প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৫
আদ্রিতা নিশি
সকালের প্রাকৃতিক পরিবেশ শীতল ও স্নিগ্ধ। প্রকৃতিতে বর্ষার হাওয়া প্রবাহিত হইতেছে। অম্বর মেঘাচ্ছন্ন, মাটি স্নিগ্ধতাসঞ্চারিণী বৃষ্টিধারায় সিক্ত। পরিবেশে প্রশান্তি ও তাজাত্ব বিরাজমান। ঘড়ির কাটায় আটটা বেজে দশ মিনিট। সারহান গোসল সেরে মাত্র রুমে প্রবেশ করল। পরনে শুধু প্যান্ট, শরীর তোয়ালে দিয়ে ঢাকা। সে নিঃশব্দে ধীরজ পায়ে ভেতরে এগিয়ে আসলো। তীক্ষ্ণ চক্ষুদ্বয় শিথিল করে প্রগাঢ় চাহনিতে সরাসরি তাকাল বিছানায় কাঁথা মুড়িয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা অরিত্রিকার দিকে। কেমন নিশ্চিন্তে, আরামসে তন্দ্রাচ্ছন্ন।
ঘুমন্ত, শান্ত মুখশ্রীতে যেন নিদারুণ মায়া এবং মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ। এই সুশ্রী মুখশ্রী এক পলক দেখলে মনটা প্রশান্তি অনুভব করে। দুশ্চিন্তা, ক্লান্তিভাব মিলিয়ে যায়। সারহান সেথায় অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে নিরবচিত্তে অবলোকন করল। তার ওষ্ঠকোণে বিরাজ করল মৃদু হাসি। আশ্চর্যজনক ভাবে সে মেয়েটাকে ডাকল না। আরেকটু সময় ঘুমাক। দৃষ্টি ফিরিয়ে রুমের এককোণে রাখা লাগেজ থেকে শার্ট এবং যাবতীয় জিনিস বের করে এনে বিছানার এককোণে রাখল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চুলে বেক ব্রাশ করে শরীরের ওপর থেকে তোয়ালে কাঠের চেয়ারের ওপর রাখল। অতঃপর বিছানায় রাখা শার্ট টা নিতে উদ্যত হলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বেলকনির খোলা দরজা দিয়ে সোনালী ক্ষীণ আলোয় রুমের ভেতরে প্রবেশ করছে। সেই আলো সরাসরি বিছানার ওপর এসে পড়ছে। হালকা উষ্ণতা অনুভব করছে অরিত্রিকা। দীর্ঘ ঘুমের রেশ কাটিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন চক্ষুদ্বয় মেলে পিটপিট করে তাকাল। ছোট ছোট চোখ ঘুরিয়ে নড়ে চড়ে রুম এবং বিছানা দেখল। রুমটা একটু অচেনা মনে হলো। সে আস্তে ধীরে দুই চোখ কচলে ভালোভাবে আশপাশ দেখতে লাগল। হঠাৎ দৃষ্টি স্থির হলো সারহানের দিকে। মুহূর্তে হচকচিয়ে গেল। মনে পড়ে গেল রাতের ঘটনা। তারমানে সারারাত এই রুমে সারহান ভাইয়ের সাথে এক বিছানায় ছিল ভাবতেই লজ্জায় মিইয়ে গেল। ভাবমূর্তি স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস করে ব্যর্থ হলো। সে অপ্রস্তুত হয়ে দৃষ্টি নত করল। অতঃপর খেয়াল করল তার ওড়নাটা উধাও। মুহূর্তে তড়িঘড়ি হন্যে হয়ে কাঁথা বালিশ উল্টে খুঁজল। অবশেষে বিছানার একপ্রান্তে পেল। সে তড়িঘড়ি করে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিল। সারহান শার্টটা হাতে নিয়ে নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত চাহনিতে দৃশ্যটুকু অবলোকন করল।
“এতো সকালে কোথায় যাচ্ছেন?”
