ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪০

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪০
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

প্রেম ধপাধপ পা ফেলে নিজের আর্ট গ্যালারিতে ঢুকে সোজোরে দরজা বন্ধ করে দিল। কয়েক ঘণ্টা আগেও সে ভাবেনি, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তার জীবন এভাবে বদলে যাবে। তার জীবনের সাথে অতপ্রতভাবে আরও কেউ জড়িয়ে যাবে—প্রেমের এই মুহূর্তে কেমন অনুভূতি হচ্ছে, সেটা সে কাউকে বোঝাতে পারবে না।
নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে তার।

নিজের অজান্তেই চোখের কোণে জল জমে উঠছে। সে শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে সামনে তাকাল—চোখ পড়লো দেওয়ালে টানানো পেইন্টিংটার উপর। আবারো সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল প্রেমের। সে জলজলে চোখে তাকিয়ে রইল হলুদ ফরসা বরণের হাস্যোজ্জ্বল মুখের প্রতিচ্ছবির দিকে।
স্থির চোখে তাকিয়ে ধীরে পায়ে এগিয়ে গেল পেইন্টিংটার কাছে। ছবিটি কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে কাঁপা হাতটা ছুঁয়ে দিলো ছবিটাতে। ধরে আসা গলায় ডাকলো, “চিত্রাঙ্গনা…
আমাকে ক্ষমা করে দিও, চিত্রাঙ্গনা। এই জীবনে আর কখনো প্রেম তোমার ভালোবাসায় সাড়া দিতে পারবে না।
তোমার জীবনের অদম্য সে স্বপ্ন পূরণের পথে প্রেম আর তোমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে পারবে না।
আমাকে ক্ষমা করে দিও, চিত্রাঙ্গনা। এই জীবনে আর তোমার প্রেমের প্রেমিকা হয়ে ওঠা হবে না।
শুধু এ জীবনের জন্য নয়, বরং আখেরাতের জন্য—প্রেম শুধুই ঊষার হয়ে গেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তুমি বোধহয় আমার ভাগ্যেই ছিলে না, চিত্রাঙ্গনা। না হলে আমার ভাইয়েরাও তো ভালোবেসেছে। হয়তোবা ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে না, হয়তোবা তীব্র বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় পুড়ে মরতে হবে।
সব জেনেও তারা মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছে, নিজেকে আটকাতে পারেনি।
কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি চাইনি নিজের জীবনের সাথে বাজি ধরতে। তোমার পাঁচটা বছরের পাগলামি চোখের সামনে দেখে ও নিজেকে বিরত রেখেছিলাম ভালোবাসা থেকে।
আমার কপালে আজকের দিনটা লেখা ছিল বলেই হয়তো তোমাকে ভালোবাসা থেকে বিরত ছিলাম।
তখন যদি তোমার ভালোবাসা সারা দিতাম, তবে আজ কি হতো আমার আমি ও তো আমার বড় ভাইয়ের মতো ধ্বংস হয়ে যেতাম।”

প্রেম আবারো নিজের চোখ মুছল। বড় বড় নিশ্বাস ফেলে নিজের ভিতরটা শান্ত করার চেষ্টা করলো। সত্যি কি একটু ও ভালোবাসেনি প্রেম? হয়তো বেসেছিলো।
সে আবারো ছবিটার দিকে তাকালো।
“আমাকে আর মনে রেখো না, চিত্রা। জানি, ভালোবাসা ভুলে যাওয়া সহজ নয়, তবুও আমার আর কিছু করার নেই।
আমি আর তোমার হবো না কখনো, তাই আজ থেকে এই আহনাব শিকদার প্রেম আর ভাববে না তোমায়।
তোমার জন্য যদি মনে কিছু থেকেও থাকে, তার সব আজ থেকে প্রেম ভুলে যাবে।”
প্রেম দ্রুত হাতে ছবিটা নামিয়ে উল্টে রাখলো। আর ঠিক করলো—যার ছবি, তাকেই দিয়ে দেবে। এটা আর নিজের কাছে রাখা যাবে না। কারণ, সে কোনভাবেই এক চুল পরিমাণও ঠকাতে চায় না ঊষাকে। এটা এখানে থাকলে এটা তাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেবে চিত্রার সেই পাগলামি গুলো, যা প্রেম আর মনে করতে চায় না।
সে এখন শুধুই ঊষার হয়ে থাকতে চায়। সে ঊষাকে দেখে যতটুকু বুঝেছে—মেয়েটা একদম নিষ্পাপ, একদম সহজ-সরল।

তার জীবনে প্রেম ব্যতীত আর কোন আপনজন নেই।
সে কাউকে কথা দিয়েছে—ঊষাকে আজীবন ভালো রাখবে, কোনো কষ্টই আর ঊষা পর্যন্ত পৌঁছাতে দেবে না।
আর শিকদাররা কখনো তাদের কথার খেলাপ করে না। তাই আহনাব শিকদার প্রেমও নিজের কথার খেলাপ করবে না।
আজ থেকে সে তার সর্বোচ্চটা দিয়ে ঊষাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবে। তার কোনো অবহেলা হতে দেবে না।
প্রেম নিজের মনের সুপ্ত অনুভূতি গুলো মাটি চাপা দিয়ে দিল। বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। অতঃপর চিত্রার ছবিটা ভালোভাবে র‍্যাপিং করে রেখে দিল। এখানেই সমাপ্ত হলো প্রেমের জীবনে চিত্রার আনাগোনা।
প্রেরণা, পরি আর প্রিয় মিলে ঊষাকে পরির ঘরে নিয়ে এসেছে।

পেছন পেছন থিরা, থোরি, তন্ময় ও এসেছে।
তাদের নতুন ভাবি এতই মিষ্টি দেখতে যে তাদের মনই ভরছে না।
পরি ঊষাকে ঘরের সোফায় বসিয়ে দুই হাতের আজলায় মুখ তুলে ধরে বললো,
“মাশাআল্লাহ ভাবি, আমার ভাইয়ের কপাল আছে—মানতেই হবে! তাই তো এত মিষ্টি ভাবি, অন্যের ভাগ্যে পড়তে পড়তে ঠিকই আমার ভাইয়ের ভাগ্যে পিচলে গেছে।”
সকলের ভিড় ঠেলে ছুটে এল তন্ময়। ঊষার পাশে বসে শাড়ির আঁচল টেনে দিয়ে ডাকলো, “ছোট ভাবি!”
ঊষা চোখ ফিরিয়ে তাকালো তন্ময়ের দিকে।
তন্ময় গালে হাত দিয়ে প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বললো,
“প্রিয় আপু, দেখে রাখো—আমি ঠিক এরকমই একটা মেয়ে বিয়ে করবো!”
তন্ময়ের কথায় লজ্জা পেল ঊষা।
প্রিয়তা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“ছ্যাহ! তোকে কে বিয়ে করবে? দাঁতে পোকা ধরা কুমড়ো পটাশ!”
তন্ময়ের সেলফ কনফিডেন্স একটু দুর্বল হল। সে বোনের দিকে তাকিয়ে ভাবলো—এরা কি তাকে একটু মোটিভেশন দিতে পারে না?
থিরা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
“আপুরা, তোমরা ভাবিকে নিয়ে পড়ে আছো, ওদিকে রাত বাড়ছে—ভাইয়ার বাসর ঘর সাজাতে হবে। সেদিকে খেয়াল আছে?”

