ধূসর রংধনু পর্ব ১
মাহিরা ইসলাম
“হেই ইউ,কে তুমি?
আমার বিছানায় কেন, কি কাজ?”
পরপর তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো পুরুষালী বাক্যবঁচনে কিছুটা ঘাবড়ে গেল তাসফি।নিজ বাসর ঘরে বিছানায় বসা উচিত হয়েছে কিনা ভাবনায় মত্ত হলো তার তনু মন।
রুমের মধ্যিখানে একফালি কালচে আলোর ডিম লাইট জ্বলছে। কারো রুমে যে এমন অদ্ভুত রংয়েরও ডিম লাইট লাগাতে পারে সেটা এই কর্কশ মানবের রুমে না আসলে জানতেই পারতো না সে।
“কি হলো এ্যানসার মি?”
আবার সেই একই ঝাঁঝালো স্বর কর্ণগোচর হলো তার।
তাসফি এখন কি উত্তর দিতে পারে এই প্রশ্নের? যে সে এই রুমের থাকা, চলমান করা পুরুষটির বিবাহিত স্ত্রী? নাকি অন্য কিছু। কি উত্তর দেবে সে?উমম ভাববার বিষয়। যে মানবের নিজের বিয়ের কথা মনে থাকে না, বেনারসি পরিহিত সদ্য বিবাহিত বউকে চিনতে পারেনা তাকে কি উত্তর দেওয়া যায়? অবশ্য চিনবে কি করে এই পাজি ডাক্তার তো আগে তাকে দেখেই নি।কিন্তু তাসফি তো ঠিকই দেখেছে। অবশ্য এমন কালো আলোয় ঘোমটা শুদ্ধ লাল বেনারসি দৃশ্যমান হবে কি করে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আপা, আপা”
নিস্তব্ধ’র বজ্যকন্ঠ কর্ণগোচর হতেই বাসন্তী কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও, নিজের মিছে তেজ বজায় রেখে এগিয়ে গেল রুমের দিকে
“কি ব্যাপার ভাই তুই এমন চিল্লাচিল্লি করছিস কেন?বাড়িতে দাদু আছে ভুলে গেলি ভাই। এমা তাসফি কই রুম এমন অন্ধকার কেন। কতবার বলেছি ভাই রুমের এই ফ্যাসফ্যাসে আলোয় কিছুই দেখা যায় না, লাইট পরিবর্তন কর। তোর রুচির ঠিক হলো না ভাই।”
নিস্তব্ধ প্রত্যুত্তরে ত্যাড়ছা কন্ঠে জবাব দিল,, “অন্তত তোমাদের রুচির থেকে এনাফ ভালো ।নাহলে একটা নাবালিকা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিতে না তোমরা।
“ভাই ও নাবালিকা নয় সাবালিকা, শুধু আঠেরো হয়নি এই যা। সামনে মাসে পূরণ হয়ে যাবে সেটাও।ডাক্তারি পাশ করেছিস তুই কীভাবে বলতো ভাই।আদ্যত্ত্বে কিছু পড়েছিস তো।”
নিস্তব্ধ চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো। মিছে তর্কের কোনো প্রয়োজন সে মনে করছেনা।
তাসফি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো, যাক মানবের তাহলে বিয়ের কথা মনে আছে।
বাসন্তী আবার বলে উঠলো,
“আর বিছানায় কে,বিছানায় কে বলে চেঁচাছিস কেন ? বিছানায় তোর বউকে বসিয়ে গিয়েলাম তো।এতে মহাভারত তো অশুদ্ধ হয়নি তাইনা।”
নিস্তব্ধ নিজের বউয়ের মুখখানা না দেখলেও, রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করা সময় ঠিকই খুব ভালো করে তার পাশে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা তাসফি বিনতে আনহা নাম খানা জহুরির চোখে পরখ করেছিল। হাতের লেখা মোটেও আহামরি সুন্দর ছিলো না।নিস্তব্ধ মুখ ছিটকেছিলো।তবুও চোয়াল শক্ত করে নিজের সাইন খানা করেছিল ‘ডাঃ নিস্তব্ধ ইয়াসার’।
কিন্তু বোকা মানবকে কে বোঝাবে নার্ভাসনেসে সাইন করার সময় প্রচন্ড পরিমাণে হাত কেপেঁ ছিল তাসফির’র তাইতো নামের সঙ্গে অক্ষর গুলোও হয়েছে কাঁপাকাপি, একটা বড় একটা ছোট।
গর্জে উঠলো নিস্তব্ধ,
“হোয়াট? আর ইউ ক্রেজী আপা। ওকে আমার রুমে কেন নিয়ে এসেছিস। ওকি আমার রুমে থাকবে নাকি?
