অন্তঃদহন পর্ব ২৫
DRM Shohag
সৌম্য হঠাৎ-ই রে’গে চিৎকার করে বলে,
– আমার বোনুর সাথে কিছু করলে আপনাকে ছাড়বো না আমি।
আকাশ ভাবলেশহীনভাবে বলে,
– আমার বউয়ের সাথে আমি কি করব সেটা তোমার থেকে কেন শুনব আমি? লজিক লেস কথা বলা বাদ দাও। বোনের শ্বশুর বাড়ি এসেছ, মিষ্টিমুখ কর।
সৌম্য রে’গে আকাশের কলার না পেয়ে দু’হাতে আকাশের গলা চে’পে ধরে। আকাশ চোখ বড় বড় করে তাকায়। আসমানী নওয়ান, শিমু দু’জনেই বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। আকাশ রে’গে সৌম্য’কে গায়ের জোরে ধাক্কা দেয়। সৌম্য এক পা পিছিয়ে যায়। আকাশ ডান হাতে সৌম্য’র কলার চেপে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– ভুলেও আমার গায়ে হাত তোলার চেষ্টা কর না সৌম্য। বউয়ের হাতের মা’র মিষ্টি লাগলেও অন্যদের মা’র আমার হজম হয় না। একশ গুণে ফেরত দিই।
সৌম্য’র চোখেমুখে রা’গ, তবে আকাশের কথায় ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়। আকাশ সৌম্য’র কলার ছেড়ে ঠাণ্ডা হয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– আমি তোমাকে ছোট ভাই ভাবি। জায়গাটা ন’ষ্ট কর না। বসো। ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলছি।
সৌম্য রে’গে বলে,
– আপনাদের মতো জা’নো’য়া’র মানুষদের সাথে বসে তো দূর, দাঁড়িয়ে-ও কথা বলার রুচি নেই আমার।
আকাশ শক্ত গলায় বলে ওঠে,
– সৌম্য??????
সৌম্য চোখ বুজল। ঢাকা শহরে আসার পর থেকে সে আকাশকে চিনতো। শিমুকে টিউশন করাতে গিয়ে সম্পর্কটা আরও সুন্দর হয়েছিল। সবসময় বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করে এসেছে আকাশকে। আর আকাশ কি কম ছিল? তাকে ছোট ভাইয়ের মতো-ই আড়াল থেকে অদ্ভুদ একটা স্নেহ দিত, যেটা সে শিমুকে টিউশন বাদ দেয়ার পর উপলব্ধি করেছিল। কিন্তু আজ জানলো, সেই মানুষটা তার বাবাকে নিয়ে তাকে আর তা বোনুকে কিভাবে মা’র’তে চেয়েছিল! না পেরে তাকে আর তার বোনুকে আগুনে পু’ড়ি’য়ে মা’রতে চেয়েছিল। সৌম্য’র ক’ষ্ট হয়। কিছু আপন মানুষ তো পু’ড়েই ছাই হলো। আর যাকে এই শহরে এসে রিহানের পর একটু হলেও আপন ভাবতো, সে নাকি এতোগুলো মানুষের খু’নি! সৌম্য চোখ মেলে। চোখদু’টো লাল। কণ্ঠে অসহায়ত্ব ঢেলে বলে,
– আমি আর আমার বোনু আপনার কি ক্ষ’তি করেছি আকাশ ভাইয়া? আমার বোনু আপনাকে ডিভোর্স দেয়নি বলেই কি আপনার এতো ক্ষো’ভ ছিল?
আকাশ বিস্ময় চোখে তাকায় সৌম্য’র দিকে। অতঃপর বলে,
– আমি ডিভোর্স চাইনা সৌম্য। তুমি ভুল ভাবছ আমায়।
সৌম্য চিৎকার করে বলে,
– ভাবছি না ভুল আমি। আপনারা কেউ মানুষ নন। প্রথমে আমাকে আর বোনুকে কত বাজেভাবে মা’রতে চাইলেন। আমার পেটে চা’কু মা’রা! আমার বোনুকে রে’প…..
আকাশ দু’হাতে কান চেপে চোখ বুজে চিৎকার করে বলে,
– চুপ কর।
আকাশের কণ্ঠ কাঁপছে। সে যেদিন জেনেছিল, তার সন্ধ্যামালতীকে অন্যকেউ ছুঁয়েছে, সে তো সেদিন-ই অর্ধেক ম’রে গিয়েছিল। আর যখন জেনেছিল, তার সন্ধ্যামালতী পু’ড়ে গিয়েছে, তখন সে পুরোটাই ম’রে গিয়েছিল। সে কাকে বোঝাবে এসব?
সৌম্য তাচ্ছিল্য হাসলো। এরপর আবার-ও আগের ন্যায় শ’ক্ত কণ্ঠে বলে,
– আপনারা কতগুলো মানুষকে পু’ড়ি’য়ে মে’রে’ছে’ন, একবার-ও হিসেব করেছিলেন? আমার বাবা মা নেই, আপনি জানতেন না আকাশ ভাইয়া? সেই জায়গায় একটা মামা, মামি ছিল, আমার দু’টো বোনু ছিল, দু’টো ভাই ছিল। সবাই ক’য়’লা হয়ে গিয়েছে। আমি আর বোনু হাঁটতে না বেরোলে তো আমরা-ও ক’য়’লা হয়ে যেতাম। তবুও আপনাদের মাঝে ন্যূনতম অনুতাপ নেই। উল্টে আমার বোনুকে আবার মা’র’তে নিয়ে এসেছেন? ল’জ্জা করে না আপনাদের?
কথাগুলো বলে সৌম্য থামে। চোখ বুজে নেয়। চোখের কোণে জলকণা জমেছে। সেই মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে গেল যে! কত সুন্দর একটি পরিবার ছিল তাদের। এক নিমিষেই সব ছাই হয়ে গেল! সৌম্য কি করে ভুলবে ওই মানুষগুলোকে? সেই সাধনকে, যে তাকে ভাই ভাই বলে মুখে ফেনা তুলত। সেই বোনুকে। যে তার কলিজার বোনুকে একটি নতুন জীবন দিয়েছিল, হাসতে শিখিয়েছিল।
আকাশ, আসমানী নওয়ান, শিমু তিনজনেই স্তব্ধ চোখে সৌম্য’র দিকে চেয়ে আছে। সৌম্য চোখ মেলে আকাশের দিকে চেয়ে ভারী গলায় বলে,
– আপনি বলছেন, আমাকে ছোট ভাই ভাবেন। সেই জায়গা যেন ন’ষ্ট না করি। অথচ আপনি আমার বড় ভাইয়ের জায়গাটা তো অনেক আগেই ন’ষ্ট করে দিয়েছেন। আপনি কিভাবে পারলেন এরকম টা করতে আকাশ ভাইয়া?
