অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭০
নুসাইবা ইভানা
বিকাল চারটা বাজে তালুকদার বাড়ির অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে, এখন ইনায়া আর অরণ্য বিদায় নিয়ে চলে আসবে। বৃদ্ধ আশ্রমের মহিলারা অনেক অনুরোধ করেছে, তাদের অল্প কয়েকদিন থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অরণ্যর অফিস রয়েছে এখানে বেশিদিন থাকা সম্ভব নয়, আবার ইনায়ার আদালতের তারিখের সময় প্রায় শেষের দিকে। এইদিকে শাফায়াতের মৃত্যু আর এসএস কোম্পানির খাবারে বিষ কে দিয়ে তা জানা যায় নাই। রূপনগর গ্রামে যে উদ্দেশ্য এসেছে তা সফল হয় নাই, শাফায়াতের মৃত্যুর রহস্য সমাধান হয় নাই। আড়ালে লুকিয়ে থাকা আগন্তুকের পরিচয় এখনো সামনে আসে নাই, যার জন্য ইনায়া আর অরণ্য এখানে বেশি দিন থাকতে পারবে না।
আদালতের নোটিশের মেয়াদ শেষ হবার আগেই আসল অপরাধীর পরিচয় যানতে হবে, তালুকদার বাড়ির সমস্ত সম্পত্তির উত্তর অধিকারী সূএে মালিক ইনায়া। সম্পত্তির সমস্ত হিসাব ইনায়া পৌরসভায় গিয়ে কালেক্ট করছে, আর তালুকদার বাড়িতে থাকা বৃদ্ধ মহিলাদের জন্য এই বাড়িটায় থাকার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। বৃদ্ধ মহিলারা সকলে ইনায়া আর অরণ্যকে বিদায় দেয়, তারা রূপনগর গ্রাম থেকে চলে আসে। শহরে যাওয়া উদ্দেশ্য গাড়ি রওনা দেয়, এখন রাস্তায় ট্রেনের মধ্যে অবস্থান করছে ইনায়া আর অরণ্য।
অন্যদিকে ইভান চৌধুরী বাড়িতে ফিরে এসেছে, প্রভা আর ইভান একসাথে এসেছে। প্রভা যথেষ্ট শান্ত মেয়ে, তবে ইভান তার চেয়েও বেশি শান্ত। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা ইভানের পছন্দ নয়, প্রভা যথেষ্ট কর্মঠ আর পরিশ্রম মেয়ে। বিজনেসের বিষয়ে তার বেশ ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে, বিদেশ থেকে বিজনেসর উপর সট্রাডি করে এসেছে।
[ রাত ৯: ০০]
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অরণ্যর গাড়ি এসে থামে তার বাড়ির সামনে, ট্রেন থেকে নেমে গাড়িতে উঠে বসে ইনাযা আর অরণ্য। রূপনগর গ্রাম থেকে শহরের রাস্তা অনেক, যার জন্য রাত নয়টা বেজে গেছে। ইনায়া গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে, সারাদিন রান্না করা,সহ গ্রামের এতো মানুষকে খাওয়ানো আর অধিক সময় গাড়িতে বসে থাকার কারণ তার শরীর অনেক টার্য়াড হয়ে গেছে। যার জন্য সে গাড়িতে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে, অরণ্য গাড়িতে বসে সারা রাস্তা ইনায়ার ঘুমন্ত মুখ দেখে কাটিয়ে দিয়েছে। তার মায়াবতী বউয়ের প্রতি তার মুগ্ধতা যেনো হাজার জন্ম চলে গেলে ও কমবে না। বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ায়, অরণ্য দেখে ইনায়া এখনো ঘুমিয়ে রয়েছে। অরণ্যর ইচ্ছা করে না ইনায়াকে ডাক দিতে, কিন্তু বাড়ির ভিতরে যেতে হবে যার জন্য অরণ্য শান্ত স্বরে ডাক দেয় –
“- ইনায়া ইনায়া “।
অরণ্যর ডাক শুনে ইনায়ার ঘুম অল্প ভেঙে যায়, তবে সে চোখ খুলে তাকায় না। শুধু একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে, অরণ্য বুঝতে পারে তার বউ গভীর ঘুমিয়ে তলিয়ে গেছে। অরণ্য মুচকি হাসি দেয় এরপর আলতো করে ইনায়াকে কোলে তুলে নেয়। ইনায়া অরণ্যর বুকে গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে, অরণ্য ঘুমন্ত ইনায়াকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যায় নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় ইনায়াকে শুয়িয়ে দেয়, এরপর সে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে যায়। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে সে রুমের বাহিরে চলে যায়, ইনায়া বিছানায় ঘুমিয়ে রয়েছে।
