প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৪

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৪
আদ্রিতা নিশি

পুকুর পাড়ের পাকা শানের ওপরে বসে আছে সাদাত। হাতে তার অতি প্রিয় গিটার। টুংটাং করে কিছুক্ষণ পরপর সুর তুলে আবার থেমে যায়। মনটা কিছুটা ভারাক্রান্ত। দুপুরের খাবারের পর থেকে ইশরার দেখা মেলেনি তার। মেয়েটিকে এক পলকের জন্য দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মন ছটফট করছে, তবু নিজেকে দমন করে রেখেছে।বাড়িতে নিজেকে প্রায় এক সপ্তাহ রুম বন্দী করেও লুকিয়ে লুকিয়ে বহুবার দূর থেকে মেয়েটিকে দেখে নিজেকে শান্ত করেছে। কিন্তু এ মুহূর্তে নিজেকে শান্ত করতে না পেরে গিটার হাতে পুকুর পাড়ে বসে পড়েছে সে।পড়ন্ত বিকেল।

পুকুরের আশেপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দূরের গাছপালার ফাঁকফোকরে সূর্যের সোনালী রশ্মি পুকুরের পানিতে পড়ছে, ঝলমল করে উঠেছে জলরাশি। সাদাত গভীর এক ধ্যানমগ্নতায় সেখানে তাকিয়ে রয়।ইশরা পুরো বাড়ি খুঁজে সাদাতকে পায়নি। বাড়ির আশেপাশে খুঁজে অবশেষে পুকুরের দিকে এসে পৌঁছেছে। দ্রুত পায়ে এগোতে এগোতে দূর থেকে দেখতে পায় চেক শার্ট পরিহিত এক যুবককে। ভুল করার সুযোগ নেই, সে সাদাতই।টেনশনে ফেলে এখানে হাওয়া খাওয়া দেখে রেগেমেগে হনহনিয়ে এগিয়ে আসে। দুমদাম করে পিঠে মা*রার জন্য হাত তুলে বসে। ঠিক সেই সময়ে গিটার থেকে সুর বের হয়—টুংটাং। সে থমকে যায়,দ্রুত হাত নামিয়ে নেয়। কিছু একটা উপলব্ধি করে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে সাদাতের পাশে বসে যায়।তখন বুঝতে পারে এ অসময়ে গিটার হাতে বসা মানে সাদাতের মন ভারাক্রান্ত। তার নিজের মনও বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে।কফি খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল সে কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেই কথা মেয়েলি অবচেতন মনে বিলীন হয়ে যায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাদাত বিষন্নতায় ডুবে গিয়ে গিটারে সুর তুলল। পুকুরের ঝকমকে পানির দিকে দৃষ্টি স্থির করে বিষাদময়, অবসন্ন কন্ঠে হঠাৎ গান গাইতে শুরু করল—
❝কিভাবে বোঝাবো তোমাকে,কতোটা ভালোবাসে মন
এখানে ওখানে তোমাকে, খুঁজে যায় পাগলের মতন
তুমি হয়তো বা ভালোবাসোনা আজও, আমি শুরু থেকে চাই তোমায়
যত দেখি তোমাকে মন শিহরে ওঠে, ছন্দরা ছন্দ হারায়
তুমি ছুঁয়ে দেখো আমায়, তুমি ছুঁয়ে দেখো আমায়,
ছুঁয়ে দেখো আমায়, আমাকে জড়িয়ে বুকে রেখে দাও।
কখনো কি ভেবেছো আমায় একটু আপন, দূরে দূরে রেখেছো সারাক্ষণ
রাতের আকাশে যখন বৃষ্টি- বাদল – গর্জন, আমারও মনের ভেতর তুফান
আমি শুরু থেকে জানি, তুমি হবে না আমারই
তবু আমি পাগল হয়েছি তার কারণে, জানো আকাশ ভরা তারা লাগে না আর ভালো
সব যেন মেঘে ঢাকা পড়েছে, তুমি ছুঁয়ে দেখো আমায়, তুমি ছুঁয়ে দেখো আমায়। ❞

সাদাত পুরো গানটায় মনের কষ্ট, যন্ত্রণা ঢেলে দিয়ে গাওয়া শেষ করল। গিটারের টুংটাং ধ্বনি থামল। আচানক দমকা হাওয়া ছুঁয়ে গেল মানব মানবীর শরীর শরীর। ইশরা মুহুর্তে শিউরে উঠল। সাদাতের ওষ্ঠকোণে হাসি ফুটল। প্রকৃতি বুঝি তার কষ্টে সায় দিতে এসেছে? সে গিটারটা একপাশে রাখল। ওষ্ঠপুটে হাসি বজায় রেখে হালকা সবুজ পানির দিকে তাকিয়ে বলল;
“আমার কষ্ট বাড়াতে এখানে কেন এসেছিস ইশু?”
ইশরার ধ্যান ভঙ্গ হলো। সে আহত নয়নে তাকাল সাদাতের দিকে। মলিন কন্ঠে বলল;
“আমি তোর কষ্ট বাড়াচ্ছি — কথাটা বলতে পারলি সাদাত?”
“কথাটা তিক্ত হলেও সত্য। তোকে একপলক দেখে যেমন মন শান্ত হয়, তেমন কষ্ট, যন্ত্রণা দাবানলের মতো বুকে ছড়িয়ে পড়ে তোকে না পাওয়ার ভয়ে।”

