ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২২

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২২
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

প্রিয়তা আরও ১৫ মিনিট কোনো রকম নড়াচড়া না করে একভাবে বসে রইল, অপেক্ষা করল। শুদ্ধ ভালোভাবে ঘুমানোর জন্য প্রিয়তা বসে বসে চিন্তা করল—এত তাড়াতাড়ি কেউ কীভাবে মরার মতো ঘুমিয়ে যেতে পারে!কই তার তো এপাশ-ওপাশে গড়াগড়ি খেতেই এক ঘণ্টা লাগে। সেখানে কেমন মানুষ এই লোক, মাবুদ জানে!
কিন্তু প্রিয়তা বুঝল না—নিদ্রা শান্তির জিনিস। যে যত বেশি দুশ্চিন্তামুক্ত, যে যত বেশি সুখী, তার তত তাড়াতাড়ি নিদ্রা আসে। আর সেখানে শুদ্ধ? সে তো এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।

যে তার প্রিয় মানুষের বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। একমাত্র ভালোবাসা না পাওয়া মানুষগুলোই জানে, ভালোবাসা আসলে কী! প্রিয়তা কী করে বুঝবে ভালোবাসার কদর? সে কি কখনো ভালোবাসার অভাব বোধ করেছে? কখনো কি কোনো দুঃখ তাকে ছুঁতে পেরেছে?
তার জীবনে দুঃখ আসার আগেই আবরার শিকদার প্রণয় তাকে নিজের বুকের গভীরে লুকিয়ে নিয়েছে, আগলে নিয়েছে সবকিছু থেকে। নাহলে প্রিয়তার জীবনেও দুর্ভোগের শেষ থাকতো না। তবে আজ, সকল দুঃখ থেকে আগলে রাখা মানুষটার সাথে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা দেওয়া মানুষটার সাথে বিচ্ছেদ হলো! প্রিয়তারই চোখের সামনে সে অন্য কারো হলো!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রিয় মানুষটাকে প্রতি নিয়ত অন্যের সাথে সহ্য করে চলেছে সে এটা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক সেটা তারাই বুঝবে যারা কখনো এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল। অতিরিক্ত ভালোবেসে ভালোবাসার অভ্যাস বানিয়ে দিয়ে, হুট করেই তার থেকে সব কেড়ে নিয়েছিল প্রনয় ছুড়ে ফেলেছিল তাকে যন্ত্রণার অথৈ সাগরে। তবুও প্রিয়তা পারে না তাকে ভুলে যেতে! কীভাবে ভুলবে? এত এত ভালোবাসা কীভাবে ভুলবে? কোটি খানেক স্মৃতি কিভাবে ভুলবে! তাই তো নিষিদ্ধ জেনেও একতরফা ভালোবেসে চলেছে সে—যা তার যন্ত্রণার আগুনে প্রতিনিয়ত ঘি-এর কাজ করছে।

অল্প বয়সের এই ঘা, যা তার কিশোরী মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। প্রিয়তার প্রণয়ের ভালোবাসায় অভ্যস্ত—অভ্যাসের দাস সে! তাই তো প্রণয়ের করা ছোটখাটো যত্নও তাকে সেই নিষিদ্ধ জিনিসের দিকে আরও বেশি ধাবিত করে। সে চেয়েও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কী জানি, এভাবে কতদিন চলবে! হয়তো প্রিয়তার একজন নিষিদ্ধ ব্যক্তির প্রতি এমন অনিয়ন্ত্রিত আসক্তির কথা যে-ই জানবে, সেই-ই তাকে চরিত্রহীন আখ্যা দেবে।
কিন্তু তার যে কিছু করার নেই! সে তো আর তার ভালোবাসার দাবি জানাচ্ছে না। ভালোবাসে সে, তার নিজের মতো! এই ভালোবাসাই তার বেঁচে থাকার কারণ। এই ভালোবাসা তার একার! এই ভালোবাসাকে ভুলে সে কিছুতেই থাকতে পারবে না। তাই এসব ব্যর্থ চেষ্টা এখন আর সে করে না।

সে স্বীকার করে—হ্যাঁ, সে ভালোবাসে! আজও ভালোবাসে! পূর্বের থেকেও বেশি, অনেক বেশি! আর তার পরিধিও দিন দিন বাড়ছে, যা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে অনেক আগেই!
কেটে গেছে আরো 5 মিনিট
প্রিয়তা মনে হচ্ছে, এইবার হয়তো পা দুটো অসাড় হয়ে যাবে। সে কিছুতেই নড়তে-চড়তে পারছে না।
শুদ্ধর ভারি নিশ্বাস এসে তার গলদেশে আছড়ে পড়ছে। সে আর একভাবে বসে থাকতে পারছে না। তার পা আর কোমর দুটোই টনটন করছে। এর ওপর, ৮৩ কেজির বেশি ওজন গায়ে নিয়ে তার চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হওয়ার মতো অবস্থা! বদ্ধ গাড়ির ভেতরে অক্সিজেনের অভাব বোধ করছে। অক্সিজেন কমে গিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ হয়তো বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে আরও গরম লাগছে। এভাবে তো আর বসে থাকা যায় না!

