প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৬ (২)

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৬ (২)
আদ্রিতা নিশি

“বিয়েটা কীভাবে হয়েছে?”
বসার রুমে সকালে গোল মিটিং বসেছে। চেয়ার, সোফা মিলিয়ে মানুষজনে পুরো রুম পরিপূর্ণ। অরিত্রিকা বাদে সবাই উপস্থিত রয়েছে। এ মুহুর্তে সবচেয়ে কৌতূহল এবং আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো ইরফান এবং রাহার বিয়ে? দুজনের বিয়েটা কীভাবে হলো তা যেন সবার মনে এক প্রকার সন্দেহ এবং উত্তেজনার ঝড় বইয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পূর্বে মেম্বারের বাড়ি থেকে ফিরেছে অথচ এখন এ বাড়িতে এসে দ্বিতীয়বার প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। আবার চৌধুরী ভিলায় গিয়ে একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।

এসব ভেবে ইরফানের মুখ আমাবস্যার ন্যায় কালো হয়ে আসে। তার চোখ মুখে লেপ্টে আছে হতাশা, উদ্বিগ্নভাব। মনের অবস্থা করুণ। হঠাৎ গ্রামের মানুষ ভুল বুঝে রাহার সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে তা যেন ভাবনাতেও ছিল না। মাথা নত করে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় নানাবিধ চিন্তায় মত্ত ছিল। এমন সময় সারহানের করা প্রশ্নে বিব্রতবোধ করল। সে বিরস মুখে তাকাল বসার রুমে অবস্থানরত সবার দিকে। প্রতিটি কৌতূহলী দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ। ভেতর থেকে তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসে। এক পলক অসুস্থ, স্তব্ধ রাহার পানে তাকায়। অতঃপর দৃষ্টি ফিরিয়ে সারহানের গাম্ভীর্যে মোড়া মুখাবয়বে তাকিয়ে থমথমে গলায় জবাব দেয়;

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“গ্রামের ইডিয়ট মানুষজন জোর করে বিয়ে দিয়েছে।”
সারহানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে। রাহাকে নিয়ে হসপিটালে গেল, হুট করে গ্রামের মানুষ দুজনের বিয়ে দিয়ে দিলো? ঘটনা সুবিধার লাগছে না। কেমন যেন গোলমেলে লাগল। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“নিশ্চয়ই হসপিটালে গিয়ে গ্রামের লোকজন বিয়ে দেইনি। আমার ভাবতেই অবাক লাগছে তুই কট খেয়ে বিয়ে করেছিস।”
“আমার চরিত্র মোটেও ওমন টাইপের না। যা হয়েছে সবকিছু গ্রামের লোকজনের এক লাইন বেশী বোঝার জন্য হয়েছে।”
“আমরা সবাই জানি তুই যথেষ্ট ভালো ছেলে। কিন্তু গ্রামের লোকজন বেশী কেন বুঝলো? সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বল।”
“বলছি।”
“বল।”

সারহান সোফায় হেলান দিয়ে ভালোভাবে বসে বলল। উপস্থিত সবাই যেন উৎসুক জনতা! ঘটনা জানার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু রাহা নিশ্চল, নিস্পৃহ ভঙ্গিমায় ইশরার কাঁধে হেলান দিয়ে আছে। চোখ দুটো বন্ধ। মলিন, ফ্যাকাসে মুখ দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে হঠাৎ বিয়ের শকটা নিতে পারেনি। ইরফান সেই মলিন মেয়েলী মুখশ্রী দেখে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়। মেয়েটার তো কোনো দোষ ছিল না। তবুও না চাইতেও বিয়েটা হয়ে গেল। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। নিজেকে সামলে ভঙ্গুর কন্ঠে বলল ;