চৌধুরী বাড়িতে সকলে রাতের খাওয়া দাওয়ার জন্য রেডি হয়, কিন্তু ইভান আর প্রভা তাদের রুমে বসে আছে। প্রভা অফিসের একটা ফাইল চেক করছে, কাল নতুন ব্যন্ডর সাথে সাথে চুক্তি হবে চৌধুরী কোম্পানির। তবে ফাইলের কিছু বিষয় প্রভা বুঝতে পারছে না, যার জন্য সে ইভানের থেকে সাহায্য নেওয়ার চিন্তা করে। ইভান নিজের রুমে বসে অফিসের কাজ করছে, বর্তমানে তার সারাদিন শুধু অফিস আর ফাইল নিয়ে কেটে যায়। পৃথিবীর সমস্ত সুখ, আনন্দ, বেদনা তার কাছে এখন তুচ্ছ মরীচিকা ন্যায়। এই মিথ্যা মায়ার বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে যে কষ্ট তার হচ্ছে, হয়তো তার থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নাই।
বর্তমানে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় বক্ত্যি মনে হয় ইভান, যে নিজের দোষে নিজের মায়ের ভালোবাসা হারিয়েছে, জেদ বা ইগোর কারণে তার ভালোবাসাকে অন্য একজনের হাতে তুলে দিয়েছে। আর এখন শুধু অফিসের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে, তার বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত ব্যাথার আগমন ঘটেছে যা প্রতি মুহূর্তে তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। শুধু বাহিরের রাগী আর নিরবতা সবাই দেখে, ভিতরে থাকা কান্না আর অসহায়ত্ব শুধু সেই যানে। শুধু তার মনের ভিতরে যানে ইনায়াকে সে কতটা ভালোবাসে, তার জীবনের সব সুখ, টাকা, আর ভালোবাসার বিনিময়ে তার ইনায়াকে চাই। কিন্তু তা আর সম্ভব না ইনায়া এখন অন্য কারো বিবাহিত স্ত্রী, অন্য একজনের হাত তার শরীর ছুঁয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ করে ইভানের রুমের দরজায় একজন নক করে, ইভান তার ভাবনার জগৎ থেকে বাহির হয়ে আসে। দরজার সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রভা দাঁড়িয়ে রয়েছে, ইভান শান্ত স্বরে বলে –
“- কি হয়েছে প্রভা? তুমি এখানে কেনো?
ইভান গম্ভীর গলায় কথাটা বলে কিন্তু প্রভার কাছে ইভানের গলার স্বর অন্যরকম লাগে। যেনো মনে হলো ইভান কান্না করেছে, আগের দিনের মতো ঠিক ততটা নীরবতা আর গম্ভীরতা আজ ইভানের কণ্ঠ স্বরে নাই। শুধু যেনো সকলের সামনে তার বাহিরের নকল রূপ দেখানোর প্রয়াস করছে, কিন্তু প্রভা ইভানের বিষয়ে এতো কেনো চিন্তা করছে। ইভান শুধু তার বস এর চেয়ে বেশি না, আর কখনো হবে ও না। প্রভাকে কথার উত্তর না দিতে দেখে ইভান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখে। প্রভা বলে –
“- কাল অফিসের মিটিং জন্য একটা ফাইল চেক করছি, কিন্তু কয়েকটা জায়গায় বুঝতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। যার জন্য আপনার সাহায্য দরকার ইভান “।
প্রভার কথা শুনে ইভান বিরক্ত হয়, যদিও প্রভা ইভানের সাথে খুব বেশি কথা বলে না। জরুরি কোনো কাজ বা কারণ ছাড়া প্রভা কথা বলা পছন্দ করে না, আর ইভান ও তাই। তবে প্রভাকে দেখে ইভান বিরক্ত হয় কারণ প্রভার চেহারা দেখলে তার ইনায়ার কথা মনে পড়ে। প্রভা চোখে মুখে যে ভয় শান্তি নীরবতা সব ইনায়ার মধ্যে ছিলো, যার জন্য হয়তো ইভান প্রভার থেকে দূরে থাকতে চাই। ইভান প্রভার দিকে তাকিয়ে বলে –
,, _ হুম দেখা ও কি সমস্যা হয়েছে?
ইভানের অনুমতি পেয়ে প্রভা রুমের ভিতরে চলে আসে, এরপর তার হাতে থাকা ফাইল ইভানকে দেখায়। একসাথে অনেক সময় কাজ করতে থাকে, ইভান প্রভার সমস্যা সমাধান করে দেয়। ইভান ফাইলের মধ্যে হাত রেখে প্রভাকে দেখায়, প্রভা ও হাত রাখে যার ফলে দুইজনের হাত একসাথে হয়। প্রভা আর ইভান একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, প্রভা মাথা নিচুঁ করে ফেলে। হঠাৎ করে দরজায় কারো গলার আওয়াজ শুনে প্রভা আর ইভান দূরে সরে যায়। অরুণা বেগম তাদের ডাকতে এসেছে। রাত অনেক হয়ে গেছে যার জন্য অরুণা বেগম ইভানকে খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে তার রুমে এসেছে।
অরুণা বেগম ইভান আর প্রভাকে দেখে ফেলে তারা সরে যাওয়ার আগেই, অরুণা বেগম বলে –
“- প্রভা তুমি এখানে? আচ্ছা তোমরা খাবার টেবিলে আসো রাতের ডিনার রেডি করা হয়েছে “।
অরুণা বেগম কথাটা বলে রুম থেকে চলে যায়, ইভান আর প্রভা একে অপরের দিকে তাকায়। এরপর ইভান বলে –
“- আচ্ছা আমাদের কালকের মিটিং কোন ব্যন্ডের সাথে হবে?