‘বাসর ঘর’ কথাটা কানে আসতেই ঈষৎ কেঁপে উঠল ঊষা।
প্রিয়তা ও পরিনীতা ও প্রবল উৎসাহিত হল। তবে কিছু একটা মনে পড়তেই তাদের উৎসাহ নিভে গেল।
প্রিয়তা একটু চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
“আপু, এত রাতে কি তাজা ফুল পাওয়া যাবে? আর তাছাড়া এত রাতে ফুলের মার্কেটে গিয়ে ফুল আনা সম্ভব না। তাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”
পরি কিছুক্ষণ ভাবলো।
একটু চিন্তা-ভাবনা করতেই তার ব্রেন ৫জি স্পিডে আইডিয়া বের করে ফেলল। একটু ভাব নিয়ে বলল,
“চিল গাইজ, ফুলের জন্য ফুলের মার্কেটে যাওয়ার কি দরকার? আমাদের বাগানে যা ফুল আছে, তা দিয়েই প্রতিদিনই বাসর করা যাবে!”

পরিনীতার কথায় সবাই অদ্ভুত চোখে তাকালো তার দিকে।
লজ্জায় ঊষার মন চাচ্ছে মাটির নিচে ঢুকে পড়তে।
পরি দেখলো সবাই ওর দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারল—ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে।
তাই কেশে কথা কেটে দিতে বললো,
“হিহি… এক্সাম্পল দিলাম আরকি! তোরা ও না, সব দুষ্টু দুষ্টু কথা ভাবিস!”
ওদের কথার মধ্যেই অরণ্য, সমুদ্র, পূর্ণতা আর ইনায়া এল।
“প্রেম ভাই বউ নিয়ে এসেছে”—এটা কানে আসতেই ইনায়া আর বাসায় বসে থাকতে পারেনি।
তাদেরকে দেখে পরিনীতা বললো,

“ওয়াও! তোমরা চলে এসেছো! আজকে গ্র্যান্ড পার্টি হবে!”
প্রিয়তা তাড়া দিয়ে বলল,
“ওসব পরে! আগে বাসর ঘর সাজাতে হবে।”
অরণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখিত কণ্ঠে বললো,
“তোদের জন্য বড় খারাপ লাগে আমার।”
থিরা ভ্রু কুঁচকালো,
“কেন?”
অরণ্য ৫ বালতি দুঃখ গলায় ঢেলে বলল,
“এই যে তরা আমার বাসর ঘর সাজাতে পারছিস না—এটা তো তোদের অধিকার! কবে যে আমার বাসর ঘর সাজাবি…”

প্রিয়তা নাক সিটকে বললো,
“ছি! তোমাকে কে বিয়ে করবে?”
অরণ্য ভ্রুকুটি করে তাকালো বোনের দিকে—তার বোন কি তাকে অপমান করল?
কিন্তু এসব অপমান গায়ে মাখলো না সে মুখ বেঁকিয়ে বলল,
— “দেখবি, দেখবি! সব ভাইয়াদের থেকে আমার বউ বেশি সুন্দর হবে।”
আবারো মুখ বাঁকালো প্রিয়তা।
ওদের ভাইবোনদের খুনসুটি দেখে ঊষার মনের ভার কিছুটা হালকা হল। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল সবার দিকে।
পরিনীতা অধৈর্য হয়ে বলল,
— “হয়ে হয়েছে, আর ঝগড়া করতে হবে না। আমি প্রিয় আর ইনু এখানেই ছোট ভাবিকে রেডি করে দেব।
পূর্ণ, ফুলদা আর ছোট আপু গিয়ে কয়েক পদের সুগন্ধযুক্ত টাটকা ফুল তুলে নিয়ে আসো।”
তন্ময় আর থোরিও লাফিয়ে উঠে বলল,

— “আমরাও যাবো!”
অরণ্য মুখ বেঁকিয়ে তন্ময়কে কোলে নিয়ে বলল,
— “তুই আজীবন মানুষদের বাসর দেখে দেখে মরবি। এটা তোর বড় ভাইয়ের অভিশাপ।”
কিন্তু তন্ময় ওর কথায় পাঁচ আনাও গুরুত্ব দিল না।
ওরা বেরিয়ে গেল ফুল তুলতে।
প্রিয়তা, ঊষাকে নিয়ে পরিনীতার ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসাল।
পরিনীতা নিজের ওয়ারড্রোব খুলে বেস্ট শাড়িটা সিলেক্ট করতে লাগলো।
ঊষা তখন থেকেই উসখুস করছে।
প্রিয়তা সেটা লক্ষ্য করে বলল,

— “কিছু কি হয়েছে, ছোট ভাবি? কিছু বলতে চাও?”
ঊষা করুণ চোখে তাকাল প্রিয়তার দিকে। আমতা আমতা করে বলল,
— “আসলে আপু, তুমি যদি কিছু মনে না করো… তোমার ফোনটা একটু দেবে?
আমি আমার বড় আপুকে একটা ফোন করতে চাই।”
অবাক হলো প্রিয়তা।
আশ্চর্য কণ্ঠে বলল,

— “তোমার না কেউ নেই?”
ঊষা অস্থির হলো। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
— “উনি আমার চাচাতো বোন…”
প্রিয়তা অবাক চোখে দেখল ঊষার অস্থিরতা।
নিজের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে হেসে বলল,
— “এভাবে বলছ কেন, ভাবি? তুমি যখন যাকে ইচ্ছে তাকেই ফোন করবে। এতে কারো অনুমতি কেন নিতে হবে?”
ঊষা ফোনটা নিয়ে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়তার দিকে।
কাঁপা হাতে নাম্বার ডায়াল করতেই দেখল—নাম্বারটা অলরেডি সেভড।
একটু অবাক হলো ঊষা, কিন্তু বিষয়টা অতটা গুরুত্ব না দিয়ে কল দিল সেই নাম্বারে।
কিন্তু ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠে ভেসে এল—
“আপনি যে নাম্বারটিতে ফোন করেছেন, সেটি বর্তমানে পরিষেবা সীমার বাইরে রয়েছে। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পরে চেষ্টা করুন।”

হতাশ হলো ঊষা।
আরো কয়েকবার ফোন করেও একই উত্তর পেল।
প্রিয়তা দেখল মেয়েটার চোখের পরিবর্তন।
ঊষা প্রিয়তাকে ফোনটা ফেরত দিয়ে বলল,
— “অনেক ধন্যবাদ, আপু।”
প্রিয়তা হেসে ঊষার হাতে হাত রেখে বলল,
— “চিন্তা করো না। একটু পর আবার করো, তখন নিশ্চয়ই ধরবেন।”
ঊষা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
প্রিয়তা নিজের ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখতেই অবাক হলো।
কল লিস্টের উপরে ‘চিত্রা আপু’ নামটা জলজল করছে।
প্রিয়তা অবাক কণ্ঠে বলল,

— “চিত্রা আপু তোমার বড় বোন?”
ঊষা উপর-নিচ মাথা নাড়াল।
ঠিক তখনই পরিনীতা একটা সুন্দর সিঁদুর রঙা জামদানি নিয়ে হাজির হলো।
প্রিয়তা আবার আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “চিত্রা আপু যদি তোমার বোন হয়, তাহলে তোমার সাথে যখন এসব হচ্ছিল—তখন চিত্রা আপু কোথায় ছিল?”
পরিনীতা ওদের কথোপকথন শুনে ভ্রু কুঁচকালো।
আশ্চর্য কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