তুই জানিস আমি রুম শেয়ার করতে পছন্দ করিনা। বিয়ে করেছি মানে এই নয় যে ওও আমার সব কিছুতে ভাগ পাবে।
এই মেয়েকে এখনি রুম থেকে বের কর আপা।”
নিস্তব্ধ’র চিৎকারে ভয়ে কিছুটা কেঁপে উঠলো তাসফি। আরো জড়সড়ো হয়ে এটে বসে রইলো বিছানায়।
বাসন্তী কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি মিশিয়ে বলল,
“আর চিল্লাস না তো ভাই। দিন দিন তোর উগ্রতা কিন্তু আমাদের অতিষ্ঠ করে তুলছে। কিছু করার নেই , দাদু যে কটা দিন আছে একটু কষ্ট তো তোকে করতেই হবে।তারপর নাহয় অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।”
নিস্তব্ধ বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে নিলো,
“কথায় কথায় একদম দাদু দাদু করবি না আপা তোর দাদু কে আমি ভয় পাই বলে মনে হয় তোর।”
“হ্যাঁ পাশ না সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
” হ্যাঁ তোর ওই বুড়ো দাদু শুধু মাত্র ব্লাকমেইল করায় বিয়েটা করতে হয়েছে। এই মেয়ের আমাকে বহন করবে তার সেই ক্ষমতা আছে। পুঁচকে একটা মেয়ে নাক টিপলে দুধ বেরুবে। ”
আঠাশের কোঠায় পা দেওয়া তাগড়া পুরুষ সে, চেয়েছিলো তার মতো প্রতিষ্ঠিত কাউকে সে বিয়ে করবে।অথচ এখন তাকে একটা এইটটিন গ্যাভ ইমম্যাচিউরড পুঁচকে মেয়েকে নিজের সাথে সারাজীবন জরিয়ে রাখতে হবে। বিরক্তিতে তার গাঁ চিরচিড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ আগুনের বোঝা তার ঘাঁড়ে চেপে দিয়েছে।ঝলসে যাচ্ছে শরীর।
বাসন্তী স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল,
“আমি এতকিছু জানিনা ভাই।দাদু আমাকে এগুলো বলতে বলেছিল বলে গেলাম। এখন বিরধিতা করতে চাইলে দাদুকে গিয়ে বলতে পারিস। আমি কিছু জানিনা।”
বাসন্তী এগিয়ে গেল বিছানায় জড়সড়ো হয়ে বসে থাকা তাসফির দিকে।ভাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,,
এই যে তাসফি রাতে তোমার কাছে এসে ভাই যা চাইবে তাই দিও কিন্তু ঠিক আছে। ভাই কিন্তু বেশ রাগী। যা বলে সব শুনবে কেমন।
তাসফি এমন ভান করলো যেন সে লজ্জায় মূর্ছা যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা মোটেও এমনটা নয়। সে মোটেও কোনো লজ্জা টজ্জা কিছু পাচ্ছে না।
— আপা..