অরিত্রিকা আস্তে ধীরে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত ভাব আড়াল করে শুধালো। সারহান হাতে থাকা শার্টটা পড়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিল। অতঃপর অরিত্রিকার দিকে তাকিয়ে নরম বিনম্র স্বরে বলল;
“সাড়ে আটটা বাজে। নিচে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম।”
অরিত্রিকার ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেল। সে চক্ষুদ্বয় বড় করে শ্যামমানবের দিকে এগিয়ে আশ্চর্যিত হয়ে আনমনা কন্ঠে বলল;
“অল্প সময়ের জন্য চোখ বন্ধ করলাম তাই দশ- এগারো ঘন্টা হয়ে গেল? আমি তো বেশী ঘুমাইনি।”
“সারারাত আমাকে জড়িয়ে ধরে মরার মতো ঘুমিয়েছিস আর এখন বলছিস তুই বেশী ঘুমাস নি?”
“কি বললেন আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছি?”
“জ্বি বিবিজান! আপনি আমায় সারারাত জড়িয়ে ধরে নাক ডেকে ঘুমিয়েছেন।”
“আপনি কি করে জানলেন আমি আপনাকে সারারাত জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছি? না ঘুমিয়ে সারারাত জেগে ছিলেন নাকি?”
অরিত্রিকা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বিস্ময়াভিভূত কন্ঠে বলে উঠল। সারহান শার্টের বাটন লাগাতে উদ্যত হয়েছিল। মেয়েলী কন্ঠস্বর কর্ণে প্রবেশ করতেই হাতটা নামিয়ে অরিত্রিকার মুখপানে চাইল। কিছুক্ষণ মৌন থেকে অতি শান্ত কন্ঠে অবলীলায় স্বীকারোক্তি টানলো ;
“ঘুমাতে আর দিলি কোথায়? সারারাত আমাকে নির্ঘুম রাত কাটাতে বাধ্য করে নিজে শান্তিতে ঘুমিয়েছিস।”
অরিত্রিকার দুগাল গরম হয়ে গেল। দুহাত অনবরত কচলাতে লাগল। ইশ! কি লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মনে মনে নিজেকে বকলো এ রুমে ভুলবশত থেকে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ করে চোখ লেগে গিয়েছিল। কখন ঘুমিয়েছিল তা যেন ভুলে বসেছে ভুলোমন। তবুও এক প্রকার বিরোধী জোড়ালো কন্ঠে বলল;
“আমি আপনাকে কীভাবে নির্ঘুম রাত কাটাতে বাধ্য করেছি? নিজে ইচ্ছে করে না ঘুমিয়ে আমার ওপর দোষ চাপাচ্ছেন।”
“কীভাবে নির্ঘুম রাত কাটাতে বাধ্য করেছিস — এক্সপ্লেইন করব? শুনবি?”
“না… না থাক।”
“কেন থাকবে?”
“আমি… শুনতে চাই না।”
অরিত্রিকা গুরুগম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই তুতলিয়ে বলল। নম্রতা ও সংকোচের রঙে মুখখানি ঢেকে গেল মেয়েলী মুখশ্রী। অনবরত চতুর্দিকে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলতে লাগল।সারহান নিগূঢ় ও শীতল দৃষ্টিতে অনিমেষ নিরীক্ষণ করল।সম্মুখে স্থিতা রমণীর লজ্জাভারাক্রান্ত মুখমণ্ডলে অর্চিষ্মান রক্তিমাভা। প্রথম প্রহরের কিঙ্কিণী আলো যেন পলকে নেমে এসেছে মেয়েলী কান্তিময় চিবুকে।সৌন্দর্যের সেই স্থবির মুহূর্তে অভিভূত বিমোহন অন্তর্গত মনোলোকে চঞ্চলতা বিস্তার করল।কিন্তু পরক্ষণেই সে ধৈর্যনিষ্ঠ স্বরূপে প্রত্যাবর্তন করল।চক্ষুদ্বয়ে পুনরায় অরক্ত, নিরাসক্ত নিগ্রহ এঁটে নিল । দুই পা এগিয়ে এসে কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল;
“যা ফ্রেশ হয়ে নে।”
অরিত্রিকা নেত্রপল্লব ঝাপটে চাইল গম্ভীর মানবটির দিকে। নিষ্পাপ চাহনিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। সারহান সেই চাহনি দেখল। মনে মনে কিছু একটা আওড়ে শার্টের বাটনে হাত দিল। সেই মুহুর্তে মেয়েলী কোমল কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল।
“কিছু যদি মনে না করেন আমি আপনার শার্টের বাটন লাগিয়ে দেই?”