প্রিয়তা সাবধানে বাম হাতটা দরজার লকের ওপর রাখলো। সাবধানে লকটা উপরের দিকে তুলতেই দরজাটা খুলে গেল।প্রিয়তা অবাক হলো এতো সহজে খুলে যাবে সেটা ভাবতে পারে নি সফলতার খুশিতে তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে নিজের ওপরে থাকা ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “অনেক জ্বালিয়েছো বেটা ! এবার পারলে আমাকে ধরে দেখাও!”
সে ধীরে ধীরে শুদ্ধর হাতটা নিজের কোমরের ভাঁজ থেকে সরিয়ে নিল। অতি সাবধানে কাজটা করতে প্রায় ১৫ মিনিট লেগে গেল! শুদ্ধ যেহেতু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তাই তার হাতের বাঁধন খুব একটা শক্ত ছিল না। কাজেই প্রিয়তা সহজেই সফল হলো। সে কোনো রকমে শুদ্ধর নিচ থেকে নিজেকে সরিয়ে পাশের সিটে গা এলিয়ে দিল। এতক্ষণে তার দেহে প্রাণ ফিরে পেয়েছে!

সে হাঁ করে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ফুসফুস করে বলল, “আমাকে কি পেয়েছিস, বেটা? তুলোর বস্তা, যে যেভাবে খুশি সেভাবে চটকে দিলি! উফ মাগো, কী ভারি!”
সে আবারও শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে খিটমিট করে বলল, “বজ্জাত বেটা! কোলে চড়ার এত শখ থাকলে কম খাবি!”
সে কিছুক্ষণ দম নিল। হঠাৎই তার চেতনা ফিরল—কী সব ভাবছে সে! এখন কি এসব ভাবার সময়? এখন তো তাকে পালাতে হবে! এই ব্যাটা জেগে গেলে মনে হয় না সে পালাতে পারবে।
সে পা টিপে টিপে গাড়ি থেকে নামল। তারপর আবার একবার গাড়ির ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে নিল, সব ঠিক আছে কি না। ভিতর-বাহির সবই অন্ধকার। সে জুতা খুলে হাতে নিয়ে একটা গভীর শ্বাস নিল। অতঃপর আর কোনো দিকে না তাকিয়ে, আল্লাহর নাম নিয়ে চোখ বন্ধ করে দৌড় দিল!
রাত ১০টা ৩৫।

প্রিতম, রাজ, অরণ্য, সমুদ্র, সাদাফ, পরিণীতা, পূর্ণতা, ইনায়া, চিত্রা, তন্ময়, তিতা, তোরি— সবাই মিলে একটা টেবিল গোল হয়ে বসে আছে। তারা প্রত্যেকেই প্রচণ্ড বিরক্ত, কারণ গত এক ঘণ্টা ধরে প্রণয় আর প্রিয়তাকে খুঁজছে, কিন্তু দু’জনেরই কোনো হদিস নেই। কতবার ফোন করেছে, কিন্তু কেউই ফোন রিসিভ করেনি। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তারা বাধ্য হয়ে বসে আছে। ভাই-বোনকে ফেলে তো আর চলে যেতে পারে না!
প্রিতম চিন্তিত কণ্ঠে বলল, “কোথায় গেল দু’জন?”
রাজও একই ভঙ্গিতে বলল, “বড় দাদান তো এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন নন! এত রাত হয়ে গেল, কিন্তু এখনো আসছে না কেন?”

সবাই গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে, অনুশ্রী বেগম চারবার ফোন করে জিজ্ঞেস করেছেন, তারা কখন ফিরবে। প্রিতম কোনো রকম এটা-ওটা বলে এড়িয়ে গেছে।
পরিণীতা গালে হাত দিয়ে ভাবল, “কোথায় গেলি প্রিয়? ভালো লাগে না এত ঝামেলা!”
সে চারপাশের সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালো। প্রিতমের উদ্দেশে বলল, “মেঝো দাদান, ছোটো দাদান কোথায়?”

প্রিতমের মনে পড়ল আবিদের কথা। এত কিছুর মধ্যে ছেলেটার খোঁজই নেওয়া হলো না! সে ফোন বের করে প্রেমের নাম্বারে ডায়াল করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হাসপাতালে।”
পরিণীতা আর সাদাফ অবাক হয়ে গেল।
পরিণীতা কিছু বলার আগেই সাদাফ প্রশ্ন করল, “কেন?”
প্রিতম পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা ব্যথিত কণ্ঠে সব খুলে বলল।
শুনে সাদাফেরও খারাপ লাগল। মলিন কণ্ঠে বলল, “ওহ…”
বাকিরা কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া করল না, কারণ তারা তো জানেই— আর অন্যের জন্য এতটা ব্যথিত কেউই হয় না।
কিন্তু পরিণীতা স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হলো, মাথায় যেন পুরো আকাশ ভেঙে পড়ল!
পায়ের নিচের জমি সরে গেল। প্রিতমের বলা শব্দগুচ্ছ গরল-মিশ্রিত তীরের মতো এসে বিধল পরিণীতার কোমল হৃদয়ে।

