সুগন্ধি ফুল ২ পর্ব ৪

সুগন্ধি ফুল ২ পর্ব ৪
জান্নাত সুলতানা

ঘুমের মধ্যে ফিজা অনুভব করতে পারছে তার উদর জুড়ে একটা শীতল স্পর্শ। যা খুব সুক্ষ্ম কিন্তু গভীর ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার শরীর। মধ্যরাতে ঘুম চোখে ধরা দিয়ে ছিলো। তাই একটু সময় লাগলো সম্পূর্ণ বিষয় টা বুঝে উঠতে। পিটপিট করে লাল লাল চোখে যখন সামনে চাইলো তখন কোনো কিছুই নজরে এলো না। পাশ ফিরে বিছানা থেকে দূরে আবরাজ কে সোফায় বসে ল্যাপটপ কোলে কিছু করতে দেখা গেলো। ফিজা চিন্তায় পরলো। সে যে কিছু সময় পূর্বে অনুভব করলে তবে কী তা ভ্রম মাত্র নিজের?

-“হোয়াট হ্যাপেন জান? এমন লাগছে কেনো তোমায়? ঘুম ভালো হয় নি, সুগন্ধি ফুল?”
ফিজা সাথে সাথে জবাব দিতে পারলো না। আবরাজ উত্তরের অপেক্ষা করলো ও না। সে নিজের কাজ ফেলে দ্রুত পায়ে বউয়ের কাছে এলো। ফিজা নিজের শাড়ী ঠিক করে বিছানায় পা ভাজ করে বসলো। বললো,
-“আপনি একটু আগে এখানে ছিলেন?”
-“আমি তো এখানেই।”
-“মজা করবেন না। আমার মনে হলো কেউ আমার গ,,,”
বলতে বলতে থেমে গেলো ফিজা। আবরাজ সাথে সাথে ওর গলা টা চেপে ধরে নিজেও ঝুঁকে গেলো ফিজার দিকে। পরপরই আবরাজ বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“বলো বলো। স্পিক আপ।”
ফিজার গলা দিয়ে আর শব্দ বের হয় না। কিভাবে হবে? একটা মানুষ এভাবে গলা মুখ গুঁজে রাখলে এটা আদৌও পসিবল? ফিজা তবুও বললো,
-“আবরাজ ছাড়ুন প্লিজ। আমার অস্থির লাগছে।”
-“তোমার অস্থির লাগছে না। আমি জানি তোমার ভালো লাগে।”
হাস্কি আওয়াজ পুরুষ টার। ফিজা সত্যি বুঝতে পারে না তার কী অস্থির লাগে না-কি ভালো লাগে। তবে কিছু তো একটা হয় যা তার কথা বলার শক্তি হারিয়ে যায়। ফিজার ভাগ্য সহায় ছিলো বিধায় হয়তো শাশুড়ির ডাক এলো তখন। আবরাজ মেড কে জিজ্ঞেস করলো বিশেষ কোনো কারণ। তখন মেড জানালো ব্রেকফাস্ট এর জন্য ডাকছে। আবরাজ একথা শোনামাত্র বউ কে ছাড়লো। সরে এসে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
-“যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।”

ফিজা ধীরে উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশ রুমে যেতে যেতে পুরো রুম পর্যবেক্ষণ করে নিলো। একপাশে বিশাল জানালা, সিল্কের হালকা ক্রিম কালারের পর্দায় ঢাকা। মাঝখানে আছে একটা কিং সাইজের মাস্টার বেড। বিছানায় হালকা গ্রে শেডের থ্রি-পিস বেডকভার, সাথে ম্যাচিং কুশন আর ছোট্ট একটা ছড়িয়ে রাখা সাদা কম্বল। বিছানার একপাশে আছে কাঠের তৈরি একজোড়া বেডসাইড টেবিল, একটাতে রাখা বইয়ের গাদা। আরেকটাতে একটা ছিমছাম টেবিল ল্যাম্প। বেশ পরিপাটি আর সৌখিনতার পরিচয় বহন করছে যেনো কক্ষ টা।
রুমের এক কোনায় বসানো ড্রেসিং টেবিল। মাঝারি মাপের আয়না, চারপাশে লুকানো লাইট। নিচে কয়েকটা ড্রয়ার, যার একটাতে সাজসজ্জার জিনিস। আরেকটাতে পারফিউমের বোতল। দেখা যেনো অনুমান করা যাচ্ছে পারফিউম এর বোতল গুলো এক-এক টা বেশ দামী হবে।

