ধূসর রংধনু পর্ব ২৩

ধূসর রংধনু পর্ব ২৩
মাহিরা ইসলাম

আমার ভীষণ প্রিয় একমাত্র চঞ্চলা হরিণী,
কথাগুলো তোমায় আজ ভীষণ করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। তবে তোমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলার সাহস আমি যুগিয়ে উঠতে পারছি না মামনী।আমার পক্ষে সেই সাহস যোগানোটা সম্ভব ও নয়।তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা এমন জটিল পন্থার চেয়ে এই পন্থা টাই কি সহজ নয়? তাই তো এই পন্থা বেঁছে নেওয়া।
আজ কোনো অভিমানের তারিপে এই চিরকুট নয়।নয় কোনো অভিযোগের তাড়না।তাই তো তুমি সম্মোধনটুকু আজ চিরস্থায়ী। কথাগুলো বলা যে তোমায় আমার ভীষণ প্রয়োজন বলে মনে হলো।
হয়তো আজ না লিখলে আর কোনোদিন বলার সুযোগ ও পাবো না।সময় ঘনিয়ে আসছে যে। যার যার শরীরের অবস্থা সে নিজে ঠিকই ঠাহর করতে পারে।

প্রিয় মামনী তুমি যখন চিরকুটটি পড়বে হয়তো আমি আর তোমাদের মাঝে থাকবো না।তুমি হয়তো তখন আমায় আর খুঁজে পাবে না। আমায় স্পর্শ করতে চাইলেও পারবেনা। আমি জানি এই ড্রয়ারের দীর্ঘ চিরকুটের ভাঁজ থেকে তুমি কখনো না কখনো অবশ্যই তা খুঁজে পাবে।জানি তখন তোমার মনে তখন হাজারো অভিমান অভিযোগ আমার প্রতি জমা হবে।আজ আমি তোমার সেই অভিমানটুকু ভাঙাবো না।আমি চাইবো এই অভিমানের অস্তিত্ব টুকু তুমি আজন্ম কাল নিজের মাঝে জমা রাখবে।আর আমায় অবসরে স্মরণে রাখবে।কখনো দীর্ঘশ্বাসের বেড়াজালে আমায় তুমি স্মরণ করবে।আমি তোমার অভিমান হয়ে জমা হবো তোমার ছোট্ট হৃদয়কুটিরে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজ আমি তোমার অভিমান ভাঙাবো না।বলবো তোমায় বাস্তবতাটুকু মেনে নিতে।জীবনে হাসি খুশি জীবন যাপন করতে।ধৈর্য্য ধরে জীবনের বাকিটা পথ তোমার প্রিয়জনের সাথে পাড়ি দিতে।তুমি যতক্ষণে চিরকুটি পড়বে ততক্ষণে জেনে থাকবে আমার মরণব্যাধি রোগের কথা।আসলে এটা হওয়ারই ছিল।আমিও চাইতাম তোমার মায়ের নিকট যেন আমি খুব দ্রুত যাওয়ার সুযোগ পাই। রব আমার সেই আশা পূর্ণ করেছে।তিক্ত ঔষধ পান করার বেড়াজাল থেকে মুক্ত থেকে দ্রুতই পরলোক গমন করা কি সহজ পন্থা নয় বলো?

দুনিয়াতে বেঁচে থাকার জন্য কি বা আছে একমাত্র তুমি ছাড়া।মানুষ যে কিসের তাগিদে এতটা জনম অথবা অমর থাকার স্বাদ গ্রহণ করতে চায় কে জানে।আমি তো দুদিনের দুনিয়ায়ই হাঁপিয়ে উঠেছি।তবে অন্যান্য মানুষের এই অদ্ভুত ইচ্ছে পোষনের হেতু কি হতে পারে।কি এমন রঙিন চশমা তাদের পড়নে।যারা তা চাইলেও খুলতে পারে না।
আমার একমাত্র আমানত তুমি মামনি।তোমায় ও আমি একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তির নিকট অর্পন করে যাবো শেষ সময়। চাইবো সে যেন তোমায় আমার অবর্তমানে ভীষন দাপুটের সঙ্গে আগলে রাখে।বিপদে তোমায় সাহায্য করবে। ক্লান্ত দুপুরে তোমার কোলে মাথা রেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।তোমার বৈরাগী তে সে তোমায় শাসন করবে।তোমায় বিগড়ে যেতে দেখলে সে তোমায় আদুরে ধমকাবে।তোমার সুখের সময় সে তোমায় আদুরে বিড়ালছানার মতো কোলের ভাঁজে আগলে নেবে।

