অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭১

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭১
নুসাইবা ইভানা

নয়না নিচে এসে দারোয়ানকে বলল, “কাকা, গেট খুলুন।”
“এত রাতে কোথায় যাচ্ছো, মামনি? তাও একা একা!”
“সামনের মাঠে। চিন্তা করতে হবে না। আপনাদের জামাই আছে সেখানে।”
গেট খুলতেই নয়না দৌড়ে বেরিয়ে গেল। রাস্তা পার হয়ে একটু সামনেই বিশাল বড় একটা মাঠ। নয়না মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতির আগুনে জ্বলজ্বল করছে ‘আই লাভ ইউ’ লেখাটা। তার ঠিক সামনেই নানা রঙের ফুল দিয়ে ‘লাভ’ আঁকা। মাঝখানে হলুদ গোলাপ দিয়ে লেখা ‘সুনয়না’।
নয়নার চোখের কোণে আনন্দের অশ্রু উঁকি দিচ্ছে। একটা মানুষ আর কতভাবে তাকে মুগ্ধ করবে! ইশ, এত ভালোবাসা সত্যি আমার কপালে ছিল! নয়না দৃষ্টি ঘুরিয়ে আশপাশে তাকালো, কাউকে দেখতে পেল না। নয়না ডাকল, “মিস্টার প্লেন ড্রাইভার, কোথায় আপনি? এই যে, শুনছেন? সামনে আসুন। আসছেন না কেন?”
গিটার হাতে গান গাইতে গাইতে সামনের দিকে এল জিয়ান। পরনে নীল পাঞ্জাবি।

“তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম…”
নয়নার মুখশ্রী জুড়ে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল। জিয়ান যত সামনে আসছিল, নয়নার হৃদস্পন্দন ততই বেড়ে যাচ্ছিল।
জিয়ান নয়নার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
নয়না হাত গুটিয়ে নিয়ে সামান্য সরে দাঁড়াল।
“কী হলো? জান, হাত সরিয়ে নিলে কেন! আমি তোমার মিস্টার প্লেন ড্রাইভার।” বলেই নয়নার অনেকটা কাছে চলে এল জাহিন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নয়না আরও দূরে সরে গেল, ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “আপনার লজ্জা লাগে না? নিজের আপন ভাইয়ের বউয়ের সাথে এসব করতে! আমি আপনার বড় ভাইয়ের বউ।”
জাহিন সামনে এগিয়ে এসে নয়নার মুখ চেপে ধরে বলল, “তোর লজ্জা করে না? এক ভাইয়ের সাথে প্রেম করে আরেক ভাইয়ের সাথে শুয়ে পড়তে।”
নয়না ঠাস করে জাহিনের গালে একটা চড় মারল। রাগী কণ্ঠে বলল, “আমি সব সহ্য করলেও নিজের চরিত্র নিয়ে আজেবাজে কথা সহ্য করব না। আমার জীবনে প্রথম ও শেষ পুরুষ আমার স্বামী। আপনার বড় ভাই। মৃত্যু পর্যন্ত এই একজনই থাকবে।”

নয়নার শাড়ির আঁচলে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। নয়নার সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। জাহিন হাত বাড়িয়ে আঁচল ধরতে চাইলে নয়না সরে দাঁড়াল।
“ভালোবাসার হিসেব পরে হবে, এখন শাড়ির আঁচল ফেলে দাও।”
নয়না স্থির দৃষ্টিতে জাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “মরে যাব তবুও আপনার সামনে শাড়ির আঁচল সরাব না। আমার স্বামীর আমানত আমি নষ্ট করব না।”
“পাগল হয়েছ? আমার সাথে কিসের এত অভিমান? ভুলে গেছ সে-সব দিনগুলো, যখন আমার সাথে রাতের পর রাত কথা বলে কাটিয়ে দিতে? সেই সব দিন, যখন তুমি আমার অপেক্ষায় কাটাতে। কেন পাল্টে গেলে, জান? আমি যে তোমাকে ভালোবাসি!” জাহিন খেয়াল করল আগুন বেড়ে গেছে। “শাড়ির আঁচল ফেলে দাও, আমি তোমার দিকে তাকাব না।”

