অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭২

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭২
ইয়াসমিন খন্দকার

আরহা ও আরুশিকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে এলেন রাজীব হাসান ও মাশরাফি। মিসেস রুমি এবং রিয়াশা তাদের দেখে অবাক হলো। রিয়াশা আরহার কাছে এসে বলল,”আরহা, তুই!”
রাজীব হাসান বললেন,”ওরা এখন এখানেই থাকবে৷ অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।”
“কি হয়েছে?”
জানতে চান মিসেস রুমি। রাজীব হাসান সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। সব শুনে মিসেস রুমি ও রিয়াশা দুজনেই অবাক হয়। রিয়াশা আরহাকে বলে,”আমার ভাইয়া তোকে এত ভালো বাসে যে তোর জন্য নিজের জীবন, ক্যারিয়ার সব কিছু এভাবে বাজিতে লাগিয়ে দিল? সত্যিই তুই অনেক ভাগ্যবতী আরহা৷ এমন ভালোবাসা সবার কপালে জোটে না।”

আরুশিও বলেন,”একদম ঠিক বলেছ তুমি রিয়াশা। আমার মেয়েটা সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী।”
মিসেস রুমি বলেন,”কিন্তু আরহাকে তো সবাই শুধুশুধু ভুল বুঝছে৷ এসব ভুল বোঝাবুঝি তো মেটা দরকার।”
আরুশি বলেন,”নাহ, আমার মেয়েকে যদি ওরা ভরসা না করে তাহলে ওদের ভুল বোঝাবুঝি মেটানোর কোন দায় আমার মেয়ের নেই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমার মেয়েকে আমি একাই সামলে নেব। আমি একজন প্রতিষ্ঠিত সাইকোলিস্ট নিজের মেয়েকে আমি সামলে নেব। আমার কোন সমস্যা হবে না।”
মাশরাফি বলে,”আমিও আপনাদের পাশে থাকব আন্টি। সামনে আরহার এইচএসসি পরীক্ষা ওকে মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে,ভালো ফলাফল অর্জন করতে হবে। আরহার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া এই স্বপ্ন পূরণের পথে আমি ওর পাশে থাকবো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাশরাফির এমন কথা শুনে আরহার চোখে জল চলে আসে। রিয়াশা আরহার চোখের জল মুছিয়ে বলে,”ধুর পাগল! এভাবে কাঁদছিস কেন? আমরা সবাই তোর পাশে আছি। তোকে মেডিকেলে চান্স পেতেই হবে। তুই যদি ডাক্তার হতে না পারিস তাহলে কিন্তু তোকে আমি ভাবি বলে মানবো না। আমার ক্রিকেটার ভাইয়ের জন্য আমার ডাক্তার ভাবি লাগবে। বুঝলে? তাই এসব কান্নাকাটি বাদ দে। এখন যা পড়তে বস।”
আরহা একটু স্বাভাবিক হয়ে বলে,”আমাকে যে খুব জ্ঞান দিচ্ছিস তা তোর কি খবর? আমি একা না তুইও তো এবার এইচএসসি দিবি। তোর কোন প্রিপারেশন তো দেখছি না।”
রিয়াশা বলে,”তুই তো জানিস, আমার স্বপ্ন কি। আমি একজন গায়িকা হতে চাই। আমি আমার সেই স্বপ্নের পথে হাটব। পড়াশোনা আমার জন্য ম্যান্ডাটরি না।”
এমন সময় মিসেস রুমি এগিয়ে এসে রিয়াশার কান টেনে ধরে বলে,”এসব বললে শুনবো না। যাও গিয়ে পড়তে বসো।”

“উফ মা,লাগছে ছাড়ো। আচ্ছা,আমি পড়তে যাচ্ছি।”
“হুম,আমার সামনে কোন অজুহাত চলবে না। যাও, দুজনেই গিয়ে পড়তে বসো।”
রিয়াশা আরহাকে নিজের সাথে নিয়ে যায়। আরুশি রাজীব হাসানকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”ভাইয়া, আমি এমনিতেই আপনাদের কাছে অনেক ঋণী। এই ঋণের বোঝা আর বাড়াতে চাই না। তাই ভাবছি কোন ফ্ল্যাট যদি ভাড়া নেয়া যেত।”
মিসেস রুমি বলে ওঠেন,”এসব আপনি কেমন কথা বলছেন? আপনি কি আমাদের পর? রাজীব তো আপনার ভাই হয়। এখানেই থাকুন না।”

“সেটা ব্যাপার না ভাবি। কিন্তু মাশরাফি ও আরহার এনগেজমেন্ট হয়েছিল এখনো বিয়ে হয়নি। এরমধ্যে যদি ওরা একসাথে একই ছাদের নিচে থাকে তাহলে এটা নিয়ে অনেক কথা হবে। আমি সেটা চাইছি না। তাই আরকি..”
রাজীব হাসান বলেন,”তোমার চিন্তাটা ঠিক আছে। আমি দেখছি কি ব্যবস্থা করা যায়। আর হ্যাঁ, আরহা ও মাশরাফির বিয়েতে আমি দেরি করতে চাই না। আমি ভাবছি, আরহার এইচএসসি পরীক্ষা আর এডমিশন টা মিটে গেলেই বিয়ের ব্যবস্থা করছি।”
মাশরাফি বলে ওঠে,”কিন্তু আরহার পরিবারের বাকি সদস্যদের কি মত আছে? তাদের ছাড়া কিভাবে এই বিয়ে হবে?”
আরুশি রেগে বলেন,”যাদের আসার তারা আসবে। কাউকে তো জোর করে আনা যাবে না। কিন্তু বিয়েটা হবেই। আমি আরহার মা হিসেবে মত দিচ্ছি। আশা করি, এটাই যথেষ্ট হবে। আর কার অনুমতি লাগবে না। বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?”

