মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৮

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৮
নওরিন কবির তিশা

আজ সকাল থেকেই সাজিদদের বাড়ির পরিবেশ অন্যরকম।
লাল, নীল, সোনালি আলোর ঝলকানিতে বাড়ির প্রতিটি কোণ যেন মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আজ সাজিদ আর ইলমার রিসেপশন—অন্তরের আবেগে ভিজে থাকা এক বিশেষ দিন।
আর সেই মুহূর্তটায় সকাল থেকে শিশির যেন এক প্রাণপণ ছায়া হয়ে জড়িয়ে ছিল ইলমার চারপাশে।
সে শুধু কারো ননদ বা বোন নয়—প্রিয় বন্ধু, নির্ভরতা,আর সাথে একজন শিল্পীও।

ইলমার ড্রেসে কোন রঙটা বেশি মানাবে, মেকআপে কতটুকু গ্লো দরকার,—সবকিছুর দেখভাল করছিল সে।
ইলমা তাকে দেখে এক সময় মুগ্ধ হয়ে পড়ল। তারপর হাসিমুখে শিশিরকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল—
— “হয়েছে হয়েছে বনু, আর না। তুমি অনেক কিছু করেছো। এখন একটু রেস্ট করো। শুনেছি গতকাল রাতে তোমার জ্বর এসেছিল। নিশ্চয়ই ভিজে যাওয়ার ফল। শুনলাম নাহিয়ান ভাইয়ার‌ও নাকি জ্বর এসেছে?”
ইলমার কথায় শিশির সামান্য সংকুচিত হলো। স্মৃতির পাতায় বৃষ্টির ধারা হয়ে ধরা দিল গতরাতের সেই মেঘমল্লার সেই রঙিন মুহূর্ত..

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 


কাল রাতে বৃষ্টির মাঝে ভিজতে ভিজতে শিশির অনুভবই করেনি, যে তার সাদা কুর্তি বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার সাথে মিশে তার শরীরের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানির স্নানে যখন সে নিজের দিকে তাকাল, তখন নিজেরই অজানা এক অস্বস্তি তাকে আচ্ছন্ন করলো। শরীরের প্রতিটি রেখা যেন আড়ালে ঢাকা পড়েছে, অথচ কি যেন অজানা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই, যেন এক অনন্য মুহূর্তে, কারো একজনের আঙুলের ছোঁয়া অনুভব করলো শিশির। নাহিয়ান পিছন থেকে তার শার্টটা এনে তার শরীরে জড়িয়ে দিল। একটি অদ্ভুত স্বস্তি অনুভব করল শিশির, যেন স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত শরীরে। নাহিয়ানের গম্ভীর কণ্ঠ শুনে শিশির চুপচাপ থাকলেও তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত আলো—কিছুটা অস্বস্তি, কিছুটা লজ্জা
“তোকে না বলেছিলাম, হিজাব বাঁধতে? হিজাব বাঁধিস নি কেন?”
নাহিয়ানের কথায় শিশির কিছুটা সঙ্কুচিত হয় ঠিকই, কিন্তু কণ্ঠে কোন রকম জড়তা ছাড়াই বলে,

“আমার ইচ্ছে।”
নাহিয়ান হালকা এক হাসি দেয়,তারপর এক অদ্ভুত রহস্যময়
কণ্ঠে সে বলে,,
“ওহ, তোর ইচ্ছা। তো আমারও না ইচ্ছা করছে, তোকে এখানে রেখে যেতে। রেখে যাই?”
শিশির কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল, এই ছেলের পক্ষে সব কিছুই সম্ভব। এখন যদি সে শিশিরকে এখানে রেখে যায়। তাহলে?!” তার কাপড়ও তো খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই, না না এখন কোনমতেই নাহিয়ানের সাথে তর্ক করা যাবে না তাই, সে শান্ত কণ্ঠে বলল,
“সরি, সরি… কাল থেকে বাঁধবো। এখন অন্তত আমাকে নিয়ে চলুন, ঠান্ডা লাগছে আমার।”
নাহিয়ান তার দিকে এক বার বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,

