ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৯
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
বাংলাদেশ
রাজ ছেলের মাথার কাছে বসে দুঃখ দুঃখ চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। চোখ ছোট ছোট করে খুঁটে খুঁটে দেখছে ছেলেটা কতটা তার মত আর কতটা তার শত্রুর মতো হয়েছে। তবে এখানেও হতাশা জুটলো রাজার কপালে। ছানাটার মধ্যে কোথাও সে নিজেকে দেখতে পেল না। নাক-মুখ, ঠোঁট, চোখ—সবই তো তার শত্রুর মতন হায় হায় একি সর্বনাশ হলো। আর চেহারার কথা যদি বাদও দেয়, তবুও আচার-আচরণ তো কদাপি তার মত নহে।
এই যেমন, এখন ছোট্ট রাজবীর তার লাল টুকটুকে মুখখানাতে তীব্র বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে তুলেছে। ওষ্ট উল্টে আধ ঘন্টা যাবত ওয়েঁ ওয়েঁ করে কেঁদে যাচ্ছে। চোখ-মুখ সিটকানো সেই কান্নার তীব্রতা কানে তালা পড়ার উপক্রম রাজের। কান্নার তালে তালে সে মাঝেমধ্যে দুই একটা লাথি ছুড়ে মারছে বাবার মুখে। ছেলের ছোটো ছোটো পায়ের লাথি খেয়ে মনে মনে গভীর শোকাহত হলো রাজ। ছেলেটা যেন তার মায়ের প্রিন্টেড কপি। মায়ের তালে তাল মিলিয়ে চলে সার্বক্ষণক। মায়ের মত, কিভাবে বাপকে বাঁশ দেওয়া যায়—তার শিক্ষা যেন এখনি রপ্ত করে নিয়েছে খোদে ছানাটা।
রাজের নিজের কথা ভেবে বড্ড মায়া হল। সে অদৃশ্য হাতে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিলো। দুঃখ প্রকাশ করে বললো, “বিয়ে করে এতো বড়ো মুসিবতে ফেঁসে যাব আগে জানলে আজীবন চিরকুমার হয়ে থাকতাম। তবু ও দুধ কলা আর দুধ সেরেল্যাক দিয়ে ঘর শত্রু বিভীষণ পলতাম না।”
“বাই এনি চান্স, আপনি কি কোনভাবে আমাদের খাওয়ার খুটা দিলেন?” রাজের পিছনে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো পূর্ণতা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেয়েলি সেই কণ্ঠে চমকে উঠলো রাজ। তবুও চেহারার দম্ভে ভাটা পরলো না , সে দৃষ্টিতে আত্মবিশ্বাসী ফুটিয়ে তুলে বউয়ের দিকে ফিরে তাকালো। কপাল কুঁচকে বললো, “তো ভুল কি বলেছি?”
“তোমাকে বিয়ে করে আমার সর্বনাশ হয়েছে বুঝলে সর্বনাশ! এই ছেলের নাম আমার সর্বনাশ দেওয়া উচিত ছিল।” রাজবির কে দেখিয়ে চটে উঠে বলল রাজ।
“আমার ঘরে থেকে আমার দুধ কলা খেয়ে আমাকেই ফনা দেখাও? টু মাচ সাহসী নাগিন।”
রাজের কথায় মনে মনে রাগে ফুঁসে উঠলো পূর্ণতা, তবে চেহারায় সেটা প্রদর্শন করলো না। বাঁকা হেসে পায় পায় এগিয়ে এলো রাজের দিকে। পূর্ণতাকে এক পা, দু’পা করে নিজের দিকে এগোতে দেখে কণ্ঠ রুদ্ধ হলো রাজের। পুরুষালী দম্ভ মিলিয়ে গেল বাতাসে। মনের ভিতরের সিংহটা ম্যাও বলে উঠলো। হাঁ করে তাকিয়ে রইলো বউয়ের দিকে।
পূর্ণতা রাজের একদম কাছে এসে দাঁড়ালো। শয়তানি হেসে রাজের মুখে আলতো করে আঙুল ছুঁয়ালো। কণ্ঠে মধু ঢেলে বললো, “আমি নাগিন তাই না, বাদর মশাই? আমাকে দুধ কলা দিয়ে আপনি পুষছেন?”
পূর্ণতার এমন স্পর্শে রাজ লাউ ডাঁটার মতো নেতিয়ে পড়লো। পূর্ণতার কথা তার কর্ণ অবধি পৌঁছালো না। এই এক সমস্যা—নাগিনটা যেমনি হোক, ভীষণ সুন্দরী। কাছে আসলেই রাজের সিস্টেম হ্যাং হয়ে যায়। নিজেকে অপুষ্টিতে ভোগা দুর্বল রোগী মনে হয়। ভুলে যায়, এই রূপের জালে আটকে সে কত ছোবল খেয়েছে।
তাই এবারও রাজ নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। পূর্ণতার কোমর আঁকড়ে ধরে মোহগ্রস্তের মত ওষ্টের ভাজে ওষ্ট মিলালো। দীর্ঘ মোলায়েম স্পর্শ একে দিতে লাগলো ভালোবাসায়। পূর্ণতা ও বাধ্য বউয়ের মতো স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে তাল মিলাতে লাগলো। রাজ সেই মিষ্টত্বের অতলে নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিতে নিলেই ব্যথায় চিৎকার দিয়ে দূরে সরে গেলো রাজ। ঠোঁটে হাত দিয়ে দেখলো, ঠোঁট কেটে রক্ত চলে এসেছে।
পূর্ণতা ওষ্টে বক্র হাসি ফুটিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। বাঁকা হেসে বললো, “নাগিন বিয়ে করেছ আর ছোবল খাবে না, তা কি করে হয় বাদর মশাই?”
