তাজমহল পর্ব ২৬

তাজমহল পর্ব ২৬
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

ফোন হারিয়ে তাসনুভার এমনিতেও মেজাজ ঠিক নেই। তার উপর আনিস ভাইয়ের জেরা একদম ভালো লাগছেনা তার।
আনিসের কলিগরা সবাই চলে এল কিছুক্ষণের মধ্যে। সবটা শুনে তারা তাসনুভার বন্ধুদের ঘিরে ধরেছে। জবাবদিহিতা চাচ্ছে কেন তারা এরকম বললো। বয়সে তাদের জুনিয়র। কিন্তু কথাবার্তা কি ছিঁড়ি! সরি না বলা অব্দি তারা কোথাও যেতে পারবে না।
তাসনুভা বিড়বিড়িয়ে বলল,”আমি আমার ফোন পাচ্ছি না। আর এরা আছে এদের তালে।”

সে হন্য হয়ে ফোনটা খুঁজছে। তাসনুভার বন্ধুরা আনিস আর তার কলিগদের হাতে জব্দ। রীতিমতো তর্কবিতর্ক লেগে গেছে সেখানে। তাসনুভার বন্ধুরা হার মানার নয়। এদিকে আনিস আর তার কলিগরাও এত সহজে দমবার পাত্র নয়।
প্রায় অনেকটা সময় ধরে কথা কাটাকাটির পর তাসনুভার বন্ধুরা সরি বললেও তাসনুভা কিছু বললো না।
সে পড়েছে মহাবিপাকে। ফোন হারিয়ে তার মাথা নষ্ট হওয়ার যোগাড়। এদিকে বাড়ির কেউ জানেনা সে কক্সবাজার এসেছে। ভাইয়াদের জানাতে গেলে সব শেষ। এখন সে কি করবে? ভয়ে ঘামছে সে রীতিমতো। কক্সবাজার এসেছে শুনলে বড় ভাইয়া, মেঝ ভাইয়া খেপে যাবে। কিছুতেই জানতে দেয়া যাবেনা। কিন্তু তার ফোন?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আনিস তার স্যারের সাথে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিল। তাসনুভার হঠাৎ মনে হলো তাকে আনিস ভাই সাহায্য করতে পারবে। এটলিস্ট সে অনুরোধ করলে এড়িয়ে যাবে না। নিজ থেকে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু বিপদে পড়লে মানুষ লঘুজ্ঞান হারিয়ে বসে। তাসনুভার এখন অন্যদিকে মন নেই। সে নিজেকে সামলে নিয়ে আনিসের দিকে এগিয়ে গেল। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে আনিস কপাল কুঁচকাল। তাসনুভা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
“আনিস ভাই আমার ফোনটা আসলে পাচ্ছি না। খুব টেনশনে আছি। আপনার স্যারের সাথে মিসবিহেভ করতে চাইনি। সরি স্যার।”

স্যার গম্ভীরমুখে বললেন,”ইটস ওকে। আনিস চলো।”
তাসনুভা একটু চুপসে গেল। আনিস তার দিকে তাকিয়ে বলল,”তোমাদের বাড়িতে জানিয়েছ?”
তাসনুভা চুপ হয়ে গেল। আনিস কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো। তাসনুভা একটু সময় নিয়ে বলল,
“আসলে আমি হুট করে চলে এসেছি। বাড়িতে জানাইনি।”
“ফোন কখন হারিয়েছ?”
“আমরা ব্যাগগুলো একসাথে রেখেছিলাম ওখানে বালির উপরে। ব্যাগের ভেতর আমার ফোন ছিল।”
“আর কারো ফোন ছিল না?”
“ওদের ফোন ওদের হাতে আছে। শুধু আমারটা নেই।”
“ব্যাগগুলো এলোমেলো পেয়েছিলে?”
“না ঠিকঠাক ছিল। বুঝতে পারছিনা কিছু।”
“ব্যাগ যেখানে রেখেছ সেখানে ভালো করে দেখো। হয়তো ব্যাগ থেকে পড়ে গিয়ে কোনোকিছুতে ঢাকা পড়েছে। তোমার ফোন বন্ধ ছিল?”