“বড়দের মতো কথা বলবি না সাদাত। এসব শুনলে মাথা হ্যাং হয়ে যায়।”
“এই প্রথম শুনলাম দুঃখ, কষ্টের কথা শুনলে কারো মাথা হ্যাং হয়ে যায়। গোলুমোলু টমেটোর মাথা বলে কথা।”
“সাদুর বাচ্চা আমায় অপমান করছিস!”
কথাটা বলে ইশরা রাগে ফসফস করে সাদাতের চুলগুলো খামচে ধরল দুহাতে। সাদাত ব্যথায় মৃদু চিৎকার করে উঠল। কোনো মতো ইশরার হাত থেকে নিজের চুলগুলো বাঁচিয়ে ব্যথাতুর কন্ঠে বলল;
“আমার চুলগুলোর জীবন শেষ করে দিলি শাঁকচুন্নি! জানিস, দুইদিন আগে জেন্টস পার্লার থেকে হেয়ার ট্রিটমেন্ট করিয়েছি।”

ইশরা মুখ বাঁকিয়ে বলল;
“ঢং দেখে বাঁচি না। পার্লার থেকে হেয়ার ট্রিটমেন্ট করেছে। এবার বুঝেছি এসব ভংচং করে আগে নতুন নতুন মেয়ে ইমপ্রেস করতি।”
“তুই আমার চুল দেখে ইমপ্রেস হয়েছিস? হোস নি তো! চুল দেখে কেউ ইমপ্রেস হয় না। আমাকে দেখে ইমপ্রেস হয়। কারণ আমি গুড লুকিং। ”
“বানরের মতো চেহারা নিয়ে নিজেকে গুড লুকিং বলতে লজ্জা করে না? গুড লুকিং কাকে বলে জানিস? সারহান ভাইকে বলে গুড লুকিং! যেকোনো মেয়ে এক দেখায় ক্রাশ খাবে।”

“নজর ঠিক কর ইশু! ভুলে যাস না ভাই কিন্তু বিবাহিত।”
“তাতে কি? ক্রাশ কি বিবাহিত, অবিবাহিত দেখে খায় নাকি?”
ইশরা মুখ টিপে হেসে বলল। সাদাতের মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল;
“অরিত্রিকা যদি জানে তুই ওর বরের দিকে নজর দিচ্ছিস তাহলে তোর খবর করে দেবে।”
ইশরা অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল;

“তাই নাকি!”
“হুমম।”
“তুই কেন আমার সমবয়সী হলি?”
“সমবয়সী হয়েছি এটা নিয়ে আক্ষেপ করার কি আছে? আমি কখনো এটা নিয়ে মনে আক্ষেপ রাখিনি।”
“আক্ষেপ করার কারণটা বুঝবি না। তুই বন্ধু হিসেবে অনেক ভালো এবং বিশ্বাসযোগ্য।”
ইশরা নিজের অজান্তে ছোট্ট করে প্রশসংসা করল। সাদাত নিঃশব্দে হাসল;
“হয়তো তোর কাছে বন্ধু হিসেবে ভালো এবং বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু আমি মানুষ হিসেবে বড্ড খারাপ, চরিত্রহীন!”
ইশরা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল;

“কয়জন মেয়েকে ছুঁয়ে নিজেকে চরিত্রহীন বলে দাবী করছিস?”
“কাউকে ছুঁয়ে দেখিনি। ওদের কাউকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে জাগেনি। শুধু কথা বলে টাইম পাস করেছি।”
“ভুল করেছিস। সেটা বুঝতে পেরেছিস এটাই অনেক। আর কখনো নিজেকে চরিত্রহীন বলবি না। মনে রাখবি মানুষ মাত্র ভুল হয়।”
“আগে করা ভুলের মাশুল গুনছি। কাউকে না পাওয়ার দহনে পুড়ছি।”
“এসব কথা বাদ দিবি নাকি আমি চলে যাব?”
ইশরা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল। সাদাত হাসি বজায় রেখে শান্ত কন্ঠে বলল;
“ঠিক আছে বাদ দিলাম।”
ইশরা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। হঠাৎ কৌতূহল মেটাতে শুধালো ;
“আমি তোর পাশে এসে বসেছি না দেখে কিভাবে বুঝতে পেরেছিস?”
সাদাত ওষ্ঠপুট প্রসারিত হলো;
“অনুভব করেছি তোর উপস্থিতি।”
“সত্যি?”
“হুমম। আমি আরও অনেক কিছু অনুভব করতে পারি।”
“আর কি অনুভব করতে পারিস?”

“আমার সাথে কথা না বলে থাকলে নীরবে কষ্ট পাস — এটা অনুভব করতে পারি।”
সাদাত শান্ত কন্ঠে বলে উঠল। ইশরা হতবিহ্বল হয়ে গেল। সাদাত কিভাবে বুঝতে পারল তার মনের অবস্থা? সে শঙ্কিত বদনে তাকাল। কম্পনরত কন্ঠে বলল;
“আমি কষ্ট পাইনি।”
সাদাত অদ্ভুত কন্ঠে বলল;
“আমার অবহেলা যার মনকে ব্যথিত করে তার মুখে মিথ্যা মানায় না।”
“তোর অবহেলা আমায় ব্যথিত করে না।”
“আমার সাথে এক মুহুর্ত কথা না বলে থাকতে পারিস না অথচ দিব্যি মিথ্যা বলছিস?”
“সব তোর ভুল ধারণা।”
“আমার থেকে তোর অনুভূতি লুকাতে চাইছিস?”

