ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৩
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
প্রণয় ও শুদ্ধ মদের নেশা পুরোপুরি আউট, তাদের অবস্থা বর্তমানে আর দেখার অবস্থায় নেই, তাদের সেন্স নেই বললেই চলে। দুজনেই বার কাউন্টারে মাথা এলিয়ে বিরবির করে কিছু বলছে। তাদের পাশের টুলে গালে হাত দিয়ে বসে আছে জাভেদ, বেচারা বারটেন্ডার বলদের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। জাভেদের চেহারার করুন দশা দেখে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডের বেশ মায়া লাগলো, সে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো জাভেদের সামনে। নতোমস্তকে কিছুটা ইতস্তত কণ্ঠে বললো—
“স্যার, উনাদের হুঁশ ফেরানোর ব্যবস্থা করুন। নাহলে পরে বস বলবেন আপনি উনার সময় নষ্ট করিয়েছেন, পরে সব দোষ আপনারই হবে স্যার, দেখা গেলো এই অপরাধে বস আপনাকে গাছের সাথে উল্টো ঝুলিয়ে দিলো,আগে একবার কিন্তু দিয়েছিল।”
গার্ডের কথায় কপাল থেকে হাত সরিয়ে, ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকালো জাভেদ। গার্ডের বলা দৃশ্যটা মনে পড়তেই ভয়ে জাভেদের মুখ দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে গেল। সে বুকে থু থু দিয়ে গার্ডটাকে ধমকে বললো—
“তোর চাকরি খেয়ে দেবো জানিস! তুই আমাকে ভয় দেখাস?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জাভেদের হুমকিতে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে গেলো গার্ডটা। জাভেদ নিজের বা হাতের কব্জি উঠিয়ে ঘড়িতে দেখলো ১ বাজতে আর মাত্র ৭ মিনিট বাকি। আর ২.৫-৩ ঘণ্টার মধ্যে সেহরি। তার আগে যেভাবেই হোক, স্যারকে ঠিক করতেই হবে, কারণ তার গাফিলতির কারণে যদি প্রণয়ের কালকের রোজা মিস হয়ে যায়, তাহলেই আর দেখতে হবে না—তার হিটলার বস নিশ্চিত তাকে গরম তেলে ভেজে, চায়ে চুবিয়ে খেয়ে নেবে। এসব চিন্তা করেই ধড়ফড়িয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো জাভেদ। ভয়-ভীতি সব ছুড়ে ফেলে ছুটলো উপরে।
১০ মিনিটের মধ্যে গ্লুকোজ, ওআরএস, লবণ-চিনি-লেবু পানি ভর্তি বড় বড় ৪টা গ্লাস ভর্তি ট্রে নিয়ে ছুটে এলো জাভেদ। ট্রেগুলো কাউন্টারের ওপর রেখে, দুজন গার্ডকে ডেকে বললো—
“স্যারকে ধরো।”
গার্ড দুটো একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ইন্সট্রাকশন ফলো করছে না দেখে বিরক্ত হলো জাভেদ, ধমকে বললো—
“কি হলো? স্যারকে ধরো!”
