প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৮ (২)
সাইয়্যারা খান
আগামী বুধবার নির্বাচন। এলাকার বালিকা বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। সারা এলাকা কেঁপে উঠছে স্লোগানে। যেই এলাকা গড়া এক দলে সেই এলাকায় বিপরীত দলের হয়ে স্লোগান। বিষয়টা সহজ না আবার জটিলও না। রাজনীতি এমনই। যখন যেটা প্রয়োজন সেটাই করতে হবে। বালিকা বিদ্যালয়ের রোডের বিপরীতে সামান্য সামনে আসলেই একতলা ক্লাব। এখানে মূলত বিভিন্ন টিকাদান কর্মসূচি করা হয়। মাঝেমধ্যে নারীশিক্ষা সহ সরকারীভাবে নারী উদ্যোগতা নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচী হয়।
ক্লাবটার প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট চেয়ারম্যান। একতলা বিশিষ্ট ক্লাবের উপরের দেয়ালে খোদাই করে লিখা ইংরেজি দুটো শব্দ ‘এসটি’। হালকা দেখতে শব্দ দুটো যার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে সে কিন্তু মোটেও হালকা না বরং ভীষণ ভারী। মানবসম্পদ এই ক্লাবের একদম উল্টো দিকে রাজনৈতিক ক্লাব। আপাতত বিপক্ষের সেই ক্লাসে বাম পায়ের উপর ডান পা তুলে বসা তৌসিফ তালুকদার। দাঁড়ি চুলকে কিছু একটা ভাবছে সে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বরাবর সম্মুখে উমায়ের শিকদার। তার চোখ মুখ হাসি হাসি। তৌসিফে’র খাদে থাকা চোখ দুটিও সামান্য হাসলো। তার পাতলা৷ ঠোঁটের হাসিটা আবার গাঢ় হয় না। গাঢ় করে জোড়ালো ভাবে হাসতে পারে না তৌসিফ। মাঝেমধ্যে মনে হয় এই হাসিগুলো মিথ্যা। তৌসিফ তালুকদার জোর করে হাসে। বানোয়াট হাসি। প্রাণখোলা তার হাসি এক নারীর আঁচলে বাঁধা। যতদিন না সেই আঁচলের গিট খোলা হচ্ছে ততদিন তৌসিফ নাহয় মিথ্যা হাসিই হেসে গেলো।
উমায়ের সাথে আজ দীর্ঘক্ষণ আলাপ হলো। তৌসিফ ঘাড় কাত করে বললো,
“বুধবার কেন্দ্রে থাকবেন?”
“তুমি আছো না?”
উমায়ের উল্টো প্রশ্ন করলো। তৌসিফে’র তা পছন্দ হলো না। প্রশ্নের পৃষ্ঠে প্রশ্ন তার পছন্দ নয়। এখন যদিও কিছু বললো না ও কিন্তু মনে মনে বেজায় বিরক্ত হলো। বিরক্ত হলে ও নড়চড় করে যা এখন করছে। ডান পা দোলাচ্ছে। উমায়ের উত্তরের আশায় চেয়ে আছে। তৌসিফ স্বাভাবিক গলায় বললো,
“দায়িত্ব নিয়েছি আমি। সবটা দেখব আমি। আমি থাকছি কেন্দ্রে।”
“বালিকা বিদ্যালয়ে তোমার এলাকার সবাই আসবে। এই দিকটা নিয়ে চিন্তা নেই আমার। বাকি দিকগুলোয় যে শু’য়ো’রের বাচ্চাগুলো কি করবে বুঝতে পারছি না। সারাটা বছর পারলে র’ক্ত চুষে খায়, কাজের বেলায় শূন্য।”
“র’ক্ত চোষারা কখনো আপন হয় না।”
উমায়ের রহস্য লুকিয়ে হাসে। ছোট্ট করে বলে,
“অভিজ্ঞ তুমি।”
“কথা সত্যি।”
তৌসিফ কথা ঘুরালো। নিজেদের ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ উময়েরের সাথে করবে ওমন ব্যক্তি তৌসিফ না। তৌসিফ কথায় কথায় এখানকার আয়োজন জানালো,
