প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৫
ফিজা সিদ্দিকী
“আপনার রক্তে আমি মিশে গেলাম, মিস্টার সাইলেন্সার। মানুষের দেহ মিশে একাকার হয়, আর আমরা রক্তে মিশে। আমাকে আপনার থেকে আলাদা করার সাধ্য আর কারোর রইলো না।”
তুর্জয়ের নাকের সাথে নাক ঘষে ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো নন্দিতা। অতঃপর আস্তে ধীরে তুর্জয়ের বাম বাহুতে ফোটানো ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা বের করে নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে।
অগোছালো ওয়াশরুমের সিঙ্কের উপর রাখা সেই শিশিটা। যেখানে আসল ব্লাড স্যাম্পল আছে। নন্দিতা আর সময় অপচয় না করে ফেলে রাখা সিরিঞ্জে সেই আসল ব্লাড স্যাম্পলটা ভরে পুশ করলো নিজের শরীরে। ঠোঁটে তার ক্ষীণ হাসি। শরীরে অদ্ভূত রকমের কঠোরতা। হাতে বাঁধা ওড়নাটা রক্তে ভিজে একাকার। পরোয়া করলো না নন্দিতা। এই শেষ রাতটুকু সে একটুও অপচয় করতে চায়না। পুরোটুকু সময় তুর্জয়কে লাগবে তার। তার গায়ের গন্ধ, তার লোমশ বুকের ওম, তার সিগারেট পোড়া খসখসে ঠোঁট, এলোমেলো চুল সবটুকু লাগবে তার। তীব্র আসক্ত কোকেনের মতো আজ সে তার আসক্তি মেটাবে। এরপর যদি না পায়? একটা রাত তার গোটা জীবনের সম্বল যে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সিঙ্ক থেকে সবকিছু ক্লিন করে রুমে ফিরে এলো সে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল বিছানার কাছে। তুর্জয়ের উন্মুক্ত লোমশ বুক খুব করে টানলো তাকে। দুনিয়া ভুলে লুটিয়ে পড়ল সেই বুকে। সাথে সাথে ডান হাত বাড়িয়ে নিভিয়ে দিলো ঘরের সবগুলো লাইট। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে জানালা থেকে বয়ে আসা ফিনফিনে বাতাসে তুর্জয়ের শরীরের সবটুকু ঘ্রাণ নাক ডুবিয়ে টেনে নিলো সে নিজের মাঝে। সাথে সাথেই ডুকরে কেঁদে উঠলো নন্দিতা। দুইহাতের আজলায় তুর্জয়ের মুখে তুলে নিয়ে ভারী কণ্ঠে বললো,
“আমি কেন কিছু পেলাম না? কেন নিয়তি আমার থেকে সবকিছু কেড়ে নেওয়ার জন্য এতো ষড়যন্ত্র করে? ছোটো এই জীবনে যেটুকু পেয়েছি, সেটুকুই তো ভালোবেসে গ্রহণ করেছি। তবুও কেন তার আমার জিনিসের প্রতি এতো নজর? আমার সুখে নিয়তির এতো কেন হিংসে? কেন আমার বলতে কেউ থাকে না কখনও। যাকেই পেয়েছি, ভাগ্য আমাকে বারবার হারিয়ে দিয়ে তাকে কেড়ে নিয়েছে আমার থেকে?”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি। নিজেকে মৃত্যুর নামে লিখে দিয়ে তোমার প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার মত করে ভালোবাসি।”
ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটা ধীরে ধীরে লুটিয়ে পড়ল গভীর ঘুমে। প্রিয়তমের বুকের উষ্ণতা নাকি গভীর ক্লান্তি কে জানে, তাকে আর জাগ্রত রাখতে পারলো না। খোলা জানালার পর্দার ফাঁক থেকে ভেসে আসা চন্দ্রাণী আলীর একটা ছটা এসে পড়ল এক মায়াবী মুখে। যার ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা হাসিটুকু তাকে করে তোলে অনন্য। যার সবটুকু লুটিয়ে দেওয়া ভালোবাসা তার প্রেমিক পুরুষকে করে তোলে ভাগ্যবান। মানুষ ভাগ্যবতী নারীর গল্প জানে শুধু, অথচ কোথাও এক ঘুমন্ত ভাগ্যবান পুরুষের গল্প কেউ জানলো না। জানলো না সেই পুরুষ নিজেও। শুধুমাত্র প্রকৃতি সাক্ষী এক পবিত্র নারীর আত্মদানের, তার ভালোবাসার।