গার্ড দুটোর মধ্যে একটা মাথা নিচু করে বললো—
“সরি স্যার, কিন্তু বস যদি পরে বকা-ঝকা করেন…”
ভয় তো জাভেদেরও হচ্ছে, কিন্তু এই মুহূর্তে এগুলো না করলে পরে তার কপালে শনি-রাহু-কেতু একসাথে নাচানাচি শুরু করবে। তাই নিজের ভয়টা চেপে গেলো জাভেদ। সাহসী কণ্ঠে গার্ডকে অর্ডার দিয়ে বললো—
“আমি বলছি, স্যারকে ধরো। স্যার কিছু বললে আমি দেখবো।”
গার্ড দুটো আর তর্কে জড়ালো না, কারণ জাভেদের ইন্সট্রাকশন ফলো করা তাদের ডিউটি। গার্ড দুজন প্রণয়ের দুই বাহু ধরে সোজা করে বসালো। প্রণয়ের হুঁশ আছে তবে একটু একটু। জাভেদ ভয়ভয় ওআরএস ভর্তি জলের গ্লাসটা নিয়ে এগিয়ে এলো প্রণয়ের কাছে, কাঁপা হাতে গ্লাসের সবটুকু জল প্রণয়কে খাইয়ে দিলো। পরপর লেবু-চিনি মিশ্রিত পানির গ্লাসটাও খাইয়ে দিলো। গ্লুকোজ, ওআরএস, লেবু-চিনি পানি এগুলো পেটে পড়তেই প্রণয়ের পেটের নাড়িভুঁড়ি মুহূর্তেই পাক দিয়ে উঠলো। সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই হরহর করে বমি করে দিলো প্রণয়। হালকা কেঁপে উঠলো জাভেদসহ গার্ড দুটো। জাভেদ আরেকটু সাহস করে আরো দুই গ্লাস খাওয়ালো। পরপর আরো দুইবার বমি করে একেবারে নেতিয়ে পড়লো প্রণয়।
জাভেদ কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়ে বললো, “যাক, বেঁচে গেছি।”
জাভেদ দুই মিনিট বিশ্রাম নিয়ে একইভাবে শুদ্ধকে ও খাওয়ালো। তবে শুদ্ধর বমি হলো না, কারণ অ্যালকোহলে তার খুব একটা প্রবলেম হয় না। এভাবে প্রায় মিনিট ২০ এক, দুই বন্ধুর সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে হাঁপিয়ে গেলো জাভেদ। আরো ৪ জন গার্ড ডেকে বললো—
“স্যার আর উনার বন্ধুকে ধরে ধরে গাড়িতে এনে বসাও।”
গার্ডরাও তাই করলো। প্রণয় ও শুদ্ধকে শুদ্ধর গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে দিলো। তাদের সাথে দুজন গার্ডও বসলো। জাভেদ ড্রাইভিং সিটে বসে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে, বেরিয়ে গেলো।
শিকদার বাড়ি, রাত ৩টা ১০। শিকদার বাড়ির সদস্যদের প্রায় সকলেই জেগে গেছেন। অনুশ্রী বেগম, তনুশ্রী বেগম, অনন্যা বেগম, অর্থী বেগম খাবার-দাবার গরম করছেন। প্রিয়তা, পরিণীতা, প্রেরণা, স্বেতা, থিরা, চিত্রা আর পূর্ণতা ট্যাবলেট সেট করছে। প্রণয়, শুদ্ধ, পৃথম, ইনায়া, প্রেম ও ঊষা এখনো নিচে আসেনি। প্রহেলিকা বাসায় নেই আজ ১ সপ্তাহ। সে নাকি তার ইউনিভার্সিটির বান্ধবীদের সাথে ট্রিপে গিয়েছে, আসবে কাল।
৪ কর্তা—মাহজাবিন চৌধুরী, রাজ, অরণ্য, সমুদ্র ও তন্ময় বসে আছে ড্রয়িংরুমে। অরণ্য, সমুদ্র, তন্ময়কে এটা ওটা বলে খেপাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও তন্ময়কে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়নি। সে ঠিকই সবার আগে আগে উঠে পড়েছে, কারণ সে-ও নাকি সেহরি খাবে, রোজা রাখবে। সে ছোট বলে তাকে ফাঁকি দিয়ে সবাই রোজা রাখবে—এটা তো আর তন্ময় বাবু কিছুতেই মেনে নেবেন না, তাই সে-ও আছে।
