ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৪
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
শিকদার বাড়ির সেহরির পাঠ মাত্রই চুকলো। সাদমান শিকদার সেহরি শেষ করে লাইব্রেরি রুমে এসে বসেছেন। সেহরির সময় শেষ হতে আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি, তাই এই সময়ের মধ্যেই তিনি কড়া করে এক কাপ চা খেয়ে নিচ্ছেন, কারণ সাদমান শিকদারের চায়ের প্রচণ্ড রকম নেশা। চা পান করতে না পারলে উনার আবার গা, হাত, পা ম্যাজমেজ করে, কোন কিছুতেই আগ্রহ পান না। কাল থেকে যেহেতু আর দিনে বেলা খেতে পারবেন না, তাই এখনই শেষ এক কাপ খেয়ে নিচ্ছেন।
সাদমান শিকদার বেশ আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গভীর মনোযোগে জুলিয়ান বার্নসের লেখা “The Sense of an Ending” বই এর পাতায় নজর বুলাচ্ছেন,
” ঠক ঠক।”
হঠাৎ দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দে উনার গভীর মনোযোগ এক লহমায় ছিটকে পড়লো বইয়ের পাতা থেকে। এতে মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেন সাদমান শিকদার, তবে সেই বিরক্তিটুকু চোখে মুখে ফুটিয়ে না তুলে রাশভারি কণ্ঠে বললেন — “আসো।”
পরিণীতা ধীর পদচারণে কক্ষে প্রবেশ করলো। তার মায়াবী চোখ দুটি অশ্রুতে পরিপূর্ণ, যেন পলক ঝাপটালেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে।
সাদমান শিকদার বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে মাথা তুলে ওপরে তাকালেন। মেয়েকে এই সময় এই ঘরে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন, তবে বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। পুনরায় চায়ের কাপেই মনোযোগ দিয়ে ভারি কণ্ঠে বললেন — “বসো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সাদমান শিকদারের ভারি কণ্ঠের সে একটি শব্দেই পরিণীতার আটকে রাখা কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে পড়ল। চোখের কোণ বেয়ে জলরেখা গাল ছুঁয়ে নেমে এলো নিঃশব্দে।
পরিণীতা বসলো না।বরং আচমকা ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে বাবার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
অপ্রত্যাশিত এ কান্ডের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না সাদমান শিকদার। বিধায় কিছুটা হকচকিয়ে গেলেন, তবে পরমুহূর্তে মূল ঘটনার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে নিজেকে সামলে নিলেন।
চেহারার গাম্ভীর্য বজায় রেখে পরিণীতার মাথায় হাত রাখলেন স্নেহের শহিত। কণ্ঠে একফোঁটা কোমলতা টেনে বললেন— “কাঁদছো কেন, ছোটো আম্মা?”
পরিণীতার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। কান্নার তোপে তার গলা দিয়ে শব্দ আসছে না। সে সাদমান শিকদারের পা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হেঁচকি তুলে বললো — “আব্বু… আমি কখনো আপনার কথার একটু-ও অবাধ্য হইনি, কোন কথার অমান্য ও করিনি। আর ভবিষ্যতেও করবো না। আমি আপনার সব কথা শুনে চলবো, আব্বু।
তবুও… আমার সাথে এমন অবিচার করবেন না… আমি শেষ হয়ে যাবো… আমি… আমি যে… উনাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি… এখন আর সেখান থেকে পিছন ফিরে তাকানো আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।
আব্বু… দয়া করে… আমাকে একটু বুঝুন… আমি উনার সাথেই ভালো থাকবো… আমাকে প্লিজ উনার সাথেই থাকতে দিন…”
সাদমান শিকদার স্থির, নিরবিকার। উনার মধ্যে অভিব্যক্তির কোন ভাবান্তর হলো না। তিনি নিরব ভঙ্গিতে মেয়ের সব কথা শুনলেন। তিনি আজকের পরিণীতার মাঝে ১৭ বছর আগের প্রণমীকে দেখতে পাচ্ছেন। সেই এক চোখ একমুখ একই আবেদন, প্রণমীও ঠিক এভাবেই উনার পা আঁকড়ে ধরে কাকুতি মিনতি করেছিল,। আর আজ, ঠিক ১৭ বছর পর আবারো পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো।
তবে সময় পাল্টে গেলেও পাল্টাননি সাদমান শিকদার — তিনি আগেও সেই পুরনো সাদমান সিকদার ছিলেন, আর আজো সেই পুরনো সাদমান সিকদারই আছেন।
তিনি পরিণীতার থেকে পা ছাড়িয়ে নিয়ে গম্ভীর, রাশভারি কণ্ঠে বললেন — “তুমি এখন কী চাও?”
পরিণীতা অশ্রুশিক্ত, কাপা নয়নে মাথা তুলে তাকালো বাবার দিকে। সাদমান শিকদার মুখ শীতল, তবে দৃষ্টি কঠিন — যা দেখে মনে মনে ভয়ে কেঁপে উঠল পরিণীতা। তিনি সাধারণত উনার মেয়েদের সামনে এমন গম্ভীর থাকেন না। তবে আজ যে ভয় পেলে চলবে না — পরিণীতার সে।
চোখ মুছে, ভয় মিশ্রিত কাঁপা কণ্ঠে বললো — “আমি মাস্টারমশাইকে ভালোবাসি।”
পরিণীতার একটি মাত্র বাক্যে তিরিক্ষি রাগে জ্বলে উঠলো সাদমান শিকদারের শান্ত চিত্ত। তবুও সেই রাগ প্রকাশ করলেন না। চশমার কোন ঠেলে পরিণীতার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। উপহাস মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন — “ভালোবাসো?”
পরিণীতা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। মাথা নিচু করে, উপর-নিচে মাথা দুলালো। মেয়ের অভিপ্রায় দেখে মৃদু হাসলেন সাদমান শিকদার। মেয়ের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দেখে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন —
“এই প্রজন্মে আমার বংশে হিরক রত্নদের জন্ম হয়েছে, যারা বাবার সঞ্চিত অর্জিত মান-সম্মান ধুলোয় মেশানো ছাড়া অন্য কিছু পারে না।”
সাদমান শিকদারের এমন বাক্যবাণে আহত হলো পরিণীতা। মাথা নিচু করে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো।
সাদমান শিকদার আবারো কণ্ঠে তাচ্ছিল্য টেনে বললেন —
“আমার বংশের মর্যাদার কথা না হয় আপাতত ছেড়ে দিলাম। তা আমার মেয়ে হয়ে, তুমি যাকে বিয়ে করতে চাচ্ছো, তার যোগ্যতা কতটুকু — সেটা তো আমাকে দেখতে হবে।
তাই তুমি বলো, তুই যে ড্রেসটা পরে আছিস, এটার প্রাইস কত?”
পরিণীতা ঝট করে মাথা উঠিয়ে তাকালো আব্বুর দিকে। সাদমান শিকদার মেয়ের বিস্মিত দৃষ্টি নিরীক্ষণ করে বললেন — “বলো, যেটা পরে আছো, সেটার দাম কত?”
পরিণীতা পুনরায় মাথা নিচু করে নিলো। নম্র কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো — “জি আব্বু… ১৫,০০০ টাকা।”
মেয়ের উত্তরে সাদমান শিকদারের অধর কোনে বিদ্রুপের হাসি ফুঁটে উঠলো। তিনি তাচ্ছিল্য মিশ্রিত কণ্ঠে, অবহেলা মিশিয়ে বললেন — “ওই ছেলের মাসিক বেতন কত জানো?”
দুই পাশে মাথা নাড়ালো পরিণীতা, যার অর্থ সে জানে না।
সাদমান শিকদার হালকা হাসলেন, বললেন — “৩০,০০০… সম্ভবত। তবে এর কমও হতে পারে।
যেখানে তোমার একটা সামান্য কাপড়ের মূল্য ১৫ হাজার, সেখানে সাদমান শিকদারের মেয়ে হয়ে, তুমি মাত্র ৩০ হাজার টাকা দিয়ে গোটা মাস চালবে কিভাবে?
এর দুই গুণ বেশি বেতন আমরা প্রতি মাসে আমাদের বাড়ির কাজের লোকগুলোকে দেই সেখানে…
বলে আবারো হতাশা প্রকাশ করলেন সাদমান শিকদার—
“তুমি জানো প্রতি সপ্তাহে এই বাড়িতে কত টাকার বাজার আসে?
আচ্ছা, এগুলোও বাদ দিলাম… তুমি কখনো শুধু ডাল-ভাত খেয়ে থেকেছো?”
আবারও দুই পাশে মাথা নাড়ালো পরিণীতা।
পুনরায় মৃদু হাসলেন সাদমান শিকদার। পরিণীতার চোখের সামনে রূঢ় বাস্তবতা ও তার জীবনধারা তুলে ধরে বললেন —
“তুমি আমার প্রাসাদের রাজকন্যা, পরি।
সাদমান শিকদারের রাজকন্যা তুমি।
তুমি কোনোদিন ওই একটা সামান্য বেতনের ছেলের সংসারে মানিয়ে নিতে পারবে না।
ওখানে এক বেলা মনমতো খেতে পর্যন্ত পাবে না, একটা ভালো কাপড়ও পরতে পারবে না।
তাহলে বলো, আমি একজন বাবা হিসেবে — আমি আমার মেয়েকে, আমার রাজকন্যাকে, কিভাবে ওই রকম একটা ছেলের হাতে তুলে দেবো, যে আমার মেয়েকে ঠিকমতো খেতে-পরতে পর্যন্ত দিতে পারবে না?
একটা চিপ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবন কাটাতে বাধ্য করবে?”
“আর তুমি এসবে অভ্যস্ত নও, পরি।
অভাবের যে কী জ্বালা — সেটা তুমি কোনদিনও দেখনি।
তাই সম্পর্ক করতে হয় সমানে সমানে।
ওভাব যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানলা দিয়ে পালায়।
আমার মেয়ে না হয় আবেগের বয়সে ভুল করছে।
তাই বলে আমি, একজন বাবা হয়ে, কিভাবে নিজের মেয়ের ভুলকে স্বীকৃতি দেবো?
কিভাবে একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দেবো, যেখানে আমি জানি, এটা করলে আমার মেয়ে রাজরানী থেকে চাকরানী হয়ে যাবে?
প্রত্যেকটা বাবাই তার মেয়েকে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে রাজকন্যার মতো রাখে।
আর প্রত্যেকটা বাবাই চায়, তার মেয়েকে ওরকম কারো হাতে তুলে দিতে — যে তার মেয়েকে তার থেকেও ভালো রাখবে।
কিন্তু তুমি এখন আমার কাছে এমন একজনের আবদার করছো, যার থেকে আমাদের বাড়ির কাজের লোকগুলোও উন্নত জীবনযাপন করে!
এখন তুমি বিচার করো, আমি আমার মেয়েকে কী দেখে বিয়ে দেবো?”