“হ্যাঁ চল, বাইকে ওঠ।”
বাইকে ওঠার পর দেখা দিল আরেক বিপত্তি ।এমনিতেই বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে গিয়েছে শিশিরের। তার উপরে এই বাতাস যেন শিশিরের হাড় অব্দি কাঁপিয়ে তুলছিল। তখনই নাহিয়ান তাকে বলে,,
“ক্লোজ হয়ে বস, ঠান্ডা কম লাগবে।”
শিশির কিছুটা ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলে,
“ল… লাগবেনা।”
নাহিয়ান তার মধ্যে থাকা লজ্জাবতী ব্যক্তিত্বটি অনুভব করে মনে মনে বলল, “ওরে, আমার লজ্জাবতী। সামান্য ক্লোজ হয়ে বসতে বলেছি, তাই লজ্জা পাচ্ছিস। আর কিছুদিন পরে তো…”
এক সামান্য বাঁকা হাসি তার ঠোঁটের কোণে খেলে গেল, যেন ভবিষ্যতের এক অদ্ভুত গোপন কথা বলার আহ্বান ছিল তার হাসিতে।

বিকালের কিছুটা পর, সন্ধ্যার ঠিক আগের সেই মায়াময় সময়টা।
রিসেপশনের ভিড়ে জমজমাট হয়ে উঠেছে শিশিরের মামাবাড়ি। রঙিন বাতির আলোয় একেকটা মুখ যেন আলো ছড়াচ্ছে, আর হালকা বাজনার সুরে পুরো পরিবেশটা হয়ে উঠেছে মনোমুগ্ধকর।
শিশির আনায়াকে নিয়ে এসেছে একটু আগেই। দুজনেই এখন ইলমার দুই বোনের সঙ্গে এক কোণে বসে গল্প করছে। হাসাহাসি আর হালকা ঠাট্টায় ভরপুর সেই আড্ডা।
ঠিক তখনই ওদের কানে ভেসে আসে ইলমার কণ্ঠ—
— “না না ভাইয়া, আজকে একটা গান গাইতেই হবে। আমি শুনেছি আপনি অসাধারণ গান করেন! সাজিদ বলেছে, আপনার গলায় নাকি যাদু আছে।”
রিদিত সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে যায় ইলমার এমন কথায়।। একটু ইতস্তত করে বলে—
— “আ… আমি? মানে, হ্যাঁ… একটু আধটু পারি। কিন্তু… উইথআউট প্রিপারেশন তো…”
ইলমা হেসে বলে,

“প্রিপারেশন ছাড়া গানেই তো আসল আবেগ বেরিয়ে আসে ভাইয়া। চলুন, সবাই চায় শুনতে!”
রিদিত একটু চুপ করে। তারপর আস্তে করে চোখ তোলে। এক ঝলক তাকায় সামনের দিকে—যেখানে দাঁড়িয়ে আছে আনায়া। হালকা গোলাপি ফ্রকের আড়ালে মাথা নিচু করে শুনছে, চোখে একটা চাপা কৌতূহল। রিদিতের চোখ আটকে যায়। যেন চারপাশের শব্দ থেমে যায় এক মুহূর্তে।
তারপর সে চোখ বন্ধ করে, একবার গলা খাঁকারি দিয়ে গাইতে শুরু করে—নরম অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে।
ওরে প্রথম দেখার কালে তারে
লেগেছিল ভালো
মুচকি হাসি দিয়া সে
কই চলে গেল….
তার কথা ভেবে আমার
অন্তর দেয় কাঁদিয়া
বেহায়া মনটা রে,
বুঝাইবো কি দিয়া…

