আত্মার অন্তরালে পর্ব ২১
প্রীতি আক্তার পিহু
ইউভানের ঠোঁটে ফুটে উঠল এক কটাক্ষপূর্ণ হাসি। তারপর সে উচ্চারণ করল,
“হি হ্যজ কাম!”
ততমুহূর্তে আভীরও সামনের দিক ফিরে অধর প্রসারিত করে হাসে।সে এতক্ষণ উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, ইউভান কার অনুসন্ধান করছিল।তখনই হলের শেষ প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি সে আর কেউ না বরং ড্রেভেন হান্টার। চারপাশ নিঃশব্দ। হলরুমের বাতাস থমকে গেছে।আর তখনই স্টেজ থেকে ডায়মন্ড বিক্রেতা ব্যক্তিটি দ্রুত সামনে গিয়ে এসে মাথা নত করে কম্পিত কন্ঠে বলে,
“স্যার আপনি যেটা ভাবছেন আসলে তা নয়,আমি…”
ড্রেভেন একটি হাত সামান্য উপরে তুলে ব্যক্তিটিকে থামিয়ে দেয়।এরপর হিমশীতল স্বরে উচ্চারণ করে,
“আইম নোট ইনট্রেসটেড ইন হেয়ারিং ইউর এক্সকিউজ। গেট ব্যক টু ইউর জব।”
মুহূর্তেই আতঙ্কিত সেই ব্যক্তি চুপচাপ মাথা নত করে সরে যায়। হলরুমের লোকজনের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ।সকলের মাঝে গুমোট ভয় বিরাজ করছে। বিশেষ করে ক্যাসিনো তার চোখ মুখে অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট।সে এক দৃষ্টিতে ড্রেভেনের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে।তখনই ক্যাসিনোর অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
“স্যার ড্রেভেন এখানে এসেছে, এতে আমাদের কাজ আরো সহজ হয়ে যাবে।আমাদের লোকেরা খুব সহজে সে ফর্মুলাটা আইস প্যালেস থেকে চুরি করে নিয়ে আসতে পারবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ক্যাসিনোর ঠোঁটে ঠান্ডা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠে।ড্রেভেনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকিয়ে সে গম্ভীর কন্ঠে উচ্চারণ করল,
“ড্রেভেনকে তো আসতেই হতো কারণ হাজার হলেও দুইজন একই নারীর উপর আসক্ত। ইউভানের সাথে দন্ডে জেতার জন্য হলেও আজ ড্রেভেন আসবে সেটা আমি বহু পূর্বেই জানতাম।”
ক্যাসিনো থামল।কতই না চেষ্টা করেছে সে ফর্মুলাটি হাতে পেতে, এমন কি ড্রেভেনর দুর্বলতা আনায়াকে বন্দী করার চেষ্টা করেছে কিন্তু তাতেও একটা সফল হয়নি,কারণটা অবশ্যই ইউভান।আনায়ার উপর প্রত্যেকটা আক্রমণ বিফলে গিয়েছে শুধুমাত্র ইউভানের কারণে।ক্যাসিনো ভাবনা-চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসে ড্রেভেনের শীতল চাহনিতে। ড্রেভেনের নীলাভ দৃষ্টি সরাসরি ক্যাসিনোর মস্তিষ্কে আঘাত হানে।দ্রুত ক্যাসিনো চোখ ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকায়।ড্রেভেন তা দেখে মুখোশের আড়ালে বাঁকা হেসে চারদিক একবার পরিদর্শন করে।তারপর সরাসরি নিঃশব্দে ইউভানের পাশে গিয়ে বসে পড়ে ড্রেভেন।ড্রেভেনের পেছন পেছন আজ তার পার্সোনাল লম্বা চওড়া একজন গার্ড ও এসেছে।সে ও ড্রেভেনে পাশে স্টিল হয়ে দাঁড়ালো।চারপাশের সকলে ভূত দেখার দৃশ্যের মতো চমকে উঠেছে।তবে ইউভানের মুখয়াবের কোন পরিবর্তন দেখা যায় না, শুধুমাত্র ঠোঁটের কোণে একটু কুটিল হাসি ফুটে উঠে।তৎক্ষণ ড্রেভেন তুষার শীতল কন্ঠে উচ্চারণ করে,
“হ্যালো ম্যান!ওয়াট’স আপ?”
কিন্তু ইউভান একবারও পাশ ফিরে তাকায় না। তার চোখ স্থির সামনের দিকে। গলা শক্ত এবং সংযত করে সে জবাব দিল,
“ফাইন!”
আভীর মনোযোগ সহকারে ফোনে কিছু একটা দেখছে।আশেপাশে হচ্ছে না হচ্ছে তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ড্রেভেন ঠোঁটের কোণে বিষাক্ত হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা করে উঠে,
“তো আমার গোল্ডমেরি কেমন আছে?”
এই নামটা শুনেই ইউভানের পুরো মুখ কাঠ হয়ে যায়। এক মুহূর্তে তার চোখে আগুনের মতো ঝলক জ্বলে ওঠে। শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে যায়। নিজের মুষ্টি এতটা শক্ত করে ধরে যে একটু হাড় ভেঙে যাওয়ার উপক্রাম।ঠোঁটের কোণে একটুখানি তাচ্ছিল্য ভরা হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো,
“নিজের প্রাণকে কেই বা খারাপ রাখে?”
ড্রেভেনের ঠোঁটের কোণায় থাকা আগের সেই বিষাক্ত, তাচ্ছিল্যভরা হাসিটা এবার মুছে যায়। তার মুখে নেমে আসে কড়া গম্ভীরতা।তৎক্ষণ সে ধারালো কন্ঠে উচ্চারণ করে,
“সি ইজ নোট ইউর প্রোপার্টি মিস্টার।”
ইউভান ঘাড় কাত করে রক্তিম দৃষ্টিতে তাকায় ড্রেভেনের দিকে। সে ঠোঁটে আত্মবিশ্বাসী হাসি ফুটিয়ে শুধালো,
“ইউ আর রাইট!সি ইজ নট মাই প্রোপার্টি, বাট সি ইজ মাই সোলবিট!”
পাশে দাঁড়ানো গার্ডটির দৃষ্টির সামনে কিন্তু তার কান ইউভান আর ড্রেভেনের কথোপকথনের দিকে।ড্রেভেন বাঁকা মুচকি হাসির সঙ্গে বিষমাখা কণ্ঠে জবাব দেয়,
“এন্ড ওয়াট ইফ আই সে, সি ইজ মাইন?”
মুহূর্তেই ইউভানের চোখের কোণা শক্ত হয়ে উঠে।সে ক্রোধে চোয়াল শক্ত করে, রাগে কাঁপা শীতল কণ্ঠে গর্জে ওঠে,
“তোর মুখে ওই নামটা মানায় না।আবার বললে জিহ্বা ছিঁড়ে দেব।”
ড্রেভেনের চোখ দুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে।সে কটাক্ষভরা হাসি দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“আমার দেশে এসে, আমার মাটিতে দাঁড়িয়ে
আমার সামনে এই সাহস?বাহ!”
ইউভান অধরের কোণে সামান্য রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে তোলে।পরমুহুর্তে সে হাতের আঙুল উঁচু করে দগ্ধ কণ্ঠে জবাব দেয়,
“ওয়াট ডু ইউ নো দ্যাট দেশ অথবা সীমানা, এই ইউভানের কাছে এসব তুচ্ছ।আমি যেখানে দাঁড়াই
সেই মাটিটাই আমার হয়ে যায়।”
ড্রেভেন চারপাশে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখল সকলের মনোযোগ ডায়মন্ডের উপর।এরপর সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে, চাপা নিঃশ্বাস ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আই উইল ফা*ক ইউর কনফিডেন্স, মিস্টার!”