প্রিতমের বর্ণনা শুনে মনে হলো, তার দেহের সমস্ত শক্তি কেউ মুহূর্তেই শুষে নিয়েছে!
পরিণীতার হাত-পা কাঁপতে লাগল। প্রাণটা ছটফট করতে থাকল। চোখে পানি চলে এলো। নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। মনে মনে বলল, “কি হয়েছে আমার মাস্টারমশাইয়ের?!”
তার কান্নারা গলা অবধি উঠে আসছে, এখুনি হয়তো বাঁধন হারাবে।
সে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল…
তাকে আচমকা উঠে পড়তে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল।
প্রেরণা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছিস পরি?”

পরিণীতা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “গরম লাগছে, পানি খাব,” বলেই উল্টো দিকের দিকে দৌড় দিল। ততক্ষণে অশ্রুকণারা টুপটাপ করে গাল বেয়ে পড়তে শুরু করেছে।
প্রেরণার উত্তরের আসা না করে দৌড়ে চলে যেতে দেখে সবাই কিছুটা অবাক হলো, তবে কেউ বিষয়টা তেমন আমলে নিলো না।
কিন্তু পূর্ণতা পুরোটা সময় ভ্রু কুঁচকে পরিণীতার বদলে যাওয়া মুখভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করছিল। সে ভালোই বুঝতে পারল, পরিণীতা মিথ্যা বলেছে।
তাই সেও উঠে দৌড় দিল পরিণীতার পিছু!
সাদাফও যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সারাদিন পরিণীতার সঙ্গে চিপকে থাকলে তার হবু শালা-সম্বন্ধীরা সন্দেহ করতে পারে। এমনিতেই এরা দুই গুণ দেখে চার গুণ শুনে, তাই এদের বুঝতে সময় লাগবে না—এই ভেবে সে আর গেল না।

পূর্ণতা পরিণীতার পিছু পিছু ছুটছে আর চিৎকার করে বলছে, “দাঁড়া, পরী! পরে যাবি, পরী!”
কিন্তু সে সব কথা পরিণীতার কানে পৌঁছাল না। সামনে আসা কত মানুষের সঙ্গে ধাক্কা লাগছে, তার ঠিক নেই, কিন্তু সে সবে পরিণীতার কোনো খেয়াল নেই। তার কানে শুধু প্রিথমের বলা আবিদের করুন অবস্থার বর্ণনাগুলো বাজছে—কীভাবে তার মাস্টারমশাই জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলেন, কতটা অসুস্থ হলে মানুষ চেতনা হারায়! এসব ভাবনাতেই তার হৃদপিণ্ডের কানায় কানায় ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে। সে মোটেও তার মাস্টারমশাইয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। পরিণীতার মনে হচ্ছে, এখন হয়তো সেও জ্ঞান হারাবে।
সে মাঠ পেরিয়ে সেই নদীর পারে পৌঁছে গেল। কিছুটা দূরে এগিয়ে গিয়ে বালির ওপর ধপ করে বসে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল।

নিস্তব্ধ রজনীতে এমন আর্তনাদ বড় করুন শুনালো নদীর জলের কলকল শব্দ কানে ভেসে আসছে, গা ছুঁয়ে যাচ্ছে দমকা শীতল বাতাস, আর নদী সাক্ষী হচ্ছে দুই নর-নারীর একে অপরের প্রতি ভালোবাসার তীব্র হাহাকারের।
প্রথমে কোনো এক প্রেমিক পুরুষ তার প্রিয়তমা হারানোর তীব্র আর্তনাদ জানিয়েছে, আর এখন তার প্রিয়তমা ও তার কাছে এসে আর্তনাদ করছে। এই দুঃখ কি প্রাণে সয়?

পরিণীতা কাঁপা হাতে আবিদের নাম্বারে বেশ কয়েকবার ফোন করল, কিন্তু ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেল। পরিণীতার সহ্য হচ্ছে না! সে পুনরায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠল। তার সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে আবিদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে মন চাইছে, আবিদের ভালোবাসাময় স্পর্শ পাওয়ার জন্য মন ছটফট করছে।
মাঝরাতে খোলা চুলে নদীর পাড়ে বসে আছে পরিণীতা। আবিদ থাকলে হয়তো নিজের হাতে তার চুল বেঁধে দিত! কত শত রাত সে তার মাস্টারমশাইয়ের হাত ধরে লুকিয়ে-চুরিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে!
তার হিসেব নেই কিন্তু এখন।
সে উঠে দাঁড়িয়ে আবারও দৌড় দিতে নিলে—
পূর্ণতা ছুটে এসে তাকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরল। পরিণীতা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলছে, “ছাড় আমাকে, ছাড়!”