দুঃখের সময় সে তোমার চোখের অশ্রু মুছিয়ে দেবে।তোমার হাতটাকে শক্ত করে ধরে রাখবে।তোমার সফলতার আগ মুহুর্তে তুমি যেন হেরে না যাও তোমায় আত্মবিশ্বাস যোগাবে।ভালোবাসার অসীম পরিনয়ে তোমায় প্রতিমুহুর্তে সে বিদ্ধস্ত করবে।প্রেমের জোড়ারে তোমায় ভাঁসাবে।
আমি চাই তুমি যেন তার প্রতি তার প্রাপ্য সকল দ্বায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করো।আমি কার কথা বলছি তুমি বুঝতে পারছো তো মামনি।আমি জানি তুমি সব বুঝতে পারবে।কারণ তোমার মনের প্রনয়ের ঘন্টা যে বেঁজে গিয়েছে। সে তুমি যতই অশিকার কতো না কেন। একদিন তার কাছে তুমি ঠিক হার মানবে।আমি দোয়া করি আমার মিষ্টি রাজকন্যা তার নিকট সবসময় হাসিখুশি থাকুক।তুমি আমার জন্য দোয়া করো মামনী যেন ওপারে বাকিটা পরজীবন তোমার মায়ের সাথে আমি অবলীলায় কাটাতে পারি।
ইতি
তোমার জন্মদাতা পিতা

চিরকুট পড়া শেষে তাসফি তা টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললো। যেই সংসারে ভালোবাসা নেই সেই সংসারে সে থাকবে কেন।সে আর চায় না ওই অহংকারী পুরুষের সান্নিধ্যো পেতে।সে চায় না জোড় করে কারো সঙ্গে ঘর বাঁধতে। তাহলে এই চিরকুট রাখারই বা কি প্রয়োজন।এই চিরকুটে তার আর তার বাবার মাঝে ভালোবাসা,মান অভিমানের সম্পর্কে লেখা নেই।রয়েছে অতীতের কিছু তিক্ত বাক্যলাভ সঙ্গে সংসার সাজানোর আর্জি।কিন্তু তাসফি তো তা চায় না।যতবার সে এই চিরকুট টি পড়বে কিছু অসহ্য অনুভুতি তাকে তাড়া করে বেড়াবে। অস্তিরতায় তোলপাড় করে তুলবে তার হৃদয়কে। কিন্তু তা তো সে চায় না।তাছাড়া সে চায় না তাদের বাবা মেয়ের চিরকুটে মিষ্টি কথনের মাঝে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির বিষয়ে অযাচিত কিছু কথা ফুটে থাকুক।

তাসফি চিরকুটের টুকরো গুলো বেলকনিতে গিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে রুমে এসে ওয়াশরুম ঢুকলো।
আবছা অবয়ব টি এগিয়ে এলো।
খুব যত্ন করে চিরকুটের টুকরোগুলো একটি একটি করে তুলে নিলো।কি করবে সে এগুলো দিয়ে?
এই প্রত্যেকটা ছোট্ট খন্ড সে নিজ হাতে জোড়া লাগাবে।হোক অস্পষ্ট। তবুও স্মৃতি তো থাকবে।
কোনো একদিন দীর্ঘ বর্ষণের পড়ে হালকা মেঘরাশি সরে গিয়ে আকাশে সাতরঙা উজ্জ্বল রংধনুর দেখা মিলবে। সেদিন সে এই চিরকুট খানা এই রমণীর হাতে তুলে দিবে। রমণী তখন আবেগে আপ্লূত হয়ে কেঁদে ফেলবে। সেদিন সে যত্ন করে তার চোখের অশ্রুকণা গুলোকে ঠিক মুছে দেবে।ঠিক মুছে দেবে।