— “কি নিয়ে কথা হচ্ছে, প্রিয়?”
প্রিয়তা কণ্ঠে অবাকত্ব ধরে রেখেই বলল,
— “চিত্রা আপু নাকি ভাবির চাচাতো বোন!”
পরী ও অবাক হলো। সন্দেহি কণ্ঠে বলল,
— “চিত্রা আপু… তার মানে চিত্রা আপুর বাবা তোমাকে জোর করে ওই বৃদ্ধ লোকটার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছিল?”
চোখে জল চলে এল ঊষার।
সে নত মুখে উপর-নিচ মাথায় নাড়ল।
পরিনীতা আর প্রিয়তা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল ঊষার দিকে।
তাদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না—চিত্রা আপুর পরিবার এতটা জঘন্য!
পরিনীতা আর প্রিয়তা একসাথে বলে উঠল,
— “সিরিয়াসলি?”
প্রিয়তা অবাক কণ্ঠে বলল,

— “চিত্রা আপুকে দেখে তো কোনোদিন খারাপ মনে হয়নি!”
ঊষা সাথেসাথেই প্রতিবাদ করল। কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
— “আপু অনেক ভালো। এত দিন দাদা-দাদির সাথে আপুই তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।”
পরিনীতা আশ্চর্য কণ্ঠে বলল,
— “তাহলে আজ এতকিছুর সময় চিত্রা আপু কোথায় ছিল?”
প্রিয়তাও উৎকণ্ঠিত চোখে তাকালো।
ঊষা আবার কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

— “চিত্রা আপু তার নানাবাড়ি গিয়েছে তিন দিন আগে। আর এই সুযোগটাই বড় চাচ্চু আর ছোট চাচ্চু নিয়েছে। চিত্রা আপু থাকলে ওরা কোনোদিন পারত না আমার সাথে এমনটা করতে।”
ঊষার চোখের পানি দেখে পরিনীতা আর প্রিয়তা ব্যথিত হলো।
প্রিয়তা ঊষার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
— “আর কান্না করো না, ভাবি। এখন আর তোমার কান্নার দিন নেই। এখন তোমার জীবনে আমার ভাই আছে। অতীতে তোমার জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট থাকলেও এখন আর সেসবের একচুলও থাকবে না।
হয়তো ভালো কিছু দেবেন বলেই আল্লাহ এত বছর তোমার পরীক্ষা নিয়েছেন, আর তোমার ধৈর্যে সন্তুষ্ট হয়ে আমার ভাইয়ের মতো একজনকে তোমার জীবনে পাঠিয়েছেন।”
ঊষা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইল।
পরিনীতা দুষ্টু কণ্ঠে বলল,

— “সত্যি বলো ভাবি, আমার ভাইকে তোমার অনেক পছন্দ হয়েছে, তাই না? নিজের ভাই বলে বলছি না, আমার ভাইয়ের মতো এত কিউট আর চার্মিং ছেলে খুব কমই আছে।”
লজ্জা মিশ্রিত হাসল ঊষা।
সত্যি বলতে, কবুল বলার পর মুহূর্তে ওই মানুষটাকে যখন প্রথমবার দেখেছিল ঊষা, থমকে গিয়েছিল তার পুরো পৃথিবী।
এই মানুষটা তার স্বামী—এটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না।
ওই মানুষটার বাদামি চোখের সঙ্গে প্রথমবার দৃষ্টি বিনিময় হওয়ার মুহূর্ত মনে পড়লে এখনও গা কাটা দিয়ে ওঠে ঊষার।
ঊষাকে লজ্জা পেতে দেখে পরিনীতা, প্রিয়তা আর ইনায়া ঠোঁট চেপে হাসল।
ইনায়া এক চোখ টিপ দিয়ে বলল,

— “এখনই সব লজ্জা পেয়ে গেলে হবে ভাবী, রাতের জন্যও কিছু তুলে রাখো!”
পরিনীতা দুষ্টু কণ্ঠে বলল,
— “বুঝলি প্রিয়,ভাবি ছোড়দার সামনে এভাবে লজ্জা পেলে ছোড়দা নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করবে।”
আরো দ্বিগুণ লজ্জায় আরষ্ট হয়ে গেল ঊষা।
ঊষাকে আর লজ্জা পেতে না দিয়ে পরিনীতা তাকে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল শাড়ি পরাতে।
ওরা চলে যেতেই প্রিয়তার হাসিমাখা মুখটা মলিন হয়ে গেল।
চিত্রা আপু ঊষার বড় বোন—এটা মনে হতেই বুকে ব্যথা ধরে গেলো।
আর কেউ না জানুক, প্রিয়তা ঠিকই জানে—চিত্রা প্রেমের জন্য কতটা পাগল, প্রেমকে কতটা ভালোবাসে, কতটা চায়।
শেষপর্যন্ত নিজের ভালোবাসার মানুষটা নিজের বোনের স্বামী হতে হলো!
এই ব্যথা কিভাবে সহ্য করবে চিত্রা?

প্রিয়তা চিত্রার আগাম ব্যথায় ব্যথিত হল।
এই ব্যথায় যে হৃদয়ের ঠিক কতটা পুড়ে, তা তার চেয়ে ভালো আর কে জানে!
শেষ পর্যন্ত চিত্রাও কি তার মতোই প্রতি মুহূর্তে ধুকে ধুকে মরবে?
সাদমান শিকদারের মাথায় আগুন জ্বলছে।
তিনি ঘরের সবকিছু এলোমেলো করে মেঝেতে বসে আছেন। উনার চোখদুটো আগুনের গুলার মতো টকটক লাল।
অনুস্রী বেগম সামির মাথায় বরফের টুকরো চেপে ধরে ভীত কণ্ঠে বললেন,

— “একটু মাথা ঠাণ্ডা করুন আপনি।”
সাথে সাথেই গর্জন দিয়ে উঠলেন সাদমান শিকদার। হুঙ্কার দিয়ে বললেন,
— “শান্ত হতে বলছো? আমি কীভাবে শান্ত হবো আমি? বলো, কীভাবে শান্ত হবো? তোমার ছোট ছেলে জাতপাতহীন একটা ফকিন্নি বাড়ির মেয়েকে আমার শিকদার বংশের বউ করে এনেছে! কোথাকার কোন রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছে!
ছ্যাহ! আমার কি কোন মান-সম্মান নেই? আমার কুল-মর্যাদা কোথায়? আমার বংশমর্যতা কোথায়? সমাজে আমি কী মুখ দেখাবো?
কি বলবো সবাইকে? যে এক সাধারণ স্কুল মাস্টারের নাতনি সাদমান শিকদারের বউমা!
তোমার ছেলে কীভাবে পারলো আমার অনুমতি ছাড়া এত বড় কাজটা করতে?”
অনুস্রী বেগম ভীতিগ্রস্ত হলেন। তিনি সামিরে শান্ত করার চেষ্টা করলেন,

— “ছোট ছেলে বুঝতে পারেনি…”
সাদমান শিকদার এবার আরো রেগে গেলেন,
— “হিসহিসিয়ে বললেন, তোমার ২৫ বছরের দামড়া ছেলে বিয়ে করে বউ আনে বুঝেছে! আর কাকে বিয়ে করছে, সেটা বুঝে নাই!
আমার বংশের সম্মান নিয়ে খেলার অধিকার আমি কাউকে দেইনি। এই সম্মানের জন্য যদি ছেলেকে ও শেষ করে দিতে হয়, আমি দ্বিবার ভাববো না!
তুমি ভালোভাবেই জানো—এই শিকদারদের জন্য, তাদের বংশ-মর্যাদার আগে কিচ্ছু নয়।”
অনুস্রী বেগমকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সাদমান শিকদার।
অনুস্রী বেগম মুখে আঁচল চেপে কেঁদে উঠলেন।

