মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৩
নওরিন কবির তিশা
— আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?? এতগুলো ঘড়ি দিয়ে আমি কি করবো??
শিশিরের কণ্ঠে মিশে আছে বিস্ময়, বিরক্তি । অথচ নাহিয়ানের মুখে একটুও ভাবনার ছায়া নেই।
সে ঠান্ডা গলায় শোরুমের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল—
— প্যাক করো। একটাও বাদ দিও না।
ছেলেটা কিছুটা থমকে গেল। এতগুলো ঘড়ি? কিন্তু নাহিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝে গেল—এই আদেশ এড়ানোর মতো নয়।
— জি, স্যার…
কিছুক্ষণ আগে…
নাহিয়ান আর শিশির বাসায় ফিরছিল। হঠাৎই নাহিয়ান বাইকের গতিপথ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। শিশির পিছন থেকে কয়েকবার বলল—
— কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি? বাসা তো এদিকে না!
কিন্তু নাহিয়ান একটাও উত্তর দিল না। যেন কিছু ভেবে রেখেছে সে।
কয়েক মিনিট পর সে বাইক থামালো এক ঘড়ির শোরুমের সামনে। শিশির ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল—
— এখানে কেন?
নাহিয়ান এবার মুখ ফেরাল, গম্ভীর গলায় বলল—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— তোর হাত ফাঁকা কেন??
— মানে?
— মানে হচ্ছে—স্টুডেন্ট লাইফে টাইম মেইনটেইন করার জন্য একটা ঘড়ি থাকা লাগে। টাইমম্যানেজমেন্ট একটা আর্ট। আর সেটা যে তোর নেই, সেটা আজকের ক্লাসেই প্রমাণ হয়ে গেছে। আটটায় ক্লাস শুরু, আর তুই তখনও সাড়ে সাতটায় ঘুমিয়ে!
শিশির চুপ করে শুনছিল। কি বলবে? সত্যিই তো, দেরি করেছিল। আর কিছুদিন আগেই ঘড়িটাও তো হারিয়ে ফেলেছে সে।
কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু তার সাথে শোরুমে ঢুকে গেল। ভেতরে ঢুকতেই শোরুম অ্যাসিস্ট্যান্ট এগিয়ে এলো—
— জি স্যার, কী লাগবে?
নাহিয়ান এক পলক দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বলল—
— সবচেয়ে ইউনিক আর নতুন লেডিস ঘড়িগুলো দেখান। সব মডেল।
ছেলেটি সত্ত্বর কাজ শুরু করল। কয়েক মিনিটেই সাজিয়ে দিল টেবিল ভর্তি ঘড়ি।
— স্যার, এগুলো একদম আজকের নতুন স্টক।
নাহিয়ান এবার শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলল—
— দেখ, কোনটা ভালো লাগে?
শিশির তাকিয়ে থাকল। ঘড়িগুলো এত সুন্দর, এত ইউনিক! তার চোখ বড় হয়ে গেল একেকটা ডিজাইন দেখে।
অবাক হয়ে ফিসফিস করে বলল—
— সবগুলোই তো সুন্দর…
কথাটা বলেই যেন সে টের পেল কিছু একটা হয়ে যাবে। আর ঠিক তাইই হলো।
নাহিয়ান ঠান্ডা স্বরে বলল—
— সবগুলো প্যাক করো। একটাও বাদ দিও না।
বর্তমান…
— স্যার, এতগুলো ঘড়ি… হোম ডেলিভারি লাগবে?
— আপনাদের হোম ডেলিভারি সিস্টেম আছে?