” এজেন্ট বসবে প্রতি টেবিলে দুই থেকে তিনজন। ওদের সকালে রুটি, কলা সহ চা আর দুপুরে যত মানুষ থাকবে সবার জন্য বিরিয়ানি। স্কুল মাঠের পেছনে রান্না। এলাকায় পোস্টার সহ চৌদ্দটা রিক্সা ছাড়া হচ্ছে। রিক্সা গুলো শাখা গলিতে থাকবে। মহিলাদের আনা-নেয়া করবে। কারো যাতে যাতায়াতে অসুবিধা না হয় সেদিকটা খেয়াল রাখবে। রোদ উঠার সম্ভবনা আছে বুধবারে তাই ছায়াযুক্ত স্থানে খালি চেয়ার রাখা হচ্ছে। পানি বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে। আমার ছেলেপেলে রাস্তায় থাকবে। যখন যা লাগবে দেখবে। আশা করি জনগণ এতে সন্তুষ্ট হবে।”
উমায়ের হা করে তাকিয়ে ছিলো। তৌসিফ তাকাতেই মুখটা বন্ধ হলো। মস্তিষ্ক হোক বা আবেগ সেটা নিয়ে তৌসিফ তালুকদার যেভাবে খেলবে খেলা সেদিকেই আগাবে। এর শরীর হোক বা চিন্তা ভাবনা সবটায় যে পূর্ব থেকে রাজনীতি তা আজ মনে মনে আরেকবার স্বীকার করলো উমায়ের।
যে কাউকে, বিশেষ করে একটু নিম্নবর্গীয় মানুষ’কে আবেগ দিয়ে কেনার হলে তাকে একটু খাওয়ালেই যথেষ্ট আবার মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগনকে একটু অতিরিক্ত সম্মান দেখলেই এরা সসম্মানে নুয়ে যায়। রিক্সা গুলো যখন তাদের বাড়ীর সামনে থেকে সসম্মানে তাদের কেন্দ্রে পৌঁছাবে তখন নিশ্চিত তারা গলবে। একটু বেশিই গলবে। যুবসমাজের ছেলেপেলে গুলো আবার তৌসিফ ভক্ত। তারা শুধু একটু নজরে আসার চেষ্টায় থাকে। এই রাস্তায় থাকার সুবাদে তারা নিজেদের জাহির করতে মরিয়া হয়ে উঠবে। ভলেন্টিয়ার হয়ে সেবা করা নিছক এক বাহানা মাত্র।
তৌসিফ উমায়েরের চোখে ভরসা দেখলো। দেখলো সন্তুষ্টি। অপেক্ষা বুধবারের।
হাজার বলেও পৌষ’কে কোন ভাবেই রাজি করানো যাচ্ছে না। মেয়েটা ঘাড়ত্যাড়া। হেমন্ত একথা জানে। পৌষ যেহেতু বলেছে ও যাবে ন এরমানে যাবে না। মায়ের উপর চরম রাগ হচ্ছে হেমন্তের। তার যে পৌষ’র সাথে কি সমস্যা তাই বুঝে না ও। এদিকে আজ ওবাড়ীতে বলা হয়েছে হেমন্ত আর পৌষ আসবে শ্রেয়াকে নিতে। তাদের একমাত্র মেয়ে, হুট করে তো আর হেমন্তের হাতে ছাড়বে না। এখন যদি পৌষ’কে না নেয় তাহলে কাকে নিবে? পিহা’কে নেয়াটাও মানায় না। ও ছোট মানুষ। মা’কে বললে এখন বলবে চাচিদের নিয়ে যেতে।
এতে করে শ্রেয়া অস্বস্তিতে পরবে। টিশার্ট পড়ে গায়ে সুগন্ধি মাখলো হেমন্ত। কপালের চুলগুলো উল্টো আঁচড়ে মানি ব্যাগ পকেটে ভরে বেরিয়ে এলো পৌষ’র ঘরে। এই ঘরে মিটিং হচ্ছে। হেমন্তের মন খারাপ হুট করে ঠিক হয়ে গেলো। পৌষ তৈরী হওয়া। একটু আগে বিরাট এক ধমক সে পৌষ’কে দিয়েছে। পৌষ তখন একদম চুপ করে ছিলো কিন্তু কেঁদেছে তার বাকি তিনটা কলিজার টুকরো বোন, সাথে মাথা নত করে ছিলো দুই ভাই। হেমন্ত এত জোরে ধমক দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গিয়েছিলো। সে দেখাতে চায় নি পৌষ’কে ধমক দিয়ে তার ভেতরে কতটা কষ্ট লেগেছে।
পৌষ’র খাটে চিৎ হয়ে শুতেই বুকের উপর উঠলো ইনি,মিনি। হেমন্ত চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো,
“চুল গুলো টেনে দে। আর মাথাটা টিপে দে।”
দুই বোন দেখলো ভাইকে। মুখ লটকে চুল ধরে জোরে টান দিয়ে বললো,
” তুমি পতা হেমুবাই। আপাকে বতা দিলে ত্যান?”