নিস্তব্ধ’র স্বর কিছুটা ঝাঁঝালো ঠেকলো কি।
“তোর আপা কে আজ আর পাচ্ছিস না ভাই টাটা।বেস্ট অফ লাক।”
বাসন্তী যেতেই নিস্তব্ধ রাগে ফেটে পড়লো।শব্দ করে নিজ হাত ঘড়িটা খুলে ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখে কাধে তোয়ালে ঝুলিয়ে সোজা ঢুকলো ওয়াশরুমে ।ধরাম শব্দ করে দরজা লাগালো।
কিছু করার নেই দুটোদিন এই উটকো জামেলাটাকে তার সহ্য করতে হবে।
ওয়াশরুমের দরজা লাগানোর শব্দে চমকে উঠলো তাসফি।
আল্লাহ দরজা ভেঙে টেঙে যায় নিতো আবার। চুপিচুপি তার চেক করতে হবে। এই মানবের সমস্যা কি যখন তখন ধমকাবে চিল্লাবে।শব্দ করে দরজা লাগাবে।
আরে বাবা তাসফির এই টুকু পরাণ, তার কি আর এত ধমক সহ্য করার ক্ষমতা আছে নাকি।আশ্চর্য!
বাসন্তী বেরিয়ে আসতেই সকলে তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। দাদু জিজ্ঞেস করলো সব সেট করে দিয়ে এসেছিস তো দিদিভাই ।
–একদম দাদু,
দাদু বলল,
“এবার দেখবো দাদুভাই সুন্দরী বউকে ছেড়ে নাবালিকা করে করে কদিন কাটাও তুমি ।”
সকলে একজোট হেঁসে নিলো।
নিস্তব্ধ’র মা অনিমা বেগম এগিয়ে এলেন সকলের দিকে।গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“রাত অনেক হয়েছে যাও যে যার যার রুমে যাও।ঘুমাও গিয়ে।সকালে আবার কথা বলো।”
সবাই সুর সুর করে নিজ রুমে চলে গেল।
বলা চলে অনিমা বেগমের থেকেই নিস্তব্ধ বোধহয় সমস্ত রাগ ট্রান্সফার হয়েছে।যেমন মা তার তেমন ছেলে।
নিলয় সাহেব চাইলেন নিজ স্ত্রীর পানে। ভয় ভয় লাগছে তাকে আবার কিছু না বলে তার গিন্নি।
অনিমা বেগম নিজ শ্বশুরের দিকে চেয়ে ভদ্রতার সহিত বললেন,
“বাবা আপনি রাতে আর কিছু খাবেন। তাহলে রুম্পাকে বলে দেই?”
ভদ্রলোক কথার বিরোধিতা করলেন,
“না বৌমা আমি রাতে আর কিছু খাবো না। রাত হয়েছে যাই শুয়ে পড়ি।”
বলেই দাদু চললেন তার ঘরের দিকে।
“কি ব্যাপার তুমি এমন সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
স্ত্রীর কথায় নিলয় সাহেব থতমত খেলেন। যা ভেবেছিলো তাই হলো। তার গিন্নি সকলের রাগ এখন তার উপরেই ঝাড়বে।
“ঠিকআছে আমি বরং রুমে যাই গিন্নি তুমি এসো।”
“দাঁড়ান।”
নিলয় সাহেব চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