— সাধারণত নেই, কিন্তু অর্ডার যেহেতু অনেক বড়, আপনার জন্য করা যাবে। ঠিকানাটা বলুন।
— বসুন্ধরা ব্লক-C, নাহিয়ান মঞ্জিল।
— ঠিক আছে, স্যার।
নাহিয়ান বিল মিটিয়ে শিশিরকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। শিশির হেঁটে চলেছে নাহিয়ানের পাশেই, কিন্তু তার চোখে এখনো বিস্ময়।
এতগুলো ঘড়ি! সে তো শুধু প্রশংসা করেছিল। এমন কিছু আশা করেনি।
প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলতে যাবে ঠিক তখনই, নাহিয়ান তার চিরচেনা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে উঠল—
— তোর টাইম এখন থেকে আমার ইচ্ছা মতো চলবে। তাই কথা না বাড়িয়ে বাইকে উঠ।
শিশির চুপচাপ বাইকে উঠে পড়ে।
গাড়িতে রাকিবের পাশে বসে এখনো ফুঁপাচ্ছে সাবিহা। সে বুঝে গিয়েছে, মেয়েটা ওর ভয়েই শব্দ করে কাঁদতেও পারছে না। অথচ তার দিকে একবার তাকিয়েই রাকিবের বুক কেমন ধকধক করে ওঠে। মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া হচ্ছে তার—ভীষণ। বিশেষ করে, সাবিহার অতীত জানার পর থেকে এই মায়াটা যেন আরও গাঢ় হয়েছে।
সাবিহা ছিল তার বাবা-মার একমাত্র মেয়ে। তবে কেবল নামমাত্রই ‘একমাত্র’। আদর-যত্ন, ভালোবাসা, নিরাপত্তা—একমাত্র সন্তানের যা প্রাপ্য, তার কিছুই পায়নি সে।
তার বাবা-মা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসে নতুন জীবনের শুরু। কিন্তু সে শুরু যে এমন অন্ধকার হবে, তা হয়তো কল্পনাও করেননি সাবিহার মা।
বিয়ের কিছুদিন পরই তিনি আবিষ্কার করেন এক নির্মম সত্য—যার জন্য নিজের পরিবার ছেড়ে এসেছেন, সেই মানুষটাই একজন নেশাগ্রস্ত, মাতাল। ধীরে ধীরে শুরু হয় টাকার জন্য নির্যাতন। প্রথমে মানসিক, পরে শারীরিক। ততদিনে পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। এই অসহায় অবস্থার মধ্যেই জন্ম হয় সাবিহার।
তবে সাবিহার জন্ম যেন তাদের জীবনে আলো না এনে আরও অন্ধকার এনেছিল। কারণ তার বাবা চাইছিলেন ছেলে। সাবিহার মুখ দেখারও প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। শুধু তার মা-ই তখন এই ছোট্ট প্রাণটাকে আগলে রেখেছিলেন যতটা পেরেছেন।
কিন্তু সাবিহার জীবনে অন্ধকার তখনও শেষ হয়নি।
মাত্র সাত-আট বছর বয়সে সে হারিয়ে ফেলে জীবনের একমাত্র আশ্রয়—তার মা। মৃত্যুর সঙ্গে নিয়ে যান জীবনের শেষ আলোটুকু। সাবিহার জীবনের শেষ আলোর রশ্মিটুকু যেন্যহারিয়ে যায় নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে । তার জীবনে শুরু হয় সৎ মায়ের অত্যাচার। কারনে-অকারনে মেরে শরীরের চামড়ায় দাগ তৈরি করা হয়ে যায় প্রতিদিনের রুটিন। শরীরে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দেওয়া, প্রচন্ড শীতের রাতে পুকুরের ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে রাখা আরো অনেক নৃশংসতা।
হঠাৎই নীরবতা ভেঙে রাকিব মুখ খোলে, নরম অথচ গম্ভীর গলায় বলে—
— আর কাঁদবে না। যা হওয়ার ছিল, তা তো হয়েই গেছে। এখন আর কাঁদলে কিছু আসবে যাবে না।
সাবিহা মুখ তুলে রাকিবের দিকে তাকায়। ভেজা চোখে, নাক টেনে বলল—
— আপনি এমনটা করলেন কেন? কেন বিয়ে করলেন আমাকে??
রাকিব শান্ত গলায় উত্তর দিল—
— তোমাকে বাঁচানোর জন্যই করেছি। না হলে ওরা ওখানেই তোমাকে মেরে ফেলত।
সাবিহা ততক্ষণে যেন ক্ষোভে, কষ্টে ফেটে পড়েছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল—
— মেরে ফেলত তো ফেলত! এমনিতেও বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই আমার! আর আপনি কে আমার? কতদিনই বা চিনেন আমাকে?? কে বলেছিল আপনাকে আমাকে বাঁচাতে??