রাজ অসহায় নজরে তাকালো নিজের বউয়ের দিকে। তার অসহায় মন চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো—
আ হা হা আমি পারিনা, আর পারিনা
আমি কেনো মরিনা,আজরাইল কি চিনে না
আমারে রে গো, আমি পারিনা, আর পারিনা
আমি কেনো মরিনা।
আমি হয়তো দুইদিন পরেই মরবো
আগে মরলে কি ক্ষতি…এই দুনিয়ার তাল বাহানা
বুঝলাম না রে এক রতি।
হয়তো দুইদিন পরেই মরবো,আগে মরলে কি ক্ষতি…এই দুনিয়ার তাল বাহানা
বুঝলাম না রে এক রতি।আমার ঘরের রমণী,
যেমন কাল নাগিনী।
ঘরের ও রমণী,যেমন কাল নাগিনী।
ভুজঙ্গিনী পিছু ছাড়লো নারে,
আমি পারিনা, আর পারিনা,
আমি কেনো মরিনা,আজরাইল কি চিনে না
আমারে রে।
রাজ যেন মেনে নিল নিজের পরাজয়। সে বিয়ে করে নিজের স্বাধীনতা খুইয়েছে।
পূর্ণতা এবার ঢং ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। ছেলের জন্য ফিডারের দুধ ভরে ফিডারের বোতল আর ডায়াপারের প্যাকেট রাজের হাতে ধরিয়ে দিলো। মুখ বাঁকিয়ে, নাক সিটকে বললো, “চরিত্রহীন পুরুষ, সারাদিন শুধু নষ্টামি করার ধান্দায় থাকেন। নিন এটা ধরুন আর যান। আপনার পুত্রের ডায়াপার চেঞ্জ করে ফিডার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন। আপনার ছাওয়াল, আপনি বুঝেন কি করবেন।”
রাজ জিনিসপত্রগুলো হাতে নিলো। অসহায় চোখে বউয়ের রাগান্বিত মুখটা একবার দেখে বেদনাতুর কণ্ঠে বললো, “এটা কি একটু সুন্দর করে বলা যেতো না, বউ? আমি কি তোমার সাথে শুধু নষ্টামি করি? তোমাকে কি ভালোবাসি না বলো, তোমাকে কি একটু আদর করি না?”—বলে চোখের পানি মুছার ভান করলো।
রাজের ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলা কথাগুলোতে পূর্ণতার পাথুরে হৃদয়টা গলে পানি পানি হয়ে গেলো। স্বামীকে এতগুলো কথা শুনিয়ে দেওয়ার জন্য অনুশোচনা হলো খুব। তাই অনুশোচনার ভাড়ে নিজেই রাজের বুকে মাথা রাখল। অপরাধী কন্ঠে বললো, “আমি ও আপনাকে ভালোবাসি বাদর মশাই। আপনি সারাদিন বদমাইশি করেন বলেই তো আপনার সাথে খিট খিট করি… আচ্ছা, সরি, কাঁদবেন না প্লিজ, আপনি কাঁদলে আমারও খুব কান্না পায়…”
রাজও সুযোগ পেয়ে পূর্ণতার পিঠ জরিয়ে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো। বউয়ের মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে মনে মনে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো, “এই তো, বউ লাইনে চলে এসেছ! আসছে আমার সাথে পাঙ্গা নিতে! ওহে বালিকা, স্বামী স্বামীই হয়… যাই হোক, আমার বউটা দজ্জাল হলেও ও লক্ষ্মীমন্ত খুব। থাক আর বিবাগী হবো না।”
পূর্ণতা এবার রাজের হাত থেকে ফিডারের বোতলটা নিয়ে লাজুক কণ্ঠে বললো, “আপনি বাবুকে ডায়াপার পরিয়ে দিন, আমি ফিডার খাইয়ে দিচ্ছি।”
রাজও মুচকি হাসলো। স্বামী-স্ত্রী দু’জন তাদের বাচ্চার সাথে খুনসুটিতে মগ্ন হয়ে গেলো।
শিকদার বাড়ির ড্রয়িং রুমে একটা সরু লাঠি হাতে নিয়ে বসেছে তন্ময়, চেহারায় রাগে রাগি ভাব ফুটিয়ে তুলে একটু পরপর ধমকাচ্ছে ভাইপুকে।
অভিরাজ এতে চরম বিরক্ত, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বই খুলে বসে আছে। তার পড়ার মোটেও ইচ্ছে নেই, সে এখন খেলতে চায়, তাই শুধু ফাঁক ফোকর খুঁজছে পালানোর। কিন্তু পালাতে গেলেই তার ছোট চাচ্চু খপাত করে ঘাড়ে ধরে ফেলেছে।
এক সময় আর ধৈর্য ধরে বসে থাকতে পারল না অভিরাজ। নাকের পাঠা ফুলিয়ে বলল, “ছোট চাচ্চু, আমি একন আল পলবো না, আমাল আল ভালু লাগচে না। আমি এখন কেলবো।”
অভিরাজের কথায় চোখরাঙ্গানি দিল তন্ময়। শক্ত কণ্ঠে বলল, “একদম বাহানা বানাবি না পুচকে ছেলে! নাহলে এটা দেখেছিস?” মেরে পিঠের ছাল তুলে নেব বলে হাতের লাঠিটার দিকে ইশারা করলো তন্ময়, আবারো রাগী কণ্ঠে বলল, “আজ ৮-এর নামতা পুরোটা ঝরঝরে মুখস্থ করবি, তারপর বসা থেকে উঠবি। আর যদি না পেরেছিস, তো তোর একদিন নয়তো আমার যে কয়দিন লাগে।”
এবার ভয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ফুপিয়ে উঠল অভিরাজ।
অরণ্য এত ঝাড়া ঝাড়ি দেখে নিজের অফিসের ল্যাপটপ নিয়ে এসে বসল তন্ময়ের পাশে। কিবোর্ডে হাত চালাতে চালাতে বলল, “কি ব্যাপার পার্টনার, এতো রেগে আছিস কেন?”
তন্ময় ফুঁশ করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো, তিক্ত কণ্ঠে বলল, “আর বল না ছোরদা, বিকেল ৪টা থেকে এই একটা ৮-এর নামতা নিয়ে বসেছে, রাত ৮টা বেজে গেছে। কিন্তু এখনো আট আটে কত সেটা বলতে পারছে না! মন চাচ্ছে চাপকে পিঠের চামড়া তুলে নেই।”
তন্ময়ের কথায় অরণ্যও হতাশ হলো।
সমুদ্র এসে পাশে বসতে বসতে ফুরঁন কেটে বলল, “এমন ভাব নিচ্ছিস যেন তুই একদিনেই ৮-এর নামতা শিখে গেছিলি। ও তো তাও ভালো, ৮ ঘণ্টায় আট আটা পর্যন্ত চলে এসেছে! কিন্তু তুই? তোর পিছে পুরো ১ সপ্তাহ মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়েছে প্রিয়, তারপরও তুই পারিসনি।”
প্রিয়তা কথা উঠতেই অরণ্যের হাত থেমে গেল, তন্ময়ের হাসি-হাসি মুখটাও মলিন হয়ে গেল। কথাটা বলে থেমে গেল সমুদ্রও।
তন্ময় আনমনে বলে উঠলো, “কতদিন প্রিয় আপুকে দেখি না… প্রিয় আপু কি আর কখনো ফিরবে না ছোরদা?”
অরণ্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পুনরায় কিবোর্ডে আঙুল চাপতে চাপতে বলল, “হয়তো ফিরবে কখনো। হয়তো এখনো অনেক অভিমান জমিয়ে রেখেছে আমাদের উপর। নিজের সেই অভিমানের পাহাড় যেদিন গলাতে পারবে, সেদিন হয়তো ও ফিরবে।”
অরণ্যের কথায় মন খারাপ হলো তন্ময় ও সমুদ্রের।
সমুদ্রও অভিমান করে বলল, “ওর কিসের এতো অভিমান আমাদের উপর? আমরা কি ওকে বিদেশে পাঠিয়ে ছিলাম, নাকি যেতে বলেছিলাম? যা কিছু হয়েছে, তাতে আমাদের দোষটা কোথায়? কেন ও আমাদের সাথে এই ব্যবহারটা করে?”
সমুদ্রের কথায় পুনরায় চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করলো অরণ্য। অফিসের মেইলটা সেন্ড করে দিয়ে বলল, “কিছু অভিমান হয় অবুঝ, লজিক খুঁজে না… এমনি হয়ে যায়। আর ওর অভিমানটা আমাদের উপর নয়, আমরা কেবল তার রাগের শিকার। সে অন্যের দেওয়া কষ্ট আমাদের ফিরিয়ে দেয়।”
সমুদ্র আবার বলে, “দাদান এরকম কেন করলেন বলতো? দাদানের এমন করা মোটেও উচিত হয়নি অরণ্য। আজ যা কিছু হচ্ছে সব তো উনার জেদের জন্যই হচ্ছে। উনি যদি ৪ বছর আগে প্রিয়তাকে এমনভাবে অপমান না করতেন, মারধর না করতেন, তাহলে হয়তো আজ এমন কিছুই হতো না। আমাদের বোন আমাদের সাথেই থাকতো, পরিবার ছেড়ে দূর দেশে একা একা বাঁচতে হতো না।”
অরণ্য চুপচাপ শুনল, ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “প্রিয়তার ভালো তোর আমার থেকে অনেক বেশি বুঝেন বড় দাদান। প্রিয়তার জন্য যেটা ঠিক, সেটাই তিনি করেছেন। তোর কাছে যেটা ঠিক মনে হচ্ছে, সেটা হয়তো ঠিক ছিল না তখন। হয়তো সত্যি, প্রিয়তার দূরে যাওয়াটা দরকার ছিল। তুই কি উনার সিদ্ধান্তের উপর আঙুল তুলছিস?”