গম্ভীর এক সকাল।কাল শত গুঞ্জনের মাঝে আচ্ছাদিত তাসফিদের বাড়িটা আজ নিস্তব্ধ।
গতকাল নিস্তব্ধ’র বন্ধরা সবাই মোস্তফা সাহেবের মাটির পর বাড়ি ফিরে গিয়েছিল।আজ আবার সকাল সকাল এসে পড়েছে।মেয়েটাকে এখন একদমি একা রাখা যাবে না।তার মনের কন্ডিশন এখন ঠিক নেই।একা একা থাকলে আরো ডিপ্রশনে চলে যাবে। যত দ্রুত সম্ভব ওসমান ভিলায় তাসফিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে।তবে যদি মেয়েটা একটু দমবন্ধকর অনুভুতি থেকে রেহায় পেতে পারে।তাছাড়া একটু গল্প গুজবের মাঝে থাকলে মানের ভার অনেকটাই হালকা হয়ে আসবে ওর।
তাইতো সকাল সকাল সবাই চলে এসেছে।বন্ধুরা এসে দেখলো নিস্তব্ধ’র টিকিটাও নেই এখানে।কাল তো এখানে রেখেই গিয়েছিল তাকে। তবে গেল কই।খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো সে বাসায় নিজের রুমে ঘুমাচ্ছে। কি আশ্চর্য এখন কি তার ঘুমানোর সময়।

অতঃপর সিদ্ধান্ত হলো এখানে তারা সবাই থাকুক সুজন যাক নিস্তব্ধ কে নিয়ে আসতে।
সুজন বের হয়ে যাচ্ছিলো নিস্তব্ধ কে বাড়ি থেকে আনতে।বেটা কিনা এমন একটা করুণ মুহুর্তে বাড়ি বসে পরে পরে ঘুমাচ্ছে। কোথায় বউকে একটু সান্ত্বনা দেবে তানা ঘুমানো হচ্ছে বেলা দশটা পর্যন্ত।
সুজন গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় ওপার পাশ হতে তখনই আশা ভেতরে ঢুকছিলো। সুজনের অন্যমনষ্ক থাকায় আশা ঠাস করে তার বুকের সাথে ধাক্কা খেল।
সুজন বুকে হাত দিয়ে ব্যাথাতুর শব্দ করলো।
সামনে তাকিয়ে আশার মুখখানা অবলোকন করতেই কন্ঠে জগৎের বিরক্তি ঢেলে বলল,

-” এই যে মেয়ে তোমার সমস্যা কি বলোতো।যখনি দেখা হয় আমায় ধাক্কা লাগিয়েই যাচ্ছো,লাগিয়েই যাচ্ছো। সেদিন দাঁত ভাঙতে চাইলে,আর আজ বুক ভাঙতে চাইলে।কবে না আমার শক্তপোক্ত হৃদপিণ্ডটাই ভেঙে ফেল।যে সাংঘাতিক মেয়ে তুমি।তোমায় দ্বারা কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।আচ্ছা তোমার কি ধাক্কা খাওয়ার ব্যামো আছে নাকি?এ তো মহারোগ তাহলে। আমার কাছে এসো , আমি তোমায় প্রেসক্রিপশন লিখে দিবো। মাসখানেকের মাঝে তোমার এই রোগ সেরে যাবে দেখে নিও।”
সুজনের অবলীলায় কথার তুবড়ি ফোটাতে দেখে আশা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
আর সেই বা কখন আজ ধাক্কা মারলো। মানলাম সেদিন নাহয় সে অন্যমনষ্ক ছিল।কিন্তু আজ তো সে অন্যমনষ্ক ছিল না।বরং এই লোকটা ছিল কারো ধ্যানে৷ তাইতো আশা সরে যাওয়ার পরেও ঠিক তার দিকে এসে ধক্কাটা মেরে দিলো আর এখন ঠিক তার ঘাড়েই দোষটা চাপিয়ে দিল৷ মহা বজ্জাত লোক তো।
একই অঙ্গ তার কত রঙ। ইয়া খোদা।
আশা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল,