সাদাত আচমকা ইশরা দুবাহু ধরে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল। ইশরা চমকে গেল। চক্ষুদ্বয়ে ভীড় করল অশ্রুকণা। তার কন্ঠনালী রোধ হয়ে হয়ে আসলো। কান্না দলা পাকিয়ে আসতে লাগল। অনুভূতি ধরা পড়ার ভয়ে দৃষ্টি নত করল। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। মন বিরোধীতা করে আর্তচিৎকার করে বলে উঠল— তুই সাদাতকে ভালোবাসিস ইশরা। তুই বাউণ্ডুলে, মেয়েবাজ, বদমাশটাকে ভালোবেসে ফেলেছিস। তুই প্রেমিকের জহুরী চোখে ধরা পড়ে গেছিস। এবার পালাবি কোথায়? ইশরার চক্ষুদ্বয়ের কার্ণিশ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে লাগল। সাদাত সেই দৃশ্য দেখে দিশেহারা হয়ে গেল। দুহাত আলতো করে মেয়েলী গালে রাখল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল;
“এই ইশু! দোস্ত কি হয়েছে কান্না করছিস কেন? আমার কথায় কষ্ট পেয়েছিস? আচ্ছা তোকে আর ওসব কথা বলব না। কাঁদিস না প্লিজ। স্যরি, স্যরি দোস্ত। তুই আমার বন্ধু হিসেবে থাকতে চাস তাহলে সেটাই হোক। তুই সারাজীবন আমার বন্ধু হয়ে থাকিস।এবার অন্তত কান্না থামা। তুই কেন বুঝতে পারছিস না তোর কান্না সহ্য হচ্ছে আমার। দম বন্ধ হয়ে আসে।”

সাদাতের উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে বলা কথাগুলো শুনে কান্নার বেগ বাড়ল। সে নিজেকে সামলাতে না পেরে সাদাতকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে লাগল। সাদাত চমকিত, থমকিত এবং আশ্চর্যিত হলো। সে স্তম্ভিত নয়নে ইশরার দিকে তাকাল। তার অন্তঃস্থিত মনে ঝড় বইতে লাগল। হৃদপিণ্ড তেজি গতিতে লাফাতে লাগল। শরীর মস্তিষ্ক সব যেন অবশ হয়ে গেল। তার দিশেহারা মন, অচল প্রায় মস্তিষ্ক তালাশ করতে মরিয়া উঠল প্রাণপ্রিয়তমার কান্নার কারণ। ইশরা দুহাতে সাদাতের শার্ট খামচে ধরল। কন্দনরত কন্ঠে উদভ্রান্তের ন্যায় বলল;
“আমি নিজের মনের অনুভূতি দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ সাদাত! আমি নিজের কাছে হেরে গেছি।”
সাদাত ঘন ঘন শ্বাস টেনে নিজেকে একটু স্বাভাবিক করল। তার হাতটা মেয়েলী চুলের ভাঁজে আদুরে ভঙ্গিতে বুলিয়ে দিল। কন্ঠে ব্যাকুলতা নিয়ে বলল;

“কি হয়েছে? খুলে বল ইশু।”
“আমি ভেঙে গুড়িয়ে গেছি। আমার জেদ, ক্ষোভ সব মিলেমিশে পানি হয়ে গেছে। ইশরা নামক মেয়েটা সমাজ, পরিবারের কথা ভুলে গেছে।”
“দোস্ত একটু শান্ত হো।”
“আমি শান্ত হতে পারছি না। তুই আমার ছোটবেলার বন্ধু। তোর সাথে ছোট থেকে বড় হওয়া অব্দি বেশীরভাগ সময় কেটেছে। এখন এক মুহুর্ত কথা না বলে থাকতে কষ্ট হয়। অরিত্রিকা শুধু তোর কষ্টের কথা ভেবে আমাকে তোর সাথে কথা বলতে নিষেধ করল। তোর থেকে দূরে থাকতে বলল। ও কেনো আমার কথাটা ভাবলো না? আমি যে কষ্ট পাবো তা বোঝার কেন চেষ্টা করল না?আমাকে কেন পর করে দিলো? আমিও তো তোর কথা ভাবি। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারি না।”

“অরিত্রিকার কথায় কষ্ট পেয়েছিস? কষ্ট পাস না। ওর কি দোষ বল? তুই যেমন আমার বন্ধু, অরিত্রিকা ও আমার বন্ধু। হয়তো আমার অবস্থা দেখে খারাপ লেগেছে। তাই বেশী কিছু না ভেবে বলে ফেলেছে।”
সাদাত বোঝানোর চেষ্টা করে বলল। ইশরার কান্না থামল না। সে সাদাতের বুকে মিশে গেল। ভেজা করুণ কন্ঠে বলল;
“যদি তোর সাথে কথা না বলে এক মুহুর্ত থাকতে না পেরে কষ্ট পাওয়া, তোকে এক পলক না দেখে খারাপ লাগা, তোর নিশ্চুপতায় দমবন্ধ হয়ে কাতরানো যদি ভালোবাসা হয়। তবে আমি তোকে ভালোবাসি সাদাত।”
সাদাত কর্ণকুহরে অপ্রত্যাশিত কথাটা প্রবেশ করতেই স্তব্ধ এবং বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তার সচল মস্তিষ্কে তালগোল পাকিয়ে গেল। মেয়েলী মাথায় বোলানো হাতটি তৎক্ষনাৎ থেমে গেল। সবকিছু যেন এক মুহুর্তের জন্য স্বপ্ন মনে হলো। তার মনটা শান্ত হয়ে গেল। ভালোবাসার অনুভূতিরা রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইতে লাগল। থেমে থেমে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিমায় যান্ত্রিক কন্ঠে আওড়ালো;
“ইশু আমাকে ভালোবাসে৷ আমার মুগ্ধমায়া আমায় ভালোবাসে।”

