প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৬

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৬
আদ্রিতা নিশি

রাত্রির গভীরতা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।বৃষ্টির স্রোত ক্রমশ তীব্রতর হয়ে উঠছে।অম্বরে বজ্রপাতের ঝলকানি ঘন হয়ে আসছে।একে একে অম্বর ভেদ করে ছুড়ে দিচ্ছে বিদ্যুতের শিখা। প্রকৃতির এই মুহূর্তটি ভীষণ অশান্ত।ঝড়ো হাওয়ার কর্কশ গর্জন পরিবেশের নির্জনতাকে কাঁপিয়ে তুলছে। আজকের রাত অন্য দিনের তুলনায় শীতল এবং অন্যরকম। বেলকনীর দরজা দিয়ে প্রবাহিত হাওয়া বিদ্রোহিণী সৃষ্টির ন্যায় উদভ্রান্তভাবে ছুটে আসছে। শীতলতর সেই হাওয়া মানব-মানবীর শরীর স্পর্শ করছে। এই সংস্পর্শে সর্বাঙ্গ শিহরিত হচ্ছে। তবুও তাদের এদিকে খেয়াল নেই। দুটি হৃদয় ইতিমধ্যেই প্রেমের অমোঘ স্রোতে নিমগ্ন!একাকার হয়ে বোধহয় প্রলয়তরঙ্গের মত ভেসে চলছে মত্ততার স্রোত হয়ে।

মেয়েলী দেহবল্লরীর স্বাভাবিক গতি সহসা থেমে গেল অন্তর্নিহিত বিস্ময়ে। সারহান প্রসন্নতাভরা দৃষ্টিতে তাকাল। তার দুহাত দৃঢ়ভাবে আটক করল অরিত্রিকার কোমল দেহকে। নিঃসংকোচ, অনবরত ও প্রগাঢ় স্পর্শে আচ্ছন্ন সেই নারীত্ব নিজ সীমারেখা ভুলে আত্মসমর্পণে প্রস্তুত।এক পর্যায়ে মনের অন্তঃস্থ জড়তা ধীরে ধীরে লঘু হতে লাগল। অরিত্রিকা নিবিড়ভাবে অনুভব করতে লাগল প্রিয় পুরুষের সান্নিধ্য!উষ্ণতায় গলতে লাগল দ্বিধা, সংকোচ ও সমস্ত অন্তরায়। যে সংকোচ এতক্ষণ তাকে আচ্ছন্ন করেছিল তা প্রাচীন ধূপের ধোঁয়ার ন্যায় বিলীন হয়ে গেল হাওয়ায়। বজ্রের ক্ষীণ আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠল পুরুষালি মুখাবয়ব। সে হাসল। অস্পষ্ট কন্ঠে প্রতিত্তোর করল ;
“ভালোবাসি আপনাকে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারহানের কর্ণকুহরে মৃদুভাবে প্রবেশ করল স্নিগ্ধ মেয়েলী কণ্ঠ। সেই কণ্ঠ যেন অতীতের সমস্ত প্রতীক্ষা ভেঙে হৃদয়ে প্রেমের আলোর ঝর্ণা বইয়ে দিল। সে বিস্ময়মাখা নয়নে অবলোকন করল প্রিয়তমার আবছা অবয়ব। পরম আবেগে সে ললাটে কোমল চু*ম্বন করল। আরেকটু দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করল ছোট্ট দেহ টাকে।অরিত্রিকা নেত্রযুগল খিঁচে এলো। হৃদয়ভরে আঁকড়ে ধরল শ্যামমানবের উষ্ণ দেহখানি। দুই বাহুতে সে জড়িয়ে ধরল তার কল্প পুরুষকে। অনুভব করল বহু প্রতীক্ষার সেই কাঙ্ক্ষিত স্পর্শ।সারহান মাথা উঁচিয়ে কিয়ৎ সময় নিগূঢ়, নেশাত্নক চাহনিতে অবলোকন করল মেয়েলী ওষ্ঠের কম্পনরত দৃশ্য। মুহুর্তে পুরুষালি সত্তা খেই হারাল। যতটুকু সংযত ছিল ততটুকু ভুলে গেল। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। সে ধীরে ধীরে দূরত্বের রেখা ঘুচিয়ে নিল। তার তপ্ত ওষ্ঠপুট দখল করে নিল মেয়েলী ওষ্ঠদ্বয়। কিছুটা অশান্ত, অধৈর্যের ন্যায় মনে হলো। প্রায় তিনবছরের ভালোবাসার পূর্ণতায় মেতে উঠল। কাঙ্খিত ছোঁয়ায় ধাতস্থ করল অরিত্রিকা। নিবিড় ভাবে সয়ে নিল বেসামাল, অধৈর্য মানুষটার সান্নিধ্যে এবং স্পর্শ! পরম সুখে তাল হারাল। ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল প্রেমময় তীব্রতা! দুজন দুজনাতে মত্ত হলো। এক উন্মদনার গভীর সমুদ্রে হারিয়ে গেল।
রাতের গভীরতা বাড়তে লাগল। নবদম্পতির নতুন জীবনের সূচনা হলো। ভালোবাসায় সিক্ত হলো দুই হৃদয়।