অরণ্যের কথায় বিদ্রুপের হাসি খেলে গেল সমুদ্রের ঠোঁটে। সে তাচ্ছিল্য করে বলল, “কি লাভ হলো শুনি, এত ভালো চেয়ে? এত ভালো করে কেউ কি ভালো আছে এখন? এসবে কষ্টটা কে পাচ্ছে? তুই, পাচ্ছিস আমি, পাচ্ছি নাকি এই বাড়ির কেউ পাচ্ছে? কিন্তু…”
কথা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই ড্রয়িং রুমে হাজির হলেন সাদমান শিকদার, খালিদ শিকদার ও অনুশ্রী বেগম।
উনাদেরকে দেখেই চুপ মেরে গেল তিন ভাই। সাদমান শিকদার ও অনুশ্রী বেগম পাশাপাশি বসে, বিয়েতে কে কে আমন্ত্রিত থাকবেন তার লিস্ট বানাতে শুরু করলেন।
দাদাকে দেখে চকচক করে উঠলো অভিরাজের চোখ সে পড়াশোনা, চুলায় উঠিয়ে এক লাফে সাদমান শিকদারের কোলে চড়ে বসলো।
এটা দেখে মনে মনে ফুঁসে উঠলো তন্ময়, তবে বড় আব্বুর সামনে কিছুই বলতে পারলো না। কারণ, উনার সামনে উনার নাতি-নাতনিদের কিছুই বলা যায় না। না হলে দেখা যাবে কয়েক ঘা তার নিজের পিঠেই পড়বে।
সাদমান শিকদার নাতিকে কোলে বসিয়ে এক হাতে পিঠ আঁকড়ে ধরলেন, আদরে কণ্ঠে বললেন, “আজকে কি কি পড়েছো দাদাভাই?”
অভিরাজ দাদার কথায় আহ্লাদি হয়ে উঠলো, দাদার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “অংক কলছিলাম দাদাভাই।”
নাতির কথায় হাসলেন সাদমান শিকদার।
অভিরাজ গুল গুল চোখে খাতার দিকে তাকালো, কৌতূহল নিয়ে বলল, “তুমি এটা কি করছো দাদাভাই?”
সাদমান শিকদার কলম চালাতে চালাতে হেসে বললেন, “লিস্ট বানাচ্ছি দাদাভাই।”
“কিচের লিচত দাদাভাই? এতা দিয়ে কি হপে?”
সাদমান শিকদার কিছু বলার পূর্বে তন্ময় পাশ থেকে মুখ বাঁকিয়ে বলল, “পড়ার নামে নাম নেই, খালি এটা কি, ওটা কি, সেটা কি হুঁহ।”
তবে সাদমান শিকদার ও অভিরাজ তন্ময়কে কানা কড়ির পাত্তা দিলেন না।
সাদমান শিকদার ও নাতির উচ্ছ্বাসে তাল মিলিয়ে বললেন, “এটা তোমার ফুপ্পি মনির বিয়ের লিস্ট, দাদাভাই।”
অভিরাজ এবার কণ্ঠে দ্বিগুণ কৌতূহল ঢেলে বলল, “বিয়ে কি দাদাভাই?”
অনুশ্রী বেগম পাশ থেকে বললেন, “নেন, এবার বুঝেন ঠেলা, নাতিকে বিয়ে কি বুঝান।”
অরণ্য সামনের প্লেট থেকে একটা বড় সাইজের সিঙারা হাতে নিলো, সেটায় বিরাট একটা কামড় বসিয়ে বললো, “বিয়ে মানে নতুন বন্ধু, ভাইপু। আর বন্ধু মানে খেলা, আর খেলা মানেই মজা।”
বন্ধুর কথা শুনে খুশিতে খিলখিল করে হেসে উঠলো অভিরাজ।
সাদমান শিকদারের পাঞ্জাবির বোতাম নিয়ে খেলতে খেলতে বায়না ধরে বললো, “আমি ও বিয়ে কলবো দাদাভাই।”
অভিরাজের কথা মুখ থেকে খসতে দেরি, কিন্তু তন্ময় ও অরণ্যের সিঙারা গলায় আটকাতে দেরি হলো না।
তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একসাথে কেশে উঠলো।
তাড়াহুড়ো করে পানির গ্লাস ঢক ঢক করে খালি করল তন্ময়। ধমকে উঠে বলল, “শক কত! ফিডার খাওয়া পুচকে ছেলে বিয়ে করবে?”
অরণ্য মুখ ব্যঙ্গিয়ে বলল, “দেখতে হবে না কার ছেলে? মীরজাফর বাবার মীরজাফর ছেলে।”
তন্ময় অভিরাজকে কোলে নিয়ে, নরম গাল চেপে দিলো। কানে কানে বললো, “এমন বলে না বাপ, আগে আমরা করবো, তার পর তুই।”
অভিরাজ সঙ্গে সঙ্গে দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানাল। ঠোঁট চৌকা করে বললো, “না না! আগে আমি কলবো, তালপল তোমলা!”
ভাতিজার কথা শুনে চোখ সরু করে তাকালো অরণ্য, তন্ময়ের কোল থেকে নিয়ে অভিরাজকে নিজের কোলে বসাল।
মুখ সিরিয়াস করে ফোল ফোল গালে কষে একটা চুমু খেয়ে বলল, “খরগোশের বাচ্চা! তোকে ধরে সোজা পেটে চালান করে দেবো, হাহাহা।”
চাচ্চুর কথায় অভিরাজের সুন্দর মুখশ্রীতে আঁধার নেমে এলো।
ভীত চোখে তাকিয়ে দ্রুত দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বললো, “আমি বিয়ে করবো না! আমাকে খেও না চাচ্চু!”
ভাতিজাকে ভয় পেতে দেখে বিশ্বজয়ী হাসি দিলো তন্ময় ও অরণ্য।
এই সকল রংঢং দেখে ভেংচি কাটলো সমুদ্র, মুখ বাঁকিয়ে বললো, “এই বাড়িতে বিয়ে পাগলা কি কম ছিল যে নতুন আরেকটা ডাউনলোড হলো?”
অনুশ্রী বেগমের নির্দেশে বাড়ির কর্তাদের জন্য চা-নাশতার ট্রে নিয়ে এলো জুলেখা।
সবার হাতে হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই, আকস্মাৎ কিছু কথা কানে এলো।
সাথে সাথেই পা থেমে গেল জুলেখার।
পেছন থেকে সাদমান শিকদার উত্তেজিত কণ্ঠে চিত্কার ভেসে এল, “কি বলছিস এসব? আমার আম্মজানকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে?”
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কি বললো শোনা গেল না, তবে সাদমান শিকদারের উচ্চারিত বাক্যে উপস্থিত সবাই বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
সাদমান শিকদার আর কিছু শুনতে পারলেন না।
বুকে হাত চেপে বসে পড়লেন। অনুশ্রী বেগম চিৎকার দিয়ে বাড়ির সবাইকে ডাকলেন।
দুই এক ডাকে বাড়ির সবাই দৌড়ে বেরিয়ে এলো।
সাদমান শিকদারকে বুকে হাত চেপে ছটফট করতে দেখে দৌঁড়ে ছুটে এলো প্রেম ও প্রিথম।
ছুটে এলো ঊষা, থিরা, পূর্ণতা, প্রেরণা।
প্রিথম সাদমান শিকদারকে ধরে বললো, “কোথায় কষ্ট হচ্ছে বড় আব্বু? কি হয়েছে এখানে?”
কেউ কিছু বলার আগেই তন্ময় সেই ৪ বছর আগের মত চিৎকার দিয়ে কান্না করে দিলো।
তন্ময়কে এভাবে কাঁদতে দেখে ভড়কে গেল অন্য সবাই।
রাজ তন্ময়ের মাথায় হাত রেখে বললো, “কি হয়েছে ভাই, এভাবে কাঁদছিস কেন?”
রাজের আদুরে স্পর্শে তন্ময়ের কান্নার জোর আরো বাড়লো।
কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা কণ্ঠে বললো, “প্রিয় আপুকে নাকি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেজদা…”
তন্ময়ের ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলা একটা বাক্যে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সকলের পায়ের নিচের জমিন সরে গেলো।
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো নিঃশব্দে।
বোন হারিয়ে গেছে কথাটা মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই মাথা ঘুরে গেলো প্রিথমের।
সাদমান শিকদারের অবস্থাও খারাপ হচ্ছে দেখে রাজ ছুটে গিয়ে ধরলো বাবাকে।
অরণ্যের উদ্দেশে চিৎকার করে বললো, “তারাতারি গাড়ি বের কর!”
