ধূসর রংধনু পর্ব ৩০

ধূসর রংধনু পর্ব ৩০
মাহিরা ইসলাম

নিস্তব্ধ রাত। ফ্লাইওভার এর উপর দিয়ে গাড়ির শোঁ শোঁ শব্দ ব্যতীত অন্য কোন শব্দ ঠাহর হচ্ছে না।এই রাস্তার চারিধারে লাম্পপোস্টের আলো গুলো না থাকলে রাতের শহরটা মনে হত কোনো ভুতুরে বাসভবন।
লোকেশন অনুযায়ী নিস্তব্ধ গাড়ি এসে থামালো একটি শপিং মলের সামনে।
ওরা দ্রুত সবাই গাড়ি থেকে বের হলো।
নিস্তব্ধ আশে পাশে খুঁজতে লাগল।
সুজন চেঁচিয়ে উঠে বলল,

-” দোস্ত লোকেশন তো মনে হচ্ছে ওই ডাস্টবিনের পাশে দেখাচ্ছে । ”
নিস্তব্ধ দৌঁড়ে সেখানেই গেল।
সত্যিই ফোনটা ডাস্টবিনের পাশেই পড়ে আছে।
নিস্তব্ধ তা হাতে ধরলো।
ফোনটা এভাবে নোংরার ভিতর রাস্তার মাঝে কি করে পরে থাকতে পারে।আশ্চর্য।
সুজন বলল,
-” এটা কোনো সংকেত নয়তো তাসফির।হতেও পারে যদি কিডনাপ হয়ে থাকে।তবে প্রমাণের জন্য তাসফি ওর জিনিস পত্র ফেলে যেতেই পারে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিস্তব্ধ আর মাহীন মাথা দুলিয়ে তিনজন আবারো গাড়িতে চরে বসলো।
ঝড়ের গতিতে নিস্তব্ধ গাড়ি চালিয়ে চলল।কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না।এদিকে যতদূর চোখ হাইওয়ের রাস্তা। পাশে কোনো বাড়ি ঘরের ছিটে ফোটাও নেই। আর না তো তাসপির ব্যবহৃত অন্য সব জিনিসপত্র।
নিস্তব্ধ মনে প্রাণে চাইছে তার বউ যেখানেই যেন সেভ থাকে।
ওরা বুঝলো না কি করবে।
নিস্তব্ধ গাড়ি থামিয়ে দিল।
মাথা ফেটে যাচ্ছে তার চিন্তায়।মেয়েটা কদিনেই তার হাড় মাংশ এক করে ফেলছে।এইরকম চলতে থাকলে সে নিশ্চিত জিন্দা লাশ হয়ে যাবে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
নিস্তব্ধ গাড়ির স্টেয়ারিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো।কিছুসময়।
হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই নিস্তব্ধ আবারো গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো।

মাহীন বলে উঠলো।
কিরে গাড়ি ঘুরালি কেন।
নিস্তব্ধ জবাব দিলো না।
তখন মাহিনের ফোনে আবারো কল এলো বাসন্তীর।
চিন্তিত কন্ঠে বলল,
-” খোঁজ পেলে।”
মাহীন হতাশ কন্ঠে জবাব দিলো,
-” না তবে চিন্তা করবেন না। অবশ্যই পাবো।আমরা খুঁজছি। ”
রাত তখন প্রায় বারোটার কাছাকাছি।
ওসমান ভিলায় সবাই জাগ্রত, কারো চোখে ঘুম নেই।
এই অবস্থায় কারই বা ঘুম আসবে।
অন্ধকার মর্গে হাত,পা বাঁধা অবস্থায় বসে তাসফি বড় বড় করে নিশ্বাস নিচ্ছে।মনে হচ্ছে লাশ গুলো ক্রমেই তার দিকে এগিয়ে আসছে।

