দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৮
তাসফিয়া হাসান তুরফা
আয়মান সাহেবের প্রশ্নে দোলনচাঁপা খুশি হলেও নিশান ভয় পেলো। যার প্রভাব ওর চোখেমুখে ফুটে উঠলো। ওর কণ্ঠস্বর কেপে উঠলো। কাপা গলাতেই প্রশ্ন করলো,
—এসব তুমি কি বলছো?
আয়মান সাহেব আগেকার ন্যায় স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
—যা শুনেছিস সেটাই বলেছি। তুই কি ভেবেছিলি আমি কখনো জানবোনা?
এবার নিশান রেগে হলো। ওর রাগভরা চোখ গিয়ে সবার আগে পড়লো নিশীথের উপর! পুলিশ যেমন ধরা পড়া চোরের দিকে যেভাবে তাকায় সে-ও নিশীথের দিক ঠিক ওভাবেই তাকালো। মনে মনে ফুসে উঠলো নিশীথের উপর ওর বিশ্বাসঘাতকতা দেখে। চোখ মুখ খিচে বেশ হিসহিসিয়ে বললো,
—এই ছিলো তোর মনে? এই দিন দেখার জন্য তোকে বিশ্বাস করে সবকিছু বলেছিলাম?
নিশীথ বেচারা অবাক। একেতো বাবার মুখে ভাইয়ের গোপন কথা ফাস হতে শুনে ও বড্ড বিস্মিত হয়েছে তার মধ্যে ভাইয়ের মুখে এমন কথা! যেখানে ও নিরীহ সেখানে নিশান রীতিমতো ওকেই সন্দেহ করে ওকেই দোষা রোপ করছে! নিশীথ স্তব্ধ স্বরে বলে,
—তুমি আমাকে সন্দেহ করছো, ভাইয়া?
—করবোনা কেন? তোকে ছাড়া আর কাউকে বলিনি আমি এ কথা।
—আমি বাবাকে বলিনি!
—তাহলে কে বলেছে? বাবা কিভাবে জানলো?
—আমি জানিনা!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিশীথ চিৎকার দিয়ে বললো। এবার ওর আওয়াজে নিশানও থেমে গেলো। ও বুঝলো নিশীথ সরাসরি বাবাকে বলেনি বললে এতক্ষণে স্বীকার করতো, কিন্তু তাহলে বাবা জানলো কিভাবে? ও সরাসরি আয়মান সাহেবকে শুধালো,
—তোমায় এ ব্যাপারে কে বললো, বাবা?
আয়মান সাহেব এতক্ষণে নিশানের বেহায়াপনায় চরম বিরক্ত। এতক্ষণ ওর কথা শুনলেও এবার বলদের ন্যায় ওকে প্রশ্ন করায় উনি রেগে বললেন,
—তোর একটুও লজ্জা নেই, তাইনা? এতটা বেহায়া তুই কবে থেকে হলি?
বাবার ধমকে নিশান মাথা নিচু করে। আয়মান সাহেব বললেন,
—কার থেকে জেনেছি সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো তুই আমার থেকে ব্যাপারটা লুকিয়েছিস। আমি ভাবতে পারিনা কর বড় স্পর্ধা হলে তুই এমন কাজ করিস আবার এতকিছুর পরেও আমার সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিস!
নিশান জবাব দিলোনা। তা দেখে আয়মান সাহেব আহত গলায় বললেন,
—এই শিক্ষা দিয়েছিলাম তোকে? তুই বিয়ে করতি আমার তো অসুবিধা ছিলোনা। পছন্দ যখন করেছিস তখন এমন কাউকে করতি যাকে আমরা মেনে নিতে পারি। অন্তত নিজ ধর্মের কাউকে পছন্দ করতি, নিশীথকেই যখন মানা করিনি তখন কি তোকে করতাম? কিন্তু তুই কি করলি? একেতো এতবড় পাপ করেছিস তার উপর কাউকে একটাবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলিনা? শুধু মাসে মাসে টাকা পাঠানোর সময় বাবাকে মনে পড়ে? অন্য সময় বাবার কোনো মূল্য নেই তাইনা!
আয়মান সাহেবের প্রতিটা কথা রুমে উপস্থিত সকলের হৃদয় নাড়িয়ে দিলো। নিশান ভাংগা গলায় বললো,
—পছন্দ কি কেউ ভেবেচিন্তে করে? আমি তো শুরুতে এতকিছু ভেবে প্রেম করিনি। পরে যখন সিরিয়াস হয়েছি তখন অনেককিছু ভেবে দেখেছি যে সবকিছু বিবেচনা করে ক্যাথেরিনকে বিয়ে করা আমার জন্য বেস্ট ডিসিশন হবে!