এই মিথ্যা অহংকারের জন্য একবার উনার কুল খালি হয়েছে।
আবার সেই একই অহংকারের জন্য তার আরেক সন্তানের দিকে হাত পড়েছে।
আগেরবার তিনি চুপ ছিলেন, কিন্তু এবার আর তিনি চুপ থাকবেন না।
উনার প্রেমের গায়ে একটাও আঁচড়ের মূল্য সাদমান শিকদারকে খুব খারাপভাবে গুনতে হবে।
রাত ১২টা
পুষ্পসজ্জিত বিছানায় ধুরু ধুরু বুকে বসে আছে নববধূ—তার চোখেমুখে স্পষ্ট ভীতি আর আড়ষ্টতার ছাপ।
তার এলোমেলো দৃষ্টি ঘরে সর্বত্র বিচরণ করছে। আজ ঘরটা ও নিজের রং বদলে ফেলেছে—প্রেমের সেই চেনা ঘরটা আর আগের মতো নেই, এখন তার সর্বত্রই অন্য ছোঁয়া।
সাদা বেডশিটের উপর ছড়ানো লাল-সাদা মিশ্রণের গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ শেপ আঁকা, তার মধ্যে গাঁদা ফুল দিয়ে সুন্দর করে “প্রেম প্লাস ঊষা” লেখা।

ঘরের সব লাইট অফ করে মেঝেতে বড় বড় কয়েকটা ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে রাখা। অন্ধকার রুমে মোমবাতির ঈষৎ আলোয় ঘরটা ভীষণ মোহনীয় লাগছে।
উত্তর দিকের বিশাল খোলা জানালার গ্রিল গলিয়ে রূপালী চন্দ্রের আলো এসে ঘরের মেঝেতে পড়েছে।
তবে এই পুরো আয়োজনের সবচেয়ে মোহনীয় উপাদানটি হলো বিছানার মধ্যমণি হয়ে বসা—লাল শাড়িতে মোড়ানো নববধূ নিজেই।

তার অনিন্দ্যসুন্দর রূপের ঝলকে শুধু ঘর নয়, পরিবেশটাও রূপ বদলে ফেলেছে।
ঊষা একটু পর কী হবে, সেই চিন্তায় এসি’র মধ্যে ও দরদর করে ঘামছে।
বুকের ভিতরের হৃৎযন্ত্রণা ছলাৎ ছলাৎ করছে।
মনে হয় বেয়াদবটা এখুনি বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে!
ঊষা চোখ বন্ধ করে দাদির বলা কথাগুলো মনে মনে স্মরণ করে নিল।
তবু ও এই ঘরের মালিকের কথা ভাবে। অজানা শিহরণে ঊষার শরীরের সকল পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
আরও কয়েক মিনিট পর ঘরের দরজা খুলার—
দরজা খোলার শব্দে কেঁপে উঠলো ঊষা।
বুকে তার এত জোরে ধড়ফড় করছে যে মনে হচ্ছে, সে হয়তো এখুনি জ্ঞান হারাবে।
ঊষা বুঝতে পারলো, দরজা খুলে কেউ ভিতরে প্রবেশ করেছে।
ঊষা দাদির কথা মতো মনে সাহস জুগিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল।
ধীরে পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালো প্রেমের সামনে।

প্রেম ভ্রু কুঁচকে তাকালো ঊষার দিকে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার স্ক্যান করল।
লাল রঙের জামদানি মেয়েটাকে মোমবাতির নরম আলোয় প্রেমের কাছে জীবন্ত পুতুল মনে হলো।
প্রেমের ভাবনার মাঝেই ঊষা প্রেমের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো।
ঊষা-কে পায়ে হাত দিতে দেখে চমকে গেল প্রেম।
সাথে সাথেই দুই কদম পিছিয়ে গেল।
বিস্মিত কন্ঠের প্রশ্ন করল,

— “কি করছো! পায়ে হাত দিচ্ছো কেন?”
ঊষা প্রেমের দিকে মুখ তুলে চাইল না।
আবার এগিয়ে গিয়ে প্রেমের পা ছুঁলো।
রিনরিনে মিষ্টি কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলল,
— “দাদিমা বলে দিয়েছেন, বিয়ের পর স্বামী—মেয়েদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে সম্মানীয়।
বাসর রাতে স্বামীর পা ধরে সালাম করে দোয়া চাইতে হয়।
তাই আপনি ও আমাকে দোয়া করে দিন।”
বাচ্ছা বউয়ের শিশুসুলভ আচরণ দেখে নিজের অজান্তেই হেসে ফেললো প্রেম।
নিজের হালাল স্ত্রীকে প্রথমবার স্পর্শ করে, মাথায় হাত রেখে বলল,

— “নাও, দোয়া করে দিলাম।”
এবার ও উঠলো না ঊষা।
অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল,
— “এভাবে দোয়া করলে তো আল্লাহ অব্দি পৌঁছাবেই না।”
বউয়ের কথা শুনে অবাক হলো প্রেম। মনে মনে বলল, দোয়া করার কৌশল ও আছে!
কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করল,
— “তাহলে আর কিভাবে দোয়া করা যায়?”
ঊষা তুতা পাখির মতো শেখানো বাণী গুলো গরগর করে বলতে লাগলো,
— “দাদিমা বলে দিয়েছেন, স্বামী যাতে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দেন—
আমি যেনো সারাজীবন স্বামীর কথা শুনে চলতে পারি,
স্বামী-সন্তান নিয়ে মুখে সংসার করতে পারি।”
মেয়েটার সরলতা দেখে এবার খানিকটা শব্দ করে হাসলো প্রেম।

না চাইতেই ঊষার দৃষ্টি চলে গেল প্রেমের পানে।
প্রেম হাসলে প্রণয়ের মতো বা গালে টোল পড়ে।
ঊষা দুনিয়া ভুলে বেবলার মতো হাঁ করে চেয়ে রইলো প্রেমের হাসোজ্জ্বল মুখের পানে।
বুকের কোথাও একটা সূক্ষ ব্যাথা অনুভব করল।
মনে মনে—“পুরুষ মানুষ এতো সুন্দর হয়?
আমার নিজেরই তো নজর লেগে যাবে!”

