মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২০

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২০
নওরিন কবির তিশা

কেটে গেছে আরও দশটি দিন।
বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শিশিররা ফিরে এসেছে সাজিদের বাড়ি থেকে প্রায় এক সপ্তাহ আগে। দিনগুলো যেন সোনালি পাখির ডানায় ভর করে উড়ে গেছে। তবে আজকের দিনটা যেন আলাদা কিছু নিয়ে এসেছে। হালকা বিষণ্ণতা, এক ধরনের অজানা টানাপোড়েন।
শিশিরের মা–বাবা আজ বাসায় নেই।…তারা গিয়েছেন নাহিয়ানদের বাসায়। কারণ কালকে‌ সকালেই নাহিয়ানের ইউএস-এ ফ্লাইট। যদিও যাওয়ার কথা ছিল আরও এক মাস পর, কিন্তু—
এক জটিল ইন্টারন্যাশনাল কেসে হঠাৎ করে সমস্যা দেখা দেওয়াতে, হেডকোয়ার্টার থেকে সরাসরি নির্দেশ এসেছে—”We need A.R on ground. ASAP.”

নাহিয়ান একজন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা অফিসার—তার কাঁধে ভর করে থাকে একাধিক মিশন আর এই ‘A.R’ মানেই পুরো টিম যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তার সিদ্ধান্ত, তার নেতৃত্বে একধরনের শীতল নির্ভরতা মিশে থাকে। শুধু একজন অফিসার নয়, সে যেন চলন্ত এক ছায়াযুদ্ধ। তার না থাকায় একটা গোটা শাখা থমকে যায়, তাই এবার ফেরাটা আর বিলম্ব করা গেল না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এমন গুরুতর দায়িত্বের ডাক উপেক্ষা করা যায় না, তাই তাকে তড়িঘড়ি করে ফিরে যেতে হচ্ছে। ঠিক কবে সে আবার ফিরে আসবে—সে ব্যাপারেও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
অন্যদিকে নিজের একমাত্র ছেলেকে এতদিন পর কাছে পেয়ে যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন নওরিফা খানম। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে সন্তানকে চোখের সামনে পেয়ে মনটা খানিকটা শান্ত হয়েছিল। কিন্তু হুট করে নাহিয়ানের ফিরে যাওয়ার খবর যেন সেই শান্ত হৃদয়ে আবারও ঝড় তুলে দিল।
তিনি জানতেন, নাহিয়ান শুধু তার সন্তান নয়, সে এখন একটা দেশের দায়িত্ব বহন করে—একজন আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্ত সংস্থার স্পেশাল অপারেটিভ অফিসার, যার প্রতিটি পদক্ষেপ হাজারো মানুষের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত।

তবুও… মায়ের মন কি আর এসব বোঝে?
ছেলের কাঁধে দায়িত্বের পাহাড়, আর মায়ের চোখে শুধু ভাঙচুর—একচিলতে মমতা আঁকড়ে ধরে থাকবার আকুতি। তাই যখন শুনলেন, ছেলেকে এক জটিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম কেস হ্যান্ডেল করতে তড়িঘড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না তিনি। তার এমন কষ্টের মুহূর্তে তাই তাকে সান্তনা দিতে ছুটে গিয়েছেন রোদেলা জামান আর সিকদার শাহ।