কি নিদারুণ আবদার! সারহান পুনরায় তাকাল মায়াবী মুখখানাতে। মনের ভেতর তখন অজস্র ভাবনার স্রোত বইছে। সে শার্ট থেকে হাতটা নামিয়ে নিল। গম্ভীর কণ্ঠে ছোট্ট প্রতিত্তোর করল ;
“ঠিক আছে লাগিয়ে দে।”
অরিত্রিকার মুখে চমৎকার হাসি ফুটল। মুখখানা প্রাণোচ্ছল প্রাণবন্ত দেখাল। সে সময় ব্যয় না করে বিছানায় লাফ দিয়ে উঠল। অতঃপর মৃদু হেসে বলল;
“আমার সামনে এসে দাঁড়ান।”
সারহান এসে অরিত্রিকার সম্মুখে দাঁড়াল। অরিত্রিকা এক মুহুর্ত দেরী না করে খানিকটা দক্ষ কর্মীর ন্যায় শার্টের বাটনগুলো লাগিয়ে দিতে লাগল। সারহান সুন্দর দৃশ্যটুকু গভীর ভাবে অনুভব করতে লাগল। প্রায় এক মিনিট লাগল বাটনগুলো সুবিন্যস্ত ভাবে লাগাতে। সেই কাজটা সম্পূর্ণ করে অরিত্রিকা প্রসন্ন হাসল। সে কোমড়ে হাত গুঁজে ভ্রু নাচালো। হাসিটুকু ওষ্ঠদ্বয়ে বজায় রেখে বলল;
“সাদা পাঞ্জাবি, সাদা শার্টে আপনাকে ভীষণ মানায়। বাহিরে বের হলে একটু সাবধানে থাকবেন।”
সারহান শার্টের কলার ঠিক করে কৌতূহলী ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল ;
“কেন?”
“বাহিরে কিছু পেত্নি ঘোরাঘুরি করে। সুদর্শন পুরুষ দেখলে ঘাড়ে চাপতে চায়। তাই সাবধান করলাম।”
“আমার ঘাড়ে চাপা এতো সহজ নয়।”
কথাটা শেষ করতেই সারহানের ফোনে কল আসল। সে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। অরিত্রিকা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নিচে নামল। ওষ্ঠকোণে তখনও মিটিমিটি হাসি। কিন্তু সেই হাসি বেশীক্ষণ স্থায়ীত্ব পেল না। এক মুহুর্তে প্রাণোচ্ছল প্রাণবন্ত মুখখানায় অন্ধকার নামল। সে চোখ মুখ শক্ত করে দরজার দিকে তাকাল। দরজাটা খোলা। তানহা লাজুক হেসে রুমে প্রবেশ করল। অরিত্রিকাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেল। হাসিটা কোথাও মিলিয়ে গেল। মেয়েটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে অরিত্রিকাকে এ মুহুর্তে একদম আশা করেনি। সে ভীষণ অপ্রস্তুত হলো। ভাবমূর্তি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল;
“তুমি এখানে?”
অরিত্রিকার মেজাজ বিগড়ে গেল। বরের রুমে থেকেও কি কৈফিয়ত দিতে হবে? সে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে গমগমে কন্ঠে বলল;
“কারো রুমে ঢুকতে হলে নক করতে হয় জানো না?”
“স্যরি! মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।”
“পরের বার নক করে ঢোকার কথা যেন মনে থাকে। এবার বলো কেন এসেছিলে?”