বিকেল অতিবাহিত হয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। দিনের প্রজ্জ্বলিত আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে নিভে গিয়ে ধরণী রাতকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করছে। পূর্ববর্তী অবস্থার তুলনায় আলো এখন বহুলাংশে ক্ষীণ ও ম্লান হয়ে উঠেছে।
সারহান এবং ইরফান বসে আছেন বসার কক্ষে। আয়নাল সাহেবের সঙ্গে ভিটের জমি সম্পর্কিত গুরত্বপূর্ণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাদের মধ্যে।

এই মুহূর্তের দৃশ্য সবার অগোচরে গোপনে পর্যবেক্ষণ করছে তানহা। প্রাসংগিক সময়ে মাঝে মাঝে সে মৃদু হাস্যরাশি প্রকাশ করছেযেন কোনো নক্ষত্রপুঞ্জের ক্ষুদ্র হাসির সঞ্চার।সিঁড়ির নিকটবর্তী স্থান থেকে তানহার এই কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে অরিত্রিকা এবং রাহা। উভয়েই ক্রোধে দগ্ধ। মেয়েটিকে যতটা সরলসাধারণ মনে করেছিল তারা তার চেয়েও বহুবিধ বুদ্ধিমান ও বেপরোয়া চরিত্রের অধিকারী। তাদের প্রত্যাশার বহির্ভূত।তানহা একপ্রকার বিনয়হীন ভঙ্গিতে সারহান ভাইয়ের প্রতি নজর দিচ্ছে। অরিত্রিকার মনের মধ্যে প্রবল ইচ্ছা জন্মেছে—তানহার চোখদুটিকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে। বেপরোয়া এই মেয়ের বিবাহিত পুরুষের প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করায় সে ক্ষিপ্ত।
“আমি তানহাকে ভোলাভালা ভেবেছিলাম। এ মেয়ে দেখি চরম লেভেলের বেহায়া। কেমন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে দেখ।”

রাহা চাপা স্বরে বলল। অরিত্রিকার মেজাজ বিগড়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে বলল;
“আগেই বলেছিলাম এই তানহা ত্যানা ছেঁড়ার যম। আমার একমাত্র বরটাকে পিশাচীনির মতো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। ইচ্ছে করছে চোখ দুটো উপড়ে ফেলে মার্বেল খেলি।”
রাহা কিয়ৎ সময় চুপ করে থেকে গমগমে কন্ঠে বলল;
“মেয়েটাকে শিক্ষা দিতে হবে।”
অরিত্রিকা রাগান্বিত বাঘিনীর ন্যায় গর্জে উঠে বলল;

“আমার নেতা সাহেবের দিকে নজর দিয়েছে। এর শোধ তুলবো। ”
কথাটি শেষ করে হনহনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় চলে গেল। পিছু পিছু রাহা ছুটতে লাগল।
সারহানের আয়নাল সাহেবের সাথে কথা বলার ফাঁকে দৃষ্টি স্থির করল বসার কক্ষের দরজার দিকে। সেই তির্যক চাহনি সরাসরি পড়ল তানহার দিকে। আচমকা সারহানের তাকানোয় তানহা ভড়কে গেল। ভীতিগ্রস্ত ভঙ্গিমায় নিজেকে কোনো মতো বাঁচিয়ে সেখান থেকে পলায়ন করল।

পুরনো বাড়িটার বেলকনি যেন জমিদারি যুগের। চারিপাশ কাঠ দিয়ে বাঁধাই করা। সেখানের পাকা মেঝেতে নানা রকমের ফুলের গাছ টবে লাগানো। ফাঁকা স্থানে পুরনো আমলের কেদারা রাখা। অরিত্রিকা কেদারায় বসে দুলে দুলে প্রকৃতি দেখছে। কিছুক্ষণ পূর্বে বাবা, বড়বাবা, মা, বড়মা এবং অরিনের সাথে কথা বলেছে। কথা বলা শেষ করে এখানে আসার পর যা ছবি তুলেছিল সব অরিনের ফোনে পাঠিয়ে দিয়েছে। খোলা বেলকিনে বাহির হতে শীতল হাওয়া আসছে। মন মাতানো গ্রামীন মাটির সুঘ্রাণ, প্রকৃতি যেন মন, মস্তিষ্ক সতেজ এবং প্রাণবন্ত করে তুলছে।
সারহান বিছানায় হেলান দিয়ে ল্যাপটপে জরুরী কিছু তথ্যদি দেখছে। কাজের মাঝে একটু সময় নিয়ে সরাসরি তাকাচ্ছে বেলকনিতে কেদারায় বসা রমণীর দিকে। মেয়েটা হঠাৎ সন্ধ্যা থেকে এ রুমে বেশী ঘোরাঘুরি করছে। মাঝে মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে পুনরায় গিয়ে কেদারায় বসছে। এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ খুঁজতে ব্যর্থ সে। সারহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অবলোকন করতে লাগল মেয়েলী কাজকর্ম। ঠিক তখনি আবিরের মেসেজ আসলো ফোনে। সে দৃষ্টি সরায়। বিছানার ওপর অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে ছোট্ট করে মেসেজ পাঠায়।