মাঠের অপর প্রান্ত থেকে একজন ছুটে এসে নয়নাকে নিয়ে লুটিয়ে পড়ল বালুর মাঠে। নিজের হাত দিয়ে বালু ছিটিয়ে দিতে লাগল জ্বলন্ত আগুনে। ধীরে ধীরে আগুন নিভে এল। নয়না শক্ত করে জিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আপনি সত্যি এসেছেন? তুমি না এসে থাকলে আমি মরে যেতাম।”
জিয়ান নয়নাকে কোলে তুলে নিল। নয়না নিজেকে গুটিয়ে নিল জিয়ানের বক্ষে। জাহিন তখনও দাঁড়িয়ে আছে ঠিক একই ভাবে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ সংযত করে বলল, “ভাবি, দিলেন তো সারপ্রাইজ নষ্ট করে!”
নয়না জাহিনের দিকে আড়চোখে একবার তাকাল। এরপর কিছু একটা ভেবে সেভাবেই পড়ে রইল জিয়ানের বক্ষে। জাহিন বারকয়েক ‘সুনয়না’ বলে ডাকল। নয়নার সাড়াশব্দ না পেয়ে গাড়ি থেকে পানি আনতে পা বাড়াল।
জিয়ান বলল, “থাক, পানি লাগবে না। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।”

জাহিন মাথা নিচু করে বলল, “সরি, ব্রাদার, তোমার সাজানো সারপ্রাইজ আমার মজা করার চক্করে নষ্ট হয়ে গেল। তোমার আসতে এত দেরি হল কেন?”
“এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে উত্তরা আসার পর থেকেই জ্যামে পড়েছিলাম। এরপর ড্রেস চেঞ্জ করলাম, ফ্রেশ হলাম। সামান্য দেরি হয়ে গেছে।”
“তুই ও তো দেখি সেম পাঞ্জাবি পরেছিস?”

“তুমি যখন সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান বললে, তখন পাঞ্জাবি কিনে রাখতে বললে, তোমার জন্য। তখন আমার মনে এই উল্টোপাল্টা বুদ্ধি এল। এক্সট্রিমলি সরি, ভাইয়া।”
“ইট’স নট ওকে, জাহিন। আমাকে তোর এসব জানানো উচিত ছিল। আজ যদি নয়নার কিছু হয়ে যেত? ও খুব সেনসিটিভ মানুষ। এমন মজা করা একদম উচিত হয়নি। নিশ্চিত নয়না ভয় পেয়েছে। সরি বলতে হলে তোর ভাবিকে বলবি। এবার যা, বাসায় যা।” বলেই জিয়ান নয়নাকে নিয়ে চলে গেল।

জাহিন সেভাবেই মাঠে বসে পড়ল। তখন মোমবাতিগুলো জ্বলছে। একটা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল, “আমাকে ধোঁকা দিয়ে সুখে থাকতে চাও? তোমার সুখ আমি কেড়ে নেব। আমি জ্বলব আর তুমি আলোকিত হবে, এত উদার আমি না। আমি জ্বললে তোমাকে নিয়ে জ্বলব। জাহিন চৌধুরীর ডিকশনারিতে ক্ষমা শব্দটা নেই। আমাকে ভুলে তুমি আমার চোখের সামনে সুখে থাকবে? এত উদার তো আমি না, সুইটহার্ট।”
🌿 জিয়ান নয়নাকে নিয়ে নয়নার বাসার সামনে এসে বলল, “এত রাতে বউকে কোলে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ঢুকব! আহারে, আমার সাধের লজ্জা।”