আকাশ ঢোক গিলল। আসমানী নওয়ান এর চোখজোড়া ভ’রে ওঠে। শিমুর চোখের কোণে-ও পানি জমেছে। সেই আগুনের কথা কেউ তো ভুলে যায়নি। কিন্তু সৌম্য’র মুখে এভাবে হা’রা’নো মানুষগুলোর কথা শুনে তারা নিজেদের সামলাতে পারছে না।
আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– এসবের কিছুই আমি জানতাম না।
সৌম্য হেসে বলে,
– চোর চুরি করে স্বীকার করেনা, সে চুরি করেছে। এসব আমি জানি।
আকাশ রে’গে তাকায় সৌম্য’র জন্য। অকারণে তাকে ভুল বোঝার কারণ কি! সৌম্য নিজেকে সামলে শ’ক্ত গলায় বলে,
– আমার বোনুর ডিভোর্স পেপার আমি রেডি করব। আমার বোনুকে ছেড়ে দিন। কোথাও ও?
এরপর সৌম্য চেঁচিয়ে ডাকে,
– বোনু??????? বোনু????????
আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– আমি সন্ধ্যাকে ডিভোর্স দিব না, আর ছাড়বো-ও না। তুমি এখান থেকে যাও সৌম্য।
কথাটা শুনতেই সৌম্য প্রচন্ড রে’গে যায়। আবার-ও তার বোনকে তার থেকে কে’ড়ে নিতে চায় এই অ’মানুষগুলো। নিজেকে দমাতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আকাশের নাক বরাবর একটা ঘু’ষি মে’রে দেয়। আকাশ চোয়াল শ’ক্ত করে তাকায় সৌম্য’র দিকে। আসমানী নওয়ান দ্রুত এগিয়ে আসেন। তার আগেই আকাশ সৌম্য’র গলা চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– বলেছি না! বউয়ের হাতের মা’র ছাড়া আর কারো হাতের মা’র হজম হয় না আমার। আমার গায়ে কোন সাহসে হাত তুললি?
সৌম্য নিজে-ও আকাশের গলা চেপে ধরেছে। তবে আকাশ আগে ধরায় সে সুবিধামতো ধরতে পারেনি। আসমানী নওয়ান আকাশকে টানতে টানতে বলে,
– আকাশ ছাড়ো। এরকম কইরো না।
আকাশ মায়ের কথা কানে নিল না। সৌম্য হঠাৎ আকাশকে জোরে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়। আকাশ দু’পা পিছিয়ে যায়। সৌম্য আবার-ও তেড়ে গিয়ে একই কায়দায় আকাশের মুখ বরাবর ঘুষি মা’রে। আকাশ রে’গে বোম হয়ে যায়। তেড়ে গিয়ে পরপর তিনটে ঘুষি মারে সৌম্য’র মুখ বরাবর। আবার-ও মা’রতে নিলে আসমানী নওয়ান টেনে আকাশকে কিছুটা পিছিয়ে দিয়ে আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। আকাশ আরেকটা ঘুষি মা’রা’র জন্য হাত উঠিয়ে মাকে দেখে থেমে যায়। আসমানী নওয়ান রে’গে বলে,
– আমি তোমারে থামতে কইতাছি আকাশ। তুমি ওরে এভাবে মা’র’তা’ছ ক্যান?
আকাশ রে’গে বলে,
– আমি তো প্রথমেই বসে কথা বলতে চেয়েছি। ও আগে আমার গায়ে হাত তুলেছে। তুমি দেখোনি? ওর সাহস কি করে হলো আমার গায়ে হাত তোলার?
সৌম্য ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা র’ক্ত মুছে রে’গে বলে,
– আপনার মতো অ’মানুষকে এখনো আপনি বলছি, এরজন্য শুকরিয়া করুন।
আকাশ রে’গে বলে,
– তোর আপনি তুই ধুয়ে খা বে’য়া’দ’ব। এইজন্যই ভাবছিলাম, আমার কোমলমতি সন্ধ্যা এরকম খা’টা’শ হলো কি করে! এখন বুঝলাম, ওর ভাই নিজে এক বে’য়া’দ’ব, বোনকে আরেক বে’য়া’দ’ব বানিয়ে ছেড়েছে।
আকাশের কথা শুনে শিমু চোখ বড় বড় করে তাকায়। কপাল চাপড়ায়। এই আকাশ ভাইয়া কিসের মধ্যে কি বলছে! আসমানী নওয়ান ছেলের দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে আছেন। সৌম্য রে’গে বলে,
– আমার বোনুকে একদম বে’য়া’দ’ব বলবেন না। ওকে সবসময় অবলা হয়ে থাকার শিক্ষা দিইনি আমি। প্রথমে অবলা ছিল বলে প্রথমদিন আমার বোনুকে থা’প্প’ড় মে’রে’ছিলেন।
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সব আদর করে পু’ষিয়ে দিব।
আকাশের কথা শুনে সৌম্য থতমত খেয়ে তাকায়। আসমানী নওয়ান ছেলের কথায় অস্বস্তিতে পড়ে যায়। শিমু এই সিরিয়াস মোমেন্টে না চাইতে-ও শব্দ করে হেসে ফেলে। শিমু সৌম্য’র পাশেই দাঁড়িয়ে। সৌম্য শিমুর দিকে রে’গে তাকায়। শিমু ঢোক গিলে বলে,
– স্যরি স্যার!
সৌম্য রে’গে বলে,
– আমার বোনু কোথায়?
শিমু কিছু বলার আগেই আকাশ বলে,
– নেই তোমার বোনু। তুমি এখান থেকে যাও। আমার মা’রা’মা’রি করতে ভালো লাগছে না। অন্য একদিন এসো। মুড আসলে আয়োজন করে ল’ড়া’ই করব।
সৌম্য রে’গে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে সৌম্য’র দিকে।
আসমানী নওয়ান উল্টো ঘুরে সৌম্য’র দিকে চেয়ে বলে,
– বাবা একটু বসো। আমরা বইসা কথা কই। তাইলে তোমার ভুল ভাঙবো।
সৌম্য রে’গে বলে,
– বলেছি তো, আমি আপনাদের সাথে দাঁড়িয়ে-ও কথা বলতে চাইনা। আমার বোনুকে এনে দিন প্লিজ!