পূর্ণতা ভয়ভরা গলায় বলল, “কোথায় যাবি তুই? শান্ত হ, পরী! তোর মাস্টারমশাই একদম সুস্থ হয়ে যাবেন!”
পরিণীতা থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড পূর্ণতার মুখের দিকে তাকিয়ে বিদ্যুৎবেগে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। পূর্ণতাও প্রিয় বান্ধবীকে আগলে নিল।
পরিণীতা অভিযোগের সুরে বলল, “আমি কি খুব বেশি খারাপ? পূর্ণ, আমাকে কি ভালোবাসা যায় না? সত্যি কি আমার চরিত্র খারাপ?”
পরিণীতার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবাধ অশ্রুধারা।

পূর্ণতার চোখেও জল চলে এলো। সে পরিণীতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কে বলেছে তুই খারাপ? তুই জানিস, তোর মতো লক্ষ্মী মেয়ে আর দুটো নেই! তুই খুব ভালো মেয়ে, পরী!”
পরিণীতার হেঁচকি উঠছে। সে থেমে থেমে বলল, “তাহলে উনি কেন আমার সঙ্গে এমন করেন? উনি কেন বললেন, আমি খারাপ? উনি কেন কথা বলছেন না আমার সাথে?”
“তাও মেনে নিলাম! কিন্তু তুই শুনলি না? মেজো দাদান কী বললেন? উনি সেন্স হারিয়ে পড়ে ছিলেন! কতটা অসুস্থ হলে মানুষ জ্ঞান হারায়, তুই বল!”

পূর্ণতা সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেল না।
সে জানে, পরিণীতা তার প্রাইভেট টিউটরকে খুব ভালোবাসে—উহু, শুধু ভালোবাসে না, উন্মাদের মতো ভালোবাসে! তবে সেই ছেলেকে পূর্ণতা কখনো দেখেনি। যা শুনেছে, সব পরিণীতার মুখে।
তবে কারও ভালোবাসা যে এত গভীর হতে পারে, কেউ যে কাউকে এতটা ডেসপারেটলি ভালোবাসতে পারে, সেটা পরিণীতা কে না দেখলে পূর্ণতা হয়তো কখনোই উপলব্ধি করতে পারত না।
তার মাঝে মাঝে মনে হয়—ভালোবাসা বড়ই যন্ত্রণাময়! সে কাউকে ভালোবাসেনি, তাই হয়তো সে বেঁচে গেছে নাহলে এই হাল হয়তো তার ও হতো।

সে পরিনীতার দিকে তাকিয়ে ভাবলো —পরিণীতার মতো এমন উচ্চবংশীয়, অতিসুন্দরী, শান্তশিষ্ট, নম্র, ভদ্র, মিষ্টভাষী, সুশীল,অহংকারবিহীন, কোমল মনের মেয়ের ভালোবাসা পাওয়া যে কোনো সুপুরুষের কাছেই পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। পরিণীতা একদম পিওর সোউল।
সেখানে পরিণীতা একজন অত্যন্ত সাধারণ—না, সাধারণের থেকেও বেশি সাধারণ—পুরুষকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে!
অথচ এত ভালোবাসার পরও কি তার এই প্রাপ্য !

কেউ কীভাবে এমন একটা মেয়েকে কষ্ট দিতে পারে?
পরিণীতা আবারও বলে উঠল, “আমাকে নিয়ে চল না, পূর্ণ! উনার কাছে! আমি একটু দেখতে চাই, উনাকে!”
“আমি কিছু বলব না, শুধু দেখেই চলে আসব,চল না প্লিজ!”
পূর্ণতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরিণীতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “কাদিস না, পাখি। নিশ্চয়ই যাব, কিন্তু এখন নয়!”
পরিণীতার কান্না থামছেই না। তার মনটা হাঁসফাঁস করছে।
সে আসলে ব্যর্থ।
সে যে মানুষটাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে, তাকেই সে বুঝাতে পারল না!
পূর্ণতা পরিণীতার হাত ধরে বলল, “চল, তাড়াতাড়ি! না হলে সবাই সন্দেহ করবে!”
পরিণীতা কিছু বলল না।

ঘন চোখের পাপড়ি বন্ধ করতেই আবারও বেদনার অশ্রু নেমে এলো।
পূর্ণতা তার গাল মুছে দিয়ে বলল, “চল, চোখে-মুখে পানি দিয়ে দেই। ভালো লাগবে।”
কিন্তু পরিণীতা যেতে চাইছিল না।
কিন্তু পূর্ণতাও নাছোড়বান্দা। একপ্রকার টেনে নিয়ে গেল তাকে।
প্রণয়ের পাগল পাগল অবস্থা!
সে কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে—একজনের পর একজনকে ধরে জিজ্ঞেস করছে, কেউ তার প্রিয়তাকে দেখেছে কি না। কিন্তু কেউই সঠিক উত্তর দিতে পারছে না।