টেবিলের উপর ছোট্ট গ্লাস ভেস, তাতে কিছু আধমরা ফুল।
ফিজা দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে আর রুমের অন্য পাশে রাখা সোফায় বসে যে আবরাজ খান ওকেই দেখছে সেদিকে খেয়াল নেই মেয়ে টার। ওয়াশ রুম থেকে নরমালি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো ফিজা। কাপড় রাতের টাই পরনে। রুমে ফিরে দেখলো আবরাজ কাঠের প্যানেল দিয়ে করা বিল্ট-ইন ক্লোজেট এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। স্লাইডিং দরজা, একটায় আয়না লাগানো। ভেতরে আলাদা শেলফ, হ্যাংগার রোড, এবং জুতা রাখার জায়গা। সবকিছু গোছানো। রঙ অনুযায়ী শার্ট সাজানো, সিল্কি শাড়িগুলো কাভারে ঝুলছে। শাড়ী দেখে ফিজার মাথায় আকাশ ভেঙে পরার জোগাড়। একজন অবিবাহিত পুরুষের ক্লোজেটে শাড়ী? তৎক্ষনাৎ মাথায় বাসা বাঁধল আবরাজ খান কী তবে পূর্ব কোনো রমণীর সঙ্গে সংসার করেছে? তবে পরক্ষণেই সেই চিন্তায় ফিজার নিজের ওপর রাগ হয়। ছিঃ ছিঃ এ হতে পারে না। কোনো কিছু আগে পরিকল্পনা করে নেওয়া ঠিক নয়। ফিজা একটু এগিয়ে গিয়ে হাত দু’টো কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞেস করলো,

-“এখানে এতো শাড়ী?”
-“ইয়াহ। অল ইউর’স।”
ফিজা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আবরাজের মুখের দিকে খানিকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো। আবরাজ হয়তো বউয়ের মনোভাব বুঝতে পারলো। একটা শাড়ী মেয়ে টার হাতে দিয়ে বললো,
-“গো ফাস্ট রেডি হয়ে এসো।”
ফিজা শাড়ী হাতে নিলো। চিকন জর্জেট টাইপ শাড়ী টার ডাস্টি পিংক বা পুরনো গোলাপি রঙের ও বলা যায়। পুরো শাড়ি জুড়ে অফ হোয়াইট রেশমি থ্রেডের কাজ রয়েছে। ছোট ছোট জ্যামিতিক প্যাটার্নে সূক্ষ্ম কড়ি-কাটার কাজ যেনো নজরকাড়া সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। পাড়ে মোটা ডিজাইন, যেখানে ফুলের মতো মোটিফ ও ঘন এমব্রয়ডারির কাজ রয়েছে সিলভার রঙে। প্রান্তে আছে হালকা ঢেউখেলানো কারচুপি। যেটার ফিজার খুবই পছন্দ হলো। শাড়ী নিয়ে ও মাথা দুলিয়ে ফের ওয়াশ রুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আবরাজ পেছন থেকে বলে উঠলো,

-“কোথায় যাচ্ছো?”
-“ওয়াশ রুম।”
-“আমি বাইরে যাচ্ছি তুমি এখানেই চেঞ্জ করে নাও।”
বলতে বলতে আবরাজ বেরিয়ে গেলো। ফিজা আয়নার দরজা টা আলগোছে চাপিয়ে দিলো। রেডি হয়ে যখন বেরিয়ে এলো আবরাজ তখন বসে আছে। ওর অপেক্ষায় না-কি অন্য কারণ বোঝা গেলো না।
তবে হাতের ইশারায় ফিজা কে কাছে ডাকলো। ফিজা এগিয়ে এলো। শাড়ির আঁচল টা মাথায় তোলা তখন। আবরাজ আচমকাই ওর হাত টেনে ধরে হেঁচকা টানে নিজের উরুর ওপর বসিয়ে দিলো। মাথা থেকে আঁচল খসে পরলো। সাথে সাথে উন্মুক্ত হলো ঘাড়গর্দান। ফিজা এক হাতে শাড়ির আঁচল শক্ত করে কাঁধে চেপে ধরে। অন্য হাত টা আবরাজের ঘাড় আঁকড়ে ধরলো। আবরাজ কিছু সময় চুপ থেকে নিষ্প্রভ দৃষ্টে চেয়ে রইলো বউয়ের মুখের দিকে। পরপরই হিমবাহের ন্যায় শীতল কণ্ঠে বললো,

