প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৩
ফিজা সিদ্দিকী
হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে তুর্জয়কে। ভেতরে ট্রিটমেন্ট চলছে। বাইরে চিন্তারত অবস্থায় বসে নন্দিতা। আনসার রিসেপশনে গিয়ে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ফর্মালিটি পূরণ করছে। রিসেপশন এরিয়া থেকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নন্দিতাকে। পরনের হালকা রঙের ভাঁজভাঙ্গা চুড়িদার, পরিপাটি গোছালো বদন। এসব দেখে মনে মনে বেশ খানিকটা ক্ষুব্ধ হলো আনসার। বিগত পাঁচ বছর ধরে আছে সে তুর্জয়ের সাথে। বলা যায় এই প্রফেশনে আসার একদম শুরু থেকেই। তুর্জয়ের মতো ধারালো বুদ্ধিমত্তার মানুষ, সে তার গোটা জীবনে দেখেনি।
মানুষটাকে দেখে তার অনেকটা নারকেলের মতো লাগে। বাইরেটা খটখটে কঠিন আবরণ, অথচ ভেতরটা নরম, মিষ্টি স্বাদের। তুর্জয়ের স্ত্রী হিসেবে নন্দিতাকে তার মোটেই পছন্দ নয়। তারও অবশ্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। শুরু থেকেই মেয়েটা তুর্জয়ের প্রতি যত্নশীল নয়। বিয়ের পর থেকেই দেখেছে সে তুর্জয়কে বেশ লেট করে বাড়ি ফিরতে। এমনকি অনেক সময় তো কাজ না থাকলেও ইচ্ছেকৃতভাবে সময় পার করে কেবিনে। হয়তো বাড়ী ফেরার তাড়া নেই তার, এজন্য।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আহসানের মনে এ ধারণা গাঁট বেঁধেছে যে, নন্দিতার সাথে ভালো নেই তুর্জয়। কিংবা হয়তো নন্দিতা তুর্জয়ের সকল মানসিক অশান্তির কারণ। আবার আজ যখন ফোনে তুর্জয় বললো, “বউ মেরেছে” ব্যাপারটা দুইয়ে দুইয়ে চার করে নিলো সে। এরপর থেকেই যেন নন্দিতাকে তার দুই চোখে সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে পুলিশে দিতে, এমন একজন মানুষকে এভাবে আঘাত করা অপরাধে।
“পেশেন্টের এমন অবস্থা কিভাবে হলো?”
“বউ মেরেছে”
রিসেপশনিস্টের কথা শুনে আচমকা ঘোর থেকে বের হওয়ায় মুখ থেকে কী বেরিয়ে গেছে খেয়াল করেনি আনসার। যখনই খেয়াল হলো তার, অনেকটা দেরী হয়ে গেছে ততক্ষনে। তার হাতে থাকা পেশেন্টের ফর্মটা একজন নার্স টেনে নিয়ে কোথাও হারিয়ে গেছে ভিড়ের মাঝে। একবার তার মনে হলো ঘরের কথা বাইরে বলেছে এসব জানলে স্যার অনেক বেশি রাগ করবে। কিন্তু পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাতে থাকা নন্দিতার দিকে তাকিয়ে এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মনে মনে ভাবলো,
“যা করেছি, বেশ করেছি। ওই দুই ফুটের মেয়েটাও এবার বুঝুক কার গায়ে হাত দিয়েছে সে।”
আনসার বেশ ভালো করেই জানত তার ওই একটা স্টেটমেন্ট আইনি দিকে নিয়ে যাবে এই ব্যাপারটাকে। কারন পুলিশ, মিডিয়া আর ওকালতি পেশায় তুর্জয় আহসানকে চেনে না এমন কেউ নেই বললেই চলে।
পায়ের ব্যথাটা বেশ বেড়েছে। হয়তো রক্তও বের হচ্ছে সেটা থেকে। তবে সেদিকে খুব বেশি ভ্রুক্ষেপ না করে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে চোখ বুঁদে শুয়ে রইলো নন্দিতা। আচমকা ভারী পুরুষালী এক কণ্ঠে নিজের নাম শুনে চোখ খুললো সে।
“মিস্টার তুর্জয় আহসানের ওয়াইফ, আপনি?”