একটি অশান্ত ও বৃষ্টিসিক্ত রাত অতিক্রান্ত হয়ে সকাল হয়েছে । পুরো রাত প্রকৃতিদত্ত তাণ্ডব পরিশেষে শান্ত এবং প্রশান্তিতে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ এ মুহুর্তে অতি শীতল। সকালে ঝড়ো হাওয়ার দেখা নেই! অম্বরে মেঘপুঞ্জের আবির্ভাব নেই। সূর্য স্বর্ণরশ্মির বিকিরণে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে অম্বরে উদিত। গাছপালা সমূহ বৃষ্টিসিক্ত হয়ে গাঢ় সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে। কোথা থেকে যেন পাখিদের কলরব ভেসে আসছে। কাঠের জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে সূর্যের তেজস্বী রশ্মি রুমটায় প্রবেশ করছে। বেলকনির দরজাটা গতরাতের মতো হাট করে খোলা! সেখান দিয়ে এক ফালি আলো এসে রুমটাকে আলোকিত করেছে।

সেই আলোর ছটাকে ঘুম ভাঙে অরিত্রিকার। চোখে – মুখে স্পষ্ট তন্দ্রার রেষ। সে অতি কষ্টে পিটপিট করে চক্ষুদ্বয় মেলে তাকাল। দিনের ন্যায় আলোকিত পরিবেশ দেখে এক নিমেষে ঠাওড় করতে পারল রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে। সে হাত দ্বারা চোখ কচলে সামনের দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ির কাটায় তখন ছয়টা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। দুজনে ভোরের আলো ফোটার পূর্বে ঘুমিয়েছে। এখনো পুরোপুরি ঘুম সম্পূর্ণ হয়নি। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নড়েচড়ে উঠল। তখনি অনুভব করতে পারল কেউ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরিয়ে আছে। মেয়েলী সত্তা থমকে গেল। সে এক প্রকার ভড়কে গেল। হতচকিত দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকাল। ডাগর আঁখিযুগলে পরিষ্কার হয়ে উঠল শ্যামমানবের নিদ্রাচ্ছন্ন মুখাবয়ব। তার দৃষ্টি অতি শান্ত হয়ে আসল। নিজেকে ধাতস্থ করে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল মানুষটার পানে। মুহুর্তেই মনে পড়ে গেল গতরাতের প্রেমোন্মাদোনার মুহুর্তগুলো। সে চোখ মুখ খিঁচে নিল। শরীরটা কেমন শিরশির করে উঠল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উবুজুবু অবস্থা। গাল দুটো গরম হয়ে উঠল তৎক্ষনাৎ। সে হাসফাস করে দৃষ্টি নত করল। এ মুহুর্তে ঘুমন্ত মানুষটার পানে তাকানোর সাহস নেই।

