মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩৩

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩৩
মুসতারিন মুসাররাত

প্রত্যাশার বিড়বিড় করা দেখে নীরব ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” কিছু বলছিলে?”
প্রত্যাশা অপ্রতিভ্য ভঙিতে মাথা নেড়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
-” ক-কই? না তো। কী বলব?”
প্রত্যাশা ক’পা এগিয়ে ডান হাতটা নীরবের সামনে সটান বাড়িয়ে একটা আইসক্রিম এগিয়ে বলল,
-” নিন।”
নীরব মাথা নেড়ে ‘না’ সূচক বোঝায়। মুখে বলল,

-” তুমি খাও। দুটোই তোমার জন্য।”
প্রত্যাশা সামনের টুলে বসল। আইসক্রিমে ঠোঁট ছোঁয়াতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। আকস্মিক ভারী স্বরে বলে উঠল,
-” আপনি যতোই সবাইকে বলেন অফিশিয়াল কাজে কুয়াকাটায় গিয়েছিলেন। আমি জানি এটা মিথ্যে। আপনার ওখানে যাওয়ার কারন আমি। আমার বারবার মনে হচ্ছে আপনার এই অ্যাক্সিডেন্টের জন্য পরোক্ষভাবে আমিই দায়ী। যদি না আমি ট্যুরে যেতাম, না ওরকম কিছু ঘটতো, আর না তো আপনাকে ওখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হতো। আজ আপনাকে এভাবে সাফার করতেও হতো না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” দূর্ঘটনা তো কখনো বলে কয়ে আসে না। আমি কুয়াকাটায় গেছি বলেই এমনটা হয়েছে; এই ভাবনাটা ঠিক নয়। আমি এখানে থাকলেও, অন্য কোনোভাবে, অন্য কোনোদিন এমন কিছু ঘটতেও তো পারত। এর থেকে বেশি কিছুও হয়তো হতে পারতো। সো, এটা নিয়ে নিজেকে দায়ী ভাবা বো’কা’মি‌।”
আইসক্রিম গলে হাত গড়িয়ে পড়তে নিচ্ছিল। নীরব সেদিকে তাকিয়ে বলল,
-” আইসক্রিম গলে যাচ্ছে।”

প্রত্যাশার মনে হলো, নীরব হয়তো কথা বলতে আগ্রহী নয়। তাই তো আইসক্রিমের কথা বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রত্যাশার রাগ হলো, আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করল না। ওর যে খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে— নীরব কী এখনো ও ছবিগুলোকে বিশ্বাস করে আছে? আমাকেই অবিশ্বাস করে? ওই ব্যাপারে কিছুই তো এরমধ্যে আর বলেনি। দুনিয়ার সব অভিযোগ রাগ-ক্ষোভ একদিনে ঝেড়ে তারপর থেকে যেনো হজ্বে বসেছে। মৌনতা পালন করছে। এতটা নির্লিপ্ত আছে যে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

সেদিন রাতের কথা ফের মনে উঠতেই প্রত্যাশার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। শুণ্যে তাকিয়ে মনেমনে আওড়ায়—- আবার সেদিনের উনার করা অপমান ভুলি কী করে! কম তো আর বলেনি। বিশেষ করে দু’টো কথা ম*রে গেলেও ভুলব না। নেহায়েৎ অসুস্থ মানুষ তাই আগ বাড়িয়েই কথা বলতে হচ্ছে। আবার উনি তো সবার সামনে সাধু পুরুষ। যাইহোক না কেনো অন্যকে জানাবে না, বুঝতে দেবে না কিছু। সেদিন রাতে কত কী ঘটল! অথচ বাড়ির একটি মানুষকেও বুঝতে দিলো না। কী সুন্দর করে সকালেই কজ দেখিয়ে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল!
মনটা ভার হয়ে এলো প্রত্যাশার। আনমনেই তাচ্ছিল্য হেসে ভাবল— উনি নিজেই তো বলেছিলো, এরপর থেকে তোমার-আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা হয়তো হবে না।

কথাটা মনে উঠতেই চোখ জিভে উঠল প্রত্যাশার। নিজেকে মনে হলো ছ্যাঁচড়া। নীরব চাইছে না, সে শুধু শুধুই বেহায়ার মতো এখানে আছে। আইসক্রিমের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির দিনের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। এসব কিছু তো আর ভালোবাসা থেকে উনি করছেন না। উনি নিজেই বলেছেন, যতদিন সম্পর্কটা থাকবে, ততদিন দায়িত্ব থাকবে।
এসব কিছু ভাবনা-চিন্তা প্রত্যাশার মন-মস্তিষ্কে বিরুপ প্রভাব ফেলল। ঝট করে ফোনটা বের করে আব্বুর নম্বরে ডায়াল করল‌। রিসিভ হতেই বলল,