কণ্ঠটা যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে পুরো আঙিনায়। কোলাহল থেমে যায়। সবাই নিঃশব্দে শুনতে থাকে। আর ঠিক তখনই আনায়া একটু মুখ তুলে রিদিতের দিকে তাকায়।
দু’জনের চোখ কয়েক সেকেন্ডের জন্য আটকে যায় এক বিন্দু নিরব চাহনিতে। না বলা অনেক কিছু যেন ছুঁয়ে যায় সে দৃষ্টিতে।
রিদিত গাইতে গাইতেই বুঝতে পারে—এই মুহূর্তে সে গান গাইছে না শুধু, সে কারো অনুভব ছুঁতে চাচ্ছে।

“তোকে বললাম খু*ন করতে হবে মানে খু*ন করতেই হবে। আর একটা কথা যদি আমি শুনি তাহলে… তুই নিজে আর তোর পরিবারের সবার কাফনের কাপড় তৈরি রেখেছিস নিশ্চয়ই?”
কথাগুলো এতটাই ঠান্ডা, এতটাই নিঃসাড়ে ভয়াবহ ছিল যে রাকিবের বুকের ভেতর একটা দপ করে কেঁপে উঠল। কণ্ঠটা ফোনের ওপাশে অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর ভেসে এসেছিল, ঠিক যেন আগুন ছুঁড়ে দিয়ে গেল তার মেরুদণ্ড বরাবর।
এই ভয়, এই শীতল হুমকি রাকিব চেনে।
তবুও আজ… তার কণ্ঠ কেমন যেন শুকিয়ে এল।
সে গলার স্বর নিচু করে বলল,

— “আমি কখন বললাম যে আমি মারতে পারব না? কিন্তু… ওই ছোট্ট বাচ্চাটা… ওকে তো ছেড়ে দেওয়া উচিত ?”
একটা বিরতি।
তারপর ফোনের ওপাশ থেকে আবার সেই কণ্ঠ— এবার যেন আরও গা ছমছমে আর তীক্ষ্ণ।
— “কি উচিত আর কি অনুচিত,সেটা আমি তোর কাছ থেকে শিখবো না নিশ্চয়ই । তোকে যা বলা হয়েছে, সেটা কর। আর যদি বাচ্চাটার জন্য এতই মায়া হয়, তাহলে খু*নের দরকার নেই… ওকে তুলে নিয়ে আয়।এমনিতেও তো আমাদের বিশটা বাচ্চা হতে দুইটা বাকি আছে। তো ওইটাকেই না হয় তুলে নিয়ে আয়।তবে শুনে রাখ— ওই বাচ্চাটার বাবা-মার কিডনি আর লিভার আমি নিজের হাতে দেখতে চাই… র*ক্তে ভেজা অবস্থায়।”
টুট করে কল কেটে যায়।

আর কিছু বলার সুযোগই পায় না রাকিব।
ঘরে তখন নিস্তব্ধতা— শুধু বুকের ধড়ফড় শব্দ যেন নিজ কানে শুনতে পাচ্ছে সে।
বাচ্চাটার বাবা-মাকে খু*ন করা—
এ তো নতুন কিছু না রাকিবের জীবনে। এমন খু*ন, এমন চিৎকার— সব সে করেছে বহুবার। এমনকি কবরস্থ করতে করতে এখন সে গন্ধেই বুঝে ফেলে কোন লা*শের কোন অংশ পচছে।
কিন্তু আজ…

আজ বুকটা চেপে ধরেছে একটা অপরিচিত কষ্ট।
কারণ এই প্রথম…
এই প্রথম সে অনুভব করছে,
মৃত্যু-ই সব নয়।
কারণ কিছু কিছু জীবন আছে,
যা মৃত্যু থেকেও বেশি নিষ্ঠুর।
এই বাচ্চাটাকে হয়তো বাঁচানো হবে…
কিন্তু সেটা কোনো জীবন হবে না—
হবে একটা ল্যাবরেটরির নমুনা, একটা বাজারের পণ্য,
একটা মস্তিষ্কের পেছনে বেঁধে রাখা সাদা গাউনের আদিম শিকার।
অন্ধকারে বসে রাকিব চোখ বন্ধ করল।
আর মনে মনে বলল,