অনুশ্রী বেগম মাংসের বাটিটা ডাইনিং টেবিলে রাখতে রাখতে প্রিয়তা ও থিরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— যাও, গিয়ে ভাইয়া ভাবীদের ডেকে নিয়ে আসো। বলবে, কোনো বাহানা না দেখিয়ে যেন ১০ মিনিটের মধ্যে হাজির হয়।
প্রিয়তা ও থিরা মাথা দুলিয়ে উপরে চলে গেল।
তিনি এবার পরিণীতা ও প্রেরণাদের বললেন,
— যাও, ভাত-তরকারির বাটিগুলো এনে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখো।
ওরা দুই বোনও আম্মুর কথামতো রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
থিরা আর প্রিয়তা ৪ তলায় ছেলেদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
থিরা প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু কণ্ঠে বললো,
— আপু, আমি ভাইয়া-ভাবীদের ডেকে তুলছি। তুমি তোমার প্রণয় ভাইকে ডেকে তোলো।
থিরার পিঞ্চ মারা কথায় বিরক্ত হলো প্রিয়তা। চোখ পাকিয়ে তাকালো বোনের দিকে। কিন্তু থিরা ওর আপুকে থোড়াই কেয়ার করে, সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে তাকালো প্রিয়তার দিকে। মুখে নাটকীয় গাম্ভীর্য এঠেঁ মহান কণ্ঠে বললো,
— বুঝেছি, বুঝেছি বালিকা। ধন্যবাদ দিতে হবে না। পরোপকার করাই আমার ধর্ম। আমি জ্ঞানী, তাই তোমার মনের ইচ্ছা তুমি না বলাতেই বুঝে নিয়েছি। আমি ঠিক জানি, তুমি ও মনে মনে এটাই চাচ্ছিলে।
— যাও, জিলো আপনে জিন্দেগী।
প্রিয়তা বোনের দিকে তাকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল, কারণ থিরা অরণ্যের কার্বন কপি।
থিরা আবারো বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,
— যাও বালিকা, যাও যাও। তবে ধন্যবাদ না দিলেও দক্ষিণাটা কিন্তু অবশ্যই মনে করে দিও।
প্রিয়তা এবার চরম বিরক্ত হয়ে থিরার কান টেনে ধরে বললো,
— আর একটা ও পাকা কথা বললে, ঠোঁট দুটো টেনে সেলাই করে দেব বেয়াদব।
তর বেয়াদবির শাস্তি হিসেবে, তুই গিয়ে প্রণয় ভাইকে ডেকে তুলবি, বলে চলে যেতে নিলে—
লাফিয়ে প্রিয়তার হাত ধরে ফেলল থিরা। কান ঢলতে ঢলতে, চোখ মুখ বিকৃত করে বলল,
— আহ ছোট আপু! তুমি আমার বোন হয়ে আমাকে তোমার জমের দুয়ারে একা ফেলে চলে যাচ্ছ! তোমার জমকে তুমি ডাকো ভাই আমার বুকের এতো পাঁঠা নাই, বলে আর কিছু শুনলো না থিরা।
প্রিয়তা কে ফেলে উল্টো ঘুরে প্রীতমের ঘরের দিকে দৌড় দিল।
প্রিয়তা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ালো প্রণয়ের ঘরের দিকে।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে প্রণয়ের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগল। মনে মনে ভয়ও পাচ্ছে মেয়েটা। তখন একটা সামান্য কারণে যেভাবে ধমকালো—এই মাঝরাতে গিয়ে ডাকা-ডাকি করলে না আবার তুলে আচড়-টাচড় মেরে দেয়?
কয়েক মিলিসেকেন্ড ভাবলো প্রিয়তা। এরপর ঠিক করলো—যা হওয়ার হবে। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করে, বড়ো আম্মু তাকে বাংলা ওয়াশ করে দেবে। যাকে বলে—জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ।
তাই প্রিয়তা বাধ্য হয়ে বাঘের খাঁচায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
দুই কদম এগিয়ে গিয়ে, জড়তা মিশ্রিত কণ্ঠে আস্তে করে ডাকলো,
— প্রণয় ভাই?