“নাস্তা করার জন্য ডাকতে এসেছিলাম।”
“তুমি যাও। আমরা আসছি।”
অরিত্রিকা শক্ত কন্ঠে বলল। কথাটা তানহার কানে গেল কিনা বোঝা গেল না। মেয়েটার দৃষ্টি বেলকনির দিকে। ভীষণ মনোযোগ সহকারে সারহানকে পর্যবেক্ষণ করছে। সেই দৃশ্য দেখে অরিত্রিকার মাথায় আগুন ধরে গেল। চাপা স্বরে ধমকে বলল ;
“এই মেয়ে ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছো? নজর ঠিক করো।”
তানহা স্বাভাবিক ভাবে অরিত্রিকার দিকে তাকাল একবার। পুনরায় সারহানের দিকে দৃষ্টি স্থির করে লাজুক কন্ঠে বলল;
“তুমি বুঝবে না আমি কি দেখছি। একটু চুপ করো।”
অরিত্রিকা রেগে আগুন হয়ে গেলো। নিষেধ করার শর্তেও বেহায়ার মতো দেখছে! সে রাগ সামলাতে না পেরে গজগজ করে আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগল ভয় দেখানোর জন্য। পাশে ছোট টেবিলের ওপর কিছু ফল সমেত ঝুড়ি দেখল। ফলের পাশে রাখা চকচকে ধাতব বস্তুটা দেখে তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। আহত বাঘিনীর ন্যায় মনকে শান্ত করতে ছু*ড়িটা নিয়ে এসে সরাসরি তানহার এক চোখ বরাবর ধরল। অতঃপর গর্জে উঠে বলল;
“উনার দিকে বেহায়ার মতো তাকিয়ে না থেকে দৃষ্টি সংযত করো। এই নির্লজ্জ মেয়ে এখনো তাকিয়ে আছো কেন? আমার হাতের ছু*রি দেখেছো? তোমার দু’চোখে ছু*রিটা ঢুকিয়ে দেই?”
তানহার ধ্যান ফিরল। সে অরিত্রিকাকে রণমুর্তি ধারন করতে দেখে ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেল। ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। সারহান কল কেটে বেলকনি থেকে দৌড়ে রুমে প্রবেশ করল। অরিত্রিকার হাতে ছুড়ি দেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ছু*ড়িটা দ্রুত হাত থেকে নিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল;
“এটা কি করতে যাচ্ছিলি? পাগল হয়ে গেছিস?”
অরিত্রিকা সারহানে বাহু জড়িয়ে ধরল। রাগে ফুঁসে উঠে বলল;
“ত্যানার চোখ উপড়ে নিতে যাচ্ছিলাম। মেয়েটার সাহস কি করে হলো আপনার দিকে তাকানোর।”
তানহা ভয়ে তটস্থ হয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল;
“ভাইয়া! আমি আপনার দিকে তাকাইনি সত্যি বলছি।”
অরিত্রিকা জ্বলন্ত চাহনি তাকাল। ধমকে বলল;
“মিথ্যা বলছো কেন? গতকাল থেকে আমি লক্ষ্য করছি তুমি উনার দিকে হায়েনার মতো তাকিয়ে থাকো। ইশরা, রাহা এরাও দেখেছে কিন্তু। ডাকবো ওদের?”
সারহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মুখাবয়ব অতিশয় কঠিন হয়ে উঠল। অরিত্রিকাকে উদ্দেশ্য করে রুঢ় কন্ঠে বলল;
“চুপ কর।”
“কিন্তু।”
“আমি বলেছি চুপ করতে। আর এটা কথা যেন মুখ দিয়ে বের না হয়।”
“হুম।”
অরিত্রিকা রাগ সংবরণ করে ছোট্ট করে প্রতিত্তোর করল। সারহান এবার তাকাল রাহার দিকে। মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রেখে ভরাট কন্ঠে বলল;
“অরিত্রিকা সম্পর্কে আমার কি হয় নিশ্চয়ই জানো?”
তানহার ভয় কমেনি। সে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে অরিত্রিকাকে দেখল। শুকনো ঢোক গিলে মিনমিন করে বলল ;
“আপনার… চাচা.. চাচাতো বোন হয়।”
“এটা ব্যতিত আরো একটা সম্পর্ক আছে ওর আর আমার।”
“কি সম্পর্ক ভাইয়া?”