মেসেজটি এমন—
“…….. এই দুইজনের পাঁচ বছরের সব কাজকর্মের ডিটেইলস চাই এবং বর্তমানে কোথায় আছে, কি করছে তথ্য চাই।”
এতটুকু লিখে ফোনটা রাখল সে। ল্যাপটপ খোলা রেখে মাথাটা পেছনের বিছানার বোর্ডে ঠেকাল। অরিত্রিকা ধীরে ধীরে নগ্ন পায়ে এগিয়ে আসল সারহানের কাছে। নৈকট্যে দাঁড়িয়ে নিস্তব্ধতা ভেঙে থমথমে গলায় বলল;
“আমরা রাজশাহীতে কবে ফিরব?”

সারহানকে স্বাভাবিক রইল।শীতল চাহনিতে তাকাল মেয়েলী মুখপানে। ল্যাপটপটা তখনও কোলের ওপর খোলা অবস্থায় রাখা। অরিত্রিকার নজর সেথায় আটকালো। সে অপ্রস্তুত হলো। সারহান ভাইকে কাজের সময় ডিস্টার্ব করছে ভাবতে মুখটা আমাবস্যার ন্যায় কালো আধারে ছেঁয়ে গেল। বাকী কথাটুকু গলদেশে অর্ধ ঝুলন্ত অবস্থায় আঁটকে রইল। কিঞ্চিৎ দ্বিধাতে জড়িয়ে অপরাধীর ন্যায় বিছানার এক প্রান্তে উঠে বসে নীরব রইল। কিন্তু তার হাতদুটো নীরব রইল না। শব্দ বিহীন ভঙ্গিতে বিছানার চাদরে আঁকিবুঁকির করতে লাগল। সারহান যেন দেখেও দেখল না এমন ভাব করে ল্যাপটপের কালো বাটন দক্ষ হাতে চেপে কিছু লিখতে উদ্যত হলো। অরিত্রিকা সেই দৃশ্য দেখে আঁকিবুঁকি থামিয়ে দিলো। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে সারহানের শরীর ঘেঁষে বসল। নরম, মসৃণ হাতটা সাহসী ভাব নিয়ে আলতো করে রাখল পুরুষালি হাতের উপরিভাগে। অধৈর্য কন্ঠে ম্লানতা মিশিয়ে বলল;

“বলুন রাজশাহীতে কবে ফিরে যাব?”
কথাটা বলে ধিমানো নজরে উত্তরের অপেক্ষা করল। আকস্মিক মেয়েলী হাত তার হাতটা স্পর্শ করতেই সে কাজ থামিয়ে দিলো। অতি শান্ত চাহনিতে তাকাল মেয়েলী অধৈর্যতায় পরিপূর্ণ মুখপানে। এবার স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে জানতে চাইল;
“হঠাৎ বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো কেন?”
“এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।”

মেয়েটি ঝিমিয়ে ওঠা কন্ঠ নিয়ে বলল। সারহান কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন হলো। সে উদ্বেগ নিয়ে ওপর হাত দ্বারা অরিত্রিকার ছুঁয়ে শরীরের তাপমাত্রা দেখল। শরীরের তাপমাত্রা একদম স্বাভাবিক রয়েছে। তবে ভালো না লাগার কারণ কি হতে পারে? মন খারাপ! সে উদ্বিগ্নতা কমিয়ে আনল। সাবলীলভাবে শুধালো;
“কেন ভালোলাগছে না? কোনো কারণে মন খারাপ হয়েছে?”
অরিত্রিকার নেত্রপল্লব কেঁপে উঠল। কেমন যেন দিকবিদিকশুন্যের নেয় তাকাল। নাক ফুলিয়ে অভিযোগের স্বরে বলল;

“আপনার দিকে কোনো মেয়ে তাকিয়ে থাকলে সহ্য হয় না আমার।”
“কে তাকিয়েছে আমার দিকে? কার কথা বলছিস?”
“ত্যানা.. তানহা। আগে কেন বলেননি আংকেলের অবিবাহিত একটা মেয়ে আছে?”
“জানলে কি করতি?”
সারহান ভ্রুযুগল গুটিয়ে বলল।অরিত্রিকা থেমে থেমে জবাব দিলো;
“এখানে ঘুরতে আসার কথা কখনোই মাথায় আনতাম না।”
সারহান বোঝানোর স্বার্থে বলল;
“তানহা ছোট মানুষ।”

“আমি কি বুড়ো? কখনো দেখেছেন আপনি ব্যতিত অন্য কোনো পুরুষের দিকে তাকিয়েছি?”
“অন্য কোনো পুরুষের দিকে তাকানোর সুযোগ দেয়নি তাই তাকানোর সাহস পাসনি।”
“আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি আমার পেছনে খোঁচর লাগিয়ে রাখতেন।তবুও বলব আমি কোনোদিন বেহায়ার মতো অন্য কারো দিকে তাকিয়ে থাকিনি।”
“ খোঁচর কি?”