ইউভানের মুখয়াবের তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যায় না।সে শান্ত অথচ ভয়ংকর গলায় ফিসফিস করে উচ্চারণ করে,
“ডোন্ট টেস্ট মাই পেসেনস!আমার ভেতরকার অন্ধকারকে জাগতে বাধ্য করো না, কারণ একবার জেগে উঠলে।তুমি কোন দিক দিয়ে পালাবে বুঝতেও পারবে না।”
ড্রেভেন কিছু বলতে যাবে তার পূর্বে মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট শুরু হয়ে যায়,
“লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যানস!দ্য মোমেন্ট ইউ অল ওয়েটিং ফর ইজ হিয়ার! উই আর প্রেজেন্টিং দ্য লেজেন্ডারি ব্লাক ডায়মন্ড।”
আলো নিভে আসে, কেবল একটিমাত্র স্পটলাইট ঝলসে উঠে সামনে রাখা একটি কালো মখমলের বাক্সের ওপর।যেখানে জ্বলজ্বলে কালো হীরাটি দেখা যাচ্ছে।ইউভান পায়ের উপর পা তুলে সামনের দিকে তাকায়। আভীরও ফোন থেকে চোখ সরিয়ে সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।এরপর ঘোষক আবার বলে ওঠে,
“দ্য স্টারটিং বিড 2.55 মিলিয়ন USD অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ৩০ কোটি টাকা থেকেই শুরু হচ্ছে নিলাম।”
মুহূর্তেই দাম কষাকষির শুরু হয়ে যায়।একজন মধ্যবয়সী ইতালিয়ান বিজনেসম্যান হাত তুলে বলে,
“2.97 মিলিয়ন মার্কিন ডলার।”
তারপরে আর একজন বিজনেসম্যান উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“আই ওফার “ল৩.৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।”
তৎক্ষণ ক্যাসিনো উঠে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে উচ্চারণ করে,
“৫.৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৭০ কোটি টাকা।”
স্টেজ থেকে পুনরায় এনাউন্স করে বলে,
“ক্যান এনিওয়ান গিভ মোর দ্যান দ্যাট?”
চারপাশে থমথম নিরবতা। ক্যাসিনো বাঁকা হাসে কারণ সে ভেবেই নেয় ডায়মন্ডটি এখন তার হবে।কিন্তু তার এই ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে আচমকা পেছন থেকে রহস্যময় গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসে,
“9.76 মিলিয়ন USD। ”
সবাই চমকে ওঠে।ক্যামেরা ঘুরে যায় পেছনের কাঙ্খিত ব্যক্তিটির উপর।কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না এই ডায়মন্ডটির দাম ১০০ কোটি টাকা পেরিয়ে গিয়েছে।
ব্যক্তিটি আর কেউ না বরং ড্রেভেন।ক্যাসিনো এক চাপা নিশ্বাস ফেলে বসে পড়ল।ড্রেভেন সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে একবার হালকা হাসে।তবে এই হাসিকে বেশিক্ষণ টিকতে দিল না ইউভান।সে স্থির হয়ে বসে, হাত উঁচু করে তীব্র কণ্ঠে উচ্চারণ ,
” 12.71 মিলিয়ন USD”
হলঘরে আবার গুঞ্জন শুরু হয়। কেউ বিস্ময়ে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়।ড্রেভেন খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে যে,ইউভান তাকে জিততে দিবে না।কিন্তু সে কি এত সহজে হার মানে?ড্রেভেন এবার সরাসরি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ইউভান দৃষ্টির উপর নিক্ষেপ করে। এরপর কন্ঠে আরো দৃঢ়তা এনে বলে,
“14.41 মিলিয়ন USD।”
হলঘরের বাতাস থমকে যায়।সকলে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ড্রেভেনের দিকে। ঘোষক একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে যাবে তার পূর্বেই ইউভান উঠে দাঁড়াই।সে ড্রেভেনের দৃষ্টি থেকে নিজের দৃষ্টি সরায় না বরং আরো হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাই।নিস্তব্ধতা ভেদ করে সে উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করে,
” 16.49 মিলিয়ন USD ( প্রায় ২০ কোটি টাকা।)
এই কথা বলা মাত্রই আভীর কেশে ওঠে।এবার ক্যামেরা ঘুরে ইউভানের দিকে যায়।সকলে হা হয়ে তাকিয়ে আছে।ক্যাসিনো পেছন ফিরে ইউভানের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাই।তবে ড্রেভেনের মুখের অভিব্যক্ত স্পষ্ট না মুখোশের আড়ালে।তখন ঘোষকের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।সে বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
“আর ইউ শিওর স্যার?”
ইউভান সামনের দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে তীব্র কন্ঠে গর্জে ওঠে,
“এনি ডাউট?”
ঘোষক দুই দিকে মাথা নাড়ায়।সে হাস্য মুখে সবার দিকে তাকিয়ে এনাউন্সমেন্ট করে,
” স সোল্ড!দ্যা ব্লাক ডায়মোন্ড গোস টু মিস্টার ইউভান।”
সকলে স্তব্ধ।কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না সামান্য একটি ডায়মন্ড ২০০ কোটি টাকা পেরিয়ে গিয়েছে।এই কাঙ্ক্ষিত ডায়মন্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্য দিয়ে কেনার বিষয়টা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। ইউভান একটু বাঁদিকে বডিগার্ডের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে।মুহূর্তেই চেকের বিনিময় ডায়মন্ডটি গার্ডদের কাছে হস্তান্তর হয়।একজন একজন করে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সম্মানসূচকভাবে তালি দিতে লাগে।ইউভান ঠোঁটে বিজয়ী হাসি নিয়ে নিলিপ্ত ভাবে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করে।আভীর ও উঠে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।কিন্তু সেই সময় ড্রেভেনের ছুড়া কথায় ইউভানের পা থেমে যায়। সে ধীরে ধীরে পেছন থেকে ফিরে ড্রেভেনের দিকে তাকায়।ড্রেভেন বাঁকা হেসে দু কদম এগিয়ে ব্যঙ্গময় কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“ডায়মন্ডকে পেয়েছো বলে এই না যে চাঁদকে ও নিজের আকাশে সাজাতে পারবে।”
ইউভানের ঠোঁটে এবার একরাশ তাচ্ছিল্য জমে ওঠে। তাচ্ছিল্যভরা ঠান্ডা গলায় ইউভান জবাব দেয়,
“চাঁদ তো আমার আকাশেই উঠবে!কোনো নর্দমার কেঁচোর কাছে আমি আমার আকাশের চাঁদ নামতে দেব না।সো কুল ম্যান!”
এই কথা শুনেই ড্রেভেনের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায়। নিচের চোয়াল কাঁপতে থাকে রাগে। দাঁত কিড়মিড় করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে,
“সেটা সময় বলে দিবে।”
ইউভান কোন প্রতিউত্তর না করে পেছন দিক ফিরে সেখান থেকে প্রস্থান করে।এসব দৃশ্য প্রতাক্ষ করে তৎক্ষণ ড্রেভেনের পাশে দাঁড়ানো গার্ডটি চোখ ফিরিয়ে তাকায় ক্যাসিনোর দিকে।গার্ডটির চোখের ইশারা বুঝে ক্যাসিনো চোখ বন্ধ করে সম্মতি জানাই। কিন্তু ড্রেভেন আঁড়চোখে গার্ড এবং ক্যাসিনোর চোখের ইশারায় কথা বলার বিষয়টি লক্ষ্য করে হাসে।এরপর চোখ ঘুরিয়ে ইউভানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে উচ্চারণ করল,
“মিশন সাকসেসফুল!”