“না বন্ধ ছিল না।”
“চার্জ ছিল?”
“খেয়াল করিনি। মাথা কাজ করছেনা।”
আনিস কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তাসনুভা এদিকওদিক তাকাচ্ছে বারবার। টেনশনে তার হাত পা ঘামছে। আনিস তার স্যারকে কিছু একটা বলে তাসনুভাকে বলল,
“ব্যাগ কোথায় রেখেছ দেখাও দেখি।”
তাসনুভা তাকে নিয়ে গেল। বালুর উপরে জুতো ব্যাগ সবকিছু রেখে পানিতে নেমেছিল তারা। জায়গাটায় কিছু চিপসের প্যাকেটও ফেলেছে। তাসনুভা বলল,
“এখানে ছিল সবগুলো। এসে দেখি ব্যাগ থেকে ফোন উদাও। তার পাশেই আপনার স্যার দাঁড়িয়েছিল তাই সবাই ভেবেছে!”

আনিস একটু কঠোরভাবে বলল,”স্যার তোমার ফোন চুরি করবে? তুমি জানো তুমি কতবড় পোস্টে আছেন? ফোন চুরি করতে যাবে কোন দুঃখে? না জেনে কথা বলা কতটুকু যৌক্তিক?”
তাসনুভা চুপ করে রইলো। অন্য সময় হলে আনিসের এত কথার ধার ধারতো না সে। বিপদে পড়েছে বলে চুপ আছে।
আনিস জায়গাটায় খোঁজাখুঁজি করলো অনেকক্ষণ। ফোনটা পাওয়া গেল না। কেউ চুরি করেছে এটাও বিশ্বাস হচ্ছে না। সন্দেহজনক কাউকে দেখা যাচ্ছে না আপাতত। তাসনুভার দিকে তাকালো সে। তাসনুভার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে ফোন না পেলে আর বাড়ি ফিরবে না।
আনিস শেষমেশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,”ফোন না পেলে আর কিছু করার নেই।”
তাসনুভা কপালের একপাশ চেপে ধরলো। সবাই বকবে আমাকে।
আনিস বলল,”কিছু করার নেই। হোটেলে ফিরে যাও। পারলে বাড়িতে জানাও। আর একটা কথা পারলে তোমার বন্ধু বান্ধব সবার ব্যাগ চেক করো।”

তাসনুভা অবাক চোখে তাকালো। আনিস বলল,
“ওরা চুরি করেছে বলছিনা। হতে পারে তুমি ওদের ব্যাগে রেখেছ তোমার ব্যাগ মনে করে।”
“আমি ওদের ব্যাগ চেক করবো এখন?”
“নাহলে কিছু করার নেই। আমি গেলাম। সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। বাড়িতে জানিয়ে দাও।”
তাসনুভা রুক্ষ স্বরে বলল,”আপনার সাহায্য চেয়েছি বলে মনে হচ্ছে আপনি অনেক দামে উঠে গেছেন।”
আনিস কিছু বললো না। সোজা চলে গেল। মেয়েমানুষ মানেই ঝামেলা। তাসনুভাকে ওর বান্ধবীরা টেনে নিয়ে গেল। তাসনুভা এবার কাঁদছে রাগে, দুঃখে, ভয়ে।

রাতে অঝোরে বৃষ্টি নামলো। শাইনা পুলের ওখানে ছিল তখনো। ভালো লাগছিল বৃষ্টিতে ভিজতে। তাজদার এসে দেখলো সে ভিজে গিয়েছে ইতোমধ্যে। আনিসও ছিল সাথে। আনিস এখানে আছে সেটা তৌসিফ জানিয়েছে ফোনে। তারপর দু’জনে ফোনে যোগাযোগ করে একত্রিত হলো।
ভারী পায়ের শব্দ শুনে শাইনা ফিরে তাকালো। আনিস বলল,”কি রে ওখানে ভিজছিস কেন?”
শাইনা তাকে দেখামাত্রই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। বলল,”তুমি কখন এসেছ?”
“আমি তো বিকেলে এলাম। ড্রেস পাল্টে নে। একসাথে সাথে ডিনার করব।”