“তোদের আপা যে ঘাড়ত্যাড়া।”
দুটোই তাকালো পৌষ’র দিকে। পৌষ দিলো এক খ্যাঁকানি,
“ঐ চোখ নামা। তোদের বাপের ঘাড়ত্যাড়া। পৌষরাতের ঘাড় একদম সোজা।”
“বাপ নাই তো আপা।”
” আহারে, বাপ নাই বলে। লাল টমেটোর বাচ্চা তোদের বাপ বাসায় নেই এটা বল। মানুষ শুনলে কি বলবে?”
” বাপ বাইলে।”
“এবার ঠিক আছে।”
হেমন্ত একটু চোখ খুললো। হাত ঘড়িতে সময় দুটো। পৌষ’র দিকে না তাকিয়েই বললো,
” বের হব এখনই।”
“হউ।”
ইনি, মিনিকে কোলে নিয়েই হেমন্ত দাঁড়ালো। ঝট করে বললো,
“সবগুলো চল।”
কথাটা বলতে দেড়ী কিন্তু চিৎকার জুড়ে দিতে দেড়ী হলো না। হেমন্তর নিজেকে বোকা বোকা লাগছে। ও মাত্রই খেয়াল করলো সবগুলো ইঁদুর বিড়াল আগেভাগেই তৈরী হওয়া যাওয়ার জন্য। দল ধরে বের হলো এক ঝাঁক চড়ুই ছানা হক বাড়ী থেকে। গাড়িতে উঠা নিয়ে বেজায় ক্যাঁচক্যাঁচানি লাগলো। ড্রাইভ করবে হেমন্ত, তার পাশের সিটটা ফাঁকা রাখলো পৌষ। এখানে শ্রেয়া বসবে। বাকি পাঁচজন গাদাগাদি করে বসলো পেছনে। গাড়িটায় হেমন্ত শুধু স্ট্রেরিংটা সামান্য যখন ঘুরালো তখনই পেছন থেকে হৈচৈ শুরু হলো যা থামলো একদম শ্রেয়াদের বাড়ীর গেইটে। চৈত্র আর পিহা গিয়ে ডেকে নিলো শ্রেয়াকে। হেমন্ত নিজেও নেমে হবু শশুর, শাশুড়ীকে সালাম দিয়ে এলো। পাশের সিটটায় শ্রেয়া বসা মাত্রই পেছন থেকে যখন হৈ হৈ করে উঠলো সকলে তখন প্রথমে চমকালো শ্রেয়া। এতগুলো মানুষ এসেছে? তাও কিনা কেনাকাটা করতে? ছোট্ট একটা ঢোক গিলা মাত্রই মনে পরলো দুই দিন আগের কথা।
পাশের বাড়ীর চাচি এসেছিলো ওদের ঘরে। মা’কে দেখেই বললো,
” একটা মাত্র মেয়ে এভাবে গাঙ্গে ভাসালেন ভাবী।”
মা প্রথমে বুঝলেন না। চাচি তখন বললেন,
“শুনলাম বিয়ে ঠিক হয়েছে। এত বড় পরিবারে কেউ আজকাল বিয়ে দেয় ভাবী? এত আদরের মেয়েটাকে সংসারের চাপেই না মে’রে ফেলে। দুই দিন যেতেই দেখবেন মেয়ে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করবে। তখন কি করবেন ভাবী? ভেবেচিন্তে দেখুন ভালো করে। তারমধ্যে এক চাচা মৃত ছেলের। শুনেছি তার মেয়ে আছে। সম্পদ ভাগের সময় হবে আরেক জ্বালা। গয়না যা দিবে তা নিয়ে শাশুড়ীই রেখে দিবে। আমি কম ভুগেছি বলুন?”