কিন্তু ভিতর থেকে আওয়াজ এলো না। মূলত, প্রিয়তার কণ্ঠই ভিতর অবধি পৌঁছালো না। চারদিকে পিন পতন নীরবতা।
প্রিয়তা আরো দু-তিন বার ডাকলো, কিন্তু ফলাফল একই। ভিতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
প্রিয়তা এবার ভয় ভয় হাতটা দরজায় ছোঁয়াতেই, ভেজানো দরজাটা হাট করে খুলে গেল। হালকা কেঁপে উঠলো প্রিয়তা।
সে আশা করেনি দরজা খোলা থাকবে, কারণ প্রণয় কখনোই দরজা খুলে ঘুমায় না।
তবু এসব নিয়ে বেশি ভাবলো না প্রিয়তা। সে কিন্তু প্রণয়-এর ধমকানোটার কথাও এখনো ভুলে যায়নি।
ফলে অভিমানে গলা দুটো উঁচু হলো।
সে মনে মনে ঠিক করলো—“জাস্ট উঠিয়ে দিয়েই চলে যাবো। একটুও কথা বলবো না, ডাকলেও শুনবে না।” যেমন ভাবনা, তেমন কাজ।
প্রিয়তা মনঃস্থির করে পা বাড়ালো প্রণয়ের ঘরে।
ভেতরটা মৃত্যুপুরীর মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার। অথচ সারাবাড়ি আলোয় ঝলমল করছে, এই ঘরের সমস্ত লাইট নিভানো। এমনকি ডিম লাইটটা পর্যন্ত জ্বালানো নেই।
প্রিয়তার এই গা ছমছমে অন্ধকারে ভয় লাগছে।
তবু… ও… এই ঘরে প্রণয় ভাই আছেন ভেবে বুকে একটু বল পেলো।
ভয়ভয় পা বাড়ালো সামনের দিকে।
সে মূলত কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অন্ধকারে এদিক ওদিক তাকাতে ও ভয় লাগছে।
তবু ও প্রিয়তা আন্দাজে হেঁটে হেঁটে প্রণয়ের বেডের পাশে গিয়ে পৌঁছালো।
মনে মনে আফসোস করে বললো, ‘ফোনটা আনলেই ভালো করতাম।’
প্রিয়তা ছোট ছোট পা ফেলে বিছানার মাথার দিকে গিয়ে দাঁড়ালো। একটু ঝুঁকে, আগের মতোই মোলায়েম কণ্ঠে ডেকে বলল,
— ও প্রণয় ভাই, উঠে পড়ুন। বড়ো আম্মু আপনাকে নিচে যেতে বলছেন। আপনি দেরি করলে পরে আমাকে আবার বকা শুনতে হবে।
কিন্তু এবারও কোনো সাড়াশব্দ পেলো না প্রিয়তা।
প্রিয়তা একটু আশ্চর্য হলো, কারণ প্রণয় ভাইয়ের ঘুম কখনোই এত গভীর হয় না।
মনে মনে ভাবলো, ‘প্রণয় ভাই কি এই ঘরে আদৌ আছেন নাকি সে সম্পূর্ণ একা?’
অন্ধকার ঘরে নিজেকে একা ভাবতেই প্রিয়তার কণ্ঠ শুকিয়ে এলো।
সে ফট করে প্রণয়ের বিছানায় বসে পড়লো।
ভয় মেশানো কাঁপা হাতটা সামনের অন্ধকারে কিছুটা এগোতেই, আচমকা হাতটা উষ্ণ নরম কিছুর সাথে স্পর্শ লেগে গেল।
সেটা কী, বুঝতে পারলো না প্রিয়তা।
তবে জিনিসটার সাথে ছোঁয়া লাগতেই প্রিয়তার দেহে বিদ্যুৎ খেলে গেল।
অকারণেই গলা শুকিয়ে কাঠ হলো, বুকে জমে উঠল অদ্ভুত এক দমবন্ধকর অনুভূতি। এমন অনুভূতির কারণ বুঝলো না প্রিয়তা।
কি ছুঁয়ে এমন কারেন্ট লাগলো বোঝার জন্য, আশপাশ হাতরাতেই খোঁচা খোঁচা কিছু একটার ঘর্ষণে হাতের তালু হালকা জ্বালা করে উঠলো প্রিয়তার।
আরো কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হল—এটা প্রণয় ভাই।
আর সে তখন প্রণয় ভাই-এর ঠোঁট স্পর্শ করে ওভাবে কেঁপে উঠেছিল।
প্রিয়তা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলো,
‘বাহ বাহ, কি কারেন্ট পোলার! পোলা তো নয়, যেন একখান আগুনের গোলা!’