নয়না জিয়ানের বক্ষে আলতো করে কামড় বসিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার আবার লজ্জাও আছে!”
“উঁহু, বউয়ের কাছে কোনো লজ্জা-টজ্জা নেই। শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে আছে।”
“এত রাতে আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি মেয়ে আর জামাইয়ের রোমান্স দেখার জন্য দূরবিন নিয়ে তাকিয়ে আছে তো!”
“তাহলে ঢুকব কীভাবে বাসায়?”
“দারোয়ান আছে তো। যে আঙ্কেল রাতে ডিউটি করে, উনি মেইন গেট খুলে দেবেন। আর বাসার ভেতরের মেইন দরজা তো আমি খুলেই রেখে এসেছি, জনাব।”
“আয়হায়, কত সুইট আমার বাটার মাশরুম! তাহ, ইশ, ইচ্ছে করছে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ি।”
“একটু ধৈর্য ধরেন, মিস্টার। আর একটু সবুর করতে হবে।”
🌿 অনিকেত আজ ব্রেকফাস্ট ব্রেকেও কারও সামনে আসেনি। মাথা তুলে তাকাতেই তাকে লজ্জা ঘিরে ধরছে। দুপুরে অনিকেতের কেবিনে খাবার নিয়ে এল আরও চারজন ডাক্তার। একজন অনিকেতের দিকে তাকিয়ে বলল, “বিয়ে করে দাওয়াত দিলেন না। মিষ্টি তো খাওয়াতে পারেন।”

আরেকজন বলল, “ডাক্তার অনিকেত মাহমুদ বিয়ে করেছে, বিষয়টি সন্দেহজনক। আসলেই বিয়ে করেছে তো! না, মানে, ইনি তো মেয়ে দেখলেই দশ হাত দূরে পালায়।”
এসব কথা শুনে অনিকেত আরও লজ্জা পাচ্ছে। কোনোমতে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, “রিসিপশনে আপনাদের ইনভিটেশন দেব। আসলে বিয়েটা হুট করে হয়ে গেছে।”
সায়না ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আমাকে ইনভিটেশন দেবেন তো, ডাক্তার সাহেব?”
অনিকেত হকচকিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল, “তুমি এখানে!”
“রিলাক্স, ডাক্তার মাহমুদ। আমি ভূত-প্রেত নই, আমি আপনার ওয়াইফ। আসসালামু আলাইকুম।”
বাকি সবাই সালামের জবাব দিল। সবার সামনে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ শেষ করে বাইরে চলে এল সায়না। পিছু পিছু অনিকেতও এসেছে।

“তোমাকে বারণ করেছিলাম তো হাসপাতালে আসতে।”
“তোমাকে বলেছিলাম তো, কল সব সময় রিসিভ করতে।”
“এটা আমার ওয়ার্কিং প্লেস।”
“হোক, তাতে কী! এক মিনিট কথা বললেই হত।”
“এসব আমার একদম পছন্দ না, সায়না।”
“আপনার তো শুধু রুমের লাইট অফ করে রোমান্স পছন্দ।”
“মুখে কিছু আটকায় না? আর করবই না কিছু। ছুঁয়েও দেখব না।”
“ঊখ, হানি নট। শিফনের শাড়ি পরে কোমর দুলিয়ে যখন আসব, তখন সামলে রাখতে পারবেন তো নিজেকে?”
“চোখ বন্ধ করে রাখব।”
“চোখে মরিচ দিয়ে দেব।”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭০

“ডেঞ্জারাস মহিলা।”
“উঁহু, ডেঞ্জারাস বউ আপনার।”
“কেন এসেছ?”
“কল করবেন আমাকে। দুই ঘণ্টা পরপর। এক-দুই মিনিট কথা বলবেন। তবুও কল করবেন। আর হ্যাঁ, রিসিপশন কবে হবে?”
“লাল, শুক্রবার।”

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৭২