শাইনা একপলক তাজদারের দিকে তাকালো। তাজদার চোখ সরিয়ে নিল। শাইনা রুমে চলে গেল। সে শাড়ি পরছিল ঠিক তখুনি তাজদার রুমে ঢুকলো। শাইনা শাড়ির আঁচল কাঁধে তুলে দাঁড়িয়ে রইলো চোখ ফ্লোরে রেখে। তাজদার চোখ সরিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিল। শার্ট পরতে পরতে কাকে যেন ইচ্ছেমতো বকে যাচ্ছে। শাইনা কিছু বুঝতে পারছেনা। শার্ট পাল্টানো দেখে বিরক্ত লাগছে। কয়েকঘন্টা পরপর শার্ট পাল্টাবে। বেড়াতেও এসেও একই কান্ড। এগুলো কি ধরণের বদভ্যাস?
আবারও গর্জে উঠলো তাজদার। শাইনা তা শুনে চমকে গেল। কাকে বকছে এভাবে? কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারছেনা সে।

শার্টের বোতাম ঠিক করতে করতে কানে ফোন চেপে ধরে শাইনার দিকে তাকালো তাজদার। বলল,”আসা হোক।”
শাইনা তার পেছন পেছন বেরোলো। সেখানকার রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া চললো একসাথে। আনিস সবার সাথে তাজদারের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তাজদার সবার সাথে ভালোভাবে কথাবার্তা বলেছে। আনিসের ভালো লেগেছে সবার সাথে ভালোভাবে গল্পগুজব করছে দেখে। দশ বছর আগের তাজদার সিদ্দিকী হলে এমনটা অবিশ্বাস্য ছিল।
তাজদার তাসনুভার উপর খেপেছে। ইচ্ছেমতো বকেছে। সামনে পেলে কি করবে তাসনুভা সেটা ভেবেই চুপসে গেছে। ডিনার করার জন্য তাকে আসতে বলেছিল। সে ভয়ে আসেনি। জানিয়েছে সে খেয়ে ফেলেছে বন্ধু বান্ধবদের সাথে। কাল দুপুরে খাবে তাদের সাথে। আনিস তাজদারকে বললো, রাগারাগির দরকার নেই। কিন্তু তাজদার শুনছেনা। সে তাসনুভাকে আসতে বলছে। না এলে সে নিজেই যাবে।

তাসনুভা তার ফোনটা পেয়েছে বান্ধবীর ব্যাগে। আনিসের কথাটা সবার সাথে শেয়ার করেছিল সে। সবাই মিলে যে যার ব্যাগ খোঁজাখুঁজি করতেই তাসনুভার ফোনটা পাওয়া গেল অথচ তারা তিন চার ঘন্টা পাগলের মতো ফোনটা খুঁজে বেরিয়েছে। ফোনটা পাওয়ার পর সবাই বসে হো হো করে হাসছে তাসনুভার পাগলামির কথা ভেবে। কিন্তু তাসনুভা এখনো স্বাভাবিক হতে পারছেনা। সে না গেলে ভাইয়া এখানে চলে আসবে। যদি সবার সামনে সিনক্রিয়েট করে?

খাওয়াদাওয়া শেষে অনেকক্ষণ সবাই মিলে গল্পগুজব করলো। ফোনে কথা বলার জন্য তাজদার একটু দূরে সরে যেতেই সবাই আনিসকে বলল বোনের জামাই ভালো পেয়েছে। আনিসও কথাটায় দ্বিমত পোষণ করেনি। তাজদার সিদ্দিকী নিঃসন্দেহে ভালো কিছু অভ্যাস ছাড়া। ছোট থেকে গরিব দুঃখী মানুষ পছন্দ করতো না। দুঃখীরা পাড়ায় ভিক্ষা চাইতে এলে তাদের দূরদূর করে তাড়িয়ে দিত। কাউকে পছন্দ না হলে তাকে আশেপাশেও দেখতে চাইতো না। তার বাপ চাচার সাথে ঝগড়াঝাটি হলে সেখানে সে মাতব্বরি দেখাতো। তার বাপ চাচাকে ভয় না পেলেও মানুষ তাকে ভয় পেত। বড় হওয়ার পর অনেক পরিবর্তন এসেছে যদিও। আগের মতো থাকলে সে বিয়েতে জীবনেও রাজী হতো না। আগে যা হয়েছে তা বাদ। এখন শুধু তার বোনটা ভালো থাকলেই হলো।