প্রিয়তা নিজের ভাবনার উপরই তাজ্জব বনে গেল। ‘ছি, কি সব ভাবছে সে! এই লোক মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে তাকে ইচ্ছা মতো ঝেড়েছে, আর এখন সে এসব ভাবছে! ছ্যাহ প্রিয়তা ছ্যাহ!’
প্রিয়তা নিজেকে সামলে নিলো, আর হিজিবিজি চিন্তা করে সময় নষ্ট করলো না।
প্রণয়ের আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে বসলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে কোমল কণ্ঠে ডাকলো,
— প্রণয় ভাই… উঠে পড়ুন না।
প্রিয়তা অন্ধকারে অনুভব করলো, তার ডাকে প্রণয় বোধহয় একটু নড়লো।
প্রণয়ের শরীর থেকে অ্যালকোহলের সাথে ম্যান পারফিউমের ঘ্রাণ মিক্স হয়ে স্ট্রং একটা স্মেল ক্রিয়েট করেছে,
যার গন্ধে প্রিয়তার মস্তিষ্ক আউলিয়ে যাচ্ছে। ঘ্রাণটা ভীষণ অন্যরকম ও নেশা ধরিয়ে দেওয়ার মতো।
কিন্তু এত ডাকাডাকি পরও প্রণয় নড়ছে না দেখে এবার একটু রেগে গেলো প্রিয়তা। পেটের কাছের শার্টটা মুঠো করে ধরে ঝাঁকিয়ে ডাকতে লাগলো।
গভীর ঘুমের মধ্যে ডিস্টার্ব ফিল করলো প্রণয়।
অবচেতন অবস্থাতেও, সে খুব কাছ থেকে সেই প্রিয়, পরিচিত নারীদেহের গন্ধটা পাচ্ছে—যা তার অবচেতন মনকেও অবশ করে দিচ্ছে।
অনুভব করতে পারছে কোমল কিছু স্পর্শ।
মনে হচ্ছে, তার পাখিটা খুব কাছেই আছে।
প্রিয়তা আরেকবার পেট ধরে ঝাঁকাতে নিলেই, তার হাতে কবজি খপ করে চেপে ধরল প্রণয়।
আচমকা অনাকাঙ্কিত পরশে মৃদু চমকালো প্রিয়তা।
প্রণয় তাকে এক টানে নিজের বালিশে শুইয়ে দিলো।
প্রিয়তা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তার ছোট্ট কোমল দেহখানা ভারী পুরুষালী দেহের নিচে চাপা পড়লো।
প্রণয় ঘুমের মধ্যেই মুখ ডুবিয়ে দিলো প্রিয়তার সুভাষিত কোমল গলায়। তার অতি প্রিয় গন্ধটা নিঃশ্বাসে শুষে নিতে লাগলো প্রিয় নারীর দেহ থেকে।
প্রণয়ের অতর্কিত আক্রমণে প্রিয়তার নিঃশ্বাসটুকু গলায় এসে আটকে গেল। ঠোঁট শুকালো, পানির অভাব বোধ করলো মেয়েটা।
প্রণয় ঘনঘন তপ্ত নিশ্বাস ফেলছে প্রিয়তার গলায়, তার ঘোর লাগানো প্রতিটা নিশ্বাসের উষ্ণতা প্রিয়তার শরীর ছুঁয়ে অস্তিত্বে মিশে যেতে লাগলো প্রতিবার। তার খোঁচা খোঁচা দাড়ির স্পর্শে হালকা হালকা ব্যাথা পাচ্ছে মেয়েটা।
কিছু বলতে চাচ্ছে হয়তো, কিন্তু গলা দিয়ে টুশব্দ বেরোচ্ছে না।
এমনকি সে যে ৮৩ কেজির নিচে চাপা পড়ে আছে — সেটা ও ফিল হচ্ছে না এই মুহূর্তে।
প্রিয়তা অনুভুতির ঝড়টা সামলানোর আগেই শোনা গেল তপ্ত পুরুষালী কণ্ঠস্বর —
প্রণয় তার গলায় মুখ ডুবিয়েই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে এলোমেলো কিছু শব্দ আওড়ালো,
— জান, তুই কি আমাকে জ্বালানোর একটা সুযোগ ও ছাড়বি না পাখি… সারাদিন, রাত, চব্বিশ ঘণ্টাই তো মন-মস্তিষ্ক দখল করে বসে থাকিস…
— একটু ও শান্তি দিস না.. একটু ও ঘুমাতে পারি না তোর জন্য…
— এখন একটু ঘুমাচ্ছি, সেটাও বুঝি তোর সহ্য হচ্ছে না? স্বপ্নেও পাগল বানাতে চলে এসেছিস?