অরণ্যও ছুটলো গাড়ি বের করতে।
কিছুক্ষণ আগের সেই হৈ-হুল্লোড় মুখর পরিবেশ যেন কিছুকক্ষণের মধ্যেই থমথমে নীরবতার অতলে হারিয়ে গেল।
দুশ্চিন্তায় কাটা হয়ে গেল প্রত্যেকটা মানুষ।
দুশ্চিন্তার পাশাপাশি তাদের মস্তিষ্কে অন্য এক ভয় চেপে বসলো—এখন কী হবে?
তাদের মধ্যে উপস্থিত সদস্যদের দু’জন নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করলেন।
কেটে গেছে আরো ১০ ঘণ্টা, সাদমান শিখদার এর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে, প্রেসার বেড়ে গেছে অনেকটা।
মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার কথা শুনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনন্যা বেগম, তৎক্ষণাৎ উনাকে ও হাসপাতালে নিতে হয়েছে।
উনাদেরকে হসপিটালে রেখেই প্রিথম ও সাজিদ শিকদার ইমারজেন্সি ফ্লাইট বুক করে কানাডা ছুটে গেছেন।
বাড়ির সকলের অবস্থাই মুমূর্ষু প্রায়, কারোরই মন ভালো নেই, তবে সকলের থেকে যেন একটু বেশি চিন্তিত খালিদ শিকদার।
তীব্র ভয় ও আতঙ্কে গুটিয়ে গেছেন তিনি,
তিন তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অস্থির চরণে অনবরত পায়চারী করে চলেছেন, অতিরিক্ত উৎকণ্ঠায় কোথাও একটু স্থির হতে পারছে না, হাঁটলে হাঁটু কাঁপছে, বসলে বুক ধড়ফড় করছে, ফুল পাওয়ারের এসির মধ্যে ও কপাল বেয়ে টুপটাপ করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে।
মনে চরম অস্থিরতার দোলাচল একটাই ভয়—এই কাজটা আবার প্রহেলিকা করেনি তো?
মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় ভদ্রলোকের অবস্থা পাগল প্রায়।
তিনি এই নিয়ে বহুবার প্রহেলিকাকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হয়েছেন।
এই চরম মুহূর্তে মেয়েটা ফোন তুলছে না।
তিনি প্রহেলিকাকে অন্তিম বারের মতো ফোন করলেন।
মোবাইলটা কানে চেপে ধরে আনমনে নিচে তাকাতেই চমকে উঠলেন, দৃষ্টি ছুটে গিয়ে স্থির হলো শিখদার বাড়ির মেইন গেটের কাছে।
চার বছর পর আবারো সেই চেহারায় দৃষ্টি আটকাতেই আতঙ্কে শিউরে উঠলেন খালিদ শিকদারের শরীর , নিজের অজান্তেই হাতে থাকা ফোনটা ফসকে নিচে পড়ে গেল।
খবর কানে চলে গেছে বুঝতে পেরে ওনার চেহারার রং ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করল।
যে ভয়টা তিনি এতক্ষণ চেপে রাখতে চাচ্ছিলেন, এবার যেন সেটাই সত্যি হতে চলেছে?
অনেকক্ষণ ধরে ডোর বেল বাজছে, কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই, কারণ কাল অনেক রাত পর্যন্ত সবাই হাসপাতালে ছিল, ভোরের দিকে বাসায় ফিরে সকলে মাত্রই ঘুমোতে গেছে, তাই এই কলিং বেলের বিকট শব্দ কারো কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না।
তবে জেগে ছিলেন অনুশ্রী বেগম, বিধায় কলিং বেলের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে, “আসছি, আসছি” বলে দ্রুত গিয়ে সদর দরজা খুলে দিলেন।
ত্রস্ততায় দরজা খুলে সামনে তাকাতেই উনার বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো, সুদীর্ঘ নেত্রযুগলে ভিড় জমালো চকচকে স্বচ্ছ পানির দানা।
দরজার অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে দেখে মূর্ছিত বা আশ্চর্যনিত হলেন না তিনি, বরং আবেগ দমিয়ে ঠোঁটের ঢাগায় প্রস্তুত বাক্যটা ছুঁড়ে দিলেন সামনের ব্যক্তির দিকে।
কড়া কণ্ঠে বললেন,
“তুমি এই বাড়িতে কেন এসেছ? তুমি যাকে খুঁজতে এসেছো সে এখানে থাকে না, তাই তুমি আসতে পারো বলে “—মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে নিলে।
দরজায় হাত চেপে ধরলো প্রণয়।
তার চেহারার অবস্থা বিধ্বস্ত, চুল এলোমেলো।
ঘাড়ের শিরা ফুলে দপদপ করছে, বাদামি রঙা চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত কোন অগ্নিকুণ্ড, দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে সে তার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে হাতের কাছে পেলে জিবন্ত চিবিয়ে খাবে।
সে নিজেকে যথেষ্ট সংবরণ করার চেষ্টা করে অনুশ্রী বেগমের উদ্দেশ্যে বললো—
“আমি জানি, ও এখানে নেই।
ও কোথায় আছে, সেটাই জানতে এসেছি।
আপনি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ান।”
অনুশ্রী বেগম শান্ত, তবে ছেলের অবস্থা দেখে ওনার মাতৃ হৃদয় ব্যথা জর্জরিত হয়ে উঠল।
তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ছেলের ভিতরের অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা ও তীব্র ছটফটানি।
উনি আরো দেখতে পাচ্ছেন, ওনার আদরের ছেলে, যার কাছ থেকে প্রথমবার মা হওয়ার অনুভূতি পেয়েছিলেন যার মুখে প্রথম বা ‘মা’ ডাক শুনেছিলেন, সেই ছেলে ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
এভাবে চললে উনার ছেলে বাঁচবে না বেশি দিন।
মেয়েটাকে যে সে কতো ভালোবাসে, তার পরিমাপ করার কোন সাধ্য নেই উনার। এই মেয়ের জন্য উনার প্রাপ্তবয়স্ক বুঝদার ছেলে কি পাগলামি টাইনা করেছে তার করা পাগলামি এই বাড়ির চাকর থেকে শুরু করে মালি পর্যন্ত সবাই দেখেছে।
তবে বর্তমানে এই ছেলে ওনার পরিবারের জন্য সর্বনাশা।
মায়ের সাথে অযথা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে নষ্ট করার মতো সময় নেই প্রণয়ের হাতে।
সে জানে না, তার জান কোথায় আছে কেমন আছে, কি করছে, বেঁচে আছে কিনা।
তবে প্রণয় নিজের কাছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা বদ্ধ—
তার আদরের ফুলটা যদি একটু ও কষ্ট পায়, তবে সব ছারখার করে দেবে প্রণয়,
জালিয়ে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দেবে সবাইকে,
ধ্বংস ঢেকে আনবে, প্রলয় ঘটিয়ে ছাড়বে চারপাশে, কাউকে বাঁচতে দেবে না,
পরিশেষে নিজেও নিঃশেষ হয়ে যাবে।
সে অনুশ্রী বেগমের অযথা কথায় কান দিল না,
উনাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।
ছেলেকে দেখে মনে মনে আতঙ্কিত হলেন অনুশ্রী বেগম—
না জানি, আবার কোন প্রলয় আসতে চলেছে এই বাড়িতে!
খালিদ শিখদার ভয়ে নিজের ঘরের ছিটকিনি আটকে বসে আছেন।
তিনি বেশ আভাস পাচ্ছেন—
এখন ওনার সাথে কি হতে চলেছে?
ভয়ে ওনার হার্ট অ্যাটাক আসার জো,
এই বুড়ো বয়সে মেয়ের জন্য না জানি প্রাণটাই খোয়াতে হয়!
উনার ভাবনা সমাপ্ত হওয়ার সাথেসাথে বাইরে থেকে বিকট দরজা ধাক্কানোর শব্দে কেঁপে উঠলেন তিনি।
কম্পিত শরীরটা গুটিয়ে নিলেন খানিকটা।
এবার ওনাকে কে বাঁচাবে?
এই ছেলে যা পাগল হয়ে আছে, বাপ-চাচা কিছুই বুঝবে না!
