ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৩
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
প্রণয় তাকে নিয়ে আগের জায়গায় চলে গেল। সেখানে প্রিয়তার কেনা সমস্ত জিনিসপত্রই পড়ে আছে। প্রণয় এক লোককে কিছু টাকা দিয়ে বলল,
“জিনিসগুলো নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলুন।”
প্রিয়তা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল প্রণয়ের দিকে। সে তো এগুলোর কথা অনেক আগেই ভুলে গিয়েছিল, কিন্তু প্রণয় ভাই ভুলেননি। তার মনটা আবার ও খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বলল, “এতো খেয়াল কেন রাখেন প্রণয় ভাই! এই জন্যই তো আপনার ওপর থেকে আমি নির্ভরশীলতা কমাতে পারি না। নিষিদ্ধ জেনেও… আপনি আমার সব…”
প্রিয়তা গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রণয়ের মুখের দিকে। মুখটা একদম থমথমে, গম্ভীর। দেখে বোঝা না গেলেও প্রিয়তার মন বলে উঠল, “এবার তুই শেষ, প্রিয়তা! এই রাগের দেয়াল ভাঙা তোর জন্য সহজ হবে না!”
প্রিয়তা মনে মনে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল, প্রণয়ের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কী হবে চিন্তা করে।
এদিকে, প্রিথম ও বাকিরা সবাই বসে গল্প করছিল। পরিণীতা এক পাশে চুপচাপ বসে আছে, মুখ থমথমে, চোখ-মুখ কিছুটা ফোলা ফোলা। সদাফ গভীর চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
কিছুক্ষণ পরই প্রণয় প্রিয়তাকে নিয়ে পৌঁছে গেল ওদের কাছে।
ততক্ষণে অনেক রাত হয়ে গেছে, ঘড়ির কাঁটা এগারো ছুঁইছুঁই। আজ বাড়ি ফিরলে অনুশ্রী বেগমের আদর-যত্নের কথা ভেবে সবাই কয়েকটা ফাঁকা ঢোঁক গিলল।
প্রিথম বলল, “তাহলে চলো, সবাই!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সবাই সম্মতি জানিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রণয় প্রিয়তার হাত ছাড়তেই সে পরিণীতার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তবে পরিণীতা এসব খেয়ালই করল না, নিজের ভাবনায় ডুবে ছিল।
প্রিয়তা পরিণীতার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “আপু! আপু! এই আপু!”
কেঁপে উঠল পরিণীতা, চমকে তাকাল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা অবাক হয়ে গেল পরিণীতার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে।
অন্যরা গাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে, কিন্তু ওরা দুজন সেটা খেয়াল করল না।
প্রিয়তা নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে, আপু?”
পরিণীতা কিছু বলবে তার আগেই রাজ এগিয়ে এসে তাদের কথার মাঝে বা হাত ঢুকিয়ে বলে উঠল, “তোদের জন্য যদি আজ আম্মুর কাছে ধোলাই খাই, তবে দু’ট কেই রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দেব!”
অরণ্য ও তাল দিয়ে বলল, “আগে দুই রাত শেওড়া গাছে ঝুলিয়ে রাখব!”
প্রিথম ওদের দু’জনের মাথায় বাড়ি মেরে বলল, “ফালতু প্যাঁচ লাগিয়ে কথা লম্বা করবি না!”
রাজ আর অরণ্য অন্যদিকে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। প্রিথম বোনদের উদ্দেশে বলল, “আপুদের জন্য কি আমন্ত্রণপত্র পাঠাতে হবে?”
প্রিয়তা আর পরিণীতা গাড়িতে উঠে বসল। প্রিয়তা ভুলেই গেল পরিণীতাকে মেসেজের কথা জিজ্ঞেস করতে। ৪৫ মিনিট পর তারা শিকদার বাড়িতে পৌঁছাল।
তন্ময় আর থোরি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চার গিন্নি জেগে জেগে তাদের বুড়ো বাচ্চাদের গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন। রাত বারোটা বাজতে আর ১৫ মিনিট বাকি। তারা সবাই শিকদার বাড়ির দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট।ওরা ভয়ার্ত চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।
সমুদ্র অরণ্যের কানে কানে বলল, “এই ভাই, কী বুঝিস? আবহাওয়া কেমন হতে পারে?”
অরণ্যও একইভাবে ফিসফিস করে বলল, “নাতিশীতোষ্ণ! সেফে থাক, কেস খেলে দাদানরা খাবেন! আমরা তো ছোট মানুষ, আমরা কেন কেস খাব?”
রাজ বাঁকা হেসে ওদের দুজনের মাঝে মাথা গলিয়ে বলল, “কেস খেলে তোদের নিয়েই খাব! জানিস তো, আমরা আবার ভাইদের না দিয়ে কিছু খাই না।”
তারা সবাই প্রিথমের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে, আর প্রিথম প্রণয়কে খুঁজছে।
প্রিথম বলল, “বড় দাদান কোথায়?”
রাজ বলল, “দাদান তো আসেননি।”
প্রিথম ভুরু কুঁচকে বলল, “মানে?”
সমুদ্র বলল, “তখন দাদান সবাইকে গাড়িতে তুলে দিলেন, কিন্তু নিজে আসেননি।”
অরণ্যও সম্মত হয়ে বলল, “আর দাদানকে প্রশ্ন করার সাহস কার আছে?”
ওদের কথাবার্তা শুনে প্রিয়তা অবাক হয়ে মনে মনে বলল, “এত রাতে কোথায় গেলেন প্রণয় ভাই?”
সব শুনে প্রিথম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সামনে এগিয়ে কলিং বেল চাপ দিল।
অরণ্য আর সমুদ্র লুকিয়ে পড়ল। চার গিন্নি তখনো জেগেই ছিলেন। অরথি বেগম এসে দরজা খুলে দিলেন। প্রিথমসহ সবাই একটু ভয় পেয়ে গেল, কিন্তু মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল।
অনুস্রী বেগম ভ্রু কুঁচকে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারা সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে—একেকজনের মুখ মাত্রাতিরিক্ত ইনোসেন্ট, যেন তারা ভাজা মাছটাও কখনো উল্টে খাইনি ।
অনুস্রী বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “রাত কতটা বাজে খেয়াল আছে? ভদ্র বাড়ির ছেলেমেয়েরা এত রাতে বাড়ি ফেরে? বেশি বড় হয়ে গেছো নাকি? এই বাড়ির আদব-কায়দা সব ভুলে গেছো?”