“আজ যদি আমার হাত কাঁপে,
তা হবে কারণ আমি মানুষ—
না হলে এখনো অন্ধকারেই থাকতাম,
নরকের এই মেঘে ঢাকা রাজ্যে।”-

রাত প্রায় ৯টা। সাজিদ-ইলমার রিসেপশন শেষ হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। অতিথিরা বিদায় নিয়েছেন, তবু বাড়ির আনাচেকানাচে এখনো উৎসবের আলো, গন্ধ আর অনুভবগুলো ভাসছে কুয়াশার মতো।
রাতের খাবার শেষে সবাই মিলে ঠিক করল—আজ রাতটাকে আরেকটু রঙিন করে তোলা যাক। সবাই ছাদে উঠবে। পুরনো কথাবার্তা, নতুন হাসির রোল, আর মাঝে মাঝে কেউ কেউ চুপচাপ থাকবে, অথচ চোখে থাকবে একরাশ রহস্য।

ছাদে গোল করে রাখা টেবিল আর চেয়ারের চারপাশে বসে পড়ল সবাই। শিশির, আনায়া, ইলমা, নিঝুম, নাহিয়ান, রিদিত, নির্ঝর, সাজিদ আর সৌজন্য—সকলেই এক ঝলমলে দল।
নিঝুম আর নির্ঝর কিছুক্ষণ আগেই এসেছে। নির্ঝর তো কলেজের রোল মডেল—গম্ভীর, সময়পটু, নিয়ম মেনে চলা মানুষ। তাই গায়ে হলুদের দিন আসা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। কিন্তু আজ—বৃহস্পতিবার।তাই ক্লাস শেষে সরাসরি চলে এসেছে।
গল্প জমে উঠতেই শিশির চোখে দুষ্টুমি নিয়ে বলে উঠল—

— “আচ্ছা, এবার একটা গেম খেলা যাক। তবে ট্র্যাডিশনাল না, একটু আপডেটেড ভার্সন—‘রিয়াল রিভিল’!”
সবার কপালে ভাঁজ পড়ে।
“রিয়াল রিভিল?”
শিশির হেসে বলে—
— “মানে ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার। কারণ এখানে অনেক রহস্যময় মানব বসে আছে যাদের রহস্যের উন্মোচন ঘটাটা দরকার”

শিশিরের এমন কথায় নাহিয়ান একবার‌ আড়চোখে শিশিরের দিকে তাকালো। সে খুব ভালো করে বুঝতে পারল যে শেষ কথাটা শিশির তাকেই উদ্দেশ্য করে বলেছে।সে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই শিশির বলে ওঠে,,
“আর হ্যাঁ যদি কারো সাহস না থাকে সত্যি বলার তাহলে সে উঠে যেতে পারে। সবার তো আর সত্যি বলার সৎ সাহস থাকে না। তাদের জন্য ছাড় আছে। ”
নাহিয়ান এবার বুঝতে পারল শিশির চাচ্ছে যাতে সে যেন এইখানে থাকে তাই এমন ইগো হার্ট করা কথা বলছে। তখনই পাশ থেকে সাজিদ বলে ওঠে,,
“তোর কেন মনে হচ্ছে যে এখানে কেউ ভীতু আছে? বেশি কথা না বলে খেলাটা শুরু কর।”
শিশির তার কথায় টিটকেরি মেরে বলে,,
“কত জানই‌ তো থাকতে পারে। যাদের সত্যি কথা বলার সৎ সাহস নেই। আচ্ছা তো তুমি যখন বলছো তখন শুরু করছি।”