তার এমন পাগলামি দেখে কিছু মানুষ বাঁকা নজরে তাকাচ্ছে। কারণ, প্রণয় শিকদারকে কে কে না চেনে! শিকদাররা তাদের মহানুভবতার জন্য পুরো রায়পুরে পরিচিত। কেউই তাদের কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে না।
শিকদারদের মধ্যে সাদমান শিকদার ও প্রণয় শিকদার ভীষণ চুপচাপ ও গম্ভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী । তাই তার এমন আচরণের সঙ্গে কেউ পরিচিত নয়। বিদায়, কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে সবাই!
যদিও এসবের কোনো কিছুই প্রণয়ের মাথাব্যথার কারণ নয়।
তার অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে, BP (রক্তচাপ) বাড়ছে, ধৈর্য হারিয়ে যাচ্ছে। অজানা আশঙ্কায় তার গলা শুকিয়ে আসছে। মনে শুধু একটাই ভয়—
“কোনো বিপদ হয়নি তো?
আমার জানটা ঠিক আছে তো?”
সে বিড়বিড় করে বলল,

“কোথায় চলে গেলে তুমি, রক্তজবা? প্লিজ ফিরে এসো আমার কাছে! আর মেরো না আমায়!
প্রণয়ের বুকের ভেতর হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে।
এই মেয়েটার যদি কিছু হয়, তাহলে সে এক সেকেন্ডও বাঁচবে না!
সে দিশেহারা।
গত দেড় ঘণ্টা ধরে পাগলের মতো খুঁজে চলেছে। বর্তমান অবস্থায় সে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছে। হাত-পা অনবরত কাঁপছে—হয়তো প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে!

শুকনো ঢোঁক গিলে প্রণয় চোখ বন্ধ করল। আল্লাহকে স্মরণ করে কাঁপা কণ্ঠে বলল—
“আমার সব কেড়ে নিয়েছো, অভিযোগ করিনি! কিন্তু বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটাও কি কেড়ে নেবে? এতটা নিষ্ঠুর তুমি হতে পারো না! আর কী আছে আমার, বলো?”
সে মেলার শেষ প্রান্তে শেষ একজনকে প্রিয়তার ছবি দেখিয়ে করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করল—
“আপনি কি এই মেয়েটাকে কোথাও দেখেছেন?”
প্রণয়ের চোখেমুখে চরম অসহায়ত্ব!

সে তীব্র আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। হয়তোবা এই লোকটা তাকে নিরাশ করবে না! হয়তোবা এই লোকটাই তার রক্তজবার সন্ধান দিতে পারবে!
লোকটি একবার প্রণয়ের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে, আবার ছবির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে জানাল,
“না ভাই, আমি দেখিনি!”
প্রণয়ের শেষ আশাটুকুও নিভে গেল। মাথাটা যেন চক্কর দিয়ে উঠল।
সে খুঁজতে খুঁজতে পশ্চিম দিকে চলে এসেছে।
সামনে শুধু বিশাল প্রান্তর, ছাড়া আর কিছু নেই!
সে শরীরে সামান্য শক্তিও আর পাচ্ছে না, হৃদয়টাও যেন কেমন শূন্য শূন্য লাগছে!
সে হাতের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল—
“আজ আছি বলে জালাচ্ছিস! কাল যখন থাকবো না, তখন আমি-ও দেখবো, তুই কাকে জালাস!”
হতাশা আর নিরাশা তাকে চার দিক থেকে চেপে ধরেছে।
সে ধীর পায়ে আরেকটু সামনে এগোতেই…

ঝাপসা… কিছু একটা তার নজরে এলো!
পায়ের গতি রোধ হলো…
দৃষ্টি স্থির হলো…
হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি আকাশ ছুঁলো…
দূর থেকে সাদা জামা পরিহিত একটি মেয়ে তীব্র গতিতে তার দিকেই ছুটে আসছে!
প্রণয় চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিল।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে মনে মনে বলল,
“অনেক, অনেক শুকরিয়া, মাবুদ!”
প্রিয়তা কেন ছুটে আসছে?
কেনই বা গিয়েছিল?
কোথায় ছিল?
কী হয়েছে?
কী হয়নি?
—এই মুহূর্তে এসব কোনো প্রশ্নই মাথায় এল না!
সে শুধু বুঝতে পারল…

তার প্রিয়তা ফিরে এসেছে… তার জান ফিরে এসেছে!
সে দুই পা সামনে বাড়ানোর আগেই প্রিয়তা প্রবল বেগে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে।
প্রণয় দু’কদম পিছিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিল।
প্রিয়তা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে প্রণয়কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বড় বড় শ্বাস ফেলতে লাগলো , খামছে ধরল প্রনয়ের শার্টের পিছন দিক এবার একটু সুরক্ষিত লাগছে । এই পুরুষটাই একমাত্র, যাকে জড়িয়ে ধরলে তার সব থেকে নিরাপদ লাগে, সব থেকে সুরক্ষিত মনে হয়। এই পুরুষটার দেহের ঘ্রাণে ও সে অপার ভালোবাসা খুঁজে পায়। এই পুরুষটাকেই তার পৃথিবীর সব থেকে বেশি আপন লাগে।
প্রিয়তা প্রণয়ের বুকে মুখ গুঁজে শরীরের সকল ভার প্রণয়ের ওপর ছেড়ে দিল। তার গোটা শরীর প্রচণ্ডভাবে কাঁপছে।
প্রণয়ও তার প্রনয়িনীকে নিজের বুকে গভীরে ঢুকিয়ে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করল।
আরেকটু হলে এখানেই সে হার্ট অ্যাটাক করত !