শাইনা চুপচাপ বসে আছে। সে তিতলির সাথে কথা বলছে হোয়াটসঅ্যাপে। তাজদার এখনো গল্পে মেতে আছে আনিস আর তার কলিগদের সাথে। আলোচনা চলছে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ঘাটতি আর করপোরেট জবের নিষ্ঠুর বাস্তবতা নিয়ে। তাজদার মাঝে মাঝে একটু গম্ভীরমুখে মাথা নেড়ে নিজের মত দিচ্ছিল। ঠিক তখুনি একটা ফোন এল। তাজদার একটু সরে গেল। আনিস কলিগদের যেতে বলে শাইনাকে নিয়ে তাজদারের পিছু পিছু গেল।
তাসনুভা ভয়ে ভয়ে ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাজদার তার দিকে কাঠকাঠ গলায় কয়েকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। কোনো ভদ্রলোকের মেয়ে এভাবে বাড়িতে না জানিয়ে ঘুরতে আসে?
তাসনুভা কাঁপছে রীতিমতো। লজ্জাও পাচ্ছে শাইনা আর আনিসের সামনে। মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। তাসনুভার একজন বান্ধবী বলল,

“ভাইয়া আমরা সবাই মিলে ওকে ট্রিট দিয়েছি। ওর জন্যও সারপ্রাইজিং ছিল ব্যাপারটা।”
“জাস্ট শাটআপ! সব নির্লজ্জ একসাথে হয়েছে। আবার বড় বড় কথা।”
তাসনুভা তার বান্ধবীকে চোখের ইশারায় চলে যেতে বললো। অপমানিত হয়ে সবাই কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিসফাস করছে। নুভার এই মেঝ ভাইটা আস্ত একটা খাটাশ। সবাই শাইনাকে দেখিয়ে বলল, বউ ভালো পেয়েছে। আরেকজন বলল, মেয়েটার কপাল খারাপ। এরকম বর মানেই জীবন তেজপাতা।
তাজদার ফোনে কাউকে ডায়াল করছে। তাসনুভার দিকে আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তোমার বাহাদুরি বের করছি আমি।”

তাসনুভা ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,”আর কখনো এমন হবে না। আব্বু শুনলে আমাকে…
কষে একটা চড় পড়লো তার গালে! শাইনা, আনিস দুজনেই কেঁপে উঠলো। আরেকটা চড় পড়তে যাচ্ছিল।
আনিস ছুটে এসে তাজদারকে সরিয়ে নিয়ে গেল। তাজদার তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে এনে ফোনে গর্জে বলল,
“বাড়ির মেয়েকে একা একা ছেড়ে দিয়েছ কি মনে করে? আমাকে জবাব দাও ও একা কক্সবাজারে কি করে এল? কাউকে জানায়নি কোন সাহসে? ফোনটাও হারিয়েছে। এই ফোনটা পেয়েছ?”
তাসনুভা কান্না মুছে উপরনিচ মাথা দোলালো।
“হ্যাঁ।”
ফোনটা তৌসিফ ধরে রেখেছে। আশেপাশে বাড়ির সবাই আছে। চুপ করে আছে তাজউদ্দীন সিদ্দিকী আর রওশনআরা।

তাজদার তৌসিফের উদ্দেশ্যে বলল,”ও কি এর আগেও এভাবে ট্যূরে যেত?”
তৌসিফ চুপ। রওশনআরা ফোন নিয়ে কি বললো কে জানে। তাজদার তাসনুভার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“একটা বেয়াদব হয়েছ তুমি। বাড়ি যাও। তারপর কথা হবে। এখন যাও এখান থেকে।”
শেষের কথাটা গা কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো তাজদার। তাসনুভা দ্রুত চলে গেল। আনিস শাইনাকে বলল,
“তুইও যা।”
শাইনা চুপচাপ চলে গেল। সে একদম চুপ হয়ে গেছে। এ যেন পূর্বের তাজদার সিদ্দিকী। আজ সে আর কোনো কথা বলবে না। মুখ খুলবে না। বড় বড় কথা শোনালে সে সহ্যও করতে পারবে না, কিছু না বলেও থাকতে পারবে না। তারচেয়ে ভালো চুপ থাকা।
তাজদার তার পিছু পিছু লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল। শাইনাকে ডিঙিয়ে রুমে ঢুকলো। শাইনা আয়াতুল কুরসি পড়ছে মনে মনে।