নন্দিতা মুখে হাসি নিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই পুলিশটা বেশ রুক্ষতার সাথে তাকে বললো,
“আমার সাথে আসুন। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ আছে আপনার সাথে।”
নন্দিতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো পুলিশের পোশাক পরিহিতা মেল পুলিশের দিকে। সাথে তার দুইজন লেডি কনস্টেবল। যারা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নন্দিতা ঠোঁট কামড়ে হেসে একজনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“আয়না হবে আপনার কাছে?”
মেয়ে দুটো একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সন্ধিহান চোখে তাকালো নন্দিতার দিকে। আশাহত নন্দিতা তাদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পুরুষ মানুষের দৃষ্টি নাকি আয়নার চেয়েও তুখোড়, নিঁখুদ। আমাকে ভালো করে দেখে বলুন তো, অ্যাম আই লুকিং টু মাচ গরজিয়াস?”
“আপনি কি আমার সাথে মশকরা করছেন, মিসেস আহসান?”
“একদমই না। আপনার সাথে করে নিয়ে আসা লেডি কনস্টেবলগুলো আমাকে যেভাবে দেখছে, মনে হয় হসপিটালে বিয়েবাড়ির উদ্ভট সাজে উপস্থিত হয়েছি আমি।”
কথাটা শেষ করেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো নন্দিতা। ইয়াং ইন্সপেক্টর আলোক তালুকদার যে বেশ বিরক্ত হলেন তার এমন রসিকতায় তা তার চোখে মুখে স্পষ্ট। নন্দিতা তাই আর কথা বাড়ানো সমীচীন বলে মনে করলো না।
হসপিটালের একটা কেবিনে মুখোমুখি বসে আছে ইন্সপেক্টর আলোক ও নন্দিতা। পায়ের ব্যথাটা এতক্ষনে বেশ জমকালোভাবে ধরা দিয়েছে। পুরো শরীরটাই টনটন করে উঠছে যেন সেই ব্যথার জের ধরে । তবুও তার মুখে হাসির অভাব নেই। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করেও একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বসে আছে ইন্সপেক্টর আলোকের সামনে। তাদের থেকে খানিকটা দূরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আনসার।
“আপনার স্বামীকে খুন করার চেষ্টা করেছেন আপনি?”
ইন্সপেক্টর আলোকের এমন কথা শুনে চোখ বড় বড় হয়ে যায় নন্দিতার। অবাকের সপ্তম পর্যায় থেকে যেন ধপ করে মাটিতে পড়ল সে। সামান্য একটা একসিডেন্টকে পুলিশ এভাবে মার্ডারের নাম দেয় কিভাবে তার এই ছোটো মাথার চিন্তার বহরে তা আসে না। তাই বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“নাহ তো, আমি সামান্য পিঁপড়াকেও খুন করিনা কখনও। আর আমার ওই জাঁদরেল বরকে খুন করব কীভাবে?”
“তাহলে কি পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন?”
“ছিঃ ছিঃ স্বামীর গায়ে পা দিতে নেই, জানেন না?”