— নিজের ইচ্ছে যখন ধরা দিয়েছিস, তখন আর পালাতে পারবি না…
প্রণয় বলা কথার ৭০% ছিলো ঘোলাটে, অস্পষ্ট — যার বেশিরভাগটাই বুঝতে পারলো না প্রিয়তা। তবু ও সে টুকরো টুকরো অস্পষ্ট কথা জোড়া তালি দিয়ে নিজের মতো করে বুঝে নিলো — ওই যে বাঙালি বলে কথা, আ বললে তারা আমেরিকা ধরে নেয় — তাই প্রিয়তা ও জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কম্পিত কন্ঠে জবাব দিলো,
“কক কি করবেন?”
প্রণয় এর কন্ঠ থেকে এবার কোন শব্দ নির্গত হলো না, সে প্রিয়তার উদর দুই হাতে চেপে ধরে তার কোমল দেহখানা আরও ঘনিষ্ঠভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।
প্রিয়তার সুগন্ধিতো গলায়,নাক ঘষেতে ঘষেতে, ঘুম জড়ানো মাধকীয় কণ্ঠে বললো,
“আদর করবো তোকে… অনেক আদর…”
প্রণয়ের নেশা জড়ানো ওই লাইনটা কর্ণ কুহরে পৌঁছতেই
গায়ের সমস্ত পশম এক সাথে দাঁড়িয়ে গেল প্রিয়তার।
হাত-পায়ের তালু শিরশির করে উঠলো, শরীর জুড়ে খেলে গেলো এক অজানা শিহরণের ঝড়।
বুকের ভেতর উথলে ওঠল প্রেমের নোনা সাগর। নারী মন তার প্রিয় পুরুষের স্পর্শে দুর্বল হয়ে পড়ছে। শরীর ও মনে কেমন দম বন্ধ কর সুখ ও দুঃখের মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে।
তার উপর সেই পুরুষের শরীর থেকে ছুটে আসছে অ্যালকোহল ও পারফিউমের মিশ্র এক ঘ্রাণ, যা প্রিয়তার মন-মস্তিষ্ক নেশায় ডুবিয়ে দিচ্ছে।
সে ভালোই বুঝে গেছে — এই পুরুষ তাকে আমৃত্যু এইভাবে ঝুলিয়ে রাখবে, কি নিদারুণ মিষ্টি যন্ত্রণা!