উনি ভাবতে ভাবতেই নিচের দিকে তাকিয়ে দেখেন, দরজার এক পল্লা ভেঙে ওনার পা ঘেঁষে মেঝেতে পড়েছে।
চমকিত নয়নে মাথা উপরে তুলতেই, এক জোড়া রক্তিম চোখের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল উনার।
এমন চোখ, যে চোখে চোখ রাখলে কয়েক মুহূর্তেই বুকে উষ্ণ রক্ত জমে বরফ হয়ে যায়।
খালিদ শিখদার ভয়াতুর নয়নে সামনে তাকিয়ে, তুতলিয়ে কিছু বলতে নিলে—
ঝড়ের বেগে এগিয়ে এলো প্রণয়।
ব্যাগ্র থাবা দিয়ে খালিদ শিখদারের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরল, দাঁতে দাঁত পিষে হিরষ্র কণ্ঠে গর্জে উঠলো—
“আমার থেকে বেশি ভদ্রতা আশা করবে না,
প্রাণে বাঁচতে চাইল আমার সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি বলুন,
আপনার মেয়ে কোথায়!
নাহলে…”
প্রণয়ের বলিষ্ঠ পুরুষালী থাবায় কুঁকড়ে গেলেন খালিদ শিখদার।
ভয়-আতঙ্কে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে ওনার,
তবুও তুতলিয়ে বলার চেষ্টা করলেন—
“বাবা… আমি তোর চাচ্চু…
আমার সাথে এমন করছিস!
আমি তোকে বড়ো করেছি।”
খালিদ শিখদারের কথায় প্রণয়ের শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠলো।
হাতটা নিশ ফিশ করে উঠলো,এর নোংরা মুখটা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য।
তবে তাদের বংশের নিয়ম—
বাঘ কখনো বাঘ শিকার করে না,
তেমন শিখদাররা ও কখনো একে অপরকে মারে না।
প্রণয় নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে,
খালিদ শিখদারকে একপ্রকার টেনে নিয়ে গেল বারান্দায়,
এক টানে রেলিং এর কাছে নিয়ে, বারান্দা দিয়ে নিচে ছুঁড়ে মারলো।
ভয়ে কলিজা ছলাত করে উঠলো খালিদ শিখদারের।
আতঙ্কে চেহারা নীল হয়ে গেল।
তিনি ঝড়ের বেগে মা গো বলে আঁকড়ে ধরলেন প্রণয়ের বাহু।
বিস্ফোরিত নয়নে নিচে তাকিয়ে, একটা বিকট চিত্কার দিয়ে কেঁদে উঠলেন।
বর্তমানে ৪ তলার বারান্দায় ঝুলছেন তিনি,
ওনার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল—প্রণয়ের বাহু।
উনার জীবন-মরণ ঝুলে আছে প্রণয়ের মর্জির উপর।
এই মুহূর্তে প্রণয় যদি একবার হাত ছেড়ে দেয়,
তাহলে সোজা ইন্নালিল্লাহ,
আর বেঁচে থাকলেও একটা হাড় ও আস্ত থাকবে না।
প্রণয় শেষ বারের মতো শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো—
“আপনার মেয়ে কোথায়? বলবেন, না কি…..”
সাথেসাথে আর্তনাদ করে উঠলেন খালিদ শিখদার।
চোখ-মুখ খিঁচে বললেন,
“বলবো! বলবো! সব বলবো!
দয়া করে আমাকে মারিস না বাপ, আমাকে বাঁচা…”
প্রণয় সেসব শুনলো না।
অধৈর্য কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো—
“কোথায়?”
খালিদ শিখদার একটা ঢোক গিলে,
জীবনের মায়ায় গরগর করে সব বলে দিলেন।
—”এবার আমাকে তুল, বাপ…”
প্রণয় এক টানে উনাকে বারান্দায় তুলে দিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেল।
উপরে উঠে, বুকে হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন খালিদ শিখদার, যেন নবজীবন লাভ করলেন।
আগে যদি বুঝতে ছেলেটা এত ভয়ঙ্কর হয়ে যাবে, তবে কখনই মেয়ের তালে তাল মিলাতেন না।
তিনি জীবনে প্রথম বারের মতো অনুভব করলেন—
নিজের জীবনের থেকে বেশি প্রিয় আর কেউ নয়।
লোকালয় থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে, চারদিক ঘন সবুজ অরণ্যে ঢাকা,বড় বড় গাছ আর ঝুপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা জায়গাটায় আসলে দিনের বেলায়ও গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাবে।
লুকচক্ষুর আড়ালে ছায়াবন, ঝোপঝাড় আর গা ছমছমে নিস্তব্ধতার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট, পুরনো, পরিত্যক্ত বাড়ি।
বাড়ির বাইরের শ্যাওলা পড়া নোংরা দেওয়ালের আশেপাশে অযত্নে গজিয়ে উঠেছে মাথা উঁচু উঁচু ঘাস আর বনলতা পাতা। অতিরিক্ত পরিত্যক্ত হওয়ায় দেওয়ালের রঙটাও চটে গেছে বহু আগে।
বাড়িটা পরিত্যক্ত হলেও জানলাগুলো বেশ আধুনিক — ম্যাট ব্ল্যাক গ্লাস দিয়ে তৈরি জানালাগুলো অতিরিক্ত কালো বিধায় ভেতরের কিছুই দেখা যায় না।
এমন এক ভুতুড়ে পরিবেশে — যে কেউ থাকতে পারে, তা মানুষের কল্পনারও অতীত।
তবে, পরিবেশটা এমনভাবে ঝোপঝাড় আর আগাছা দিয়ে ঘেরা, যেন কেউ ইচ্ছে করে জায়গাটাকে লুকোচক্ষুর আড়ালে রেখেছে।
তবে আজকের পরিবেশ অন্যরকম। সামনের সেই ভুতুড়ে, পরিত্যক্ত, জরাজীর্ণ ঘর থেকে ভেসে আসছে তীব্র চেঁচামেচির আওয়াজ।
ঘরের ভেতরের ঝাপসা আলোয় মেঝেতে পড়ে আছে প্রহেলিকা। তার তুলতুলে ফরসা গালে পাঁচ আঙুলের দাগ জলজল করছে।
সে টলটলে, ঝাপসা চোখে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে সামনের ক্রোধান্বিত পুরুষটার পানে।
এই পুরুষটার পেশিবহুল হাতে সে মাত্র কিছুক্ষণ আগেই একটা বিশাল দাবাং মার্কা চড় খেয়েছে — ভীষণ লেগেছে গালে, তবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই প্রহেলিকার।
এই স্পর্শে সে আঘাত পেলেও ভীষণ খুশি।
বেহায়া তার মন ভালোবাসা না, ধিক! মারের উছিলায় ছুঁয়ে তো দিয়েছে, এ-ই অনেক।
প্রহেলিকার নিশ্চুপতায় রক্তে আগুন ধরে যাচ্ছে প্রণয়ের। সে বন্দুকের ঠান্ডা নলটা প্রহেলিকার মাথায় ঠেকিয়ে হিমেল কণ্ঠে বলল —
“তোকে শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি, আমার জান কোথায়? বল। না হলে, এই ঘরে যদি লাশ হয়ে পড়ে থাকিস, আজীবনে ও তোকে কেউ খুঁজে পাবে না।”
প্রণয়ের কণ্ঠে বলা সূচালো বাক্যগুলো প্রহেলিকার কান অবধি পৌঁছাল না।
সে ঠোঁট চেপে তাকিয়ে নিজের চার বছরের তৃষ্ণা নিবারণ করতে ব্যস্ত সেই পুরুষটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ উপচে পড়ছে অনর্গল নোনজলের স্রোত।