পরিণীতা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল সাদমান শিকদারের দিকে।
সে তার আব্বুর কথার প্যাঁচে পুরোপুরি ফেঁসে গেলো।
তবুও নিজের কথায় অনড় থাকলো পরিণীতা।
সাদমান শিকদারের পায়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো —
“আমি এত টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি, বিলাস-বহুল জীবন কিছুই চাই না, আব্বু।
আমি শুধু… উনার সাথে একটা খুব সাধারণ জীবন কাটাতে চাই।
আমার ১৫,০০০ টাকার কাপড়, গরুর মাংস, ইলিশ মাছ… এসব না হলে ও চলবে।
আমি কখনো শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাইনি — এটা সত্যি…
কিন্তু উনি সাথে থাকলে আমি অভ্যেস করে নেবো।
মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারলেই জীবন সুন্দর — এমন তো কোনো কথা নেই, আব্বু, যে আমাকে সারাজীবন এভাবেই থাকতে হবে।
ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যেই মানুষের জীবন।
টাকা-পয়সায় আমি সেই শান্তি পাই না, আব্বু, যে শান্তি আমি উনার সাথে থাকলে পাই।”
পরিণীতার কথায় বেশ মজা পেলেন সাদমান শিকদার।
বিদ্রূপের হাসি অধর কোনে ফুটিয়ে তুলে কটাক্ষ করে বললেন —
“ছোটো আম্মা, বাস্তব জীবন ৯০ দশকের বাংলা ছায়াছবির মতো নয়।
জীবন অনেক রূঢ় ও কঠিন।
জীবনের কতটা দেখেছো তুমি?
এখানে সিনেমার ডায়লগ চলে না।
যখন গুষ্টির কাজ করে শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেতে হবে, তখন এইসব ভালোবাসাটাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবে।
তবে তুমি যখন এত করে চাচ্ছো, তখন তুমি আমার মেয়ে — তোমার ইচ্ছার গুরুত্ব আমার কাছে সবার আগে।
আর তোমার ইচ্ছা পূরণ করাও আমার কর্তব্য।
তাই, তোমার কথা আমি মেনে নিচ্ছি — এক শর্তে।”
সাদমান শিকদারের কথায় পরিণীতার চোখ-মুখে উজ্জ্বলতা খেলে গেলো।
মনের কোণে নিভে যাওয়া আশার প্রদীপটা ধক করে জ্বলে উঠলো।
সে দ্রুততার সহিত জবাব দিলো —
“আমি আপনার সব শর্তে রাজি, আব্বু!
আপনি শুধু বলুন, আমায় কী করতে হবে?”
মেয়ের উৎসাহ দেখে হাসলেন সাদমান শিকদার।
একটু দম নিয়ে বললেন —
“আমি তোমার সাথে ওই ছেলের বিয়ে দেবো — যদি ওই ছেলেটা তোমাকে বিয়ে করে এই বাড়িতেই থাকতে রাজি হয়।
এখন মেয়ে পালছি, পরে না হয় জামাইও পালবো — এটা সাদমান শিকদারের জন্য বড় কোনো বিষয় নয়।”
সাদমান শিকদারের এমন অদ্ভুত শর্তে ভ্রু কুঁচকে ফেললো পরিণীতা।
অবাক কণ্ঠে শুধালো —
“এই বাড়িতে থাকবে কেন?”
সাদমান শিকদার চায়ের কাপে পুনরায় চুমুক দিয়ে বললেন —
“কারণ আমার মেয়ের ভরণ-পোষণের এবিলিটি ওই ছেলের মাঝে দেখি না।
সেখানে ওর বাবা-মাও আছে।
তুমি আমার মেয়ে… আমার মেয়ে আমার কাছে একটা জিনিস চেয়েছে।
সেটা তো আর আমি না বলতে পারি না — যতোই আমার বংশের মুখে চুনকালি পড়ুক।
তবে…”
সাদমান শিকদারের কথায় হতবাক হয়ে গেলো পরিণীতা।
তার মুখের উজ্জ্বলতা পুনরায় তামাশাচ্ছন্ন আঁধারে ঢেকে গেলো।
তবুও সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো সাদমান শিকদারের দিকে।
সাদমান শিকদার এবার রয়ে-সয়ে নিজের মোক্ষম চালটা চেলে দিলেন।
কণ্ঠের নমনীয়তা দূর করে এবার রূঢ় ও কঠিন কণ্ঠে বললেন —
“তবে… যদি ওই ছেলে এই শর্তে রাজি না হয় — তাহলে তোমাকে আমার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে।
আর এই বিষয়ে আমি কোনো ধরণের গাইগুই শুনবো না।
এটা তোমাকে আমার মতামত নয়, আমার সিদ্ধান্ত জানালাম।
বাকিটা তোমার ইচ্ছা।
তবে আমার অমতে যদি নিজের ভাইয়ের মতো কিছু করার চেষ্টাও করো — তাহলে এর পরিণাম কী হবে, সেটা নিশ্চয় তোমাকে বলে দিতে হবে না।
তুমি আমার মেয়ে — যথেষ্ট বুদ্ধিমান।
প্রথমবার ভুল করেছো — তাই শুধরে দিচ্ছি।
তুমি ভালো মতনই জানো, তোমার আব্বু আসলে কী রকম…
আর নিশ্চয়ই চাইবে না — ১৭ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক।
সময় পাল্টে গেলেও পালটায়নি সাদমান শিকদার আর তার সাম্রাজ্য।
সাদমান শিকদারের মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর ফল কী হয় — সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেবো।
তখন…
এখন যাও এখান থেকে।
আর ওই ছেলেটার সাথে শেষ বারের মতো কথা বলে নাও।
যদি রাজি হয় — তো আমার কাছে নিয়ে এসো।
আর যদি না হয়…”
পরিণীতা আর বাকি কথা শোনার জন্য এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না।
কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলো লাইব্রেরি রুম থেকে।
পরিণীতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসলেন সাদমান শিকদার।
যেটা জোর করে পাওয়া যায় না — সেটা কৌশলে আদায় করে নিতে জানেন তিনি।
জীবনের খেলায় চাল দেওয়াতে সাদমান সিকদারই সেরা।
আবিদ পুরো রাত জেগে স্টুডেন্টদের সব অ্যাসাইনমেন্ট চেক করতে করতে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো, হাত-পা, ঘাড়, পিঠ—শরীরের সমস্ত অস্থি – সন্ধি যেন ব্যথায় অবশ হয়ে আসছিল তার। সে মাত্রই সেহরি শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে এলো। উদ্দেশ্য—একটা লম্বা ঘুম, না হলে এখন আর বাঁচবে না সে। ঘরে-বাইরে এত চাপ, আর সহ্য হচ্ছে না বুঝি কিছুতেই। মানুষের শরীর একটু শান্তি, একটু বিশ্রাম তো চায়।
আবিদ সব কাগজপত্র গুছিয়ে রেখে ঘরের লাইট অফ করে বালিশে মাথা রাখতেই ক্লান্ত শরীরের চোখ দুটো গভীর তন্দ্রায় বুঝে আসলো। ঘুমটা একটু গাঢ় হতেই অসহ্যকর ফোনটা তুমুল শব্দে কানের পাশে বেজে উঠলো। ফোনের তীক্ষ্ণ শব্দে গভীর তন্দ্রা নিমিষেই ছুটে গেল আবিদের। বিরক্তিতে কপালে ২-৩ টে সূক্ষ্ম ভাঁজের সৃষ্টি হলো।
আলস্যে ঝিম ধরে গেল সারা শরীরে। সে আলগোছে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো। হয়তো পরি ফোন করেছে। কিন্তু ফোনের ওপাশের ব্যক্তির কণ্ঠ কানে পৌঁছাতেই বিরক্তিতে আবিদের মুখ তেতো হয়ে উঠলো, রাগের পারদ আকাশ ছুঁলো, মনে মনে রাগে চিরবিরিয়ে উঠলো।
ফোনের ওপাশ থেকে চিত্রলেখা বললেন, “সেহরি খেয়েছেন স্যার?”
আবিদ চোখ-মুখ কুঁচকে উঠে বসলো, তেতো কণ্ঠে জবাব দিলো, “জি…”
চিত্রলেখা ম্যাডাম আবার বললেন, “এখন আপনার শরীর কেমন আছে স্যার?”
“জি ভালো।”
“আন্টি কেমন আছেন স্যার?”
“জি ভালো।”
“ঔষুধগুলো ঠিক মতো খাচ্ছেন তো স্যার?”
“জি…”
আবিদকে এক-দুই শব্দে ঠান্ডা গলায় প্রশ্নের জবাব দিতে দেখে মুখটা চুপসে গেল চিত্রলেখার। দম চেপে থাকা অভিমানটা আর আটকে রাখতে পারল না সে। এমন নিঃশব্দে অবহেলার ভার সহ্য করতে না পেরে এবার ভণিতা ছাড়াই ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে বলল—
“আমার সাথে একটু ভালো মতো কথা বললে কী হয় স্যার? আপনার আম্মু ও তো আমার সাথে কত সুন্দর করে কথা বলেন। আপনি ও যদি একটু সুন্দর করে কথা বলেন, আপনার তো খুব একটা ক্ষতি হবে না। যার সাথে কথা বললে আপনার প্রাণসংশয় হতে পারে, আপনি তো প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ও তার সাথে দিব্যি কথা বলেন। তাহলে আমার বেলাতেই এত অবিচার কেন স্যার?”
চিত্রলেখার তীব্র অধিকার মিশ্রিত কথা বলার ধরনে আবিদের উত্তপ্ত মস্তিষ্কে রাগ ধরে গেলো।
‘এই মহিলা আসলে কী ভাবেন নিজেকে? সে কী বলতে চায়? সে কি নিজেকে পরির সমতুল্য মনে করে? বারবার নিজেকে পরির সঙ্গে তুলনা করে কী প্রমাণ করতে চায়?’
তবে এবার আর চুপ থাকতে পারলো না আবিদ। কণ্ঠের রাগ উগরে এলো। সে খানিক উচ্চস্বরে রাগ ঝেরে বললো,
“দেখুন ম্যাডাম, আপনি সব সময় আমাকে পার্সোনাল অ্যাটাক করবেন না। আমার একটা পার্সোনাল লাইফ আছে। সেখানে আমি কাকে কতটুকু গুরুত্ব দেবো, আর কাকে দেবো না সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কে আমার জীবনের কতটুকু জুড়ে আছে, কে আমার কি—সেটাও আমার ব্যাপার।
“হ্যাঁ, মানছি… আপনি সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। ওই রাতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন—আজ আমি বেঁচে আছি আপনার জন্য। এর জন্য আমি আপনার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। আমার প্রতি আপনার যে আর্থিক খরচ হয়েছে, সেটা আমি এই মাসেই ফেরত দিয়ে দেব। তবে হ্যাঁ, টাকা দিয়ে হয়তো কখনোই আপনার ঋণ শোধ করতে পারবো না—তা সত্যি। তাই ঋণ আছে বলেই আপনি আমাকে যখন তখন পার্সোনালি অ্যাটাক করতে পারেন না।
আমার পার্সোনাল স্পেসে ঢুকে পড়তে পারেন না। আমার একটা নিজস্ব ব্যক্তিগত জীবন আছে, সেখানে এভাবে কথায় কথায় আপনি আমাকে খোঁটাও দিতে পারেন না। সে অধিকার আপনার নেই। আর পরিকে নিয়ে তো একদমই নয়। পরি আমার জীবনে কী বা কতটা, তার কৈফিয়ত আমি কাউকে দেবো না, দিতে বাধ্য নই। আশা রাখবো, এরপর থেকে আপনি একটু বুঝে-শুনে কথা বলবেন ম্যাডাম।
ভালো থাকবেন। শুভ রাত্রি।”
একশ্বাসে মনের সব ক্ষোভ ঝেড়ে দিলো আবিদ।
কট করে ফোন কেটে দিয়ে কপাল চেপে ধরে বসলো। মাথায় তার দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। জীবনের সমস্যা কি কম আছে, যে আরেকটা উড়ে এসে ঝুড়ে বসতে চায়! আর তার আম্মু ও কেমন কয়েকদিন থেকে এই মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্য কান-মাথা ঝালাপালা করে দিচ্ছেন। উফফ্… অসহ্যকর। এবার ফাইনালি কিছু একটা করতেই হবে। এত মানসিক চাপ আর সে নিতে পারছে না।
আবিদ পুনরায় ফোনটা পাশে রেখে শুতে নিতেই… আবার উচ্চ শব্দে ফোন বেজে উঠলো। এবার আর ধৈর্য ধারণ করতে পারলো না আবিদ। ফোন রিসিভ করে তুলনামূলক চিৎকার দিয়ে বললো,
“প্লিজ ম্যাডাম, ডিস্টার্ব করবেন না। I need to sleep. Please!”
কিন্তু ওপাশ থেকে ফুপানোর শব্দ ভেসে আসতেই আবিদের হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠলো। মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে এলো,
“Angel…”
পরিনিতা এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমি কী করবো মাস্টার মশাই? বড়ো আপুর মতো আত্মহত্যা ছাড়া আমার কাছে ও আর কোনো উপায় নেই। আমি এত মহান নই মাস্টার মশাই, যে আপনার ভালো’র জন্য আপনাকে ছেড়ে দেবো। আমি পারবো না মাস্টার মশাই, আপনাকে ছেড়ে আমি কিছুই বাঁচতে পারব না… আবার চোখের সামনে আপনার কিছু হলে আমি সেটা ও সহ্য করতে পারবো না…”
পরিনিতার বলা বাক্যে আবিদের বিরক্তি আর ঘুম দুটোই কর্পুরের মতো উবে গেলো। সে উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,
“এসব কী বলছো পরি?”
পরিনিতা ফুপাতে ফুপাতে বললো,
“ঠিকই বলছি। আমি আপনার কথা আব্বুকে বলেছিলাম।”
— “তারপর?”
— “তারপর আব্বু বলেছে, আপনাকে বিয়ে করলে সারাজীবন আপনাকে আমাদের বাড়িতেই থাকতে হবে। আর যদি তা না হয়, আমি যেন আর কখনো আপনার সাথে কোনো যোগাযোগ না রাখি। এটা নাকি আপনার জন্য ভালো হবে না…”
“আমার আব্বু-চাচ্চু-ভাইয়ারা উপর-উপর ভালো মানুষি দেখালেও, ওরা ভিতরে ভিতরে অনেক খারাপ মাস্টার মশাই… এটা আমি খুব ভালো মতো বুঝে গেছি…”
বলে বাঁধনহারা কান্নায় ভেঙে পড়লো পরিনিতা।
বুক চিরে দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এলো আবিদের। এমন যে হবে, সে তো প্রথম থেকেই জানতো। তবে এবার আর ১৭ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেবেনা সে।
পরিকে সে নিজের করবেই।
তাই কয়েক সেকেন্ড দম নিয়ে ঠাণ্ডা কণ্ঠে বললো,
“আমাকে বিয়ে করতে চাও পরি? আমার বউ হতে চাও?”
আবিদের বলা বাক্যে স্তব্ধ হয়ে গেলো পরিনিতা। কান্না ও বন্ধ হয়ে এলো নিমিষেই।
আবিদ আবার প্রশ্ন করলো,
“বলো, বউ হবে আমার? আমি উল্টোপাল্টা কোনো কথা শুনতে চাই না। Just say Yes or No.”
কণ্ঠ কেঁপে উঠলো পরিনিতার। অস্ফুটে বললো,
“কিন্তু…”
আবিদ শক্ত কণ্ঠে বললো,
“এই ‘কিন্তু’ শুনতে চাই না। Yes or No?”
পরিনিতা কাঁপা কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো,
“Yes…”
মৃদু হেসে বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবিদ প্রশ্ন করলো,
“ভয় পাচ্ছো?”
পরিনিতা ছোট করে উত্তর দিলো, “উহু।”
আবিদ কণ্ঠে একটু বিরক্তি মিশিয়ে বলল,
“তোমার বাপ আস্ত একটা ইবলিশ, বুঝেছো?”
পরিনিতা মৃদু রেগে গিয়ে বললো,
“উনি যেমনই হোক, আমার আব্বু।”
হাসলো আবিদ, হেসে বললো,
“তোমার এই অসুর বাপকে শ্বশুর আমি বানাবোই। এখন শুনো…”
“হুম…”
আবিদ সিরিয়াস কণ্ঠে বলতে শুরু করল,
“ভালোমতো ভেবে নাও পরি। একবার এগোলে কিন্তু আর পিছনে তাকানোর সুযোগ নেই।”
বুক কেঁপে উঠলো পরিণিতার। তবু মনে সাহস যুগিয়ে বলল, “তাকাবো না।”
হাসলো আবিদ, তবে মুখে গাম্ভীর্য টেনে সিরিয়াস কণ্ঠে বললো,
“পরশু…”
পরিণীতা সব শুনে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। কম্পিত কণ্ঠে বললো, “কিন্তু মাস্টার মশাই…”
আবিদ একটু ধমকে বলল,
“একদম চুপ! যা বললাম, তাই। মরতে তো এমনিতেই হবে, ওমনিতেও হবে। তাহলে একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কোথায়?”
এবার একদম চুপ মেরে গেল পরিণীতা। কিন্তু ভয়ে তার হৃদ্পিণ্ড লাফাচ্ছে অনবরত। এত রিস্ক নেওয়াটা কি ঠিক হবে? তবুও সে মাস্টার মশাই কে বিশ্বাস করে। আর সত্যি তো—মাস্টার মশাই কে না পেলে তো তাকে এমনিতেও মরতে হবে। তাহলে মরতেই যখন হবে, তখন আফসোস থাকবে কেন?
পরিণীতা ও নিজে মনকে বুঝিয়ে নিলো—যারা তার কথা বিন্দুমাত্র ভাবে না, সে ও তাদের কথা ভাববে না।
আবিদ পরিণীতাকে ডেকে বললো, “এখন ঘুমাই অ্যাঞ্জেল।”
পরিণীতা সম্মতি জানিয়ে বললো, “জি।”
আবিদ লাইট অফ করে পুনরায় শুতে শুতে রহস্যময় কণ্ঠে বললো,
“আর মাত্র এক দিন, তারপর… রেডি থাকো।”
আবিদের বলার ধরণ দেখে গা কাঁটা দিয়ে উঠলো পরিণীতার। লজ্জা মিশ্রিত রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো তার শুভ্র রঙা মুখশ্রীতে।
আবিদ রসিকতা করে বললো,
“কল্পনা করতে হবে না, বাস্তবেই সব হবে। Be prepared, baby.”
পরিণীতা লজ্জায় ফোন কেটে দিলো।
হেসে উঠলো আবিদ।
এবার কিছু একটা হবে।
হয় বাঁচবে, নয় মরবে—
আর ঝুলে থাকবে না তারা।
আবিদ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ফোন পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।
sylhet- Jalalabad Cantonment Public School & College – JCPSC
দুপুর ১টা। আজ এখানে মেডিকেল ক্যাম্পিং-এর পঞ্চম দিন। আজকের পর আর ১০ দিন ক্যাম্পিং হবে, তারপর শেষ। সকল ডাক্তাররা ঢাকা ব্যাক করবেন। কলেজ ক্যাম্পাসের সিঁড়ির শেফটি দেয়ালের উপর পা ঝুলিয়ে বসে বসে ColorMatch Puzzle সলভ করছে প্রিয়স্মিতা। তার নিচের সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে বসে বসে একটা দুটো করে মানুষ গুনছে রুহি, জারা, নূহা, স্নেহা, দৃৃষ্টি, সৃষ্টি।
নুহা বলল, “এই ভাই, বাংলাদেশে যে এত সুন্দর সুন্দর টাকওয়ালা কাক্কু আছে, এটা তো আগে জানতাম না।”
স্নেহা বাকা হেসে বলল, “শুধু টাক দেখলি গাধি? টাকের সাথে টাকাটা দেখলি না।”
সৃষ্টি উৎসাহ নিয়ে বলল, “তাহলে এরকম একটা কাক্কু জীবনে থাকলে মন্দ হয় না, বল?”
দৃষ্টি মুখ বাকিয়ে বলল, “ওই টাকেই তেল মালিশ করতে করতে তোর জীবন যাবে, দেখিস।”
স্নেহা মুখ বাকিয়ে বলল, “তুই শালী শুধু ভয় দেখাতেই জানিস। বাংলাদেশে এরকম কত ফেমাস ফেমাস কাপোল আছে দেখিস না যারা—”
ভ্রু বাকিয়ে বললো, “যেমন?”
স্নেহা কণ্ঠের দ্বিগুণ উৎসাহ ঢেলে বলল, “যেমন মুস্তাক-তিশা, টম-মিষ্টি, লায়লা-মামুন। আরেকটা আছে, আপা, কিছু বললেই গালি দিয়ে দেবে, তাই নামটা আর নিলাম না।”
নুহা চোখ বড় বড় করে বলল, “এগুলো সব সুগার ড্যাডি তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু লায়লা-মামুনের কেসটা কি?”
স্নেহা দুষ্টু হেসে বলল, “সব জায়গায় বৈষম্য খোঁজো কেন শালী? মেয়েদের সুগার ড্যাডির প্রয়োজন হয় আর ছেলেদের হয় না নাকি? তাই মামুনের জন্য লায়লা সুগার মাম্মি। ইকুয়াল।”
সৃষ্টি মুখ বাকিয়ে বলল, “তোর যত বাজে কথা! দোয়া করে দিলাম, তোর জন্য মোশতাকের মতন একটা টাকলা ভুড়িওয়ালা কাকু জুটবে।”
নুহা দুষ্টু হেসে বলল, “কিন্তু আমাদের স্নেহা রানির তো নির্ভান ভাইকে পছন্দ।”
নুহার কথায় সবাই চোখ বড় বড় করে একত্রে তাকালো স্নেহার দিকে।
রুহি এবার বিরক্ত কণ্ঠে বললো, “থামবি তোরা?”
ঝাড়ি খেয়ে একসাথে চুপ মেরে গেল সবাই।
রুহি কয়েক সেকেন্ড বিরক্ত চোখে সবার এক্সপ্রেশন দেখে ঘাড় উঁচিয়ে প্রিয়স্মিতার দিকে তাকালো। প্রিয়স্মিতার এমন নির্লিপ্ত ভাব দেখে গা জ্বলে গেল রুহির। প্রিয়স্মিতার হাত থেকে পাজেলটা কেড়ে নিয়ে খেঁকিয়ে উঠে বললো —
“তোর ব্যাপারটা কী বলতো? আজ ৪ দিন হয়ে গেল, ডাক্তার চৌধুরীর কোনো পাত্তা নেই। তিনি ওইদিনের পর আর একবারও কলেজে আসলেন না। এর পরও তুই এমন নিভে আছিস কিভাবে?”
প্রিয়স্মিতা রহস্যময় চোখে তাকালো রুহির দিকে, বাঁকা হেসে দেয়াল থেকে এক লাফে নেমে পড়লো। চুলের লম্বা বেণিটা পিছনে ঠেলে রুহির হাত চেপে ধরে বললো —
“চল।”
আশ্চর্য হলো রুহি। কপাল কুঁচকে সন্দিহান কণ্ঠে বললো —
“কোথায়?”
প্রিয়স্মিতা বাঁকা হেসে টানতে টানতে বললো —
“চলো শালী, দেখাচ্ছি তোমাকে।”
বলে টেনে নিয়ে কলেজ মাঠের দিকে যাওয়া ধরলো। জারা, নূহা, স্নেহা, দৃৃষ্টি, সৃষ্টি — একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে এক লাফে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো।
স্নেহা ভ্রু বেঁকিয়ে বললো —
“কোথায় গেলো দুজন?”
দৃৃষ্টি, সৃষ্টি, জারা, স্নেহা — প্রিয়স্মিতার পেছন পেছন দৌড় দিতে দিতে বললো —
“তুই বসে গবেষণা কর কোথায় গেলো, আমরা বরং ততক্ষণে পরবর্তী সিনটা এনজয় করে আসি।”
বলে চলে গেলো।
নূহা নিজের ভাবনা চিন্তা ছুঁড়ে ফেলে বান্ধবীদের পিছু নিলো।
৯০,০০০ স্কয়ার ফিট বিশিষ্ট পুরো কলেজ মাঠ জুড়ে মেডিকেল ক্যাম্পিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডাক্তারদের ক্যাটাগরি অনুযায়ী মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে বাঁশ দিয়ে স্ক্রিন টানিয়ে ছোট-বড় বেশ অনেকগুলো প্রাথমিক চেম্বার বানানো হয়েছে। সেগুলোতে বিভাগ অনুযায়ী ডাক্তাররা সাধারণ মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দিচ্ছেন।
অর্ধভূমি পুরো মাঠ জুড়ে বিভিন্ন বয়সী মানুষদের আনাগোনা ও প্রচণ্ড ভিড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন মেডিকেল কর্মী ও সহকারী মেডিকেল স্টুডেন্টরা। এত ভিড়ের মূল কারণ — ভালো মনের ডাক্তার।
কত শত সাধারণ মানুষরা টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকে। দিনের পর দিন তারা চাইলেও একজন ভালো ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারে না, কারণ গুণগত মানসম্পন্ন ডাক্তারদের ফিস অনেকটা — যা অ্যাফোর্ড করার সামর্থ্য সবার থাকে না। সে জায়গায় প্রতি দুই বছরে একবার সিলেটের ভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশের সকল কোয়ালিফাইড ডাক্তারদের নিয়ে মেডিকেল ক্যাম্পিং-এর আয়োজন করা হয় এবং সাধারণ মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাই বিনামূল্যে ভালো ডাক্তার দেখাতে সিলেটের ভিন্ন প্রান্তের মানুষ এইখানে আসেন।
প্রিয়স্মিতা রুহির হাত চেপে ধরে টানতে টানতে মাঠের অপর প্রান্তের একটা চেম্বারের পেছনে এসে দাঁড়ালো।
জায়গাটা বেশ বনজঙ্গলে ঢাকা, পাশে হতো পচা ডোবাও আছে।
রুহি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আশেপাশে চোখ বুলাতেই —
“আঃ!” করে উঠলো।
সাথে সাথেই ওর মুখ চেপে ধরলো প্রিয়স্মিতা।
রুহির পায়ের পাতায় সোজোরে লাথি মেরে ফিসফিসিয়ে বললো —
“ওই শালী, চিৎকার দিয়ে কেস খাওয়াবি নাকি? মশার কামড় যেমন-তেমন!”
প্রিয়স্মিতার লাথি খেয়ে আরও ব্যথায় কুকিয়ে উঠলো রুহি।
জোরে চিৎকার দিতে চাইলো, কিন্তু প্রিয়স্মিতা মুখ চেপে ধরেছে বিধায় পারলো না।
অসহায় চোখে তাকালো প্রিয়স্মিতার দিকে।
তার মন চিৎকার দিয়ে গেয়ে উঠলো সেই ভাইরাল গানের এক লাইন —
“আমি চিৎকার দিয়ে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার!”
প্রিয়স্মিতা ছাড়ছে না দেখে এবার রুহি ও প্রিয়স্মিতার পায়ে সোজোরে লাথি মারলো।
ব্যথায় চোখমুখ কুচকে গেল প্রিয়স্মিতা।
রুহিকে ছেড়ে দিয়ে “আঃ!” করতে চাইলে এবার রুহিও প্রিয়স্মিতার মুখ চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো —
“শালী, তুই তোর স্ট্রবেরি ডাক্তার দেখানোর নাম করে এখানে তোর আত্মীয়-স্বজন ওরফে মশাদেরকে আমার রক্ত ডোনেট করাতে এসেছিস? আবার মশার কামড়ে চুলকাতে ও দিচ্ছিস না!”
প্রিয়স্মিতা এবার কৌশলে রুহিকে ল্যাং মেরে নিচে ফেলে দিলো।
দৃৃষ্টি, সৃষ্টি, জারা, স্নেহা, নূহা পাশে দাঁড়িয়ে গুলগুল চোখে যেন লাইভ টম অ্যান্ড জেরি কার্টুন দেখছে।
জারা এসে রুহিকে টেনে তুলে শরীরের ধুলোবালি ঝেড়ে দিলো।
ফুঁশ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো —
“তোরা কি এখনও চুলাচুলির বয়স পার করতে পারিসনি?”
দৃৃষ্টি এসে জারাকে ধমকে বললো —
“তোকে এতো মাতব্বরি মারতে কে বলেছে? ভালোই তো মজা লাগছিলো দেখতে!”
দৃৃষ্টি আবারও রুহি আর প্রিয়স্মিতার দিকে তাকিয়ে বললো —
“গার্লস, তোমরা কন্টিনিউ করো।”
রুহি আর প্রিয়স্মিতা একে অপরের দিকে তাকিয়ে একসাথে দৃৃষ্টির পায়ের পাতায় লাথি মেরে মুখ চেপে ধরলো।
প্রিয়স্মিতা বাঁকা হেসে বললো —
“এবার এনজয় কর।”
দৃৃষ্টি দুই হাতে মুখ চেপে ধরে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে উঠলো।
নূহা প্রিয়স্মিতার পাজেলটা সলভ করতে করতে বললো —
“তোদের এসব সার্কাস দেখাবি বলে কী নিয়ে আসছিস?”
নূহার কথায় বাঁকা হাসলো প্রিয়স্মিতা।
কলেজ ড্রেসের পকেট থেকে একটা ধারালো ব্লেড বের করলো।
ব্লেড দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো ওরা।
সৃষ্টি কৌতূহলী কণ্ঠে বললো —
“তুই স্যুইসাইড করতে চাস প্রিয়ো? প্লিজ বোন, তুই স্যুইসাইড করলে ওইদিকে গিয়ে কর, এখানে মরলে আমরা ফাঁসবো। আমরা বেচারি এখনো জামাইয়ের মুখটা পর্যন্ত দেখিনি!
কত স্বপ্ন—আমাদের জামাই হবে, হালিতে হালিতে বাচ্চা কাচ্চা হবে—সেসব স্বপ্ন আমার স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।”
প্রিয়স্মিতা বিরক্ত চোখে তাকালো ওর দিকে, তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
পেছন ফিরে খুব সূক্ষ্মভাবে মেডিকেলের গ্রিন স্ক্রিনটা ভার্টিকালভাবে কেটে ফেললো।
আচমকা এই কাণ্ডে বিস্মিত হলো মেয়েরা।
প্রিয়স্মিতা স্ক্রিনটা একটু ফাঁক করে ভিতরে দৃৃষ্টি পাত করলো।
এসব দেখে কৌতূহল বাড়লো ওদের।
ওরা ও দ্রুত এগিয়ে এসে স্ক্রিনের কাটা অংশে চোখ রাখলো।
অতিরিক্ত গরমে শুদ্ধর ফর্সা ত্বক টকটকে লাল আপেলের মতো হয়ে গেছে।
শুদ্ধ এ.সি. ছাড়া থাকতে পারে না, আর সেখানে কিনা এই ৪০ ডিগ্রি গরমে এ.সি. তো দূর, একটা ভালো মানের পাখা পর্যন্ত নেই!
কেবল মাথার উপর একটা আদি কালের সিলিং ফ্যান বিকটভাবে শব্দ দূষণ করে ঘুরে চলছে।
শুদ্ধ রুমাল দিয়ে নিজের কপালের ঘামটুকু মুছে পরবর্তী পেশেন্টকে ডাকলো —
“আসুন।”
ঘরের পর্দা সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন ফুকলা দাঁতের ৪০ ঊর্ধ্ব এক লোক।
শুদ্ধ প্রেসক্রিপশন প্যাডে কলম চালাতে চালাতে শান্ত কণ্ঠে বললো —
“বসুন।”
ভদ্রলোক এসে শুদ্ধর সামনে চেয়ারে বসলেন।
শুদ্ধ প্যাড থেকে মাথা তুলে তাকে ২ সেকেন্ড পর্যবেক্ষণ করে বললো —
“বলুন, আপনার কী সমস্যা?”
সমস্যার কথা শুনে লোকটার শ্যামবর্ণের মুখটা এইটুকুনি হয়ে গেল।
তিনি হতাশাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন —
“আজ কয়েকটা মাস হলো ডাক্তার সাব, খালি বুকে এই পাশে, ওই পাশে—দুই পাশেই ব্যথা করে। আর এই জন্য কাজে যেতে পারি না, বলে বউটা খালি খিটখিট করে।”
শুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে ওনার কথা শুনলো।
অতঃপর স্টেথোস্কোপটা কানে পড়ে ওনার বুকে চেপে ধরে বললো —
“জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিন।”
লোকটা ও তাই করলো।
শুদ্ধ এবার ওনার হাতে বি.পি. মনিটরের কাফ পরিয়ে দিলো।
ব্লাম্বারটা হাত দিয়ে চেপে চেপে বাল্ব করতে করতে ওনার প্রেশার মেপে বললো —
“আপনার বি.পি. অনেক হাই — ১৪০/৯০ mmHg।”
শুদ্ধর কথা লোকটার মাথার উপর দিয়ে গেল।
লোকটা বুঝতে না পেরে বললো —
“এ.বি. হেইডা আবার কী ডাক্তার সাব?”
শুদ্ধ ওনার হাত থেকে কাফটা খুলে নিতে নিতে বললো —
“ব্লাড প্রেসার, মানে আপনার উচ্চ রক্তচাপ আছে। সেটা অনেক বেশি। এটা কমাতে হবে।”
লোকটা আবারো হতাশার একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললো —
“আপনার ঘরে ও যদি আমার বউ এর মতো ওরকম একখান বউ নামক গোপীযন্ত্র বাস করত, তাহলে আপনার রক্তচাপ ও চড়চড় করে মাথায় উঠে যেত ডাক্তার স্যাব।”
আচমকা লোকটার এহেন কথায় কেশে উঠলো শুদ্ধ।
গলা খাকারি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো —
“এর আগে ও কোথাও ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?”
লোকটা মাথা নাড়িয়ে বললো —
“হ্যাঁ ডাক্তার স্যাব, আমার এলাকার এক ডাক্তারকে দেখাইছিলাম। উনি কয়েকটা টেসও দিয়াছিলেন।”
“টেস্টগুলো করাইছেন?”
“জি ডাক্তার সাব।”
“সাথে এক্সরে আনছেন?”
শুদ্ধর কথায় লোকটা একটু লজ্জা পেলো।
মাথা নিচু করে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল —
“না ডাক্তার সাব, বউকে সাথে এনেছি। এক্সরে সাথে আনলে বউ মেরে ফেলবে।”
লোকটার কথায় আহাম্মক বনে গেলো শুদ্ধ!
দৃষ্টি, সৃষ্টি, জারা, স্নেহা, নুহা, রুহি, প্রিয়স্মিতা — একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে একসাথে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
ঘরের পেছন থেকে এতগুলো মেয়ের হাসির শব্দ ভেসে আসাতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো শুদ্ধ।
গলা উঁচিয়ে বাইরে থাকা নার্সকে ডাকলো —
“সিস্টার!”