অরিত্রিকা শ্যামমানবের দৃঢ় হাতের বন্ধন থেকে সরে আসতে চাইল। কিন্ত পারল না। পূর্বের ন্যায় কুন্ঠা ঠেলে লজ্জা ভাব আড়াল করে সবেগে চাইল সারহান ভাইয়ের দিকে। সেই মুহুর্তে খেয়াল করল নগ্ন প্রশস্ত বুকটা! বুকের ভেতরটা ধকধক করে উঠল। সে চঞ্চলা দৃষ্টিতে আশে পাশে তাকাল। বিছানার এক পাশে রেশমী চুড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা, টেবিলের ওপরের মোমবাতি দুটো নিচে পড়ে আছে, বাহির হতে আসা রাতের তীব্র হাওয়ার সম্পূর্ণ রুম প্রায় এলোমেলো। তার দৃষ্টি হঠাৎ স্থির হলো বিছানার পাশে অবহেলায় পড়ে থাকা গোলাপি শাড়িটার দিকে। আরেকদফা থমকাল তার সত্তা। সে ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিমায় নিজের দিকে চাইল। দুজনের শরীরে জড়ানো কাঁথা। তার শরীরে জড়ানো গতরাতে সারহান ভাইয়ের শুভ্র রঙা শার্টটা।

শিরদাঁড়া বেয়ে বেয়ে গেল শীতল শিহরণ! পরপর এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে মিইয়ে গেল। এ মুহুর্তে সারহান ভাই যদি তার অবস্থা দেখতো তবে কি হতো? নিশ্চয়ই উনার চোখে চোখ রাখতে পারতো না লজ্জায়! ঘন ঘন নিঃশ্বাসের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত। সে কিয়ৎ সময় নিজের সাথে লড়াই করে ভাবাবেগ সামাল দিলো। পুনরায় নেত্রপল্লব ঝাপটে সুগভীর চাহনিতে চাইল। চোখে মুখে ভড় করল মুগ্ধতা। সে নিবিড় চাহনিতে পরখ করতে লাগল প্রিয় পুরুষটিকে। ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করতে লাগল শ্যামমানবটি তার অর্ধাঙ্গ! যাকে নিঃশব্দে ভালোবেসেছে সেই মানুষটা সম্পূর্ণ রুপে তার।

এতটুকু ভেবে মৃদু হাসল। সে মোহগ্রস্থের ন্যায় খানিকটা ঝুকে আসলো। মনে মনে ভাবল, মানুষটাকে যতোটা ধৈর্যশীল, যন্ত্রমানব ভেবেছিল ততোটা নয়। সামান্য শাড়ি পড়া দেখে কেউ এতোটা অধৈর্য বেসামাল হয় বুঝি?তার চঞ্চলা মনে হঠাৎ আবির্ভাব ঘটল এক অকল্পনীয় দুঃসাধ্য কার্য সম্পাদন করার। সে প্রশ্রয় দিলো মনকে। ফটাফট ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে পুরুষালি চিবুক, কপাল এবং বুকের বাম পাশে। আরেকটু সন্নিকটে এসে আলতো করে গালে হাত রেখে তামাটে ওষ্ঠদ্বয়ের কাজে ওষ্ঠদ্বয় ছোঁয়ানোর মতো ধান্দা করল। ঘুমন্ত মানুষটার ঘুমের সুযোগ নিয়ে দুষ্ট কান্ডকারখানা মস্তিষ্ক দখল করল। সে চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে উক্ত ভাবনার সমাপ্তি ঘটাবে এমন সময় শোনা গেল ঘুমুঘুমু ভরাট কন্ঠস্বর ;
“আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে ফায়দা লুটছিস ফাইরুজ?”

অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় বড় করে তাকাল। মুখে দুই হাত গুঁজে ছিটকে সরে গেল। বিস্ময়াভিভূত চাহনিতে তাকাল জেগে ওঠা সারহানের দিকে। মানুষটা জাগ্রত ছিল! ভাবতেই আরেকদফা লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। বুকের মধ্যে উথাল পাথাল ঢেউ খেলে গেল। কি বলবে, কি করবে তা বুঝতে যেন অপারগ। সারহান অরিত্রিকার এহেন দিশেহারা অবস্থা দেখে নিঃশব্দে হাসল। হাত দিয়ে মেয়েলী বাহুটা টেনে সন্নিকটে নিয়ে আসলো। দৃঢ় ভাবে জড়িয়ে ধরে কন্ঠ খাদে নামিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বলল;
“কন্টিনিউ কর।”

অরিত্রিকার কর্ণদ্বয় ঝাঝা করে উঠল। সে লজ্জায় তাকানোর সাহস করল না। কুণ্ঠিত বদনে এলোমেলো ভাবে এদিক ওদিক তাকাল। আড়ষ্টতায় জড়িয়ে যাওয়া কম্পিত কণ্ঠে বলল;
“আপনি ঘুমানোর ভাণ করে ছিলেন?”
সারহান নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিলো ;
“ ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু তোর ঠোঁটের উষ্ণতায় ঘুম ছুটে গেছে। এভাবে কেউ ঘুমের সুযোগ নেয়?”
“সত্যি বলছি… আমি ইচ্ছাকৃত কিছু করিনি।”
“হাসবেন্ড হই তোর। চু*মু খেতেই পারিস। এখানে ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কি আছে?”
“আরেকটা কথা বলবেন না। শুনতে কেমন যেন লাগছে।”
“ওকে।”

কথাটি দৃঢ় কন্ঠে বলে অরিত্রিকার দিকে ঝুঁকে আসলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিগূঢ় শীতল চাহনিতে পরখ করল। মেয়েলী শরীরে দৃশ্যমান তার শার্ট টা যেন আকর্ষণীয় লাগছে। এ রূপ যেন নিসর্গের সবচেয়ে নিখুঁত সৃষ্টি। এক পলক তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া দায়! একবার দুর্নিবার মায়াতে ফেঁসে গেলে দিন দুনিয়া ভুলে যায়। এ কোমল সুশ্রী রূপে বসন্তের কোমলতা,বর্ষার রহস্য আর শরতের স্বচ্ছতায় পরিপূর্ণ।অরিত্রিকা এহেন দৃষ্টি দেখে শুকনো ঢোক গিলল। মানুষটার হাবভাব মোটেও সুবিধার লাগছে না। সে উৎকন্ঠিত মনোভাব নিয়ে নিশ্চুপ রয়। সারহান অভিধাবিহীন চাহনি সংযত করে সংবরণহীন কন্ঠে বলল;

“সাদা শার্টে মোড়া তুই…
চোখ ফেরানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে, জান।”
মদ্যক কন্ঠ, বেপরোয়া চাহনিতে অরিত্রিকার বক্ষঃস্থল ধরফরিয়ে উঠল। সে লজ্জায় এলোমেলো দৃষ্টিতে আশে পাশে তাকাল। কাঁথা ভালোভাবে জড়িয়ে হম্বিতম্বি করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। সারহান বাঁকা হাসল। কাঁথাটা সরিয়ে দিয়ে হঠাৎ মেয়েলী উন্মুক্ত গলদেশে ডুব দিলো। আকস্মিক সংস্পর্শে মেয়েলী সত্তায় নতুন করে আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড়। সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল। একের পর এক উষ্ণ ছোঁয়ায় সিক্ত হলো মুখশ্রী, গলদেশ। পুনরায় নতুন করে ভালোবাসায় সিক্ত হলো সত্তা।