আসমানী নওয়ান অবাক হলেন না। ছেলেটিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সন্ধ্যাকে ছেলেটির কাছে ফিরিয়ে দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করে কথা বলবে নাহয়। আসমানী নওয়ান এটা ভেবে মৃদুস্বরে বলেন,
– আচ্ছা দাঁড়াও। জান্নাতরে আমি আনতাছি।
সৌম্য ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই ভদ্রমহিলা তার বোনুকে এই নামে ডাকে কেন? তার মা তার বোনুকে এই নামে ডাকতো। সৌম্য বুঝতে পারেনা।
ওদিকে আকাশ তার মায়ের কথা শুনে কিছু না বলেই বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। সে কিছুতেই সন্ধ্যাকে যেতে দিবে না।
আসমানী নওয়ান আকাশের হাবভাব হয়তো বুঝলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে।
আকাশ দ্রুত তার ঘরের দরজা খুলে দরজা আটকে দেয়। এরপর উল্টো ঘুরে দেখল, সন্ধ্যা মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে, হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফোঁপাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। আকাশ দ্রুত সন্ধ্যার সামনে গিয়ে মেঝেতে দু’হাঁটু ঠেকিয়ে বসে।
এরপর দু’হাতে টেনে সন্ধ্যাকে শ’ক্ত করে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। আকাশ অসহায় কণ্ঠে বলে,
– সন্ধ্যামালতী আমাকে রেখে যেও না।
সন্ধ্যা রা’গে গায়ে যা শ’ক্তি ছিল সব প্রয়োগ করে আকাশকে ধাক্কা মা’রে। তার ভাই তাকে কখন থেকে ডাকছে, অথচ এই লোকটা তাকে ঘরে আটকে রেখেছে। সন্ধ্যার গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করল,
– অসুস্থ মস্তিকের লোক আপনি। ডক্টর না দেখিয়ে আমার উপর কেন টর্চার করছেন?
সন্ধ্যার মনের কথা মনেই রইল। আকাশ অসহায় চোখে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে। সন্ধ্যাকে আবার-ও জড়িয়ে ধরতে গেলে এবার সন্ধ্যা না পেরে রা’গে জিদ্দে একদলা থুতু আকাশের মুখে নিক্ষেপ করে। সাথে সাথে আকাশ চোখ বুজে নেয়। এতোক্ষণের করা সন্ধ্যার প্রতিটি আ’ঘা’ত আকাশ মেনে নিতে পারলেও এবারের করা সন্ধ্যার কাজটি আকাশের সহ্য হলো না। সন্ধ্যা এই কাজ দ্বারা কি তাকে ঘৃণার পরিমাণ বোঝালো? আকাশের বুকটা হঠাৎ কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে হলো, একটি চিনচিন ব্য’থা বিদুৎ বেগে পুরো দেহে ছড়িয়ে পড়ছে।
একটু পর চোখ মেলে সন্ধ্যার দিকে তাকায় আকাশ। সে দেখল,
সন্ধ্যা দু’হাতে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাচ্ছে। আকাশ ঢোক গিলল। লালিত চোখজোড়ায় জলকণা চিকচিক করছে।
আসমানী নওয়ান অনবরত দরজা ধাক্কাচ্ছে। দরজা খুলতে বলছে আকাশকে।
সন্ধ্যা নিজেকে সামলে দ্রুত আকাশের সামনে থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আকাশ ঘাড় বাঁকিয়ে মলিন মুখে দেখল সন্ধ্যাকে। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত অবহেলে পড়ে থাকা চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এই চুলের অধিকারীনিকে ছাড়া সে পা’থ’র হয়ে বেঁচে ছিল। তার সন্ধ্যামালতীর প্রতিটি ক্ষ’ত তাকে তার ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদিয়েছে। এই কয়টামাস কত হাজারবার চোখ ভিজেছে তার হিসেব নেই। অথচ সেই মেয়েটি-ই তাকে কতটা ঘৃণা করে একটু আগে সেটাই বুঝিয়ে দিল!
এর চেয়ে তো সেটাই ভালো ছিল, যখন সে ভাবতো, সন্ধ্যা পু’ড়ে গিয়েছে, আর তার থেকে বিদায় নেয়ার আগে তার সন্ধ্যামালতী তাকে এক ভালোবাসায় মোড়ানো চিঠি দিয়ে গিয়েছে। আকাশ-ও ভেবেছে, মেয়েটির মনে তার জন্য কত অনুভূতি আছে!
আসলে কিশোরী মেয়েরা কখনো খুব ভ’য়া’ন’ক ভাবে ভালোবাসতে জানে, যার রেশ সারাজীবনে-ও কাটেনা। নয়তো এই কিশোরী মেয়েরা-ই আবেগে ভাসে, যা দু’দিনেই কেটে যায়। তবে কি সন্ধ্যা দ্বিতীয় সারির মেয়ে? সন্ধ্যার আবেগ কেটে গিয়েছে?
কথাগুলো ভেবে আকাশ মাথা নিচু করে ঢোক গিলল।
সন্ধ্যা পু’ড়ে যাচ্ছে ভেবে লাস্ট যখন চিৎকার করে কেঁদেছিল, আজ-ও সেভাবেই কাঁদতে ইচ্ছে করছে আকাশের।
আকাশ ডান হাতে ভর দিয়ে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায়। মুখে লেগে থাকা সন্ধ্যার ছিটানে থুতু ডানহাতে মুছে দেয়। এরপর ঝাপসা চোখজোড়া দু’হাতে ডলে সামনে তাকিয়ে দেখল সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দরজায় থা’প্প’ড় দিচ্ছে।
আসমানী নওয়ান দরজার ওপাশ থেকে বুঝলেন সন্ধ্যা অনেকক্ষণ থেকে দরজায় থা’প্প’ড় দিচ্ছে। তার খারাপ লাগলো। আকাশ মেয়েটির সাথে এরকম জোরজবরদস্তি করছে কেন?
একপর্যায়ে আসমানী নওয়ান চেঁচিয়ে বলে ওঠেন,
– আকাশ তুমি কি দরজা খুলবানা? তুমি দেখতাছ না, জান্নাত তার ভাইরে চাইতাছে। তুমি ওর সাথে এরকম জোরজবরদস্তি করে ওরে মা’ই’রা ফেলতে চাও?
মায়ের কথায় আকাশের বুক কাঁপলো। তার সন্ধ্যামালতী তার কাছে থাকলে ম’রে যাবে? ঢোক গিলল আকাশ। দুর্বল পায়ে এগিয়ে এসে সন্ধ্যার পিছনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দেয়।
দরজা খোলা পেয়ে সন্ধ্যা হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে সামনে আসমানী নওয়ানকে দেখে সন্ধ্যা আসমানী নওয়ানকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। ভদ্রমহিলা খেয়াল করলেন, সন্ধ্যার শরীর কাঁপছে। আকাশের দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– আকাশ কি করছ তুমি আমার জান্নাতের সাথে?