“হাসপাতাল থেকে বের হবার পনেরো মিনিটের মধ্যেই প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়। আমরা তখন গ্রামের মেইন রাস্তায় ছিলাম। হঠাৎ করে গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেল। আশেপাশে কোনো গ্যারেজ বা ওয়ার্কশপ ছিল না। দুর্ভাগ্যবশত, ফোনটাও হাসপাতালেই পড়ে গিয়েছিল আর সেটার ডিসপ্লে একদম নষ্ট হয়ে যায়।তাই তোদের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতেও পারিনি।আমরা প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম বৃষ্টি থামার জন্য। কিন্তু বৃষ্টি তো কমার বদলে আরও বেড়ে যাচ্ছিল। জায়গাটা ছিল একদম অচেনা, নির্জন। তাই একটু ভয়ও করছিল। রাহা তখন অসুস্থ ছিল, ওর জন্য গাড়ির ভেতর বদ্ধ হয়ে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। তাই জানালা একটু খুলে রেখেছিলাম যাতে ওর একটু হাওয়া লাগে।বৃষ্টির শব্দ আর ক্লান্তির মাঝে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল, বুঝতেই পারিনি।

যখন ঘুম ভাঙল, দেখি চারপাশে লোকজন আমাদের ঘিরে ফেলেছে, গাড়িসহ! মানুষজন নানা কথা বলছে। বাজে মন্তব্য, ইঙ্গিতও করছিল আমাদের নিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি হাতের বাহিরে চলে গিয়েছিল। কিছু ভাবার আগেই গ্রামের মানুষজন বিষয়টা নিয়ে যাতা বানিয়ে ফেলেছিল। তবুও আমি যতটা সম্ভব ঠান্ডা মাথায় বিষয়টা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু গ্রামের মেম্বার এসে পরিস্থিতিটা একেবারে ঘোলাটে করে দিলো।উনার কথায় গ্রামের লোকেরা একরকম জোর করেই আমার আর রাহার বিয়ে দিয়ে দিলো।”

সারহান এবং আবির হতভম্ব হয়ে গেল। গ্রামের মানুষজনের এমন কান্ডে আশ্চর্য না হয়ে পারল না। আসলে গ্রামের মানুষজন ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখে আসল কাহিনী উদ্ঘাটন না করে সরাসরি বিয়ে পড়িয়ে দেয়। এটা গ্রামে এখনো প্রচলিত। ইরফানের চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠে। ভেতরটা রাগে ফুঁসে ওঠে। এ রাগের কারণ, গ্রামের বুদ্ধিহীন মানুষগুলো। সারহান কিছুক্ষণ মৌন থেকে ইরফানের ভাবভঙ্গি অবলোকন করে ভরাট কন্ঠে বলল;
“রাহার ফোন দিয়ে কল করতে পারতিস আমাদের কাউকে? তাহলে এমন একটা পরিস্থিতির স্বীকার হতে হতো না।”
ইরফান দৃঢ় কন্ঠে বলল ;

“রাহার ফোন ইশরার কাছে ছিল।”
“ওহহ!”
“বাড়ির সবাই যদি জানে আমি কেমন পরিস্থিতিতে রাহাকে বিয়ে করেছি? তখন আমার মান সম্মান সব চলে যাবে। ওহহ গড! ”
“রাহার ফ্যামিলির কথা ভাব একবার। যদি জানতে পারে মেয়ে ঘুরতে এসে বান্ধবীর ফুপাতো ভাইকে বিয়ে করেছে তখন কি হবে?”
“ভাই আমি এসব ভাবতে পারছি না।”
“টেশনশ না করে ফ্রেশ হয়ে নে। বাকীটা পরে ভাবা যাবে।”
সারহান ভরসা দিয়ে বলল। ইরফান নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় শুনল শুধু। এ মুহুর্তে শোনা ছাড়া কিছু বলার ভাষা নেই তার। সারহান বলে উঠল ;

“আয়নাল চাচাকে কে কল দিয়ে ডেকেছিল?”
ইরফান নিমগ্ন কন্ঠে বলল;
“মেম্বার!”
সারহান চতুর্দিকে নজর বুলিয়ে ভরাট কন্ঠে বলল;
“সবাই বিকেল চারটার মধ্যে রেডি হয়ে থাকিস,আজকেই রাজশাহী ফিরবো আমরা।”
সবাই বিস্মিত হয়ে গেল। আরও দুইদিন থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি ঘোলাটে। এ মুহুর্তে থাকাটা মোটেও ভালো হবে না। তাই কেউ টু শব্দ অব্দি করল না। আয়নাল সাহেব ও সবাইকে থাকার কথা বললেন না। গ্রামের পরিস্থিতি সকাল থেকে উত্তপ্ত! তিনি কোনো মতে সবটা সামলে ইরফান এবং রাহাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন। না হলে আরও ভয়াবহ কিছু ঘটতো। দাবানলের মতো বিয়ের খবরটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত। তখন সারহান সহ চৌধুরী বাড়ির সবার মান সম্মান এক নিমেষে মাটিতে মিশে যেত।