গাড়ির ভেতরে অস্বস্তিকর নিঃশব্দতা। সামনের সিটে ড্রাইভার মনোযোগী হয়ে ড্রাইভ করছে। পেছনে চামড়ার আরামদায়ক সিটে বসে আছে আভীর আর ইউভান।ভেতরে গাড়ির হিটার চলছে, কিন্তু তবুও বাইরের শীত গাড়ির কাঁচ ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়েছে।এই নীরবতা ভেদ করে আভীর উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে,
“ওয়াট দ্যা হেল ইউভান ব্রো?এসব কেন করলি?”
ইউভান জানালার কাঁচের বাইরে তাকায়।শহরের বাতিগুলো ঝাপসা লাগছে।ঠান্ডা স্থির কন্ঠে সে জবাব দিয়ে ওঠে,
“জেতার জন্য!”
আভীর কপাল কুঁচকে মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“কার থেকে?”
ইউভানের ঠোঁটের কোণে হালকা দৃঢ়তা ফুটিয়ে উত্তরে বলল,
“ড্রেভেনের থেকে।”
আভীর বিস্মিত হয়ে বলল,
“আর ইউ কিডিং মি?লাইক সিরিয়াসলি?”
ইউভান চোখ ফিরিয়ে আভীরের দিকে তাকায়।সঙ্গে সঙ্গে আভীর কয়েকটা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে ঠান্ডা পুণরায় আওড়ায়,
“ওকে!আগে বল কতদিন তুই আনায়ার কাছে ড্রেভেনের অস্তিত্ব লুকিয়ে রাখবি?”
ইউভান ঠোঁট বাঁকিয়ে ধরা কন্ঠে বলল,
“যতদিন ইউভানের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন।”
তৎক্ষণ আভীরের ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য রহস্যময় হাসি খেলে যায়।সে তার বাদামি চুলের গোছা এক হাতে ব্রাশ করে পিছনে ঠেলে দিল।তাদের কালো গাড়িটি ধীর গতিতে থামে এক বিশাল, অভিজাত বিল্ডিং-এর সামনে। চারদিকে হালকা তুষারপাত হচ্ছে আর গাড়ির কাঁচের ওপরে জমেছে এক পরত পাতলা বরফ।গার্ড এগিয়ে এসে নত মাথায় গাড়ির দরজা খুলে দেয়। দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে বিল্ডিং এর ভেতরের দিকে অগ্রসর হয়। বিশাল গ্লাসের দরজা পর দৃশ্যমান হয় ড্রয়িংরুম। ডানদিকে গ্র্যান্ড সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের তলায়,যার পাশ দিয়ে ঝুলে আছে বিশাল এক ঝাড়বাতি।তখনই ইউভান আভীরকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“আমার জন্য এক কাপ ব্ল্যাক কফি পাঠা উপরে। আর হ্যাঁ, অবশ্যই সুগার কম হবে।”
আভীর সরু চোখে ইউভানের দিকে তাকায়। তার কাছে এ আর নতুন কী? তার মনে পড়ে যায় একেবার শখ করে সে ইউভানকে কফি বানিয়ে খাইয়েছিল। সেদিন থেকেই কফি বানানো দায়িত্ব তার ঘাড়ে এসে পড়ে।আভীর পেছনের ফিরে হঠাৎ বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
“সুগারের বদলে বিষ মিশিয়ে দিলে আজ আমার লাভবাডকে রেখে এখানে পড়ে থাকতে হতো না।”
এই কথাটা ঠিকি ইউভানের কানে গিয়ে পৌঁছে যায়।একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে,সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলে,
“এসব শোনার জন্যই বুঝি এটাকে বড় করেছি আমি।”
বলেই ইউভান ধীর পায়ে উঠে যায় উপরের তলায়।সে একটা নির্দিষ্ট রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে।নিশব্দে সে সোজা একটি চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে পরে।এরপর আয়েস ভঙ্গিতে পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটি নাম্বারে ডায়াল করে।
অপদিকে, আনায়া তখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।ফোনের রিংটোনের বিরক্তিকর আওয়াজ তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। সে আদো-আদো চোখ খুলে তাকায় জানালার দিকে। মুহূর্তেই দুপুরের সূর্যের কড়া রশ্মি পর্দা ছেদ করে তার চোখে এসে পড়ে।আনায়া সঙ্গে সঙ্গে এলোমেলো চুলগুলো নিয়ে উঠে বসল।সকাল গড়িয়ে দুপুরে গিয়েছে সে টেরও পাই না।আনায়া চোখ মেলে কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের পাতায় অন্যমনস্কতা। ধীরে ধীরে ফোনটা হাতে তুলে নিল আনায়া। কিছুক্ষণ স্তব্ধ তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে অর্থাৎ কিছু অনুধাবন করার প্রচেষ্টা করছে সে। এক নিমিষে সমস্ত স্মৃতি ঝাপসা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় তার।গতরাতের সেই ভয়ংকর স্মৃতি এবং গাড়ির ভেতরের ঘটনা মনে পড়ায় লজ্জা, ভয়ের মিশ্রণ অনুভূতিতে মুখ লাল হয়ে ওঠে তার।সে কম্পিত হাতে ফোনটা রিসিভ করে কানে তুলে নিল।তৎক্ষণ অপরপ্রন্ত থেকে ভারী পুরুষলি কণ্ঠ ভেসে আসে,
“সুইটি!”
আনায়ার বুকটা কেমন ধপ করে ওঠে।ইশশ!ছেলেদের কন্ঠ বুঝি এতো গভীর হয়?সেটা হয়তো আনায়া ইউভানের কন্ঠের আওয়াজ না শুনলে জানতেই পারত না। সে কণ্ঠনালী কাপিয়ে জবাবে বলে উঠল,
“হুমম!”
ফোনের ওপাশ থেকে শুধু নিঃশ্বাসের ভারী আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সেই আওয়াজে আনায়ার হৃদয় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।হঠাৎ সেই নিঃশ্বাস ভেদ করে ভেসে আসে ইউভানের কন্ঠে,
“ঘুম কী ভেঙেছে ম্যাডাম আপনার?”
আনায়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে গলার স্বর ভারী করে উত্তর দিল,
“হুমমম!ফোন দিলেন যে?”
ইউভান বাঁকা হেসে জবাবে বলল,
“কেন আপনাকে ফোন দেওয়ার জন্য কি আমার কারণ লাগবে?”
আনায়া তড়িৎ কন্ঠে বলে উঠলো,
“না মানে আমি সেটা বলিনি! আচ্ছা আপনি এখন কোথায়?”
ইউভান গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“সুইজারল্যান্ড!”
আনায়ার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। হতচকিত হয়ে সে এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসে পড়ে বিছানায়।বিস্মিত কন্ঠে কে প্রশ্ন করে বলল,
“কি? কখন? কোথায়? কীভাবে? কেন?”
ইউভান কিছুটা হতভম্ব হয় আনায়ার এহেন প্রতিক্রিয়ায়।সে আনায়াকে আশ্বস্ত করার জন্য ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“কুল ডাউন! হঠাৎ জরুরী একটা কাজে বের হতে হয়েছে রাতেই।তুই যেহেতু ঘুমাচ্ছিলে তাই আর ডেকে তুলিনি।
আনায়া দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ফেলে গলার স্বর নিচু করে আওড়ায়,
” ওহহ!”