ওরা ভদ্র বাচ্চাদের মতো মাথা নিচু করে নিল, একটা শব্দও করল না।
অনুস্রী বেগম আবার বললেন, “তোমাদের কাণ্ড দেখে অবাক হচ্ছি! দিন দিন বড় হচ্ছো, নাকি আরও ছোট?”
ওরা এবার ও কিছু বলল না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
অনুস্রী বেগম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সবার উদ্দেশে বললেন, “সবাই হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আসো, খাবার বাড়ছি।”
ওরা অসহায় মুখে তাকাল। যার অর্থ—পেটে একটু জায়গা নেই, কিন্তু এই কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করার সাহস হলো না কারও। না হলে দেখা যাবে, এই বয়সেই পিঠে দু’-একটা ঘা পড়তে পারে! তাই কথা না বাড়িয়ে সবাই নিজের ঘরে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
ওরা যেতেই অনুস্রী বেগম আবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। এই ছেলে-মেয়েগুলো যে তাকে কোনোদিনও শান্তি দেবে না—এই বিষয়ে তিনি পুরো নিশ্চিত।
রাত ২:৪৫
শিকদার বাড়িতে একটা মশা-মাছিও পর্যন্ত জেগে নেই। সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেছে।
শুধু একজন ছাড়া।
এক সপ্তদশী কন্যা বারান্দার দোলনায় বসে সামনের পিচঢালা রাস্তায় স্থির দৃষ্টি ফেলেছে। চোখ-মুখ ফোলা, ক্লান্ত, বিষণ্ন।
রাত ৩টার কাছাকাছি—পরিনীতা শুনেছে, এই সময় থেকে নাকি ভূতেদের সময় শুরু হয়।
ভীতুর ডিম পরিনীতা!
আগে এই সময় জেগে গেলে তার কেমন কেমন লাগত। মনে হতো, কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে, এখনই কেউ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড় মটকে দেবে! একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর তার ঘুম আসত না। সেই ভয় থেকে বাঁচতে সে সঙ্গে সঙ্গে আবিদকে ফোন করত। আবিদ যত গভীর ঘুমেই থাকুক, ফোন তো তাকে ধরতেই হতো। আর ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই মোহনীয় কণ্ঠে আবদার ভেসে আসত—
“মাস্টারমশাই, ভয় করছে, প্লিজ আসুন!”
আর আবিদ কখনো তার এঞ্জেলের আকুলতা উপেক্ষা করতে পারত না। রাত যতই হোক, ছুটে আসত সে! তখন বোধহয় ভূত-প্রেত দেখত না।
শিকদার বাড়ির নিচের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত সে, আর পরিনীতা বারান্দায় বসে। একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফোনে কথা বলত। কখনো কখনো লুকিয়ে চুরিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার মাস্টারমশাইয়ের কাছে চলে যেত। চোখে ভাসে সে সব দিন!
স্মৃতির স্রোতে ভেসে গিয়ে পরিনীতা হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠল।
আজ আর তার ভয় করছে না।
সে ফোন বের করে ঝাপসা চোখে আবিদের নাম্বারে ৫১২তম কল লাগাল। পরিনীতা এমনি ফোন করেছে, কারণ সে জানে আবিদ ফোন ধরবে না। এই আশা সে কবেই ছেড়ে দিয়েছে, তবু মন যে মানে না।
কিন্তু পরিনীতাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে আবিদ ৫১২তম ফোন কল রিসিভ করে নিল।
পরিণীতা কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে শান্ত, পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসলো—
“কিছু বলবে, পরিনীতা?”
পরিনীতা এত চেষ্টার পর প্রিয় পুরুষটি তার ফোন রিসিভ করেছে—এ ভেবে আনন্দে আত্মহারা হলেও আবিদের কণ্ঠস্বর আর কথা বলার ধরন শুনে তার গলা শুকিয়ে গেল।
আবিদ আবারও শান্ত, শীতল কণ্ঠে বলল—
“কিছু বলার না থাকলে বারবার ফোন করো না, পরিনীতা। অনেক রাত হয়েছে, এটা তোমার জন্য শুভনীয় নয়।”
সে ফোনটা কেটে দিতে, নিলেই পরিনীতা অনুরোধের সুরে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“প্লিজ, মাস্টারমশাই, ফোন কাটবেন না! প্লিজ, আমার সঙ্গে একটু কথা বলুন!”
বলতে বলতেই মেয়েটা ফুপিয়ে উঠল। পরিনীতার কান্না শুনে ধক করে জ্বলে উঠল আবিদের হৃদয়। সে চোখ বন্ধ করে নিল। কানে ধরে রাখা ফোনটি নামিয়ে নিয়ে মনে মনে বলল,
“কেন এত ছলনা, অ্যাঞ্জেল? আমার মতো সাধারণ ছেলের সঙ্গে তোমার এত কিসের শত্রুতা? কেন আমাকে একটু একটু করে মেরে ফেলছ? তুমি হারিয়ে গেলে নিঃস্ব আমি… এমনি-তেও মরে যাব, এভাবে ছলনা করে মারার প্রয়োজন হবে না, অ্যাঞ্জেল।”
সে আবার ফোনটা কানের কাছে ধরল। পরিনীতা কান্না মিশ্রিত গলায় বারবার অনুরোধ করে বলছিল,
“প্লিজ, একটু আসবেন? আমি আপনাকে একটুখানি দেখব। প্লিজ, না করবেন না, মাস্টারমশাই!”
আবিদ কিছু বলছে না। পরিনীতা আবারও অনুরোধের সুরে বলল,
“প্লিজ, মাস্টারমশাই, একটুখানি আসবেন?”