বিলাসবহুল ঘরের কাঁচের খোলা ফটক ভেদ করে সূর্যের আলো তেরচাভাবে পড়েছে তুর্জয়ের মুখের উপর। অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। বুকের উপর ভারী ওজনের কিছু একটা অনুভব হলেও চোখ খোলা বেশ যন্ত্রণার ঠেকলো তার। বাম হাতেও ব্যথা ভীষণ। মনে হচ্ছে যেন একেবারে অবশ হয়ে আছে হাতটা। বহু কষ্টে চোখে মেললো তুর্জয়। পুরো শরীরটা কেমন যেন ঝিম ধরে আছে। মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে কাল রাতের কথা মনে করতে করতে উঠতে গিয়ে নিজের বুকের উপর আবিষ্কার করলো নন্দিতাকে। নন্দিতাকে এতটা কাছে দেখে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো সে।
মাথা উঁচু করে কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিয়ে আস্তে করে তার মাথা বালিশে রাখতে গিয়ে খেয়াল করলো নন্দিতার হাতের দিকে। রক্তে লাল হয়ে ভেজা ওড়নাটা দেখে আঁতকে উঠলো তৎক্ষণাৎ। ভুলে গেলো নিজের শারীরিক অসুস্থতার কথা।
কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোর কারণে মুখ ঢেকে নন্দিতার। বেঘোরে ঘুমানো নন্দিতাকে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে তার হাতের বাঁধন খুললো তুর্জয়। সারারাতে রক্ত জমাট বেঁধে ওড়নার সাথে লেপ্টে গেছে। জমা রক্তে আঁকড়ে গেছে হাত। লম্বালম্বি ভাবে কেটেছে হাতের মাঝের অনেকটা মাংসল অংশ। তার গোটা জীবনে এতটা অস্থির সে কখনও হয়নি, যতটা আজ নন্দিতার এতটুকু ব্যথা দেখে লাগছে তার। এতখানি অস্থিরতা, এতখানি বেদনা, যেন এই ব্যথা তার শরীরে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। অন্যের শরীরের আঘাত তাকে এতটা ব্যথা কিভাবে দেয়? এমন ব্যথা তো সে অনেক পেয়েছে, অথচ কখনও তো এমন মনে হয়নি।
অস্থিরতায় মেডিসিন বক্স উল্টে দিলো সে মেঝেতে। অতঃপর নিজেও বসে পড়ল মেঝেতে। বিছানা থেকে বেরিয়ে থাকা হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় আলতো করে ধরলো সে। ঠিক যেন কোনো তুলতুলে বাচ্চার শরীর। একটু চেপে ধরলেই ব্যথা পাবে।
আস্তে ধীরে তুলো দিয়ে সবটুকু ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো সে। অতঃপর ব্যান্ডেজের উপর ঠোঁট ছুঁইয়ে করুণ সুরে বলে উঠলো,
“আসামিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়, অথচ আমার বিবেকের কাঠগড়ায় আমি পরাজিত।”
তুর্জয় সবেমাত্র রেডি হয়ে বের হচ্ছিল। আয়নার সামনে দাঁড়ি য়ে ঘড়ি পরতে পরতে একপলক তাকালো আয়নায় পড়া নন্দিতার প্রতিবিম্বের দিকে। আর সেই মুহূর্তেই খানিকটা নড়াচড়া করে উঠলো নন্দিতা। অতিরিক্ত ব্যথার ফলে যে কাল রাতে অজ্ঞান হয়েছিলো, এ ব্যাপারে অজানা নয় তুর্জয়ের। অনেকটা ইচ্ছে করেই সে নন্দিতার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেনি। এক প্রকার পালিয়ে যেতে চেয়েছিল যেন। আজকে সকালটা বড্ডো অনাকাঙ্খিত, অযাচিত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে শুরু করতে চায়নি সে মোটেও। কিন্তু নিয়তির পরিকল্পনা তো অন্যকিছু। সহজ জীবন সহজভাবে চলতে দেয় কই সে?