তার পুষে রাখা অভিমানের পাহাড় ও সেই পুরুষের উষ্ণ আদরে গলে যেতে মুহূর্ত ব্যয় করল না।
প্রণয় আবার অস্পষ্ট কণ্ঠে বীরবীর করলো,
“বাস্তবে তুই আমার না হলে, ও কল্পনায় তুই শুধুই আমার… এখানে তোকে আমার থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না…
তাই এখানে তোকে ভালোবাসার ১% অধিকারও আমি কাউকে দেবো না।”
বলেই প্রিয়তার কণ্ঠনালীতে ঠোঁট চেপে ধরলো প্রণয়,
তার শক্ত পক্ত বন্দনে আবদ্ধ থেকেই থর থর করে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা।
চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো সে ও দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল প্রণয়ের পৃষ্ঠদেশ। তবে সেই চওড়া পিঠ দুই হাতের মধ্যে আঠলো না প্রিয়তার।
সে ভালই বুঝতে পেরেছে —
প্রণয় এই মুহূর্তে পুরোপুরি জেগে নেই, সে স্বপ্ন ও বাস্তবের দুনিয়াতে আটকা পড়েছে…
কিন্তু এভাবে কতক্ষণ? কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাই প্রিয়তা নিজের আবেগ সামলে নিলো। তাছাড়া ও এভাবে সে কারো অচেতন অবস্থার সুযোগ নিতে চায় না —
তাই প্রিয়তা প্রণয়ের নিচ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো।
কিন্তু এতে ফলাফল হলো উল্টো।
প্রণয় এবার আরও শক্ত করে চেপে ধরলো —
যেন, নিঃশ্বাস নেবার উপক্রম নেই প্রিয়তার…
প্রণয় ঘুম-জড়ানো কণ্ঠে ধমকে বললো,
“আচ্ছা বেয়াদব হয়ে গেছিস তুই জান… বাস্তবের মতো স্বপ্নেও আমার সাথে ত্যাড়ামি করছিস…
বললাম না আদর করবো… নড়বি না।”
প্রিয়তার ভেতরটা ক্রমশ অশান্ত হয়ে উঠছে।
সে মনে মনে শুকনো ঢোক গিলে বললো —
“হ্যাঁ ব্যাটা, হুশে থাকতে কতো আদর করো সে আমার ভালই জানা আছে, আদরের নাম করে আমার হাড় গোড় গুঁড়ো করে দেওয়ার মতলব! উফফ, কী ভারী… মনে হচ্ছে যেন হাতির নিচে চাপা পড়েছি!”
ঘুমিয়ে থাকলে বা নেশা করলেই শুধু এই লোকের পিরিত উথলে উঠে!
প্রিয়তা আবারো ছটফট করলে,তার দুই হাত একত্রে বেডের সাথে চেপে ধরলো প্রণয়।
চোখ বুজে প্রিয়তার ঘাড়ের ঠিক নিচের বাঁকে ঠোঁট রাখলো —
একটা নিঃশব্দ, গভীর, ভেজা চুমুতে শিউরে উঠল প্রিয়তা…
প্রণয়ের ঠোঁট ধীরে ধীরে গলা বেয়ে নিচে নামতে নামতে প্রিয়তা কে আদুরে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলো।
ওষ্ট কেঁপে উঠলো প্রিয়তার, চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো মেয়েটা…
প্রণয় আরেকটু নিচে নামতে নিলেই, তার চুল খামচে ধরে থামিয়ে দিলো প্রিয়তা।
তার মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরলো নিজের বুকের সাথে।
কম্পিত কন্ঠে তোতলিয়ে বললো —
“পপ্লিজ প্রণয় ভাই… কী করছেন? চোখ খুলুন… এমন করবেন না!”
কিন্তু প্রণয় থামছেই না।
প্রিয়তা এবার বাধ্য হয়, প্রণয় এর বাহুতে একটু জুড়েই কামড়ে দিলো।
হাতে তীব্র ব্যথা অনুভব হতেই থেমে গেলো প্রণয়।
ঘোরের দুনিয়া থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো।
প্রণয় সরে যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো প্রিয়তা।
তার শরীরটা যেন বাতাসের মতো হালকা হয়ে গেল মুহুর্তেই।
বুক ভরে নিশ্বাস নিতে লাগল মেয়েটা, যা এতক্ষণ নিতে পারছিল না।
প্রিয়তার মতে, প্রণয় এর উচিত খাওয়া দাওয়া কম করে ওজন কমানো।
কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে, খেতে তো দেখে না! আর খেলে ও তো ঘাস পাতাই খায়! জিম, ওয়ার্ক আউট করে সবসময়।
তার পর ও এতো ওজন কিভাবে হাউ?
জেগে উঠতেই প্রণয়ের মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
“কী সাংঘাতিক স্বপ্ন!”
প্রণয় মাথা চেপে ধরে বিড় বিড় করে বলল —
“উফফ, এমন চললে আমি খুব শীঘ্রই পাগল হয়ে যাবো!
আমায় কাল থেকে আবার রেগুলার মেডিসিন নিতে হবে?”