সারহান কপালের মধ্যাংশে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে ভরাট কন্ঠে বলল। অরিত্রিকা নাক মুখ কুঁচকে গমগমে কন্ঠে বলল;
“ খাঁটি বাংলা ভাষায় খোঁচরকে চামচা বলে।”
সারহান নাক সিটকে বিরক্তিসূচক কন্ঠে বলে;
“পড়াশোনা করেও ভদ্র ভাষা বলতে পারিস না।”
“আমার মুখে ভদ্র ভাষা আসছে না ওই তানহার জন্য।”
“আমি তানহাকে বুঝিয়ে বলব আমার দিকে যেন সে না তাকায়। এবার খুশি!”
“ ওর সাথে কথা বললে আপনাকে জানে মে*রে দেব।”

অরিত্রিকা ফুঁসে উঠে তর্জনী আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল। সারহান নিভৃতসুধার এমন বিধ্বংসী রুপ দেখে অবাক হলো বটে। পরক্ষণে কোলের ওপর থেকে ল্যাপটপটা নামিয়ে বিছানায় রাখল।তার হাত দ্বারা মেয়েলী হাতটা ধরে নিজের কাছে সন্তর্পণে টেনে নিল। অরিত্রিকার কাজল কালো আঁখিযুগল কিঞ্চিৎ কাঁপল। ঘন ঘন পাপড়িগুলো ঝাপটালো। ছোট্ট দেহখানা পুরুষালি প্রশস্ত বুক ছুঁতে সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল। গোলাপি ওষ্ঠপুট তিরতির করে কাঁপতে লাগল। সারহান অপলক সেই দৃশ্য দেখে নিঃশব্দে হাসল। ইচ্ছে করল প্রেয়সীর ভয়,শঙ্কা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য দুর্বোধ্য কাজ করতে। মেয়েলী গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়ের ভাঁজে তার তপ্ত ওষ্ঠপুট গভীর এবং আদুরে ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিতে। আরেকটু সুগভীর ভাবে কাছে পেতে মরিয়া হয়ে উঠল অভ্যন্তরীণ সত্তা। অরিত্রিকা হয়তো বুঝতে পারল। তবুও প্রতিক্রিয়া স্বরুপ কিছু বলতে পারল না। সে পুরুষালি হাতের উপরিভাগ থেকে তার হাতটা সরিয়ে নিল। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ব্যর্থ সৈনিকের ন্যায় সেথায় অনড়ভাবে বসে রইল। অসহায় চাহনিতে তাকাল সারহানের হাতের ভাঁজে থাকা তার হাতটার দিকে।

“সবাই ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার প্ল্যান করেছে। আপনাকে আর আমাকে হয়তো খুঁজছে। নিচে চলুন।”
অরিত্রিকা কিয়ৎ সময় ব্যয় করে কুন্ঠা ঠেলে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া ভঙ্গিমায় ক্ষীণ স্বরে বলল। এতটুকু বলতেই হাতটা মৃদু কাঁপল। সারহান খানিকটা ঝুঁকে আসলো। তার অন্য হাতটা মেয়েলী মুখশ্রীতে রাখল। বৃদ্ধা আঙুলটা গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়ের আশেপাশে বিচরণ করাতে করাতে শীতল বাণী ছুড়ল ;
“ পিঁপড়ার মতো কলিজা নিয়ে আমাকে জানে মা*রার হুমকি দিচ্ছেন বিবিজান! ইন্টারেস্টিং।”
অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় বড় করে চাইল। শুকনো ঢোক গিলে মিনমিন করে বলল;

“এমনি বলেছি।”
সারহানের ওষ্ঠকোণে তখন সেই চিরচেনা নিঃশব্দ হাসি। সুগভীর তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া অন্য বাসনায় ডুবন্ত। মুখাবয়বে অদ্ভুত স্থবিরতা বিরাজমান। ভাবমূর্তি স্বাভাবিক লাগলেও ভেতরটায় তুফান বইছে। সে গাঢ় চাহনিতে তাকায় ফর্সা মুখশ্রীতে কন্ঠনালী খাদে নামিয়ে বলে;
“আমাকে নিঃশেষ করতে চান? তাহলে অতি সন্নিকটে আসুন। নিজেকে আমার মাঝে বিলীন করে দিন।”
অরিত্রিকা স্তম্ভিত নয়নে তাকাল। লজ্জায় গাল দুটো গরম হয়ে গেল। বিড়াল ছানার ন্যায় শরীরটা গুটিয়ে জড়সড় হয়ে বসল। লজ্জায় মুখশ্রী নেতিয়ে পড়ল। তবুও লজ্জা ভাব বুঝতে না দিয়ে বলল;
“চুপ করুন। নির্লজ্জ কথাবার্তা শুনে লজ্জা লাগছে।”

“আগেই বলেছিলাম এসব কথাবার্তা, কাজে অভ্যস্ত হতে।”
“বলেছিলেন তো। উমম এসব বলতে আপনার লজ্জা করছে না?”
“উহু।বিয়ে করা বউকে কথাগুলো বলতে একদম লজ্জা করছে না।”
সারহান ঠাট্টার স্বরে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল। অরিত্রিকা মানুষটার হঠাৎ এমন পরিবর্তন দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। মন ডেকে বলল, আজ তুই পালানোর কোনো সুযোগ নেই। সে শঙ্কিত মন নিয়ে হাসার ভাণ করল। ক্ষীণ স্বরে বলল;