তার দ্বারা বোধহয় আর চোখ দুটো খুলে রাখা সম্ভব নয়।
তবে কি এখানেই তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস টুকু ত্যাগ করতে হবে।
আর বুঝি তার ডাক্তার সাহেবের রাগী মুখখানা দেখার সৌভাগ্য হবে না। শ্বাশুড়ি মায়ের আদুরে ধমক খাওয়া হবে না। আয়েশা ভাবী আর বাসন্তী আপার হাস্যকর কথা শোনা হবে না। নানির লজ্জাজনক কতা শোনা হবে না। তার দাদীর আহাজারি শোনা লাগবে না। মেজ চাচির ভালোবাসা পাওয়া হবে না।
আহা আর কিছুই বুঝি আর তার সাদরে গ্রহন করা হবে না। তার ডাক্তার সাহেবের ভালোবাসা পাওয়া বুঝি আর তার এ জনমে হবে না। আচ্ছা পরবর্তী জনমে কি সে পাবে অহংকারী পুরুষটার ভালোবাসা?
কি নিষ্ঠুর প্রকৃতি।তার ভাগ্যের উপরেরই কেন সর্বক্ষেত্রে এই বিপদ গুলো খন্ডিত রয়েছে।
প্রথমে মা তারপর বাবা আর এখন তার ডাক্তার সাহেব।

এত যন্ত্রণা ভোগ করার চেয়ে বিপরীত মৃত্যুই কি তার জন্য বেছে নেওয়া উত্তম পন্থা নয়। বাবাতো বলেছে উত্তম পন্থা বেঁছে নিতে।এত এত কষ্টের চেয়ে মৃত্যুই কি যোগ্য উপায় নয়?
একবারে মৃত্যুবরণ করলে তো আর তার এই শারীরিক মানসিক কোনো কষ্টই তাকে ভোগ করতে হতো না।ইশশ!
নিস্তব্ধ গাড়ি এসে থামালে পুনরায় প্যাশন মেডিকেল কলেজের সামনে।
দ্রুত সিটবেল্ট খুলে নেমে এলো।
পকেট থেকে ফোন বের করে গ্যালারি খুঁজে তাসফির লুকিয়ে তোলা একখানা ছবি বের করলো।
গেটে থাকা দারওয়ানের কাছে এগিয়ে গেল তটস্থ কদমে।
চাচাকে ছবি দেখিয়ে বলল,

-” চাচা খুব মনযোগ দিয়ে ভেবে তারপর বলুন।বিকাল থেকে এই পর্যন্ত এই মেয়েটাকে কি গেটের বাইরে যেতে দেখেছেন?”
দারওয়ান চাচা চিন্তিত মুখভঙ্গিতে বলল,
-” এত মানুষ যাওয়া আশা করে কার কথা কেমনে মনে রাখবো স্যার।”
নিস্তব্ধ আবারো জোড় দিয়ে বলল,
-” বিকাল থেকে খুব কম শিক্ষার্থীই যাওয়া আশা করে ভালো করে মনে করুন চাচা।আমার জীবন মরণের প্রশ্ন চাচা। এখন আপনিই শেষ ভরসা।”

দারওয়ান চাচা একটু চিন্তিত হয়ে পড়লো।ডাক্তার সাবের জীবন মরণের প্রশ্ন।কে এই রমণী যার জন্য এতবড় একজন ডাক্তারের জীবন মরণের প্রশ্ন।
সে চেনে এই ডাক্তার কে।অনেক ভালো মানুষ।হসপিটালের খরচ ব্যতীত কতদিন আগে তার এক আত্নীয়র ওটি করেছিলেন নিজের ফিস না নিয়েই।তারা গরিব ছিল।আজকাল এমন বড় ডাক্তার গো উদার মন তো খুঁজেই পাওয়া যায় না। তা খবই দর্লভ।
দারওয়ান চাচা কিছু ক্ষণ ভেবে বলল,

-” আমি দুপুর থেকে এখানে ডিউটি করি।
আমার মনে হয় না আমি এনাকে বের হতে দেখেছি।
আর সন্ধ্যার পর তো তেমন কেউ বের হয় নি।”
নিস্তব্ধ’র মন মাঝারে এক টুকরো আশার আলো উদয় হলো। মাহীন আর সুজনের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল,

-” তার মানে তাসফি ভেতরেই আছে।”
সুজন কে বলল প্রত্যেক রুমের চাবি নিয়ে আসতে।
আজ তাসফির প্রাক্টিক্যাল ছিল তিনতলায়
অতঃপর ওরা তিনজন ছড়িয়ে পড়লো।
একেকজন একেক রুমে খুঁজতে লাগলো।
কারণ পিয়ন গুলো ফাঁকিবাজ হয়।তারা ভালো করে না চেক করেই ভয়ে বলে চেক করেছি।
তাদের মিথ্যা কথার জোড়েই অনেক সময় অনেক মানুষকে ভুগতে হয়।এটা খুবই খারাপ একটা অভ্যাস এই পিয়নদের।
নিস্তব্ধ, সুজন, মাহীন প্রত্যেকটা রুম তন্যতন্য করে খুজতে লাগলো।কিন্তু তাসফির দেখা নেই।নিস্তব্ধ যে মনোবল নিয়ে কলেজের ভেতরে প্রবেশ করেছিল। প্রত্যেকটা রুম খোঁজা পরেও তাসফিকে না পেয়ে সেই মনোবল টুকুও হারাতে শুরু করেছে।