আকাশ একবার মায়ের দিকে তাকায়। এরপর চোখ সরিয়ে নির্জীব চোখে সন্ধ্যার দিকে তাকায়।
আসমানী নওয়ান সময় ন’ষ্ট না করে সন্ধ্যার হাত ধরে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে যায়। সন্ধ্যা সৌম্যকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সৌম্য দু’হাতে বোনুকে জড়িয়ে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, তার বোনু ঠিক আছে ভেবে। সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
– কাঁদিস না বোনু। আছি আমি তো! এইযে আমি এসেছি!
এরপর সন্ধ্যাকে ছাড়িয়ে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল, মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে এসেছে। মাথায় হিজাব নেই। চুলের যাচ্ছেতাই অবস্থা। কলেজ ড্রেস এর ওড়না এলোমেলো হয়ে আছে। সৌম্য’র অসহায় লাগলো৷ সে সবসময় ভাই হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তার বোনুকে আগেভাগে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়ে নিতে পারে না। দু’হাতে সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দিয়ে ভারী গলায় বলে,
– স্যরি বোনু! আমি আবার-ও তোকে আগলে নিতে পারলাম না!
আসমানী নওয়ান, শিমু অবাক হয়ে এদের দু’ভাইবোনকে দেখে। এরকম ভাইবোনের সম্পর্ক দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় যেন।
সন্ধ্যার তার ভাইয়াকে হাতের ইশারায় বোঝায়, – সে এখান থেকে চলে যেতে চায়। সৌম্য সন্ধ্যার হাত ধরে উল্টো ঘুরে কয়েকপা এগিয়ে যায়।
আকাশ সিঁড়িতে দাঁড়ানো ছিল। সন্ধ্যার চলে যাওয়াটা সে মানতে পারলো না। বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে সন্ধ্যাকে টেনে শ’ক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সে কিভাবে থাকবে তার সন্ধ্যাকে ছাড়া? বিড়বিড় করে আওড়ায়,
– সন্ধ্যামালতী আমাকে ছেড়ে যেও না, প্লিজ!
এরপর সন্ধ্যাকে ছেড়ে দু’হাতের আঁজলায় সন্ধ্যার মুখ নিয়ে ভাঙা কণ্ঠে বলে,
– আমি তোমাকে আর মা’র’বো না সন্ধ্যামালতী। আর বাজে কথা বলব না। বিশ্বাস কর। প্লিজ যেও না তুমি। আমি কিভাবে…..
বাকিটুকু শেষ করার আগেই সৌম্য রে’গে আকাশকে ধাক্কা দিয়ে সন্ধ্যার থেকে সরিয়ে দেয়। রাগান্বিত স্বরে বলে,
– একদম আমার বোনুর কাছে ঘেঁষবেন না। আমি বলেছি তো, খুব তাড়াতাড়ি আমার বোনুর আর আপনার ডিভোর্স করিয়ে দিব আমি।
আকাশ জ্বলন্ত চোখে তাকায় সৌম্য’র দিকে। তেড়ে গিয়ে আবার-ও সৌম্য’র গলা চেপে ধরে চিৎকার করে বলে,
– আমি আমার বউকে ডিভোর্স দিব না। তুই কেন বারবার এই কথা বলছিস, তোকে মে’রেই ফেলব আজ।
সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তকায়। আসমানী নওয়ান ছেলেকে ধরার জন্য এগিয়ে আসার আগেই সন্ধ্যা আকাশকে ধাক্কা মে’রে সরিয়ে দেয়। দু’হাতের সৌম্য’কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। এই লোকটা এমন কেন? তাকে আর তার ভাইকে কি মে’রে ফেলতে চাইছে? সৌম্য ঢোক গিলে তার বোনকে বা হাতে জড়িয়ে ধরার আগেই আকাশ সন্ধ্যাকে জোর করেই টেনে আবার-ও নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। ঢোক গিলে বলে,
– আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিব না সন্ধ্যামালতী!
সন্ধ্যা আকাশের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে। সৌম্য আবার তার বোনকে সরিয়ে নেয়ার জন্য এগোয়, তার আগেই আসমানী নওয়ান আকাশকে টেনে সন্ধ্যার থেকে ছাড়িয়ে আকাশের বাম গালে পরপর ক’ষিয়ে দু’টো থাপ্পড় মা’রে। রে’গে আওয়াজ তুলে বলে,
– তুমি এতো অ’মানুষ কবে থেইকা হইছ? দেখতাছ না জান্নাত তোমার কাছে থাকতে চাইতাছে না। কানতাছে। ওর সাথে এরকম জোরজবরদস্তি করতাছ ক্যান? কই পাইছ এইসব স্বভাব?