শুদ্ধর কথায় একপ্রকার দৌড়ে এলেন নার্স।
ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন —
“জি স্যার?”
শুদ্ধ চোখ মুখে স্বাভাবিক মাত্রার গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললো —
“পেছনে কে বা কারা অসভ্যের মতো হাহাহিহি করছে?”
নার্স তাড়াহুড়ো করে বললেন —
“এখনই দেখছি স্যার।”
বলে ঘরের পেছন দিকে চলে গেলেন।
শুদ্ধও আবার পেসেন্ট দেখায় মনোনিবেশ করলো।
এদিকে কেউ আসছে বুঝতে পেরে প্রিয়স্মিতা, রুহি, স্নেহা, দৃষ্টি, সৃষ্টি, জারা, নুহা — উল্টো ঘুরে ভো দৌড় দিলো।
দৌড়াতে দৌড়াতে লুকের ভিড়ে নির্ভানের সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে গেলো প্রিয়স্মিতা।
পড়ে যেতে নিলে নির্ভান ওর হাত টেনে ধরল, চোখের চশমা ঠিক করে বললো —
“এখনই তো পড়ে যেতে চড়ুই, এভাবে ছুটাছুটি করছো কেন?”
নির্ভানকে দেখে জারা, স্নেহা, নুহা, রুহি, দৃষ্টি, সৃষ্টি — চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেলো।
কিন্তু ফেঁসে গেলো প্রিয়স্মিতা।
এখন তাকে উকিলের মতো জেরা করবে এই লোকটা।
প্রিয়স্মিতা অদৃশ্য হাতে নিজের কপাল চাপড়ে বললো —
“দুনিয়াতে ধাক্কা খাওয়ার জন্য কি আর ব্যাটা ছেলে ছিলো না?”
নির্ভান প্রিয়স্মিতাকে ভাবনার সাগরে ডুবে যেতে দেখে তাকে সোজা করে দাঁড় করালো।
কোমল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো —
“ওদিকে কোথায় গেছিলে? বললে না তো?”
প্রিয়স্মিতা একটা ভ্যাটকি মেরে বললো —
“ওদিকে? হেহে… আজ কতটুকু গরম পড়েছে, মাপতে গেছিলাম নির্ভান ভাই !”
কথাটা বলেই জিভ কাটলো প্রিয়স্মিতা।
“এই ছেলেটা কি সব সময় তাকে বাঁশ দেওয়ার জন্য বাঁশ ঝাড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে? আর এই ছেলেটার সামনে পড়লেই প্রিয়তার যত বলদি মার্কা কাজ কাম করে, ছ্যাহ!”
প্রিয়স্মিতার এমন উদ্ভট কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেললো নির্ভান।
সন্দিহান চোখে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো, বুকে হাত গুঁজে বললো —
“কেমন গরম পড়েছে, তার জন্য ওদিকে কেন যেতে হবে? ফোনে তাপমাত্রা দেখে নিলেই তো হয়! আর গরম কি শুধু ও দিকেই পড়েছে? সব জায়গাতেই পড়েছে! তাহলে ওদিকে কেনো?”
প্রিয়স্মিতা চোরের মতো নজর লুকালো এদিক-ওদিক।
এতে সন্দেহ বাড়লো নির্ভানের।
সে প্রিয়স্মিতার হাত ছাড়তেই আর কোনো দিকে না তাকিয়ে, কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে — সোজা ভো দৌড় দিলো প্রিয়স্মিতা।
এতে নির্ভানের ভ্রু আরও খানিকটা কুঁচকে গেলো।
সে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইলো প্রিয়স্মিতার যাওয়ার পানে।
মনে মনে বললো —
“আবার কোথায় না জানি, কোন খিচুড়ি পাকিয়েছে এসে! আল্লাহ মালুম, এই মেয়েটাকে নিয়ে যে ভবিষ্যতে আমায় অনেক হেঁপা পোহাতে হবে, সে আমি এখন থেকেই বেশ বুঝতে পারছি।”
নির্ভানকে তপ্ত রোদের মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো নিলয়।
কাঁধে হাত রেখে বললো —
“মামা, এত গভীর প্রেমে পড়া ভালো না। একটা গান মনে আছে তো? — ‘প্রেম করে ভাসলো সাগরে, অনেকে পায়লো না কূল।’
পরে দেখবি, এই লাইনটা তোর জীবনে সত্যি হয়ে যাবে!”
হাসলো নির্ভান।
নিলয়ের পেটে ঘুষি মেরে বললো —
“ডুবেই তো মরতে চাই, যদি সে আমায় ডুবতে দেয়। একেবারে তলিয়ে যেতে চাই তার প্রেম সাগরে, আর ভাসতে চাই না!”
বাঁকা হাসলো নিলয়।
দুজনে মিলে ভার্সিটির দিকে যেতে যেতে বললো —
“তবু ও মামা, সামলে। এই বয়সী মেয়েদের মন কখন কোন দিকে চলে যায়, তুমি বুঝতেই পারবে না। তাই খুব সাবধান হে।”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো নির্ভান।
আহত কণ্ঠে বললো —
“এইজন্যই তো সব সময় চোখে চোখে রাখি, পাছে যদি হারিয়ে যায়…”
আমি যে বড়, অচল তাকে ছাড়া — আর কিছু বললো না নিলয়।
দিনের শেষ ভাগ
বয়জ্যেষ্ঠ মুরুব্বিরা বলেন, রোজা রমজানের দিন নাকি অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি বরকতময় হয়। আল্লাহ নাকি উনার নেক বান্দাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেন এই সময়… প্রিয়তার কাছে ও কথাটা একদম সত্যি মনে হয়। তার কাছে ও অন্যান্য দিনের তুলনায় এই রোজার দিনগুলো একটু বেশি লম্বা মনে হয়, বিশেষ করে যোহরের পরের সময়টা। কেন যেন কাটতেই চায় না! খালি বুক ধড়ফড় করে, আলসেমি লাগে। তবে আলসেমি লাগছে বলেই তো আর শুয়ে থাকা যায় না!
এখন বিকেল ৪টা ৪১। আজকের প্রথম ইফতারি ৬টা ১৩-তে। তাই সেই অনুযায়ী প্রিয়তা, পরিণীতা, প্রেরণা, ঊষা, ইনায়া, প্রহেলিকা ইফতারি বানানোর কাজে লেগে পড়েছে। রমজানের পুরো মাস ইফতারি বানায় বাড়ির মেয়েরা, আর সেহরির জন্য রান্না করেন গিন্নিরা। উনারা ইফতারি বানাতে চাইলেও প্রহেলিকার সাফ মানা — করে দিয়েছে, তাই এই বিকেল বেলা উনারা একটু শুয়ে বসে রেস্ট নেন।
প্রহেলিকা মনোযোগ সহকারে আটা মাখছে। ইনায়া ও ঊষা, দুই ঝা নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলতে বলতে বেগুনির, আলুর চপ, ডালের বড়া, পেঁয়াজু সহ বিভিন্ন আইটেমের তেলেভাজা বানাচ্ছে। থিরা ফল কাটছে, আর প্রিয়তা খুব যত্ন নিয়ে শরবত বানাচ্ছে। সে তরমুজ কেটে কুচি কুচি করে বরফের টুকরো, রুআফজা আর ঠান্ডা দুধ মিশিয়ে স্পেশাল “মোহাব্বতের শরবত” বানাচ্ছে। এর আগে সে লেবু, কমলাসহ আরও কয়েক প্রকার শরবত বানিয়ে ডিফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখেছে।
প্রিয়তা শরবত বানিয়ে সেটা বড় একটা জগে ভরে ফ্রিজে তুলতে নিলেই, পেছন থেকে কেউ তার ওড়নার কোনা টেনে ধরল। পেছনে না ঘুরেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো প্রিয়তা। পাশে থেকে একটা বড় গ্লাস তুলে, এক গ্লাস শরবত তন্ময়ের হাতে ধরিয়ে দিলো।
তন্ময় চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে তার প্রিয় আপুর দিকে। প্রিয়তা ওর হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে বললো, “এটা তর কত নম্বর ইফতারি, ভাই?”
তন্ময় প্রিয়তার হাত থেকে শরবতের গ্লাসটা নিয়ে এক শ্বাসে মেরে দিলো, প্রিয়তার ওড়নায় হাতা মুখ মুছে বললো, “So yummy, আপু, অনেক রিফ্রেশিং!”
থিরা ওর মাথায় ঠুকা দিয়ে বললো, “বলি না তো, এটা তোর কত নম্বর ইফতারি?”
তন্ময় প্রিয়তার মুখের সামনে গ্লাসটা ধরে বললো, “বড় আম্মু বলেছেন, আমি ছোট মানুষ, পুরো রোজা একবারে রাখতে পারবো না, তাই দুপুর বেলা ভাত খেয়ে অর্ধেকটা, আর সন্ধ্যা বেলা তোমাদের সাথে ইফতারি করে বাকি অর্ধেকটা — এভাবে পুরোটা রাখবো।”
তন্ময়ের কথায় ঊষা আর ইনায়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। প্রিয়তা পুনরায় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে গ্লাসে শরবত ঢেলে দিলো।
থিরা মুখ বাকিয়ে বললো, “কাস, আমারও এভাবে অর্ধেক অর্ধেক করে রোজা রাখতে পারতাম। আসলে আমাদের তাকদিরটাই খারাপ!”
তন্ময় দ্বিতীয় গ্লাস খেতে খেতে বললো, “বড় আম্মু বলেছেন, এভাবেও রোজা রাখা যায়। তুমি রাখবে, আপু? তাহলে নাও, তুমি-ও খাও।”
শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো তন্ময়।
লাফিয়ে থিরা দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে বললো, “না না, থাক ভাই! তুই খা, আমার এত সুখের দরকার নেই।”
ওদের কথার মধ্যে কিচেনের সামনে এসে দাঁড়ালো প্রণয়।
বড়ো ভাশুর দেখে ঊষা ও ইনায়া তাড়াতাড়ি করে মাথায় কাপড় দিলো।
প্রণয় সকলের দিকে এক নজর তাকিয়ে বললো, “আমার একজন হিন্দু গেস্ট আসবে আজ, তাই বিফের কিছু রেখো না।”
বলেই চলে গেলো প্রণয়।
প্রণয়কে দেখে হার্ট ফার্স্ট হয়ে গেলো প্রহেলিকার। মুচকি মুচকি হেসে আবার রুটি বেলায় মন দিলো। প্রহেলিকার ঠোঁটের মৃদু হাসি কেন জানি সহ্য হলো না প্রিয়তার — কেমন বিষ খেয়ে বিষ হজম করার মতো মনে হলো!
প্রণয়ের কথামতো বিফ আবার ফ্রিজে তুলে, শুধু মুরগির মাংস আর খাসির মাংস রান্না বসানো হলো।
ইফতারের মাত্র ৪০ মিনিট বাকি। তাই প্রিয়তা সালাদ বানাচ্ছে, প্রেরণা আর থিরা ডাইনিং টেবিল সেট করছে।
এর মধ্যেই বড় একটা ঘামলা হাতে করে নিয়ে কিচেনে ঢুকলো অরণ্য ও তন্ময়। এত বড় গামলা দেখে হা হয়ে গেলো।
ঊষা, ইনায়া, প্রিয়তা ও থিরা প্রিয়তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দেখে, অরণ্য গামলাটা ক্যাবিনেটের উপর রেখে, তাড়া দিয়ে বলল, “এই কালাচাঁদের বউ, সর সামনে থেকে!”