-” আব্বু তুমি কোথায়?”
-” কেনো রে মা? কোনো সমস্যা?”
-” নাহ, কোনো সমস্যা নেই। আব্বু তুমি একটু হাসপাতালে আসতে পারবে? আমাকে নিতে? সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে তো তাই বলছি। নইলে আমি একাই যেতে পারতাম।”
-” আমি বাজারে আছি। কিন্তু প্রত্যাশা যাওয়ার সময় বললে রাতে থাকবে তুমি।”
প্রত্যাশা নীরবের দিকে তাকিয়ে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল। ফিসফিসিয়ে বলল,
-” আসলে সামনে পরীক্ষা এখানে থাকলে পড়াশোনা হবে না। তাই উনি নিজেই যেতে বলেছে।”
মিথ্যে বলতে প্রত্যাশার গলা মৃদু কাঁপল। শফিক সাহেব বললেন,

-” আচ্ছা, আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে।”
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই শফিক সাহেব আসেন। জামাইয়ের সাথে টুকটাক কথা বলে বেড়িয়ে যান। প্রত্যাশা বাবার পিছুপিছু যেতে গিয়ে কেবিনের দরজাটা একহাতে টেনে আবার ফিরে তাকাল। বেডে হেলান দিয়ে আধশোয়া নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল মিহি স্বরে,
-” আসছি।”
প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই ঘুরে পা চালাল প্রত্যাশা। পরমূহুর্তেই পিছুন থেকে আসা একটা শব্দেই পা দু’টো থেমে গেল।

-” শোনো?”
নীরব দরজা বরাবর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই ফের আদেশ স্বরুপ বলল,
-” এদিকে তাকাও। কথা আছে।”
প্রত্যাশা কলের পুতুলের মতন ঘুরে দাঁড়াল। বলল,
-” জ্বী বলুন।”

-” মাথা থেকে পুরনো সব ঝামেলা ডিলিট করে দাও। নাউ ইটস্ টাইম টু ফোকাস, জাস্ট ফোকাস অন ইয়োর স্টাডি। সামনে তোমার এক্সাম, ওটাই প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। আমার বউ হয়ে শুধু ফেল ঠেকানোই যেন তোমার আল্টিমেট গোল না হয়। দ্যাট উড বি কাইন্ডা এমব্যারাসিং ফর মি।”
সারাবছর না পড়ে লম্ফঝম্প করে বেড়ানো প্রত্যাশা শেষের কথাশুনে মনেমনেই মুখ বাঁকাল। নীরব মৃদু হাসল, সে হাসি অবশ্য প্রত্যাশার দৃষ্টিগোচর হলো না। নীরব আরো বলল,

-” রেজাল্টের দিন যেনো আমাকে লজ্জায় পড়তে না হয়। বি কেয়ারফুল, ওকে?”
প্রত্যাশা তৎক্ষণাৎ বিড়বিড় করল,
-” আহা! এখন উনাকে লজ্জা থেকে বাঁচাতে হলে তো আলাদিনের চেরাগ ঘষে জ্বিন ডাকতে হবে! বলব– হে জ্বিন বাবু, আমার হাজবেন্ডের মান-ইজ্জতের প্রশ্ন। প্লাস পাইয়ে দিও, নইলে উনি আত্মসম্মানহানিতে ভেঙে পড়বেন। যত্তসব!”
তবে ভদ্রতা দেখিয়ে মুখে বলল প্রত্যাশা,

-” ঠিক আছে।”
বলেই আর টু শব্দটি না করে প্রত্যাশা প্রস্থান করে।
পাওয়ার থাকলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়, সুযোগও বেশি মেলে। কিন্তু নীরব কখনোই নিজের পেশাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করেনি, করবেও না। এই বিশ্বাস ওর নিজের ওপর আছে। তবে কোনো সমস্যা সমাধানে, ন্যায়- অন্যায় জাস্টিফাইয়ের জন্য পেশার থেকে পাওয়া ক্ষমতা ব্যবহার করাই যায়। ছবি থেকে হোটেলের নাম দেখে ছিলো, সরাসরি গন্তব্য ***হোটেলে। নিজের অফিসিয়াল আইডি কার্ড দেখিয়ে রিসিপশনে যোগাযোগ করে ম্যানেজারের সঙ্গে। প্রথমে ওরা রাজি হচ্ছিল না সিসিটিভি ফুটেজ দিতে, কিন্তু নীরব যখন বলে; প্রয়োজনে উপরের কর্তৃপক্ষের পারমিশন আনবে, তখনই ম্যানেজার নমনীয় হয়।

