”
প্রিয়তার আর সাধল না। এই ব্যাটা যে একটা খেয়েছে, সেটাই অনেক!
প্রিয়তা তৃতীয় নম্বর প্লেটের শেষ ফুচকাটা মুখে পুরতেই তার নজর আটকাল পাশের টেবিলের দিকে। সেখানে ২০-২২ বছরের সাত-আটজন মেয়ে বসে ফুচকা খাচ্ছে। আসলে খাওয়ার নাম করে তারা প্রণয়কে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে! একজন আরেকজনকে গুঁতো মেরে কিছু একটা বলছে।
প্রণয় যদিও এসব লক্ষ করেনি, কিন্তু প্রিয়তা ঠিকই বুঝে ফেলল। ছেলেরা না বুঝুক, মেয়েরা মেয়েদের মুখ দেখেই মন পড়ে নিতে পারে! ভীষণ হিংসেয় জলে গেল প্রিয়তা। হোক না পুরুষটা নিষিদ্ধ, তাই বলে এতগুলো মেয়ে “হ্যাঁ” করে তাকিয়ে থাকবে?
বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা।
প্রণয় অবাক হয়ে উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে? ঝাল লাগছে? পানি খাবি? আইসক্রিম খাবি?”
কিন্তু প্রিয়তা এসবের কোনো উত্তর দিল না। সে নিজেই প্রণয়ের আঙুলের মাঝে আঙুল গুঁজে শক্তভাবে বলল,
— “খাওয়া শেষ, চলুন এখান থেকে!”
প্রণয় কিছু বলতে চাইল, কিন্তু প্রিয়তা কিছুই শুনল না। টেনে নিয়েই চলে গেল সেখান থেকে।
প্রণয়কে চলে যেতে দেখে মেয়েগুলোর মুখ চুপসে গেল!
সাদাফ আর পরিণীতা বসে আছে একটা টেবিলে। পরিণীতার মনটা ভীষণ খারাপ। চারদিকে এত আলো, এত গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ—সবকিছুই তার অস্বস্তিকর, বিষাক্ত লাগছে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। হৈ-হুল্লোড়প্রিয় মেয়েটা একদম নিভে গেছে। সে একটা বাড়তি কথাও বলছে না, সাদাফ যেদিকে নিয়ে গেছে সেদিকেই গেছে।
এখন তারা একটা টেবিলে বসে আছে। সাদাফ জোর করেই তাকে বড় এক গ্লাস আখের রস খেতে দিয়েছে, কারণ ভীষণ গরম। পরিণীতা সেটা ধীরে ধীরে খাচ্ছে। খেতে খেতেই তার নজর আটকাল দূরে একটা সুন্দর রজনীগন্ধার মালার দিকে।
রজনীগন্ধা আবিদের প্রিয় ফুল। আবিদ তাকে প্রায়ই এই ফুলের মালা কিনে নিজের হাতে চুলে পরিয়ে দিত। মালাটার দিকে তাকিয়ে তার আবার বুক ভেঙে কান্না আসছে।
সাদাফ পরিণীতার দৃষ্টি লক্ষ্য করে সেও তাকিয়ে দেখল। পরিণীতা একদৃষ্টিতে দূরের রজনীগন্ধার মালাটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। সাদাফের মনে হলো, হয়তো পরিণীতার হয়তো মালাটা খুব পছন্দ হয়েছে। তাই সে পরিণীতাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। আখের রসের বিল মিটিয়ে, পরিণীতার হাত ধরে তুলল। বাধ্য মেয়ের মতো পরিণীতা ও উঠে পড়ল।
সাদাফ হেসে তাকে জিজ্ঞেস করল,
— “ফুলপরী, রজনীগন্ধা তোমার খুব পছন্দ, তাই না?”
পরিণীতা অবাক চোখে তাকাল। না, রজনীগন্ধা তার প্রিয় ফুল ছিল না। কিন্তু যেদিন থেকে সে জেনেছে, তার প্রিয় মানুষের প্রিয় ফুল রজনীগন্ধা, সেদিন থেকেই রজনীগন্ধা তার সবচেয়ে প্রিয় ফুল। তার যা কিছু প্রিয়, সবকিছুই পরিণীতা নিজের প্রিয় বানিয়েছে।
পরিণীতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। হাসল সাদাফ। পরিণীতাকে নিয়ে সে ফুলের দোকানের সামনে দাঁড়াল। সাদাফ লোকটার কাছ থেকে মালাটা কিনে নিল।
লোকটা রসিকতার সুরে বলল,
— “খুব সুন্দর মানাইছে, মামা! মামি তো মাশাল্লাহ, চাঁন্দের লাহান সুন্দর।”
লজ্জা পেল সাদাফ। বিব্রত বোধ করল পরিণীতা। সাদাফ ফুলের দাম দেওয়ার সঙ্গে লোকটাকে অতিরিক্ত ১০০ টাকা টিপস দিল।
পরিণীতা জিজ্ঞাসা করল,
— “এটা কেন নিয়েছেন সাদাফ ভাই?”