“নিস্তব্ধ বিয়ে করেছে ঠিক আছে কিন্তু এখনি কেন আপনার বাপ মেয়েটাকে ওর কাছে ঠেলে পাঠাচ্ছে। কেন উঠে পরে লেগেছে আমার ছেলের পেছনে। আপনার মতো তো আর আমার ছেলে এতটা অধৈর্য্যশীল নয়। আপনার বাপ কেন তাকে লাগামছাড়া বানাতে চেষ্টা করছে? আর মেয়েটার বয়স দেখেছেন তার নিজেকে প্রস্তুত করতে আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন।তাছাড়া তার এখন সংসার করার বয়স হয়নি। তার পড়াশোনা আছে কিছুদিন পড় সে ডাক্তারি পড়বে। মানলাম ভাগ্য চক্রে বিয়েটা হয়েছে কারণবসত।তার মানে তো এই নয় তাকে এখনি সংসার করতে হবে।
এই জন্যই বলে বুরো মানুষের বোধ বুদ্ধি থাকে হাঁটুটে। আপনার বাবা কে জানিয়ে দেবেন, বেশী বাড়াবাড়ি যেন সে না করে। ”
অনিমা বেগম হনহন করে সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে উপড়ে উঠে গেল। নিলয় সাহেব করুণ চোখে তাকিয়ে রইল নিজ গিন্নির পানে।
এই এক সমস্যা গিন্নি তার শ্বশুরের সাথে অতি ভদ্র ভাবে কথা বলেন অথচ তার কাছে সমস্ত কর্কশ নালিশ এসে জুড়ে দেয়।
আরে বাবা সে কি করে এখন বাবাকে বলবে।
আরে তার ছেলের বয়স আঠাশ। এখন নাতি নাতনির মুখ না দেখলে হয়। তাছাড়া তাসফি তো এতটাও ছোট নয়। সামনের মাসেই তার আঠারো পড়বে।নিলয় সাহেব নিজে তার মায়ের কোল আলো করে এসেছিলেন ষোলো বছর বয়সে।সমস্যা কোথায়।
এই জন্যই লোকে বলে বেশি বিদ্যা ভয়ংকর।
আর তার অতিরিক্ত শিক্ষিত গিন্নি চরম ভয়ংকর।
** নিস্তব্ধ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো, মেয়েটা এখনো হাভাতের মতো সেভাবেই বসে আছে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিলো সে।
এই মেয়ে বসে থাকুক আর দাঁড়িয়ে থাকুক তাতে তার কিচ্ছু আসে যায় না।
সে সোফায় বসে নিজ কাজে ব্যস্ত হলো। এই বিয়ে নিয়ে দুদিন কাজ থেকে বিরতি নিয়েছিল সে। আর নয় কাল থেকেই হসপিটালে জয়েন্ট করতে হবে।শুধু শুধু ঘরে বসে থাকার চেয়ে হসপিটালের গন্ধ শুকা অনেক ভালো।তাছাড়া কিছুদিন পর সে থাকবেও না।
ল্যাপটপ ওপেন করে কালকের অ্যাপয়েনমেন্ট গুলো দেখতে লাগলো সে।
ল্যাপটপের স্কিনে লাগামছাড়া আজিব গুষ্ঠির ভিডিও কল দৃশ্যমান হলো তখন। দোটানা মনে তা রিসিভ করলো নিস্তব্ধ।
মুহুর্তে সকলের হাস্যউজ্জ্বল মুখশ্রীর সাথে ভেসে এলো লাগামহীন কথাবার্তা।
“বাসর রাত কেমন কাটছে আমাদের ডাক্তার বন্ধুর হুম হুম।”
— কেমন কাটবে মানে আমাদের বন্ধু তো নিজেই সার্জন। ইনজুরি হলে সে নিজেই সঙ্গে সঙ্গে সেলাই করে নিবে। সো নো চিন্তা গাইস।
ল্যাপটপ থেকে ভেসে আসা পর পর বাক্যলাপে চোখ বড় বড় করে নিলো তাসফি। আসতাগফিরুল্লাহ!