আসমানী নওয়ানের কাজে সৌম্য, সন্ধ্যা, শিমু সকলেই বিস্ময় চোখে তাকায়। আকাশ ঝাপসা চোখে মায়ের দিকে তাকালো। তার মা ঠিক-ই বলেছে, সন্ধ্যা তাকে চাইছে না। সে যতবার সন্ধ্যাকে ধরতে গিয়েছে, ততবার-ই সন্ধ্যা তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে। ঘৃণার ভাড়ে থুতু ছুড়েছে তার দিকে। কিন্তু সে কি করবে? এতোকিছুর পর-ও সে নি’র্ল’জ্জে’র মতো সন্ধ্যাকে চাইছে। সে যে পারছে না। আকাশ ঢোক গিলল।
এরপর হঠাৎ-ই এগিয়ে এসে একহাতে সৌম্য’র হাত, আরেক হাতে সন্ধ্যার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে দরজার বাইরে বের করে দেয়। এরপর ডান হাতের আঙুল তুলে চিৎকার করে বলে,
– আর কখনো কেউ আমার চোখের সামনে আসবি না। আমি-ও যাবো না। আসলে দু’টোকেই জ্য’ন্ত ক’ব’র দিয়ে দিব। মাইন্ড ইট।
কথাটা বলেই সন্ধ্যা আর সৌম্য’র মুখের উপর ঠাস করে দরজা আটকে দেয় আকাশ৷ শরীর কাঁপছে।নিজেকে সামলাতে ডান হাত তুলে দরজায় রেখে চোখজোড়া বুজে নেয়।
দরজার ওপাশে সন্ধ্যা আর দু’জনেই হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। তারা বুঝতেই পারেনি আকাশ এরকমটা করবে। সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যার হাত ধরে রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। সন্ধ্যা পিছু ফিরে বন্ধ দরজার দিকে নির্বাক চাহনীতে চেয়ে। সৌম্য বাইকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার ছেড়ে দেয়া চুলগুলো যত্ন সহকারে খোঁপা করে দিল। এরপর এলোমেলো ওড়না ঠিক করে দিল। সন্ধ্যাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। তবে সন্ধ্যার প্রতি আকাশের ব্যবহার তাকে ভাবাচ্ছে।
সৌম্য বাইকে উঠে বসে বাইক স্টার্ট দেয়। সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
– বোনু উঠে বোস।
সন্ধ্যার দৃষ্টি আকাশদের বাড়ির দিকে ছিল। ভাইয়ের ডাকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। এরপর এক সাইডে পা রেখে বাইকে উঠে বসে। ডান হাতে সৌম্য’র পেট জড়িয়ে সৌম্য’র পিঠে মাথা ঠেকিয়ে রাখে। মুখটা মলিন। সৌম্য বাইক নিয়ে জায়গাটি প্রস্থান করলে, চোখের পলকে আকাশের বাড়ি আড়াল হয়। সাথে সাথে সন্ধ্যার দু’চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
আকাশ সেই তখন থেকে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দমবন্ধ লাগছে তার। মনে হচ্ছে সহ্যের সীমা পেরিয়েছে। বহুক’ষ্টে একটা ঢোক গিলল। এরপর উল্টো ঘুরে মায়ের দিকে তাকায়। আসমানী নওয়ান নিশ্চুপ হয়ে আকাশের দিকেই তাকিয়ে ছিল। আকাশ মায়ের দিকে চেয়ে ভাঙা গলায় বলে,
– শুনেছিলাম, মায়ের দোয়া আল্লাহ ফিরিয়ে দেয় না। প্রমাণ-ও পেয়েছি। আমি সন্ধ্যাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলাম বলে তুমি বলেছিলে, একটাসময় আমি দিনের পর দিন কেঁদে কেঁদে সন্ধ্যাকে চেয়ে-ও পাবো না। আসলেই আমি মাস এর পর কেঁদে-ও আমার সন্ধ্যাকে পাইনি। আর তারপর একদিন তুমি বললে, আমি সন্ধ্যাকে ঠিক খুঁজে পেয়ে যাবো। তোমার সে কথা-ও ফলে গিয়েছে মা। এইতো আজ আমি আমার সন্ধ্যাকে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু তুমি হয়তো এই দোয়া করতে ভুলে গিয়েছিলে যে, সন্ধ্যামালতী যেন আমাকেই ভালোবাসে! আর তাই সন্ধ্যামালতী আমায় ভালোবাসে না, আমায় আর চায় না।
তোমার সব দোয়াই তো কবুল হয়ে গেল মা! এবার তবে ক’ষ্ট করে এই দোয়াটাও করে দাও। আমি যেন খুব দ্রুত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি। কথায় আছে,
❝ জীবিত ফুলে কেউ ঘ্রাণ নেয় না অথচ শুকনো মালায় পূজা করে। ❞
ঠিক যেমন,
সন্ধ্যামালতী হারিয়ে গেলে আমি সন্ধ্যামালতীকে ভালোবেসেছি। এবার নাহয় আমি হারিয়ে গেলে সন্ধ্যামালতী আমায় ভালোবাসবে। ম’রে গিয়ে হলেও সন্ধ্যামালতীর ভালোবাসা আমার চাই।
আসমানী নওয়ান ছলছল দৃষ্টিতে ছেলের পানে চেয়ে থাকে।
আকাশ কথাগুলো বলে ডানহাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে চোখের কোণে লেগে থাকা পানি ছিটকে ফেলে। এরপর বড় বড় পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে-ও কোণার দিকে একটি ঘরের দরজার সামনে তার বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। এগিয়ে গিয়ে তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে শ’ক্ত গলায় বলে,
– চিন্তা কর না, তোমাকে না মে’রে, ম’র’ব না। তোমার মতো অ’মানুষ কে মা’রা’র জন্য সন্ধ্যামালতীকে ছাড়া একদিনের জন্য হলেও বাঁচতে চাই।
একটু থেমে ঢোক গিলে বলে,
– হাজার হোক বাবা তো, তাই তোমাকে মা’র’তে একটু সময় লাগছে।
লাস্ট কথাটা শ’ক্ত করে বলতে গিয়েও পারলো না। গলা বেঁধে আসছিল। আকাশ আর এখানে দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে তার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সাইফুদ্দীন নওয়ানের চোখেমুখে অসহায়ত্ব, ছেলের কথাটা একদম কলিজায় গিয়ে লেগেছে। বুকটা ভার লাগলো খুব। মলিন মুখে আকাশের দিকে চেয়ে রইল।
আকাশ ডিভানের উপর বসে আছে। মাথা নিচু তার। দু’হাত জমা করে কপালে ঠেকিয়ে রেখেছে। বার বার সন্ধ্যার থুতু নিক্ষেপ করার দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। কিছুতেই ভুলতে পারছে না। সন্ধ্যা তাকে এতোটা ঘৃণা করে! সে যে মানতে পারছে না। শ্বাস নিতে ক’ষ্ট হচ্ছে আকাশের। তার সন্ধ্যামালতীর চোখে ঘৃণা দেখার মতো সাহসী সে নয়। সৌম্য’র মতো সন্ধ্যামালতী-ও কি ভাবে, সেই সন্ধ্যাদের সাথে প্রতিটি ঘটা অঘটনের সাথে জড়িত? তার বাবা এসবের পিছনে আছে, সে তো জানতো না। কিন্তু সে কিভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে? যেখানে তার ঘরেই শত্রু বসে আছে? তাকে অবিশ্বাস করাটাই তো স্বাভাবিক। কথাগুলো ভেবে মুখটা মলিন হয় আকাশের।
কোথায় যেন শুনেছিল,,
হয় নারীরা পুরুষদের গড়ে,
নয়তো নারীদের ছোঁয়ায় পুরুষেরা ধ্বসে পড়ে।
একটাসময় কথাটা একদম ভিত্তিহীন মনে হলে-ও আজ ভীষণ অর্থপূর্ণ লাগলো আকাশের কাছে। সে তো কখনো চায়নি কোনো নারী এসে তার জীবন গড়ে দিক। আর না তো চেয়েছে, কোনো নারীর ছোঁয়ায় তার জীবনে ধ্বস নামুক। কিন্তু সন্ধ্যা তার জীবনে এসেছিল, তারপর হারিয়ে-ও গেল। আবার-ও ফিরে এলো, তবে তাকে ভুলে গিয়ে!
আকাশের মেয়েদের সাথে জড়াতে না চাওয়ার কিছু কারণের মাঝে একটি কারণ ছিল,, তার ধারণা, মেয়েরা ভালোবাসতে জানেনা। সত্যি-ই সন্ধ্যা তাকে ভালোবাসলো না! ভালোবাসলে তো একটু হলে-ও বিশ্বাস করত। কিন্তু সন্ধ্যা তো আবেগে ভেসে তাকে তার কিছু অনুভূতি জানিয়েছিল। সময়ের সাথে সেসব আবেগ উড়ে-ও গিয়েছে।
আকাশ যেসব কারণে মেয়েদের সাথে জড়ানোর ব্যাপারে কখনো বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট দেখায়নি, সেসবের মাঝে একটি কারণ তার সাথে ফলে গেল।
আসমানী নওয়ান ছেলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। আকাশ যেই যে মাথা নিচু করে স্ট্যাচু হয়ে বসে আছে। একটু-ও নড়চড় নেই। আসমানী নওয়ানের হাতের বরফ। থা’প্প’ড় দু’টো খুব জোরে দিয়েছিল। আকাশের ফর্সা গালে হাতের ছাপ পড়েছে, আসমানী নওয়ান নিচে থাকতেই খেয়াল করেছে এটা। ছেলের ক’ষ্টে তার বুকটা ভারী হয়ে আসছে। মৃদুস্বরে ডাকল,
– আব্বা?
মায়ের কণ্ঠে আকাশ মাথা উঁচু করে তাকায়। আকাশের লাল চোখজোড়া আসমানী নওয়ানের চোখে পড়ে। তিনি মৃদুস্বরে বলেন,
– তুমি তো জানো আব্বা, জান্নাতের সাথে কত কিছু ঘটছে,, এরপর-ও ওর সাথে এইরকম ব্যবহার করলে ওর মানসিক অবস্থা খারাপ হইয়া যাইবো।
আকাশ হঠাৎ-ই উঠে দাঁড়িয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। ভাঙা গলায় বলে,
– আমি সব জানি মা। কিন্তু সন্ধ্যামালতী আমার থেকে শুধু পালাতে চাইছিল। তুমি জানো? ও অন্য একটা ছেলের হাত ধরে হাঁটছিল মা। এসব দেখে আমার মাথা ঠিক ছিল না। ও আমায় ভুলে গিয়েছে মা। সন্ধ্যামালতী আমাকে বলে গিয়েছেল, আমি যেন কোন এক সন্ধ্যায় ওকে মনে করি। কিন্তু সন্ধ্যামালতী আমাকে মনে রাখতে বলে, ও নিজেই আমাকে ভুলে গিয়েছে মা।
আকাশের কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে। আসমানী নওয়ানের চোখজোড়া ভিজে যায়। তার ছেলে কয়টামস হলো কত ক’ষ্ট পাচ্ছে সে তো জানে। কি বলবেন তিনি? কিন্তু সন্ধ্যাকেই বা কি বলবেন? মনের উপর কি কারো জোর চলে?
আসমানী নওয়ান আকাশের পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন,
– আব্বা তুমি নিজেকে একটু শ’ক্ত কর। আমি জান্নাতরে বোঝামু।
আকাশ তার মাকে ছেড়ে ঝাপসা চোখজোড়া মুছে নেয়। আবার-ও ডিভানে বসে চোখজোড়া বুজে বলে,
– তুমি যাও মা। আমার ভালো লাগছে না।
আসমানী নওয়ান ছেলের পানে চেয়ে রইল। ছেলেকে কি বলে সান্ত্বনা দিবেন তিনি? তার কাছে যে শব্দ নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের গালে বরফ লাগালে আকাশ ছ্যাঁত করে উঠে বলে,
– কি করছ?
– বরফ লাগিয়ে দিচ্ছি। গাল লাল হয়ে আছে।
আকাশ মায়ের হাত সরিয়ে দিয়ে আবার-ও চোখ বুজে নেয়। বা হাত কপালের উপর রেখে বিষন্ন কণ্ঠে বলে,
– আমার উপরে ব্য’থা লাগেনি মা। পারলে ভেতরের ব্য’থা সারানোর মলম ‘আমার সন্ধ্যামালতী’ কে এনে দাও।
আসমানী নওয়ান অসহায় চোখে চেয়ে রইল ছেলের পানে।
অনেকক্ষণ থেকে টেবিলের উপর আকাশের ফোন বাজছে। আকাশ বিরক্ত হয়। এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফোন নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে নিয়াজ বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– আকাশ খুবই ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে কল করেছি। গুড নিউজ বলতে পারো।
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কি?
নিয়াজ দ্রুত বলে,
– তোমার বউ সন্ধ্যা, আর ওর ভাই কি যেন একটা নাম। ওরা দু’জনেই বেঁচে আছে। ভাবো একবার!
আকাশ বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– তোমার কি খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই। ডাক্তার হয়ে এতো ফা’ল’তু টাইম কোথায় পাও? পেসেন্টদের বসিয়ে রেখে ফা’ল’তু কাজে বিজি থাকো। এইজন্যই তোমার হসপিটালের পেসেন্টরা সুস্থ হয়না সহজে।
আকাশের কথা শুনে নিয়াজ চোখমুখ কুঁচকে নেয়। মানে এই আকাশের ভালো করতে গিয়ে এখন তাকেই কথা শোনাচ্ছে। ভাবলো এ বউয়ের শোকে আধ-পা’গ’ল হয়ে আছে। খবরটা দিলে খুশি হবে। উল্টে তাকেই কথা শোনাচ্ছে। তার ভালো মানুষ হওয়াই ভুল হয়েছে। আকাশের মা’র খেয়েও আবার তার-ই উপকার করতে যায়।
নিয়াজ রে’গে বলে,
– আমি তোমার উপকার করছিলাম।
আকাশ রে’গে বলে,
– আমি বলেছি তোমাকে, আমার উপকার করতে?
নিয়াজ বিরক্ত হলো। সত্যি-ই সে রোগীকে ওয়েটিং-এ রেখে একে সংবাদ দিতে এলো। কিন্তু ব্যবহার দেখে নিয়াজের নিজেকেই দু’টো থা’প্প’ড় দিতে ইচ্ছে করল। তবুও নিজেকে দমালো। ভাবলো, আকাশ হয়তো ভাবছে, সে মজা করছে। কিন্তু না। সে তো আজকে দেখল ওই ইরা নামের মেয়েটির সাথে এরা সবাই। অতঃপর বলে,
– তুমি বিশ্বাস করছ না তো? ওরা হসপিটালেই আছে। ওয়েট, আমি পিক উঠিয়ে দিচ্ছি।
আকাশ রে’গে বলে,
– সন্ধ্যামালতীর পিক উঠালে তোমার দু’হাত একদম কে’টে ফেলব নিয়াজ।
নিয়াজ হতাশ হয়ে বলে,
– রাখছি।
আকাশ এবার শান্ত কণ্ঠে বলে,
– ওরা হসপিটালে কি করছে?