প্রিয়তা অনুভব করল, স্বাভাবিকের তুলনায় তীব্র গতিতে প্রণয়ের Heart beat করছে। এত জোরে… এত দ্রুত! যে তা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে প্রিয়তা!
প্রিয়তা আরও শক্ত করে প্রণয়ের পিঠ আঁকড়ে ধরল, শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে তারা একে অপরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইল।
মনে বয়ে চলেছে বিধ্বংসী সুনামি ঝড়ের প্রবল জলোচ্ছ্বাস। যতক্ষণ না প্রিয়তা প্রণয়কে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে পারবে, ততক্ষণ সে কিছুতেই শান্ত হতে পারবে না তার মনের ভয় দূর হবে না।
কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই প্রণয়, প্রিয়তাকে বুকে রেখেই ধমকের সুরে বলে উঠল—
“আমাকে না বলে কোথায় গিয়েছিলি তুই?
বেঁচে থাকতে একটু শান্তি ও কি পাব না?
আমাকে জ্বালিয়ে তোর খুব আনন্দ লাগে?
কেন জ্বালাস আমাকে?

তোর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আমি-ও একদিন ঠিক হারিয়ে যাব!”
ধমক শুনে প্রিয়তা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল প্রণয়কে।
প্রণয়ও আরও অনেক কথা শোনাতে চেয়েও পারল না। মাথা নিচু করে প্রিয়তার মাথায় একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে প্রিয়তার ছোট্ট দেহটা নিজের অস্তিত্বের সাথে নিবিড়ভাবে মিশিয়ে নিল।
মাথা ঠান্ডা হতেই প্রণয়ের মনে কিছু প্রশ্নের আবির্ভাব হলো। উত্তেজনায় সে ভুলেই গিয়েছিল প্রশ্নগুলো। প্রশ্নগুলো মাথায় আসতেই সে প্রিয়তাকে নিজের থেকে আলাদা করল, তীক্ষ্ণ সুচালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করল প্রিয়তার নীল চোখের গভীরে।
প্রণয়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়তেই প্রিয়তা বিদ্যুৎবেগে চোখ নামিয়ে নিল। সাথে সাথেই কয়েকটা ভাঁজ পড়ল প্রণয়ের কপালে। প্রিয়তা মনে মনে আবারও ঘাবড়ে গেল। প্রণয় ভাই এখন যদি তাকে হাজার ও প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে, কী উত্তর দেবে সে?

তার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই প্রণয় গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল—
“এদিকে কোথায় গিয়েছিলি তুই? এদিকে তো অন্ধকার, ধূ ধূ প্রান্তর ছাড়া আর কিছু নেই। আর এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”
প্রিয়তা চমকে উঠল। উদ্বিগ্ন দৃষ্টি এদিক-ওদিক ফেলতে লাগল। কী জবাব দেবে এখন সে? সব সত্যি বলে দেবে প্রণয় ভাইকে? কিন্তু যদি ভুল বোঝে?
সে তো ওই পুরুষের মুখটাও ভালো করে দেখেনি। আর লোকটা তার সঙ্গে যে সব করেছে, তার বর্ণনাই বা সে কীভাবে দেবে? পুনরায় ঐ লোকটার স্পর্শের কথা মনে পড়তেই গা কাটা দিয়ে উঠল প্রিয়তার। এভাবে কেউ তাকে আগে কোনো দিন ও স্পর্শ করেনি। প্রণয় ভাইও করেনি।
প্রিয়তাকে সাতপাঁচ ভাবতে দেখে প্রণয়ের ভ্রু আরও খানিকটা কুঁচকে গেল। তার মনে উঁকি দিল হাজারো প্রশ্ন আর সন্দেহ।

কেনই বা মেয়েটা ওভাবে দৌড়ে এসেছিল? সে প্রিয়তার উদ্বিগ্ন চোখের দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে রইল।
সে কখনোই এই মেয়ের চোখ পড়তে ভুল করে না।
এই মেয়ের হাবভাব দেখেই বুঝে গেল, সে মনে মনে মিথ্যে বলার পরিকল্পনা করছে।
কিন্তু কেন?
প্রণয় আবারও শীতল, অথচ কঠিন কণ্ঠে একটু ঝাঁঝিয়েই প্রশ্ন করল—
“কি হয়েছে? উত্তর দিচ্ছিস না কেন? কোথায় ছিলি তুই?”
প্রিয়তা অল্প কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রতিউত্তর করল—
“গ… গরম লাগছিল, প্রণয় ভাই। তাই একটু হাঁটতে গিয়েছিলাম…”
চোখ বন্ধ করে জীবনে প্রথমবারের মতো প্রণয়কে মিথ্যেটা বলেই ফেলল প্রিয়তা।
কলিজা আছে, মানতেই হবে!