সকাল নয়টা বেজে পনেরো মিনিট। সারহান কিছুক্ষণ পূর্বে ঘুম থেকে উঠেছে। মাত্র ফ্রেশ হয়ে রুমে আসলো। এ বাড়ির সকালের আমেজ অন্যদিনের তুলনায় কম। বাড়িতে কারো তেমন আনাগোনা নেই। মনে হচ্ছে সবাই কোথাও গিয়েছে বা হুট করে উধাও হয়ে গিয়েছে। সে ফ্রেশ হয়ে আসার সময় ইরফান এবং সাদাতকে খুজতে ওদের রুমে গিয়েছিল কিন্তু পায়নি। ইশরা, রাহাসহ বাড়ির বাকীদের চোখে পড়েনি। এ সকালে সবাই হঠাৎ কোথায় উধাও হলো তা এ মুহুর্তে বোধগম্য হলো না।সারহান লাগেজ থেকে কালো রঙের শার্ট বের করে শরীরে জড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের দিকে।

আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে সুদক্ষ হাতে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগায়। শার্টের হাতা কনুই অব্দি গুটিয়ে চুল ব্রাশ করতে থাকে। সে সময় হঠাৎ নজর যায় গলার দিকে। লালচে ক্ষুদ্র ক্ষ*তের দাগ! তারমানে এ কারণে গোসলের সময় জ্বলুনি অনুভব করেছিল। পিঠটা এখনো জ্বলছে। সে টেনে শ্বাস ফেলে। মেয়েটা হাতের নখ কেটে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে। ওষ্ঠ কামড়ে কিছু একটা ভেবে সে চিরুনীটা রেখে পিছু ফিরে তাকায় ঘুমন্ত অরিত্রিকার দিকে। মেয়েটা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে জড়োসড়ো হয়ে। নিষ্পাপ তন্দ্রাচ্ছন্ন নিভৃতসুধাকে ডাকতে মন সায় দিলো না। থাক, আরেকটু ঘুমাক। সে পা বাড়িয়ে কাঠের টেবিলের দিকে গেল। মেঝেতে পড়া মোমবাতি দুটো উঠিয়ে রাখলো টেবিলে।

চার্জবিহীন ফোনটা চার্জে বসিয়ে মেঝেতে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা শাড়িটা গুছিয়ে চেয়ারের ওপর রাখল। মনে পড়ে গেল অরিত্রিকার পা মচকে যাওয়ার কথা। তার মনে এ মুহুর্তে কেন যেন অনুশোচনা হলো না। সে খুঁজে ব্যাথানাশক মলমটা নিয়ে আসলো। অরিত্রিকার পায়ের কাছে বসে আঘাতপ্রাপ্ত পায়ে মলম লাগিয়ে দিলো যত্ন করে। মেয়েটা নিদ্রিত অবস্থায় নড়ে উঠল। সারহান একপলক মায়াবী মুখখানার পানে তাকিয়ে কাঁথা দিয়ে পা ঢেকে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মলমটা যথাস্থানে রেখে রুমের বাহিরে পা বাড়াল। রুমটা বাহির হতে লক করে হাঁটতে লাগল। সবাই কোথায় উধাও হলো জানা প্রয়োজন তার।
সারহান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখা হলো তারা বেগমের সঙ্গে। সারহানকে বাড়িতে দেখে তিনি অবাক হলেন। অবাকতার রেষ নিয়ে বললেন;

“বাবা তুমি এখানে? তোমার চাচার সাথে যাওনি?”
সারহান কথাটা শুনে থেমে গেল। কৌতূহলী ভাব নিয়ে ভরাট কন্ঠে প্রশ্ন করল ;
“চাচা কোথায় গেছেন?”
তারা বেগম বুঝলেন সারহানকে জানায়নি। তিনিও জানেন না আয়নাল সাহেব কোথায় গিয়েছেন। তবে যে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেলেন মনে হয় কোনো বড় কিছু হয়েছে। তিনি শাড়ির আঁচল মাথায় ঠিকঠাক করে দিলেন। উদ্বিগ্ন ভাব কমিয়ে বললেন;