ছিঃ ছিঃ! কি অসভ্য মার্কা কথা বার্তা। ভাব দেখায় সাধুপনার।
নিস্তব্ধ আড়চোখে একবার তাসফির দিকে তাকিয়ে ঝটপট এয়ারপড গুজলো কর্ণে।
চোখ পাকিয়ে তাকালো বন্ধু মহলের দিকে।
সবগুলো বদমাশ মান সম্মান সব ধূয়ে দিচ্ছে ওরা ওই নাবালিকা মেয়েটার সামনে তার।
কলের ওপাশ থেকে সুজন চেঁচিয়ে উঠলো,,
কি খবর মামা, কথা বলো না কেন হুম। বাসর রেখে এখানে কি। নাকি দ্রুতই কাজ সেরে ফেলেছো বলো বাছা।
মাহিন ধমক দিলো তাকে আরে চুপ থাক সুজন মাঝি, এই নিস্তব্ধ বউ দেখা, বউ দেখা আগে। নিজের নাম নিস্তব্ধ তাই বলে কি বিয়েটাও এমন নিঃশব্দে করে ফেলবি বেটা। সালা চুপিচুপি বিয়ে করে নিলি, এই তোর কলিজার বন্ধুদের একটাবার খবর দিলি না। আরে তোদের বাড়ির পাশে বাড়ি আমাদের বলার সঙ্গে সঙ্গে তো হাজির হয়ে যেতাম, ফ্রিতে মাংস খেতাম। একটু বাসরের টাকা পেতাম।
মাহিনের সব উগরে দেওয়ায় ওপর পাশে থাকা সৃজন গলা খাকারী দিল। মাহিনের যেন হুশ ফিরলো কি বলছে সে দ্রুত নিজের জ্বীব কাটলো।
না মানে বলছিলাম আরকি আরশী না বললে তো জানতেই পারতাম না।
ওদের ফালতু কথায় নিস্তব্ধ বরাবরই নিরামিষ।কপাল কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— ফালতু কথা বাদ দিয়ে, কাজের কথা থাকলে বল নাহলে ফোন কাট।
এবারে আরশী আর আয়ানা চেঁচিয়ে উঠলো,,
— এই একদম ফোন কাটবি না। একে তো না বলে বিয়ে করেছিস তার উপর এখনো বউ না দেখিয়ে বসে আছিস। এখনি আমাদের ভাবীর ছবি পাঠা।
— নেই।
নিস্তব্ধ’র এক শব্দে রাগি চোখে তাকালো সকলে। যেন ভস্ম করে দিবে ওদের ওই চোখ দিয়েই।
সুজন বলে উঠলো নেই তাহলে ক্যামেরায় দেখা। নাকি সেটা দেখানোর…..
— যাস্ট, শাট আপ সুজন। ওর এখনে আঠারো হয়নি। বাজে কথা বলবি না।দেখতে ইচ্ছে হলে এসে দেখে যাস। আমি কাউকে দেখাতে পারবো না।
— সবাই চোখ উল্টে তাকালো।
— বলিস কি ভাই। ভাবীর আঠারো হয় নি।
— আরে ধুর আঠারো হয়নি তো কি হয়েছে। এখনকার মেয়েরা সব ওভার স্মার্ট বুঝলি মাহীন।
ওদের সবার কথায় তৃপ্তি প্রচন্ড বিরক্ত হলো।তার এসব অতিরিক্ত নেকামি বয় কিছুই মনে হচ্ছে না।
একেতো তাকে না জানিয়ে নিস্তব্ধ বিয়ে সেরে ফেললো।তার উপর বাসরের কথা শুনে তার গাঁ পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।