নীরব সোজা চলে যায় সেই তারিখে, দুপুরের পর থেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে। এক পর্যায়ে দেখা যায়, প্রীতি নিজের রুমে ঢোকে, একটু পরেই ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর কাটতে কাটতে দেখা যায়; দু’জন মেয়ে প্রত্যাশার হাত ধরে রেখেছে। দেখে বোঝা যাচ্ছিল, প্রত্যাশা স্বাভাবিক নেই। নীরব মনোযোগ দিয়ে ফুটেজ দেখতে থাকে। প্রত্যাশা প্রীতির গাল টিপে দেয়, খিলখিলিয়ে হাসে, হাত ছড়িয়ে নাচতে নেয়। এসব দেখে নীরবের পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রত্যাশা ড্রাঙ্ক অবস্থায় ছিলো নিশ্চয়। তাছাড়া ও যতই ইমম্যাচিউর হোক, এরকম বিহেভ করবে না। আই থিংক ওকে নে”শা যুক্ত কিছু খাওয়ানো হয়েছিল।

এরমধ্যে সার্থকের উপস্থিতি। প্রীতির ব্যাগ হাতড়ে কিছু খোঁজা, কিছুপল পর সার্থকের রুমে প্রত্যাশার ঢোকা। নীরব প্রথমেই জেনে নিয়েছিল, সার্থক, প্রীতিরা কত নম্বর রুমে ছিলো। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না। সার্থকের সাথে প্রত্যাশার রুমে থাকার সময় দশ মিনিটের মতো হবে হয়তো। কারন দশ মিনিট খানেক পরেই সার্থক কে একলা বের হতে দেখা যায়। তারপর করিডোরে অদ্রিকার সাথে সার্থকের কথা। কিছুক্ষণ পর ট্রে করে শরবত জাতীয় কিছু নেওয়া।
নীরব অনেক সময় ধরে সবটা পর্যবেক্ষণ করে। সব মিলিয়ে সমীকরণ একটাই দাঁড়ায় প্রত্যাশা হুঁশে ছিলো না। আর শিওর ছবিগুলো ওই দশ মিনিটের ভেতর তোলা। এখন প্রশ্ন, প্রত্যাশাকে কীভাবে ড্রাঙ্ক করা হয়েছিল? ছবিগুলো কে তুলেছে?

আরেকটা বিষয় যেটা প্লাস পয়েন্ট হিসেবে নজরে আসে। প্রীতির সাথে হোটেলের একজন স্টাফ বয়ের কথা। প্রীতি ব্যাগ থেকে টাকা দিচ্ছে। যেটা প্রীতির দিকে সন্দেহের তীর নিয়ে যাচ্ছে। তবে সমস্ত কিছুর পিছুনে নীরব ওদের দুই ভাই-বোনের হাত আছে বলে মনে করে। হোটেল কর্তৃপক্ষের থেকে সেই স্টাফের নাম ঠিকানা আর কন্টাক্ট নম্বর যোগাড় করে নীরব। শোনা যায়, ছেলেটি হোটেলের চাকরি সম্প্রতি ছেড়ে দিয়েছে। মালয়েশিয়া যাবে বলে। সেইদিনই উক্ত নম্বরে কল করে নীরব। কিন্তু কপাল খারাপ থাকায় ফোন বন্ধ বলে।

প্রীতির পেট থেকে যেভাবেই হোক কথা বের করা। আর নয়তো সেই বয়টির সাথে কন্টাক্ট করা। তারপর সব সত্যি সামনে নিয়ে প্রত্যাশার কাছে স্যরি বলবে। আর প্রীতি আর ওর ভাইয়ের একটা বিহিত তো করতেই হবে। নীরবের অনুশোচনা হচ্ছে, সে রাতে মেজাজ খারাপ না করে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবা উচিত ছিলো। প্রত্যাশাকে অতকিছু বলা কোনো মতেই উচিত হয়নি। যদিও ওর ভুল কম নয়। ওর বো’কামির জন্যই এতকিছু। তবুও রাগের মাথায় মুখ ফস্কে বলে ফেলা কয়েকটা কথার জন্য নীরব নিজেই অনুতপ্ত।