প্রেম হেসে ঊষার মাথায় হাত রেখে বললো,
— “তোমাকে দোয়া করে দিলাম।
তুমি সৌভাগ্যবতী হও,
স্বামী-সুহাগিনী হও,
সু-সন্তানের জননী হও।”
ঊষা চোখ ফিরাতে পারলো না প্রেমের দিক থেকে।
এতো সুন্দর করে গুছিয়ে কেউ কথা বলতে পারে, জানা ছিল না ঊষার।
প্রেম লক্ষ্য করলো, ঊষা তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
হাসি থেমে গেল প্রেমের।
সে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
— “যেগুলো পড়ে আছো, ওগুলো ছেড়ে ফ্রেশ হও।
নফল নামাজ আদায় করবো।”

ঊষা স্বামীর দিক থেকে টেনে হিচঁড়ে দৃষ্টি নামালো।
সম্মতি জানিয়ে প্রেমের ড্রেসিং টেবিলের টুলে গিয়ে বসল।
প্রেম ওয়ারড্রোব খুলে সাদা পাঞ্জাবি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
ঊষা অনেকগুলো বড় বড় সোনার চুড়ির মধ্যে থেকে দুটো করে দুই হাতে চারটা রেখে বাকিগুলো খুলে ফেললো।
বাকি সব সাজসজ্জাও তুলে ফেললো।
কিন্তু গলার হার খুলতে গিয়ে বাধলো বিপত্তি।
হারের সঙ্গে চুলের ক্লিপ বাজেভাবে আটকে।
চুলে অতিরিক্ত টান লাগায় ব্যথায় চোখে পানি চলে এলো ঊষার।
প্রেম ওজু করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো, ঊষা হার ধরে টানাটানি করছে।
দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চুলের সঙ্গে বাজেভাবে ফেঁসে গেছে।
প্রেম ধীরে পায়ে এগিয়ে গেল ঊষার কাছে।
আলতো হাতে চুল ও হারের প্যাঁচ ছাড়াতে লাগলো। হঠাৎ প্রেমের স্পর্শ গলায় পেতেই গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল ঊষার।

লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিল।
প্রেম যত্ন সহকারে গলার হারটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো।
এবার ধীরে ধীরে একটা একটা চুলের ক্লিপ খুলতে লাগলো।
লজ্জায় আর আরষ্টতায় ভেতর ভেতর হাঁসফাঁস করে উঠলো ঊষা।
প্রেমের হাতের স্পর্শ যতবার গলায়, ঘাড়ে লাগছে, ততোবারই কেঁপে কেঁপে উঠছে মেয়েটা।
প্রেম ভালোই অনুভব করলো ঊষার দেহের কম্পন।
তবুও কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবো না।
চুল থেকে শেষ ক্লিপটা খুলে নিতেই ঊষার দীঘল কালো কেশরাশি প্রথমে কাঁধ, তারপর পিঠ, তারপর কোমর—আর সব শেষে হাঁটু ছাড়িয়ে গেল।
এত বড় চুল দেখে অবাক চোখে চেয়ে রইলো প্রেম।
ঊষা ধীরে বসা থেকে উঠলো, হাতে চুল পেঁচিয়ে খোঁপা করতে করতে মৃদু কণ্ঠে বললো,
“আমি ওজু করে আসি।”

অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিল প্রেম। সম্মতি জানিয়ে বললো,
“হুমম।”
ঊষা চলে গেল ওয়াশরুমে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে ওজু করে বেরিয়ে এলো ঊষা।
গালে, গলায় লেগে থাকা জলবিন্দুগুলো হীরের মতো চকচক করছে।
ঘরের সব লাইট অন করে দিল প্রেম।
আগে-পিছে করে দুটো জায়নামাজ বিছিয়ে নিলো দুজন।
দুজন সময় নিয়ে নফল নামাজ আদায় করে নিলো।
নামাজ শেষে করে উঠতে যেতে নিতেই ঊষার ডান হাত চেপে ধরে আবারো বসিয়ে দিলো প্রেম।
চমকালো ঊষা।

প্রেম তার দিকে না তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে সুরা পড়তে লাগলো।
স্বামীর দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো ঊষা।
প্রেম সুরা পড়ে ঊষার সারা গায় ফু দিয়ে দিল।
ঊষার দুই হাত নিজের হাতে মুঠোয় নিয়ে কোমল চোখে তাকালো।
ঊষা মায়াবী চোখে অবাকত্ব নিয়ে তাকিয়ে আছে।
প্রেম কিছুক্ষণ ঊষার দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো,
“এখন তোমাকে কিছু কথা বলব। মনে রেখো, আমরা যতদিন এই বাড়িতে থাকব, তুমি সেই কথাগুলো অবশ্যই মেনে চলবে।”

ঊষা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো।
প্রেম তার মায়াবী চোখে চোখ রেখে নরম কন্ঠে বলল—
“তোমাকে এই বাড়িতে অনেকেই ভালোবাসা দেখাবে।
কিন্তু ভুলেও সবার কথায় ভুলবে না।
ভুলেও সবাইকে বিশ্বাস করবে না।
তুমি আমার বউ।
তোমার যখন যা লাগবে তুমি আমায় বলবে।
তোমার স্বামী তার সাধ্য অনুযায়ী তোমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবে।
এই বাড়িতে যেই তোমাকে যাই বলুক, সব আমাকে বলবে।
কেউ যদি অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখায়, তাহলে তো অবশ্যই বলবে।
আর মনে রাখবে,

মানুষ যতটা ভালো মানুষী দেখায়, তারা আসলে অতটা ভালো হয় না।
তুমি আমার বউ, আমার দায়িত্ব।”
ঊষা বাকরুদ্ধ চোখে তাকিয়ে শুনছিলো প্রেমের কথা।
প্রেমের মুখে ‘আমার বউ’ শব্দটা ঊষার কলিজায় লাগলো।
প্রেম আবার বললো,
“যা বললাম, মনে থাকবে তো?”
ঊষা লাজুক হেসে উপরে-নিচে মাথা ঝাকালো।
স্নিগ্ধ হাসলো প্রেম।
কোমল কণ্ঠে বললো,

“যাও, অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো।”
ঘুমানোর কথা শুনে ঊষা একটু চঞ্চল হয়ে উঠলো।
ঊষাকে ঠায় বসে হাত কচলাতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো প্রেম।
কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
“কি?”
ঊষা আমতা আমতা করে বললো,
“কোথায় ঘুমাবো?”
আশ্চর্য হলো প্রেম।
আশ্চর্য নিত কণ্ঠে বললো,
“এতো বড় খাট থাকতে, কোথায় ঘুমাবে!”
ঊষা বোকা চোখে তাকাল…
অবুঝ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

“তাহলে আপনি কোথায় ঘুমাবেন?”
প্রেম এবার হাত ভাজ করে তাকালো ঊষার দিকে।
আচমকাই ঊষার দিকে একটু ঝুঁকে গেল প্রেম।
প্রেম কে এগিয়ে আসতে দেখে ভড়কে গেল ঊষা।
প্রেম ঊষার একদম কাছে গিয়ে ঊষার ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো স্লো ভয়েজে বললো,
“আমার ঘর, আমার বউ, আমার বিছানা—আর আমাকেই জিজ্ঞেস করছো আমি কোথায় ঘুমাবো?”
প্রেমের মুখে ‘আমার বউ’ কথাটা বারবার ঊষার শরীরের পশমে পশমে কাঁপন ধরাচ্ছে।
ঊষা কম্পনরত চোখে তাকালো প্রেমের দিকে।
প্রেম বাঁকা হেসে ঊষার হাত ধরে টেনে তুললো।
বিছানায় নিয়ে গিয়ে ফুলের পাপড়িগুলো সরিয়ে ডান পাশে শুতে শুতে বললো,

“বাঁ পাশটা তোমার, ওখানে শুয়ে পড়ো।”
ঊষা প্রেমের দিকে তাকিয়ে ঘামতে শুরু করলো।
সে একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের সঙ্গে ঘুমাবে—কথাটা ভাবতেই গলার পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে!
প্রেম ঊষাকে ঘামতে দেখে বললো,
“এত নার্ভাস হওয়ার কী আছে? আমার সাথেই এভাবেই তোমাকে সারাজীবন কাটাতে হবে।”
ঊষা ইতস্তত করে প্রেমের পাশে শুতেই এখন শুধু ঘাম নয়, বরং শরীর ও থর থর কাঁপতে শুরু করেছে।
প্রেম আগেই ঘরের সব লাইট অফ করে ক্যান্ডেল নিভিয়ে দিয়েছিল।
এখন টেবিল ল্যাম্পটা অফ করতেই আতকে উঠলো ঊষা।
‘ভূত! ভূত!’ করে চিত্কার দিয়ে এক লাফে প্রেমের বুকে চলে গেল।
উক্ত কাণ্ডে দুজনেই হতবম্ভ হয়ে গেলো।
প্রেমের সংস্পর্শে আসতেই ঊষার ভূতের ভয় পালিয়ে গিয়ে শরীরের রক্ত, মাংস, হাড়, হাড্ডি সব ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপতে শুরু করল।