প্রহেলিকার এমন নিঃশব্দ কান্নায় রাগ ধরে গেল প্রণয়ের।
সে বন্দুকটা শক্ত করে চেপে ধরল প্রহেলিকার মাথায়, চাপা রাগ দেখিয়ে বলল —
“তো’র ড্রামা দেখার সময় নেই আমার কাছে। চুপচাপ বল, আমার জানকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস? বিশ্বাস কর, আমার বুকটা খুব ব্যথা করছে।”
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে কণ্ঠ কেঁপে উঠল প্রণয়ের।
সে বন্দুকের নলটা এবার নিজের বুকের বা পাশে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করল। দম আটকে বলল —
“তাকিয়ে দেখ, এত পুড়ছে এই জায়গাটা — যা তুই দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারবি না। প্লিজ বল আমায়, কোথায় রেখেছিস? তোকে মারলে তো আমি মেরে ফেলতেই পারি, কিন্তু তোকে মেরে ফেললেই তো আর আমি আমার জানকে ফেরত পাব না।”
প্রণয় করা আঘাতে, অপমানে প্রহেলিকার এতটা কষ্ট লাগে নি, যতটা লাগেছে এখন প্রণয়ের এই বাক্যের শেষ লাইনে।
অন্য কারো প্রতি এতটা ভালোবাসা না দেখিয়ে আরও ২–৪টা মেরে দিত। ওটা প্রহেলিকার জন্য বোধহয় বেশি সুখের হতো।
কিন্তু সব মেনে নিয়েও প্রণয়ের যন্ত্রণাটা আজকাল আর কেন জানি সইতে পারে না প্রহেলিকা। হয়তো না-পাওয়ার আগুনে পুড়তে পুড়তে ভালোবাসা আরও গাঢ় হয়ে গেছে।
তাই সে প্রণয়ের দিক থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। অস্ফুটে বলল —
“আমি জানি না প্রিয় কোথায়। আমি ওকে কিডন্যাপ করাইনি। আমি ওকে ঘৃণা করি, ঠিকই, মেরে ও ফেলতে চাই, কিন্তু এবার আমি কিছুই করিনি।”
প্রহেলিকার কণ্ঠ কাঁপছিল। তবে তাতে মিথ্যার আভাস পায়নি প্রণয়।
এবার আরও বেশি দুশ্চিন্তায় প্রণয়ের চেহারাটা পাংশুটে হয়ে গেল।
ভয়ে পায়ের রক্ত লাফিয়ে মাথায় উঠে গেল। এতক্ষণ কোথাও না কোথাও তার মনে একটা আশা ছিল যে, এই কাজটা হয়তো প্রহেলিকার।
প্রহেলিকার কাছেই সে তার জানকে পাবে। তবে এতটা সময় পেরিয়ে গেছে — প্রহেলিকা যদি তার জানকে কিডন্যাপ না করে, তবে করেছে কে?
প্রণয়ের এই অবস্থা দেখে ভীষণ মায়া লাগলো প্রহেলিকার।
সে নিচু কণ্ঠে বলল —
“আমার মনে হয় প্রিয়তা কানাডাতেই আছে, তোমার ওখানেই দেখা উচিত।”
প্রহেলিকার কথায় কয়েক সেকেন্ড প্রহেলিকার দিকে তাকালো প্রণয়।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করতেই চট করে মাথার ভেতর কিছু একটা খেলে গেল।
সঙ্গে সঙ্গেই ঝট করে চোখ খুলে ফেললো প্রণয়। দ্রুত ছুটে বেরিয়ে গেল সেই পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে।
অশ্রু চোখে সেই যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো প্রহেলিকা।
কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দ থেকে, হু হু করে বুকভাঙা কান্নায় লুটিয়ে পড়লো, সশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে বলল —
“হে আল্লাহ, হয় আমাকে ভালোবাস দাও, না হয় মৃত্যু দাও।
মাঝখানে ঝুলিয়ে রেখে এমন নিষ্ঠুরতম শাস্তি আর দিও না।
এই কষ্ট আমার আর সহ্য হয় না মাবুদ, আর সহ্য হয় না।”
প্রণয় হন্তদন্ত পায়ে এসে গাড়ির সীটে বসে পড়ে, যেন নিঃশ্বাস ছাড়লেই প্রাণটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসবে।
সে শ্বাস আটকে দ্রুত নিজের পার্সোনাল ল্যাপটপ ওপেন করে।
হাতটা উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে, চোখে একরাশ আতঙ্ক আর অজানা অনিশ্চয়তা।
সে দ্রুত হাতে ট্র্যাকার অ্যাপ ওপেন করে, ট্র্যাকারের শেষ রেকর্ডেড ফুটেজটা চালু করল…
ডার্ক স্ক্রিনে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে — কাল সন্ধ্যা।
“Tracking device sync – active.”
“Last synced location – 6:41 PM – Lakeview Point.”
প্রিয়তা হাঁটছে আনমনে, নিঃশব্দে,
হাওয়ায় তালে উড়ে বেড়াচ্ছে তার হাঁটু ছাড়ানো লম্বা চুল গুলো,
ক্লান্ত চেহারায় একরাশ বিষণ্ণতার চাপ, যেন সব থেকেও সে সর্বহারা।
তার গভীর নীলচে চোখ দুটো যেন সীমাহীন মায়ার সাগর।
হঠাৎ আসা ধমকা বাতাসের তোড়ে থেকে থেকে উড়ে যাচ্ছে তার সাদা ওড়নাটা।
সে একাকিত্বে ডুবে পথ চলছে একা একা।
হঠাৎই……
তিনজন কালো হুডি পরা, বিশাল দেহি লোক এগিয়ে আসে পেছন দিক থেকে — তা খেয়াল করে না প্রিয়তা।
এলোমেলো কদম সামনে ফেলতেই কেউ একজন আচমকাই নাকেমুখে ক্লোরোফর্ম মাখানো ভেজা রুমাল চেপে ধরে।
চমকে উঠে প্রিয়তা!
পেছন ফিরে তাকানোর পূর্বেই, অন্য একজন শক্ত হাতে তার দুই হাত চেপে ধরে।
প্রিয়তা ধস্তাধস্তি করে নিজেকে বাঁচানোর সময় টুকু ও পায় না।
তার আগেই চোখের সামনে সকল দৃশ্যই কেমন ঘোলাটে হয়ে আসে।
নাক দিয়ে “উহু উহু” করতে করতে নিশ্বাস ফুরিয়ে আসে প্রিয়তার,
দুই-এক সেকেন্ডের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে পিচঢালা রাস্তায়।
নীলরঙা চোখ দুটো নিস্তেজ হয়ে আসে ধীরে ধীরে।
ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে অস্পষ্টে ডাকে —
“প্রণয় ভাই…”
লোকগুলোর একজন এসে খুব সাবধানে প্রিয়তার নিথর শরীরটাকে কোলে তুলে নেয়।
আর এক ফাঁকে, হাতের অনামিকা থেকে খুলে পড়ে রিংটা।
তাদের মধ্যে একজন চট করে আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে নেয়।
ঘাড় ঘোরাতেই তার হুডি সামান্য সরে যায় —
আর প্রণয় সেই ক্যামেরা ফুটেজেই আংশিকভাবে দেখে পায় লোকটার গলায় ট্যাটু করা একটা লোগো —
“EVA–314,”
লেখাটার উপর নজর পড়তেই চোখ আটকে যায় প্রণয়ের।
ভিডিওটা পজ করে, জুম করে লেখাটা ভালোভাবে দেখতেই তার কেমন অদ্ভুত লাগে।
মনে হয়, সে এই লোগোটা আগে কোথাও একটা দেখেছে।
কিন্তু কোথায়?