প্রত্যাশাকে নিয়ে রাত আটটার দিকে শফিক সাহেব বাসায় ফিরলেন। অধরা তো মেয়ের উপর ক্ষিপ্ত হলেন। সাথে স্বামীকেও কথা শুনাতে বাদ রাখলেন না।
-” প্রত্যাশার যেনো বোধবুদ্ধি নেই, ও বলল আর তুমি ওকে নিয়ে চলে এলে। তুমি ওকে বোঝাতে পারলে না ওখানে ওর থাকাটা জরুরী। ওর শ্বশুর বাড়ির লোক বলবে না, কেমন বউ। বর হাসপাতালে ও বাড়িতে আরাম করে থাকে। কোনো দায়দায়িত্ব নেই।”
শফিক সাহেব মিনমিনে গলায় বললেন,

-” আরে তুমি আমাকে কথা শুনাচ্ছ কেনো? আ’জ’ব! প্রত্যাশা নিজে বলল নীরবই যেতে বলেছে। ওর সামনে এক্সাম। সেখানে আমার কী করার আছে বলো?”
প্রত্যাশা দুই হাত এক করে মাথাটা নুইয়ে দাঁড়িয়ে। অধরা রাগ ঝাড়তে লাগলেন,
-” প্রত্যাশা তোর কোনোকালে আক্কেল, কান্ডজ্ঞান হবে না? জামাই বলল আর তুই সাথে সাথে এক লাফে চলে এলি। কেনো, তোর কোনো দায়িত্ব নেই?”

-” কী আশ্চর্য! আম্মু তুমি শুধু শুধু আমাকে কেনো বকছো?”
-” তুই বিকেলে গিয়ে সন্ধ্যায়ই কোন সাহসে চলে এলি? বল তোর সমস্যাটা কী?”
-” আমার ওখানে থেকে কাজটাই বা কী? কোনো কাজ নেই শুধু শুধু বসে থাকা। তাই…”
প্রত্যাশার কথা শেষ করতে না দিয়ে অধরা ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,

-” ইচ্ছে করে চওড়িয়ে দাঁত ফেলে দিতে। ওখানে ওর কাজ কী? ওকে বলে দিতে হবে যেনো সব। তুই একেবারেও ছোট না প্রত্যাশা। ডাক্তার নীরবকে আপাতত ক’দিন মুভমেন্ট করতে নিষেধ করেছে। এখন যদি ছেলের বউ থাকতেও তোর শাশুড়ি ছেলের দেখভাল করে, ব্যাপারটা ভালো দেখায়? তুইই বল ভালো দেখায়? প্রতিবেশীরা এসে প্রশ্ন তুলবে ছেলের বউ আসেনি। বউমা থাকতেও মা’কেই সেবা করতে হচ্ছে।”
প্রত্যাশা মনে মনে ভাবল— ধূর! আম্মুকে কীভাবে বোঝাই! উনি যেহেতু ওনার আশেপাশে আমাকে চাইছেন না। ঠিক করে কথাও বলেনি। আর সে রাতের কথাই বা ভুলি কী করে!
অধরা গলার স্বর এবারে একটু নরম করে বললেন,

-” কালকে সকালে নীরবকে রিলিজ করবে। আমারো তো একবার দেখতে যাওয়া লাগে। সেদিনের পর আর যাওয়া হয়নি। কাল আমি ও বাড়ি দেখতে যাচ্ছি। তুইও আমার সাথে যাবি। আমি কিন্তু তোকে রেখে আসবো, তাই সেইভাবে ব্যাগ গুছিয়ে নিস।”
-” রেখে আসবে মানে? সামনের বৃহস্পতিবার থেকে আমার এক্সাম। আর মাত্র ছ’দিন পরেই।”
-” পরীক্ষা বই সাথে নিবি। তোর শাশুড়ির সাথে আমার ফোনে একটু আগেই কথা হয়েছে। তোর গিয়েই চলে আসায় উনার কথায় বুঝলাম অসন্তুষ্ট সে। যদিও মুখে সরাসরি বলেনি। উনি নিজেই বলেছেন, প্রত্যাশা তো বই-টই নিয়েও আসতে পারতো। একদিক দিয়ে ওর-ও সুবিধাই হতো; পড়ায় কোনো সমস্যা হলে, নীরবের থেকেই বুঝে নিতে পারতো।”
মা আর শাশুড়ির সিদ্ধান্তের মাঝে পরে প্রত্যাশা আর দ্বিরুক্তি শব্দ উচ্চারণ করার সাহস পেলো না। নিঃশব্দে মেনে নিল।