সে কী করেছে, বুঝে আসতেই ভয় ও লজ্জা গুটিয়ে গেল।
এখন যদি প্রেম বকা দেয়—এই ভেবে গলা শুকালো।
এত কিছুর মধ্যে সে যে প্রেমের বুক থেকে সরে যাবে, সেটুকু আর ভাবার সময় পেল না।
কিন্তু ঊষার ভাবনার মতো তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না প্রেম।
বরং ঊষার বালিশটা নিজের বালিশের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ঊষাকে আরেকটু ভালোমতো বুকে জায়গা করে দিলো।
চুলের খোঁপাটা খুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“এত কাঁপাকাঁপির কি আছে? তোমাকে কি মারছি?”
প্রেমের কন্ঠে ফাঁকা ঢোক গিলল ঊষা।
পাঞ্জাবির গলাটা শক্ত করে মুঠো করে ধরল।

প্রেম বুঝলো, মেয়েটা নার্ভাস।
তাই সে আর কিছু বলল না।
আগের মতোই মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নরম কন্ঠে বলল,
“সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ঘুমাও।”
অনেকক্ষণ কাঁপাকাঁপি করে কিছুটা শান্ত হলো ঊষা।
এই মানুষটার স্পর্শ শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয় ঠিকই,
কিন্তু এই মানুষটার স্পর্শের মতো ভালো লাগা আর সুখের অনুভূতি এর আগে কখনো অনুভব করেনি সে।
এই মানুষটার স্পর্শে যেরকম শান্তি, কন্ঠেও তেমন অদ্ভুত মায়া।
তার ভাগ্যে এত ভালোবাসা ও বুঝি ছিলো!
প্রেমের বুকে উষ্ণতায় ভীষণ আরাম বোধ করলো ঊষা।
আরেকটু কাঁপাকাঁপি করে, কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর তন্দ্রায় তলিয়ে গেলো সে।
প্রেম ও নিজের সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর কোমল শরীরটা বুকে নিয়ে গভীর তন্দ্রায় তলিয়ে গেলো।
রাত একটা।

কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছে চিত্রা।
যখনই জানতে পেরেছে, তার অনুপস্থিতিতে তার বোনকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে—আর বসে থাকতে পারে নি।
চিত্রা এত রাতে বাড়ি ফিরে এসেছে।
চিত্রা ভীষণ রেগে চিৎকার-চেঁচামেচি করে পাড়ার লোক জড়ো করে ফেলেছে—
“আমি জানতাম, তোমরা খারাপ! অর্থলোভী!
তাই বলে এত লোভী!
তোমাদের টাকার এত লোভ যে, নিজের মৃত ভাইয়ের মেয়েকে সামান্য কয়টা টাকার জন্য বিক্রি করে দিচ্ছিলে! ছিঃ!
আচ্ছা বাবা, তোমার একবারও মনে পড়লো না, তোমারও একটা মেয়ে আছে?
ওই ছোট মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে তোমার একটু মায়া হলো না?
তুমি তো তাকে খাওয়াতে না, পড়াতে না—জীবনে এক চুলের দায়িত্বও নাওনি!
তাহলে কোন অধিকার ঊষার জীবনটা নষ্ট করতে নিয়েছিলে?”
একটু থামলো চিত্রা। অতিরিক্ত রাগে তার শরীর কাঁপছে।
বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে চাচার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো।
ঝাঁঝালো গলায় বললো,

“আজ যদি বৃদ্ধ লোকটার সঙ্গে আমার ঊষার বিয়ে হতো, তাহলে নিশ্চিত এই বাড়িতে কয়েকটা লাশ পড়ে যেত।
ওই মেয়েটাকে আমি আর দাদুভাই বড় করেছি, তোমরা নয়!”
চিত্রার কথা শেষ হওয়ার আগেই সুলেমান উদ্দিন মেয়ের গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিলেন।
দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“অনেকক্ষণ ধরে তোর বেয়াদবি সহ্য করছি।
তুই কাল জন্মে আজ আমায় জ্ঞান দিচ্ছিস?
এখন আমার কাজের কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে?
যা করেছি, বেশ করেছি!
জানিস, কত টাকা পেতাম!
ওই টাকাগুলো দিয়ে কি আমার কিছু হতো!
যা করতাম, তোর জন্যই করতাম!
আর তুই আমায় কথা শোনাচ্ছিস?”
আরো রাগ হলো চিত্রার।

দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগটা গিলে নিলো।
তার শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু টকবক করে ফুটছে।
চিত্রার দাদা সাদেক মিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
কাঁপা কাঁপা হাতে নাতনির মাথায় হাত রেখে বললেন,
“শান্ত হয়ে যা বোন, যা হওয়ার হয়ে গেছে—ঘরে গিয়ে রেস্ট নে।”
চিত্রা করুণ চোখে তাকালো দাদার দিকে।

সাদেক মিয়া অসুস্থ মানুষ, তাই নাতনিকে বুঝিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
চিত্রা আকাশের পানে চেয়ে ঊষার কথা ভাবতেই, কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে সচকিত হলো।
সামনের ব্যক্তিদের দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকালো।
এদেরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আশেপাশে চাইলো চিত্রা।
কিছুটা দূরে উঠোনের এক কোণায় গুটিসুটি হয়ে, ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে কুহু।
চিত্রা ধীরে পায়ে এগিয়ে গেলো কুহুর দিকে।

কোণা থেকে টেনে বের করে বোনের দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকালো।
কিছুক্ষণ আগে কুহুই লুকিয়ে চিত্রাকে জানিয়েছে সব।
চিত্রা কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললো,
“থ্যাঙ্ক ইউ বোনু।”
বোনের রাগ কমেছে দেখে একটু স্বাভাবিক হলো কুহু।
চিত্রা এবার দম নিয়ে বললো,

“এবার বলতো বোন, ঊষার কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে? কোনো ফোন নাম্বার বা ঠিকানা দিয়ে গেছে?”
ঊষার স্বামীর কথা শুনতেই কুহুর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
চোখে মুখে খুশি ঝলকে উঠলো।
সে চিত্রার কোমর জড়িয়ে ধরে প্রফুল্ল কণ্ঠে বললো,
“আপু! আপু! তুমি ভাবতেও পারবে না, ঊষা আপুর কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে!
আমার তো এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না!
ঊষা আপুর যে বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, এই চার গাঁয়ে কারো সাধ্য নেই—ওই বাড়িতে বউ হয়ে যাওয়ার!”
বোনের হেয়ালি পূর্ণ কথায় কপালে ভাঁজ পড়লো চিত্রার।
কপট বিস্ময়ে বললো,