আজ ভার্সিটি থেকে ফিরতে শিশিরের একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। যদিও সেটা ইচ্ছাকৃত নয়, বরং বেশ যৌক্তিক কারণেই। আজ ছিল সাইফের জন্মদিন। ক্লাস শেষে হঠাৎ করেই বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, একটা ছোট্ট জন্মদিনের আয়োজন হবে পাশের রেস্টুরেন্টে। ব্যাস, একটা কেক, কিছু হাসি-ঠাট্টা আর বন্ধুত্বের উষ্ণতায় মুহূর্তগুলো পেরিয়ে যায় অনায়াসে।
কিন্তু সেলিব্রেশন এর মাঝেই শিশির এক ফাঁকে বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দেয়, যাতে তারা চিন্তা না করেন। আর তাই দেরিতে বাসায় ফিরেও সে নিশ্চিন্ত—কারণ জানে, তার মা-বাবা অন্তত চিন্তা করবে না।
কিন্তু বাসায় ঢুকেই খবর পেল—ওনারা কেউ নেই।
নাহিয়ানের বাসায় গেছেন।
আর শিশিরকেও যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
তাই নিজের রুমে রেডি হচ্ছিল শিশির।হিজাব বাঁধছিল আয়নার সামনে। হঠাৎ দরজায় একটা টোকা পড়তেই সে ঘাড় না ঘুরিয়ে বলে উঠল—

— “দরজা খোলা আছে।”
বাইরে থেকে পরিচিত কণ্ঠটা ভেসে আসে—
“আপু, তোমাকে একজন ভাইয়া নিতে এসেছেন। বাইকে বসে নিচে অপেক্ষা করছেন। আমাকে বলেছে তোমাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলি।”
শিশির তখন হিজাবের শেষ দিকের পিন গোছাচ্ছিল। হঠাৎ অসতর্কভাবে একটা পিন গেঁথে যায় তার আঙুলে।
সামান্য যন্ত্রণায় মুখ দিয়ে নিঃশব্দ “উফ” শব্দটা বেরিয়ে আসে।
সে চোখ কুচকে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে একটু বিরক্তি নিয়ে মনে মনে বলে—
“কি পরিমাণ অলক্ষুণে লোক! তার নাম শোনামাত্রই পিন ফুটে গেল হাতে। আল্লাহই জানেন, পুরো পথ ওর সঙ্গে কিভাবে সামলাব!”
তবুও ঠোঁটের কোণে চাপা এক হাসি লুকিয়ে রেখে সে বলে ওঠে—

— “রিয়া, তুই নিচে গিয়ে বল আমি আসছি।”
রিয়া বাইরে থেকেই বলে—
— “আচ্ছা আপু।”
রিয়া, এই বাড়ির চেনা ছায়া। বহু বছর আগে রিয়ার মা, রহিমা ছিলেন এ বাড়ির আস্থাভাজন গৃহকর্মী। একাই সন্তান মানুষ করতেন। এক অসহায় মা, এক সাহসিনী যোদ্ধা। এক বছর আগে যখন রহিমা ক্যান্সারে মারা যান, তখন থেকেই শিশিরের পরিবার রিয়াকে নিজেদের পরিবারের অংশ করে নিয়েছে। সে যেন শুধু একজন কাজের মেয়ে নয়—একটা নির্ভরতা, একটা ছোট্ট বোনের মতো হয়ে উঠেছে।

মাত্র পাঁচ মিনিট পর শিশির গেট পেরিয়ে দেখে—নাহিয়ান বাইকের সাথে হেলান দিয়ে মোবাইল ঘাঁটছে, মুখে চিরাচরিত গাম্ভীর্য। তাকে দেখে শিশির মনে মনে বলে উঠল,
—“একজন মানুষ এতটা দেমাগ নিয়ে বাঁচে কীভাবে! নিজেকে কি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য ভাবে নাকি?”
তারপর সে সামনে এসে শান্ত ভঙ্গিতে বলে—
—“চলুন, আমি রেডি।”

নাহিয়ান এক ঝলকে তাকিয়ে দেখে—শিশির আজ মেরুন রঙের ফ্রকে, সাথে তারই দেয়া হিজাব।ফর্সা মুখশ্রীতে মেরুন কালারের হিজাবটা যেন তাকে অপরূপা করে তুলেছে।যেন লালচে আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। নাহিয়ানের বুকের ভেতর কোথাও যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায় সবকিছু। চোখে একটা গভীর ছায়া নেমে আসে, তারপর অজান্তেই সে একবার গলাধঃকরণ করে নেয়। কিন্তু তা এতটাই সুক্ষ্ম যে শিশিরের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় পুরোপুরি।
পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা কণ্ঠে বলে—
— “হেলমেট পরে পিছনে বস।”
শিশির কিছু না বলে মাথা নেড়ে হেলমেটটা পরে নেয়। তারপর একটুখানি দ্বিধা নিয়ে, বেশ গুটিসুটি মেরে বাইকের পেছনে বসে পড়ে।
তাদের মাঝখানে আজ কোন কথার প্রয়োজন নেই। শুধু নীরবতা… আর এক অদ্ভুত নিঃশ্বাস-ভেজা অনুভূতি।

“ভাই… আমাদের দলের আরও পাঁচজন নিখোঁজ হয়ে গেছে। এভাবে প্রতিদিন একজন করে হারিয়ে গেলে আমাদের ব্যবসাটাই তো শেষ হয়ে যাবে!”
ফোনের এপাশের কণ্ঠটা দুশ্চিন্তায় টান টান, কিন্তু বিপরীত পাশে থাকা কণ্ঠটি বরফ-ঠান্ডা, অদ্ভুতভাবে স্থির—
— “তোরাদের কি আমি ফাও পুষতাছস? ওরা হারায় গেলে তোরা দুঃখ করিস ক্যান? কাজ করতে বলছি, তোরা খালি হিসাব করিস!”
এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে আবার বলে, কণ্ঠে এখন আর শীতলতা নেই, আছে নিঃশ্বাস কাঁপানো ভয়—
— “তুই কি ভাবিস, আমি কাঁচা খেলোয়াড়? আমি এমন এক চালাক শিকারি—হারানো আমার অভিধানে নাই। আমি হারি না, হারতে জানিও না।”

একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে মুহূর্তখানেক। তারপর হঠাৎই প্রশ্নটা আসে—
— “যে দশটা বাচ্চার কথা বলছিলাম… সেগুলার কি হইছে? সব জোগাড় হইছে তো?”
ফোনের এপাশের লোকটা যেন গিলে ফেলে নিজেরই জিভ। কণ্ঠটা কেঁপে ওঠে—
— “না ভাই… এখনো দুইটা বাকি আছে। তবে… আপনি চিন্তা কইরেন না, আজ রাতের ভেতর সব ম্যানেজ হইয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।”
ওপাশ থেকে এবার বজ্রাঘাতের মতো গর্জে ওঠে কণ্ঠটা—
— “আজো বাকি? কী করস তোরা? কাল সকালে আমি দুইটা বাচ্চা চাই—যেভাবেই হোক। না হলে তুই জানিস, কী হতে চলেছে…”
মোখলেস‌ ঢোক গিলে বলে—

— “ভাই, আ..আ, আপনি রাগ কইরেন না। আমি লোক পাঠাইছি। পাশের হাটে আজ মেলা বসছে। আধা ঘন্টার ভেতর দুইটা বাচ্চা পাওয়া যাওয়ার কথা।”
— “আশা করিস না। তুই আশা না দেখাইয়া, কাজ কর। সকালের মধ্যেই আমার যে করেই হোক বাচ্চা চাই।”
টুক করে কল কেটে দেয় অপরপ্রান্তের সেই ভয়ংকর কণ্ঠ।
মোখলেস মিয়া যেন নিঃশ্বাস নিতে পারে তখন। বুকের ওপরের চেপে থাকা ভয়টাকে ঠেলে সরাতে‌ যায় তখনই পাশে থাকা জিন্নাহ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে—
— “চাচা… আপনি সত্যিই ভয় পান?”
মোখলেস কণ্ঠটা গা ছমছমে ঠান্ডা হয়ে ওঠে—
— “আমি এতক্ষণ কোনো মানুষের সাথে কথা বলি নাই, জিন্নাহ। আমি কথা বলছিলাম একটা জ্যান্ত নরখাদক রাক্ষসের সঙ্গে। ওর নাম শুনলে ভয়ের ঠেলায় মগজ বরফ হয়ে যায়।”
জিন্নাহ বোঝে না—কী এমন লোক, যার ভয়ে চাচা মোখলেসের মতো মানুষ কাঁপে? কিন্তু সে এটুকু বুঝে যায়—তার এমন ভয়ানক চাচা যাকে ভয় পায়, সে এই দুনিয়ার সাধারণ কেউ নয়।

ঢাকার কোলাহলপূর্ণ রাস্তার বুকে তাদের বাইক ছুটে চলেছে। চারদিকে গাড়ির হর্ণ, বাতাসে উড়ে বেড়ানো ধুলো, মাথার উপর উজ্জ্বল ব্যস্ত চাঁদ—সব মিলিয়ে যেন এক বিশৃঙ্খলার ভেতরেও খুঁজে পাওয়া প্রশান্তির মতো মুহূর্ত।
শিশির আজ আর কাঁধে হাত রাখার জন্য সঙ্কোচ বোধ করেনি। তার নরম আঙুলের আলতো ছোঁয়া এখন নাহিয়ানের কাঁধে, যেন অনির্বচনীয় এক নীরব কবিতা লিখছে প্রতিটি স্পর্শে। এই ছোঁয়াটুকু শুধু ছোঁয়া নয়—এ যেন এক অনুচ্চারিত স্বীকারোক্তি।
নাহিয়ানের বুকের ভেতর অনুরণন তোলে সেই ছোঁয়া। বাইক চললেও তার হৃদয় থেমে গেছে কোথাও। যেন ঢাকার সব কোলাহলকে নিঃশব্দে পেছনে ফেলে সে এখন এক অন্য জগতে, যেখানে শুধুই শিশিরের নিঃশ্বাস, সেই মৃদু হাতের চাপ, আর সেই অচেনা এক আরাম।
আজ রাত জোৎস্নার রাত।

চাঁদ আজ যেন একটু বেশিই উজাড় করে দিচ্ছে নিজেকে। তার নরম রুপালি আলো ঢেকে দিচ্ছে শহরের সমস্ত ব্যস্ততা, সমস্ত যান্ত্রিকতা। কিন্তু চাঁদ‌ও যেন নিজের রূপ হার মানাতে চায় শিশিরের মুখশ্রীর কাছে। মেরুন হিজাবে ঢাকা তার মুখটা এখন আভায় ঝলমল করছে—স্নিগ্ধ, শান্ত, অথচ উষ্ণ। নাহিয়ান বাইকের গতি কমিয়ে দেয় অজান্তেই, যেন মুহূর্তগুলো একটু দীর্ঘ হয়, যেন এই অনুভবটুকু একটু বেশিদিন স্থায়ী হয়।
ঠিক তখনই, পাশ ঘেঁষে ছুটে যায় একটি কালো গাড়ি। গাড়ির জানালা হালকা খোলা, আর সেখান থেকে ভেসে আসে এক পুরনো হিন্দি গানের অসম্ভব সুন্দর দুইটি লাইন—

“Yeh kya baat hai, aaj ki chandni mein…
Ke hum kho gaye, pyaar ki ragini mein…”
শব্দগুলো যেন চাঁদের আলোয় মিশে এক নতুন জাদু ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। শিশিরের ঠোঁটে খেলে যায় এক টুকরো নরম হাসি, আর নাহিয়ান তার চোখের কোনা দিয়ে দেখে—এই মেয়েটা, এই মুহূর্তটা, এই চাঁদনী রাত—সব একসাথে মিলে এক পরিপূর্ণতা।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ১৯

কিছু অনুভূতি থাকে, যেগুলো কোনো শব্দে ধরা যায় না। তারা কেবল অনুভব করা যায়—মাঝরাতের রোদ্দুরের মতো… একটানা ছুঁয়ে যায় হৃদয়, অথচ কোথাও স্পর্শ না করেই।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২১