“যা ভাগ্যে ছিল তাই ঘটেছে। দুশ্চিন্তা করো না। বাড়িতে ফিরে সবাইকে সবটা বুঝিয়ে বললে কেউ কিছু বলবে না। এখন ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নাও।”
আয়নাল সাহেব স্বাভাবিক ভাবে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন। তারা বেগম এতোক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে কথোপকথন শুনছিলেন। স্বামীর কথা শুনে রান্নাঘরে ছুটলেন। তানহা ও দেরী করল না মায়ের পিছু পিছু গেল। ইশরা দীর্ঘ শ্বাস টেনে রাহাকে নিয়ে রুমের দিকে রওনা হলো। বাকীরা সেখানে বসে রইল।

সন্ধ্যা সাতটা বেজে দশ মিনিট। চৌধুরী বাড়ির কর্তা – গিন্নিরা লিভিং রুমে বসে আছেন। সবার চোখে মুখে উদ্বিগ্ন, চিন্তিত ভাব। দুপুরের দিকে সারহান কল করেছিল আরশাদ সাহেবকে। সে ইরফান এবং রাহার বিয়ের কথাটা জানিয়েছে। এ বিষয়টা নিয়ে দুপুর থেকে সবার মন ভার। ছেলেটা এমন অনিশ্চিত, জঘন্য পরিস্থিতিতে পড়ে বিয়ে করেছে ভেবে মন তিক্ততায় ভরে গেছে। তবুও স্বাভাবিক রাখছেন। কিন্তু সবার মনে একটাই ভয় কাজ করছে ইরফান কি রাহাকে মেনে নিবে? নাকি এটা নিয়েও ঝামেলা বাঁধবে? আজমল সাহেব সারহানের থেকে খবরটা পেয়ে ইসমা বেগমকে কিছুক্ষণ পূর্বে কল করে সবটা জানান। ছেলের হুট করে বিয়ের কথা শুনে কান্নাকাটি করতে থাকেন। তিনি ছোট ভাইকে জানিয়েছেন আজকেই ফিরবেন এ বাড়িতে।

অপেক্ষামান চৌধুরী বাড়ির সদস্যদের ধ্যান ভাঙিয়ে অরিত্রিকাকে কোলে করে সরাসরি লিভিং রুমে প্রবেশ করল সারহান। সবাই পায়ের শব্দ শুনে কৌতূহল বশত তাকায় সদর দরজার দিকে। চমকপ্রদ দৃশ্যপট সামনে দৃশ্যমান হতেই চারজন লাফিয়ে দাঁড়িয়ে যান। তাদের চোখে মুখে বিস্ময়াদি ছলকে পড়তে থাকে। চক্ষুদ্বয় চড়কগাছ! সারহান সেই চাহনি উপেক্ষা করে অরিত্রিকাকে সোফায় বসিয়ে দেয়। মেয়েটা এহেন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে হাসফাস করে উঠে। সে নতজানু হয়ে থ বনে বসে রয়। কতোবার শ্যামমানবকে বলল, হেঁটে ভেতরে আসতে পারবে কিন্তু একরোখা মানুষটা তার কথা শুনলো কই? বাড়ির সবার সামনে মুখ দেখানো দায় হয়ে যাচ্ছে।
“মা, চাচী — ফাইরুজের পা মচকে গেছে। অন দ্য ওয়ে ডক্টর দেখিয়ে নিয়ে আসলাম। ডক্টর বলেছে রসুন, কালোজিরা এবং সরিষার তেল গরম করে আঘাতপ্রাপ্ত স্থান মালিশ করে দিতে। আপনাদের মধ্যে কেউ একজন মালিশের ব্যবস্থা করুন।”