“সেটা তো জানিনা বাবা। তবে তোমার ভাই, ফুপাতো বোনও উনার সাথে গিয়েছে।”
সারহানের কপালের মধ্যাংশ বরাবর সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। হঠাৎ সবাই মিলে গেল কোথায়? প্রশ্নটা মস্তিস্ক জুড়ে ঘুরপাক খেতে লাগল। কিছুক্ষণ মৌন থেকে প্রশ্নাত্মক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ;
“রাহা, ইরফানকে দেখেছেন?”
তারা বেগম বললেন;

“হয়তো উনার সাথে গেছে। তুমি বরং কল দাও উনারে। আমি যাই খাবারগুলো টেবিলে গুছিয়ে রাখি।”
তারা বেগম কথাটা বলে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। সারহান চিন্তিতগ্রস্থ বদনে পা বাড়িয়ে বাহিরের দিকে গেল। বাগানের পাশের পার্কিং প্লেসটায় দৃষ্টি স্থির করল। তার গাড়ি থাকলেও ইরফানের গাড়ি সেথায় নেই। সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে পকেট হাতড়ে ফোন খুঁজতে লাগল। কিন্তু পেল না। মনে পড়ল, ফোনটা রুমে চার্জ দিয়ে রেখে এসেছে। প্রয়োজনের সময় ফোনে চার্জ না থাকায় বেশ বিরক্তিবোধ করল। সে পুনরায় বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে উদ্যত হলো তখনি গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে সেথায় দাঁড়িয়ে পড়ল। তির্যক চাহনিতে চাইল মেইন গেটের দিকে। গাড়ি থেকে নেমে আবিরকে এদিকটায় আসতে দেখে আশ্চর্যিত হলো। এ অসময়ে আবির না বলে আসাটা কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে।

বসার রুমে সোফায় বসে আছে আবির। সামনের টেবিলে বিভিন্ন রকমের নাস্তা সাজানো। কিছুক্ষণ পূর্বে তারা বেগম নাস্তা দিয়ে গেছেন। আবিরের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে অনবরত কল করছে ইরফান, সাদাত, ইশরা এবং আয়নাল সাহেবকে। কেউ কল রিসিভ করছে না। সবাই কোথায় গেছে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সে এসেছিল গুরুত্বপূর্ণ খবর দিতে কিন্তু এসে আরেক ফ্যাসাদে ফেঁসে গেল। সে আরও কয়েকবার কল করে রেসপন্স না পেয়ে ফোনটা প্যান্টের পকেটে রাখল। অতঃপর সাহেবী ভঙ্গিমায় বসে থাকা সারহানের দিকে তাকিয়ে বলল;
“কাহিনী কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না। হুট করে সবাই কোথায় উধাও হয়ে গেল?”
সারহান নিবিড় চাহনিতে তাকাল আবিরের দিকে। দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“লোকেশন ট্র্যাক কর।”

আবির মাথা দুলাল। হঠাৎ তার চিলের ন্যায় চোখ জোড়া নিবদ্ধ হলো সারহানের গলার দিকে। মুহূর্তেই ওষ্ঠজুড়ে বিচরণ করল দুষ্ট হাসি। ফোনটা পকেট থেকে বের করে কৌতূক পূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল ;
“দোস্ত কোনো জংলী বিড়ালের ক্ষপ্পরে পড়েছিলি নাকি? গলায় কতো সুন্দর নখের দাগ।”
সারহান আবিরের দিকে তাকাল। না রেগে বরং নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল;
“জংলী বিড়াল নয় বিয়ে করা বউয়ের ক্ষপ্পরে পড়েছিলাম।”
আবিরের হাসির মাত্রা বাড়ল। আরেকটু রসিয়ে বলল;
“ঘুরতে আসার নাম করে বউয়ের নখের আঁচড় খাওয়া হচ্ছে? যে সারহান ইদায়াত চৌধুরীকে কেউ আ*ঘাত করার সাহস হয়নি সে এখন বউয়ের হাতে আ*হত হচ্ছে। ”
সারহান ভ্রুযুগল গুটালো। বাঁকা হেসে বলল;
“এটাকে আ*হত হওয়া বলে না, বউয়ের ভালোবাসা বলে।”
আবিরের হাসিভাব উবে গেল। চক্ষুদ্বয় বড় হয়ে গেল। বন্ধুর এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে বুঝতে অসুবিধা হলো না কাহিনী। সে ধরফরিয়ে উঠে বলল;