“আপনার মাথায়….
কথাটা বলতে গিয়েও গলদেশে আঁটকে গেল। অন্তঃস্থিত মন হাসফাস করে উঠল। সে তৎক্ষনাৎ মুখখানা নত করল। সারহান ওষ্ঠ টিপে হাসল। মেয়েলী গালে থাকা হাতটা সরিয়ে নিয়ে যেয়ে অরিত্রিকার হেয়ার ক্লিপটা খুলে দিলো। মুহুর্তে কৃষ্ণ বর্ণের দিঘল চুলগুলো ঘাড় ছাপিয়ে বিছানার বুকে লুটোপুটি খেলতে লাগল। অকস্মাৎ এহেন কান্ডে মেয়েটা ভয় পেল। চমকিত, থমকিত এবং শিহরিত হলো। ছোট্ট মস্তিষ্কে বোঝার চেষ্টা করল শ্যামমানবের কান্ড। সারহান বক্ষঃস্থলে উথাল-পাতাল ঢেউ থামাতে দুই চোখ বুজে কাঠের বিছানার বৃহাদাকার বোর্ডে মাথা ঠেকাল।মেয়েলী শরীরটাকে নিজের শরীরে মিশিয়ে শক্তভাবে আলিঙ্গন করল যেন বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নিতে চায়। একটু দৃঢ়ভাবে অনুভব করতে চায়।

শার্টের বাটন কয়েকটা খোলা থাকায় অরিত্রিকার মুখশ্রী সরাসরি গিয়ে ঠেকল পুরুষালি প্রশস্ত উন্মুক্ত বুকে। মুহুর্তে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। সে চোখ মুখ শক্ত করে বলহীন ভঙ্গিমায় চুপটি করে মুখ গুঁজে রইল। সারহান চোখ খুলে মুগ্ধ নয়নে তাকাল অরিত্রিকার দিকে। রোবটের মতো শক্ত হয়ে থাকতে দেখে ওষ্ঠ প্রসারিত হলো। মুখটা নিচু করে খোলা চুলের ভাঁজে তপ্ত ওষ্ঠপুট ছুঁইয়ে দিল। সেই চুলের সুঘ্রাণ যেন নাসিক্যে প্রবেশ করে অভ্যন্তরীণে আলোড়ন তৈরি করল। অরিত্রিকা অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে চমকে উঠে দুহাতে পুরুষালি সুঠাম দেহ আষ্টেপৃষ্টে ধরল। চোখ মুখ পূর্বের থেকে আরও খিঁচে নিল।

“তোর সান্নিধ্যে এসে আমি স্বস্তি অনুভব করি। দুশ্চিন্তায় কষ্টে ভরা মস্তিষ্কটা শান্ত হয়ে যায়। যতদিন তোকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে নিতে পারব না, ততদিন আমার মন পুরোপুরি শান্ত হবে না।”
সারহান মোহাবিষ্ট কন্ঠে আওড়াল। অরিত্রিকা বোধ হয় শুনল। কিন্তু দুঃসাহস করল না মানবটির দিকে তাকানোর। ওই সুগভীর তীক্ষ্ণ বাদামী বর্ণের চোখে তাকালেই যেন সব আড়ষ্টতা, লজ্জার অবসান ঘটবে। সে পুরুষালি বক্ষের উষ্ণীষ ভাবে আরাম বোধ করে। নির্দিধায় সব অস্বস্তি, সংকোচ ঝেড়ে ফেলে তন্দ্রাঘোরে পতিত হয়। কিয়ৎ সময় কেটে যায়। মেয়েটা নিশ্চিন্তচিত্তে কল্প পুরুষের বুকে মাথা রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। উষ্ণ ঘন শ্বাস প্রশ্বাসে সারহানের ধ্যানমগ্নতা কাটে। সে শান্ত নিগূঢ় চাহনিতে মেয়েলী ফর্সাটে মুখশ্রীতে তাকায়। কিছুক্ষণ অনুধাবন করে বুঝতে পারে অরিত্রিকা ঘুমিয়েছে। সে আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। সযত্নে বালিশটা মাথার নিচে দিয়ে পাশে রাখা কাঁথাটা মেলে ছোট্ট শরীরটা গলা অব্দি ঢেকে দেয়। তারপর সময়ের সৎ ব্যবহার করে। মেয়েটার ঘুমের সুযোগ নিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়ের স্বাদ হরণ করে। অতঃপর অরিত্রিকার কপালের মধ্যাংশে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল;

“আমার হৃদয়ে ঝড় তুলে তুই কীভাবে এত শান্তিতে ঘুমোতে পারিস, ফাইরুজ? এটা মোটেই ঠিক করিসনি।”
কথাটি শেষ করে বালিশ টেনে অরিত্রিকার পাশে শুয়ে পড়ল। বেলকনির দরজা খোলা। বাহিরের শীতল হাওয়া হুর হুর করে রুমে প্রবেশ করছে। জানালা – দরজার পদ্মা থেমে থেমে নড়ছে। রুমে জ্বলছে সাদা কৃত্রিম আলোর বাল্ব। রুমের প্রধান দরজা বন্ধ। সারহান দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখার চেষ্টা করে। সময়টা সাড়ে নয়টার কাছাকাছি। সে পুনরায় দৃষ্টি স্থির করে নিঃসাড়, শান্ত, ঘুমন্ত মেয়েলী মুখশ্রীতে। কাত হয়ে খানিকটা এগিয়ে দু’হাত দ্বারা আগলে নেয় অরিত্রিকার দেহখানা। কিছুক্ষণ অপলক চাহনিতে তাকিয়ে থেকে মনটা শান্ত করে চোখ বুজে।