সারহান সবার অদ্ভুত নজর পরখ করে নিস্তব্ধতা ভেঙে গম্ভীর কণ্ঠে বলল। উপস্থিত সবার চোখ মুখে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলো।তবুও পূর্বের ন্যায় ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রইল। তারা সবাই উদ্বিগ্ন, বিচলিত ভাব নিয়ে ছুটে এসে দাঁড়ালেন অরিত্রিকার সামনে। কতোটা আঘাত পেয়েছে তা জানতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। সাথী বেগম মেয়ের পাশে বসে কাঁদো কাঁদো মুখে নানান বিলাপ করতে লাগলেন। তানিয়া বেগম ছুটলেন কিচেনের দিকে তেল গরম করতে। সারহান কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সবার দুশ্চিন্তা, বিচলিত ভাব দেখল। অতঃপর পুনরায় পা বাড়িয়ে বাহিরের দিকে গেল।
“বিয়েটা কোন পরিস্থিতি হয়েছে সেটা ফ্যাক্ট নয়। তুমি এবং রাহা এখন স্বামী – স্ত্রী! আমাদের মতে, তোমার এবং রাহার ভালো হবে যদি দুজনে নতুন সম্পর্কটা মেনে নাও। যদি না মানতে পারো তাহলে স্থিতিশীল পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবে। তুমি একজন বুদ্ধিমান ছেলে। আমি কি ইঙ্গিত করছি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো?”

লিভিং রুমে অরিত্রিকা, রাহা, ইশরা এবং সাদাত ব্যতিত সবাই উপস্থিত। কিছুক্ষণ পূর্বে অরিন অরিত্রিকা ও রাহাকে খাবার, ঔষধ খাইয়ে বিশ্রাম নিতে বলে নিচে এসেছে বর্তমান অবস্থা দেখার জন্য। ইশরা ও ওদের রুমে শুয়ে আছে। সাদাত জার্নি করে ফিরে ক্লান্ত! তাই অসময়ে ঘুমাচ্ছে। আরশাদ সাহেবের কথা শুনে ইরফান মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বোঝায় ; সে বুঝেছে। তানিয়া বেগম এবং সাথী বেগম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সময়ে কি বলবেন বুঝতে পারছে না। আজমল সাহেব চোখ মুখ থমথমে। নীরব হয়ে কি ভাবছেন তা বোঝা যাচ্ছে না। সারহান এবং আবির আপাতত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। আরশাদ সাহেব পুনরায় বলে উঠলেন;
“আগামীকাল রাহার বাবা – মাকে ডাকবো। উনাদের সাথে কথা বলবো। আমার মন বলছে, উনারা সবকিছু বুঝবেন। তোমাকে মেয়ের জামাই মানতে দ্বিধায় পড়বেন না। কারণ, ইউ আর এ ওয়েল-এস্ট্যাবলিশড, এডুকেটেড, অ্যান্ড ওয়েল-ব্রট-আপ ইয়াং ম্যান।”
ইরফান নম্র কন্ঠে প্রতিত্তোর করল ;

“মামুজান আপনাদের যেটা ভালো মনে হয় করুন। আমি চাই না আমার জন্য আপনাদের সম্মানে আঘাত আসুক।”
“তুমি কি মন থেকে রাহাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবে?”
“বিয়ে আমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও, রাহা এখন আমার স্ত্রী এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। যেহেতু এই সম্পর্কের বন্ধন তৈরি হয়েছে, তাকে সম্মান আর স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব থেকে আমি কখনো পিছিয়ে যাব না।”

ইরফান কিছুক্ষণ মৌন থেকে কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল। উপস্থিত সবাই জবাব শুনে সন্তুষ্ট হলো। সারহান নিঃশব্দে হাসল। সে জানতো, ইরফান কখনো বিয়েটাকে অস্বীকার করবে না। রাহাকে বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিবে। কে জানতো, নিয়তির খেলা এমন অদ্ভুত হবে? মেয়েটা ভালোবাসা প্রকাশ করার আগেই ভালোবাসার মানুষটিকে সারাজীবনের জন্য পেয়ে যাবে? আর এক একতরফা ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া সত্তা নতুন করে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য জীবনসঙ্গিনী পাবে? সে মনে মনে দোয়া করে, দুজন যেন সারাজীবন সুখে, দুঃখে একসাথে থাকতে পারে।
আরশাদ সাহেব প্রসন্ন হাসলেন;