শ্রেয়া এসব শুনে ভয় পেয়েছিলো। চাচি তো আরো কত কিছু বললো। এমন পরিবারে নাকি স্বামী স্ত্রী প্রাইভেসি থাকে না। ঘুরাঘুরি সহ স্বামী নিয়ে শ্রেয়ার স্বপ্ন আছে। বাবা তাকে সাহস দিয়েছে কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে ভাই-বোন ছাড়া হেমন্ত চলতে পারে না। এই মুহূর্তে শ্রেয়ার একটু বিরক্ত লাগছে। লজ্জাও লাগছে সাথে একটু কান্না পাচ্ছে। ও একা বড় হয়েছে। সবসময় ভাই-বোন চেয়েছে কিন্তু পায় নি। বিয়ের প্রথমে দাদী নাকি মাকে কড়া ভাবে না করেছিলো যাতে আর সন্তান আপাতত না নেয় কিন্তু এরপর যখন চেষ্টা করলো তখন আর হলোই না। একা একাই বড় হলো শ্রেয়া। একটা হাহাকার তার সবসময় ছিলো।
গাড়িটা যখন মার্কেটে এসে থামলো তখন গটগট করে বের হলো সব-কয়টা। বসুন্ধরার সিঁড়িতেও উঠতে উঠতে ‘ভাবী ভাবী’ শব্দটা কতবার যে শ্রেয়া শুনলো তার ইয়ত্তা নেই। লজ্জায় টুকটুকে হলো শ্রেয়া। পাঁচটা মেয়ে-ছেলে ভাবী ডাকছে। বিষয়টা সত্যিই লজ্জার। শাড়ীর দোকানেও একসাথে ঢুকলো সবাই কিন্তু শাড়ী দেখতে দেখতে হঠাৎ ও খেয়াল করলো দোকানে ওরা একা। হেমন্ত আর শ্রেয়া। বাকি কেউ নেই। দোকানী নিজে শাড়ী পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে নানান অঙ্গভঙ্গি করে হেঁটে দেখাচ্ছেন। চেয়েও শ্রেয়া জিজ্ঞেস করতে পারলো না ওরা কোথায় গেলো হঠাৎ?
সব কেনাকাটা করলো হেমন্ত আর শ্রেয়া। শ্রেয়া যা যা নিলো হেমন্ত তাই দিলো। সাত তলায় যখন খেতে বসেছে ওরা তখন না পেরেই শ্রেয়া জিজ্ঞেস করে,
“ওরা কোথায় গেলো?”
“কারা?”
“আপনার ভাই-বোন?”
“এখনেই তো। কোথায় আর যাবে?”
শ্রেয়া আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে রইলো। হেমন্ত খুঁটে খুঁটে জিজ্ঞেস করছে শ্রেয়ার কি কি শখ আছে। বিয়েটায় যাতে ওর কোন আফসোস না থাকে। শ্রেয়ার চোখে মুগ্ধতা। হেমন্ত নামক ছেলেটাকে তার ভালো লাগছে। খেতে খেতে শ্রেয়া এবার একটু নরম গলায় বললো,
“ওরা খাবে না?”
“খাচ্ছে তো।”
“কোথায়?”
“তোমার পেছনে।”
চমকে গিয়ে পিছু ঘুরে শ্রেয়া। ওর চোখ দুটোয় অবাকতা। ওদের থেকে একটু দূরে পাঁচজন বেশ মজা করছে খাচ্ছে। তারা হাসছে। গল্প করছে। একজন আরেকজনকে খায়িয়ে দিচ্ছে মাঝেমধ্যে ঝগড়া করছে। ঢোক গিলে শ্রেয়া। তার নিজেও মন চাইছে ওদের সাথে মিশতে। হেমন্তের দিকে তাকিয়ে বললো,
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৮
“এখানে আসতে বলুন৷ একসাথে খাই। ওরা দূরে কেন?”
“জীবনেও আসবে না। আমাকেও কড়া ভাবে নিষেধ করেছে। যদিও ওদের বিয়ে হয় নি কিন্তু ওদের মনে হয় ওরা থাকলে প্রাইভেসি নষ্ট হবে।”
শ্রেয়া নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জিত হচ্ছে। একটু থেমে বলে উঠলো,
“ওদের আসা নাহয় নিষিদ্ধ কিন্তু আমরা যদি যাই?”
হেমন্ত দেখলো শ্রেয়ার চোখে উচ্ছাস। নিষেধ করার সাহস ওর আর হলো না।