নিয়াজ ভাবলেশহীনভাবে বলে,
– এসে দেখে যাও। আমার সময় নেই। পেসেন্ট ওয়েট করছে।
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– বলো।
নিয়াজ একটু হেসে বলে,
– প্লিজ বললে বলতে পারি।
নিয়াজের ফা’জ’লা’মি ধরতে পেরে আকাশ রে’গে বলে,
– থা’প্প’ড় খাবে।
নিয়াজ বিরক্ত হলো। কিন্তু আর কথা না বাড়িয়ে বলল,
– ইরা নামের একটি পেসেন্ট এর সাথে আছে দেখলাম।
আকাশ অবাক হয়ে বলে,
– কোন ইরা?
– আমি কিভাবে জানবো কোন ইরা!
– পিক উঠিয়ে দাও তো।
নিয়াজ চোখ বড় বড় করে বলে,
– পা’গ’ল না-কি! মেয়েদের পিক তুলতে গিয়ে গণপিটুনি খাবো!
আকাশ ভাবলেশহীনভাবে বলে,
– তো খাও!
কেমন বে’য়া’দ’ব দেখ। কিভাবে তাকে মা’র খেতে বলছে! নিয়াজ রে’গে খট করে কল কেটে দেয়। আকাশ বিরক্ত হলো। আসমানী নওয়ান এগিয়ে এসে বলে,
– কোন ইরা আব্বা?
আকাশ ফোন রেখে বলে,
– বুঝতে পারছি না মা। রেডি হও তো। হসপিটালে গিয়ে একটা খোঁজ নিই।
আসমানী নওয়ান সম্মতি দিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন একটা। আর সময় ন’ষ্ট না করে রেডি হওয়ায় জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আকাশ, আসমানী নওয়ান আর শিমু হসপিটালে এসে আইসিইউ রুমের বাইরে ইরার মাকে পেয়ে যায়। ইরার মা, আসমানী নওয়ান দু’জনেই দু’জনকে দেখে ভীষণ অবাক হয়। এরপর ইরার মা,, আসমানী নওয়ান, আকাশকে সব ঘটনা বললে আসমানী নওয়ান কান্নায় ভেঙে পড়েন। আকাশ চোখমুখ শ’ক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। ইরার মা হিজাবের কোণা দিয়ে চোখ মুছলেন।
শিমুর মুখে বিস্ময়ের ছাপ। সাথে ইরার কথা ভেবে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা যে তাদের আপন কেউ এটা সে আজকেই জানলো। তার মাকে-ও কল করে জানিয়েছে। ইরাকে দেখতে আসছে সে। শিমু সবার উপর একটু রে’গে আছে। তাকে কেউ কিছু জানায়নি এজন্য।
আসমানী নওয়ান নাক টেনে আফসোসের সুরে বলে,
– তুমি ইরা মায়ের একটা খবর দিলে না ভাবি! আকাশ এই শহরে কত খুঁজেছে তোমাদের। আমি তো তোমার বাবার বাড়ি চিনতাম না।
ইরার মা মলিন গলায় বলে,
– তোমার স্বামীকে খুব ভ’য় লাগে আসমানী। আমার আধ-ম’রা মেয়েটার যদি কিছু করে ফেলত! সেই ভ’য়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করার সাহস পায়নি।
আসমানী নওয়ান কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
– আমার ভাইজান এর একটা খবর দিতে পারতে! এই কাজটা একদম ঠিক করনি। আমি আমার ভাইজানকে শেষ দেখা টা-ও দেখতে পারলাম না।
ইরার মা কিছু বলল না। আকাশের বাবাকে ভরসা করেন না তিনি। আল্লাহ না করুক, তাদের যদি কিছু করে দিত! সে জানে, তার জায়গা থেকে সে কেমন পরিস্থিতিতে ছিল।
আকাশ গটগট পায়ে হেঁটে অনেকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। এতো চাপ নিতে পারছে না সে। তার বাবার আর কয়টা কুকীর্তি, সে ছেলে হয়ে হজম করবে? একদিকে বলতে গেলে সন্ধ্যাকে হারিয়ে-ই ফেলেছে, এতেই আধ-ম’রা হয়ে গিয়েছে। সাথে বাবার করা কাজ একটার পর একটা সামনে আসছে। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল। কাঁপা কণ্ঠে বিড়বিড় করল,
– আল্লাহ সহ্যশক্তি দাও।
ইরার মা শিমুকে নিয়ে একটুখানি ক্যান্টিনে গিয়েছে। আসমানী নওয়ান নিজেকে সামলে আইসিইউ রুমে প্রবেশ করতে গেলে তখন-ই রুম থেকে সৌম্য বেরিয়ে আসে। আসমানী নওয়ান অবাক হয়ে বলে,
– তুমি এইখানে?
সৌম্য নিজেও অবাক হয়, আসমানী নওয়ানকে এখানে দেখে। আকাশের ফ্যামিলিটাকেই তার সহ্য হচ্ছে না। সেখানে আবার-ও ইনি। তাও আবার ইরার রুমে যেতে চাইছিল। ইরার সাথে খারাপ কিছু করবে না-কি! অতঃপর রে’গে বলে,
– আপনি এখানে কেন এসেছেন? বের হন এখান থেকে।
আসমানী নওয়ান হতভম্ব হয়ে যায়। সৌম্য’র ব্যবহার তার একটু-ও ভালো লাগলো না। তবুও নিজেকে সামলে বলে,
– সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। আমি ইরা মা কে দেখতে এসেছি। আর ভালোভাবে কথা বলো। আমি তোমার গুরুজন।
সৌম্য আগের চেয়ে-ও দ্বিগুণ রে’গে যায়। অতঃপর রাগান্বিত স্বরে বলে,
– আপনাদের মতো মানুষদের সাথে আমি এর চেয়ে ভালোভাবে কথা বলতে পারিনা। আমি কখনোই আপনাকে ইরার রুমে ঢুকতে দিব না। আপনারা আসলেই মানুষ তো! আর কত মানুষের ক্ষ’তি করবেন?
আসমানী নওয়ানের এবার সহ্য করতে না পেরে সৌম্য’র গালে ক’ষিয়ে একটা থা’প্প’ড় মেরে দেয়। তখন-ই সেখানে আকাশ, ইরার মা আর শিমু এসে দাঁড়ায়। সৌম্য’র বলা লাস্ট কথাগুলো আর আসমানী নওয়ানের সৌম্যকে থা’প্প’ড় মা’রা দেখে সকলে হতভম্ব হয়ে যায়।
আসমানী নওয়ান সৌম্য’র উদ্দেশ্যে রাগান্বিত স্বরে বলেন,
– তুমি ভীষণ-ই বে’য়া’দ’ব একটা ছেলে। জ্যোস্নার ছেলে এরকম কি করে হতে পারে আমি তো ভাবতেই পারছি না। ভুলেও আমার সামনে বে’য়া’দ’বি করবে না। আমি আমার সন্তানদের যতটা ভালোবাসতে জানি, ততটা শাসন-ও করতে জানি। তোমাকে আদব শেখাতে আমার দু’দিন-ও সময় লাগবেনা।
কথাগুলো আসমানী নওয়ান শ’ক্ত করে বললেও তার চোখের কোণে পানি লেগে আছে। আকাশ এগিয়ে এসে তার মাকে সরিয়ে দিয়ে সৌম্য’র কলার ধরে সাইড দিকে নিয়ে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– তুই ইরার রুমে ঢুকতে না দেয়ার কে? আমি আমার মামাতো বোনের রুমে যাব, আমার মা তার ভাতিজির রুমে যাবে,, তুই বাঁধা দেয়ার কে রে?
সৌম্য বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মামাতো বোন? ইরা তো তার-ও মামাতো বোন। আকাশ আবার-ও সৌম্য’কে গায়ের জোরে ধাক্কা দেয়। সৌম্য পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তার চোখেমুখে বিস্ময়।
আসমানী নওয়ান আর ইরার মা এগিয়ে এসে আকাশকে টেনে সরিয়ে দিলে আকাশ সৌম্য’র দিকে শ’ক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আইসিইউ রুমে প্রবেশ করে।
আকাশের মা দুর্বল শরীর টা টেনে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসল। মন, শরীর সব দুর্বল লাগছে তার।
ইরার মা এগিয়ে এসে অবাক হয়ে বলে,
– তুমি তো এমন ছেলে নয় সৌম্য। কাউকে অ’সম্মান করে কথা বল না। তাহলে তোমার খালার সাথে এমন করলে কেন বাবা?
সৌম্য বিস্ময় চোখে তাকায় ইরার মায়ের দিকে।এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে আসমানী নওয়ানের দিকে তাকালে দেখল ভদ্রমহিলা মায়ামায়া দৃষ্টিতে সৌম্য’র দিকেই চেয়ে আছে। চোখজোড়া জলে ভরা। সৌম্য আসমানী নওয়ান এর দিকে দৃষ্টি দেখে ঢোক গিলল। এরপর থেমে থেমে বলে,
– উনি আমাদের কে আন্টি?
ইরার মা অবাক হয়। সে তো ভেবেছিল, এরা সবাই সবাইকে চিনে। তার কারো সাথে যোগাযোগ নেই। তাই সে এসব খবর জানে না। অতঃপর কণ্ঠে বিস্ময় ঢেলে বলেন,
– আসমানী তোমার বড় খালা। আর শিমুর মা, ওর নাম ‘ তারা’ সে তোমার ছোট খালা। আর জ্যোস্না তো তোমার-ই মা। তোমাকে যে সেদিন বললাম, তোমার মায়েরা তিনবোন। তুমি জানতে না?
সৌম্য বাকহীন হয়ে চেয়ে রইল আসমানী নওয়ান এর পানে। ইরার মা এগিয়ে গিয়ে বলে,
– আসমানী তুমি সৌম্য কে চিনতে না?
আসমানী নওয়ান মলিন গলায় বলেন,
– চিনতাম না। আগে তো কখনো দেখি-ই নি ওকে। জান্নাতকে আনার পর চেহারা দেখে মনে হয়েছিল এটা আমার বোনের ছেলে।
একটু থেমে সৌম্য’র দিকে চেয়ে শক্ত কণ্ঠে বলেন,
– ওর কু’লা’ঙ্গা’র বাপ আমাকে বলেছিল, সৌম্য না-কি সন্ধ্যার সৎ ভাই। আকাশের বাপ, আর এই সৌম্য’র বাপ, এই দু’টো মানুষের পরিণতি যে কত ভ’য়ংক’র হবে এইটা তুমি কল্পনাও করতে পারবা না ভাবি। আমার সহ্যের সীমা ভেঙে দিল এই দু’টো মানুষ।
কথাগুলো বলে থামলো আসমানী নওয়ান। আজ আর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেন না তিনি। আসছে না কেন যেন।
সৌম্য স্তব্ধ চোখে চেয়ে আছে। তার অনুভূতি ঠিক কি! নিজেও বুঝতে পারছে না।
সন্ধ্যা রুম থেকে বাইরে বেরতে যাচ্ছিল, তার আগেই বাইরে প্রত্যেকের বলা কথা সব শুনেছে সাথে বুঝেছেও। তার মাথা ঘুরছে। এটা কোথায় এসে পড়ল? যেন সব একই সূত্রে গাঁথা। হঠাৎ-ই দরজা ঠেলে ভেতরে আকাশকে ঢুকতে দেখে সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়।
আকাশ সন্ধ্যাকে দেখে অবাক হলো না। মাত্র রা’গ করে এই রুমে প্রবেশ করলেও সন্ধ্যার মুখ দেখে চোখেমুখে শীতলতা ভর করে।
কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা যেন আকাশের মনে কিছু সময়ের জন্য ঢেকে গেল। তার শুধু মনে পড়ল, সে সন্ধ্যাকে বের করে দিয়ে মুখের উপর ঠাস করে দরজা আটকে দিয়েছিল। তখন বলেছিল, সামনে দেখলে জ্য’ন্ত ক’ব’র দিবে। অথচ এখন সব ভুলে খেই হারিয়ে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে নেয়। অপরাধীর ন্যায় বলে,
অন্তঃদহন পর্ব ২৪
– স্যরি!
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশের ব্যবহারে সে অবাক না হয়ে পারে না। সে কতকিছু করল, মুখে থুতু পর্যন্ত দিয়েছে। আসার পথে বাইকে বসে বসে এটার জন্য চোখের পানি ফেলেছে সে। অথচ এখন আকাশ নিজেই তাকে স্যরি বলছে। ভাবনার মাঝেই আকাশ সন্ধ্যাকে ছেড়ে সন্ধ্যার গালে দু’হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলে,
– ঘৃণার পরিমাণ কমাও। এতো লোড নিতে পারি না! দুর্বল হার্টের পেশেন্ট আমি।
সন্ধ্যা আকাশের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না। আকাশের দিকে বোকা চোখে চেয়ে রইল।