“তোমার থেকে এমনটাই আশা করেছিলাম। আগামীকাল রাহার বাবা মাকে ডেকে সব সমস্যা সমাধান করবো। এতো তাড়াহুড়ো কেন করছি জানো? কারণ; বিশ – বাইশ দিন পরে অরিন, আবিরের রিসেপশন। এরপরেই সারহান, অরিত্রিকার রিসেপশন করা লাগবে। একের পর এক ব্যস্ততায় ডুবে যাওয়ার আগে তোমাদের ম্যাটার সল্ভ করা জরুরী।”
ইরফান ভদ্রতাসূচক জবাব দিলো ;
“যত দ্রুত পারুন রাহার বাবা – মায়ের সাথে কথা বলুন। আরেকটা বিষয় সমাধান করার চেষ্টা করবেন মামুজান?”
“বলো।”

“আপনারা সবাই হয়তো জানেন রাহা এনগেজমেন্টের আসর থেকে পালিয়ে এসেছিল। এটা নিয়ে হয়তো ওর বাড়িতে ঝামেলাও হয়েছে। আপনি উনাদের বুঝিয়ে বলবেন, রাহাকে যেন ওর ভুলের জন্য ক্ষমা করে দেয়।”
“উনারা আসুক এ বিষয় নিয়ে কথা বলবো আর তুমি যেহেতু রাহার হাসবেন্ড। তোমার উনাদের সাথে খোলাখুলি কথা বলার রাইট আছে। উনারা যখন আসবেন, তুমিও থাকবে।”
“ঠিক আছে।”
ইরফান তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল। আরশাদ সাহেব স্ত্রীর পানে তাকালেন। তানিয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন ;
“রাতের খাবারের ব্যবস্থা করো।”
তানিয়া বেগম মাথা নাড়িয়ে“ জ্বি ” বলে ডাইনিং রুমের দিকে চলে গেলেন। সাথী বেগমও পিছু পিছু গেলেন। আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব হাত – মুখ ধোঁয়ার জন্য উঠে গেলেন। আবির সারহানের পাশ থেকে উঠে এসে অরিনের পাশে দাঁড়াল। আশে পাশে তাকিয়ে পুনরায় অর্ধাঙ্গিনীর পানে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল;
“বউজান! আর মাত্র বাইশ দিন।”

অরিন আবির দিকে তাকিয়ে প্রশ্নাত্মক চাহনিতে তাকিয়ে বলল;
“বাইশ দিন পর কি?”
“তোমাকে আমার সাথে পার্মানেন্ট ভাবে নিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স পাবো। আহ! তারপর যখন তখন মুড আসলে ভালোবাসতে পারবো।”
“অসভ্য লোক! কি খেয়ে এসেছেন আগে বলুন?”
“সত্যি বলছি বউ কিছু খাইনি। বিয়ের পরেও সিঙ্গেল আছি তাই বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে। চলো রুমে যাই। একটা চু*মু খেয়ে বুকে জ্বলা পেট্রোলের আগুন নিভিয়ে দাও।”
“চলুন কেরোসিন কিনতে যাই। আপনার বুকে জ্বলা পেট্রোলের আগুনে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে দাবানল তৈরী করে দেই।”
ভেংচি কেটে কথাটা বলে অরিন সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগল। আবির পিছু পিছু ছুটে গেল। হায় হুতাশ করে বলল;

“তুমি এটা করতে পারো না বউ। এ অবিচার সইব না আর।”
আবিরের এমন অদ্ভুত কথাবার্তা শুনে সারহান এবং ইরফান একে অপরের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পরেই শব্দ করে হেসে উঠল। কিছুক্ষণ পরেই ইসমা বেগম সদর দরজা দিয়ে দৌড়ে প্রবেশ করলেন। তিনি সরাসরি এসে ছেলের পাশে বসে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সারহান এবং ইরফানের হাসি থেমে গেল। ইসমা বেগমের কান্না দেখে ইরফান মাকে জড়িয়ে ধরল। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সংযত কন্ঠে বলল;
“মা, কাঁদছো কেন?”
ইসমা বেগম কন্দনরত কন্ঠে বললেন;
“বাপ! তোর কি সর্বনাশ হয়ে গেল রে।”
ইরফান বুঝতে পারল ইসমা বেগমকে কেউ বিয়ের খবরটা জানিয়েছে। সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। শান্ত কন্ঠে বলল;