কিছুক্ষণ থমথমে নীরবতা।কেউ কোন কথা বলছে না।এই নীরবতা ছেদ করে হঠাৎ ইউভান বলে উঠল,
“ম্যাডাম, আপনি কি আমাকে মিস করছেন?”
আনায়া একরাশ অনুভূতি গিলে ফেলে ঠাণ্ডা কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“আজব!আমি কেন মিস করব আপনাকে?”
ইউভান অধরের কোণে হালকা হাসি ফুটিয়ে তুলে চাতুর্য মেশানো স্বরে বলল,
“করবেন!কারণ অকারনেই মিস করবেন আমাকে।”
আনায়া ঠোঁট বাঁকিয়ে কণ্ঠে তীব্র ঠাট্টা মিশিয়ে বলল,
“হু! অতটা খারাপ দিন এখনো আমার আসেনি বুঝলেন।”
ওপাশ থেকে ইউভান ধরা গলায় শুধালো,
“ম্যাডামের হাব-ভাব ভালো ঠেকছে না আমার কাছে। ম্যাডাম কী আমাকে সিডিউস করার চেষ্টা করছেন? যদি তাই করে থাকেন তাহলে বলবো— লাভ হবে না! আমি আসব নাহ।”
আনায়া হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে। মনে মনে ভাবছে একটা মানুষ এতটা বেশি কিভাবে বুঝতে পারে?পরক্ষণে কটকটে গলায় বলে উঠল,
“তো কে বলেছে আসতে? আপনি ওখানেই থাকুন। আসার প্রয়োজন নেই।”
কথাটা বলার পরেই ওপাশ থেকে ইউভানের কণ্ঠটা একটু গা শিরশির করে দেয় আনায়া।ইউভান নেশালু কন্ঠে উচ্চারণ করে,
“এটা তো আপনার মুখ বলছে। কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি, আপনার মন বলছে যেন আমি আসি আর এসে অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পন্ন করে দেই।”
আনায়া ভ্রু কুঁচকে তুলে বোঝার চেষ্টা করে এই ‘অসম্পূর্ণ কাজ’ বলতে ইউভান ঠিক কি বুঝাচ্ছে?সে একটু দ্বিধায় ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ফেলে,
“মানে কিসের অসম্পূর্ণ কাজ?”
সেই মুহূর্তে ইউভানের গলা একটুখানি ভারী শোনা যায়,
“গত রাতে গাড়িতে যে কাজটা অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে ওটা। কিছু করার আগেই তো আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।”
এটা শোনার পর আনায়ার মনে ঝলসে ওঠে সেই রাতের টুকরো স্মৃতি। স্পষ্ট কিছু না বললেও ইউভানের কথার ইঙ্গিত সে এবার ঠিকই বুঝতে পারে।তার মুখটা লাল হয়ে যায় মুহূর্তেই। ।তৎখান ইউভান আনায়াকে লজ্জায় ফেলানোর প্রয়াসে পুনরায় বলে ওঠে,
“তুই কী লজ্জা পাচ্ছিস সুইটি?”
এবার লজ্জায় আনায়া ঠোঁট কামড়ে ধরে।কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হচ্ছে তার।তখনই সে মুখ ফঁসকে নিজের অজান্তেই বলে ফেলে,
“অভদ্র লোক!”
ইউভান নিঃশব্দে হাসলো।এরপর আনায়াকে আরেকটু উত্তপ্ত করার উদ্দেশ্যে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠে,
“অভদ্র হয়েছি আমি তোমারই প্রেমে তাই….
কাছে আসো নাহ..আরও…
তৎক্ষণাৎ আনায়া আর সহ্য করতে না পেরে ফোনের ওপাশে চিৎকার করে ওঠে,
“চুপপপপপ!”
চিৎকারের তীব্রতায় ইউভানের হাতে ধরা ফোনটা খানিক কেঁপে ওঠে। সে এক সেকেন্ড চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফোনটা একটু কানে থেকে সরিয়ে নেয়।ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে আনায়া কলটা কেটে দিয়েছে।ইউভান বাঁকা হেসে ফোনটা রেখে টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কিছু ফাইল দেখতে থাকলো।
অতীত,
আলিসা তার অতীতের দীর্ঘ ঘটনা বলে থেমে গেল। অনেকটা হালকা লাগলেও, বুকের ভেতর কোথাও এখনো বেদনা জমে আছে।ক্যাসিনো এতক্ষণ একদম চুপচাপ ছিল। শুধু তাকিয়ে শুনছিল। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না, একজন বাবা কীভাবে তার নিজের সন্তানের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে! এতটা অমানবিকতা কীভাবে সম্ভব?তবে একটা জিনিস সে স্পষ্ট বুঝে গেছে যে, আলিসার এই অতীতই তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলেছে।
তখনই আলিসার চোখ থেকে হঠাৎ একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।পাথরের মতো কঠোর মনের মানুষ ক্যাসিনো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে এক হাত বাড়িয়ে দেয়। সেই একফোঁটা কান্নার পানি সে আলিসার গাল থেকে আলতো করে মুছে দেয়।আলিসা কিছুটা অবাক হয়ে, থেমে যায়। চোখ বড় বড় করে ক্যাসিনোর দিকে তাকিয়ে রইল।ক্যাসিনো সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে গলা নিচু করে বলে,
“যা হয়েছে তা বদলাতে পারবো না, তবে এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারো এমন কিছু ভবিষ্যতে তোমার জীবনে কোনদিনই হবে না।”
আলিসা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।ক্যাসিনোর হঠাৎ এমন পরিবর্তন সে উপলব্ধি করতে পারছে না।একি কেবলই সমবেদনা নাকি অব্যক্ত কোন অনুভূতি?এর কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেন ল্যান্ড করে সুইজারল্যান্ডে। সবাই একে একে প্লেন থেকে নেমে যায়।আ্যশার তখনো ঘুমিয়ে আছে।আলিসা তাকে আলতো করে নাড়িয়ে তোলে।এয়ারপোর্টের বাইরে এসে তারা দেখে কালো রঙের এক মার্সিডিজ-বেঞ্জ দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাসিনো নিজেই দরজা খুলে ধরে।আলিসা আ্যশারকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।গাড়ি চলতে শুরু করে সুইজারল্যান্ডের সরু রাস্তা দিয়ে।আ্যশার হালকা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
আলিসা আ্যশারের মাথায় হাত বুলিয়ে মোলায়েম কন্ঠে জবাব দেয়,
“যেখানে কোনো অন্ধকার আর কোন ভয় নেই সেখানে যাচ্ছি আমরা।”
এই কথা শুনে ড্রাইভিং সিটে বসা ক্যাসিনো ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে তুলল।কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে থামল কোর্টের সামনে।আলিসা বুঝতে না পেরে ক্যাসিনো কে জিজ্ঞাসা করে,
“এখানে কেন এনেছো আমাদের?”
ক্যাসিনো জানালার কাচ নামিয়ে মাথা সামান্য ঘুরিয়ে আলিসার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,
“ভেতরে চল। সব বুঝবে।”
আলিসার দুচোখ প্রশ্নে ভরা, তবুও সে আ্যশারকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পরে।ভেতরে প্রবেশ করার মুখেই আলিসা নিচু হয়ে আ্যশারের কপালে একটা চুমু খায়।
তারপর বলে,
“আ্যশার, তুমি এখানেই থেকো। আমি একটু ভেতরে যাচ্ছি, ঠিক আছে? বেশি ঘোরাঘুরি করো না।”
আ্যশার মাথা দু’দিকে নাড়ে। তারপর আলিসা পেছন ফিরে ক্যাসিনোর সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে।আ্যশার বাইরে খেলতে থাকে।ভেতরে ঢুকে দেখে, একজন ম্যারেজ অফিসার দাঁড়িয়ে।সামনে বিয়ের কাগজপত্র ছড়ানো। আলিসা পুরো থমকে যায়।সে ক্যাসিনোর দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলে,
“এসব কী?”