“এটা তুই কি করলি দোস্ত! রিসেপশনের আগে ঘুরতে এসে অধৈর্য হয়ে ছক্কা মে*রে দিলি? আমাদের বাসর ঘরের দরজা আঁটকে টাকা নেওয়ার ধান্দায় লালবাত্তি জ্বলিয়ে দিলি? এটা কোনো ভাবে মেনে নেওয়া যায় না। কতো আশা ছিল পাঁচ লাখ টাকা লুটে নিবো।”
সারহান আবিরের ভাবমূর্তি দেখে বিরক্তির সহিত তাকাল। চোখ গরম করে গম্ভীর কন্ঠে বলল;
“কয়েকদিন পর তোর পকেট থেকে টাকা লুট হবে সেটার কথা ভাব। আমার দিকটা না ভাবলেও চলবে।”
“ভেবেই রেখেছি। দোস্ত আমার কষ্ট হচ্ছে। আগে বিয়ে করেও ছক্কা মা*রতে পারলাম না অথচ তুই পরে বিয়ে করে ছক্কা মে*রে দিলি। আহ! কষ্ট।”

“আর একটা বাজে কথা বললে মুখে কথা বলার অবস্থায় রাখব না। তাই যা বলেছি সেটা কর।”
“দোস্ত! এভাবে আমার কষ্টকে উপেক্ষা করলি? বন্ধু হয়ে বন্ধুর কষ্ট বুঝলি না।”
“তুই নিজেই নিজের কষ্ট বোঝ।”
সারহান গম্ভীর কন্ঠে বলল। আবির হঠাৎ ওষ্ঠ এলিয়ে হেসে বলল;
“তোর জল্লাদ শশুর যদি জানতে পারে উনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেঙেছিস তাহলে নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করবেন। শোন, বাড়ি ফিরে একদম ভদ্র সভ্য হয়ে থাকবি যেন বুঝতে না পারে।”
সারহান দাঁতে দাঁত চেপে চাপা স্বরে ধমকে বলল;
“চুপ কর। নয়তো বিয়ের রিসেপশন আঁটকে দেবো।”
“আমাকে হুমকি দিচ্ছিস?”
“হুমম দিচ্ছি।”

আবির কথা বাড়াল না। মনে মনে গালমন্দ করে ফোনে সাদাতের নাম্বার ট্র্যাক করতে লাগল। লোকেশন গ্রামেই দেখাচ্ছে। সে হাতে থাকা ফোনটা সারহানের সামনে বাড়িয়ে ধরল। অতঃপর নিমগ্ন কন্ঠে বলল;
“লোকেশন গ্রামে দেখাচ্ছে।”
সারহান ফোন স্কিনে নজর রেখে বলল;
“চল।”
আবির ফোনটা পকেটে পুড়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। সারহানও সময় ব্যয় না করে দাঁড়িয়ে গেল। দুজনে একসাথে বসার রুম ছেড়ে বাহিরের দিকে যেতে লাগল।

সারহান এবং আবির মেইন গেট খুলে বাহিরে বের হলো। তখনই ইরফানের গাড়ির দেখা মিলল। গাড়িটা আস্তে ধীরে এসে থামল আবিরের গাড়ির পেছনে। সেই দৃশ্য দেখে দুজনে দাঁড়িয়ে পড়ল ও কৌতূহল মেটাতে তাকিয়ে রইল। গাড়িটির দরজা খুলে সাদাত, ইশরা এবং আয়নাল সাহেব নামলেন। কিছুক্ষণ পর ইরফান নেমে রাহাকে ধরে গাড়ি থেকে নামালো। সবার চোখে মুখে উদ্বিগ্ন চিন্তিত ভাব পরিলক্ষিত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে গুরুতর কিছু ঘটেছে। ইরফান রাহাকে ধরে এগিয়ে আসলো। সারহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে একপ্রকার উপেক্ষা করে রাহাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। ইশরাও ভাইয়ের পিছু পিছু ছুটে গেল। এহেন আচরণে অতিব আশ্চর্য হলো সারহান। হঠাৎ উপেক্ষা করার কারণ খুঁজে পেল না। আয়নাল সাহেবকে আসতে দেখা গেল।
“চাচা আপনারা কোথায় থেকে আসছেন?”