প্রভা নীরবতা ভেঙে জবাব দেয় –
“- ইজি শপ যা শহরের সবচেয়ে বড়ো ব্যন্ড এর মালিক হলেন ইনায়া চৌধুরী, ওনি অনেক বড়ো বিজনেস ওমেন। খবরের কাগজে দেখে ছিলাম অরণ্য রাজ চৌধুরীর সাথে ওনার বিয়ে হয়েছে। ওনি তো অরুণা আন্টির বন্ধাবীর মেয়ে তাই না?
প্রভা সব কথা ইভান শুনেছে কি না যানা নাই তবে শুধু মাএ ইনায়ার নাম তার কান অবধি পৌঁছে গেছে, ইভান শুকনো ঢুক গিলে বলে –
“- ইনায়ার সাথে ডিল হতে যাচ্ছে “।
“- হুম ওই ব্যন্ডর মালিা ইনায়া চৌধুরী, অরণ্য রাজ চৌধুরীর বউ “।
অরণ্যর বউ কথাটা শুনে তার মনের মধ্যে থাকা কষ্ট আরো দিগুণ হয়ে যায়, ইভান বলে –
“- প্রভা যান নিচে খাবার খেতে যান।
প্রভা উঠে খাবার খেতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়, তবে সে আবার জিজ্ঞেস করে –
“- আপনি খাবার খেতে যাবেন না ইভান “।
“- না আজ আর খিদে নাই আমার “।
ইভান আর কথা বলে না প্রভা রুম থেকে বের হয়ে যায়, ইভান বিছানায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তার হৃদয় থেকে শুরু একটা শব্দ বারবার হাজার বার উচ্চারণ হচ্ছে। কাল তার ইনায়ার সাথে দেখা হবে, প্রায় কতদিন পর ইনায়ার সাথে দেখা করবে সে।
অন্যদিকে রাত দশটার সময় অরণ্য ছাদের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, আকাশ দেখে যাচ্ছে তার মন আজ বড্ড ভালো। ইনায়া যবে থেকে তার জীবনে এসেছে কেমন যেনো সুখ ফিরে পেয়েছে জীবনে, হারানো সকল সুঃখের শূন্য স্থান পূরণ হয়ে গিয়েছে ইনায়ার আগমনে। অরণ্যর ভাবনার মাঝে হঠাৎ করে তার পিছন থেকে কেউ একজন ডাক দেয়, অরণ্য কণ্ঠটা শুনে চমকে যায়। এই কণ্ঠ তার বড্ড পরিচিত, অরণ্য পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে তার সামনে রেহানা বেগম দাঁড়িয়ে রয়েছে। অরণ্যর দুই চোখে বিশ্বাস করত পারছে না, তার মা কি তার নামে নিয়ে ডাক দিয়েছে।
রেহানা বেগম তার সামনে থাকা অরণ্যর দিকে দেখে, তারা মা ছেলে আজ কতো বছর পর একে অপরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রেহানা বেগম নিজের ছেলের মুখ একবার ভালো করে দেখে, তার ইচ্ছা করছে তার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। রেহানা বেগম বলে
“- অরণ্য “।
রেহানা বেগমের মুখে অরণ্য ডাকটা শুনে অরণ্যর চোখে পানি জমে যায়, তার মা তাকে নাম ধরে ডেকেছে। অরণ্যর মনে হচ্ছে সে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ, যে মা তার সামনে কখনো আসে নাই সে আজ তার নিজে এসে তাকে ডাকছে। অরণ্য বলে –
“- আম্মু “।
অরণ্যর মুখে আম্মু ডাকটা শুনে রেহানা বেগমের হৃদয় শান্তির প্রণয় বয়ে যায়। অরণ্যর চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কতটা খুশি হয়েছে রেহানা বেগমের মুখে তার নাম শুনে। রেহানা বেগম নিজের মনকে শক্ত করে অরণ্যর করা অন্যায় সে কখনো ভুলে যেতে পারে না। রেহানা বেগম বলে –
‘- অরণ্য তোমার সাথে কথা আছে আমার?
অরণ্য বলে –
“- হুম আম্মু বলো কি কথা আছে? কোনো সমস্যা হয়েছে? কি হয়েছে শুধু একবার বলো?
রেহানা বেগম বলে –
“- তুমি ইনায়াকে কেনো বিয়ে করেছ অরণ্য? শুধু কি ইভান চৌধুরীর থেকে প্রতিশোধ নিতে? না তোমার কেনো পরিকল্পনা রয়েছে?
অরণ্য যানে রেহানা বেগম তাকে খুব ভালো করে চিনে, অরণ্য হাসি মুখে বলে –
অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৬৯
“- যদি বলি ইনায়াকে আমি ভালোবাসি?
“- অসম্ভব “।
“- আর যদি বলি আমার নোংরা খেলার একটা গুটি ইনায়া তখন কি বলবে আম্মু?
“- কথাটা বিশ্বাস যোগ্য “।