“সর্বনাশ হয়নি। আমার বিয়ে হয়েছে।”
ইসমা বেগম অবাক হয়ে চাইলেন ছেলের পানে। অতি স্বাভাবিক আচরণ মেনে নিতে পারলেন না। একপ্রকার তেতে উঠে বললেন;
“বাপ, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
“আমার মাথা খারাপ হয়নি মা। কান্নাকাটি থামিয়ে তোমার একমাত্র ছেলের বউকে দেখে আসো।”
“এতো সহজে তুই কি করে মেনে নিলি?”
“বিয়েটা যেহেতু হয়েছে। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।”
ইসমা বেগম কান্না ভুলে গেলেন। হতভম্ব হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইরফান একদম স্বাভাবিক যেন কিছুই হয়নি। সারহান পায়ের পা তুলে সোজা হয়ে বসল। ইসমা বেগমের ভাবসাব দেখে অগোচরে বাঁকা হাসল।

রাতটা কোনোভাবে কেটেছে। ইরফান আর রাহার বিয়ে নিয়ে সকালে কেউ কোনো কথা তোলেনি। সবাই যেন চেষ্টা করছে আগের মতো স্বাভাবিক পরিবেশ ধরে রাখতে। এই বিবর্ণ সকালেও অরিত্রিকা একটু নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিল। বিয়ের পর এই প্রথম সে সকালে কিচেনে পা রাখল—ইচ্ছেটা ছিল সবার জন্য নিজে হাতে রান্না করবে।পায়ের ব্যথা আগের তুলনায় অনেকটাই কম।তাই আজ নিজেকে প্রস্তুত মনে হচ্ছিল। কিন্তু কিচেনে ঢুকেই তার মন খারাপ হয়ে গেল রান্না ইতোমধ্যেই শেষ। সবাই নিজের মতো করে সকালটা সামলে নিয়েছে।
মনটা খারাপ হলেও অরিত্রিকা ইচ্ছেটা অপূর্ণ রাখেনি। নিজেকে সামলে ইউটিউব খুলে বসে, আর দেখে দেখে বানাতে শুরু করেছিল পায়েস। ধীরে ধীরে কিচেন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দুধ, চাল, এলাচ আর ঘি-র মোহময় গন্ধ। পায়েসটা দেখতে যেমন হয়েছিল স্বাদেও যেন তেমনই হবে এই বিশ্বাসে ভরে যায় তার মন।সে এখন একরকম অধীর হয়ে আছে কখন সবাই এসে পায়েস খাবে, কখন তার এই ছোট্ট প্রয়াসটুকু একটু প্রশংসা পাবে। রান্না করতে না পারার শুরুতে যে মনখারাপ ছিল।

ডাইনিং টেবিলে বাড়ির সবাই খেতে বসেছে। বাড়ির গিন্নিরা খাবার বেড়ে দিচ্ছে। আজ টেবিলে বসার ক্ষেত্রে একটু ভিন্নতা লক্ষণীয়। সারহান, অরিত্রিকা একসাথে বসেছে। পাশের দুটো চেয়ারে ইরফান, রাহা বসেছে। এ প্রান্তের চেয়ারে ইসমা বেগম বসেছেন। অপরপাশের চেয়ারগুলোতে ইশরা, সাদাত অরিন সহ বাড়ির কর্তারা বসেছেন। আবির গতরাতেই বাড়ি চলে গিয়েছিল। সবাই থাকতে বলেছিল কিন্তু থাকেনি। প্রায় আধা ঘন্টা পর সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। অরিত্রিকা তা দেখে এক প্রকার জোড়ালো কন্ঠে বলল;
“কেউ চেয়ার থেকে উঠবে না। আমি সবার জন্য পায়েস বানিয়েছি। সেটা খেয়ে কেমন হয়েছে বলবে তারপর উঠবে।”