“নিস্তব্ধ যেহেতু বিয়ে টা মানছে না, তোদের এত আদ্যিক্ষ্যতা করার কি আছে আমি তো বুঝতে পারছি না।তোরা কেন এত নাক গলাচ্ছিস।
তৃপ্তি এর কথায় ফুঁসে উঠলো সুজন,
” কেন, কেন আদ্যিক্ষেতা করবো না কেন।নাক গলাবো একশোবার নাক গলাবো।আমাদের নাক আছে তাই আমরা হাজার বার নাক গলাবো।তুই বরং তোর ওই দর্গন্ধযুক্ত, সর্দি মাখা নাক নিয়ে দূরে থাক।
আমাদের প্রিয় বন্ধু বিয়ে করে এনেছে অথচ এখন বলবে সে নাবালিকা।উহু তা তো হবে না।কেন ভাই বিয়ে করার আগে মনে ছিল না। এহন সে নাবালিকা হোক আর বাচ্চা হোক, ভাই এখন আমাদের ওই নাবালিকা ভাবীর সাথেই তোর বাসর টা সেরে ফেলতে হবে।আর দ্রুত আমাদের মামা কাকা ডাক শুনিয়ে ফেলতে হবে।সো নো ডিসকাউন্ট। অনলি ফুল মানি পেমেন্ট কর দ্রুত। ”
“সাট আপ স্টুপিড”
নিস্তব্ধ’র ধমকে সুজন মোটেও চুপসে গেল না সে তার কথা চালিয়েই গেল।
” বুঝলি ভাই সৃজনের একটা বাচ্চার মামা ডাক শুনতে শুনতে শুনতে কান পচে জং ধরে গেল। খুব দ্রুত জং ছোটা তো। ভেবেছিলাম নিজেই পজিশন চেঞ্জ করবো।কিন্তু.. এখন তো দাবার গুটি পাল্টে গেল।এখন তুই ভরসা। কি বলিস সবাই।”
সবাই এক জোটে হইহই করে উঠলো। মনে হচ্ছে মেসেঞ্জার গ্রুপ ভেঙেই বোধহয় ওরা বেরিয়ে আসবে।
সুযোগ থাকলে তাই করতো বোধহয়।
অ্যাপটা কে বানিয়েছে তাকে এই সিস্টেম টাও চালু করে দিতে বলতে হবে।
মেসেজ থেকে টুকুস করে ঘরে বেরিয়ে আসবে।
নিস্তব্ধ খট করে কলটা কেটে দিলো এদের সাথে কথা বলা মানে তার সময় নষ্ট।
সবকটার লাগামহীন, বিকৃত মুখের ভাষা।
ফোনটা রিসিভ করাই তার বোকামো ছিল।
সবচেয়ে বেশী লাগামহীন সুজন। নিস্তব্ধ আজও ভেবে পায় না এই ছেলেটা তার প্রিয় বন্ধুর খাতায় নাম লেখালো কি করে।
বন্ধুদের ছবি দেখানোর কথায় নিস্তব্ধ’র মনে পড়লো সে তার সদ্য বিবাহিত বউয়ের মুখখানাই এখনো দেখেনি।ওই যে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে রমনী। কালো না ফর্সা তাও সে জানেনা।
তার জানার দরকারও নেই। যাকে বউ হিসাবে মানতেই পারছে না তার চেহারা দেখারও প্রয়োজন মনে করছে না সে।
নিস্তব্ধ বিছানার দিকে এগিয়ে গেল, নববধূর দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলো।
” এই মেয়ে এখনো সংয়ের মতো বিছানার মাঝে বসে আছো কেন?