সে চুপিচুপি হেঁটে রুমে ঢুকলো। বিছানায় উঠে আরাম করে শুয়ে রিমোট চেপে টিভি অন করবে তখুনি তাজদার আঙুল তুললো।
“আরেকটা আছে টিভি দেখার তালে। টিভি বন্ধ। টিভি ছাড়লে সেটা মাথায় তুলে আছাড় মারবো।”
শাইনা তখুনি টিভি বন্ধ করে দিল। রিমোটটা রেখে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। তাজদার রায়হানের সাথে কথা বলছে। শাইনা অবাক হচ্ছে।
বড় ভাইয়ের সাথেও মানুষ এভাবে কথা বলে? তার মেঝ ভাইয়া এখনো বড় ভাইয়াকে কত সমীহ করে। আর এই লোকটা!

শাইনা কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো নিজেরও টের পায়নি। হঠাৎ বিকট শব্দ হতেই দেখলো তার পাশে লম্বা করে পা টেনে শুয়েছে তাজদার সিদ্দিকী। পিঠের নিচে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে বসেছে। টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দিয়েছে। শাইনা বালিশটা তুলে কানের উপর চাপা দিল। তাজদার সাউন্ড আরও বাড়িয়ে দিয়ে মনোযোগ দিয়ে নিউজ দেখছে। শাইনা তার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তারপর বিরক্ত হয়ে বলল,
“জার্নি করে এতদূর এসেছি একটু শান্তিতে ঘুমাতেও পারছিনা। আপনি কি কারো ভালোমন্দ বোঝেন না?”
তাজদার টিভির সাউন্ড একটুও কমাল না। কথাটা যেন সে শোনেইনি। শাইনা তার হাতের মুঠোয় থাকা রিমোটটা ধরতেই তাজদার তাকে আচমকা ঠেলে বিছানায় ফেলে দিল।
শাইনা সরে এসে বিড়বিড়িয়ে বলল,”ছোটলোককে আবার যখন তখন ছুঁতে সমস্যা নেই।”
“কি বললে?”

শাইনা শান্তভাবে বলল,
“স্পষ্ট শুনেছেন কি বলেছি।”
“তুমি নিজেকে ছোটলোক বলে দাবি করছো?”
শাইনা রিমোট কেড়ে নিয়ে টিভি বন্ধ করে দিল। তারপর শুয়ে পড়তে পড়তে বলল,” হ্যাঁ, সেটা আপনিই বলেছেন। ছোটলোকের সাথে এক বিছানায় ঘুমান ভেবে আপনার লজ্জা হওয়া উচিত। আমার তো অসম্ভব ঘৃণা হয় আপনার মুখে ছোটলোক শুনেও আপনার সাথে ঘুমাতে। কয়েকদিন পর বলবে অমুকের বাচ্চার মা। পরিচয়টাই আমার কাছে লজ্জার। আপনি জ্ঞানী মানুষ হলে বুঝবেন। আর বেশি বলব না।”
তাজদার সিদ্দিকী তাকে ঠেলে বিছানা থেকে ফেলে দিল। শাইনা বিপদের আশঙ্কা বুঝে তার বুকের শার্ট চেপে ধরে, গলা ধরে ফেলেছিল ফলস্বরূপ তাজদারকে নিয়েই পড়ে গেল একসাথে।
আঘাত বেশি শাইনাই পেয়েছে। চ্যাপ্টা হয়ে গেল সে তাজদারের বুকের নিচে। কোমরটা মনে হচ্ছে গেল। মাথার নিচে তাজদার সিদ্দিকী শক্ত হাত ছিল। তাতে ব্যাথা আরও বেশি পেয়েছে সে। তাজদার তার মুখের দিকে তাকালো। শাইনার নাক কাঁপছে। চোখ জ্বলজ্বল করছে।

তাজদার তাকে ব্যাথায় কোঁকাতে দেখে তুলে বালিশে হেলান দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। এলোমেলো বেণীটা সামনে ঝুলে আছে। মাথায় আর কোমরে ব্যাথা পেয়ে ঘেমে উঠেছে সে। বুক ধড়ফড় করছে। পানি খাওয়া দরকার।
সে ফুঁপিয়ে উঠে আবার নিজেকে শান্ত করাচ্ছে দেখে তাজদার ফুঁসে উঠলো। শাইনার দুই বাহু চেপে ধরে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,
“তুমি এগজ্যাক্টলী কি চাইছো সেটা বলবে? সময়গুলো যেভাবে পার হচ্ছে মনে হচ্ছে বেশিদিন তোমার সাথে আমার থাকা হবেনা। আমি মদ খাই, গাঁজা খাই? তোমার আমাকে নিয়ে সমস্যা কি? আমি নেহাতই তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি নইলে….