প্রিয়তা ও ভ্রু কুঁচকে সরে গেলো।
অরণ্য উপর থেকে বড় মুড়ির ডাব্বাটা বের করে, বেশ আধা গামলা মুড়ি ঢাললো।
গামলায় এত মুড়ি ঢালতে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলো ঊষা ও ইনায়া। তবে প্রিয়তা আর থিরা বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালো না, কারণ এই কাহিনি তাদের বাড়িতে প্রতিবছরই চলে।
অরণ্য আধা গামলা মুড়ি ঢেলে, সাথে ৩ প্লেট বেগুনি, ৩ প্লেট পেঁয়াজু, ১০টা সিঙাড়া, ৫টা চপ দিয়ে হাতে গ্লাভস পরে ভালো মতো চটকে চটকে মুড়ি মাখতে শুরু করলো।
অরণ্যের মুড়ি মাখানো দেখে ঊষা ও ইনায়া বেশ খুশি হলো, না হলে তাদেরকেই মুড়ি মাখতে হতো।
ওদেরকে খুশি হতে দেখে থিরা ফুঁশ করে নিশ্বাস ছেড়ে বললো, “ভাবীজানেরা বেশি খুশি হয়ে কোনো লাভ নেই। মুড়ি তোমাদেরকেই মাখতেই হবে। পিকচার আভি বাকি হ্যায়, মেরি জান — দেখো না, আগে আগে হোতা হ্যায় কিয়া।”
থিরার কথার সারমর্ম কিছুই বুঝলো না ঊষা-ইনায়া, তবে প্র্যাকটিক্যালি বুঝিয়ে দিলো অরণ্য।
ভালো মতো মুড়ি মেখে এবার ফ্রিজ খুলে আসল জিনিস বের করলো — রসগোল্লার গামলা এনে, সেখাম থেকে বড় বড় ৮ পিস রসগোল্লা মুড়ির গামলায় ঢেলে দিলো।
মুড়ি মাখাতে রসগোল্লা মেশাতে দেখে ইনায়া আর ঊষার চোখ দুটো ও রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে গেলো।
অরণ্য রসগোল্লার পাশাপাশা জিলাপি আর গুড় মিশিয়ে আরও ভালো মতো চটকে চটকে মাখতে শুরু করলো।
মুড়ি মাখাতে গুড়, রসগোল্লা, জিলাপি মিশাতে দেখে ইনায়ার গা গুলিয়ে উঠলো।
প্রিয়তার আর সহ্য হলো না, সে কন্ঠে হতাশা মিশিয়ে বললো, “মুড়ির ওপর এমন অমানবিক নির্যাতনটা না চালালেও হয় না, ছোট ভাইয়া! দেখেই তো বমি পাচ্ছে!”
অরণ্য আরেকটু মিষ্টির রস মিশিয়ে মাখতে মাখতে বললো, “একটু খেয়ে দিখবি কেমন… সাধের জিনিস! এই স্বাদের ভাগ হবে না বুঝলি! এই অখাদ্যগুলো গিলতেই হবে ভেবে গা গুলিয়ে উঠলো প্রিয়তা।
সে নাক শিটকে বললো, “এগুলো সুস্থ মানুষের খাবার নয়। তুমি খাও!”
তন্ময় মুড়ির গামলা থেকে এক মুঠো মুখে পুরে দিলো।
অরণ্য ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো, “কেমন হয়েছে পিচ্চু?”
তন্ময় চোখ বড় বড় করে সেই এক্সপ্রেশন দিয়ে বললো, “ফাটাফাটি!”
অরণ্য বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে মুড়ির গামলা নিয়ে চলে গেলো।
এসব দেখে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না ঊষা-ইনায়া।
প্রিয়তা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পুনরায় মুড়ি মাখতে শুরু করলো। কারণ, এসব অখাদ্য আর যেই খাক — প্রণয় ভাই কোনোদিনও ও খাবে না।
প্রিয়তা মুড়ি মাখা শেষ করে, সব কিছু রেখে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে।
সন্ধ্যা ছয়টা এক।
ইফতারের আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি। শিকদার বাড়ির ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বড়ো বড়ো দুটো মাদুর পেতে, তার চার পাশে গোল হয়ে বাড়ির ছোটো বড়ো সকলে ই ইফতারের জন্য বসেছেন। বাড়ির মেয়ে-বউরা যে যার স্বামীর পাশে বসেছেন। বিশেষ করে, প্রহেলিকা তো পারেই না, প্রণয়ের কোলে উঠে পড়ে। প্রণয় শুধু দাঁতে দাঁত পিষচ্ছে, অথচ কিছুই বলতে পারছে না। এসব দেখে প্রিয়তার ভিতরটা জ্বলন্ত কয়লার মতো ধিকি ধিকি জ্বলছে। হঠাৎ হঠাৎ চোখও ঝাপসা হয়ে আসছে, তবু ও বাড়ির সবার সামনে স্বাভাবিক দেখানোর প্রচেষ্টা। সে দীর্ঘনিশ্বাসে বারন্ত জ্বালাটা বুকে চাপা দিয়ে সবার জন্য প্লেটে প্লেটে ইফতারি বাড়তে শুরু করলো।
অরণ্য, সমুদ্র, তন্ময় আর রাজ, নিজের মুখের সামনে সেই মুড়ি মাখার গামলাটা নিয়ে বসে আছে। তাদের গুলগুল চোখগুলো সেই গামলাটার উপর স্থির। তাদের ভাবখানা এমন, যেন আজানের ধ্বনি কানে আসা মাত্রই তারা এই গামলার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে! আর মাত্র কিছুক্ষণ… ইতিমধ্যে শিকদার বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠলো।
কলিং বেলের শব্দে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো প্রণয়। আজকেই তার এসব অভিনয়ের ভেজাল মিটবে। সে বসা থেকে উঠে গিয়ে সদর দরজা খুলে দিলো। দরজা খোলার সাথেসাথেই প্রণয়কে চেপে ধরলো প্রণয়ের বয়সী এক যুবক। হাসোজ্জ্বল মুখে পেটে কিল-ঘুষি মেরে বললো — “শালা, বেয়াই বানাবি না ভালো কথা, কিন্তু মাঝে মাঝে মনে তো রাখতে পারিস!”
আবির্ভাবকে দেখে চোখে হাসলো প্রণয়। কাঁধ চাপড়ে বললো — “আগে বিয়ে করে ছেলের বাপ হ, তারপর বেয়াই বানাবো কিনা ভাববো।”
আবির্ভাব ভিতরে আসতে আসতে বাঁকা হেসে, দুষ্টু কণ্ঠে বললো — “আমি তো ছেলের বাপ আজ না হয় ঠিকই হয়ে যাবো, কিন্তু তুই মেয়ের বাপ হবি কবে?”
আবির্ভাবের পিঞ্চ মারা কথায় প্রণয়ের মুখের হাসি নিভে গেলো। আর কোনো উত্তর দিলো না। প্রণয় ও আবির্ভাব ড্রয়িং রুমে চলে এলো।
প্রণয়ের সাথে এখন অপরিচিত ছেলেকে দেখে অনুশ্রী বেগম মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন — “উনি কে, আব্বু?”
প্রণয় হালকা হেসে, আবির্ভাবকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো — “ও হচ্ছে সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর আবির্ভাব রায়চৌধুরী, আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। ওকে আজকে আমি আমাদের বাসায় ইনভাইট করেছিলাম।”
আবির্ভাব ও সবার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো, বিনম্র কণ্ঠে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো।
আবির্ভাবকে দেখে প্রেরণা ও থিরার চোখ রীতিমতো হা হয়ে গেলো। থিরা গালে হাত দিয়ে প্রিয়তার গায়ে হেলে পড়লো, বুকে হাত চেপে ধরে বললো — “হুসনে কি পরী শুনেছিলাম, কিন্তু এত হুসনে কা পারা? আয় হায়! ছোটো আপু, মে তো গায়া!”
থিরার ঢং দেখে বিরক্ত হলো প্রিয়তা। চাপা কণ্ঠে ধমকে বললো — “উনি প্রণয় ভাইয়ের বন্ধু, মানে তোর বয়সের দ্বিগুণের থেকেও ২-৩ বছর বেশি হবে, বেয়াদব!”
প্রিয়তার কথায় পাত্তা দিলো না থিরা। ড্যাব ড্যাব করে আবির্ভাবের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো — “পেয়ার মে উমর কা কেয়া কাম হ্যায়, বাতাও! মেরা দিল তো উস হুসনে কা পারা কে লিয়ে দিওয়ানা হো গেয়া।”
এবার প্রেরণাও প্রিয়তার গায়ে হেলে পড়লো। দুই হাতে বুক চেপে ধরে বললো — “বেহনা, মে ভি ফিসাল গায়া!”
দুজনের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলো প্রিয়তা।
প্রিয়তার পাশেই বসে ছিলো স্বেতা। সে রাগে ফুঁস ফুঁস করতে করতে তাকালো আবির্ভাবের দিকে। আবির্ভাব বেশ স্টাইল মেরে এসেছে, দেখতে ও পুরো চকোলেট বয় লাগছে। স্বেতা আবির্ভাবের দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বললো — “একবার শুধু তোকে একা হাতের কাছে পাই, তারপর মেয়ে পটানোর স্বাদ যদি জন্মের মতো গুছিয়ে দিতে না পেরেছি, তবে আমার নামও মৃত্তিকা চৌধুরী স্বেতা নয়!”
আবির্ভাবকে দেখে সবার রিঅ্যাকশন যেমন তেমন, তবে প্রহেলিকার রিঅ্যাকশন দেখার মতো। সে আবির্ভাবকে এখানে দেখে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, পুরো পৃথিবীটা তার মাথায় চক্রের মতো ঘুরছে। এসি লাগানো, তার পরও প্রহেলিকা দর দর করে ঘামতে শুরু করেছে মুহূর্তেই। ভয়ে তার পা জমে যাচ্ছে, হৃদপিণ্ডটা মনে হচ্ছে এখনই ব্লাস্ট করবে! সে কি তবে কোনো প্রতারণার শিকার হলো?
প্রণয় আর আবির্ভাব বসতেই, প্রণয়ের ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। সে পকেটে হাত দিয়ে ফোনটা বের করতেই তার চেহারার এক্সপ্রেশন পাল্টে গেলো। দুই ভ্রুর মাঝবরাবর সূক্ষ্ম দুই একটা রেখা দেখা গেলো। সে আবির্ভাবের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো — “তুই বস, আমি একটু আসছি।”
বলেই কল রিসিভ করে বাড়ির উত্তর দিকে চলে গেলো। আপাতত বসার সব জায়গা ফুল থাকায়, আবির্ভাব গিয়ে প্রহেলিকার পাশে বসলো, তার ভাবখানা এমন যে সে প্রহেলিকাকে কখনো দেখেইনি, চিনেও না।
তবে প্রহেলিকার ভয় এতে আরো বেড়ে গেলো। ভয়ে যেন সে নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে।
ততক্ষণে বাইরে থেকে ভেসে এলো আজানের সুমধুর ধ্বনি। প্রিয়তা আর ঊষা, সবার হাতে হাতে ইফতারের প্লেট আর গ্লাস তুলে দিলো। সকলে বিসমিল্লাহ বলে দোয়া পড়ে রোজা খুললেন। তবে প্রণয় এখনো আসেনি।
এদিকে দেরি করে ইফতার করা উচিত নয়, তাই প্রিয়তা দ্রুত বাম হাতে শরবতের একটা গ্লাস তুলে, ডান হাতে দুই-তিনটা খেজুর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কাউকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে, বাড়ির উত্তর দিকে চলে গেলো।
প্রণয় উত্তরের ব্যালকনি পেরিয়ে বাগানে পৌঁছে গেছে। প্রণয় দ্রুত কণ্ঠে ওপাশের ব্যক্তিকে বললো — “Partner, I will call you back later.”