“মিট মাই নিউলি ম্যারিড ওয়াইফ মিসেস অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরী।”
সারহান অরিত্রিকা দেখিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল। অরিত্রিকার রাগ হঠাৎ কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে গেল। তার ওষ্ঠকোণে ফুটে উঠল মিষ্টি হাসি। বক্ষপিঞ্জরে ভালোলাগারা উড়াউড়ি করতে লাগল। সে সারহানের বাহু আরেকটু শক্ত করে ধরল। তানহার মাথায় যেন বাজ পড়ল। সারহান ভাইয়া বিয়ে কবে করল? সে কেন জানে না? মানুষটা যে বিয়ে করেছে ভাবতেই কান্না দলা পাকিয়ে আসলো। বুকটা ফেটে পড়ল কষ্টে। পূর্বে যখন সারহান ভাইয়া এসেছিল তখনও লুকিয়ে দেখতো। মানুষটাকে মনের অজান্তে ভালোলেগে গিয়েছিল। কিন্তু বলার সাহস হয়নি। সে ছলছল চোখে দুজনকে দেখে নিল। কান্না আঁটকে শুধু বলল;
“শুভ কামনা রইল নতুন জীবনের জন্য।”
কথাটা বলে তানহা রুম থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেল। সারহান তপ্ত শ্বাস ফেলল। তানহার ভাবমূর্তি অনেক আগে খেয়াল করেছিল। ছোট মানুষ দুইদিন পর ভুলে যাবে ভেবে চুপ ছিল। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। উল্টো হিতে বিপরীত হয়েছে।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই সবাই মিলে ঠিক করল বিকেলে মেলায় যাবে। গ্রামের মেলা তাই সবারই বেশ উৎসাহ। মেলা দেখে আবার গ্রামও ঘুরে দেখা হবে এমন ভাবনায় সবাই বেশ রোমাঞ্চিত। তবে তানহা জানিয়ে দিয়েছে সে যাবে না। কেউ জোর করল না ওর ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিল সবাই।সাদাত আর ইশরা আগের মতোই ভালো সময় কাটাচ্ছে। তাদের মধ্যে যে দূরত্ব ছিল সেটা আর নেই বললেই চলে। এখন আবার আগের মতো মজা করে, একসাথে ঘোরাঘুরি করে, গল্পে মেতে থাকে।কিন্তু রাহা একেবারেই চুপচাপ। রাত থেকেই সে মনমরা হয়ে আছে। কথা কম বলছে, কারো সাথে তেমন মিশছেও না। কান্না করে মাথা ধরেছে, শরীরটাও কেমন দুর্বল লাগছে। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ। এসব দেখে অরিত্রিকা বুঝে গেছে রাহার মন খুব খারাপ আর সেটা কোনো ছোটখাটো কারণে না। তবুও সে কিছু না জেনে প্রশ্ন না করে বরং ওকে একটু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছে। জোর করে হলেও কিছু খাইয়েছে, ওষুধও দিয়েছে।রাহার এই হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যাওয়া ইরফানের নজর এড়ায়নি। মেয়েটা এমন করে নিশ্চুপ হয়ে যাবে এটা সে ভাবতেই পারেনি। ওর মন খারাপ দেখে ইরফানের ভেতরেও কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু সে বুঝতে অক্ষম।
বিকেল পাঁচটা। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুটি কালো রঙের গাড়ি। একটিতে সাদাত, ইরফান, রাহা আর ইশরা আগেই উঠে বসেছে। অন্যটিতে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে সারহান। সবাই অপেক্ষা করছে অরিত্রিকার জন্য। মেয়েটা এতোক্ষণ ধরে কী সাজছে সে নিয়ে সবার মধ্যেই একটা অস্বস্তি কাজ করছে।সারহান চুপচাপ স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে মেইন গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখটা থমথমে, চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। কয়েকবার কল দিয়েছে কিন্তু অরিত্রিকা রিসিভ করেনি। এবার আর ধৈর্য রাখতে না পেরে সে ফোনটা হাতে নেয়। আবার কল দিতে যাবে ঠিক তখনই গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে উঠে বসে অরিত্রিকা।
সারহান বিরক্তিসূচক শব্দ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। মুহূর্তেই ভাবমূর্তি পরিবর্তন হয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কেমন শিথিল হয়ে আসে। অন্তঃস্থিত সত্তা থমকে যায়। কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে যায় ওষ্ঠপুট। হাত থেকে ফোনটা ফসকে পড়ে নিচে। ফোনটা শব্দ করে পড়ায় অরিত্রিকা ভয় পেয়ে যায়। সে দ্রুত নিচ থেকে ফোনটা তুলে নেয়। দ্বিধান্বিত কন্ঠে বলে;
“সারহান ভাই আপনি ঠিক আছেন?”