ক্যাসিনো চোখে চোখ রেখে হালকা কণ্ঠে বলে,
“ভেবেছিলাম, তোমাকে কাঁদিয়ে ছেড়ে দেবো।কিন্তু কেন জানি পারলাম নাহ সেটা করতে।”
আলিসা শক্ত চোখে তাকিয়ে চাপা কন্ঠে বলে উঠলো,
“দয়া দেখাচ্ছেন আমাকে?আমার সব কথা মানতে রাজি হয়েছেন শুধুমাত্র ওই ভিডিওটার জন্য ভুলে গিয়েছেন বুঝি?”
ক্যাসিনো হাসল।কেন হাসলো সে নিজেও জানেনা।আলিসা সেই হাসি লক্ষ্য করে বড্ড অবাক হয়,তার এত কঠিন কথায় ক্যাসিনোর এমন প্রতিক্রিয়া সে আশা করিনি।ক্যাসিনো কাগজটি আলিসার দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে পুনরায় বলল,
“তোমাকে মর্যাদা দিতে চাই রোজ।পরিচয় দিতে চাই আমার। শুধু নামেই না বরং অনুভবেও।”
আলিসা কিছু বলতে চায়, কিন্তু কথা আটকে যায় গলায়।সে ক্যাসিনোর হঠাৎ পরিবর্তিত আচারণে ক্রমাগত বিস্মিত হচ্ছে। তবে অবশেষে সই করে ফেলে সে।সবকিছু যেন স্বপ্ন লাগছে আলিসার কাছে।ওদিকে আ্যশার ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে আশপাশে হাঁটছে।তখনই তার নজর আটকায় একটি গোলাপ ফুলের দিকে।সে খুশিতে হাত বাড়িয়ে গোলাপটি ছিঁড়তে যায়।ঠিক তখনই পাশ থেকে একজন লোক এগিয়ে এসে বললেন,
“ওই ছেলে! ফুল ছিঁড়তে নেই বাবা। তোমার মা কোথায়?”
আ্যশার চমকে যায়। চোখ বড় বড় করে লোকটার দিকে তাকায়।’মা’ এই শব্দটা তার কাছে অচেনা, যেমন কেউ প্রথমবার চাঁদ দেখে।।সে কখনোই শব্দ উচ্চারণও করিনি।আ্যশার বড্ড কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
” মা মানে কী?”
লোকটা অবাক হয় আ্যশারের কথায়।তবুও সে নিচু হয়ে আ্যশারের চোখে চোখ রেখে উত্তর দিল,
“মা মানে যিনি তোমাকে লালন-পালন করেন,খাবার দেন, জামা পরান, আদর করেন,স্কুলে নিয়ে যান।আর মায়েরা তাদের সন্তানকে অনেক বেশি ভালবাসে।”
আ্যশার মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনল।তার মনে পড়ে—সে তো রাস্তায় বড় হয়েছে, আগে কখনো কেউ তাকে খাবার দেয়নি, স্কুলে পাঠায়নি,আদর করিনি কিন্তু আলিসা করেছে।তার অসুখে রাতে জেগে থেকেছে, শীতের রাতে জড়িয়ে ধরেছে,
কাঁদলে বুকে টেনে নিয়েছে আলিসা।তাহলে মা মানে তো সে–ই।আ্যশার ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে লোকটির দিকে এক পলক তাকায়ে,মুহূর্তেই ফুলটা ছিঁড়ে উল্টো পথে দৌড় দিল।লোকটি হতভম্ব হয়ে ফ্যাল ফ্যাল চোখের সেদিকে তাকিয়ে রইল।আলিসা আর ক্যাসিনো বাইরে বেরিয়ে চারদিক তাকিয়ে আ্যশার কে খুঁজে।আলিসা আ্যশারকে না পেয়ে বিচলিত হয়ে বলল,
“ক্যাসিনো আ্যশার কোথায় গেল?”
ক্যাসিনো গাড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে উত্তরে বলল,
“চিন্তা করো নাহ। হয়ত ও গাড়িতে আছে আমি গিয়ে দেখছি।”
আলিসা মাথা নাড়ায়।তারা যখনই গাড়ির দিকে এগোতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে একটি শিশুর কন্ঠস্বর তীক্ষ্ণ ভাবে ভেসে আসে,
“রোজ মা!”
আলিসা থেমে যায়। বুকটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে তার। সে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে ছোট্ট আ্যশার দৌড়ে আসছে, হাতে একখানি লাল গোলাপ নিয়ে।আ্যশার দৌড়ে এসে দু’চোখে শিশির ভেজা উচ্ছ্বাস নিয়ে গোলাপটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মা ফুল!”
আলিসা ভেজা নয়নে তাকিয়ে রইল। ‘মা’ শব্দটা তার অস্তিত্বের ভিত কাঁপিয়ে দেয়।এই প্রথমবার কেউ তাকে “মা” বলল। প্রথমবার! শুধু জন্ম দিলেই কি মা হওয়া যায়? না, লালন-পালন, ভালোবাসা, বুকে আগলে রাখাই তো আসল মাতৃত্ব। আলিসা মুহূর্তে নিচু হয়ে দুই হাত বাড়িয়ে আ্যশারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।আ্যশার তার ছোট্ট হাতে গোলাপটি আলিসার চুলের মাঝে গেঁথে দিয়ে হেসে বলল,
“তোমায় সুন্দর লাগছে রোজ মা!”
আলিসা কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“থ্যাঙ্ক ইউ বাবা। চলো এখন আমাদের ফিরতে হবে।”
বলেই আ্যশারের হাত ধরে সামনে এগুলোর জন্য উদ্যত হয়।ঠিক তখনই পিছন থেকে আ্যশার থেমে দাড়ায়।আলিসা ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে?”
তখন আ্যশার হঠাৎ বলে বসে,
“তুমি কি আমায় ভালোবাসো, রোজ মা?”
আলিসা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ছোট্ট মুখটার দিকে। এসব কথাবার্তা তো সে শেখায়নি আ্যশারকে। তবুও কী গভীর প্রশ্ন!ক্যাসিনো নির্বাক চোখে তাকিয়ে এ দৃশ্য উপভোগ করছে। আলিসা আ্যশারকে বুকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি তোমায়, বাবা।”
আ্যশার মুচকি হাসে।তারা এবার গাড়ির দিকে এগিয়ে আসে।গাড়িতে ওঠার পূর্বেই ক্যাসিনো আলিসাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“আ্যশার পিছনের সিটে বসুক।তুমি সামনে বসো।”
আলিসা বিনা বাক্যের সামনে থেকে বসে পড়ল এবং আ্যশার পেছনের সিটে বসে।ক্যাসিনো ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।গাড়ি চলতে শুরু করে।চলার পথে গাড়ির ভেতর হাসিখুশি পরিবেশ। আলিসার মনে হয় এই ছোট্ট জীবনের জন্য এইটুকুই সুখ যথেষ্ট। কিন্তু সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।হঠাৎই পেছন থেকে একটা গাড়ি বেপরোয়া গতিতে এগিয়ে আসে।কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রাকটি সজোরে এসে গাড়িকে আঘাত করে।আর মুহূর্তেই আলিসা আর ক্যাসিনো ছিটকে গাড়ি থেকে বাইরে পড়ে।আলিসার কানের অন্তিম বারের মত আ্যশারের আর্তনাদ ভেসে আসে,
“মাআআআআআআ….!