“হুম, বুঝেছি। আরু একদম ঠিক বলেছে।”
বললেন রাজীব হাসান। তার মনে হয়, আরুশির কথাই ঠিক।
আরহাকে রুমে নিয়ে এসে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিল রিয়াশা। কিন্তু আরহা স্বাভাবিক হতে পারছিল না। আরহা রিয়াশাকে বলে ওঠে,”পাপা, আমিনা আপু, আকাশ ভাইয়া ওরা কি কখনো আমায় ক্ষমা করবে না?”
“ওদের কথা ভাবছিস কেন তুই? যারা তোর কথা ভাবে না তাদের কথা ভেবে তুই কি করবি?”
“কিন্তু ওরা তো আমার আপনজন। ওদের কিভাবে আমি পর করি?”
রিয়াশা বুঝতে পারে আরহার মনের অবস্থা। তাই সে আরহার মন ভালো করার জন্য বলে,”আচ্ছা, তাহলে চল আমি তোকে একটা গান শোনাই। গান শুনলে তোর মন একদম ভালো হয়ে যাবে। ”
এটা বলেই সে গান গাইতে শুরু করে।

রিয়াশা যখন গান গাচ্ছিল, আরহা চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। রিয়াশার মন ভালো করা কণ্ঠস্বর যেন আরহার ভেতরের মেঘগুলোকে কিছুটা হলেও সরিয়ে দিচ্ছিল। গান শেষ হলে আরহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আরহা বলল,”জানিস, তোর গান শুনলে মনটা একটু হালকা হয়। কিন্তু আমার ভেতরে একটা কাঁটার মতো বিঁধে আছে যে, আমার আপনজনেরা আমাকে ভুল বুঝছে। ওরা জানে না আমি কত অসহায় ছিলাম। ইচ্ছা করে কিছু করিনি।”
রিয়াশা আরহার হাত ধরে বলল,”তুই কেন ওদের কথা ভাবছিস? যারা তোর বিপদে তোর পাশে ছিল না, বরং তোকে ভুল বুঝেছে, তাদের নিয়ে এত চিন্তা করার দরকার নেই। তোর মা আছেন, মাশরাফি আছে, আমরা আছি।”
আরহা চুপ করে রইল। রিয়াশার কথাগুলো সে বুঝতে পারছিল, কিন্তু বুকের ভেতরের কষ্টটা মোছা যাচ্ছিল না। তার চোখ আবার ছলছল করে উঠল।

রিয়াশা আরহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল,”আচ্ছা, বাদ দে এসব। এখনো অনেক সময় আছে। যখন সব ঠিক হয়ে যাবে, তখন দেখবি সবাই তোর কাছে ফিরে আসবে। এখন তোর প্রধান কাজ হলো পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া। দেখবি, ডাক্তার হয়ে যখন তুই ওদের সামনে দাঁড়াবি, তখন ওরাই তোর কাছে ক্ষমা চাইতে আসবে।”
আরহা মুখ তুলে রিয়াশার দিকে তাকাল। রিয়াশার কথায় একটা জোর ছিল, যা আরহাকে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করল।
এদিকে নিচে ড্রইংরুমে রাজীব হাসান আরুশিকে বললেন,”আরুশি, আমি আজই একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করছি। তোমার কথাটাও ঠিক। ওদের বিয়ের আগে একই ছাদের নিচে থাকাটা হয়তো অনেকের কাছে ভালো নাও লাগতে পারে।”

আরুশি মাথা নেড়ে সায় দিলেন। বললেন,”হ্যাঁ রাজীব ভাই, এটাই ভালো হবে। আর ওদের পড়াশোনার জন্য একটা শান্ত পরিবেশ দরকার।”
মাশরাফি এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। এবার সে বলল,”কিন্তু আন্টি, আরহার বাবার জন্য কি আমরা অপেক্ষা করব না? আরহার বাবা ছাড়া কি বিয়েটা সম্ভব?”
আরুশি কড়া চোখে মাশরাফির দিকে তাকালেন। বললেন,”যে বাবা নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করে না, বিপদের সময় তার পাশে থাকে না, তার জন্য অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। আরহার জন্য আমিই যথেষ্ট। আরহার বাবা আসুক বা না আসুক, বিয়ে হবেই।”

মাশরাফি আর কোনো কথা বলল না। সে বুঝল, আরুশি তার মেয়ের ব্যাপারে কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রাজীব হাসানও আরুশির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজীব হাসান তার পরিচিত একজন রিয়েল এস্টেট এজেন্টের সঙ্গে কথা বললেন। তারা দ্রুত একটি উপযুক্ত ফ্ল্যাটের খোঁজ দিতে রাজি হলো। রাজীব হাসান সিদ্ধান্ত নিলেন, আজই তিনি আরুশি ও আরহাকে ফ্ল্যাট দেখতে নিয়ে যাবেন।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭১

সন্ধ্যা নামতেই রাজীব হাসান, আরুশি, আরহা ও মাশরাফি একটি ফ্ল্যাট দেখতে গেল। ফ্ল্যাটটা বেশ ভালো ছিল, পড়াশোনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশও ছিল। আরহা ফ্ল্যাটটা দেখে খুশি হলো। মাশরাফি আরহার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। সে মনে মনে ভাবল, আরহার স্বপ্ন পূরণে সে সবসময় ওর পাশে থাকবে। এই নতুন জায়গায় নতুন করে সব শুরু করার একটা আশা দেখছিল আরহা। হয়তো এই নতুন শুরু তাকে পেছনের সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৩