সারহানের মাঝে কোনো পরিবর্তন এলো না। সে অতি শান্ত চাহনিতে পরখ করল অরিত্রিকাকে। মেয়েটা তার দেওয়া হালকা গোলাপী রঙের জামদানী শাড়িটি পড়ছে। মুখশ্রীতে হালকা সাজ। কানে, হাতে, গলায় সিম্পল স্টোনের গহনা। চুলগুলো খোলা। এমন আবেদনময়ী রুপে যেন পুরুষালী সত্তা বেসামাল হলো। তীক্ষ্ণ অক্ষিযুগল নেশালো দেখাল। সারহান ঝুকে এলো। হালকা গোলাপী রঙা লিপস্টিক পড়া ওষ্ঠে নজর বুলিয়ে মদ্যক কন্ঠে বলে উঠল;
“শাড়ি কেন পড়েছিস?”
অরিত্রিকা সিটের সাথে মিশে গেল। শরীরটা একটু কেপে উঠল।নেত্রপল্লব ঝাপটে ক্ষীণ কন্ঠে বলল;
“আপনি বলেছিলেন শাড়িতে আমায় ভীষণ মানায় তাই পড়েছি। সুন্দর লাগছে না আমায়?”
“শাড়ি পড়ে তোকে ভুবনমোহিনী লাগছে ফাইরুজ। তোর এ রুপ দেখে ক্ষণে ক্ষণে ম*রছি। আমাকে জানে মা*রার তোড়জোড় শুরু করেছিস কেন বলতো?”
“আমি আপনাকে….”
অরিত্রিকা কথা বলতে পারল না সারহানের সম্মোহনী দৃষ্টি দেখে। সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে এদিক ওদিক তাকাল। মনের মাঝে অনুভূতিকে দমিয়ে রাখার বৃথা প্রয়াস চালালো। সারহান নিগূঢ় চাহনিতে শান্ত ভঙ্গিতে লাজে রাঙা মুখটা দেখল। ব্যাকুল মনটা নিষিদ্ধ ইচ্ছাকে আশকারা দিতে চাইল। তা অতি কষ্টে দমন করল। আরেকটু ঝুকে এসে অশান্ত, সুগভীর কন্ঠে বলল;
“আমার বুকে প্রেমানল ধরিয়ে দিয়েছিস। এবার নেভানোর দায়িত্ব তোর।”
উক্ত কথাটির সমাপ্তি ঘটিয়ে সারহান স্বাভাবিক হয়ে বসল। ঘন ঘন শ্বাস টেনে চোখ মুখ শক্ত করে গাড়ি স্টার্ট দিলো। অরিত্রিকা অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে রইল। সারহান ভাই কথাটা দ্বারা কি বুঝাতে চাইল — তা বুঝতে অপারগ সে।
“আপনি আমার জন্য ঊনিশ রকমের রেশমী চুড়ি কিনলেন? এতো চুড়ি দিয়ে আমি কি করব?”
গোধূলি লগ্ন পেরিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সন্ধ্যা নামবে ধরণীতে। মেলায় দীর্ঘক্ষণ ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা, ফুসকা চটপটি খেয়ে মাত্র গাড়ি যেখানে পার্কিং করছে সেখানে এসে দাঁড়াল অরিত্রিকা। মানুষজনের ভীড় ঠেলে এ পর্যন্ত আসতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে তার। সারহান পিছু পিছু আসলো। মেয়েলী কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করলেও কোনো জবাব দিল না। এক প্রকার উপেক্ষা করে কিনে আনা গাজরা অরিত্রিকার চুলের ভাঁজে লাগিয়ে দিল। অরিত্রিকা চমকে উঠে পিছনে তাকাল। অন্য হাতে মাথায় হাত রেখে গাজরা স্পর্শ করে অবাকরতার রেষ নিয়ে বলল;
“আপনি গাজরা কখন কিনলেন?”
সারহান প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়াল। দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলো ;
“আসার সময় কিনে আনলাম।”
অরিত্রিকা মনে মনে খুশি হলো। সে আশপাশে তাকিয়ে বাকীদের খুঁজতে লাগল। কাউকে না দেখতে পেয়ে কপাল কুঁচকে বলল;
“বাকীরা কোথায়?”