“কি? কোথায়? কোন এমন রাজপ্রাসাদে বিয়ে হয়েছে, যে আর কেউ সেখানে বউ হতে পারবে না?”
এবার আরো প্রফুল্ল হলো কুহু।
আনন্দিত কণ্ঠে বললো,
“আপু, ঊষা আপু অনেক ভাগ্যবতী!
কি সুন্দর বর পেয়েছে জানো? এত সুন্দর বর কেউ পায়নি!”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো চিত্রা।
ক্লান্ত কণ্ঠে বললো,

“আর হেয়ালি না করে বল, কোথায় আর কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে ঊষার?”
কুহু আরো আনন্দিত কণ্ঠে বললো,
“ঊষা আপুর বিয়ে থিয়ার ভাইয়ার সঙ্গে হয়েছে।”
একটু নেতিয়ে পড়েছিল চিত্রা।
থিয়ার ভাইয়ার কথা শুনতেই চমকে উঠলো।
চকিতে তাকালো কুহুর দিকে।
আশ্চর্য কণ্ঠে বললো,
“শিকদার বাড়ি?”
কুহু উপর-নিচ মাথা ঝাকালো।
চিত্রা বিশ্বাসই করতে পারছে না!
শিকদার বাড়িতে থিয়ার ভাই তো অনেকগুলো!
সে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

“প্রিথম ভাইয়ের সঙ্গে?”
দুই পাশে মাথা নাড়ালো কুহু।
“রাজ ভাইয়ার সঙ্গে?”
আবারও দুই পাশে মাথা নাড়ালো কুহু।
এবার একটু আশ্চর্য হলো চিত্রা।
শিকদার বাড়িতে এখন নিয়ম অনুসারে পৃথম বা রাজের বিয়ে হওয়ার কথা।
সে বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে আর কে?

অরণ্য ভাইয়া বা সমুদ্র ভাইয়া?”
এবারও না সূচক মাথা নাড়ালো কুহু।
কুহু সবগুলোতে অসম্মতি জানানোয় বিরক্ত হলো চিত্রা।
“থিয়ার কোনো ভাই যদি বিয়ে না করে, তাহলে শিকদার বাড়ির বউ হবে কীভাবে?”
সে একটু বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“ফাজলামি করবি না কুহু, এখন ফাজলামোর মুড নেই।”
কুহুও অধৈর্য হলো।
অধৈর্য কণ্ঠে বললো,
“উফফ আপু! তুমি তো সবার নামই বললে, শুধু আমার কিউট দুলাভাইটা ছাড়া!”
“মানে?”
কুহু এবার উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,

“ঊষা আপুর বিয়ে থিয়ার ছোট দাদানের সাথে হয়েছে!”
ক্লান্তিতে একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল চিত্রা।
কুহুর বাক্য কর্ণগোচর হতেই কয়েক ন্যানোসেকেন্ডের মধ্যেই সকল ক্লান্তি উবে গেলো চিত্রার।
শরীরের সকল রক্ত চলকে উঠল মুহূর্তেই।
সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো কুহুর দিকে।
চিত্রার হৃদপিণ্ড ধকধক করতে লাগলো।
জীবনে বেঁচে থাকার অবলম্বন হারানোর ভয় জেকে বসলো মনে।
সে কাঁপা কণ্ঠে বললো,

“মামানে!”
চিত্রা মনে প্রাণে চাইলো, তার ভাবনা মিথ্যে হোক।
এই ভাবনা সত্যি হলে লাশ হয়ে যাবে চিত্রা।
কিন্তু চিত্রার মনের ভয়কে সত্য প্রমাণ দিয়ে কুহু বললো,
“আরে আপু, চিত্রার ছোট দাদনকে চিনো না?
কী যেন ছিল ভাইয়াটার নাম?
ওই যে লম্বা মতো, অনেক সুন্দর দেখতে, চশমা পরা ভাইয়াটা!”
পা টলে গেলো চিত্রার।
কুহু আবারো মনে করার ভঙ্গিতে বললো,

“হ্যাঁ, মনে পড়েছে—প্রেম ভাইয়া!”
‘প্রেম’ নাম কানে আসতেই চিৎকার দিয়ে উঠলো চিত্রা,
“না-আ-আ!”
হঠাৎ চিত্রার এমন চিৎকার শুনে ভড়কে গেল কুহু।
অবাক চোখে তাকালো চিত্রার দিকে।
কুহু কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিত্রা অদ্ভুতভাবে কাঁপতে শুরু করলো।
এবং চোখের পলক ফেলার আগেই জ্ঞান হারিয়ে নিথর হয় মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
ভয় পেয়ে গেলো কুহু।

দৌড়ে গিয়ে চিৎকার দিয়ে ডাকলো সবাইকে।
কুহুর কান্না শুনে একপ্রকার দৌড়ে বের হলেন সকলে।
সুলেমান উদ্দিন আতঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন কুহু?”
কুহু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“চিত্রা আপু হঠাৎ কেমন করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেলো!”
কুহুর কথায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো সুলেমান উদ্দিনের।
তিনি দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরে গেলেন।
মেয়ের এই অবস্থা দেখে জোহেরা বেগম আহাজারি করে কান্না শুরু করে দিলেন।
বিরক্ত হলেন সকলে।

সুলেমান উদ্দিন আতঙ্কিত হাতে মেয়ের চোখে মুখে পানি ছিটাতে লাগলেন।
কয়েক মিনিট পর চোখ পিটপিট করে খুললো চিত্রা।
একটু জ্ঞান আসতেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে
“প্রেম!”
বলে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো চিত্রা।
চিত্রার এমন কান্নায় হতবম্ভ হয়ে গেলেন সকলে।
সুলেমান উদ্দিন মেয়ের পাশে বসে আতঙ্কিত চোখে তাকালেন।
মাথায় হাত বুলিয়ে নরম কণ্ঠে বললেন,
“কাঁদছিস কেন মা? কে এই প্রেম?”
চিত্রা এলোমেলো চোখে তাকালো সুলেমান উদ্দিনের দিকে।
চোখের পলক ফেলার আগেই সুলেমান উদ্দিনকে শক্ত করে ধরে সশব্দে কেঁদে উঠলো চিত্রা।
আধো আধো কণ্ঠে বললো,

“আমার প্রেম অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে না, আব্বু!
আমি মরে যাবো প্রেমকে ছাড়া।
আমাকে আমার প্রেম এনে দাও, আব্বু।”
বলতে বলতে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে লাগলো চিত্রা।
চিত্রার কথা শুনে সকলে তাজ্জব বনে গেলো।
প্রেমের বিয়ে হয়ে গেছে শুনে চিত্রার এমন করছে দেখে আশ্চর্যের শীর্ষে পৌঁছলো কুহু।
সুলেমান উদ্দিন চিৎকার করে বললেন, “কে এই প্রেম? বল মা! এখনই এনে দেবো!”
কুহু কাঁপা কণ্ঠে বললো,

“প্রেম ভাইয়া… ঊষা আপুর বর…”
পুরো ঘর স্তব্ধ হয়ে গেলো।
সবাই চমকিত চোখে তাকিয়ে আছে চিত্রার দিকে।
চিত্রার করুণ কান্নার শব্দ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
সে কাঁদতে কাঁদতে নিচে পড়ে গেলো।
বারবার একটা কথাই বলছে, “আমি প্রেমকে ছাড়া বাঁচবো না! প্রেমকে এনে দাও!”
জোহেরা বেগম মেয়ের অবস্থা দেখে বুক ধরতে পারলেন না।
ছুটে গিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
চিত্রা আম্মুকে জড়িয়ে ধরে করুণ কণ্ঠে মিনতি করলো,
“আম্মু, প্লিজ! আমার প্রেমকে এনে দাও। বিশ্বাস করো, প্রেমকে ছাড়া আমি এক মুহূর্তও বাঁচবো না! আমি প্রেমকে অনেক ভালোবাসি মা!”