শুরু হলো খেলা। তবে এবার বোতলের ঘূর্ণি নয়, বরং চকচকে এক সিলভার রিং ঘুরে চলেছে মাঝখানে রাখা মার্বেলের টেবিলটায়।
রিং প্রথম পড়ল ইলমার দিকে।
শিশির রসিয়ে জিজ্ঞাসা করে—
ট্রুথ নাকি ডেয়ার?
ইলমা সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে উঠেছিল যে প্রথম টার্নটা তারই। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
“ট্রুথ।”

শুধু একটা কথা তারপরই সাজিদ ফেটে পড়ে। সে যেন এটারই অপেক্ষা করছিল। সে দ্রুত শিশিরকে বলে,,
“স্টপ শিশির প্রশ্নটা আমি করব।”
শিশির কিছুটা মুচকি হেসে বলে আচ্ছা তুমিই করো। অনুমতি পেয়ে সাজিদ ইলমার দিকে তাকিয়ে বলে,,
“তো মিসেস রেডি?”
ইলমা তার দিকে তাকিয়ে আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বলে,
“অবশ্যই”

ইলমা‌ মুচকি হাসে কারণ সে খুব ভালো করেই জানে সাজিদ তার কাছে কি প্রশ্ন করবে। তবে এখন আর সাজিদকে জানিয়ে দিতে ইলমার কোন বাঁধা নেই। অনুমতি পেয়ে সাজিদ বলে,,
“তোমার জীবনে আমি ছাড়া আর ছিল? যার কারণে তুমি আমার সাথে সম্পর্ক ভেঙে যেতে চেয়েছিলে? একদম সত্যি বলবা ট্রুথ নিয়েছো কিন্তু।”
ইলমা কিছু বলার আগেই শিশির হেসে ওঠে। হাসতে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। এরপর সে সাজিদের দিকে তাকিয়ে বলে,,
“ভাইয়া তুমি না আসলেও বোকা ইলমা আপু ঠিকই বলেছিল তোমার মতন বোকা কখনোই আমাদের চালাকি ধরতে পারবে না।”
সাজিদ কিছুটা অবাক হয়ে বলে,,
“মানে?”
শিশির এবার জোরে হেসে ওঠে।তারপর বলে,,

“মানে তোমার মাথা আর আমার মুন্ডু।আপুর জীবনে‌ অন্য কোনো পুরুষ ছিল-ঠিল না।ওটা আমার আর আপুর প্ল্যান ছিল। যাতে তুমি তোমাদের সম্পর্কের কথাটা মামা-আর মামনিকে জানাতে পারো। না হলে তোমার যা অবস্থা দেখেছিলাম তাতে এজন্মেও তুমি তোমার আর আপুর সম্পর্কের কথা মামা-মামণিকে জানাতে পারতে না। জন্যই আমি আপুর সাথে মিলে এই প্লানটা করি। যে আপু যেন তোমাকে বলে যে আপুর বিয়ের কথা চলছে।আর আপু সেখানেই বিয়ে করতে চায়। পরে আমি মামনিকেও সবটা বলেছিলাম। তারপর মামনি মামাকে আর তোমার একটা বিষয় জানা দরকার যে তুমি মামা মামীকে সবটা বলার আগেই তারা ইলমা আপুর বাবা-মার সঙ্গে বিয়ের পাকা কথা ঠিক করে রেখেছিল । শুধু অপেক্ষা করছিল তোমার সাহসের জন্য। বুঝলে?”

সাজিদ এবার যেন আকাশ থেকে পড়ে। সে বুঝতে পারে এই জন্যই তার বাবা মাকে ইলমার কথা বলার সাথে সাথে তারা রাজি হয়ে গিয়েছিল কোন আপত্তি করেনি। তাহলে এর পিছনে সমস্ত অবদান শিশিরের। সে উঠে শিশিরের দিকে এগিয়ে আসে তার চোখে অপার কৃতজ্ঞতা। শিশিরের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর হাত বাড়িয়ে শিশিরের মাথায় আলতো স্পর্শ রেখে বলল,,
“থ্যাংক ইউ রে বনু। ইলমা ঠিকই বলে, যে তোর মত বোন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি দোয়া করি, জীবনে ও ঠিক সেরকম কেউ আসে, যে তোকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে।”
শিশির নিজের মাথায় রাখা সাজিদের হাতটি নিজের হাত দিয়ে আচ্ছাদন করে। তার কণ্ঠে একরাশ মায়া, তবুও মিষ্টি শ্লেষ—

— “আমিন। তবে আপাতত দোয়া করো, যাতে পড়াশোনাটা শেষ করতে পারি। পড়ার চাপ দেখে তো মনে হচ্ছে—আমি কোনো গবেষণাগারে বন্দি!”
সাজিদ হেসে বলে ওঠে—
— “আরে, এত কষ্ট কেন করিস? একটা বড়লোক জামাই দেখে বিয়ে দিয়ে দিই তোকে। তারপর তো ওর ঘাড়ে বসে সারা জীবন খেয়ে ঘুমিয়ে কাটাতে পারবি। সমস্যা একটাই—বড়লোক মানেই টাকলা!”
শিশির এবার রেগে গিয়ে সাজিদের হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে চট করে বলে ওঠে—
— “বললেই হলো নাকি! টাকলা হলে আমি তোর বিয়ে করব না! এসব বুদ্ধি বাদ দাও। যাও, গিয়ে নিজের নতুন বউয়ের পাশে বসো।”

অন্যদিকে, নাহিয়ান শিশিরের কথার মাঝেই নিঃশব্দে মুচকি হেসে নিজের মনে বলে—
“কে‌ বলল তোকে টাকলার সাথে বিয়ে দিবে? তুই তো হবি আমার মন গহীনের রাজ্যের রানী।”
খেলা আবার শুরু হলো। এবার সিলভার রিং-এর মুখ ঘুরে ঘুরে গিয়ে পড়ল নাহিয়ানের সামনে। শিশির মনে মনে বাঁকা হেসে বলল—
— “এবার কই যাবেন মিস্টার গুমড়ামুখো? আজকে আমি আপনার সেই সুহাসিনীর রহস্য উন্মোচন করেই ছাড়বো।”
কিন্তু শিশিরের সব আশা যেন মুহূর্তে নিরাশায় পরিণত হলো, যখন নাহিয়ান বলল—
— “ডেয়ার।”
অন্যদিকে শিশিরের মুখ মুহূর্তেই এমন চুপসে যেতে দেখে, নাহিয়ান মনে মনে বলল—
— “নিজেকে কি অনেক বেশি চালাক মনে করো আমার বোকা শিশির বিন্দু? এই খেলাটা যে একটা ফাঁদ, তা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়েছে ভেবেছো? আমি খুব ভালো করেই জানি, তুমি আমার সুহাসিনীর খোঁজ করতেই খেলাটার আয়োজন করেছ। কিন্তু এত সহজে তো তার খোঁজ আমি তোমাকে দিব না!”
শিশির আর কিছু বলল না। অন্যপাশ থেকে নিঝুম বলল—

— “ভাইয়া, অনেকদিন তোমার কণ্ঠে গান শুনি না। একটা গান শোনাও।”
নাহিয়ান নিঝুমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, তারপর গুনগুন করে গেয়ে উঠলো—
Mere khwab mera khayalo ki rani
Kisi din banegi hamari kahani
Ye meri be khudi
Ye kasam mein nahi
Pyaar mein ek pal
Meri jaan tujhe paana
Oh oh jaane jaana
Dhoonde tujhe deewaana
Sapno mein roj aao
A zindegi mein aana sanam…

তাঁর কণ্ঠে যেন এক অদ্ভুত রোমান্টিক বিষাদ। সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে, আর শিশির মনে মনে বলে—
— “আবার রোমান্টিক গান! আমি নিশ্চিত এই বেডা প্রেমে পড়েছে। কিন্তু আল্লাহই জানে কোন সে হতভাগা মেয়ে, যার কপাল পুড়েছে!”
গান শেষ হলে সবার করতালিতে মুহূর্তটা আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তখনই সাজিদ বলল—
— “আচ্ছা বাবা বুঝেছি, প্রেমে পড়েছিস। এখন আবার খেলা শুরু করো, না হলে রাত শেষ হয়ে যাবে।আমার আবার নতুন বউ বোঝো তো!”