সারহানের কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয় প্রবেশ করল আয়নাল সাহেবের। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। মুখাবয়ব অতিশয় থমথমে। ঝিমিয়ে ওঠা কন্ঠে বললেন ;
“মেম্বারের বাড়িতে।”
সারহান তীক্ষ্ণ চাহনিতে পরখ করল আয়নাল সাহেবকে। এক দেখায় ঠাওর করেছে বড়সড় কাহিনী ঘটেছে। তবুও শান্ত কন্ঠে জানতে চাইল;
“কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটেছে?”
“সাদাতকে জিজ্ঞেস করো। এ মুহুর্তে বলার মতো ভাষা নেই আমার।”
আয়নাল সাহেব ভারাক্রান্ত কন্ঠে বললেন। তারপর হেঁটে বাড়ির দিকে চলে গেলেন। সারহান এবার সরাসরি ছোট ভাইয়ের দিকে তাকায়। সাদাতকে মুখ ভার করে আসতে দেখা যায়। আবির সবার উদ্ভট আচরণ দেখে বলে;
“সারহান এদের কি হয়েছে? সবার মুখ আমসত্ত্বের মতো হয়ে আছে কেন?”
সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল;

“বুঝতে পারছি না কি হয়েছে। সাদাতকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে।”
সাদাত রয়ে সয়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল ভাইয়ের সামনে। তার মুখটা ভীষণ ভার। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় স্বাভাবিক ভাব উবে গেছে। এতোক্ষণ কোনো মতো চুপচাপ থেকে হজম করেছে। কিন্তু ভাইকে সব ঘটনা বলা এবং বাড়ির সবাইকে জানালে পরিস্থিতি কোন দিকে ধাবিত হবে তা নিয়ে শঙ্কায় আছে সে। সারহান কিয়ৎ মৌন থেকে রুঢ় কন্ঠে বলল ;
“কাহিনী কি? সবার চোখ মুখ চুপসে আছে কেন?”
সাদাত চমকে তাকাল ভাইয়ের দিকে। বিরস কন্ঠে বলল;
“ভাই ধামাকাদার কাহিনী ঘটেছে। আমি বলব কিন্তু তুমি সবটা সামলে নিবে প্রমিজ করো।”
সারহানের বিচক্ষণতা তাৎক্ষণিক ধরতে পারল যা ঘটেছে তা তার ধারণার বাহিরে। সে শান্ত চাহনিতে তাকাল। অতঃপর আশ্বাস দিয়ে বলল;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৫

“প্রমিজ করলাম সবটা সামলে নিবো।”
সাদাত হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এতোক্ষণের চিন্তা খানিকটা কমল। তবুও চেপে রাখা উত্তেজনা দমাতে পারল না। উত্তেজনাপূর্ন কন্ঠে উচ্চস্বরে বলে উঠল;
“ ইরফান ভাই কট খেয়ে রাহাকে বিয়ে করেছে।”
সারহান এহেন কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আবির যেন লাফিয়ে উঠল। বিস্মিত কন্ঠে চিৎকার করে বলল;
“কি বললে সাদাত, ইরফান কট খেয়ে রাহাকে বিয়ে করেছে?”
সাদাত দুই দিকে মাথা দুলিয়ে বলল;
“হুম। ইরফান ভাই এবং রাহা নিউলি ম্যারেড কাপল। মানে কট ম্যারেড কাপল।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৬ (২)