ভালোবাসার কথা শুনে সকলের পায়ের নিচে জমিন সরে গেলো।
জোহেরা বেগম আহাজারি করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“আজকে আপনার লোভের জন্য আমার মাইয়াডার এই অবস্থা। আজ যদি আপনি ওই মেয়েটাকে বিয়ে দিতে না চাইতেন, তাহলে আপনার বাপ ওই পোলারে ডেকে আনতো না, আর ওই মুখপুড়ির সাথে ওই পোলার বিয়ে ও হতো না। আর আজ আমার মাইয়া এত কষ্ট ও পেত না! সব আপনার দোষ!”
সুলেমান ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন।
চিত্রা কাঁদতে কাঁদতে মুখ দিয়ে লালা পড়ছে।
তার মুখে একটাই কথা— “প্রেম!”

চিত্রা চোখ মুছে পাগলের মতো ফোন হাঁতরালো।
মনে পড়লো, ওর ফোন পড়ে আছে বারান্দার কোণায়।
সবাইকে উপেক্ষা করে এলোমেলো পায়ে ছুটলো বারান্দার দিকে।
চোখ মুছতে মুছতে অন্ধকার হাতড়ে ফোন বের করলো।
কাঁপা হাতে, ঝাপসা চোখে ফোন দিলো প্রেমের নাম্বারে।
বালিশের পাশে সাইলেন্ট মোডে ফোন বেজে উঠলো প্রেমের।
প্রেম তখন ঊষাকে বুকে নিয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, তাই ফোন আর দেখলো না।
সে কাঁপা হাতে আরও কয়েকবার ফোন করলো।
কিন্তু রিসিভ হলো না।

নিঃশ্বাস আটকে এলো চিত্রার।
কাঁপতে কাঁপতে ফোন লাগালো প্রিয়তার নাম্বারে।
শব্দ করে বেজে উঠলো প্রিয়তার ফোন।
প্রিয়তা ও ইনায়া তখন গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন।
এমন জোরালো শব্দ কানে আসতেই ঘুমের মধ্যেই ভুরু কুঁচকে ফেললো প্রিয়তা।
কুশন দিয়ে কান চেপে ধরলো।
প্রথমবার ফোন রিসিভ না হওয়ায় আবার ফোন লাগালো চিত্রা।
এবার ঘুম ঘুরেই ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো প্রিয়তা।
কিন্তু চিত্রার করুণ আর্তনাদ কানে আসতেই সেকেন্ডের মধ্যেই ঘুম ছুটে গেলো প্রিয়তার।
ইনায়া ও জেগে গেল।

চিত্রা কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা কণ্ঠে অনুরোধ করলো,
“প্রিয়, প্লিজ! আমি তোমার পায়ে পড়ি বোন, প্লিজ! একটু ফোনটা প্রেমের কাছে নিয়ে যাও। আমি একটু কথা বলবো তার সাথে।”
চমকে উঠলো প্রিয়তা।
ঘুম পালিয়ে গেলো।
সে নিজেকে ধাতস্থ করে ঘড়ির দিকে দেখলো— রাত ২টা বেজে ২৫ মিনিট।
প্রিয়তা কিছু বলছে না দেখে অধৈর্য হলো চিত্রা।
এবার চিৎকার দিয়ে কেঁদে বললো,
“প্লিজ প্রিয়তা! আমার প্রেমের কাছে একটু নিয়ে যাও!”
চিত্রার কান্নায় প্রিয়তার ও বুকে ব্যথা হল।
এই ব্যথা সম্পর্কে তার চেয়ে ভালো কে জানে?
প্রিয়তা ধীর কণ্ঠে বললো,

“শান্ত হও আপু। আমার কথা শোনো, কালকে কথা বলবা ছোড়দার সাথে।”
চিত্রা অধৈর্য হয়ে একটু রেগেই বললো,
“প্লিজ! আমার কথা শুনো প্রিয়তা! একটু বুঝো প্লিজ! আমার প্রেমের কাছে ফোনটা দাও।”
ধর্মসংকটে পড়লো প্রিয়তা।
এত রাতে ভাই-ভাবিকে ডেকে কী বলবে সে?
তার ভাবনার মাঝেই চিত্রা বললো,
“তুমি যদি প্রেমকে ফোন না দাও, তাহলে আমি কিন্তু এখন কিছু একটা করে ফেলবো।”
ভয় পেয়ে গেলো প্রিয়তা।
কাঁপা কণ্ঠে বললো,

“প্লিজ আপু, তুমি কিছু কোরো না। একটু বোঝার চেষ্টা করো— ভাইয়া এখন বাসর ঘরে! কী করে ডাকবো?”
থেমে গেলো চিত্রা।
তার “প্রেম বাসর ঘরে” কথাটা কানে আসতেই একেবারে শান্ত হয়ে গেলো।
সকল পাগলামি, সকল উন্মাদনা থেমে গেল চোখের পলকে।
হাত থেকে ফোনটা ও পড়ে গেলো।
প্রিয়তা “হ্যালো! হ্যালো!” করতে করতে আতঙ্কিত চোখে চাইল ফোনের দিকে।
ইনায়া হাই তুলে বলল, “কি হয়েছে প্রিয়?”
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝে এলো প্রিয়তার— কতো বড় ভুল করে ফেলেছে সে।
ভয়ে প্রিয়তার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো।
দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পরির ঘরের দিকে ছুটলো।
কিছুই বুঝলো না ইনায়া।

চিত্রাকে শান্ত হয়ে যেতে দেখে সবাই আরও অবাক হলো।
আরও বেশি ভয় পেয়ে গেলো।
এবার আর কথা বের হচ্ছে না— শুধু চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় নুনা পানির বর্ষণ হচ্ছে।
জোহেরা বেগম ও জয়তুন বেগম চিত্রার পাশে গিয়ে বসলেন।
জোহেরা বেগম মেয়ের গালে হাত দিয়ে ডাকলেন,
“চিত্রা মা, গো! দেখ আম্মুর দিকে।”
কিন্তু কথা বললো না চিত্রা।
দেখতেই আবারো জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
সুলেমান উদ্দিন ধপ করে উঠোনে বসে পড়লেন।
“আজ তার পাপের শাস্তি আল্লাহ তাকে হাতে হাতে দিয়ে দিয়েছেন।
অন্যের মেয়ের সর্বনাশ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তার হাত দিয়েই তার নিজের মেয়েরই সর্বনাশ করে দিয়েছেন!”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩৯

মেয়ের অবস্থা দেখে বুঝেছেন, ওই ছেলেকে ছাড়া তিনি নিজের মেয়েকে টিকিয়ে রাখতে পারবেন না।
আর ওই ছেলে তাঁর সামর্থ্যের মধ্যে নেই।
সে তো আর যার তার ছেলে নয় যে ধরে বেঁধে এনে মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবেন।
সে সাদমান শিকদারের ছেলে!
অন্যের মেয়ের অনিষ্ট করতে গিয়ে তিনি নিজের মেয়ের ওনিষ্ঠ করে ফেলেছেন।
এখন মনে শুধু একটাই প্রশ্ন—
“উনার মেয়েটা বাঁচবে তো?”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪১