প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৬
সাইয়্যারা খান
তালুকদার বাড়ীর সামনে সুন্দর একটা ঘাট। চারপাশে বাঁধা, বরাবর সিঁড়ি ধরে নিচে নামা যায়। সেই ঘাট মেইন সড়ক হতে দেখা যায় না। বাজার থেকেও যাতে না দেখা যায় তাই সম্রাট নিজে বাঁধাই করার পর বড় বড় গাছ লাগিয়েছিলো চারপাশে। গাছগুলো এখন বেশ হয়েছে। বাড়ীর পাশে বিশাল এক কৃষ্ণচূড়া গাছ। চারপাশে লাল লাল ফুল গুলো বিছিয়ে থাকে। তৌসিফ’দের বাড়ীটার পেছন বলা হোক অথবা একটু বাম দিকেই সম্রাটদের বাড়ী। পেছনে খালি জায়গা।
সেখানে নানান পদের গাছগাছালি সহ বাগান বাড়ী করা। তৌসিফদে’র প্রতিটি ভাইয়ের বাগান বাড়ী আছে। নিজ নিজ শখে বানিয়েছে তারা। নিজেদের বাড়ী থেকে একটু দূরত্বে কিন্তু সম্রাটের বাগান বাড়ী এই ছোট জঙ্গলের মাঝে। দুইতলা এক বাসা। ছাদটা শ্যাওলায় ভরে আছে। সেই বাগান বাড়ীর একদম সামনে খনন করা আরেকটা পুকুর ঘাট। সেই পুকুরে সম্রাট চাষ করতো মাগুর মাছ। বিশাল বড় বড় মাগুর এই পুকুরে। বাইরে থেকে দেখলে বুঝার কায়দা নেই এখানে এত সুন্দর করে এক বাগান বাড়ী করা। জঙ্গলটার চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া। আবদ্ধ বলা চলে।
তৌসিফ এতক্ষণ নিজেদের ছাদ থেকে তাকিয়ে ছিলো সেখানটায়। ঘুরে এসে এখন দাঁড়ালো সম্মুখে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এখান থেকে বাজার দেখা যাচ্ছে। ঝলমলে আলোয় পরিপূর্ণ চারপাশ। আজ সারাদিন সে নিজে দলের ছেলেপেলে সাথে নিয়ে প্রচার কাজ চালিয়েছে। উমায়ের’কে এবারেও উপজেলা চেয়ারম্যানের পদে বহাল রাখবে তৌসিফ। মানুষের চাইতে রহস্যময় জীবন আর কোন মাখলুকাতের নেই। এই যে স্বয়ং তৌসিফ তালুকদার তার উদাহরণ। নিজের চৌদ্দ পুরুষ যেখানে চেয়ারম্যান সেখানে তৌসিফ বাড়ী বাড়ী গিয়ে আজ ভোট চেয়ে এসেছে বিপক্ষের দলের জন্য। তুরাগ যথেষ্ট বুঝদারের মতো আচরণ করছে। আদি’কে তার সাথেই দিয়েছে কিন্তু তুহিনটা মানছে না। তৌসিফ’কে কিছু বলতেও পারছে না আবার চুপ থাকতেও পারছে না।
তৌসিফ ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে তাকালো আকাশ পানে। তার গর্তে ঢোকানো সেই সুন্দর চোখ দুটি ক্লান্ত। আকাশে আজ চাঁদ তারা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি বোধহয় হবে না। তৌসিফ রেলিঙের উপর ঝুঁকে গায়ের ভর ছাড়লো সামান্য। তার পেটানো শরীরের হাতের শিরা গুলো তখন টানটান দেখাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়েই চোখ দুটো কেমন জ্বলজ্বল করে উঠে তার। বুক ভেঙে আসে। তৌসিফ চুপ করে প্রকৃতির শব্দ শুনে। নিজের হারিয়ে যাওয়া কিছু অতীত খোঁজে। অতীত নামক বইটা খুললেই পৃষ্ঠা গুলো কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তৌসিফ তখন যেন ডুবে যায় তাতে। নিজের হাত দু’টো দেখলে ভেতরের দহন যেন তরতর করে বৃদ্ধি পায়। তৌসিফ তালুকদার তখন ভেঙে যেতে চায় কিন্তু ভাঙবার উপায় নেই। পুরুষ ভাঙতে হলে তাকে সামলানোর জন্য একজন মহীয়সীর প্রয়োজন। সেই নারী এখন নেই তৌসিফে’র জীবনে। কার সামনে ভাঙবে তৌসিফ তালুকদার? কে আছে তাকে সামলানোর? তৌসিফ মৃদুস্বরে ডেকে ওঠে,
“আম্মু।”
“তৌসিফ?”
হঠাৎ তুরাগের ডাক শোনামাত্র সোজা হয়ে দাঁড়ালো তৌসিফ। তুরাগ এগিয়ে আসে। দুই ভাই বসে থাকে এই নিঃস্তব্ধ রজনীতে। তৌসিফ আস্তে করে বলে,
“এই সময় ছাদে এলে যে?”
“তুই এলি যে?”
“আমি ব্যাচেলর মানুষ বড় ভাই। তোমার বাল-বাচ্চা নেই?”
“আছে তো। এলাম কথা বলতে।”
“গুরুত্বপূর্ণ কিছু?”
“হুঁ।”
তুরাগ চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। তৌসিফ বুঝলো গুরুত্বপূর্ণ কিছুই বলবে। নিজেও গলা খ্যাঁকানি দিয়ে বসলো। তুরাগ যথেষ্ট গম্ভীরতা নিয়ে বললো,
” তাহমিনা আপা ডাকিয়েছিলো আমাকে আজ৷”
“তাতে এমন কি? চাচি ভালো আছে?”
“তোকে যেতে বললেন চাচি।”
“তাহমিনা আপা কেন ডাকালো?”
তুরাগ একটু গম্ভীরমুখে বললো,
“তুই নির্বাচন আরেক দলের হয়ে লড়ছিস এটা নিয়ে কথা হলো। আমি বুঝালাম যতটুকু পারা যায়। তুহিন’কে নিয়ে অনেক রেগে আছেন আপা। ও নাকি ওর বাগান বাড়ীতে মেয়ে নিয়ে থাকে। ওখানেই নেশার আড্ডা গেড়েছে। তুহিনকে থামানো যাচ্ছে না কোন ভাবেই। ও আর কত নেশা করবে? বাদ রেখেছে কিছু? তারমধ্যে…. ”
তুরাগ’কে থামিয়ে তৌসিফ বলে উঠলো,
“নারী ঘটিত জটিলতা তুহিনের নেই। পলক’কে ভালোবাসে।”
“*ল বাসে। *শ্যা এনেছে বাড়ীতে। ** ওকে শুধু একদিন হাতে পাব তখন দেখবি ওর মাথাটা দেহ থেকে কিভাবে আলাদা করি আমি।”
তৌসিফ কথা বললো না। তুরাগ দাঁত চেপে বললো,
” ওই রূপ দিয়ে কি করবে ওই ** বাচ্চা। যেই রূপে স্বামী বাঁধতে পারে না।”
তৌসিফ মৃদুস্বরে শুধু বলে,
“তুহিন’কে ফাঁসানো হচ্ছে ভাই। ও মেয়েবাজ না।”
তুরাগ তখনও গালিগালাজ করছে পলক’কে। এই বাড়ীর কেউ পলক’কে এখনও মেনে নেয় নি। তুহিন প্রেম করে একা একাই বিয়ে করে এনেছিলো পলক’কে। ওদের মাও মেনে নেন নি পলক’কে। তৌসিফ তুহিনে’র দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“শাহরিয়ার ভাইয়ের খবর কি?”