গোধূলি লগ্নে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্বর্তী পথপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে লালচে আভা। সূর্যটি ধীরে ধীরে পর্বতের কোল বেয়ে নামছে। এমন নিস্তরঙ্গ মুহূর্তে হঠাৎ স্টেশনের দিক থেকে ভেসে আসে ট্রেনের হুইসেল।ধোঁয়া বিস্তার করতে করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন থেকে শাটল ট্রেনটি ধীরগতিতে যাত্রা শুরু করে।ট্রেনের জানালায় অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের মুখাবয়ব গোধূলির আলোয় স্লান লাগছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রবেশদ্বার থেকে সামান্য দূরত্বে, বাঁ দিকে একটি পাকা রাস্তা গিয়ে মিশেছে একটা নিরিবিলি মোড়ে।মোড়টির এক কোণজুড়ে অবস্থিত দুখি মিয়ার চায়ের দোকান। চায়ের দোকানের সম্মুখে তিনটি বাঁশের নির্মিত বেঞ্চ, যার একটায় বসে আছে আনায়া, রুহি আর পিহু। তাদের ঠিক পেছনে একটি বৃহৎ কাঠগোলাপ গাছ, যার ছায়া তাদের মাথার উপর ছাউনি রূপে বিস্তৃত। গাছের নিচে হাওয়া বেয়ে ভেসে আসছে কাঠগোলাপের সৌরভ। এটা তাদের তিনজনের আড্ডার স্থল।তাদের বন্ধুত্বের সূচনা থেকেই তারা এই দুখী মিয়া চায়ের দোকানে বসেই অবসর সময় পার করত।আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।তিনজনের হাতেই ধোঁয়ামণ্ডিত চায়ের পেয়ালা।তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ দূরের কর্মব্যস্ত সড়কের দিকে। হঠাৎ পিহু সেই স্তব্ধতা বিদীর্ণ করে উচ্চারণ করে,
“আমি মনে করি তোর পুলিশকে ঘটনাটা জানানো উচিত, আনায়া।”
আনায়া দৃষ্টি ঘুরিয়ে পিহুর দিকে তাকায়।কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে সে বলল,
“কিন্তু কী বলব? আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। শুধু এটুকু জানি ওই ধর্ষকের নাম নেক।”
এ কথা শুনে রুহি আর পিহু মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে যায়।এতক্ষণ যাবৎ আনায়া সেই ধর্ষণের ঘটনা তাদেরকে খুলে বলেছে।এত ভয়াবহ ঘটনা শুনে রুহি আর পিহু দু’জনে ই ভয়ে হিম হয়ে আছে।তখনই রুহি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বলে ওঠে,
“আচ্ছা, একটা উপায় আছে আমার কাছে। আমরা বরং কাল ওই বিল্ডিং এ গিয়ে প্রমাণ কালেক্ট করি। কিছু না কিছু তো থাকবেই, সেগুলো নিয়েই পুলিশের কাছে যাই। কী বলিস?”
কিন্তু আনায়া নিরাশ হয়ে বলে ওঠে,
“কিন্তু কাল তো সারাহ আপুর গায়ে হলুদ। আমরা চাইলেও বের হতে পারব না। তার চেয়ে বরং আপুর বিয়ের পরেই ওইখানে আবার যাই।”
পিহু তখন কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলে,
“তা না হয় ঠিক আছে। কিন্তু আলু, তুই ওই ধর্ষকের চেহারা দেখিস নি?”
আনায়া মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে জবাব দেয়,
“নাহ, লোকটার মুখ ঢাকা ছিল। কিন্তু সে আমার নাম কীভাবে জানল?”
পিহু চমকে ওঠে।আসলেই তো ওই ধর্ষকটি আনায়ার নাম কিভাবে জানলো?এসব রহস্য তিনজনের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।ঠিক তখনই পিহু দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
“আচ্ছা ওসব বাদ দে। তুই ঠিক আছিস এটাই অনেক। তোর কাজিন ঠিক সময় না আসলে কী হতো ওটা ভাবলেই ভয় করছে আমার।”
ঠিক তখনই দুখি মিয়ার একমাত্র পুত্র বল্টু, বয়স বড়জোর চার-পাঁচ বছর হবে। একগাল দুষ্টু হেসে পিহুর সামনে এসে দাঁড়ায়।তার পেছনে হাতে ধরা ছোট্ট কাঠগোলাপ।এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আনায়া ঠোঁট চেপে হাসে।রুহি দুহাত মুখে চেপে ধরে হেসে উঠে বলে,
“ওহ মা গো! আবার শুরু হলো।”
বল্টু ফুলটা পিহুর দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“আই লাপ ইউ!”
পিহু এমন দৃশ্য দেখে হেসে গড়াগড়ি খায়।এই ঘটনা তাদের কাছে নতুন না।তারা যতবারই আড্ডা দিতে এসেছে, ততবারই এক ফুল হাতে নিয়ে বল্টু পিহুকে প্রপোজ করবে।পিহু তখন মুচকি হেসে বল্টুর কাছ থেকে কাঠগোলাপটা নিয়ে নাটকীয় কণ্ঠে বলে,
“লাপ ইউ টু!”
বলেই আচমকা এক হাতে বল্টুর প্যান্ট টেনে নামিয়ে দেয় পিহু।বল্টু হতভম্ব হয়ে দুই হাতে নিজের বিপদসংকেত ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে। বেচারা আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে ওখান থেকে দৌড়ে পালায়। মুহূর্তেই হাসির রোল পড়ে যায়। আনায়া একহাতে তার পেট চেপে ধরে, মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল,
“ছি পরটা!বেচারার ইজ্জতই খেয়ে দিলি তুই।”
পিহু হেসে গড়াগড়ি খেয়ে বলল,
“ভালোই তো বুঝবে প্রেম করতে গেলে কত দাম দিতে হয়।”
রুহি এবার গলা খাঁকড়ি দিয়ে সবার হাসি থামিয়ে দিয়ে বলল,
“সবাই চুপ!আমি এখন আমার সাংঘাতিক কণ্ঠে একটি ভয়ংকর গান পরিবেশন করতে চাই।”
এই কথা শোনা মাত্রই আনায়া আর পিহু দু’জনই করুণ চোখে একে অপরের দিকে তাকায়।রুহি সোজা হয়ে বসে গানের জন্য প্রস্তুতি নেয়।এরপর হাত উঁচিয়ে শিল্পীর ন্যায় সে তার সাংঘাতিক কণ্ঠে গাইতে শুরু করে,
“সন্ধ্যাবেলায় বেগুন খেতে করতে গেলাম চুরি…
বেগুন ওয়ালায় ওমনি আমার হাতটা নিল ধরি..
ধইরা নিয়ে ভ…..
আর বলতে পারে নাহ রুহি।তার পূর্বেই আনায়া আর পিহু একসঙ্গে চিৎকার দিয়ে ওঠে,
” নাআআআআআআআআআআ!”