সারারাত কি এভাবে বসেই কটাবে। দেখি সরে বসো। তারপর যা খুশি করো।
তাসফি মনে মনে ভেঙছি কেটে সরে বসলো।
নিস্তব্ধ কাঁত হয়ে সুয়ে পড়লো।
সিরিয়ালের মতো সে তার আরামের বিছানা ছেড়ে সোফায় ঘুমিয়ে ঘাঁড় ব্যাথা করতে পারবে না। অসম্ভব।
এই মানব তো কিছু না বলে ঠিক শুয়ে পড়লো।
এবার তাসফি কি করবে।
তাসফি খুব যত্ন নিয়ে পরোখ করলো তার নিজস্ব সুদর্শন পুরুষটিকে। যে কিনা বর্তমানে তার বর।কেমন নাম না জানা অনুভুতিতে শিহরিত হচ্ছে ভেতর টা।ফর্সা মশ্রিণ ত্বক,ঘন ভ্রু,, পেশিবহুল হাত,সারা অঙ্গে যেন পুরুষত্ব উপচে পড়ছে। পুরুষ মানুষ এত সুন্দর কেন হবে। তাসফিরর নিজেরই হিংসা হচ্ছে। বোধহয় পুরুষটি সৌন্দর্যের দিক দিয়ে তাকে ও ছাড়িয়ে গিয়েছে।আশ্চর্য! সুন্দর বলে কি তাসফি এই অহংকারী লোকটার প্রেমে পড়ে যাবে? মোটেও না।সুন্দর হলেই তো হবে না তার ব্যবহার একদম কুৎসিত। মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য ঠিক হলেই তো আর হবে না, ভেতরটাও সুন্দর হতে হবে।
বুড়িটা বলে দিল তার স্বামী নাকি লাক্ষে একটা। তার উপর ডাক্তার। তাদের নাকি মায়াদয়া বেশী। কিন্তু তাসফির ভাষ্যমতে ডাক্তার রা হয় কষাই। ঠিক মিলে গেল তার কথা। কিছুদিন পর সেও কষাইয়ের খাতায় নাম লেখাবে।বাবাকে কতো করে বোঝালাম,
” বাবা সবে আমি এইচএসসি দিলাম। ইন্টার্নি শেষ করি তারপর নাহয় বিয়ে করি। আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা বাবা।প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো।”
কিন্তু তার কোনো আকুতি কোনো কাজে দিলো না। বুড়ির কথায় বাবা বিয়েতে একপায়ে রাজী হয়ে গেল।
তাছাড়ান বুড়ির কথার সকল প্রশংসা এখন পুরোটাই উল্টো দেখছে তাসফি।এই মানব মোটেও ভালো মানুষ নয়। বদমাশ লোক একটা, আস্ত পাজি ডাক্তার।অসভ্য,বর্বর, কর্কশ।
মা নেই দাদি আর চাঁচির কাছে মানুষ সে। বাবাই তার সব।
মায়ের কথা তার ভীষণ মনে পরে। হৃদয়য়ের কষ্ট গুলো যেন তাসফির চোখ উপড়ে বেড়িয়ে আসতে চায়।ধীরে ধীরে বাবার প্রতি তার বড্ড অভিমান জমা হচ্ছে হৃদপৃষ্ঠে।হৃদয়ের পাথরটা দির্ঘাকৃতি রুপ নিচ্ছে যেন।তার মা ছিল একগুঁয়ে শিক্ষিত মহিলা।আজ তার মা থাকলে তার সারাজীবনের একটা ডিসিশন এইভাবে বাবাকে নিতে দিতো? হয় তো না। আজ তার বিয়েটাও বোধহয় এভাবে হতো না।
কেন বাবার হুট করে এত দ্রুত তার বিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়লো তাসফি জানে না। তবে তার বাবা তাকে যেই যুক্তি দিয়েছে তার মনে হয়েছে সেটা নিছকই একটা বাহানা মাত্র, নিশ্চিয়ই আরো অন্য বড় কোনো কারণ রয়েছে। যেটা শুধু সেই জানেনা। তবে তা তো সে জেনেই ছাড়বে।
নিস্তব্ধ’র নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে তাসফি বিরবিরালো কিছু।এই লোক সুন্দর হোক যা খুশি হোক।সেও কম নাকি। সে কি বানের জলে ভেসে এসেছে।