-“আই নিড সাম থিং, ডু ইউ নিড এনি থিং জান?”
ফিজা চোখ কটমট করে তাকায়। আবার সকাল সকাল মানুষ টার নির্লজ্জ কথাবার্তা শুরু হয়েছে। সারাদিন কিভাবে পাড় হবে? এই বেহায়া নির্লজ্জ পুরুষ তাকে সুস্থ রাখবে তো? মনে তো হচ্ছে না। নির্লজ্জ কথাবার্তা দিয়ে তাকে মেরে ফেলবে বোধহয়। ফিজা আবরাজের বুকে ধাক্কা দিলো। শাড়ির আঁচল টা মাথায় তুলে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে আওড়াল,
-“অসভ্য নির্লজ্জ পুরুষ।”
আবরাজ ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়াল। ফিজা দরজার সামনে থেকে শুনতে পেলো আবরাজ বলছে,
-“আমি অসভ্য, নির্লজ্জ পুরুষ তা তো শুধু তুমিই জানবে সুগন্ধি ফুল। কারণ আমি তোমার কাছেই অসভ্যতামি করবো।”
ফিজা পেছনে তাকালো না আর। মূলত তাকানোর মতো সাহস টা করে উঠতে পারলো না। বুক টা দুরুদুরু করছে। কাঁপছে বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা। তাই তো নিজে কে লুকিয়ে পালিয়ে গেলো।

পুরো সকাল টা ফিজা শাশুড়ির আঁচল ধরে ঘুরঘুর করলো। মিসেস ইলা রান্না ঘরে রান্না করছে ফিজা সেখানেই ওনার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। শাশুড়ির বেশ মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে। রান্না করতে বেশ পছন্দ করে ভদ্রমহিলা। বাড়িতে রান্নার জন্য আলাদা রান্না দু’জন লোক থাকলে-ও তিনি রান্না নিজের হাতেই করে থাকেন। স্বামী উনার হাতের রান্না বেশ পছন্দ করে। তবে বাড়িতে যেহেতু দুইজনেই থাকে শুধু তাই রান্না করতে উনার তেমন অসুবিধা হয় না। বরং রান্না তিনি যতোদিন সুস্থসবল থাকবেন ততদিনই করার মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
শাশুড়ির সাথে গল্পে গল্পে ফিজা আশে-পাশের কথা এবং সে শ্বশুর বাড়িতে আছে একথা ও একপ্রকার ভুলেই গেলো। তবে আচমকাই খুব জোরে রান্না ঘরের বাইরে থেকে আবরাজ তার মাকে ডাকছে।

-“আম্মু! আম্মু!”
ইলা বেগম অবাক হলেন। ফিজাও হতভম্ব হয়ে গেলো। দুজনেই দ্রুত পায়ে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। টেবিলের ওপর থেকে সবেমাত্র একটা আঙুরফল তুলে মুখে দিয়েছে আবরাজ। স্বাভাবিক সে। ইলা বেগম চিন্তিত হয়ে ছেলে কে জিজ্ঞেস করলো,
-“কী হয়েছে বাবা? কিছু লাগবে তোমার?”

-“হাঁ আম্মু। বউ লাগবে। তুমি আমার বউ সকাল থেকে নিয়ে রেখেছো। এখন আমার বউ আমাকে ফেরত দাও।”
দুই জোড়া চোখ বিস্ময়ে আকৃতি ধারণ করলো গোলগোল। কী সব বলছে মাথা ঠিক আছে তো? ফিজার লজ্জায় মনে হলো মাটির তলায় লুকিয়ে যেতে। অথচ সামনের পুরুষের কোনো হেলদোল নেই। সে টপাটপ আরও কয়েকটি আঙুর মুখে পুরে নিচ্ছে। মিসেস ইলা বেগম তাড়া দেখিয়ে রান্না ঘরে যেতে যেতে অস্থির কণ্ঠে বললো,

সুগন্ধি ফুল ২ পর্ব ৩

-“তোমার বউ তুমি নিয়ে যাও। আমার রান্না ঘরে মেলা কাজ। আমি যাই।”
ফিজা চোখ কটমট করে তাকালো আবরাজের দিকে। আবরাজ সে-সব তোয়াক্কা করে না। বরং চোখ টিপে দিয়ে বললো,
-“উম দেখো না দেখো না। এভাবে দেখো না জান। নিজের সর্বনাশ কখনো হবে টেরও পাবে না।”

সুগন্ধি ফুল ২ পর্ব ৫