সাদাফ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
— “আমার ফুলপরীর জন্য।”
সাদাফের বলার ধরন দেখে কেঁপে উঠল পরিণীতা। সে সোজা সাদাফের চোখের গভীরে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, “সাদাফ ভাই কি কোনোভাবে আমাকে পছন্দ করেন?”
সঙ্গে সঙ্গেই তার মন থেকে তীব্র বিরোধিতা আসল। মন চেঁচিয়ে উঠল—
“কি বলছিস? মাথা ঠিক আছে তোর? তোকে সে ছোট বোনের নজরে দেখে, তাই হয়তো এমন বলেছে।”
পরিণীতা, “ও তাই,” বিশ্বাস করল। ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ঘাঁটাল না।
সাদাফ পরিণীতার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। পরিণীতা অবাক হলো। সাদাফ পরিণীতার চুলে হাত দিতে গিয়ে কাঁধে একটু ছোঁয়া লেগে যায় প্রিয়তমার ছোয়াতে সে নিজেই কেঁপে উঠল।
পরিণীতা সরে যাওয়ার চেষ্টা করে বলল,
— “কি করছেন সাদাফ ভাই?”
সাদাফ পরিণীতার দুই হাতের বাহু ধরে আটকে দিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— “আমার যা ইচ্ছে! কারণ, মেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি আমার। তাই আমি যা ইচ্ছে, তাই করব।”
চুপ হয়ে গেল পরিণীতা। সাদাফ যত্নসহকারে মালাটা পরিণীতার দীঘল কেশে পরিয়ে দিল। এতে মেয়েটার সৌন্দর্য যেন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেল।
মনে মনে সাদাফ তার হবু বউয়ের প্রশংসা করে বলল, “মাশাল্লাহ।”
সাদাফ সামনে এসে আবারও পরিণীতার হাত ধরে এগিয়ে চলল।
ওরা চলে যেতেই বেরিয়ে এলো আবিদ। সে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। আবিদকে দেখে মোটেও সুস্থ মনে হচ্ছে না।
এই জমকালো পরিবেশের সামনে তাকে বড়ই ফিকে ফিকে লাগছে, বড়ই বেমানান লাগছে। গায়ে সস্তা রঙচটা একটা টি-শার্ট, চুলগুলো এলোমেলো, শ্যামসুন্দর সুদর্শন মুখে মলিনতার পাহাড়। দুই হাতে ব্যান্ডেজ, চোখ দুটো টকটকে লাল—এক কথায় ভয়ংকর অসুস্থ লাগছে আবিদকে।
পরিণীতা ছয় ঘণ্টায় নিজের হালত খারাপ করে ফেলেছিল, আর আবিদ তেরো ঘণ্টায় নিজের হালত দেখার অবস্থায় রাখেনি। আজ দুপুরে আর সহ্য করতে না পেরে সে পরিণীতাকে ফোন করেছিল—শুধুমাত্র প্রিয়তমার একটুখানি কণ্ঠস্বর শোনার জন্য। নিজের জানটাকে সে নিজের হাতে কত জোরেই না আঘাত করেছে, আর সেই আঘাত করা হাতকেও সে শান্তি দিয়েছে।
কিন্তু পরিণীতা যখন ফোনটা রিসিভ করে বিলাপ করে কাঁদছিল, তখন আর আবিদ নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি—ক্ষমা করে দিয়েছিল তার এঞ্জেলকে।
ফোনটা কেটে দিয়ে ভেবেছিল, আজ রাতে সে জিজ্ঞেস করবে কেন পরিণীতা সেই লোকটাকে অভাবে জড়িয়ে ধরেছিল—সে তো এমন নয়! নিজের খারাপ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবে, পরিণীতাকে দেওয়া তার কথা রাখবে। একসঙ্গে আজকে ঘুরবে।
কিন্তু শিকদার বাড়ির কাজের লোকের কাছ থেকে জানতে পেরেছে, আজ শিকদাররা সবাই এই মেলায় আসবে। তার মানে পরিণিতাও আসবে। তাই সে সোজা এখানে চলে এসেছে। অসুস্থ শরীর নিয়েও সে অনেক কষ্টে নিজের অ্যাঞ্জেলকে খুঁজে বের করেছিল।
কিন্তু তার সঙ্গে পুনরায় কাল রাতের সেই যুবককে দেখে তার পদযুগল থমকে গিয়েছিল। হৃদপিণ্ড যেন তার কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। সে লুকিয়ে পড়েছিল আড়ালে—সবকিছু দেখার জন্য।