উপস্থিত সবাই অবাক হলো। এটা সবার জন্য অপ্রত্যাশিত ছিলো। তানিয়া বেগম ও সাথী বেগম হাসলেন। সারহান পানির গ্লাসটা ধরতে গিয়েছিল তখন মেয়েলী কন্ঠস্বর শুনে হাতটা নামিয়ে ভ্রুযুগল কুঁচকে তির্যক চাহনিতে অরিত্রিকার দিকে তাকাল। অরিত্রিকা সেই চাহনি দেখে মাথা নত করল। গতকাল থেকে মানুষটার থেকে এক প্রকার পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যথাসম্ভব নিজেকে আড়াল করে রাখছে। লজ্জায় কথা বলতে পারছে না। সারহান যতোবার কথা বলতে চেয়েছে ততবার নানা বাহানায় দিয়ে চুপ থেকেছে।
“পায়েস কি উপলক্ষে রান্না করেছিস?”

সারহান নিস্তব্ধতা ভেঙে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল। অরিত্রিকা আড় চোখে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর মানুষটাকে দেখল। অতঃপর দৃষ্টি নত করে মিনমিন করে বলল;
“বিয়ের পর এ বাড়ির নতুন বউ হিসেবে রান্না করে কাউকে খাওয়াইনি। তাই ভাবলাম৷ পায়েস রান্না করে খাওয়াই।”
সারহানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। রুঢ় কন্ঠে বলল;
“পায় মচকে বসে আছিস অথচ সেদিকে নজর না দিয়ে উড়নচণ্ডীর মতো ঘুরে রান্না করা হচ্ছে?”
“পায়ের ব্যথা কমে গেছে। যদি বিশ্বাস না করেন হেঁটে দেখাবো?”
“সত্যি কমেছে?”

“হুম! আপনি দুটো পে*ইন কিলার দিয়েছিলেন, ওগুলো খেয়ে ব্যথা কমে গেছে।”
“ওগুলো খেলে ব্য*থা কমে না মাথামোটা!”
সারহান হতাশাপূর্ণ চাহনিতে তাকিয়ে বিরবির করে আওড়ালো। অরিত্রিকা হয়তো স্পষ্ট শুনলো কথাটা। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে নেত্রপল্লব উঁচিয়ে সাথী বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল;
“আম্মু, সবাইকে পায়েস দাও।”

সাথী বেগম সবাইকে পায়েস দিতে শুরু করলেন। প্রথমে সারহান এবং অরিত্রিকাকে দিয়ে বাকীদের দিতে লাগলেন। অরিত্রিকা প্লেটে লোভনীয় পায়েসের দিকে তাকিয়ে সারহানকে উদ্দেশ্য করে লাজুক হেসে বলল;
“পায়েসে কিন্তু আমার ভালোবাসা মিশিয়েছি। খেয়ে বলবেন কেমন হয়েছে।”
সারহান মিষ্টিজাতীয় খাবার খায় না। তবে এখন বউয়ের মন রাখতে একটু হলেও খেতে হবে। সে প্লেটের পায়েসের দিকে তাকায়। দেখতে দুর্দান্ত লাগছে। প্লেটে হাত দিয়ে দৃঢ় ক্ষীণ কন্ঠে বলে;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৬

“দেখি তোর ভালোবাসা মেশানো পায়েসের টেস্ট কেমন হয়েছে। আদৌও খাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ হচ্ছে।”
অরিত্রিকা কথাটা শুনে মুচকি হাসল। অতঃপর সময় ব্যয় না করে হাত দিয়ে পায়েস তুলে মুখে দিলো। ব্যস, গলদেশে সেটুকু নামতেই চোখ মুখ কুঁচকে গেল। দুহাতে মুখ ধরল। একটু পর ওয়াক ওয়াক করে ছুটলো ওয়াশরুমের দিকে। সারহান পায়েস মুখে তুলতে নিয়েছিল। সে মুহূর্তে অরিত্রিকার ওমন অবস্থা দেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো পেছনে।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৭