রুহি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে দুই বান্ধবীর দিকে।আনায়া থেমে একটু হাসিমুখে বলে উঠল,
“থাম মেরি মা।তোর গান শুনে আমরা অকালে মরতে চায় নাহ।”
তিনজনেই হেসে লুটোপুটি খেতে খেতে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। পাশের টেবিলের লোকজনও হাসতে বাধ্য হয়। আড্ডা শেষ করে তারা চায়ের বিল মিটিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।এমন সময় হঠাৎ আনায়ার ফোন বেজে ওঠে।আনায়া ফোন বের করে দেখে ইউভান কল দিয়েছে।মুহূর্তেই সে ফোনটা কেটে দিলো।ধরবে না সে এই বদমাশ লোকের কল।সে আবারও হাঁটতে থাকে। ঠিক তখনই হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ আসে। আনায়া ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ইউভান তাকে এসএমএস দিয়েছে,
“সুইটি কল ধরছিস না কেন?”
আনায়ার ভ্রু কুঁচকে যায়।সে মেসেজটা সিন করেই রেখে দেয়। তারপরই আবারও ইউভান মেসেজ দেয়,
“জানননন!”
এটা পড়ে আনায়ার চোখ একবার বড় হয়ে যায়।সে চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে।তারপর না চাইতে ও সে কম্পিত হাতে টাইপ করে,
“আমি বাইরে আছি।”
এটা দেখা মাত্রই ইউভান পুণরায় কল দেয়।আনায়া এবার হাঁটা বন্ধ করে রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে কলটা রিসিভ করল। তৎক্ষণ অপর পাশ থেকে ইউভান উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ভেসে আসে,
“ম্যাডাম কোথায় বের হয়েছেন শুনি আমাকে না জানিয়ে?”
আনায়া শুকনো কয়েকবার গলা খাঁকারি দিল।তারপর ঠোঁট ভিজিয়ে নিচু কন্ঠে বলল,
“ও ওই, আমি ভার্সিটির সামনের রাস্তায় হাঁটছি।”
ওপাশে ইউভান গভীর তপ্ত শ্বাস ফেলে। রাগ সামলে সে ঠান্ডা স্বরে বলে উঠল,
“এই সন্ধ্যায় এমনভাবে রাস্তায় হাঁটছেন?সাবধানে থাকিয়েন তবে,আমার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কিন্তু আপনার কাছে আমানত রেখে এসেছি আমি।খেয়াল রাখবেন।”
আনায়া একটু থেমে ভ্রু কুঁচকে যায়। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করল,
“কি আমানত রেখেছেন আমার কাছে শুনি?”
ইউভানের গলার স্বর আরো নিচু করে বলল,
“আমার প্রাণটা।”
এই একটা কথাটা মুহূর্তেই আঘাত করে আনায়ার বুকের মাঝখানে।হৃদপিন্ড তাল গুলিয়ে ফেলে এক মুহূর্তের জন্য।ইউভান আবারও বলল এবার কণ্ঠটা আরও ভারী,
“দেহটা এখানে হলেও,প্রাণটা কিন্তু আপনার কাছে।
তাই সাবধানে রাখবেন সেটা।আপনার হাতে আমার সবচেয়ে দুর্বল জিনিস রেখেছি আমি।”
আনায়া ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল।সে ইউভানকে উদ্দেশ্য করে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
“আপনার এই আমানতের খেয়ানত আমি করব না।
বিশ্বাস করতে পারেন আমাকে।”
ইউভান তখন ধরা গলায় উত্তরে বলল,
“জ্বী ম্যাডাম আপনাকে বিশ্বাস করাই তো আমার দায়িত্ব, আর সেই বিশ্বাসকে বজায় রাখা কিন্তু আপনার কর্তব্য।”
আনায়া হালকা হেসে দৃঢ় কন্ঠে পুনরায় বলে উঠলো,
“আমি কর্তব্য পালন করায় কোন ঘাটতি রাখব না বিশ্বাস করুন ইউভান ভাই।”
ইউভান একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শীতল কন্ঠে শুধালো,
“এই পৃথিবীর প্রায় ৮২৩ কোটি ৩০ লাখ ২৮ হাজার ৩৫৮ জন মানুষের ভীরে, আমি তো কেবল আপনাকেই বিশ্বাস করি ম্যাডাম।”
ইউভান এই কথার মাঝেই সেখানে আভীর হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে।আভীরকে দেখে ইউভান কলটা কেটে দিয়ে উঠে দাড়িয়ে বলল,
“ওয়াট হ্যপেন?”
আভীরের বাদামী চোখের মণিগুলোতে রক্তাভ ছাপ। গালের হাড়দুটো উঁচু হয়ে আছে রাগে।সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠে,
“অনেক বড় প্রবলেম হয়ে গিয়েছে ইউভান। যে গাড়িতে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ছিল,সেই গাড়িটা সহ উধাও।”
এ কথা শোনা মাত্রই ইউভানের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। চোয়াল শক্ত করে, স্নায়ু টানটান করে রক্তে বাজ পড়ার মতো গর্জে ওঠে,
“ওয়াট দ্যা ফাক।”
আভীর ইউভানের দিকে তাকিয়ে,কন্ঠের স্বর আরও চওড়া করে বলল,
“আর এটা কে করেছে, সেটা হয়তো তুই বুঝে গিয়েছিস…”
মুহূর্তেই ইউভানের রাগ কয়েকগুন বৃদ্ধি পায়।সে ক্রোধে বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
“ক্যাসিনো ব্লাডি বিচ!”
আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে সে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।যাওয়ার সময় তাড়াহুড়োয় ফোনটা টেবিলেই ফেলে যায়।অন্যদিকে, ইউভানের হঠাৎ কল কেটে দেওয়াতে হতবাক আনায়া।সে আবার কল দিতে যাবে—ঠিক সেই সময়েই রুহি আর পিহু সেখানে এসে উপস্থিত হয়।রুহি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে আনায়ার হাত ধরে টান দেয়,
“আলু, চায়ের দোকানে চল। মনে হয় আমার ফোনটা ভুল করে ওখানে ফেলে এসেছি।”
বলে সে আর দেরি না করে আনায়াকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই টেনে হাঁটতে শুরু করে।তাড়াহুড়োয় আনায়ার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায় নিচে।পিছনে থাকা পিহু বিরক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“উফ। এরাও না, এতটাই বেখেয়ালি।”
সে নিচু হয়ে ফোনটা তুলে নেয়। হাতের আঙুলে ফোনটা ছুঁতেই স্ক্রিনে টাচ লেগে আনায়া ইউভানের নম্বরে কল দিতে চাচ্ছিল, সেটাতেই অটোমেটিক কল চলে যায়,যা পিহু বুঝতেই পারে না।অপরপাশে আভীর ইউভানের রুম থেকে বের হবে তখন পেছন মোবাইলের আওয়াজ শুনে থেমে যায়। সে এক পা এগিয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে রিসিভ করে বলল,
“হ্যালো?”
হঠাৎই ফোন থেকে একটি পুরুষলী কণ্ঠ ভেসে আসায়,পিহু চমকে ওঠে।সে অবচেতনভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে ওপাশ থেকেই কেউ কথা বলছে।একটু দ্বিধা নিয়েই পিহু ফোনটা কানে দিয়ে বলল,
“হ্যালো?”
এক মুহূর্ত স্তব্ধতা।সব শব্দ যেন থেমে যায়। বাতাস, ঘড়ির টিকটিক, পৃথিবীর গতি সব স্তব্ধ হয়ে যায়।আভীর চোখের অস্থিরতা থেমে শীতলতা নেমে আসে।কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে পিহু পুনরায় কম্পিত কন্ঠে বলে ওঠে,
“হ্যালো কে বলছেন?”