জানে, সে প্রণয় ভাইয়ের থেকে কিছু লুকাতে পারবে না। ধরা খেয়ে যাবে… তবুও মিথ্যে বলল।
প্রণয় অবাক চোখে চেয়ে রইল প্রিয়তার দিকে।
তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে—তার রক্তজবা তাকে মিথ্যে বলেছে!
কিন্তু কেন?
সে আবারও কিছু বলবে, তার আগেই তার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো। অনেকক্ষণ ধরেই অনুভব হচ্ছে, কিন্তু অতিরিক্ত টেনশনে তার মস্তিষ্ক সেটাকে ক্যাচ করতে পারেনি। তবে বিষয়টা বুঝে আসতেই সে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি প্রিয়তার উপর নিক্ষেপ করল।

প্রিয়তা কিছু বোঝার আগেই, তাকে এক ঝটকায় নিজের একদম কাছে টেনে নিল।
চমকে উঠলো প্রিয়তা! ভয়ার্ত চোখে তাকাল প্রণয়ের দিকে। কিন্তু প্রণয় এসব পাত্তা দিলো না।
সে মুখটা প্রিয়তার গলার কাছে নিয়ে কয়েকটা গভীর নিঃশ্বাস নিল। পরিচিত, অথচ অপ্রিয় ঘ্রাণটা নাকে আসতেই দেহের শিরায়-উপশিরায় বৈদ্যুতিক ঝটকা লাগল!
এক ঝটকায় দূরে সরে গেল প্রিয়তা তার কাছ থেকে।
তার চোখে-মুখে চরম অবিশ্বাস! সে যেটা অনুভব করলো, সেটা মানতে কিছুতেই রাজি নয় সে!
হঠাৎ করেই যেন তার চারপাশ বদলে গেছে মুক্ত ! আশেপাশের শীতল বাতাসও কেমন বিষাক্ত লাগছে! দম আটকে আসছে। বুকের ভেতরের নরম মাংসপিণ্ডে প্রবল ব্যথা শুরু হয়ে গেছে!
প্রিয়তা অবাক হয়ে তার কাছে ছুটে এলো, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে, প্রণয় ভাই?”
প্রিয়তা কাছে আসতেই তার গা থেকে আবারও সেই গন্ধটা এসে প্রণয়ের নাকে লাগলো!
প্রণয় কাঁপা কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে বলল, “দূরে যা!”
প্রণয় কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে!

প্রিয়তা অবাক হয়ে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের পরিবর্তিত অভিব্যক্তির দিকে, বোঝার চেষ্টা করছে হঠাৎ করে কী হলো! একটু আগেও তো ঠিক ছিল!
প্রিয়তাকে অবাক করে দিয়ে প্রণয় তার থেকে কিছুটা দূরে চলে গেল।
প্রিয়তা বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
প্রিয়তার দেহ থেকে ছুটে আসা শুদ্ধের দেহের ঘ্রান তার দেহ ও মনে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
প্রণয় মনে করার চেষ্টা করল—এমন প্রাণঘাতী যন্ত্রণা তার ২৯ বছরের জীবনে আগে কখনো হয়েছে কি না! সে তো তার জীবনে কম কষ্ট পায়নি! কিন্তু এমন মরণযন্ত্রণা আগে কখনো অনুভব করেনি সে!
এই যন্ত্রণার কাছে আগের সকল যন্ত্রণাই তুচ্ছ লাগছে!
প্রণয়ের এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, কেউ যদি তার থেকে তার প্রাণটা নির্মমভাবে আলাদা করে বলত—”ব্যথা পেয়েছিস?”—তবু হয়তো সে হেসে বলত, “আমার রক্তজবা যে ব্যথা দিয়েছে, তার থেকে কম!”
তার বিশ্বাসই হচ্ছে না!

যার দেহে সে কোনোদিন অন্যের বাতাস পর্যন্ত লাগতে দেয়নি, তার দেহ থেকে তীব্র মাত্রায় অন্য পুরুষের দেহের সুবাস ভেসে আসছে!
এই গন্ধ তার ভীষণ পরিচিত!
‘শুদ্ধ’—যে কিনা তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল!
তার পারফিউমের গন্ধ চিনতে সে ভুল করেনি?!
কতটা ঘনিষ্ঠ হলে দেহের ঘ্রাণ আদান-প্রদান হয়?!
প্রণয়ের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল!
চোখ বন্ধ করতেই ভাবনার পাতায় কিছু বিষাক্ত, অপ্রিয় দৃশ্য ফুটে উঠলো!
চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দুই ফোঁটা তরল…
তার মনে হাজারো ধরনের বিষাক্ত প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে!