ওপাশ থেকে কী বললো শোনা গেলো না, তবে প্রণয় আর শোনার অপেক্ষাও করলো না। কল কেটে পেছনে ফিরতেই, কারো ছোট্ট দেহের সাথে মৃদু ধাক্কা লেগে গেলো। সাথেসাথেই গ্লাসটা শক্ত করে চেপে ধরে, চোখ-মুখ খিচে বন্ধ করে নিলো প্রিয়তা। দুজনের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল এক ঝাঁক সাদা সারস।
দিনের শেষ ভাগ, সূর্য প্রায় অস্ত যাওয়ার পথে। সেই অস্ত যাওয়া সূর্যের শেষ এক চিটা কমলা রঙা আলো এসে আঁচড়ে পড়েছে প্রিয়তার শুভ্র রঙা মুখশ্রিতে। আর তাতেই যেন দৃষ্টিতে ঘোর লেগে গেলো প্রণয়ের। বুকের ভিতর থাকা ছোট্টো হৃদয়টা ধক ধক করে উঠলো। মন অনমনে বলে উঠলো —
“তুমি নারী, নাকি পরি? বিধি নিজেই করবে ভুল!”
প্রিয়তা সামনের ব্যক্তির কোনো সরা শব্দ না পেয়ে, ধীরে ধীরে আঁখি পল্লব মেলে উপরে তাকাতেই, তার নীলাভ চোখের কালমণি দুটো কারো গভীর দৃষ্টির মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়লো।
ঘোরের মাঝেই প্রণয়ের দিকে শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিলো প্রিয়তা।
শরবতের গ্লাস মুখের সামনে ধরতেই ঘোর কাটলো প্রণয়ের। সে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বড়ো বড়ো দুটো নিঃশ্বাস ফেলে, প্রিয়তার হাত থেকে শরবতের গ্লাসটা নিলো। শরবতের গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে নিতেই, তার মুখের সামনে একটা খেজুর তুলে ধরলো প্রিয়তা।
নিচু স্বরে, কোমল কণ্ঠে বললো — “নবীজির সুন্নত, খেজুর দিয়ে রোজা খুলতে হয়।”
ত্রিপ্ত চোখে তাকালো প্রণয়। প্রিয়তার হাতটা মুঠো করে ধরে, খেজুরটা নিজের মুখে পুরে দিলো।
হাতের আঙুলে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ পেতেই ঈষৎ কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। প্রণয় এবার ঢকঢক করে গ্লাসের অর্ধেকটা শরবত খেয়ে নিলো।
এতক্ষণে যেন প্রাণ ফিরলো দেহে। এবার সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তার শুকিয়ে যাওয়া শুষ্ক ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে,পুনরায় দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো প্রণয়। প্রিয়তার মাথা থেকে পড়ে যাওয়া সাদা ওড়নাটা আবার সুন্দর করে মাথায় টেনে দিলো। সাথেসাথেই ফট করে চোখ তুলে তাকালো প্রিয়তা।
প্রণয় ওর হাতের মুঠো থেকে একটা খেজুর নিয়ে, তার বিজ ছাড়িয়ে প্রিয়তার মুখে পুরে দিলো। মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রিয়তা।
প্রণয় এবার নিজের আধখাওয়া গ্লাসের শরবত টুকু প্রিয়তার মুখের কাছে তুলে দিয়ে বললো — “তাড়াতাড়ি খা, না হলে রোজা কষ্ট পাবে।”
প্রিয়তা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে, খেজুর আর শরবতটা খেতে নিলো।
প্রণয় এবার ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু বাকিয়ে বললো — “এখানে কেন এলি? আমি নিজেই তো যেতাম।”
প্রিয়তা দৃষ্টি নত করে নিলো, নিচু কণ্ঠে বললো — “আপনার দেরি হচ্ছিল, তাই…”
প্রণয় কোনো জবাব দিলো না, কেবল আসক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো।
সত্যি, স্বীকার করতে তার কোনো আপত্তি নেই — এই মেয়েটার জন্য সে জীবনের যে কোনো সীমা অতিক্রম করতে পারে, হোক সেটা ভালো, হোক সেটা মন্দ।
এই মুখটার দিকেই তাকিয়ে সে সব করতে পারে সব ।
প্রণয় ওর হাত চেপে ধরে, আর কিছু না বলে বাড়ির ভিতরের দিকে হাটা দিলো।
প্রহেলিকার ভয়, অস্থিরতায় হাত-পা কাঁপছে অনবরত। সে কিছু খেতেই পারছে না। এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন অনুশ্রী বেগম। তিনি প্রহেলিকার প্লেটে একটু ফল-মিষ্টি তুলে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললেন, “কি হয়েছে আম্মু? কোনো সমস্যা? খাচ্ছ না কেন?”
অন্যমনস্কতায় অনুশ্রী বেগমের স্বাভাবিক কথাতে ও ঘাবড়ে গেল প্রহেলিকা। সে একবার ভয়ার্থ চোখে মাথা ঘুরিয়ে আবির্ভাবকে দেখলো। অতঃপর অনুশ্রী বেগমের কথার কোনো জবাব না দিয়ে, একপ্রকার দৌড়ে চলে গেল উপরে। ওর এই অদ্ভুত আচরণের কোনো কারণই খুঁজে পেলেন না অনুশ্রী বেগম। মনে মনে ভাবলেন, “কি হলো মেয়েটার?”
প্রহেলিকার আচমকা এমন ব্যবহার হজম হলো না সাদমান শিকদার ও খালিদ শিকদারের। তবে, ওনারা ও এই মুহূর্তে বিশেষ কিছু ভাবলেন না।
তবে তাঁদের চোখ এড়ালো না প্রণয় ও আবির্ভাবের ঠোঁটের অদৃশ্য বাঁকা হাসি। খালিদ শিকদার ভ্রু কুঁচকে ভাবলেন, “কি হয়েছে সেটা আমাকে খুব তারাতারি জানতে হবে।”
বাড়ির মেহমান বলে অনুশ্রী বেগম ও অনন্যা বেগম নিজেরা আবির্ভাবের পাশে বসে স্পেশাল মেহমানদারি করতে শুরু করলেন। যার ফলস্বরূপ, কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবির্ভাব পেট ভরে গলায় চলে এলো। তবুও সে হেসে হেসে, গল্প করতে করতে খাচ্ছে। তার এমন কিলার স্মাইল দেখে উল্টো দিকে বসে থাকা থিরা ও প্রেরণা নিঃশব্দে আচাড় খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো।
প্রেরণা, থিরার হাত জড়িয়ে ধরে বললো, “তোর দুলাভাই হিসেবে কেমন মানাবে বল?”
প্রেরণার কথায় কপাল কুঁচকে ফেললো থিরা। মুখ ঝাঁমটা মেরে বললো, “নজর দিও না সেজো আপু, উনি তোমার ছোট বোনের হবু স্বামী।”
থিরার কথায় খেঁকিয়ে উঠলো প্রেরণা। চাপা শব্দে ধমকে বললো, “ওই! তোর বয়স কত?”
থিরা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “এই মাসে ১৪ হবে।”
জলে উঠলো প্রেরণা। কান টেনে দিয়ে বললো, “জানিস, ওনার কত?”
এই প্রশ্নের উত্তর আবির্ভাবই দিলো — “জি আন্টি, ২ মাস পর ৩০ হবে।”
আবির্ভাবের কথায় সন্তুষ্ট হাসলেন অনুশ্রী বেগম।
আবির্ভাবের কথায় মুখ হাঁ হয়ে গেল থিরার। প্রেরণা এবার আরও জোরে ওর কান টেনে ধরে বললো, “শুনেছিস?”
থিরাও কম কী? প্রেরণার হাতে জোরে চিমটি কেটে বললো — “মারদ কাবি বুড়্ডে নেহি হোতে!”
চিমটির তীব্রতায়, চাপা কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো প্রেরণা।
স্বেতা, ওদের সামনে বসে বসে সব সার্কাস মনোযোগ দিয়ে এনজয় করছিল। এবার সে একটা গ্রিন আপেলে কামড় বসাতে বসাতে, ওদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে গাইল — “যতোই গুঁড়ি উড়াও, রাতে লাঠাই তো আমার হাতে।”
স্বেতার গানে মুখ বন্ধ করে ফেললো থিরা ও প্রেরণা। চোখ ছোট ছোট করে চাইল স্বেতার দিকে।
স্বেতা “ডোন্ট কেয়ার” ভাব নিয়ে উঠে চলে গেল।
প্রেরণা ও থিরা কেমন সন্দেহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে।
অনুশ্রী বেগম ও অনন্যা বেগম, আধা ঘণ্টার পরিচয়েই আবির্ভাবকে নিজেদের ছেলে বানিয়ে ফেলেছেন। অনুশ্রী বেগম, আবির্ভাবের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন — “রাতের খাবার খেয়ে যেও, আব্বু। তোমার জন্য রান্না বসাচ্ছি।”
আবির্ভাব একটা বিশাল হাসি মুখে ঝুলিয়ে বললো — “অবশ্যই।”
প্রহেলিকার চিন্তায় অস্থিরতায় কপাল বেয়ে নদীর স্রোতের মতো দরদর করে ঘাম ছুটছে। সে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা, ব্যস্ত কদমে পায়চারি করছে। অন্য কিছু নয়, কেবলমাত্র ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার ভয়ে তার মনে ঝেঁকে বসেছে, মনে হচ্ছে অদৃশ্য হাতে কেউ গলাটা শক্ত করে চেপে ধরেছে।
সে কস্মিনকালে ও কল্পনাও করেনি ওই ডাক্তারের সাথে প্রণয়ের কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে। এখন যদি ওই ডাক্তার প্রণয়কে কিছু বলে দেয়, এটা ভাবতেই চোখ বন্ধ করে চিত্কার দিয়ে উঠলো প্রহেলিকা—
“নাআআআ… এটা হতে পারে না! প্রয়োজন হলে ওই ডাক্তারকে ও আমার রাস্তা থেকে সরিয়ে দেবো। তবুও ও আমার প্রণয়কে হারাতে দেবো না!”
প্রহেলিকা যেন চোখে অন্ধকার দেখছে, ভয়, দুশ্চিন্তা, হতাশা তাকে চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে পেছিয়ে ধরেছে। প্রহেলিকার আচমকাই কান্না পেয়ে গেলো, সে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো, হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠলো।
মিস প্রহেলিকা শিখদারকে কি কান্না মানায়? উঠো, প্ল্যান করো কিভাবে আমার সর্বনাশ করা যায়!
কারও কণ্ঠে পিলে চমকে উঠলো প্রহেলিকা। ঝট করে মাথা তোলে, রক্তিম চোখে তাকালো—সামনে প্রণয় বাঁকা হেসে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রণয়ের বলা বাক্যগুলো প্রহেলিকার ব্রেইনে প্রসেস হতেই প্রহেলিকার হৃত্পিণ্ড চলাৎ করে উঠলো, কলিজার পানি শুকিয়ে মরুভূমি হলো মুহূর্তেই। ভয়ার্থ চোখমুখে আতঙ্কিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রণয়ের পানে।
প্রণয় বাঁকা হেসে এগিয়ে এলো প্রহেলিকার নিকট। প্রহেলিকার চোখ, মুখে এই হারানোর ভয়টা দেখে কেন জানি আজ প্রণয়ের মনে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে, এই দিনের অপেক্ষায় যেন ছিল সে কতকাল!