তার আকুতি-মিশ্রিত বাণী আবিদের হৃদয়ের গভীরে আঘাত করছিল। তার অ্যাঞ্জেল তাকে কেন বারবার এত অনুরোধ করছে? তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। কিছুক্ষণ আগেই সে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। দুটো স্যালাইন দিতে হয়েছে, তবে জ্বরটা এখন কম। অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিল, কিন্তু ঘুম আসছিল না। মনের ভেতর আগুন জ্বললে কি আর ঘুম আসে! এর ওপর পরিনীতা একের পর এক ফোন করেই যাচ্ছিল।
আবিদ গভীর শ্বাস ফেলল। তারও যে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তার অ্যাঞ্জেলকে… খুব বেশি ইচ্ছে করছে! আর এই ইচ্ছেটা দমন করা তার জন্য কঠিন। অবশেষে, সে আর ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে পারল না। তার পরি যদি তাকে শেষ করে দিতেও চায়, তাতে আবিদের কোনো অসুবিধা নেই। তাই সে ছোট্ট করে বলল—
“আসছি।”
বলে ফোন কেটে দিলো।
পরিনীতার চেহারা পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। মাত্র এক দিনের অবহেলাতেই তার ছোট্ট মন ব্যথায় জর্জরিত হয়ে গেছে। সে মনে মনে বলল, “আপনাকে আজ আমার সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে!” তবে তার বেহায়া মনে আবিদের জন্য কোনো রাগ নেই, নেই কোনো অভিযোগ। যা আছে, তা শুধুই অভিমান। আবিদের একটুখানি স্নেহেই তার অভিমানের পাহাড় ও গলে পড়বে ।
পরিনীতা ঘরে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। অভিমান থাকুক আর যা-ই থাকুক, এভাবে চোখ-মুখ ফুলিয়ে মঞ্জুলিকা সেজে তো আর মাস্টারমশাইয়ের সামনে যাওয়া যায় না! তাই পাক্কা পাঁচ মিনিট ধরে ঘষামাজা করে শুধু মুখটাই ধুলো, যেন কোনো মতেই মলিনতার রেশ না থাকে। এত ঘষাঘষির ফলে ফরসা মুখটা মুহূর্তেই রক্তিম হয়ে উঠল।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে বেছে বেছে আবিদের পছন্দের পার্পল রঙের থ্রি পিস পরে নিলো পরিনীতা। অতঃপর খোঁপা করা চুল ছেড়ে দিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু এত ঘষে-মেজে মুখ ধুয়েও কোনো বিশেষ পরিবর্তন না দেখে হতাশ হলো। মুখটা এখনো কলাগাছের মতো ফুলে আছে। তবে ওই ফোলা ফোলা মুখ ও অদ্ভুত আকর্ষণীয় মায়ার সাগর!
পরিনীতা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রিবন্ডিং করা সিল্কি চুলগুলো বেণি করে পিঠের উপর ফেলে রাখলো। বেণিটা কোমরের নিচে দুল খাচ্ছে। কাজলের কৌটা হাতে নিয়ে ভাবলো, “এই রাতের বেলায় কাজল কি মাস্টারমশাইয়ের চোখে পড়বে?”
সে আর অতশত না ভেবে চোখে হাল্কা কাজল দিলো। লালচে-গোলাপি ঠোঁটে একটু লিপগ্লস ছোঁয়ালো। কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপও পরলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো, ভালোই দেখাচ্ছে!
সে সাদা রঙের ওড়নাটা গলায় জড়াচ্ছিল, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। পরিনীতা ছুটে গিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। স্ক্রিনে “মাস্টারমশাই” নামটা দেখে তার মন খুশি হয়ে গেলো।
ত্রস্ত হাতে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ক্লান্ত, পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—
“কোথায় তুমি, অ্যাঞ্জেল? বারান্দায় আসো।”
আবিদের কণ্ঠে সেই পরিচিত নামটা শুনে পরিনীতার হৃদপিণ্ড ঢিবঢিব করতে শুরু করলো। লজ্জায় লাল হয়ে বললো
“তুমি দাঁড়াও, এখুনি আসছি।”
আবিদ শুধু ছোট্ট করে বললো—
“হুম।”
পরিনীতা বারান্দার পর্দাটা একটু সরিয়ে সামনে উঁকি দিতেই চোখ স্থির হয়ে গেল। নিচের ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে—একজন লম্বা, গড়নের যুবক দাঁড়িয়ে আছে।
পরিনীতা আর দেরি না করে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তাকে যে লুকিয়ে বেরোতে হবে, উত্তেজনায় মেয়েটা সেটা-ও ভুলেই গেল!
সে যখন অসাবধানতায় ড্রয়িংরুম ক্রস করছিল, তখন এক জোড়া দৃষ্টি তাকে ঠিকই দেখে নিল। কেউ একজন ঈগল-চোখে পরিনীতার গমন দেখল। সঙ্গে সঙ্গেই তার কপালে বিরাট বিরাট ভাঁজ পড়ল। সে ভাবল, এত রাতে এভাবে কোথায় যাচ্ছে?
সে-ও সন্তর্পণে পিছু নিল পরিনীতার।
পরিনীতা বাড়ির পেছনের দিকে দ্রুত পায়ে দৌড়ে গেল। পদ্মপুকুর পেরিয়ে শিকদার বাড়ির উঁচু পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়ানো পেয়ারা গাছটায় সাবধানে পা রাখল। দু-তিন মিনিটের মধ্যেই সে পাঁচিলে উঠে পড়ল। আগেরবার এখান থেকে পড়ে গিয়ে সে ভয়ানক ব্যথা পেয়েছিল, কিন্তু এবার তার মাস্টারমশাই আছেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস—এবার সে কোনোভাবেই ব্যথা পাবে না।
সে চোখ বুজে আল্লাহর নাম নিয়ে ঝাঁপ দিল।
পরিনীতার ভাবনাটাই সত্যি হলো। সত্যিই সে আগেরবারের মতো পিচঢালা রাস্তায় পড়ে হাত-কোমরে ব্যথা পায়নি। সে কারও উষ্ণ বুকের ওপর আছড়ে পড়েছে! কেউ তার কোমর জড়িয়ে ধরে শূন্যে ভাসিয়ে রেখেছে।
সেই ব্যক্তির অতিমাত্রার গরম নিঃশ্বাস পরিনীতার গলার কাছে এসে আছড়ে পড়ছে। কাঁটা দিয়ে উঠল পরিনীতার শরীরে।
সে আবিদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওভাবেই আবিদের গলা জড়িয়ে ধরল। প্রিয় নারীর পরশে আবিদের প্রাণটাও ছটফটিয়ে উঠল। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “কি করছো, অ্যাঞ্জেল! কেউ দেখে নেবে!”
পরিনীতার সে সব কথা কানে ঢুকল না। সে আবিদকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আবিদের গলায় মুখ গুঁজে পড়ে রইল। প্রিয় পুরুষের স্পর্শ তাকে গত ৩০ ঘণ্টার সকল যন্ত্রণা নিমেষেই ভুলিয়ে দিচ্ছে।
সে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল, “আপনি আমার সকল ব্যথার ওষুধ, মাস্টারমশাই। আপনার একটু দেখা, আপনার একটু স্পর্শ আমাকে কী পরিমাণ শান্তি দেয়, আপনি জানেন? জানেন না! জানলে এত কষ্ট দিতে পারতেন না…”
সে আবিদের বুকে মুখ গুঁজে প্রিয় দেহের গন্ধ নিজের শিরায়-শিরায় টেনে নিচ্ছে।
পরিনীতার এমন স্পর্শে আবিদের হাতে-পায়ে কাঁপন ধরছে। ভয়ংকর সব অনুভূতি হচ্ছে। আবিদ মনে মনে বলল, “তুমি আমাকে সত্যি খুন করতে এসেছো, অ্যাঞ্জেল!”
তবে, সে পরিণীতাকে মুখে কিছু বলল না; তাকে কোলে নিয়েই হাঁটা ধরল পাশের চিকন ঘাসের রাস্তা দিয়ে।
এই সকল দৃশ্য কেউ একজন দূর থেকে আগুনচোখে দেখছিল।
তার হাত মুষ্টিবদ্ধ!
সে ও পুনরায় সন্তর্পণে পিছু নিল তাদের…
আবিদের শরীরটা ভীষণ দুর্বল। তবু, তার এখন নিজেকে দুর্বল মনে হচ্ছে না। সে কোলে থাকা নারীটির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “তুমি যে আমার সকল সুখের একমাত্র ঠিকানা, এঞ্জেল।
এতো সুখ কেন তোমার মাঝে।
কেবল তুমিই পারো আমার জীবনটাকে ভালোবাসার ফুলে সাজিয়ে দিয়ে জান্নাত বানিয়ে দিতে। আবার, তুমিই পারো আমাকে দুঃখের কাঁটায় জর্জরিত করে কষ্টের জাহান্নামে ছুড়ে ফেলতে। তুমি হিনা, আমি একেবারে নিঃস্ব!”
তার যা শান্তি লাগছে, তা হয়তো সে কোনোদিন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। চাঁদনি রাতের নিশুতি পথঘাট সাক্ষী হলো দুটো মনের নীরব ভালোবাসার। সকল ভালোবাসা প্রকাশের জন্য বাক্যের প্রয়োজন হয় না—কিছু ভালোবাসা নীরবতাতেই সুন্দর।
পরিণীতা চুপচাপ আবিদকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। মিনিট পনেরো পর, তারা একটা বিশাল শিমুল গাছের নিচে এসে পৌঁছালো। পুরো গাছের নিচ সেজে আছে গাঢ় লাল রঙের শিমুল ফুলে।
অবিদ পরিণীতাকে নামিয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মন-প্রাণ ভরে খুঁটিয়ে খুঁটি দেখে নিলো নিজের প্রিয়তমাকে। পরিণীতার মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল। কপালের কিঞ্চিৎ বেকে যাওয়া টিপটা সোজা করে দিতে দিতে মনে মনে বলল—
“কি বিষাক্ত আসক্তির বাহু-ডোরে আমায় বাঁধলে, প্রিয়তমা!
যেখান থেকে এক পা পিছনে ফেরার আমার সত্যিই নেই উপায়।
এখন আর তোমাকে না পেলে বা হারালে,
মৃত্যুর ব্যথিত কোনো নিস্তার নেই আমার।
আমাকে সম্পূর্ণভাবে হৃদরোগী বানিয়ে দিয়েছ। তুমি, হিনা।
নিঃশ্বাস নিতেও পারি না আমি!”
পরিণীতা আবিদকে গভীর ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে অবাক হলো। সেও কিছুক্ষণ তার প্রিয় পুরুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলল—
“এত সুন্দর কেন আপনি, মাস্টারমশাই?”
অতঃপর মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে লক্ষ্য করল—
আবিদের দুই হাতে ব্যান্ডেজ, চুলগুলো এলোমেলো, শ্যামসুন্দর সুদর্শন মুখে রাজ্যের মলিনতা। চশমার আড়ালের চোখ দুটোও কেমন ঘোলাটে। তার মাস্টারমশাইয়ের এমন অবস্থা দেখে পরিণীতার ভালো লাগার ঘোর নিমেষেই কেটে গেল। বুকের ভেতর আবারও যন্ত্রণার পাহাড় চেপে বসল। সে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে আবারও আবিদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
কাঁদতে কাঁদতেই আবিদের হাত দুটো ধরে বলল—
“কীভাবে এত ব্যথা পেয়েছেন, মাস্টারমশাই? আর কিভাবেই বা এত অসুস্থ হলেন? কেন এমন করেন, বলুন না, মাস্টারমশাই?”
আবিদ অনিমেষ চোখে চেয়েছিল তার এঞ্জেলের ফুলো ফুলো মুখের পানে। সে মনে মনে বলল, সব তোমার জন্য, এঞ্জেল! কিন্তু তুমি কেঁদেছিলে কেন?
তারও ভীষণ মন টানছে।
সামনের রমণীকে আঁকড়ে ধরতে তার মন এখন আর কিছুতেই মানতে রাজি নয়—এসব ছলনা! কিন্তু যা দেখেছে, যা শুনেছে, তাই-বা কীভাবে মিথ্যে হয়? সে বড় একটা শ্বাস নিয়ে নিজের অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতি গিলে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করল। কিন্তু পরিণীতার উপস্থিতি আর স্পর্শ তার চিন্তা-চেতনা এলোমেলো করে দিচ্ছে। তার মস্তিষ্ক বলছে, মেয়েটাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দে, সে তোকে ভালোবাসে না! কিন্তু মন তাতে তীব্র বাধা দিচ্ছে।
সে না সরিয়েই ধীরে বলল, “কেন ডেকেছো, এঞ্জেল?”
পরিণীতা আবিদের বুক থেকে মাথা তুলে তার চোখের দিকে তাকিয়ে হেঁচকি তুলে বলল, “আপনি কেন আমাকে ভুল বুঝছেন, মাস্টারমশাই? আমি কী করেছি? কেন আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছেন? কেন এত যন্ত্রণা দিচ্ছেন? আপনি জানেন না, আপনাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারি না!”
আবিদ তাকিয়ে আছে পরিণীতার চোখের দিকে। ওই চোখে সে মিথ্যে দেখতে পাচ্ছে না। তবে সে যা শুনেছে, তার সবটাই কি মিথ্যে? তবে কেউ কেন মিথ্যে বলবে? আবিদের ভ্রু কুঁচকে গেল।
সে পরিণীতাকে নিজের থেকে সরাতে সরাতে মলিন কণ্ঠে বলল, “প্লিজ, এঞ্জেল! এভাবে পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরো না। তুমি পবিত্র, তোমার গায়ে কলঙ্ক লেগে যেতে পারে!”
এমন কথায় পরিণীতা হতভম্ব হয়ে গেল। সে অবাক কণ্ঠে বলল, “আপনি পরপুরুষ?”
আবিদ একইভাবে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “তাহলে কে আমি? বলো, কে হই তোমার?”
পরিণীতার কথা আটকে গেল।
সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, “বলো, এঞ্জেল! কে হই আমি তোমার?”
পরিণীতা অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে আছে।
আবিদ কিছুটা ধমকের সুরে বলল, “তুমি কোন ভরসায় এত রাতে বাড়ি থেকে বের হলে? তুমি একটা যুবতী মেয়ে, যে কোনো পুরুষ থেকেই তোমার ভয়ানক বিপদ হতে পারে! সেখানে আমি তো সম্পূর্ণ বাইরের ব্যক্তি…”
পরিণীতা কিছুক্ষণ আবিদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। অতঃপর মৃদু হেসে আবিদের দুই হাতের তালুতে পেছানো সাদা ব্যান্ডেজে পরপর দুটো চুমু খেয়ে ধীরে আবারও আবিদকে জড়িয়ে ধরল।
আবিদ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কণ্ঠনালী কেঁপে উঠল। থেমে গেল তার সকল প্রশ্নবাণ।
পরিণীতা আবিদের টি-শার্টের পেছনটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে আবিদের কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
“আপনি আমার কে জানতে চান? আপনি আমার সব! আমার বেঁচে থাকার কারণও আপনি, আমার মরে যাওয়ার কারণও আপনি! আপনি আমার অতীত, আপনি আমার বর্তমান, আপনি আমার ভবিষ্যৎ। আপনি আমার সুখ, আপনি আমার দুঃখ। আপনি আমার রূহের সেই অংশ, যাকে আমার থেকে আলাদা করতে গেলে চিরতরে আমার বিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।
আপনি ব্যথিত হলে আমি নিশ্বাস নিতে পারি না, যার অর্থ—আপনি আমার অক্সিজেন! আপনি আমার সুখের কল্পনা, যাকে আমি বাস্তবতার রঙতুলিতে আঁকতে চাই। তাই, কোনোদিন যদি আপনি হারিয়ে যান, তবে সেদিন এই অনুজা শিকদার—পরিণীতা ও চিরতরে হারিয়ে যাবে!”
“আমি আপনার কাছে বেশি কিছু চাই না। শুধু আপনার হাত ধরে বাকি জীবনটা অতি সাধারণভাবে কাটিয়ে দিতে চাই, যেখানে আপনি পাশে থাকবেন। একটু কষ্ট হলে ভালোবেসে সব পুষিয়ে দেবেন। আমি আপনার সঙ্গে একটা অতি সাধারণ জীবন কাটাতে চাই। আমার অর্থ, বিত্ত, ধন-সম্পদের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি শুধু আপনার সংসার করতে চাই, আপনার সন্তানের মা হতে চাই।
শুনতে পাচ্ছেন? আপনাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ! তাই, সবার দেওয়া কষ্ট আমি সহ্য করতে পারলেও, আপনার দেওয়া কষ্ট আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না!”
বলেই আরও নিবিড়ভাবে আবিদের সঙ্গে মিশে গেল পরিণীতা।
এই বুকটা তাকে এত শান্তি দেয় কেন, বুঝতে পারে না পরিণীতা।
আবিদ সম্পূর্ণ থমকে গেছে,সে সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ! সে জানত পরিণীতা তাকে ভালোবাসে, তাই বলে এতটা? তার ঠোঁটে ফুটে উঠল প্রাপ্তির হাসি।
তার মনের সকল দ্বিধা-সংশয় নিমেষেই মুছে গেছে। রইল না সন্দেহের কোনো অবকাশ। সে বুঝতে পারছে, তার অ্যাঞ্জেল কেবল তারই।
তার অ্যাঞ্জেল তাকে এত ভালোবাসে—এই সন্দেহ না করলে তো সে কোনোদিনই জানতেই পারত না!
সে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে গভীর ভালোবাসায় নিজের ভালোবাসার পরিকে নিজের বুকে মিশিয়ে নিল। এই পরিটা কেবলই তার! যদি কখনো মৃত্যু আসে, আর তার অ্যাঞ্জেল যদি তার হাত ধরে থাকে, তবে সেই মৃত্যুকেও সে হাসিমুখে কবুল করবে!
পরিণীতার মাথার চুলে গভীর ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিল আবিদ।
দুই হাতে পরিণীতার সুন্দর মুখশ্রী তুলে নিয়ে পরপর তার দুই গালে, কপালে, আর ভেজা ভারি চোখের পল্লবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল আবিদ। তার নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় পরিণীতা হারিয়ে গেল সুখের জগতে। জাপটে ধরে অভিমানী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “এত কষ্ট কেন দিয়েছিলেন, মাস্টার মশাই?”
আবিদ পরিণীতাকে জড়িয়ে ধরে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল,
— “আর দেব না।”
পরিণীতার জন্য এইটুকু উত্তরই যথেষ্ট ছিল। সে আর কোনো প্রশ্ন করল না। আবিদকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
— “পুরো তিন দিন হয়ে গেল, আপনি কোলে নেননি, মাস্টারমশাই!”
আবিদ হাসলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— “তাই?”
পরিণীতা আগের মতোই মাথা নাড়লো,
— “হুম।”
আবিদ দুষ্টুমি হাসি হেসে বললো,
— “তাহলে একটু আগে ম্যাডাম কী হাওয়ায় ভেসে এসেছিলেন?”
পরিণীতা একইভাবে উত্তর দিলো,
— “তখন কষ্টে ছিলাম, আপনাকে অনুভব করতে পারিনি। এখন কোলে নিন!”
আবিদ আবার হাসলো,
— “কোলে তুললেই হলো? কোলে চড়তে হলে ওজন কমাতে হবে। তুমি যা ভারী, আমার হাত খুলে হাতে চলে আসবে!”
পরিণীতা রেগে গেল। আবিদের বুকে মাথা ঘষে বললো,
— “নেন, তারাতারি! না হলে এখন কিন্তু কামড় দেবো!”