“আপু বাড়ির অবস্থা কেমন? ঝড় থেমেছে?”
রাহা বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিল। হঠাৎ তার চাচাতো বোন নূহার কল আসতেই তটস্থ ভঙ্গিতে ফোনটা রিসিভ করে আতংকিত ভাব নিয়ে প্রশ্ন করল। ফোনের ওপর পাশ থেকে নূহার দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বিরস কন্ঠে জবাব দিল;
“বাড়ির অবস্থা ভালো না। বাড়ির আশেপাশের লোকজন অনেক কটু কথা বলছে। আমাদের বাহিরে বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। মানুষের মুখে লাগাম টানা দায় হয়ে যাচ্ছে। তোকে নিয়ে জঘন্য কুৎসা রটাচ্ছে। বনু, তুই বাড়ি থেকে পালিয়ে ভুল করেছিস। এই ভুলের জন্য আমাদের সবার মান সম্মান ধুলোয় মিশে গেছে।”
রাহা খানিকটা কেঁপে উঠল। অনুশোচনায় বুকটা ভারী হয়ে উঠল। কম্পনরত বলল;

“আব্বু – আম্মু সুস্থ আছে তো?”
“চাচা চাচীর মনে অবস্থা ভালো না। দুজনে সুস্থ আছেন কিন্তু মনমরা হয়ে গেছেন। কারো সাথে কথা বলছেন না।”
“আপু, ও আপু আব্বু আম্মু কি আমার ওপর অনেক রেগে আছে? দুজনে আমার কল রিসিভ করছে না কেন?”
“হুমম। রেগে আছে। তুই পালানোর পর চাচাকে ছেলের বাড়ির লোকজন অপমান করেছেন। সেই রাগে তিনি বলেছেন — এ বাড়ি তোর জন্য সারাজীবনের জন্য বন্ধ এবং তুই উনার কাছে ম*রে গেছিস। তুই ভুলেও যেন এ বাড়িতে পা না রাখিস এটা আমাকে জানিয়ে দিতে বলেছে।”

“আপু আমি ভুল করে ফেলেছি। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। তুমি আব্বুকে গিয়ে বলো না আমায় ক্ষমা করে দিতে। আম্মু! আম্মুকে ফোনটা দাও আমি কথা বলব। ক্ষমা চাইব।”
কথাটা বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠল রাহা। তার বাবা একটা ভুলের জন্য তাকে মৃ*ত বানিয়ে দিলো? সে এতো বড় কথাটা মানতে পারল না। নূহা বিচলিত হয়ে বলল;
“সোনা কাঁদিস না। একটু শান্ত হো। আমি জানি আবেগের বশে তুই ভুল পদক্ষেপ নিয়েছিস। কয়েকটা দিন যেতে দে চাচাকে একটু স্বাভাবিক হতে দে দেখবি উনি গিয়ে তোকে নিয়ে আসবে।”
রাহা হাউমাউ করে কেঁদে বলল;

“আব্বু এতো সহজে সবকিছু ভুলে যাবে না আপু। আমার জন্য তোমাদের মানুষের কটু কথা শুনতে হচ্ছে। আমার তাড়াহুড়োয় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি। আরেকটু ভাবার দরকার ছিল। সবকিছু হয়েছে ওই শয়তান লোকটার জন্য। আব্বুকে যদি আমার আর ইরফান ভাইয়ার সম্পর্কে উল্টাপাল্টা কথা না বলতো তাহলে এতো কিছু হতো না।”
“এখন অনেকটা দেরী হয়ে গেছে রাহা। সিচুয়েশন আউট অফ কন্ট্রোল। এসব বাদ দে। গতকাল চাচী বলল, চাচা চৌধুরী ভিলায় গিয়েছিল। তোর বান্ধবীর হাসবেন্ড মানে এমপি সাহেবের সাথে নাকি কথা হয়েছে। ওখান থেকে এসে নাকি চাচা একটু স্বাভাবিক রয়েছেন।”

“ভাইয়া আব্বুকে কি বলেছে জানো?”
“নাহ জানিনা। আচ্ছা এখন রাখছি।”
“আচ্ছা আপু।”
কথাটা বলেই রাহা কল কেটে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল। তারপর হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসাটা যে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল সেটা সে অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিল। কেন পালানোর আগে বাবা – মা এবং পরিবারের কথাটা ভাবলো না? ভাবা উচিত ছিল। তবে সে ইরফানের জন্য পালায়নি। পালানোর আসল কারণ ছিল—যে শয়তান স্বভাবের মানুষটিকে পরিবারের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছিল তাকে সে মেনে নিতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়েই পালিয়ে এসেছিল।রাহার মনে পড়ে গেল সেই প্রথম দিনের কথা, যেদিন সে চৌধুরী ভিলায় এসে উঠেছিল।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৩

ভয়, দুশ্চিন্তা আর কষ্টে ভেঙে পড়েছিল সে। লিভিংরুমে ঢুকতেই সারহান ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কাঁদতে দেখে সারহান জানতে চেয়েছিল কী হয়েছে। রাহা আর লুকোতে পারেনি।প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব বলেছিল তাকে। কথা বলতে বলতে অসাবধানেই ফসকে গিয়েছিল সে ইরফানকে ভালোবাসে।সারহান শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। শুধু শান্ত গলায় বলেছিল, “চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।” তারপর কখন তার বাবা এসেছিল? কখন সারহান ভাইয়ার সাথে কথা বলল? কেন তার সাথে একটিবার কথা না বলে চলে গেল? এসব ভেবে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৫