“তাহলে ওনার এই অবস্থা হলো কী করে? একেবারে ইনজিওর্ড হয়ে হাসপিটালের বেডে। আর আমি স্পষ্ট দেখেছি আপনাকে সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতে। এখানেই তো দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যায়। দেখুন, পুলিশের কাছে সত্যি সত্যি সবটা স্বীকার করুন, নাহলে টর্চার সেলে নিয়ে যেতে গেলে আপনি সুস্থভাবে ফিরতে পারবেন না আর কখনও।”
নন্দিতা এবার যেন খানিকটা জড়োসড়ো হয়ে গেল। কিন্তু চেহারার ভাব ভঙ্গিতে এমন কিছু প্রকাশ না করে উল্টে আরও খানিকটা জোর গলায় বললো,
“এসব কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? যা জিজ্ঞাসা করার ওই ফুলদানিটাকে করুন। আমি মারতে চাইনি কিন্তু ফুলদানিটা আমার হাতে ছিল, আর এক্সিডেন্টলি ওটা দিয়ে আঘাত পান উনি। তবে ওই সাইলেন্সার ব্যাটাকে আছাড় দিতে মন যে আমার চায়না এমনটা না, কিন্তু সম্ভব নয় দেখে রাগ গিলে খেয়ে ফেলি। ব্যাটা আছাড় না খেয়ে আমার শখের ফুলদানিটা আছাড় খেলো আজ।”
“ফুলদানি আছাড় দিলে মিস্টার আহসানের এই অবস্থা হলো কিভাবে? আর ইউ কিডিং উইথ মি?”
“এতোদিন তো জানতাম আমি একাই বেশি বকবক করি। কিন্তু এখন তো দেখছি আপনি আমার চেয়েও বেশি বাচাল। শোনেন কম, চিল্লান বেশি। পড়াশোনা করে পুলিশ হয়েছেন তো নাকি এক্সামের সময় ওয়াশরুমে রাখা বই থেকে টুকে টুকে।”
চোখে মুখে গাম্ভীর্যে ভরপুর একজন পুলিশ অফিসার মিস্টার অলোক তালুকদার। তার চেয়ে বয়সে ঢের কম, সামান্য একজন মেয়ের কাছে থেকে এমন ধরনের কথা শুনে তিরতির করে রাগের পরিমাণ বাড়লো তার। হাতে থাকা লাঠিটা টেবিলের উপর জোরে আঘাত করে ফুঁসে ওঠা কণ্ঠে নন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“একদম ফাজলামি করার চেষ্টা করবেন না আমার সাথে।”
নন্দিতার ছোটো কলিজাটা ভয়ে কেঁপে উঠলো কানের কাছে এমন জোরালো শব্দে। ভীতু কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এই লাঠিটা কী আমার মতো নিরপরাধ মানুষ পেটানোর জন্য দেওয়া হয়েছে আপনাকে? এটা দিয়ে চোর পেটায়, ডাকাত পেটায়, বাচ্চা পেটায় না। আমাকে দেখে কি আপনার চোর, ডাকাত মনে হয়? সঠিক জিনিস সঠিক জায়গায় ব্যবহার করতে না পারলে হাতে রাখার দরকার নেই।”
আলোক তালুকদার ক্রুর হেসে ঠেস দিয়ে বসলেন সামনে রাখা টেবিলের উপর। অতঃপর বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বলেন,
“আজ আসছি, আমাদের আবার দেখা হবে মিসেস আহসান। আর সেদিন আপনি জল ছাড়া মাছের মত ছটফট করবেন, আই সোয়্যার।”
“সেই দিন কখনও আসবে না মিস্টার তালুকদার। আই থিঙ্ক আপনি ভুল কেস নিয়ে ইনভেস্টিগেশনে নেমেছেন। এটা অবুঝ বউয়ের ছোটখাটো আদরের ফল, নাথিং এলস।”
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ২
মাথায় ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো তুর্জয়কে হসপিটালের ড্রেসআপে সামনে দেখে ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে ওঠে ইন্সপেক্টর আলোক তালুকদারের। এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় করমর্দন করার উদ্দেশ্যে। তুর্জয় ও হালকা হেসে তার হাত বাড়িয়ে দেয়। ইন্সপেক্টর আলোক একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকায় নন্দিতার দিকে, যে ব্যস্ত তার ফোন নিয়ে। তাদের দিকে একপলক ঘুরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করছে না। অতঃপর তুর্জয়ের দিকে খানিকটা ঝুঁকে ধীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আমাদের আবারও দেখা হবে, আপনি না চাইলেও হবে। খুব শীঘ্রই হবে।”