নন্দিতাকে তাড়াহুড়ো করে উঠতে দেখে তুর্জয় এগিয়ে যায় তার কাছে। অস্বস্তি এড়াতে শার্টের কলার ঠিক করতে করতে ভারিক্কি কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ওঠার দরকার নেই। রেস্ট করো তুমি। রান্না করে রেখেছি আমি। দুপুরে খেয়ে নিও সময় মতো।”
কথাটুকু কোনক্রমে শেষ করে যেন পালিয়ে যাওয়ার মত করে বেরিয়ে যেতে গেল তুর্জয়। এমন সময় তাকে পিছু ডাকলো নন্দিতা। করুণ সুরে বললো,
“তুর্জয়!”
এই প্রথম তাকে নাম ধরে ডেকেছে নন্দিতা। উত্তেজনার বশে এর চেয়ে বেশি কিছু মাথায় আসেনি তার। তুর্জয়ও পিছু না ফিরে উত্তর দিলো,
“বলো”
“কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না?”
“কোন ব্যাপারে?”
“যেটা মন চাইবে।”
“জিজ্ঞাসা করলেই কী উত্তর দেবে?”
নন্দিতার আর বলার মতো কিছু থাকলো না। আসলেই তো সে সঠিক উত্তরটা দেবে না তাকে। তাহলে কেন চাইছে তুর্জয় তাকে প্রশ্ন করুক। প্রশ্নের বানে জর্জরিত করে কিছু কটু কথা শোনাক। এভাবেই কী তবে অপরাধবোধের বোঝাটুকু কমাতে চাইছে সে?
“আমার এতো বছরের ক্যারিয়ারে কোনো আসামিকে নিজের দোষ সরাসরি স্বীকার করতে দেখিনি। তাই আশাও করিনা।”
“তাহলে আমার এতো যত্ন কেন নিচ্ছেন?”
“কে বললো তোমার যত্ন নিচ্ছি? আমি আমার ধ্বংসকে যত্ন করছি। ইতিহাস সাক্ষী, প্রতিটা পরাজিত যুদ্ধে আপনজনের হাত রয়েছে।”
“নিজের ধ্বংসকে যত্ন করতে হয়না, ধ্বংসের কারণকে মূলসহ উপড়ে ফেলতে হয়।”
তুর্জয় আলতো হাসে। হাসিটা কেমন যেন বেদনার্ত শোনালো। ঠিক যেমন কেউ কয়েকটা ছুরিকাঘাত করার পরেও মানুষ হাসে, অনেকটা এমন।
“তাকে উপড়ে ফেলতে গেলে যে নিজেকেও উপড়ে যেতে হয়। বড্ডো আলগোছে, কৌশলে সে ভাইরাসের মতো আমার রক্তে মিশে গেছে, কোথা থেকে বাদ দেব ঠিক বুঝতে পারছি না। শরীরের সবটুকু রক্ত বাদ দিলেও কোথাও না কোথাও থেকে যাবে বোধহয় একবিন্দু।”
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ১৪
“ঘৃনা করেন?”
“আসেনা। তাকে দেখলেই লোভ লাগে। বুকে টেনে নেয়ার লোভ, ভালোবাসার লোভ। আদুরে শরীরে মিশে যাওয়ার লোভ। সে আস্ত এক যন্ত্রণা। আমাকে ধ্বংস করার একমাত্র উপায়।”