“হয়তো ভেতরে আছে।”
“ইরফান ভাইকে কল করে দ্রুত আসতে বলুন।”
“আচ্ছা আমি কল করছি।”
কথাটা বলে সারহান পকেট থেকে ফোন বের করে কল করল ইরফানকে। কল বাজল কিন্তু রিসিভ হলো। আরো কয়েকবার কল করতেই রিসিভ হলো এবার। কিন্তু আশেপাশের কোলাহলে কথা শোনা যাচ্ছে না। সারহান সেখান থেকে কোলাহলমুক্ত জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। অরিত্রিকা ভদ্র মেয়ের মতো গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
“আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। আগে কি কখনো আমাদের দেখা হয়েছে?”
অপরিচিত পুরুষালি কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকা সামনে দৃষ্টি স্থির করল। লম্বা চওড়া সুদর্শন একজন পুরুষকে দেখে তার কপাল কুঁচকে গেল। সে তির্যক চাহনি লক্ষ্য করল পুরুষটিকে। পরনে কালো শার্ট, প্যান্ট । মুখ কালো মাস্ক দ্বারা আবৃত। সে পাত্তা না দিয়ে অন্যত্র তাকাল। অপরিচিত ব্যক্তিটি বোধ হয় হাসল। অদ্ভুত কন্ঠে বলল;
“তিনবছর পর আপনার সামনে এসে দাঁড়ালাম অথচ আপনি চিনতে পারছেন না! নাকি চিনেও অচেনার মতো ভাণ করছেন?”
অরিত্রিকার মেজাজ বিগড়ে গেল। ক্রোধান্বিত চাহনিতে তাকাল অচেনা ব্যক্তির দিকে। গমগমে কন্ঠে বলল;
“ আমি আপনাকে চিনি না। আমাদের কখনো দেখা হয়নি। এবার দয়া করে বিরক্ত করা বন্ধ করুন।”
“চৌধুরী বাড়ির মেয়েদের স্মৃতিশক্তি ও মানুষ চেনার ক্ষমতা অনেক কম।”
“আপনি এখান থেকে যাবেন নাকি আমি চিৎকার করে মানুষ ডাকব।”
“রিলাক্স। এতো হাইপার হয়ে যাচ্ছেন কেন? আমি এসেছিলাম পুরনো হিসাব মিটাতে। কিন্তু এসে দেখলাম আপনি আপনার স্মৃতি থেকে আমাকেই মুছে দিয়েছেন। এটা মোটেও ঠিক কাজ করেননি।”
“আপনি কে?”
অরিত্রিকা বিস্ময়াভিভূত চাহনিতে তাকিয়ে রইল কিয়ৎ সময়। কেন যেন মনে হলো সামনে দাঁড়ান অপরিচিত ব্যক্তিটি তার চেনা। পূর্বে হয়তো দেখা হয়েছে। ব্যক্তিটি বলেছিল— তিনবছর পরে তাকে দেখছে। তাহলে কি এই অদ্ভুত রহস্যময় ব্যক্তির সাথে তার তিনবছর পূর্বে দেখা হয়েছিল? তার মন শঙ্কিত হলো। অজানা আতংকে সিঁটিয়ে গেল। সে দৌড়ে সারহানের কাছে যেতে লাগল। তখনই ইটে পা বেঁধে ঠাস করে পড়ল মাটিতে। হাতে থাকা ব্যাগটি ছুটে গিয়ে পড়ল একটু দূরে। পায়ে লাগায় ব্যথায় মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠল। চোখ মুখ খিঁচে ভীতিগ্রস্ত বদনে চাইল এগিয়ে আসা ব্যক্তির দিকে।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৪
“আরে ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি আপনার সাথে মজা করছিলাম।”
ব্যক্তিটি কিটকিটে হেসে বলল। অরিত্রিকার চক্ষুদ্বয় টলমল করে উঠল। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। বুকটা অসম্ভব কাঁপতে লাগল। তবুও সাহস সঞ্চার করে বলল;
“আপনি কে? আপনার পরিচয় কি?”
ব্যক্তিটি মজা পেল ভীষণ। হেঁয়ালিপূর্ণ কন্ঠে জবাব দিল;
“আমি অন্ধকার। আমার মাঝে যে একবার হারিয়ে যায় — সে কখনো আলো খুঁজে পায়না।”