আবিদ পরিণীতার কথা শেষ হওয়ার আগেই তাকে কোলে তুলে নিলো। পরিণীতার এখন নিজেকে সত্যিকারের পরি মনে হচ্ছে। সে আবিদের গলায় জড়িয়ে ধরে আবিদের কপালে গভীর চুমু খেলো। চোখ বন্ধ করে নিলো আবিদ।
পরিণীতা দুই হাতে আবিদের মাথার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
— “একটা কথা চিরকাল মনে রাখবেন, পৃথিবী পরিবর্তনশীল। মানুষও পরিবর্তনশীল। জাগতিক যা কিছু আছে, সবই পরিবর্তনশীল। তবে যা পরিবর্তনশীল নয়, তা হলো—আপনার অ্যাঞ্জেলের আপনার প্রতি ভালোবাসা। আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা চিরন্তন। শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি আপনার, আর আপনাকে ও আমার হয়ে থাকতে হবে। ভালোবাসি অনেক, মাস্টারমশাই।”
আবিদের কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেল। সে পরিণীতার নরম, মসৃণ গালে গাল ঘষে দিয়ে বললো,
— “কেমন ভালোবাসো, তা তো সময়ই বলে দেবে…”
পরিণীতা মুখ কুঁচকালো, বিরবির করে বলল, “আনরোমান্টিক নিরামিষ বেটা মানুষ!”
আবিদ শুনে ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, “আনরোমান্টিক নিরামিষীই তোমার জন্য ঠিক আছে। তুমি ছোট মানুষ, আমি রোমান্টিক কিনা প্রমাণ দিতে গেলে তুমি সহ্য করতে পারবে তো? অ্যাঞ্জেল, আমি ধরলে কিন্তু ছাড়বো না!”
পরিণীতা লজ্জা পেয়ে গেল। তার গালে ছড়িয়ে পড়ল রক্তিম আভা। সে আবিদের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল।
আবিদ পরিণীতার মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে ভাবল— কি জানি, আল্লাহ আমার কপালে কী লিখে রেখেছেন! অ্যাঞ্জেল, আবেগ-কল্পনাকে দূরে সরিয়ে বাস্তবিক অর্থে ভাবতে গেলে তুমি কি সত্যি কোনোদিন আমার হবে? সত্যিকার অর্থে, তুমি তো আমার জন্য সেই দূর আকাশের চাঁদ! যাকে প্রাণ ভরে দেখার অধিকার থাকলেও ছুঁয়ে দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। আমার মতো দরিদ্র ব্রাহ্মণরা আকাশের দিকে চেয়ে চাঁদকে পাওয়ার স্বপ্ন বুনতে পারে, আশায় বুক বাঁধতে পারে, চাঁদের আলো গায়েও মাখতে পারে… কিন্তু চাইলেই কি তারা চাঁদকে ধরতে পারে? চাঁদ কি সত্যি তাদের কুঁড়ে ঘরে নেমে আসে? তুমি কি আমার জন্য আজীবন সেই দূর আকাশের চাঁদ হয়েই থেকে যাবে, অ্যাঞ্জেল? তুমি কি হবে না আমার একান্ত?
ওই শিকদাররা কি এত সহজে সব মেনে নেবে? এত বছরে ও তুমি তাদের চিনতে পারোনি?
এইসব ভাবতে ভাবতেই আবিদ পরিণীতার চুলে চুমু খেল।
তাদের এই মান-অভিমান, স্নেহ-ভালোবাসা দেখে নিঝুম রাত্রিও যেন লজ্জা পেল। ভালোবাসার আদরে কেটে গেল আরও ২ঘন্টা।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আবিদ পরিণীতাকে ডাকল, “অ্যাঞ্জেল…”
পরিণীতা আবিদের বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আবিদ দু’-তিনবার ডাকল, কিন্তু পরিণীতা নড়ে চড়ে আবার ঘুমিয়ে গেল।
আবিদ তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল, অতঃপর কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিল শিকদার বাড়ির দিকে। পুরোনো জায়গায় ফিরে এসে সে আবারও পরিণীতাকে ডাকল, কিন্তু পরিণীতা এবারও জাগল না।
আবিদ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “ছোটাচ্ছি তোমার ঘুম!”
বলেই সে পরিণীতার গলায় মুখ গুঁজে দিল।
সেকেন্ড দু’এক পার হতেই পরিণীতা ধড়ফড়িয়ে উঠল। তার সারা শরীর কাঁপছে, গা-গলা শিরশির করছে। গলায় খোঁচা খোঁচা কিছুর সঙ্গে উষ্ণ, নরম পরশ পেয়ে সে লাফিয়ে উঠল।
তার ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেছে। সে জেগে দেখল, তার মাস্টারমশাই তার গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে দিয়েছেন। আৎকে উঠল সে মুহূর্তেই পরিণীতার হাত-পায়ের তালু শিরশির করে উঠল। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে তার শরীরের সকল স্নায়ু অবশ হয়ে আসছে, শরীরের সকল রক্ত চলকে উঠছে।
কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হতেই সে আবিদের চুল খামচে ধরল। অনুনয়ের সুরে বলল, “মাস্টারমশাই, প্লিজ ছাড়ুন!”
কিন্তু আবিদ ছাড়লো না। তার পরিণিতাকে জাগানোর উদ্দেশ্য থাকলেও, সে এখন প্রিয় নারীর গভীর স্পর্শে ও গন্ধে নিজেকে সংযম হারিয়েছে।এই মুহূর্তে তার মস্তিষ্কের সবকিছু এলোমেলো লাগছে।
পরিণিতা চটফটিয়ে উঠল। আবিদের মাথার চুল আরও শক্ত করে মুঠো করে ধরে করুন কণ্ঠে বলল,
— “মাস্টারমশাই, প্লিজ!”
পরিণিতার কণ্ঠে ছিল মাদকতার ছোঁয়া, যা আরও বেশি নেশা ধরিয়ে দিল আবিদের মধ্যে। সে পরিণিতাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে তার গাঢ় বাদামি রঙের চোখের দিকে মাতাল দৃষ্টিতে তাকাল। পরিণিতার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাঁপছে তার অতীব আকর্ষণীয়, লালচে-গোলাপি উষ্ণ যুগল। আবিদ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল।
চোখের পলক পড়ার আগেই সে পরিণিতার কোমর শক্ত করে চেপে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিল। এক হাত রাখল ওর পিঠে, আরেক হাত পরিণিতার মাথার পেছনে রেখে তীব্র বেগে আঁকড়ে ধরল তার কোমল ওষ্ঠযুগল। আবিদের ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই পরিণিতার শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। শরীরের ভেতর দৌড়ে বেড়াতে লাগল অপরিচিত সব অদ্ভুত অনুভূতি—যা এর আগে সে কখনো অনুভব করেনি। তবে অনুভূতিগুলো ছিল বড্ড বেপরোয়া, যেন এখুনি পরিনীতা কে শেষ করে দেবে!