-“কিন্তু এবারের ধাক্কাটা তো আপনিই দিলেন ভাইয়া।”
সুজন চোখ কপালে উঠিয়ে বলল,
-” একদম মিথ্যা কথা বলবে না অসভ্য মেয়ে।এই সুজন কখনো বাকা পথে হাঁটে না।সে সবসময় সোজা ঘাটের মাঝি। আর কি বললে?ভাইয়া?
আমি তোমার কোন জনমের ভাইয়া।তুমি তো আমার ছাত্রী আর আমি তোমার স্যার।সম্মান দিয়ে কথা বলবে।এইভাবে চোখমুখ কুঁচকে কথা বলো তুমি আমার সঙ্গে কি করে।”
আশা ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” স্যার তো আপনি কলেজের ভেতরে।বাইরে তো আর নন।ভাইয়া যেহেতু বলবো না তবে কি চাচা ডাকবো।”
সুজন দিলো এক রাম ধমক,

-” অসভ্য মেয়ে।আমার মতো এত হ্যান্ডসাম যুবককে তোমার কি চাচা মনে হয়।বেয়াদব মেয়ে।”
বিরবির করতে করতে সুজন বেরিয়ে গেল।
আশা ভেঙচি কাটলো।
-” ঝগড়ুটে লোক একটা। ইচ্ছে করে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে।কোন কুক্ষণে যে সে এই লোক কে ভালোবাসতে গেল কে জানে।”
আশা এসে তাসফির পাশে বসে দশ মিনিট সান্ত্বনার বানী দিতে না দিতেই তার চাঁচির ফোন। এক্ষুনি যেতে হবে।তার খুব খারাপ লাগছে এমন একটা পরিবারে থাকে সে যে নিজের ইচ্ছে মোতাবেক বেস্টফেন্ডের সঙ্গে বসে একটু তার দুঃখের সাথী হবে তারও উপায় নেই।দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশা আবার বেরিয়ে পড়লো বাড়ির পথে।
সুজন নিস্তব্ধকে নিয়ে আসতে গেলেও সে আসেনি।

বলল তার সময় হলে সে ঠিক যাবে।সুজন ভেবে পায় না এই ছেলের এসবের নাটকের মানে কি।
সুজন এসে দেখলো তাসফির রুমের মাঝে কেমন থমথমে ভাব।সকলের মুখে অন্ধকার। তাসফি বসে আছে খাটের উপর। অনিমা বেগম, দাদু আর বাসন্তী বসে তাসফির শিওরে।আর তার বন্ধুরা মেঝেতে।
সুজন কিছু বুঝতে পারছেনা।মনে হচ্ছে এখানে কোনো ভাইরাস ঢুকে পড়েছে আর সকলের মুখে থমথমে রোগ সৃষ্টি করে গিয়েছে।
সুজন ও সকলের মতো মেঝেতে বসে সৃজন কে খুঁচিয়ে বলল,

-“কি হয়েছে এভাবে থম মেরে আছিস কেন সব?”
সৃজন থেমে থেমে দুমিনিট আগে তাসফির দেওয়া ঘোষণা সুজন কে বলে শোনালো,
-” কিন্তু আমি তো আর ওসমান ভিলায় যাচ্ছি না দাদু।
ডাঃ নিস্তব্ধ ইয়াসার কে আমি ডিবোর্স দিতে চাই।অনেক তো হলো তাসের ঘর করা।যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে সংসার টিকবে কেমন করে।জানি বলবেন ভালোবাসা ব্যতীত অনেকে আজীবন কাল সংসার করে যাচ্ছে। কিন্তু আমার দ্বারা ভালোবাসা ব্যতীত কোনো সংসার করা পসিবল নয়।তাছাড়া বাবাই যেহেতু বিয়েটার ভিত্তি ছিল তবে যেখানে বাবাই নেই সেখানে আর বিয়েটার কি দরকার।আমার দিন আমি ঠিক চালিয়ে নিতে পারবো।কথাটা আপনার নাতি কে স্পষ্ট করে বলে দেবেন দাদু।”

ধূসর রংধনু পর্ব ২২

তাসফির এই কয়েকটা বাক্যলাভে পুরো রুমে যেন বিনা মেঘে বর্জ্যপাত হলো।সবার মুখ ভাইরাসের আক্রমনে যেন পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো।

ধূসর রংধনু পর্ব ২৪