তুরাগ খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর করলো,
“আগের মতোই।”
তৌসিফ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ও যেন জানতোই উত্তর এটাই হবে। শুধু বললো,
“সম্রাট ভাই’কে সম্মান করি বলি তাহমিনা আপা’কে জিজ্ঞেস করতে গেলাম না কেন তুহিন সম্পর্কে এই কথা তোমাকে বলেছে। তাহমিনা আপা’কে চাচাতো বোন ভাবি না কখনোই। আপা আর তিশা আমার কাছে যা তাহমিনা আপাও তাই কিন্তু তাই বলে জবাবদিহিতা তো এড়িয়ে যাবে না। নির্বাচনটা যাক অতঃপর খবর নিচ্ছি।”
“আপাকে যা বলবি সাবধানে।”
” শা’লা সবাই ভাবে তৌসিফ পুতিয়ে গিয়েছে। গা ঝাড়া দিলে এখনও যে কোথায় কোথায় ঢিল লাগবে তা কেউ বুঝে উঠতে পারবে না।”
“সময় হোক।”
দুই ভাই নিচে নেমে এলো। তৌসিফ গম্ভীর মুখে নিজের রুমে এলো। গায়ের টিশার্ট খুলে উবুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো ও। বালিশে মুখ গুজে ওভাবেই পরে রইলো। সিল্কের কুশনটা টেনে সামান্য শুকলো। সেখান থেকে তিরতির করে এক নারীর ঘ্রাণ যেন এখনো বেরিয়ে আসছে।
ভাঙা পা আর ছিলে যাওয়া হাত নিয়ে ব্যথায় যথেষ্ট কাতরালো পৌষ। ও বাড়ীতে গিয়ে এখনও ফিরে নি কেউ। রাত বারোটার কাছাকাছি। হেমন্ত ফোন দিয়েছিলো অবশ্য। আসছে বললো। পাশের বাড়ীর এক বড় আপাকে পাঠিয়েছিলো যাতে পৌষ একা না থাকে কিন্তু সেজো চাচা বাড়ী ফিরতেই আপা চলে গেলো। চাচা অবশ্য একবার জিজ্ঞেস করেছিলো, পৌষ ঠিক আছে কি না। পৌষ বলেছে সে ঠিক আছে। ব্যস সেজো চাচ্চু ঘরে ঢুকে গেলো। এতিমদের দু’বার জিজ্ঞেস করতে নেই। অভ্যস খারাপ হয় তাতে। পৌষ’র তাই মনে হয়। ভাই-বোনরা বাদে চাচ্চুরা বা চাচিরা কেউ পৌষ’কে দ্বিতীয় বার কিছু সাঁধে না। যদি পৌষ চেয়ে বসে। বুঝ হওয়ার পর থেকে পৌষ চাওয়াই ছেড়ে দিলো। হেমু ভাই যা নিজ থেকে দেয় পৌষ নেয় নাহয় নাই৷ পৌষ এইসব আজাইরা জিনিস নিয়ে তত ভাবে না। এত ভাববার সময় কই? মহা ব্যস্ত সে।
গায়ে দেয়ার কাঁথাটা শরীরে মুড়িয়ে মাথা সহ ঢেকে উঠে দাঁড়ালো পৌষ। গন্তব্য এখন রান্না ঘর। কিছু একটু খেয়ে একটা নাপা গিলতে হবে যদিও এই ফালতু জিনিসটা পৌষ’র পছন্দ না। এখন আবার নাপার দিন শেষ। নতুন নাপা এসেছে। পৌষ কাঁপতে কাঁপতে বিরবির করলো,
“পুরাতন নাপার দিন শেষ, নাপা একস্ট্রার বাংলাদেশ।”
এক পাতিল গরম পানি বসিয়ে তার দিকে পৌষ তাকলো দুই সেকেন্ড। ধৈর্য্যে কুলালো না তার। ইন্সট্যান্ট নুডলস তাতে ঢেলে ভাঙা পা নিয়ে কোমড় দুলিয়ে দুলিয়ে চামচ নাড়ছিলো আর মুখে বিরবির করে গাইছিলো,
“বন্ধু আমার রষিয়া,
দিলের ভিত্তে কষিয়া
হেব্বি একটা গান বানাইসে…
ও বন্ধু.. আহা বন্ধু.. কই তুমি বন্ধু গো ওওও”
সারা বাড়ী তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার শুধু রান্না ঘরের বাইরের লাইট জ্বলছে। আলো চোখে বিঁধছিল বিধায় পৌষ রান্না ঘরের লাইটও জ্বালায় নি। সেজো চাচা তখন ঘর থেকে বেরিয়েছেন। হেমন্ত ফোন দিয়ে বললো তারা আসছে। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে হালকা আলোয় রান্না ঘরে এমন অদ্ভুত জিনিস নড়তে দেখে সেজো চাচার শরীরটা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। ভূত কি না ভাবতে ভাবতে আচমকাই পৌষ তখন গানের তালে একটু নাচতে গিয়ে ভাঙা পা নিয়ে কাঁথা দিয়ে পেঁচিয়ে ধপাস করে পড়লো মেঝেতে। সেজো চাচা জোরে চিৎকার করে ডেকে উঠলেন,
“ওরে আল্লাহ গো! পৌষ, পৌষ। আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর…এরপর কি? হায় হায়। ওরে পৌষ কই গেলি তুই?”