প্রণয় কপাল চেপে ধরে, ব্রেনে চাপ দেয়, অনেক চেষ্টা করে মনে করার, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ে না।
সে এবার ভ্রু কুঁচকে হালকা একটা ট্রিক্সস অ্যাপ্লাই করে —
তার যেহেতু নামটা চেনা চেনা লাগছে, তার মানে এই লোগোটা বিশেষ কিছুর ইঙ্গিত করছে।
কিন্তু সেটা যে সে নরমাল গুগল সার্চে পাবে না, এই বিষয়ে সে শতভাগ নিশ্চিত।
তাই—
ঝটপট ভিপিএন কানেক্ট করে অ্যানিয়ন ব্রাউজার ওপেন করলো।
এক ক্লিকে ঢুকে পড়ল ইন্টারনেটের সেই অন্ধকার জগতে, যে জগতের অ্যাক্সেস সাধারণ মানুষ সহজে পায় না।
প্রণয় ডার্ক ওয়েব ওপেন করেতেই প্রচন্ড ডিস্টার্বিং কিছু সিন স্ক্রিনে ভেসে উঠলো, তবে সে সেগুলো সম্পূর্ণ ইগনোর করে সার্চ বারে লেখলো —
“EVA–314,”
অ্যারো চিহ্নতে চাপতেই এমন কিছু ইনফরমেশন উঠে আসলো, যা দেখে প্রণয়ের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল,
শরীরের জোড়ায় জোড়ায় কাঁপন ধরল মুহূর্তেই।
হার্টবিট বেড়ে যায় কয়েকশো গুণ।
সেকেন্ডের মধ্যে ঘামে ভিজে উঠে পুরো শরীর।
ইভা! ওরাই!
ওই সাইন্টিস্ট গ্রুপ, যারা রিসার্চ করছে গত ১৫ বছর!
ওরাই ওদের এক্সপেরিমেন্টেট ফাইনাল টেস্ট নিতে আমার জানকে ব্যবহার করতে চায়…
প্রণয়ের হাত কাঁপতে থাকে, দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসে।
ল্যাপটপের স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে যায়।
আর বাদামি চোখ জোড়াতে জেগে ওঠে ভয়ংকর হিংস্রতা।
হাত দুটো আপনাআপনি মুষ্টিমদ্ধ হয়ে আসে।
সে সাইকোদের মতো ঘাড় বাঁকায়, মট করে শব্দ করে ওঠে ঘাড়ের হাড়টা।
জ্বলন্ত কণ্ঠে বলে —
“আমি আসছি জান পাখি… আমি তোকে প্রমিস করছি,
তোর প্রণয় ভাই তোকে প্রমিস করছে — ওরা তোকে যতটা কষ্ট দিয়েছে,
তোর প্রণয় ভাই তার এক গুণা ১০০ গুণ ফিরিয়ে দেবে ওদের …
এমন মৃত্যু দেবে, যার কথা ভাবলে মরণের পরও ওদের রুহু কেঁপে উঠবে।”
“ঐ কুত্তার বাচ্চাদের কলিজা ছিঁড়ে যদি রক্ত খেতে পারি,
তবে আমার নামও আবরার শিকদার প্রণয় নয়!”
প্রণয় রাগে গজগজ করতে করতে চোখের পাতা এক করল।
সাথেসাথেই নরম হয়ে এল বুকটা।
নিঃশব্দে কেঁপে উঠলো গলার অ্যাডামস অ্যাপল।
সে নরম কণ্ঠে বলল —
“আমি আসছি আমার ময়না পাখি, একটু ধৈর্য ধর… সোনা…
আমি থাকতে তোকে কিছুই হতে দেব না।”
প্রণয় চোখ খুলে ফোন বের করে, কল লাগায় জাভেদের নাম্বারে।
ফোনটা এক রিং বাজতেই সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে জাভেদ।
নিচু কণ্ঠে বলে —
“জি স্যার।”
প্রণয় কঠোর কণ্ঠে আদেশ ছুঁড়ে দিয়ে বলে —
“Just ৩০ minutes. Just ৩০ minute এর মধ্যে কানাডার টরোন্টো সিটির লেক অন্টারিওর সকল রাস্তা ঘাটের CCTV ফুটেজ চাই। Now. Hurry up!”
বলে ফোন কেটে দিল প্রণয়।
চোখে জ্বলছে তার ধ্বংসের আগুন।
অতিবাহিত হয়েছে আরও ১০ ঘণ্টা।
প্রিয়তা নিখোঁজ হয়েছে প্রায় ২৪ ঘণ্টা হতে চললো।
এখনো কোনো খুঁজ খবর মেলেনি তার।
মেয়েটা যেন কর্পূরের মতো ভ্যানিশ হয়ে গেছে।
প্রিয়তার চিন্তায় পাগলপ্রায় অবস্থা মিসেস মেহজাবিন চৌধুরী, সাজিদ শিখদার ও প্রিথমের।
তারা কানাডায় এসে দ্রুত পুলিশ কমপ্লেইন করিয়েছিল, রিপোর্ট লিখিয়েছিল।
তবে পুলিশ এখনো কোনো আশানুরূপ ফলাফল দিতে পারেনি।
কানাডার উত্তর পশ্চিম সীমান্তে, Yukon Territory পেরিয়ে আরও একশো কিলোমিটার বরফের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে বিস্মৃত এক রহস্যময় জনপদ—Vortex Falls।
মানব সভ্যতার আড়ালে এই হিমবাহ উপত্যকা যতটা না বেশি সুন্দর, তার থেকে বেশি রহস্যমড়কে আচ্ছাদিত, কারণ আশ্চর্যজনকভাবে এই জায়গাটার অস্তিত্ব পৃথিবীর মানচিত্রে নেই। গুগল জিপিএস ট্র্যাকারে ও এই জায়গাটাকে ট্র্যাক করা যায় না, আর না যায় এই জায়গাটার লোকেশন দেখা। এমনকি কানাডিয়ান সরকার নিজেই ২০০৯ সালে এই জায়গাটাকে “Dead Arctic Zone” হিসেবে ঘোষণা করে জায়গাটার ধ্বংস দেখিয়েছিল।
দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেছিল এই জায়গাটার নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা।
কিন্তু বাস্তবে কি সত্যিই তাই ঘটেছিল, তা আজও কুয়াশা-আবৃত রহস্য।
চারদিকে যতদূর চোখ যায়, শুধু হিম ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ, উপত্যকা, ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের ফাটলে শতবার্ষিকী পুরনো পাইন গাছ।
সেই শতবার্ষিকী পুরনো পাইন গাছ থেকে কয়েক মিটার দূরত্বে এসে নামে হেলিকপ্টার RZ-8 Nightblade।
তার ব্ল্যাক স্লাইডিং ডোর ঠেলে, ব্ল্যাকড আউট শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বেরিয়ে আসে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাস CΛN গ্রুপের লিডার, মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল ASR। তার পদ ধ্বনিতে কেঁপে উঠে আশপাশ।
তার ধারালো, তীক্ষ্ণ চোখের বিদ্বংসী দৃষ্টিতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে বড় বড় দেশের নেতা-মন্ত্রীদের।
Blacked-Out Shirt-এর সাথে Jet Black Straight Pant-এ তার পুরুষত্ব যেন ফেটে পড়ছে।
তার পেছন পেছন হেলিকপ্টার থেকে বের হয় বর্তমান বিশ্বের টপ ৫ কার্ডিও সার্জনের একজন Dr. Aboddho Chowdhury Shuddho।
তারা দুজন নেমে পাশাপাশি দাঁড়ায় তবে তাদের দু’জনকে পাশাপাশি খুবই বেমানান লাগছে— তাদের একজন নৃশংসতার সীমানা ছাড়িয়ে যায়, মৃত্যু দেয় চরম নিষ্ঠুরতায়, তো অন্যজন সহিষ্ণুতার সীমানা ছাড়িয়ে যায়, নিজের সবটা উজাড় করে ফিরিয়ে দেয় মহামূল্যবান জীবন। যেন সৃষ্টি আর ধ্বংস পাশাপাশি।
দুজন কয়েক পা এগিয়ে সতর্ক চোখে আসে পাশে, দৃষ্টি পাত করে।
দক্ষিণ পর্বতশৃঙ্গের বাঁদিকে একটা সুবিশাল মৃত হ্রদ—Dried Mirror Lake, তার শেষ প্রান্তে একটা বড় সাদা পাথুরে গুহা।
যেটা আপাদমস্ত খুবই সাধারণ, সেখানে সন্দেহজনক কিছু নেই, বিধায় শুদ্ধ অন্য দিকে যেতে নিলে—
ASR নিরেট কণ্ঠে বলে—
দাঁড়া।
পা স্থির হয়ে যায় শুদ্ধর।
পেছন ফিরে তাকায়, ASR এর দৃষ্টি অনুসরণ করে বলে—
ওদিকে কী দেখছিস? ওখানে কিছুই নেই।
শুদ্ধর কথায়, ASR এর অধরে তীক্ষ্ণ বক্র হাসি খেলে যায়।
সেই পাথুরে গুহার দিকে তাকিয়ে বলে—
যা আছে, তা ওখানেই আছে।
শুদ্ধ পুনরায় এগিয়ে আসে ASR-এর কাছে।
সেই সাদা পাথরের দিকে তাকিয়ে বলে—
বুঝলাম, ওখানে কিছু আছে।
কিন্তু তুই এখনও আমাকে বলিসনি আমার sweetheart-কে কারা কিডন্যাপ করেছে। আর কেন? কেন করেছে?