ইশশ সে নাকি নাবালিকা।আরে তোর চৌদ্দ গুষ্টি নাবালিকা। তওবা!তওবা! তুই নাবালিকা। আরে কিছুদিন পর এই তাসফি ডাক্তারী পরবে। কিছু বছর পর লোকের সেবা করবে আর সে নাকি নাবালিকা।যত্তসব।
হিসেব মোতাবেক আজ নাকি আবার তাদের বাসর রাত। বিয়ের প্রথম রাত যেহেতু বাসর রাত তো বটেই। কিন্তু বাসর রাত আসলে কেমন হয়? বাসর রাতে বুঝি এভাবে দুজন মানব- মানবী মুখ ঝামটি দিয়ে একে অপরের দিকে পীঠ দিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে।দুনিয়ায় আদ্যত্বেও কারো এমন বাসর হয়েছে কিনা তাসফি’র জানা নেই। বর বলে মেয়ে তুমি বেরিয়ে যাও আমার ঘর ছেড়ে। আহাঃ কত সুন্দর বাসর।
বাসর রাত নিয়ে তাসফির’র মাথা ব্যাথা কোনো কালেই ছিলনা। তবে এমন পরিস্থিতি কখনো তার সামনে আসবে সেটাও ধারণায় ছিলনা।
যাইহোক তবুও বাসর রাত নিয়ে তার খুব ভালো এক্সপেরিয়েন্স হলো অবশেষে না চাইতেও।
গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হলো আর শ্বাস নালি ফেড়ে।
এখন দেখার পালা এই গভীর নিঃশ্বাস কবে হালকা হবে, তারই প্রহর গোনা।
খচমচে ভারী শাড়ি পড়েই সেও কাঁত হয়ে শুয়ে পড়লো।
বিয়ে টিয়ে নিয়ে তার কোনো স্বপ্ন নেই। তার ইচ্ছা একদিন সে বড় ডাক্তার হবে। সব ডাক্তারের মতো কষাই সে হবে না। সে হবে নরম ধরনের ডাক্তার। যেমন অন্যদের মতো সে নিজের রুগীকে কখনো এই অসহ্য মানবের মতো ধমকাবে না।তার হৃদয় আবার ফোমের মতো নরম কিনা।
ঘুমেরা ধরা দিল তাদের চোখে। কালো নিয়ন আলোয় কি সিগ্ধই না লাগছে তাদের। যেন তাসফি’র সংস্পর্শে অধিক আলোকিত এই দাম্ভিক ডাক্তার নিস্তব্ধ ইয়াসারের কোপলখানা।
আকাশের চাঁদমামা সঙ্গে শজ্জায়িত তাসফি’র উজ্জ্বল মুখের আদলে লুকিয়ে থাকা আলোয় নিস্তব্ধ’র আধারে ঢাকা ঘর আজ আলোকিত।
তবে ডাক্তার নিস্তব্ধ ইয়াসার কবে তা ঠাহর করবে?
কবুল একটি মাত্র শব্দ বলার সাথে সাথেই নাকি মেয়েদের জীবন পরিবর্তন হয়ে যায়। আসলেই কি শুধু কবুল বলার কারণে তাদের জীবন পরিবর্তন হয়? উহু। তাদের জীবন পরিবর্তন হয় যখন তাদের চেনা পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে একদম ভিন্ন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে হয়।
ঘর আলাদা, ঘরের লোক আলাদা, এমন কি নিজের চেনা পরিচিত রুম টাও বদলে যায় এক লহমায়। একজন অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে থাকতে হয় এক বিছানায়।
আর পরিবেশ বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, সেই কবুলের কঠিন ধাপ গুলো ও বেরিয়ে আসতে থাকে। কেউ কেউ মানিয়ে নিতে পারে। কেউ কেউ পারে না।
হয় ডিভোর্স।
তাসফি কি পারবে মানিয়ে নিতে?
দুজন বিপরীত মানসিকতার জেদী মানব- মানবীর মিলন কেমন হবে? কি করে হবে তাদের মিলন?
আদ্যত্ত্বে কি দুজন বুনবে ভালোবাসার বুনন হৃদমাঝারে? নাকি অন্যদের মতো তাদের পরিণতিও হবে শূণ্য।
তাদের জীবনের ধূসর রংধনু ঠেসে বের করে আনতে পারবে কি সাত রঙা ওই উজ্জ্বল রংধনু।
যার প্রতিটা মুহুর্ত জ্বলজ্বল করবে তাদের ভালোবাসার রঙিন শিহরণে।