পরেরদিন…..
অধরার সাথে বিকেলে শ্বশুর বাড়ি এসেছে প্রত্যাশা। অধরা অবশ্য সন্ধ্যার পরেই চলে গিয়েছে। সবাই অনেক থাকতে বলেছিল। বাড়ি ফাঁকা এটাওটা অজুহাত দিয়ে থাকলেন না। যাওয়ার আগে প্রত্যাশাকে হাজারটা আদেশ-নিষেধসহ অনেককিছুই বলে যান। এ-ও বলেন— এমনভাবে চলতে, যেনো কোনো কথার সৃষ্টি না হয়।
রাতে ডিনার শেষে রুমে যাচ্ছিল প্রত্যাশা। নীহারিকা বললেন,
-” ওয়াটার বোতলের পানি ফেলে ঠাণ্ডা পানি নিয়ে যাও। আর হ্যাঁ, নীরবের কী কী ওষুধ আছে এখন সেগুলো মিলিয়ে দেখে দিও।”

-” আচ্ছা, ঠিক আছে।”
নীরব হাঁটাচলাচল করছে না এমন নয়। প্রয়োজনীয় সব নিজেই করছে, কিছুটা খুঁড়িয়ে। তবে ডাক্তার যেহেতু পায়ে প্রেশার দিতে নিষেধ করেছে তাই বেশি সময় তার বিছানাতেই কাটছে। রাতের খাবার রুমেই দেয়া হয়েছিল।
রুমে ঢুকতেই বিছানায় নজর গেল প্রত্যাশার। কালো টিশার্ট, ধূসর ট্রাউজার পরনে। কপালে সাদা ব্যান্ডেজ। যেটা আজকে আসার আগে ড্রেসিং করে নতুন করে করা হয়েছে। বেডের হেডে হেলান দিয়ে ফোন স্ক্রল করছে নীরব। প্রত্যাশা কোনো কিছু না বলে বোতলের পানি চেঞ্জ করে আনে। পরপর প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষুধ বের করে বেডটেবিলে নামাতে নামাতে বলল,

-” আপনার মেডিসিন। এগুলো রাতে আছে।”
নীরব একটা অফিশিয়াল মেইল দেখছিলো। ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখেই বলে,
-” রাখো।”
প্রত্যাশার মনে হলো নীরব তাকে ইগনোর করছে। জোড়ালো শ্বাস ফেলে দরজাটা লক করে বিছানার ওপাশে বসল। কয়েক মূহুর্ত পরপরই কিছু ভেবে অভিমানী কণ্ঠে বলল,
-” শুনুন, আপনি কথা বলা অফ করে দিয়েছিলেন, যোগাযোগ রাখা বন্ধ করেছিলেন। সম্পর্কটা রাখতে চান না, সেটাও জানি। সব ঠিক আছে।”
একটু থামল। দুই হাতের তালু ঘষে ফের বলল,
-” আমাকে এখানে আসতে দেখে, আপনি আবার ভাববেন না আমি অবলা নারীর মতো আপনার হাতে পায়ে ধরে, হাউমাউ করে কেঁদেকেটে বারবার রিকোয়েস্ট করব সম্পর্কটা রাখতে। আর সেটা করতেই এখানে এসেছি। এরকম ভাবলে ভুল।”

নীরব ফোনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। প্রত্যাশার ঠোঁট দুটো এক নাগাড়ে চলতে লাগল,
-” তাহলে আপনি এখন প্রশ্ন করতেই পারেন আমি এখানে কী করতে এসেছি? আপনার সাথে একটা সম্পর্ক না থাকলেও আরেকটা সম্পর্ক কিন্তু থেকে যাবে। নিভান ভাইয়া বউকে খুব ভালোবাসে। আপনার আমার সম্পর্ক থাকা না থাকায় ওদের সম্পর্কের এতটুকু ভাটা পড়বে না। আর ওদের সম্পর্ক থাকা মানেই আপনার আমার বেয়াই-বেয়াইনের সম্পর্কটা থেকে যায়। কখনো সামনাসামনি পড়া, জাস্ট হাই-হ্যালো এতটুকুই। যাকে আত্মীয়তার হক বলে আরকি। ধরুন, আমি সেই আত্মীয়তার জের ধরেই অসুস্থ আপনাকে দেখতে এসেছি। নেহায়েৎ আম্মু বারবার বলেছে তাই বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩২

নীরব শীতল চাহনিতে চেয়ে আছে তুরন্ত ছুটে চলা ঠোঁটজোড়ার দিকে। মৃদু হেসে ফোনটা বিছানায় নামাল। ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে ফাজলামির সুরে বলল,
-” হ্যাঁ, আপনি তা দেখতে আসতে পারেনই। একটা প্রশ্ন, আজকালকার বেয়াইন বেয়াইয়ের বেডে একসাথে শুতেও আসে নাকি? বেয়াইনদের এই হক সম্পর্কে আমি অবগত নই।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩৪