চেকমেট পর্ব ৪২

চেকমেট পর্ব ৪২
সারিকা হোসাইন

“আমার মাকে আমি খোঁজে পেয়েছি স্যার।
সারফরাজ এর উৎসুক আনন্দ ভরা কন্ঠে প্লেট থেকে নজর তুলে সারফরাজ এর খুশি মাখা মুখের পানে দৃষ্টি দিলেন সুফিয়ান।ছেলেটির চোখে মুখের এমন দীপ্ত জ্যোতি আগে আর কখনো দেখেন নি তিনি।মা কে খোঁজে পাবার বাসনায় ছেলেটির চোখ মুখে অসহায় যন্ত্রনার ছটফটানি দেখেছেন বহুবার।ছেলেটির চোখের আকুতি আর ছোট আবদার “আমাকে মাকে খোঁজে দিবেন কমিশনার সাহেব? আজো তাড়া করে বেড়ায় তাকে।এমন কোন স্থান নেই যেখানে প্রাক্তন আর্মি অফিসারের সহধর্মিণী কে তিনি খোঁজেন নি।

চিটাগাং এর অলি গলি,হসপিটাল ,আশ্রম থেকে শুরু করে ঢাকা এরপর সারা বাংলাদেশ।কোথাও মিলেনি মায়া চৌধুরী।নিজের ব্যর্থতা আর অনুতপ্তে দিন রাত দগ্ধ হয়েছেন তিনি।সারফরাজ তার খালি বুক,ভেঙে যাওয়া অগোছালো সংসার আর অসুস্থ স্ত্রীকে পরিপূর্ণ করেছিলো।বিনিময়ে কিছুই দিতে পারেন নি তিনি।এবার তিনি মনে মনে স্থির করলেন সারফরাজ কে খালি হাতে ফেরাবেন না তিনি।সারফরাজ যা চাইবে তার কাছে দুঃসাধ্য হলেও দিবেন তিনি।
হাতের লোকমা ফেলে সুফিয়ান আঙ্গুল গুটিয়ে শুধালেন
“কোথায় আছে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এটো প্লেট হাত দিয়ে সরিয়ে টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে সারফরাজ উত্তর করলো
“এক দুস্টু দানবের কাছে বন্দি ছিলো দীর্ঘ যুগ।এখনো আছে।তবে আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না আমার মাকে।খুব তাড়াতাড়িই তার বন্দি জীবদ্দশার মুক্তি মিলতে চলেছে।সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওই দানব বধ করবো আমি।
“মাকে কবে আনতে যাবি?
“খুব শীঘ্রই।আর তর সইছে না।বাইশটা বছর দেখিনি।মা কি আমাকে চিনবে স্যার?ঠিক চিনবে তাই না?আমার চোখ জোড়া তার খুব পছন্দের ছিলো।এই চোখ কি করে ভুলতে পারে সে?
সারফরাজ এর চোখ জলে টইটুম্বুর হলো কথা গুলো বলতে বলতে।মায়ের জন্য কতো ধুকেছে সে এই কথা নির্ঘুম রাত আর রাত জাগা নিশাচর পশুপাখি ছাড়া কেউ জানে না।আহ কি নিদারুণ কষ্টে কেটেছে প্রতিটি মুহূর্ত।!
সারফরাজ এর পানে তাকিয়ে শক্ত করে তার বাহু জড়িয়ে ধরলো রূপকথা।সারফরাজ কাঁদছে।নীরবে জল গড়াচ্ছে তার চোখ দিয়ে।ভেতরের কষ্ট গুলো ঠিক ভাবে উজাড় করতে পারছে না সে।
সারফরাজ চোখের জল দ্রুত মুছে পুনরায় বলে উঠলো

“আমাকে ক্যালিফোর্নিয়া যেতে হবে ।মা ওখানেই আছে।যতটুকু খোঁজ নিয়ে জেনেছি উনার মেন্টাল কন্ডিশন ঠিক নেই।উনি মানসিক শারীরিক দুই ভাবেই অসুস্থ।আমি মাকে ফিরিয়ে আনলে একা ট্যাকেল দিতে পারবো না।আমার একটা বউ দরকার কমিশনার সাহেব।আপনার মেয়েকে আমি আমার রাজ্যের রানী করে নিয়ে যেতে চাই। দিবেন?একটুও কষ্ট পেতে দেবো না আপনার মেয়েকে।নিজের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও তাকে আগলে রাখবো আমি।
সুফিয়ান তপ্ত শ্বাস ফেললেন।প্রত্যুত্তর এর ভাষা কিভাবে গুছিয়ে বলবেন ভেবে পেলেন না।নিশ্চুপ সুফিয়ান কে দেখে সারফরাজ ঠান্ডা গলায় বললো

“না দিলেও নিয়ে যাবো।আপনি কিছুতেই আর না করতে পারবেন না।করলে আমি ভুলে যাবো আপনি আমার হবু শশুর।শেষ বারের জন্য আমার আমানত আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি আমি।ফিরে এসে আমার বউ আমি নিয়ে যাবো।আপনার মেয়ে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।এরম আধমরা জীবন ঠেলে ঠুলে কতোদিন বলুন?আমারও তো ইচ্ছে করে প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে হেসে খেলে বাঁচতে!কিন্তু জীবন আমার প্রতি খুব কঠোর।নয়তো আমাকে এতো যাবজ্জীবন দুঃখ কষ্টে কেনো ফেলেছে বিধাতা?আমি কি জন্ম থেকেই পাপী কমিশনার সাহেব?আমার জীবনের সুখ ,আনন্দ ,ভালোবাসা কোথায়?এগুলো আমার পাপী হাতে ধরা দেয় না কেনো?নাকি এগুলো ভোগ করার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন উপরওয়ালা ?

বেদনায় নীল হয়ে আসা সারফরাজ এর করুন মুখের পানে তাকিয়ে ব্যথিত গলায় কমিশনার উত্তর করলেন
“জন্ম থেকে কেউ পাপী হয়না সারফরাজ।তুই ও হেসে খেলে বাঁচবি সবুর কর।আগে মাকে ফিরিয়ে আন।
বলেই উঠে গেলেন সুফিয়ান।রূপকথাকে সারফরাজ নিয়ে যাবে এটা ভাবতেই তার বুক ভেঙে যাচ্ছে।হৃদ গতি বন্ধ হতে চাচ্ছে।চারপাশ কেমন বিষন্ন একা খালি খালি ঠেকছে।মেয়েটাকে ছাড়া দুজন বুড়োবুড়ি কিভাবে থাকবেন তারা?
সারফরাজ এর চোখের জল তর্জনী আঙ্গুলি দিয়ে মুছিয়ে দিলো রূপকথা।সারফরাজ মাথা নত করে ধীর গলায় বললো

“তোমাকে ফেলে ক্যালিফোর্নিয়া যেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না।যাবে আমার সঙ্গে?
রূপকথা মাথা ঝাঁকালো সে যাবে।সারফরাজ অল্প হাসলো।এরপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে বললো
“ঠিক আছে তোমার বাবার সাথে কথা বলবো আমি।উনি অনুমতি দিলে নিয়ে যাবো সঙ্গে করে।আসছি।
আর দাঁড়ালো না সারফরাজ।বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে।সারফরাজ চলে যেতেই পিছন পিছন দৌড়ালো রূপকথা।সারফরাজ যখন গাড়ির দরজা খুলতে ব্যস্ত সেই মুহূর্তে সারফরাজ কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো রূপকথা।রূপকথার স্পর্শে চোখ বন্ধ করে ফেললো সারফরাজ।এরপর রূপকথার হাত চেপে বলে উঠলো

“এভাবে আটকে দিলে আমার নিজেকে মানাতে কষ্ট হয় রূপকথা।তোমার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য আমি কতটা মরিয়া তুমি নিজেও জানো না।বহু কষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছি আমি।প্লিজ আমাকে কন্ট্রোললেস হতে বাধ্য করো না।
রূপকথা শুনলো না।সে আরো শক্ত আলিঙ্গনে সারফরাজ কে জড়িয়ে সারফরাজ এর পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বলে উঠলো
“তোমাকে ছাড়া দম বন্ধ লাগে আমার।আমার পুরো পৃথিবী উলট পালট লাগে।প্লিজ যেও না।
সারফরাজ পেছন ফিরলো।রূপকথা আদুরে মুখটা নিজের হাতের আজলায় ভরে বলে উঠলো
“ইচ্ছে করছে সারা রাত গল্প করতে।কিন্তু আমার নিজের কিছু ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে।আজ রাতেই করতে হবে এগুলো।ফিরে এসে সারা রাত গল্প করবো কেমন?

রূপকথা মানলো না।সে জেদি বাচ্চার মতো নিজের ইচ্ছেয় বহাল রইলো।সারফরাজ এবার বিপাকে পরলো।রূপকথাকে ফলো করা ছেলেটিকে আজ পরপারে পাঠানোর সকল ফাঁদ সাজিয়ে এসেছে সে।তাছাড়া ক্যালিফোর্নিয়া যাবার আগে নিজের ব্যাক্তিগত কিছু কাজ আছে।এই দশ দিনের প্রত্যেকটা সেকেন্ড তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ।নিরুপায় সারফরাজ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে পুনরায় বলে উঠলো
“কখনো তোমায় এভাবে ফিরিয়েছি বলো?
“এই যে ফেরাচ্ছ।

বলেই সারফরাজ কে শক্ত করে জড়িয়ে বুকে মুখ লুকিয়ে রইলো রূপকথা।সারফরাজ বেশ বুঝলো এই মেয়ে নিজের কথা থেকে এক চুল নড়বে না।বাধ্য হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো।এরপর অভিকে কল করলো।রিং হতেই অভিরূপ ফোন তুললো
“হ্যা বল।

“আমার বাড়ির পেছনের গুদাম ঘরে এক সালাকে বন্দি করে এসেছি।সারা রাত ভর পিটিয়ে রুদ্র সম্পর্কে তথ্য নিবি ওর থেকে।যদি একটাও মিস করে গেছিস তবে তোকে তিনদিন বন্দি করে রাখবো ওই ঘরে।
সারফরাজ এর নির্দেশে গলা শুকিয়ে এলো অভিরূপ এর।মানুষের গায়ে হাত দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব ব্যপার।একটা মানুষ তার দেয়া আঘাতে চিৎকার করবে কাঁদবে এটা সে কিছুতেই সইতে পারবে না।পরে দেখা যাবে সে নিজেই অজ্ঞান হয়ে গেছে।এদিকে অভিরূপ কে চুপ থাকতে দেখে সারফরাজ ধমকে উঠলো

“কি হলো শুনতে পাস নি?
অভি মিনমিন করে বললো
“ভাই কাল আমি নেলির বাড়িতে যাবো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।আমাকে মাফ কর।এসব দৃশ্য আমি সইতে পারবো না।আমাকে হসপিটালে ভর্তি করতে হবে।নেলি বলেছে কাল যদি না যাই তাহলে ও অন্য কাউকে বিয়ে করে নেবে।
অভিরূপ ভীতু ছেলে সারফারাজ জানে।ছেলেটা কোনো কাজের না।কিন্তু অকাজের ও নয় ।সারফরাজ এর জীবনে তার ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না।সারফরাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ফোন কেটে রূপকথাকে বলে উঠলো
“আমাকে ছাড়বে না রূপকথা?
“না”
পটাপট উত্তর দিলো রূপকথা।সারফরাজ বাঁকা হেসে বললো
“ঠিক আছে।গাড়িতে এসো।
বলেই ব্যাক সিটের দরজা খোলে দিলো সারফরাজ।রূপকথা খুশি মনে ভেতরে ঢুকতেই শার্টের বোতাম খোলতে খোলতে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো সারফরাজ।সারফরাজ কে শার্ট খুলতে দেখে রূপকথা বোকা চোখে শুধালো

“এসব কি করছো?শার্ট খুলছো কেনো?আজকের আবহাওয়া তো যথেষ্ট ঠান্ডা।
সারফরাজ বাঁকা হেসে উত্তর করলো
“ভাবছি যেতেই যখন দিবে না তখন সময় টা কাজে লাগাই।গল্প করে কি আর রাত পার করা যাবে নাকি?তার চেয়ে একটু আদর যত্ন করলে মন্দ হয়না।তুমিও খুশি আমিও খুশি।কি বলো?
বলেই গায়ের শার্ট ছুড়ে মারলো সারফরাজ।সারফরাজ এর লোম হীন প্রশস্ত বক্ষ,কাঁটা কাঁটা পেটের মাসল যুক্ত খাঁজ,ফুলে ওঠা নীলচে শিরায় বিস্ফারিত নজর বুলালো রূপকথা।এরপর ফাঁকা ঢোক গিলে দুই হাতে চোখ বন্ধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে উঠলো

“ছি ছি ,এসব দেখতে চাইছি নাকি?তোমার অকাজের তুতু দেখা যাচ্ছে।বন্ধ করো।আমার শরম করছে।
বলেই আবার ঘাড় ঘুরিয়ে আঙুলের ফাক দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিলো রূপকথা।সারফরাজ ঠোঁটে দুস্টু হাসি ঝুলিয়ে প্যান্টের বকলেসে রূপকথার হাত টেনে ছুঁইয়ে হাস্কি স্বরে বলে উঠলো
“চলো প্র্যাকটিক্যালি ফিজিওলজির ক্লাস হোক।তাছাড়া আমার গুলো অকাজের হলেও তোমার …..
থেমে গিয়ে ভ্রু নাচালো সারফরাজ।এবার ভয় পেয়ে গেলো রূপকথা।সারফরাজ এর সিরিয়াস চোখ মুখে কোনো দুস্টুমির ছাপ নেই।ঠোঁট শক্ত,চোয়াল স্থির।চোখের ভাষা এলোমেলো।রূপকথা তড়িৎ নিজের হাত সরিয়ে চেপে বসলো একটু।এরপর আমতা আমতা করে বললো

“আচ্ছা যাও কাজে যাও।কাল আমার ক্লাস আছে।ঘুমুতে হবে।ক্লান্ত লাগছে।এতোক্ষন তোমাকে আটকে রাখার জন্য সরি
বলেই সারফরাজ এর শার্ট টেনে এনে কাঁপা কাঁপা হাতে সারফরাজ এর কাঁধের উপর তুলে দিলো।কিন্তু সারফরাজ তাতে একটুও ভরকালো না।সে রূপকথার উপর ঝুকে ঠোঁটের অনেকটা কাছে নিজের ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বললো
“এসব বললে মানবো কেনো?চলো না জান সারা রাত ভালোবাসা বাসির খেলা খেলি।দুদিন পর তো এমনিতেও আমার হয়ে যাবে।দুদিন পর যা আজো তো তাই নাকি?তাছাড়া এতো ভয় কেনো পাচ্ছ?আমি বাঘ ভাল্লুক?একটুও ব্যথা দেবো না।প্রমিস।
রূপকথা সেটে গিয়ে জড়সড় হয়ে বসে কম্পিত গলায় বলে উঠলো
“ভালো হচ্ছে না কিন্তু সারফরাজ।এবার কিন্তু ভয় পাচ্ছি আমি।তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো।আমি চিৎকার করে বাবা কে ডাকবো বলে দিলাম।
সারফরাজ রূপকথার হম্ভীতম্ভী তোয়াক্কা না করে গলার স্বর নামিয়ে নেশালো চোখে রূপকথার কাঁধ চেপে ধরে বলে উঠলো

“তোমার গায়ের এই জামাটা বেশ বিরক্ত করছে আমায়।চূড়ান্ত ঈর্ষা জমেছে এই জামার প্রতি আমার।তোমার গায়ে জড়িয়ে থাকার কোনো অধিকার এই জড় বস্তুর নেই।তোমার সারা গতরে আজ বিচরণ হবে আমার।
রূপকথা আর এক দন্ড বসলো না।ভীত চোখে কম্পিত হাতে দরজা খোলে একপ্রকার লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।এরপর ঝট করে দরজা লাগিয়ে দৌড় দিলো বাড়ির ভেতর।পেছনে সারফরাজ কে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখলো না।রূপকথার যাবার পানে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো সারফরাজ।এরপর গায়ের শার্ট পরে বোতাম লাগিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করতে করতে বলে উঠলো
“আচ্ছা জব্দ করা গেছে গাধিটাকে।

নেলির মুখোমুখি বসে আছে অভিরূপ।পাশে তার মা আর ছোট বোন।শিউলি আর আমজাদ হায়দার বসে আছে নেলির পাশে।প্রথম দেখাতেই অভিরূপ কে পছন্দ হয়ে গিয়েছে তাদের।এখন নিজেদের চাহিদা মাফিক মিললেই আমজাদ হায়দার হ্যা না কিছু একটা জানিয়ে দিবেন।নেলির চোখ মুখে চূড়ান্ত ভীতির ছাপ।সে রূপকথাকে বেশ অনুরোধ করেছিলো আসার জন্য।তাকে সাহস দেবার জন্য।কিন্তু হিংসুটে মেয়েটা আসেনি।
অভি চোরা চোখে একবার নেলিকে দেখলো।ল্যাভেন্ডার রঙের একটা জামদানি পরেছে নেলি।ফর্সা শরীরে শাড়িটা যেনো জ্বলে উঠেছে।চোখে কালো কাজল,গলায় সোনার ছোট নেকলেস,কানে ঝুমকা।হালকা প্রসাধনী দিয়ে সাজানো নির্মল মুখশ্রী।যেনো বেহেশতের হুর।দুনিয়ার সমস্ত সৌন্দর্য আজ নেলির কাছে ফিকে।এই সৌন্দর্যে অভিরূপ এর মরন নির্ঘাত।

সমস্ত নীরবতা ভেঙে আমজাদ হায়দার গলা খাকরি দিলেন।এরপর রয়ে সয়ে শুধালেন
“বর্তমানে কি করছো তুমি?
অভি ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে ধরে উত্তর করলো
“আমি ক্যালিফোর্নিয়া তে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একটি কোম্পানি তে আছি।তাছাড়া আমার ছোট একটা বিজনেস আছে।অবসরে ওটাই দেখাশোনা করি।
অভির চোখ মুখের এক্সপ্রেশন আর সাবলীল স্বরে আমজাদ হায়দার মুগ্ধ হলেন।তিনি আর বাড়তি আলতু ফালতু প্রশ্ন করলেন না।অভিরূপ এর মাকেও বেশ পছন্দ হয়েছে তার।মহিলা যথেষ্ট মার্জিত আর রুচিশীল।মানুষের চালচলন ই বলে দেয় তাদের ঘরের কালচার ঠিক কি।
আমজাদ হায়দার এবার বললেন

“আমার মেয়ের থেকে তোমাদের বিষয়ে সব শুনেছি আমি।তোমার বাবার অকাল মৃত্যুতে আমি গভীর ভাবে শোকাহত।আমার মেয়েকে আমি কখনো কোনো কিছুতে বাধা দেই নি।ওকে আমি সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিয়েছি।আজ পর্যন্ত আমার মেয়ে আমাকে কখনো কষ্ট দেয়নি।কারো কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি।আমার মেয়ের পছন্দ মানেই আমার পছন্দ।তোমরা দুজন দুজনকে পছন্দ করেছো ভালোবেসেছো বেশ ভালো কথা।কিন্তু বাবা আমার একটা অনুরোধ আছে।
বলে থামলেন আমজাদ হায়দার।অনুরোধ এর কথা শুনে নেলি অভি দুজনেই ঘাবড়ে গেলো।শিউলি মেয়ের হাত ধরে আশ্বস্ত করলেন।আমজাদ হায়দার অল্প পানি গলায় চালান করে বলে উঠলেন

“মেয়েকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন আমার।এই মুহূর্তে বিয়ে হলে সংসারে মনোযোগী হয়ে যাবে সে।পড়াশোনাটা ঐভাবে করবে না।তাই তুমি যদি নেলিকে কয়েকটা বছর সময় দাও।মানে এমবিবিএস পাশ পর্যন্ত তাহলে আমার স্বপ্নটা পূরণ হতো আর কি।
অভির মা মৃদু হেসে বলে উঠলেন
‘আমাদের কোনো আপত্তি নেই ভাইজান।আপনার কথাকে আমরা সম্মান করি।মেয়ে পড়ুক।অভিও আরেকটু সফল হোক।পরেই না হয় পাকা কথা হবে।
আমজাদ হায়দার খুশি হলেন।তিনি গদগদ করে বলে উঠলেন
“জামাই হিসেবে কিন্তু অভি দশে দশ।আমার খুব পছন্দ।তাহলে ঐ কথাই রইলো।নেলির এমবিবিএস শেষ হলেই ধুমধাম করে মেয়ে তুলে দেবো।
আমজাদ হায়দার এর কথায় অভি সায় জানালো।অভির অনুমতি তে খুশি হয়ে আমজাদ হায়দার বলে উঠলেন
“চলো জামাই তোমাকে ছাদ বাগান ঘুরে দেখাই।

সুফিয়ান চৌধুরীর পা চেপে ধরে মেঝতে গড়াগড়ি খাচ্ছে রূপকথা।তার এক কথা সে সারফরাজ এর সাথে যাবে।এতো বড় মেয়ের এমন কাণ্ডে থ হয়ে শক্ত হয়ে বসে রইলেন সুফিয়ান।মেয়েকে বোঝানোর নানান চেষ্টা করলেন তিনি।কিন্তু অবুঝের মতো সবকিছু মানতে নারাজ এই মেয়ে।শেষমেশ বিরক্ত হয়ে শুধালেন
“তোমার কাছে কি মনে হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়া ঢাকার ওই পাশে?বাসে চড়লে আর আধ ঘন্টা পর নেমে গেলে?
“আমি এতো কিছু জানিনা।আমি যাবো ব্যস।
“জেদ করো না রূপকথা।সব কিছুরই একটা সময় থাকে।হুট করে চাইলেই যা কিছু করা যায় না।সপ্তাহ খানেক আগেও যদি সারফরাজ বলতো তাও আমি ভেবে দেখতাম। তাছাড়া ভিসা প্রসেসর ও একটা বিষয় আছে।
“তুমি শুধু টিকিট কেটে দাও।সিট না পেলে টুলে বসে চলে যাবো আমি।কোনো সমস্যা নেই আমার।
কপাল চাপড়ালেন সুফিয়ান।সত্যিই মেয়েটা নির্বোধ হয়েছে।তার চেয়েও বেশি রাগে ফায়ার হলেন সারফরাজ এর প্রতি।কি এমন ভালোবাসা ওই ছেলে এই মেয়েকে দিয়েছে যা সে এই বারো বছরেও দিতে পারে নি?

এয়ারপোর্ট এ বসে আছে সারফরাজ।পাশে ইয়ং,লুইস।কিছুক্ষন পরেই ফ্লাইট।সারফরাজ চেকিং এর জন্য উঠে দাঁড়ালো।একে একে লাইন পেরিয়ে চেক -ইন,ইমিগ্রেশন আর বোর্ডিং পাস কালেক্ট করে টার্মিনালে প্রবেশের জন্য পা বাড়ালো।রূপকথার জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে।মেয়েটা সকালে খুব কেঁদেছে।গত রাতেও সারা রাত কেঁদেছে।সারফরাজ যেনো খুব দ্রুত ফিরে আসে এটা নিয়েও করুন আবদার করেছে।নয়তো তার দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যাবে।সারফরাজ সুফিয়ান এর কাছে অনুরোধ করেছিলো যাতে রূপকথাকে তার সঙ্গে যেতে দেয়।সুফিয়ান শুধু বলেছিলেন

“ভিসা প্রসেসিং করার জন্যও একটা সময় দরকার।তুই আমাকে আগে বললে আমি ঠিক ভেবে দেখতাম ।
সুফিয়ান এর কথা যৌক্তিক।দোষ সারফরাজ এর।তার মাথায় কেনো এই বুদ্ধি আগে এলো না?
সারফরাজ এর খুব কষ্ট হয়েছে রূপকথাকে ফেলে আসতে।না জানি মেয়েটা কি করছে।ব্যথায় জর্জরিত শ্বাস ছুড়ে শক্ত চোখে মুখে সামনে পা বাড়ালো সারফরাজ।এমন সময় কেউ ডেকে উঠলো
“দাঁড়া সারফরাজ।
পেছন ফিরতেই কমিশনার আর রূপকথাকে দেখা গেলো।সারফরাজ কপাল কুঁচকে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অবস্থা বোঝার জন্য।নিজের কার্ড শো করে রূপকথার ভিসা পাসপোর্ট দেখিয়ে সারফরাজ এর সামনে এসে দাড়ালেন সুফিয়ান চৌধুরী।এরপর বললেন

“আমার নিজের চাইতেও তোকে বেশি বিশ্বাস করি আমি।নিয়ে যা ওকে।সামলে রাখিস।আর তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস।মেয়েটাকে ছাড়া কখনো আলাদা থাকিনি।
সুফিয়ান এর বেদনার্ত মুখের পানে সারফরাজ শুধালো
“জামাই হিসেবে মানলেন তবে?
“না মেনে উপায় কই?চাবি তো তোর হাতে।
সারফরাজ ফিক করে হাসলো।এরপর চোখ টিপে কানে কানে বললো
“আপনার মেয়ে আমার মধ্যে কি পেয়েছে বলুন তো?ছাড়তেই চায়না।
“আমি কি জানি?

চেকমেট পর্ব ৪১

রূপকথার হাত চেপে ধরে সারফরাজ লম্বা শ্বাস টানলো।এরপর বললো
“আসছি।খুব শীঘ্রই আপনি নানা হবেন
বলেই দুস্টু হেসে সামনে পা বাড়ালো।
সুফিয়ান ধমকে বলে উঠলেন
“এসব যদি ভুলেও করেছিস তবে তোকে খুন করবো আমি হতচ্ছাড়া।

চেকমেট পর্ব ৪৩