এগুলো যেন প্রশ্ন নয়, গরল-মিশ্রিত তীক্ষ্ণ সূচালো বাণ, যা তার হৃদপিণ্ডকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে!
সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, তার প্রিয় নারীর দেহ থেকে অপ্রিয় ব্যক্তির দেহের গন্ধ ভেসে আসবে!
এই জন্যই কি তার রক্তজবা তাকে মিথ্যে বললো?
সে তাচ্ছিল্যের হাসি দিল।
একটা কথা আজ আবারও প্রমাণিত হলো—

কষ্ট কখনো বাইরের মানুষরা দেয় না, কাছের মানুষরাই দেয়!
যাদের বাস হৃদয়ের অতি-নিকটে, তাদের জন্যই অতি-সহজ হয় হৃদয়ে আঘাত আনা!
যা আজ প্রিয়তা আনলো!
সেটা জেনে হোক বা না জেনে।
প্রণয় বুঝলো—প্রিয়তা সামান্য কারণে মিথ্যে বলেনি! হয়তো অনেক বেশি কিছু হয়েছে! নাহলে ওর সারা শরীর থেকে শুদ্ধ শুদ্ধ গন্ধ আসতো না।
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়তমার বিস্মিত মুখশ্রীতে নজর বুলিয়ে, মনে মনে বললো— আমকে কি একটু ভালবাসিস নি জান।
“কীভাবে পারলি তুই?!
আমার কথা তোর একবারও মনে আসলো না?
একবারও না?!
কীভাবে পরপুরুষের গায়ের গন্ধ মেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালি?!

এর থেকে তোর নিজ হাতেই মেরে ফেলতি!
বিশ্বাস কর, এত কষ্ট কোনোদিনও হতো না!
এভাবে অদৃশ্য বিষাক্ত ছুরি…!
না মারলেও পারতি!
কী করবো বল?!
খুব কষ্ট হচ্ছে যে…!
তোকে যে ভীষণ ভালোবাসি!
আমি যে কোনো দিনও তোকে কারো সাথে সহ্য করতে পারবো না!
এমন দিন আসার আগে আমার মৃত্যু হোক!”
প্রণয় ঠোঁট কামড়ে কান্না নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো।
প্রকৃতপক্ষে, সে এখানে ‘সুদ্ধ’-র কোনো দোষই দেখলো না। কারণ সে শুদ্ধর অনুভূতি সম্বন্ধে ভালোই জানে!
তার রক্তজবার যদি সম্মতি না থাকতো, তাহলে সে তাকে কখনোই মিথ্যে বলতে পারতো না!তার ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতার লোভ পাচ্ছে।

সে কল্পনা করার চেষ্টা করলো কি কি হতে পারে!
কিন্তু সামান্য কিছু দৃশ্য মস্তিষ্কে ভেসে উঠতেই তার নিশ্বাস আটকে গেল!
সে আর গভীরে ভাবতে পারলো না!
এতো গভীরে ভাবতে গেলে সে এখানে দম আটকে মরে যাবে!
সে চোখ মুছে নিল!
কান্না নিয়ন্ত্রণের ফলে কিছু মুহূর্তের মধ্যেই চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে গেছে!
সে আবার প্রিয়তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো!
কিন্তু এবার আর চোখ-মুখে কোনো বিস্ময় নেই!
নেই কোনো অনুভূতি!

চোখ-মুখ অস্বাভাবিক শান্ত, শীতল!
বোকা মেয়েটা কিছুই বুঝলো না!
শুধু অবাক নয়নে চেয়ে রইলো প্রণয়ের পানে!
প্রণয় আর তাকে কোনো রকম কোনো প্রশ্ন করলো না!
এখন আর চোখ-মুখ দেখে তার মনের ভাব বোঝার এতটুকু উপায় নেই!
সে প্রিয়তার ডান হাতটা সন্তর্পণে নিজের হাতে মুঠোয় নিয়ে নিল।
প্রিয়তা গোল গোল চোখে চেয়ে আছে তার দিকে, মনে মনে বললো—
“আমি কি প্রণয় ভাইকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?!
কিন্তু আমি বা কী করতাম?!
যা যা হয়েছে, তার এক লাইনেরও বর্ণনা আমি তাকে দিতে পারবো না…!”
প্রণয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেটে চললো মেলার দিকে, অবশ্যই প্রিয়তাকে আগলে রেখেছে, যাতে কেউ ধাক্কা-টাক্কা দিতে না পারে!

সে হয়তো আজ নিজের অজান্তেই অনুভব করলো যে, এতগুলো দিন প্রিয়তা কী আগুনে জ্বলে-পুড়ে বেঁচে আছে!
কেউই তার ভালোবাসার মানুষের সাথে তৃতীয় ব্যক্তির ঘনিষ্ঠতা কখনোই সহ্য করতে পারে না!
অথচ, ওই ছোট্ট মেয়েটা করেছে…!
সে যেতে যেতে ফোন বের করে কল লিস্ট ওপেন করলো—
প্রিতমের ২০টা মিসড কল!

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২১

প্রণয় সেসব পাত্তা না দিয়ে প্রিতমকে ফোন দিয়ে জেনে নিল তারা কোথায়!
প্রিয়তা প্রণয়ের থমথমে মুখ দেখে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে!
সে জানে—প্রণয় ভাই তার উপর খুব রেগে আছেন!
কারণ, সে একটা প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর দিতে পারে নি।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৩