শাইনা চোখ বন্ধ ঠোঁট কামড়ে রেখে ফোঁপানি আটকাচ্ছে। এতটুকুতেই ক্লান্ত সে। সামনে কি অপেক্ষা করছে জানেনা। কিন্তু এই লোকটার সাথে বেশিদিন এভাবে চলতে থাকলে সে মরে যাবে। সে আঘাত পেয়েছে তার মধ্যে এভাবে চেপে ধরেছে একটু পানি না দিয়ে। সে কি চায় স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে ওইদিন আবারও বলছে সে কি চায়।
তাকে ওভাবে বসে নীরবে কাঁদতে দেখে তাজদার সরে গেল। ঠোঁটের কাছে হাত রেখে পায়চারি করতে করতে শাইনার দিকে বারবার তাকাল।

বিয়ের আগে মনে হচ্ছিল সবটা সহজ। খুব সহজ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিষয়টা খুব জটিল। শাইনার দিকে এগিয়ে গেল সে একটা কথা বলার জন্য। শাইনা তার দিকে চোখ মেলে তাকালো। ওই চাহনিতে কি ছিল যা তাজদার সিদ্দিকীর পদক্ষেপ থামিয়ে দিল? শাইনা তার দিকে চোখ জল নিয়ে তাকিয়ে বলল,
“দুমুঠো ভাতের আশায় আমি আপনার কাছে আসিনি। দুমুঠোর ভাতের বদলে যেদিন সম্মান নিয়ে আসতে পারবেন সেদিন আমার কাছ থেকে স্বাভাবিক আচরণ আশা করবেন যদি আপনি মানুষ হয়ে থাকেন। অমানুষ হয়ে থাকলে যা ইচ্ছে করেন। আমি আপনাকে আর বাঁধা দেব না।”
তাজদার তার দিকে কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো। অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো। সম্মান? সবার বিরুদ্ধে গিয়ে এত টাকাপয়সা খরচ করে বিয়ে করেছে এটা সম্মান নয়? তাকে কথাটা বড্ড ভাবালো। সম্মান! শাইনা মমতাজ তার কাছ থেকে সম্মান চায়।

সে বেরিয়ে যাচ্ছিল। শাইনা বলল,”কোথায় যাচ্ছেন বলে যান। এটা বাড়ি নয় যে আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়বো।”
তাজদার তার দিকে ফিরে তাকালো। গম্ভীর মুখে বলল,
“মরতে যাচ্ছি। সমুদ্র যদি টেনে নেয় তো ভালোই। আর যদি বেঁচে ফিরি তবে আমি তোমাকে তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। এত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শোনার জন্য বিয়ে করিনি সবার বিরুদ্ধে গিয়ে, এত টাকাপয়সা খরচ করে। তুমি আমাকে কি মনে করো আমি জানিনা। আমি তোমার সাথে স্বাভাবিক হতে চাইছি বলে কাছে ঘেঁষেছি। আজকের পর থেকে আমার পাও তোমার কাছে যাবে না। আমি তোমার মুখও দেখব না। তুমি এখনো আমাকে চেনোনি।”
বলেই সে বেরিয়ে গেল। অনেকটা সময় পার হয়ে গেলেও এল না। শাইনা ঘুমঘুম চোখে আনিসকে ফোন দিল। আনিস ফোন রিসিভ করলো।