রাকিব থেমে যায়। কোনো উত্তর খুঁজে পায় না সে। সত্যিই তো—সে সাবিহাকে এর আগে কখনো দেখেনি। চিনেও না। তবুও কী এমন হলো যে, সে এতটা এগিয়ে গেল? কেন তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল, যখন ওরা সাবিহাকে বাজে নষ্টা বলছিল?? কেন রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছিল, যখন ওরা সাবিহার দিকে আঙুল তুলছিল?
রাকিবের জানা নেই।
গাড়ির মধ্যে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর খুব সোজাসাপটা গলায় সে বলল—
— চলে এসেছি।
শোরুম থেকে বের হয়ে, বাসার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে নাহিয়ান ও শিশির। বাইক চলছে নিজগতিতে। শিশির নাহিয়ানের ঘাড়ে আলতোভাবে হাত রেখে বসা, আর শিশিরের স্পর্শ অনুভব করছে নাহিয়ান । হঠাৎই দুইটা ছেলে অন্য একটি বাইক দিয়ে তাদের পাশ ক্রস করে যাওয়ার সময় বলে ওঠে,,,
-হেই বেবি গার্ল । ইউ আর লুকিং সো হট।
শুধুমাত্র দুইটি শব্দ নাহিয়ানের চোখ আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। সে শিশিরকে বলে,,
-শক্ত করে ধর।
শিশির তাকে শক্ত করে ধরার সাথে সাথে নাহিয়ান বাইকের স্পিড সর্বোচ্চতে নেয়। এরপর কয়েক মিনিটের মাঝেই সেই বাইকটার সামনে যায়। শিশিরকে বাইক থেকে নামতে বলে সে নিজেও বাইক থেকে নামে। এবার সেই বাইকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,,
-শু****বাচ্চা কি বলেছিলি আবার বল।
অন্যদিকে নাহিয়ানের এত তাড়াতাড়ি তাদের ধরে ফেলা আর নাহিয়ানের রক্তিম চোখ দেখেই ছেলে দুটোর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। নাহিয়ান তাদের কোন কথা না বলতে দিয়ে যে ছেলেটা শিশিরকে বাজে কথা বলেছিল তার কলার ধরে বাইকের উপর থেকে নামিয়ে এনেই মাটিতে ফেলে বুকের উপর ইচ্ছামতন লাথি দিতে শুরু করে। তার লাথির তোপে ছেলেটির মুখ দিয়ে রক্ত উঠে আসে। তার সাথে থাকা ছেলেটি কোনো উপায় না পেয়ে দৌড়ে এসে শিশিরে পা জড়িয়ে ধরে বলে,,
-আপু আমরা আর কখনো কোনদিন কোন মেয়েকে কোন বাজে কথা বলব না। মাফ করে দিন আমাদের।দয়া করে ভাইকে থামান। না হলে ও মারা যাবে। দয়া করুন দয়া করুন আপু ছেড়ে দিতে বলেন।
শিশির ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলে,,
-কি করছেন তা ছাড়ুন আমার।
ছেলেটি শিশিরের কথার জবাবে ভীত স্বরে বলে,,
-না না আপা মাফ করে দিন। মাফ করে দিন আমাদের।
বাইকে ছেড়ে দিতে বলেন ও কে।
শিশির কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে,,
-আপনি আমার পা না ছাড়লে আমি কি করে যাব?? ছাড়ুন বলছি।
ছেলেটি এবার শিশিরের পা ছেড়ে দেয়। শিশির দেখতে পায় নাহিয়ান এখনো নৃশংসভাবে মারছে ছেলেটিকে। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে নাহিয়ানকে থামিয়ে বলে,,
-কি করছেন??মেরে ফেলবেন নাকি??