—কিন্তু তাই বলে একটা বিধর্মী মেয়েকে তুই এ বাড়ির বউ বানিয়ে দিলি? বিদেশ যেয়ে কি ধর্মের শিক্ষাও হারিয়ে ফেলেছিস নাকি তুই? এটা আমাদের ছেলে হতে পারেনা। এমন শিক্ষা তো আমরা দেইনি তোকে!
আসমা বেগম এবার চিল্লিয়ে উঠেন। এতক্ষণ বাবার ধমকে নিশান এমনিতেই কাবু হয়ে ছিলো, এবার মা যোগ দেওয়ায় ও ভয় পেয়ে যায়। সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয়! ঠিক যে ভয়টার কারণে নিশান এতদিন চুপ ছিলো। কাউকে বিয়ের ব্যাপারে জানাতে সাহস পাচ্ছিলোনা আজকে দেশ ছাড়ার আগের মুহুর্তে ঠিক সেই ভয়টাই তার সত্যিতে রুপান্তরিত হয়ে যায়। ও ঘড়িতে দেখে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, এখন দেরি করলে একেতো পরিবার যাবে, ফ্লাইট মিস করলে ওর ভবিষ্যৎ যাবে! নিশান বরাবর যুক্তিতে বিশ্বাসী মানুষ। পরিবার এর প্রতি ওর কিছুটা দূর্বলতা থাকলেও ও নিশীথের মতো নয়। ও জানে জীবনে কিসে প্রায়োরিটি দিলে এগিয়ে যাওয়া যায়। তাই ও তড়িঘড়ি করে বললো,
—মা, আমি তোমাদের রাগ বুঝতে পারছি। তবে চিন্তা করোনা। ক্যাথেরিন বলেছে ও ধর্ম পরিবর্তন করবে। আর যদি নাও করে তবে আমি যতদূর জানি ইসলামে কিছু শর্ত মোতাবেক খ্রিস্টান মেয়েকে বিয়ে করা জায়েজ আছে। আমি সবকিছু ভেবেচিন্তে ঠান্ডা মাথায় ওকে বিয়ে করেছি। আমি মোটেও নিজের সিদ্ধান্তে নাখোশ নই। তোমরাও আমার দিকটা বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ। আজ আর সময় নেই। আমি জলদিই আবার দেশে ফিরবো। তখন ক্যাথেরিন কে সাথে নিয়ে ফিরবো। দেখো আমরা দুজনে মিলে তোমাদের সকল অভিমান তখন ঠিকি দূর করে দিবো। এখন রওনা হই? আমার ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে। থাকো সবাই। আমি আসছি?
দ্রুত গতিতে কথাগুলো বলে নিশান আর কারও জন্য অপেক্ষা করেনা। লাগেজ হাতে নিয়ে গটগট করে চলে যেতে আরম্ভ করে। আয়মান সাহেব একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন বড় ছেলের দিকে, তার মনে হলো নিশান ভীষণ বড় হয়ে গেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ও সবকিছু থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। তিনি সবসময় মনে করতেন তার ও নিশানের মাঝে একটা আলাদা বন্ডিং রয়েছে। নিশান যত কদম সামনে এগিয়ে যাচ্ছে তার ও নিশানের মাঝের সম্পর্ক ততটাই ফিকে হয়ে যাচ্ছে! নিশান বাসার মেইন গেটের কাছে গিয়ে কি মনে করে যেন থামলো। হঠাৎ পেছন ফিরে বললো,
—যাওয়ার আগে লাস্ট একটা প্রশ্নের উত্তর দাও বাবা প্লিজ। আমার বিয়ের কথাটা তোমায় কে বলেছে? নিশীথই বলেছে তাইনা?
আয়মান সাহেব না-বোধক মাথা নাড়লেন। বলবেন না বলবেন না ভেবেও কি মনে করে হঠাৎ শান্ত কণ্ঠে বললেন,
—আমার মেয়ে বলেছে।
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৭
আয়মান সাহেবের কথায় নিশান সহ আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে গেলো। মেয়ে বলেছে মানে?
আয়মান সাহেব চোখ ঘুরিয়ে প্রত্যেকটা মানুষের মুখ দেখলেন। দেখলেন স্তব্ধ দোলনচাঁপার ছলছলে চোখ জোড়া। অতঃপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন,
—দোলনচাঁপা বলেছে!