কাল রাতের দৃশ্যটা ভুল হতে পারে, কিন্তু আজকের দৃশ্যটা কিছুতেই ভুল হতে পারে না।
লোকটা পরিণীতার হাত ধরে হাঁটছে। কেউ তার পরিকে অনবরত ছুঁয়ে দিচ্ছে—এটা দেখে আবিদের মনে হচ্ছিল, কেউ তার কলিজাটা নৃশংসভাবে ছিড়ে নিচ্ছে।
সবশেষে দোকানদারের ওই কথাগুলো আর লোকটাকে পরম যত্নে তার অ্যাঞ্জেলের চুলে মালা পরাতে দেখে এখন আর তার কোনো সংশয় নেই। আবিদের দেহের যন্ত্রণার চাপিয়ে হৃদয়ের যন্ত্রণা হাজার গুণ ভারী হয়ে গেল। নিশ্বাস নিতেও মনে হচ্ছে, জানটা বুঝি এখুনি বেরিয়ে যাবে। আবিদ একদৃষ্টিতে দুজনের গমনপথের দিকে চেয়ে রইল।
সবকিছু দূরে সরালে, দোকানদার ঠিকই বলেছিল—ওদের দুজনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। লোকটা নিশ্চয়ই অনেক বড়লোক, শিকদারদের সমান-সমানের কেউ হবে। সে সেই লোকটার চোখে তার পরিণীতার জন্য স্পষ্ট এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা দেখেছে, যা মিথ্যা নয়। তার মানে কাল রাতের ঘটনাও মিথ্যা ছিল না।
আবিদ নিজের হাঁটুতে বল পাচ্ছে না। সে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মাঠের পাশে বড় নদীর তীরে গিয়ে ধপ করে বালির ওপর শুয়ে পড়ল। তার চোখের দুই পাশ ভেসে চলেছে অবিরাম গড়িয়ে পড়া নোনা জলের স্রোতে। আজ তার রাগটা কোথাও চাপা পড়ে গেছে—তার প্রাণের থেকেও প্রিয় প্রিয়তমাকে হারানোর ব্যথার কাছে।
সে সহ্য করতে পারছে না এই তীব্র দহনযন্ত্রণা। সে গায়ের সমস্ত জোর লাগিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। আজ আর কেন জানি না কোনো প্রকার রাগ হচ্ছে না, কেমন তীব্র অসহ্য যন্ত্রণায় বুকের বাঁ পাশটা অবশ হয়ে যাচ্ছে। সে মোটেও বাঁচতে পারবে না তার অ্যাঞ্জেলকে ছাড়া, আর এটা শুধুমাত্র মুখের কথা নয়।
সে কোনো রকম ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে লাগল—
“কেন আমার সঙ্গে এমন ছলনা করলে, অ্যাঞ্জেল? আমি তো তোমার কাছে যাইনি। আমি তো তোমাকে ভালোবাসতে চাইনি। আমি তো জানতাম আমাদের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। আমি তো জানতাম তেল আর জল কখনো এক হয় না।
কিন্তু তুমিই তো আমার কাছে এসে আমাকে তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলে। তবে এখন কেন মাঝসমুদ্রে হাতটা ছেড়ে দিলে? তুমি তো কথা দিয়েছিলে, অ্যাঞ্জেল—শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমার হাত ছাড়বে না, সারাজীবন আমার হয়ে থাকবে।”
তবে আজ এত সহজেই ভুলে গেলে? আমি জানি, আমি তোমার যোগ্য ছিলাম না, তবুও তো তোমাকে আমার সবটা দিয়ে নিজেকে উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম। তাহলে তুমি কীসের প্রতিশোধ নিলে? কী জন্য আমাকে নিঃস্ব করে দিলে, প্রিয়তমা? কেন ছলনা করলে? আমি যে তোমাকে এক সেকেন্ডও অন্যের পাশে সহ্য করতে পারবো না, কিছুতেই পারবো না। ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে, অ্যাঞ্জেল। পৃথিবীতে যেই তোমাকে যতটুকুই ভালোবাসুক, আমার মতো করে কেউ চেষ্টা করলেও বাসতে পারবে না।”
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ১৮
এইসব বিড়বিড় করতে করতেই সে চাঁদের আলোয় চিকচিক করা বালির ওপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল। তার এই তীব্র আহাজারি—এই নিশুতি রাত ছাড়া কেউ দেখল না, কেউ শুনল না।