“হ্যাঁ বল।”
শাইনা ঢোক গিলে বলল,”ভাইয়া তুমি কোথায়?”
“আমি তো শুয়ে পড়েছি। কেন?”
“উনি কোথায় গেল জানিনা।”
“কোথায় গেছে? বলে যায়নি?”
শাইনার হঠাৎ করে হাত কাঁপছে।
“এখন তো ঝড় হচ্ছে। পানিতে কি নামা নিষেধ?”
আনিস বলল,”কিসব বলছিস? এখন বাইরে যেতে দিলি কেন? কোনো কাজে বেরিয়েছে? হ্যালো!”
শাইনা বলতে বলতে ফোন রেখে বেরিয়ে গেল। জোরে বাতাস বইছে। রাগে, দুঃখে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এই লোকটা তাড়াতাড়ি লন্ডনে চলে গেলেই ভালো। এত অশান্তি আর নিতে পারছেনা সে।
তাজদার সিদ্দিকী কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে। তবে শাইনা তাকে খোঁজার জন্য বেরিয়ে গেল। এটুকু দায়িত্ববোধ তার আছে। ভয়ে তার গা শিরশির করছে। এরকম ঝড় হলে সে জীবনেও এখানে আসতো না। হঠাৎ তার পা জোড়া থেমে গেল। ওই দূরে কেউ বসে আছে একলা। শাইনা ডাকল,

“শুনছেন?”
সে অন্য কোনো সম্বোধন জানেনা। কি বলে ডাকবে সেটাও খুঁজে পেল না। তাজদার সিদ্দিকী ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে শাইনা মমতাজ। হাওয়ার বেগে তার শাড়ি আঁচল উড়ছে। সে বসা থেকে ধীরেধীরে দাঁড়িয়ে পড়লো। শাইনা এসে তার বুক বরাবর কিল বসালো। ধাক্কা মেরে বলল,
“ঝড়ের রাতে বেরিয়ে গিয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? শুনুন আমি আপনাকে যেদিন বিয়ে করেছি ওইদিন সব ভয় ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। আপনি আমার সামনে এইসব হিরোগিরি দেখাবেন না একদম।”
তাজদার তাকে বলল,”তোমাকে এখানে কে আসতে বলেছে? যাও তো মাথা না খেয়ে।”
শাইনা তার শার্ট টেনে ধরলো।

“আপনি যাবেন কি যাবেন না?”
তাজদার লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যেতে লাগলো সামনে। আরেহ লোকটা পাগল নাকি? শাইনা দৌড়ে গিয়ে তার হাত ধরে ফেললো। তাজদার থামলো। শাইনা নরমভাবে বলল,
“ওকে আপনার কথামতো সব হবে। চলুন আগে।”
মনে মনে সে তাজদারকে ইচ্ছেমতো গালাগাল দিচ্ছে যদিও। তাজদার তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“মিথ্যেবাদী।”

সে হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে লাগলো। শাইনা বলল,
“ঠিক আছে। পানিতে আগে আমি নামবো। আমারও বাঁচার ইচ্ছে নেই।”
বলেই তাজদারের আগেভাগে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে লাগলো। দূর হতে সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে। যেতে যেতে শাইনা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। আর উঠতে পারলো না। তাজদার সিদ্দিকী হো হো আকাশ কাঁপিয়ে হেসে উঠে তার সামনে বসে পড়লো।
শাইনাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লো। শাইনা বহুকষ্টে উঠে বসলো। তাজদার গা কাঁপিয়ে হাসছে তার এমন দুরাবস্থা দেখে। শাইনা পাশে বসে তার বুকের উপর বালু তুলে দিতে লাগলো। এমনকি খাইয়েও দিল। তাজদার সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে থুতু ফেলে দিল পাশে। তারপর রুক্ষ ভঙ্গিতে মুখ মুছে নিয়ে শাইনাকে ফেলে দিল নিচে।

তাজমহল পর্ব ২৫

শাইনা হতচকিত হওয়ার আগেই, তাজদার দু’হাত ভরে বালু কুড়িয়ে তার গলায় মেখে দিল রুক্ষ ভঙ্গিতে। তারপর মুখটা তুলে ধরে, ভেজা, কাঁপা ঠোঁটের উপর চেপে ধরল নিজের ঠোঁট। এক ঝটকায় ঢেলে দিল সমস্ত জমাট ক্ষোভ, গম্ভীর নীরবতা, আর একরাশ দাহ করা প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা। নিঃশ্বাসহীন মুহূর্তে আটকে গেল সবকিছু। তারপর শাইনাকে একা রেখে সে চলে যেতে গেল রিসোর্টের দিকে।

তাজমহল পর্ব ২৭