তার কথা শুনে রিদিত হেসে উঠলো—
— “নাও নাও, সবাই একটু তাড়াতাড়ি খেলাটা শেষ করো। না হলে আবার আমার বন্ধুর নতুন বিয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।”
সবাই একযোগে হেসে ওঠে এবার। ইলমা শুধু সাজিদের দিকে কড়া চোখে তাকায়। শিশির হেসে বলে—
— “আচ্ছা আচ্ছা, বুঝেছি। আর দুই রাউন্ড খেলব, তারপর শেষ। এমনিতেও অনেক রাত হয়েছে।”
এই বলে সিলভার রিং ঘোরানো হলো। এবার গিয়ে পড়ল রিদিতের দিকে। রিদিত কিছুটা ভাব নিয়ে বলে—
— “আমি সর্বদা সত্য কথা বলতে পছন্দ করি। তো আমি ট্রুথই নিব।”
শিশির এবার উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে—

— “তাহলে প্রশ্নটা আমিই করব। রেডি ভাইয়া?”
রিদিত হালকা হেসে বলে—
— “অবশ্যই!”
শিশির এবার বলে—
— ” সন্ধ্যায় আপনি একটা রোমান্টিক গান গেয়েছিলেন, মনে আছে? ওখানে আপনি মেবি‌ কাউকে মিন করে গিয়েছিলেন। তো তার নামটা কি জানতে পারি?”
রিদিত কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে, কিন্তু পরক্ষণেই বলে—
— “অবশ্যই। আমি একজনকে মিন করেই গেয়েছিলাম। আর গানটা তার ক্ষেত্রেই সত্যি—তাকে প্রথম দেখাতেই আমার পছন্দ হয়েছিল।”
সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। সাজিদ পেছন থেকে বলে ওঠে—
— “কি হলো? তাহলে আমাদের শুদ্ধ পুরুষেরও কাউকে পছন্দ হলো? তুমি যা‌ শুরু করেছিলে, তাতে তো মনে হচ্ছিল না যে জীবনে কাউকে তোর পছন্দ হবে? তাহলে শুনি, সেই মহান ব্যক্তিত্বের নাম—যাকে‌ প্রথম দেখাতেই আপনার ভালো লেগেছে?”
রিদিত এবার আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে—

— “আয়নিন… আয়নিন আনায়া।”
কথাটা যেন তীব্র শব্দে বিস্ফোরিত হলো ছাদের বাতাসে।
সবাই অবাক হয়ে আনায়াকে দেখছিল। ঠিক তখনই আনায়া কিছু না বলে সোজা উঠে নিচে চলে যায়। রিদিত উঠে যেতে চায়, কিন্তু শিশির তার পথ রোধ করে বলে—
— “ভাইয়া, দাঁড়ান। ওর সাথে যাবেন না। ওকে একা ছেড়ে দিন। আপনি জানেন না, নিজের অজান্তেই আপনি কি করে বসেছেন।”
রিদিত এবার শিশিরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে—

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৭

— “কি করেছি? আমি তো শুধু আমার মনের কথাই বলেছি!”
শিশির তার দিকে তাকিয়ে বলে—
— “আপনার কাছে এটা শুধু আপনার মনের ভাষা হলেও, ওর কাছে সেটা একটা অতীত, এক দগদগে দুঃসহ ক্ষত। যেটা অনেক কষ্টে শুকিয়ে ফেলেছিল ও। আপনি আজ আবার সেটা খুলে দিয়েছেন…”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৯