আভীর ঘনঘন কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে।তারপর কণ্ঠনালী কাঁপিয়ে পুনরায় উচ্চারণ করে,
“পরী…”
শব্দটা বিদ্যুতের মতো বিদ্ধ করে পিহুকে।তার হাত থেকে ফোনটা প্রায় পড়ে যেতে বসে।তার হৃদস্পন্দন এর গতি ক্রমশ কমে যেতে থাকে।পিহু নিজেও বুঝতে পারছে না তার কেন এত অস্থির লাগছে?সে দ্রুত ফোনটা কেটে দেয়।অপাশে,আভীর এক দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।কিন্তু এখন তার কাছে ভাবার সময় নেই কিছু। তাই সে ফোনটা পকেটে গুজে নিচে নেমে আসে।বাইরে এসে আভীর দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুইটি কাল বাইক।ইউভান ঠিক বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে,তার পরনে কালো লেদার জ্যাকেট আর ধূসর রঙের চাপা কাটের জিন্স যার, হাঁটুর পাশটা হালকা কাটা।পায়ের নিচে গাঢ় কালো হেভি বুট।আভীরের পরনে গাঢ় নীল মোটা ডেনিম জ্যাকেট আর নীল রঙের স্টোন-ওয়াশড জিন্স।দু’জন বাইকে উঠে হেলমেট পরে নেয়। বাইক ছুটে চলে সরু রাস্তা দিয়ে গন্তব্য ক্যাসিনোর আস্তানা।
একই সময়, অন্যপ্রান্তে অন্ধকার একটি কক্ষের ভেতরকার টেবিলের এক পাশে চমক দিচ্ছে ব্ল্যাক ডায়মন্ড,আর অপর পাশে রাখা রয়েছে বিশেষ নীল ফর্মুলাটি, যার গা দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।ক্যাসিনো দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের সামনে।সে দুইটি বস্তুর দিকে তাকিয়ে, কন্ঠে অহংকার মিশিয়ে বলে উঠলো,
“অবশেষে দুইটা জিনিসই আমার হাতে চলে আসলো।”
ঠিক তখনই তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন গার্ড সামান্য দ্বিধা নিয়ে নিচু গলায় বলে,
“কিন্তু স্যার, আপনার তো শুধু ফর্মুলাটার দরকার ছিল।তাহলে আপনি কেন ব্ল্যাক ডায়মন্ডটা আনতে গেলেন?”
ক্যাসিনো হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।তার হাসির ধাক্কায় য দেয়ালের ধুলো ঝরে পড়ে।সে একপা এগিয়ে টেবিলে হাত ঠেকিয়ে বলে,
“আমার উদ্দেশ্য তো ফর্মুলা না অথবা ডায়মন্ড না।
আমার উদ্দেশ্য হলো,ড্রেভেন, ইউভান আর আভীর—তারা একসাথে আমার আস্তানায় আসুক।”
গার্ডটি কিছু বুঝতে পারে না। আরে গার্ডটি আর কেউ না বরং ড্রেভেনের বিশ্বস্ত গার্ড।যে ক্যাসিনোর হয়ে কাজ করছিল এতদিন।সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করে বলে,
“মানে?”
ক্যাসিনোর চোখ লাল হয়ে ওঠে। সে পেছন ফিরে গার্ডটির দিকে তাকিয়ে রুক্ষ কন্ঠে বলে,
“আমি যাচাই করতে চাই যে ড্রেভেন আর ইউভান তারা সত্যিই কি আলাদা মানুষ? এই খেলাটা আমি সাজিয়েছি সেই উদ্দেশ্যে।এখন তো সব ঠিকঠাকভাবে চলছে।তিন দিক থেকে তিনটা সত্তা এগিয়ে আসছে আমার দিকে।”
বলেই সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।অন্যদিকে,ড্রেভেন আইস প্যালেসে ফর্মুলার খবর না পেয়ে নিজেই রওনা দেয় ক্যাসিনোর আস্তানায়। আর ইউভান ও আভীর, ব্ল্যাক ডায়মন্ড চুরির সূত্র ধরে রওনা দেয় একই দিকেই।তিনটি পথ,তিনটি সত্তা,তিনটি অতীত, একই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে আসছে।কিন্তু তারা একসাথে মুখোমুখি হলে আদৌ কি কোন সত্য উন্মোচন হবে?আর ক্যাসিনো? সে-ও এই যুদ্ধের এক নির্মম খেলোয়াড়!তাদের চারজনের এই সাক্ষাৎ হয়তো কোন এক গোপন রহস্যর উন্মোচন করবে।
বাংলাদেশ,
সন্ধ্যা গড়িয়ে প্রায় রাত নেমেছে।পিহুও বহু পূর্বে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে চলে গিয়েছে।সে ফোনের বিষয়ে আর আনায়াকে কিছু বলেনি।আনায়া আর রুহি প্রায় আধঘণ্টা পর এসে পৌঁছায় চৌধুরী ম্যানশনে।ম্যানসিনের চারপাশের সাজসজ্জায় সজ্জিত।আঙিনা, বারান্দা, ছাদ সর্বত্র রঙিন ফেয়ারি লাইটের ঝিকিমিকি করছে।কারণ কাল সারাহর গায়ে হলুদ, আর পরশুদিন বিয়ে।তারা দুজন ভেতরে প্রবেশ করতেই কোথা থেকে যেন তানহা দৌড়ে এসে আনায়ার হাতটা টেনে ধরে,ড্রয়িং রুমে মেহমানদের সামনে বসিয়ে দেয়।তানহার এহেন কাজে আনায়া কিছুটা বিরক্ত হয়।তখনই তা দৃষ্টি আটকায় সামনে বসে থাকা দুজন বয়স্ক মহিলা এবং একজন যুবকের দিকে।সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। আনায়ার জানি কেমন অস্বস্তি হতে শুরু করে।হঠাৎই সায়মা বেগম ট্রে হাতে এসে চা রাখলেন টেবিলের ওপর।হালকা হাসিমুখে অতিথিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এই তো আমার ছোট মেয়ে এসে গিয়েছে। ওই হলো আনায়া!”
আনায়ার মাথায় যেন কেউ পেরেক ঠুকে দেয়।তার কাছে কোনো কিছু ভালো ঠেকছে নাহ।ঠিক তখনই সামনে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মহিলাটি বলে ওঠে,
“আমার ছেলের বউ হিসেবে আপনাদের মেয়ে আমার ভারী পছন্দ হয়েছে।আংটি পরিয়ে রেখে দিয়ে যাই আজ, কী বলেন?”
এ কথা শোনা মাত্রই আনায়ার চোখ এক লহমায় বড় হয়ে আসে।রুহিও অবাক হয়ে আনায়ার দিকে তাকায়। কিন্তু তানহা ঠিকি পৈচাশিক আনন্দ পেয়ে হাসে,কারণ সেই তো ঠিকই তো ভাবে আনায়ার সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে।আর এসব কিছু তানহা করেছে ইউভানের থেকে আনায়াকে দূরে সরানোর জন্য। আনায়া এবার অসহায় চোখে তার মায়ের দিকে এক পলক তাকায়। তার চোখে ধীরে ধীরে জল জমে ওঠে ।গলা শুকিয়ে গিয়ে শ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার।সায়মা কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই তানহা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
আত্মার অন্তরালে পর্ব ২০
“কেন না! আজই আংটি পরিয়ে দিন।”
এই কথায় আনার হৃদয়টা কেঁপে ওঠে।তার দৃষ্টিতে এখন আর কিছুই স্পষ্ট না।সব ঝাপসা হয়ে আসছে, ইউভানের অস্তিত্ব হয়তো তার জীবন থেকে ঝাপসা হচ্ছে ধীরে ধীরে।তখন সায়মা বেগম কন্ঠে একটু দ্বিধা নিয়ে বলে,
“আচ্ছা তাই হোক!”