নাহিয়ান শিশিরের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,,
-হ্যাঁ হ্যাঁ, মেরেই ফেলবো। বাস্টার্ডটার কত বড় সাহস তোকে উল্টোপাল্টা কথা বলে।
নাহিয়ান থামে না। গাড়ির পার্কিং পিলারের সঙ্গে মাথা ধাক্কা দেয় এমনভাবে যে ছেলেটার কপাল ফেটে যায়। মুখ দিয়ে রক্ত গড়াতে থাকে।
চারপাশে থাকা লোকজন থ হয়ে যায়। কেউ কেউ ফোন বের করে, কেউ আবার ব্যাক করে যায়। ঠিক তখনই, আশপাশের একজন ভদ্র চেহারার লোক—যিনি VL-দের একজন—চুপিচুপি ৯৯৯-এ ফোন করে।
মুহূর্তখানেক পর🍁🍁
দুইজন পুলিশ এসে ছুটে আসে।
— এই যে ভাই, কী হচ্ছে এখানে?
তারা যখন নাহিয়ানকে জিজ্ঞেস করতে যায়, তখনই অন্য এক পুলিশ চিনে ফেলে—
— স্যালুট স্যার! আপনি তো সিআইডি অফিসার নাহিয়ান চৌধুরী, তাই না স্যার?
নাহিয়ান তখনো ছেলেটার কলার চেপে ধরেছিল। একটু পর ছাড়ল, চোখ নামাল—
—এই পেরভার্টেড জারজটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করছিল। সামলান ওকে।
পুলিশ দ্রুত ছেলেটাকে নিজেদের হেফাজতে নিল। আরেক অফিসার কনফার্ম করল,—
—স্যার, আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। ধন্যবাদ।
নাহিয়ান চুপচাপ শিশিরের দিকে তাকাল। ওর মুখে এখনো কিছুটা আতঙ্ক, কিন্তু সে একটাও শব্দ করল না। নাহিয়ান আবার হালকা গলায় বলল—
—চল।
বাইক থামে শহরের অভিজাত একটা শপিংমলের সামনে। ঝাঁ চকচকে বিল্ডিং, কাচের দেয়ালে চোখ ধাঁধানো আলো।
নাহিয়ান শুধু শিশিরকে বলে—
-নাম।
শিশির বুঝতে পারে না নাহিয়ান কেন তাকে এখানে এনেছে। কিন্তু ভালো সে করেই জানে না নাহিয়ানের কাছে এখন প্রশ্ন করলে কোন উত্তর পাওয়া যাবে না। তাই অগত্যা সে নেমে চুপিচুপি নাহিয়ানের পিছুপিছু যেতে থাকে।
নাহিয়ান তাকে নিয়ে ঢুকে একটি Luxury Modest Fashion Boutique-এ। নাহিয়ান ঢুকেই বলে—
— হিজাব আছে?
দোকানের স্টাফ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসে বলল,
— জি স্যার, আমাদের কালেকশন একেবারে এক্সক্লুসিভ। নতুন সব ডিজাইনার পিস।
নাহিয়ান এবার সরাসরি বলল,
— যত রঙের যত ইউনিক ডিজাইন আছে, সবগুলো থেকে একটা করে তুলে দিন। প্যাক করে দিন একসাথে।
শিশির এবার সত্যিই বিরক্ত হয়ে পড়ে। তার চোখ বড় হয়ে যায়। গলা চড়িয়ে বলল,
— আপনি চাচ্ছেন টা কি হ্যাঁ?? একটু আগে ঘড়ির সবগুলো মডেল কিনে নিলেন, আর এখন হিজাবের সব কালার?? আর তাছাড়া হিজাব আমি কি করবো???
-আজ থেকে তুই হিজাব পরবি। বাইরে বের হবি মাথা ঢেকে। আর চুল খুলে চলা? ভুলে যা।
-আমি হিজাব বাধঁতে পারি না।
নাহিয়ান শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল—
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১২
-বাঁধতে পারিস না শিখে নিবি। আর তুই জানিস, আমি যা বলি, সেটা হয়—অবশ্যই হয়।
সেটা দেখে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে,,
-আপনি বললেই হল নাকি?? আমার ইচ্ছা।
নাহিয়ান এক পা এগিয়ে এসে শিশিরের চোখের গভীরে তাকাল, গলার স্বর গভীর—
-ওওও, আপনার ইচ্ছা? তো মিস… এই নাহিয়ান চৌধুরীর এককথাই শেষ কথা। মানবি তো ভালো, না হলে সারা জীবন পস্তাবি… মাইন্ড ইট ফর দ্য রেস্ট অফ ইয়োর লাইফ…..