পরিণিতা আবিদের টি-শার্ট খামচে ধরল। ওরও নেশা চড়ে গেছে। হৃদস্পন্দন যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে! সারা শরীর তীব্র ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপছে! আবিদের এই উন্মত্ততা, মাতাল করা ছোঁয়া পরিণিতাকে পাগল করে দিচ্ছে।
আরালে থাকা সেই ব্যক্তি এই সকল কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার আগেই সরে গিয়েছিল। তাই এসব আর তার দেখা হলো না। হয়তো তার দেখা উচিতও হতো না…
প্রায় পাঁচ মিনিট পর, পরিণিতা আবারও ছটফটিয়ে উঠল। তার নিশ্বাস ফুরিয়ে আসছে। এবারও আবিদকে খামচি দিচ্ছে! আরও এক মিনিট পর, অবশেষে আবিদ ওকে ছেড়ে দিল।
পরিণীতা হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে, তার অবস্থা দেখার মতো! আবিদ জহুরী চোখে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল। অতঃপর, পুনরায় পরিণীতাকে কাছে টেনে নিল। তার ঠোঁটের স্পর্শ প্রচণ্ড বেপরোয়াভাবে এদিক-ওদিক ছুটছে। পরীণিতার মনে হচ্ছে, সে হয়তো এখুনি এখানেই জ্ঞান হারাবে।
কিছুক্ষণ পর, পরিণীতা আবিদের বুকে মুখ লুকিয়ে হাঁপাতে লাগল। গাল দুটো লজ্জায় লাল পাকা টমেটোর মতো হয়ে গেছে। কিন্তু আবিদের নেশা কাটছেই না! সে পরিণীতার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে গভীর নেশাময় কন্ঠে বলল
— “জান, আমায় আনরোমান্টিক বলেছিলে… দেখলে তো! ভালোবাসার মাত্রা একটু বেশি হলে তুমিই নিতে পারো না। এভাবে ছটফট করলে তোমাকে কি ভালোবাসা দেওয়া সম্ভব? তাই বলছি, এখনো ছোট তুমি! আগে বড় হও, সামান্য ভালোবাসাও সহ্য হয় না তোমার।”
পরিণিতা লজ্জায় চোখ নামিয়ে অধৈর্য কণ্ঠে বলল—
— “চুপ করুন…”
আবিদ ঠোঁট কামড়ে হাসল, গভীর শ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। তারপর আবার বলল—
— “তুমি এত নরম কেন জান? বিশ্বাস করো কিভাবে যে সামলেছি নিজেকে!”
পরিণীতার মনে হলো, এবার সে হয়তো লজ্জায় সত্যিই মারা যাবে! এই মানুষটাকে এরকম রূপে সে আগে কখনো দেখেনি গম্ভীর ব্যক্তিত্বের মানুষটা এমন ৩৬০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেলে অবাক হওয়ারই কথা । কী অদ্ভুত ভয়ংকর সব অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো!
যদি এসবের অভ্যাস হয়ে যায়, তাহলে? তখন কি হবে? তখন আমি এসব চাইবই বা কীভাবে?
আবিদ পরিণীতার লাল লাল গালের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল—
— “আমার সামনে এভাবে লজ্জা পেও না, অ্যাঞ্জেল… বিশ্বাস করো, তোমাকে খেয়ে ফেলতে মন চায়!”
সে পরিণীতার গালে হাত রেখে বলল, “যাও, সকাল হয়ে যাচ্ছে।”
পরিণীতার মুখটা ছোট হয়ে গেল। সে আবিদের বুকে মাথা রেখে বলল, “আরেকটু থাকি?”
আবিদ তার ঠোঁটে হালকা চুমু খেয়ে দুষ্টু হেসে বলল, “কেন?”
আবিদের বলার ভঙ্গি দেখে পরিণীতা লজ্জা পেলো। আবিদ হাসতে হাসতে তার কপালে গভীর চুমু খেয়ে মৃদু স্বরে বলল, “শোনো অ্যাঞ্জেল, তোমাকে এই আদর আমি দিতে চাইনি। কিন্তু ভালোবাসার পরিমাণ এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি, সীমা পেরিয়ে উপচে পড়েছে। তবে এর থেকে বেশি তুমি পাবে না, এমনকি এটুকুও না! যখন যখন ভালোবাসা বেশি হয়ে যাবে, তখন তখন একটু আদটু পাবে।”
পরিণীতার মুখটা অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার হয়ে গেল। আবিদ তার গাল টেনে বলল, “আমার জন্য আমার অ্যাঞ্জেলের উপস্থিতিই যথেষ্ট।”
পরিণীতা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে হাসল। আবিদ পুনরায় তাকে পাঁচিলে তুলে দিয়ে বলল, “সাবধানে যাবে। যদি পড়ো, তাহলে—”
পরিণীতা আবিদকে তার কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে আবিদের গালে একখানা নরম চুমু খেয়ে বলল, “আপনি আছেন না? ভালোবাসা দিয়েই সব ঠিক করে দেবেন।”
এরপর আর কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে নেমে গেল।
আবিদের ঠোঁটে পূর্ণতার হাসি, কিন্তু তার মনের ভেতর দোলাচল। সে ভুল বুঝে নিজেকে এবং নিজের ভালোবাসাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু এই ভুল-বোঝাবুঝি কারো ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি—এটা তার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক বেশ বুঝল।
তবে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। সে মনে মনে বলল—
“আমাদের বিষয়টা কি বিশেষ কেউ জানে, যার জানা উচিত নয়?”
অটোমেটিকভাবে তার ভ্রু কুঁচকে গেল।
তবে এখন এসব ভাবার মতো অবস্থায় সে নেই। বুকের যন্ত্রণায় সে গত দু’রাত ঘুমাতে পারেনি। যন্ত্রণার জায়গাটায় এখন আরাম লাগছে। তাই তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আজ থেকে আবার তার জব শুরু, তাই এখন ঘুমানো খুব প্রয়োজন। সে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
কে জানে, এই তীব্র প্রণয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে?