প্রহেলিকা ফট করে বসা থেকে উঠে পড়লো, প্রণয়কে জড়িয়ে ধরতে—নিলেই দুই কদম পিছিয়ে গেলো প্রণয়, শক্ত কণ্ঠে হুংকার দিয়ে বললো—
“Don’t touch me!”
থমকে গেলো প্রহেলিকা, চোখের পাতায় বিন্দু বিন্দু অশ্রু, কণারা ভির জমালো মুহূর্তেই। তবে কি সব শেষ হয়ে গেলো? প্রণয় কি সব জেনে গেলো? এখন কি ছেড়ে দেবে তাকে?
কিন্তু ছেড়ে দিতে চাইলে কি সে ছাড়তে দেবে? বউ সে তার! বিয়ে হয়েছে তার সাথে, তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে কিছুতেই নিজের অধিকার ছেড়ে নেবে না, প্রণয়কে ছাড়বে না—কখনোই না।
প্রণয়জনে ঘৃণা নিয়ে ও বাঁচবে, তবু ও ছাড়বে না।
প্রণয় প্রহেলিকার মনের ভাব বুঝতে পেরে বাঁকা হাসলো। পায়ের উপর পা তুলে বেডের উপর বসলো। ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বললো—
“এই আবরার শিকদার প্রণয়কে ধরে রাখা তোমার কর্ম নয়, মিস প্রহেলিকা শিখদার। শুধু তুমি কেন, এই পৃথিবীতে একজন ব্যথিত আর কারও এক চুল পরিমাণও সামর্থ্য নেই এই আবরার শিকদার প্রণয়কে ধরে রাখার। আর না আছে আমায় ধরার বা ছুঁয়ার অধিকার। এই পৃথিবীতে আমি শুধু একজনকেই সেই অধিকার দিয়েছি—সে চাইলে ধরতে ও পারে, ছুঁতে ও পারে, ইচ্ছা করলে খেয়ে ও ফেলতেও পারে—her own choice।”
অন্যের প্রতি প্রণয়ের এমন ভালোবাসার বহিপ্রকাশে অন্তর জ্বলে উঠলো প্রহেলিকার। মুহূর্তেই ভয়ংকর রণমূর্তি ধারণ করে তেড়ে গেলো প্রণয়ের দিকে। প্রণয়ের শার্টের কলার চেপে ধরে চিত্কার দিয়ে বললো—
“কেমন পুরুষ তুমি! লজ্জা করো না তোমার? নিজের বউয়ের সামনে অন্য মেয়েকে ভালোবাসার কথা বলো? আমাকে দেখো! আমি তোমার বউ! ওই মেয়েটার থেকে যথেষ্ট পরিণত! নাকি আমি আর আজকাল তোমাকে সুখ দিতে পারি না, যে তোমার অন্য মেয়েদের কথা মনে পড়ে?”
প্রহেলিকার কথা শেষ হওয়ার আগেই তার গালে, গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে সজোরে চড় বসিয়ে দিলো প্রণয়। মারের তীব্রতায় চিটকে মেঝেতে পড়ে গেলো প্রহেলিকা। পুরুষালী গায়ের শক্তিতে মুহূর্তেই নরম গালের মাংস ছিঁড়ে গেলো, দাঁতের সাথে লেগে ঠোঁট কেটে রক্ত চলে এলো।
ব্যথায় কান্না পেয়ে গেলো প্রহেলিকার। সে অশ্রুভেজা নয়নে তাকালো, তাকালো প্রণয়ের দিকে—নিঃশব্দে, তার চোখ বেয়ে অশ্রুগুলো ফোটায় ফোটায় গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
প্রণয়ের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। সে আজ আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না, মন চাচ্ছে এই মেয়েটাকে এখানেই পুঁতে ফেলতে। সে প্রহেলিকার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে বসলো।
প্রহেলিকার দিকে আঙুল উঠিয়ে ব্যঙ্গ করে বললো—
“আমাকে সুখ দেওয়ার ক্ষমতা তোর নেই। তোকে আমি পাঁচ বছর আগেই বলেছিলাম—তো শরীরের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। শুধু তুই কেন, এই পৃথিবীতে এক নারী ব্যথিত—এই আবরার শিকদার প্রণয়ের আর কোনো নারী দেহের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই।
না হলে এই আবরার শিকদার প্রণয় যদি চাইত, তো তোর থেকে হাজার গুণ সুন্দর মেয়ে প্রতিদিন সকাল-বিকাল সে তার বিছানায় রাখতে পারতো। কিন্তু সত্যি কথা কী বলতো, ফিল পাই না। কিন্তু ওই একটা নারীকে দেখলে আমার সমস্ত শরীরের পশম একত্রে দাঁড়িয়ে যায়—শুধু একবার স্পর্শ করার জন্য, একটু ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য, একটু বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য। বিশ্বাস কর, সে ব্যথিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী—ও যদি আমার সামনে ন*গ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাও ফিলিংস জাগা তো দূরের কথা, থু থু ফেলতে ও ইচ্ছে হবে না। সেখানে তুই কোন ছাড়?”
প্রণয়ের বলা এক একটা বিষাক্ত তীক্ষ্ণ বাক্যবান প্রহেলিকার হৃত্পিণ্ডকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলো। অন্য কেউ এমন কটু কথা বললে হজম করে নেওয়া যায়, কিন্তু সেই মানুষটা ওকে এগুলো বলছে, যে মানুষটার জন্য প্রহেলিকা এত যুদ্ধ করেছে, এত কিছু করেছে!
কিন্তু সেই মানুষটাই কীভাবে সস্তা বাজারি মেয়েদের সাথে তুলনা করে দিলো! তবুও ও দমে গেলো না। প্রহেলিকা কণ্ঠে ঝাঁজ নিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বললো—
“এত সাধু পুরুষ সাজা, তোমাকে মানায় না প্রণয়! ভুলে গেছো, এই ঘরেই কি কি করেছো রাতের পর রাত?”
প্রহেলিকার কথায় হাসি পেয়ে গেলো প্রণয়ের। প্রহেলিকার মুখের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। কয়েক সেকেন্ড হেসে নিজেকে সামলে নিলো, নাক সিটকে বললো—
“বড্ড বোকা! তুই? তোর মনে হয় আমি তোকে ছুঁয়েছি? এত খারাপ রুচি আমার?”
প্রণয়ের বলার ধরন দেখে তাজ্জব বনে গেলো প্রহেলিকা। অবিশ্বাস চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় বাঁকা হেসে বললো—
“Go and get a medical test.”
থমকে গেলো প্রহেলিকা। চোখ-মুখে চরম অবিশ্বাস। কিন্তু ধাক্কাটা সামলে নিয়ে বললো—
“শরীর সম্পর্ক হোক বা না হোক, আমি তোমার বউ! তাই তুমি যতই বলো, আমার হাত তোমার রেহাই নেই!”
এবার আরও জোরে হেসে উঠলো প্রণয়। হুহু করে হাসতে হাসতে কন্ঠে রসিকতা ঢেলে বললো—
“সিরিয়াসলি তুই আমার বউ?”
প্রণয়র হাসি দেখে এবার চরম ভয় হচ্ছে প্রহেলিকার—নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলার ভয়। সে কম্পিত কণ্ঠে বললো—
“এমন মজা করোনা প্রণয়… সব মজা সহ্য হয় না।”
প্রণয় আর কোনো কথার জবাব দিল না, নিজের স্যুটকেস গুছাতে শুরু করলো। প্রণয়কে জামাকাপড় গুছাতে দেখে আতঙ্কে গা কাঁটা দিয়ে উঠলো প্রহেলিকার।
প্রণয়র বাহু জাপটে ধরে কান্না করে দিয়ে বললো—
“প্লিজ প্রণয়… আমায় ছেড়ে যেও না… আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি…”
কিন্তু প্রণয় ওর হাত ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিলো। প্রহেলিকার এত এত কান্না, আহাজারি—অর্থহীন, প্রণয়ের উপর যেন কোনো প্রভাবই ফেলতে পারলো না।
প্রহেলিকা এবার বাধ্য হয়ে চিৎকার দিয়ে বললো—
“তুমি যদি আমার সঙ্গে না থাকো, তাহলে আমি সব শেষ করে দেবো! মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবো ওই মেয়েটাকে… আর তুমি খুব ভালো মতো জানো প্রণয়, আমি যা বলি তাই করি… তাই ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না।”
প্রহেলিকার কথায় হাত থেমে গেলো প্রণয় এর। সে রহস্যময় বাঁকা হেসে তাকালো প্রহেলিকার দিকে। কোনো রূপ বাক্য ব্যয় ছাড়াই নিজের ফোনটা এগিয়ে দিলো প্রহেলিকার দিকে।
প্রহেলিকা ভয়ার্থ চোখে তাকিয়ে আছে। প্রণয় ইশারায় ফোনটা নিতে বললো।
প্রহেলিকা ফাঁকা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে ফোনটা নিলো।
ফোন চলছে—একটা ২ মিনিটের ভিডিও—যেখানে প্রহেলিকা স্বীকার করছে, যে সে আর তার বাবা-চাচা মিলে এই পুরো ষড়যন্ত্রটা সাজিয়েছিলো, যার ফলে একটা খুন—প্রিয়তা, আর একটা খুন করেছিলো প্রণয়।
ভিডিওটা দেখে প্রহেলিকার দুনিয়া দুলে উঠলো। হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে শুরু করলো।
প্রণয় ওর হাত টেনে ফোনটা কেড়ে নিয়ে আবার পকেটে ঢুকিয়ে দিলো।
প্রহেলিকার করুণ দশা দেখে ঠোঁট এলিয়ে হেসে বললো—
“My dear পাতানো বউ… তুমি চাইলেই তোমার কাছে থাকা ভিডিওটা পাবলিশ করে দিতেই পারো… আমার কোনো প্রবলেম নেই… এবার মরলে আমার জান একা মরবে না… এবার মরলে সবাই একসাথে মরবো… তুমি, আমি, তোমার বাপ-চাচা… আমরা সবাই একসাথে নরকে যাবো… এবার ভাব, কী করবে?
সুন্দর মতো দুনিয়াতে বেঁচে থাকবে, নাকি সবাইকে নিয়ে নরকে যাবে?”
“কিন্তু যাই করো, আমি আর তোমার সঙ্গে থাকছি না। আর এই মিথ্যে বিয়ের নাটকও আর করতে পারছি না। তাই আমি আমার ঘরে চললাম। বাড়ির লোককে কী বলবে, সেটা তোর ব্যাপার। Okay baby. Bye bye…”
বলে বাঁকা হেসে চলে গেলো প্রণয়।
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৩
মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো প্রহেলিকা। তার এতো… বছরের পরিশ্রম—সব যেন এক নিমিষে মিথ্যে হয়ে গেলো… কত বড় প্রতারণার শিকার হলো সে। সে প্রণয়ের বউ নয়, ওদের মধ্যে কিছু নেই।
এটা ভাবতেই প্রহেলিকা পাগলের মতো হয়ে গেলো। সারা ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে শুরু করলো। চোখ-মুখ তার জ্বলে উঠছে—ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসার আগুনে—যে চোখে ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নেই।
হয়তো আজ থেকে আবার নতুন কোনো ধ্বংস লীলার সূচনা হতে চলেছে…