প্রণয় স্বপ্ন ভেবে সব কিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল, কিন্তু পরক্ষণেই কি যেন মনে হতে, প্রণয়ের হৃদপিণ্ড চলাৎ করে উঠলো।
নিজের শার্টের কলারটা টেনে নাকের কাছে ধরতেই চোখ জেড়া বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল , কারণ — তার নিজের শরীর থেকেই অতিমাত্রায় সেই চেনা পরিচিত মেয়েলি গন্ধটা আসছে…
অজানা আশঙ্কায় ঢোঁক গিললো প্রণয়।
তারাহুরো করে পাশে থাকা টেবিল ল্যাম্পটা অন করতেই চোখের সামনে সেই প্রিয় মায়াবী মুখটা ভেসে উঠলো।
সেই নারী তার গভীর নীলাভ চোখের ভারী পল্লব, জাপটে আতঙ্কিত নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকেই।
প্রণয়ের বোধগম্য হলো —
সে এতক্ষণ স্বপ্নে আদর করে নি।
যা করার তা বাস্তবেই করেছে।
বড় এক দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে এলো প্রণয়ের।
সে ভেবে পায় না —
ভাগ্য তার সাথে এমন শত্রুতা কেন করে সময়…
এই নারী থেকে সে নিজেকে যত দূরে রাখতে চায়,
ভাগ্য তাকে ততই কাছে নিয়ে আসে।
এই স্পর্শ গুলোই যে তার অন্যতম বড় দুর্বলতা। এগুলো সে কিছুতেই ভুলতে পারে না।
এই নারীর ছোট বড় সকল স্পর্শই তার অন্তরের গভীর দাগ কাটে।
এক এক সময় মন এই স্পর্শ পাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠে, গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে থাকে, নিশ্বাস নিতে পারে না।
এই নারী তার মরণের অভ্যাস। সে যতই এই অভ্যাসকে বুকে চেপে রাখতে চায়, ততই এই নারীর স্পর্শে তা জ্বলে উঠে পুনরায়।
মানে — ভাগ্যই প্রণয় শিকদারের জাত শত্রু!
প্রণয় নিজেকে সামলে চোখ-মুখ স্বাভাবিক করলো।
প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো —
“এতো রাতে আমার ঘরে কী করিস? ভয় করে না? রাত বিরেতে এই ঘরে আসতে?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে নিলো।
রিনরিনে কোমল কণ্ঠে বললো —
“আসলে বড় আম্মু আপনাকে ডাকতে পাঠিয়েছিলো সেহরি খাওয়ার জন্য… তাই এসেছিলাম…”
প্রণয় কিছু বলে না শুধু তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে…
এই তৃষ্ণা, এই পিপাসার যেন কোনো অন্ত নেই।
পিপাসা নিবারণের ও কোনো রাস্তা নেই…
সে বিলক্ষণ জানে —
শেষ কালে এই অতিরিক্ত তৃষ্ণার সাগর বুকে পুষে, চাতকের মতোই তার মৃত্যু হবে।
চাতক যেমন তার শেষ পানিটুকু পায় না, প্রণয় ও তেমন তার অনন্ত তৃষ্ণা কোনদিনও নিবারণ করতে পারবেনা।
প্রণয় ভারি নিশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিলো।
বিছানা থেকে উঠে রুমের সব লাইট অন করে দিলো।
পাশের ড্রয়ার থেকে প্রিয়তার প্রিয় চকলেটটা ওর হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিয়ে বললো —
“পুরোটা তোকে দেইনি… অর্ধেকটা আমার জন্য রেখে যাবি।”
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫২
বলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো প্রণয়।
প্রিয়তা হতাশ হলো।
মনে মনে বললো —
“এই পোলার মন বুঝা… নয়রে নয় সোজা!”
প্রিয়তা ও তাই করলো মনের সুখে —
চকলেটটা কুট কুট করে অর্ধেকটা খেয়ে,
বাকি অর্ধেকটা প্রণয়ের টি-টেবিলের উপর রেখে চলে গেলো।