ASR ওর দিকে তাকায়, তার চেহারা শান্ত, তবে চোখ দুটো যেন আগুনের ফুলকির মতো জলন্ত।
তাদের কথার মধ্যেই সেখানে এসে নামে আরও একটা হেলিকপ্টার।
সেটা থেকে বেরিয়ে আসে জভেদ সহ সুদীর্ঘ দেহী, কালো পোশাক পরিহিত ১০ জন প্রশিক্ষিত GIRD।
তাদের হাতে “NecroViper X-77” রাইফেল।
তারা ASR-এর সামনে এসে মাথা ঝুকিয়ে শ্রদ্ধাশীল কণ্ঠে বলে—
Give the order, boss.
ASR একবার তাদের দিকে তাকিয়ে শুদ্ধর উদ্দেশ্যে বলে—
ওকে তুলে নিয়ে গেছে Neuro-Void Research Facility-র সায়েন্টিস্টরা।
“Scientist” কথাটা শুনে চরম আশ্চর্য হয় শুদ্ধ।
বিস্ময় নিয়ে বলে—
কেন?
“Scientist” গুলোর কথা মনে করতেই ASR এর ঘাড় রগ ভেসে উঠে।
জ্বলন্ত কণ্ঠে চিবিয়ে বলে—
“Oblivion Core Unit” এর সায়েন্টিস্টরা ১৫ বছর ধরে একটা মেডিসিন,, যার নাম “Thanatonic Pulse”, আবিষ্কারের চেষ্টা করছে, যার দ্বারা তারা মানুষের মস্তিষ্কের উপর নিজেদের কন্ট্রোল রাখতে পারবে।
প্রয়োজনে তারা মানুষের বুদ্ধিমত্তা, IQ, ইন্টেলিজেন্স সব বের করে নিতে পারবে।
ASR এর কথার ধরণে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে শুদ্ধর।
ASR আবার বলে—
ওরা এই মেডিসিন আবিষ্কার করে ও ফেলেছে।
ওদের সব এক্সপেরিমেন্ট ও ডান, জাস্ট ফাইনাল টেস্টের জন্য ওরা আমার জান কে তুলে নিয়ে গেছে।
আর এই কাজে ওদের আড়াল থেকে সংগ দিচ্ছে বিশ্বের প্রভাবশালী পাঁচটা দেশ।
তুই যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস, সেটা সাধারণ মানুষের জগৎ নয়। সেখানে কোনো সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারে না।
কারণ এই প্রজেক্ট শুরুর আগেই এই জায়গাটাকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এবার বুঝ, কতো বড় চক্র!
ASR এর কথায় মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো শুদ্ধর।
ভালোবাসার মানুষটা চরম বিপদে আছে, বুঝতে পেরে শুদ্ধর কলিজা ছিড়ে যাওয়ার মত অনুভূতি হল।
মন-মস্তিষ্ক একত্রে পাগল হয়ে উঠলো প্রিয়তা-কে দেখার জন্য।
সে ASR-এর দিকে না তাকিয়ে, সেই দিকে দৌড়ে যেতে নিলে পুনরায় সেই হিমেল কণ্ঠ ভেসে আসে—
দাঁড়া।
এবারও থেমে গেল শুদ্ধ।
ASR ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তার কাছে কাছে, শান্ত কণ্ঠে বললো—
তুই ওখানে যাবি না।
তুই ফিরে যা।
আমি ওকে নিয়ে আসবো।
ASR এর কথায় আশ্চর্য হয়ে গেল শুদ্ধ—তার প্রাণটা এত বিপদে, আর সে চলে যাবে!
কখনোই না!
শুদ্ধ চাপা ক্ষোভ নিয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে জানালো—
তোর যেতে ইচ্ছে না হলে যাবি না, আমি একাই যাবো।
আমি একাই আমার sweetheart-কে নিয়ে আসবো ওই মৃত্যুপুরী থেকে।
ASR শান্ত নজরে পর্যবেক্ষণ করলো শুদ্ধর দৃষ্টির ব্যাকুলতা, মনের অস্থিরতা।
সে পুনরায় বললো—
তুই যাবি না, কারণ ওই চক্রে একবার পা দিলে তোকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।
মাছ যেভাবে জালে আটকা পড়ে, ওভাবে আটকা পড়বি।
শুদ্ধ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো।
ASR পুনরায় বললো—
ওখানে ঢুকে ঝামেলা করলে, ওই বেআইনি মেডিসিন আবিষ্কারের অপবাদ তোর মাথায় পড়বে।
খুব সূক্ষ্মভাবে, পুরো পৃথিবীর সামনে তোকে ভিলেন হিসেবে প্রেজেন্ট করা হবে।
দেখাবে, বিশ্বের সেরা একজন হার্ট বিশেষজ্ঞ, কিভাবে নিজের সার্টিফিকেটের আড়ালে বেআইনি মেডিসিন আবিষ্কার করে।
তোর এত বছরের পরিশ্রম অর্জন সব চোখের নিমেষে ধুলোয় মিশে যাবে।
নায়ক থেকে খলনায়কের ভূমিকায় প্রমোশন পেতে সময় লাগবে না।
ASR এর কথায় আশ্চর্য হয় শুদ্ধ—
ফেঁসে যাবে? অর্জন হারিয়ে ফেলবে?
এসবের মতো তুচ্ছ কারণের জন্য সে তার ভালোবাসাকে ফেলে গা বাঁচিয়ে পালাবে?
শুদ্ধ এবার ASR এর উপর চরম রেগে যায়, চেঁচিয়ে উঠে বলে—
“Fu*ck off my achievement.”
আমার sweetheart-এর আগে কিছু নয়।
ওর জন্য যা যা করতে হয়, আমি তাই তাই করবো।
মরে গেলে যাবো তবু ও আমি যাবই।
বলে যেতে উদ্যত হয় শুদ্ধ।
ASR আগেই আঁচ করতে পেরেছিল।
এমনটাই হবে তাই এর ব্যবস্থা সে আগে থেকেই করে রেখেছে।
শুদ্ধ এগোতে নিলেই সে GIRD দের চোখের ইশারায় কিছু বোঝায়।
সাথে সাথেই আগত ১০ জন শক্ত সামর্থ্য GIRD এসে শুদ্ধকে আস্তে পৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরে।
হঠাৎ এমন কাণ্ডে হতবম্ব হয়ে যায় শুদ্ধ।
ধস্তাধস্তি করতে করতে হুঙ্কার দিয়ে বলে—
এদেরকে দিয়ে আমায় ধরিয়েছিস কেন? ছেড়ে দিতে বলো!
ASR পাত্তা দেয় না শুদ্ধর কথায়।
GIRD দের আদেশ দেয়—
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৮
“Sir কে নিয়ে টরন্টোতে ব্যাক করো।
আর যতক্ষণ না পর্যন্ত এখনকার সলিড কোন নিউজ পাও, ততক্ষণ ছাড়বে না।”
বলে দুই হাতে দুটো মেশিনগান তুলে নেয় ASR।
চোখ মুখ শক্ত করে এগিয়ে যায় সেই পাথুরে গুহার দিকে।
এই প্রথমবারের মতো জাভেদের প্রচণ্ড ভয় হয় তার স্যার-এর জন্য।
তবুও মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করে—
পাপী হলেও যেন এই মানুষটা আরো কিছুদিন বেঁচে থাকে।