সকাল ৮টা ৪৫। শিকদার বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী, এক ঘণ্টা পর সবাই অফিস-কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে। এই সকালের সময়টায় শিকদার বাড়ির সকলেই ব্যস্ত সময় পার করেন। তিন গিন্নি নাশতা বানাচ্ছেন, আর তনুশ্রী বেগম ছেলে-মেয়েদের ঘুম থেকে ডেকে তুলতে গেছেন।
শিকদার বাড়ির জমিদারদের নবাবি ঘুম এত সহজে ভাঙে না। কানের কাছে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে ড্রাম বাজাতে হয়, তবেই তারা ঘুম থেকে ওঠেন।
প্রহেলিকা সোফার ওপর আধশোয়া হয়ে ঘুমোচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, হয়তো অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
প্রণয় ঠিক দুই মিনিট আগেই বাড়ি ফিরেছে। চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দুটো লাল, শুষ্ক ঠোঁট—সুদর্শন মুখটায় রাজ্যের মলিনতা। সারারাত কোথায় ছিল, কে জানে!
সে ঘরে ঢুকতেই চোখ গেল সোফার দিকে। কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যও সে ওদিকটা দেখল না। ওয়ারড্রোব খুলে ফরমাল শার্ট-প্যান্ট নিয়ে সরাসরি ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
আজ এস.কে গ্রুপের জন্য বিশেষ একটা দিন। আজ ডি.কে গ্রুপের সঙ্গে পুনরায় পাঁচ বছরের নতুন কন্ট্রাক্ট সাইন হবে। ডি.কে গ্রুপের মালিক সাদমান শিকদার এর বিশেষ শুভাকাঙ্ক্ষী —শিকদার পরিবারের সকল উন্নতির পেছনে যার ৮০% অবদান।
ওয়াশরুমে ঢুকে ঝরনা ছেড়ে ঠান্ডা পানির নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রণয়। শীতল জলরাশি তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মন? মন তো ছুঁতে ব্যর্থ।
এই শীতলতরলরাশি যেন তার দেহে বিষাক্ত কাঁটার মতো ফুটছে, মনে তীব্র দাবানলের সৃষ্টি করছে, যা সহ্য করতে পারছে না প্রনয়। কিছুতেই পারছে না…
সে ভারী নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করল। চোখ বন্ধ করতেই দৃশ্যপটে ভেসে উঠল কিছু অবাঞ্ছিত স্মৃতি। সাথে সাথেই দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তার। এই মুহূর্তে তার কিছুটা মানসিক শান্তি দরকার, নাহলে এখনই দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে সে!
সে ঠিক করল, এই বিষয়ে শুদ্ধের সঙ্গে কথা বলবে। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হলো সে। নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করে বোঝ দিয়ে বলল—
“হতে পারে আমি ভুল ভাবছি। আমি অযথাই আমার রক্তজবার ওপর মিথ্যে সন্দেহ করছি!
আমার রক্তজবা এমন কিছুই করতে পারে না… আমি তো জানি, আমার রক্তজবা শুধু আমাকেই ভালোবাসে! শুদ্ধের সাথে আমার রক্তজবার কিছু হয়নি, হতে পারে না! হয়তো ওটা শুদ্ধের গায়ের গন্ধ নয়, আমার বোঝার ভুল… হয়তো অন্য কিছু… হ্যাঁ, নিশ্চয়ই অন্য কিছুই হবে!”
এভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার ফলে সত্যি মনটা একটু শান্ত হলো। কিছুটা মানসিক স্বস্তি অনুভব করল প্রণয়। এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই এখন আর ততটা খারাপ লাগছে না।
সে দ্রুত গোসল শেষ করল।
প্রিয়তা গোসল সেরে একটা গাঢ় লাল রঙের পাতলা জামদানি শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে। গা ভিজে থাকার দরুন শাড়িটা শরীরের সঙ্গে একেবারে আটসাঁট হয়ে লেগে আছে, যা তার ফর্সা দেহের উজ্জ্বলতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। গালে, গলায়, পিঠে জলের ছোট ছোট বিন্দুগুলো মুক্ত দানার মতো চিকচিক করছে। পদ্মলাল ঠোঁটজোড়া ভীষণ রক্তিম ও আকর্ষণীয় লাগছে। হাঁটু অবধি ভেজা চুলগুলো খোলা, যা থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। হাতে সোনার দু’টো-দু’টো করে চারটা বড় বড় বালা, ঠোঁটে ছোট্ট এক ফালি মোহনীয় হাসি—উফ! পুরো নতুন বউ নতুন বউ ভাব, তার সর্বাঙ্গে চোখ ঝলসানো রূপের ছড়াছড়ি!
সে ধীর পায়ে হেঁটে এসে বিছানার পাশে গিয়ে বসল। শুদ্ধ খালি গায়ে উপুড় হয়ে পড়ে গুমিয়ে আছে। ফর্সা পৃষ্ঠে এখানে-ওখানে ভালোবাসার চিহ্ন। প্রিয়তা শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে হাসল। তার নরম হাত দিয়ে শুদ্ধর সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো করে কানের কাছে মুখ এনে মোহনীয় কণ্ঠে ডাকল,
— “এই যে, শুনছেন?”
শুদ্ধ একটু নড়ে চড়ে উঠল, তারপর সোজা হয়ে শুয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়ল। হাসল প্রিয়তা। এবার সে হেসে শুদ্ধর কপালে গভীর ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে গালে হাত রেখে ডাকল,
— “উঠবেন না? হাসপাতালে যেতে হবে তো!”
প্রিয়তার ভেজা চুলের পানি শুদ্ধর উন্মুক্ত বুকের ওপর পড়ছে।
শুদ্ধ এক টানে প্রিয়তাকে নিজের ওপর ফেলে দিয়ে তার বুকে মুখ ডুবিয়ে বলল,
— “I need you, sweetheart. Once again, I want you deeply.”
প্রিয়তা ছটফটিয়ে উঠে বলল,
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২২
— “ছাড়ুন প্লিজ!”
শুদ্ধ বিরক্ত হয়ে গলায় নাক ডুবিয়ে বলল,
— “ডিস্টার্ব করো না, বউ! ভালোবাসা যেহেতু দিবেই না, তবে একটু ঘুমাতেই দাও!”
বলেই সে প্রিয়তার গলায় হালকা কামড় দিলো। প্রিয়তা আরো ছটফটিয়ে উঠল।