লুঙ্গি তুলে সেজো চাচা এক দৌড়ে দোতলায় উঠে গেলেন। সেজো চাচার কণ্ঠে আঁতকে উঠে পৌষ নিজেই। কোমড়ে যথেষ্ট ব্যথা পেয়েছে ও। কোনমতে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে দরজা খুললো। কখন থেকে বাজছে। বাড়ীর সকলে হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো। তারা বাইরে থেকে সেজো চাচার গলা শুনেছে। সকলের চোখে মুখের প্রশ্নোত্তর চাহনি। পৌষ ধপাস করে সোফায় বসলো। পিহা সহ চৈত্র তারাতাড়ি ওকে ধরতেই পৌষ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলো,
“যাহ সর সামনে থেকে।”
ধমকে দুটা সরতেই হেমন্ত এগিয়ে এলো। পৌষ মুখ ঘুরিয়ে রাখলো। বড় চাচা গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“চিৎকার দিলো কে?”
সেজো চাচি এতোগুলো মানুষের মাঝে সন্দিহান কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কোন ব্যাটা ছেলে তুই ঘরে ঢুকালি রে? আমি স্পষ্ট শুনেছি। সবাই শুনেছে।”
হেমন্ত সহ জৈষ্ঠ্য আর চৈত্র চোখ গরম করে তাকালেও পৌষ গা কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বললো,
“নতুন জুটিয়েছি সেজো চাচি। তোমাদের গলা শুনে ছাদ দিয়ে পালালো বলে। যাও যাও গিয়ে ধরো।”
“পৌষ!”
হেমন্তের ধমকে পৌষ উঠে দাঁড়ালো। খোঁড়াতে খোঁড়াতে রান্না ঘরে ঢুকলো। নুডলস বাটিতে ঢেলে কাঁথাটাও তুলে হাঁটা দিলো নিজের ঘরে। পেছনে অতগুলো মানুষ তখনও দাঁড়িয়ে। পৌষ যখন যাচ্ছিলো তখনই সেজো চাচা উপর থেকে নামতে নামতে পৌষ’কে দেখে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কিরে কই ছিলি তুই?”
“তোমার বউ এর ভাষায় যদি উত্তর দেই তাহলে প্রেমিক নিয়ে রংঢং করছিলাম।”
কাউকে পরোয়া না করে পৌষ রুমে চলে গেলো। সেজো চাচা নিচে আসতেই দেখলেন বাড়ীর তিন ছেলে রাগে হাত মুঠ করে আছে। তিনি কিছু বলার আগেই ছোট চাচা প্রশ্ন করলেন,
“ভাইজান আপনি চিৎকার দিয়েছিলেন?”
“দিব না? পাকের ঘরে ভূত ছিলো। নাচতে নাচতে আমাকে ধরতে আসছিলো।”
ভূত শুনেই ইনি, মিনি লাফিয়ে উঠলো। এদিকে সকলের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেলো। হেমন্ত শুধু শক্ত চোয়ালে বললো,
” সংযত হন সবাই নাহয় আমিই খারাপ হতে বাধ্য হব।”
পৌষ গপগপ গরম গরম নুডলস গিলছে। আদিত্য’কে কাল ক্যাম্পাসে ধরতে হবে। ওই চোখ দুটোর মালিক কে ছিলো? পৌষ তাকে আগেও দেখেছে তবে ততটা গভীর ভাবে না। সে যে তালুকদার বাড়ীর কেউ তা পৌষ জানে তাই তো চোখ দুটো ঠিক সম্রাটের মতো। তীক্ষ্ণ বাজপাখির ন্যায়। ইনি,মিনি দৌড়ে রুমে ঢুকে খাটে উঠলো একদম পৌষ’র দুই পাশে বসলো। তুতলে তুতলে বললো,
“আপা ভূত।”
“যা ফট।”
“আপা কি খাও?”
“তোর বাপের মাথা।”
“আমাকেও দেও বাপের মাথা।”
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৫
“ছিঃ ছিঃ, কি দিন কাল এলো। পোলাপান নিজের বাপ, চাচাদের মাথা খেতে চায়। নে হা কর।”
চামচে পেঁচিয়ে দুই বোনকে মুখে তুলে খাওয়ালো পৌষ। হেমন্ত সহ বাকিরা তখন সিরিয়াল ধরে দরজায় দাঁড়িয়ে। ইনি, মিনি বাদে বাাকি সবার উপর রেগে বো’মা হয়ে আছে পৌষ।