ঘড়ির কাটায় রাত তখন বারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে অজান্তেই খুব সাবধানে।
মাহীন খুঁজে খুঁজে দোতালার মর্গের দিকে এগুলো।
মর্গে বা তাসফি কি করতে আসবে।তবুও কোন মনে যেন সে এদিকে আসলো।মর্গের বাহিরে আজ পাহারাদার ও নেই কি আশ্চর্য। সব এমন অদ্ভুত কেন সিসি ক্যামেরা নষ্ট। এখানে পাহারা নেই।সন্দেহ টা একটু বেশীই হচ্ছে।
মাহীন গুটি গুটি পায়ে দরজার কাছে এগোতেই হালকা গোঙানির আওয়াজ পেল। মাহীনের বুক ধক করে উঠলো।
চিৎকার করে ডাকলো সে নিস্তব্ধ আর সুজন কে।
নিস্তব্ধ উঠে দাঁড়িয়ে আবারো দৌড়ে এলো সে দিকে।
ওদের সবার চোখে মুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। তবে নিস্তব্ধ’র যেন তা একটু বেশিই।
সুজনের চাবি দিয়ে রুম খোলায় দোরী করা নিস্তব্ধ’র পছন্দ হলো না।সে নিজে সুজনের থেকে চাবি কেঁড়ে নিয়ে কাঁপাকাপা হাতে তালা খুলতে লাগলো।

তবে কাঁপা হাতে খুলতে গিয়ে সুজনের থেকে তারই সময় বেশি লাগছে।তবুও ওরা কিছু বলল না। বন্ধুর মনের অবস্থা তারা খুব করে ঠাহর করতে পারছে।
রুম খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো ওরা।
সুজন সঙ্গে সঙ্গে চেনা থাকায় সুইচবোর্ড খুঁজে লাইট জালিয়ে দিলো।অন্ধকার মর্গ আলোকিত হয়ে উঠলো সাদা আলোয়।
পাশে তাকাতেই নিস্তব্ধ থমকে গেল।
চোখমুখ বিধস্ত অবস্থায় তাসফি পড়ে রয়েছে ফ্লোরে। তার মুখ,হাত, পা বাঁধা।
নিস্তব্ধ আর এক মুহুর্ত ও দেরী করলো না।
সেকেন্ডের মাঝে ঝড়ের গতিতে দৌড়ে গিয়ে জাপ্টে জরিয়ে ধরলো তার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনীকে।কাঁপা কাঁপা হাতে তাসফির মুখের কাপড় সরিয়ে দিলো।
চোখে মুখে অজস্র চুম্বন করলো তার পুরুষালীর ওষ্ঠদ্বয়ের সহিত। বউকে পেয়ে নিস্তব্ধ’র চোখ মুখ খুশিতে চিকচিক করছে।

হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলো।নিস্তব্ধ যেন তাসফিকে একদম বুকের মাঝে ঢুকিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে।ঢুকলেই বোধহয় ভালো হতো।
তাহলে তো আর এভাবে হারিয়ে যেতে পারতো না। কেউ তার বউকে আর কষ্ট দিতে ও পারতো না।হঠাৎ উষ্ণতা পেয়ে তাসফিও তার দুর্বল হাত দুটো উঠিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরার চেষ্টা করলো তার ডাক্তার সাহেব কে তবে ততটা সফল হলো না।
তাসফির গোঙানিতে নিস্তব্ধ’র হুশ ফিরলো।হাতের বাঁধন একটু হালকা করে ধরলো।
নিস্তব্ধ আদুরে স্বরে ডাকলো,
-“এই তাসফি কি হয়েছে ।কথা বলো, কথা বলো বোকা মেয়ে।”
তাসফি মুখদিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,

-” পানি, পানি।”
নিস্তব্ধ সুজনের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
-” কিরে গাধার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন শুনিস নি ওও পানি খেতে চেয়েছে।”
নিস্তব্ধ তখনো তাসফিকে জরিয়ে ধরে আছে ।
তাসফি দর্বল চিত্তে নিস্তব্ধ’র চোখে মুখে হাতালো।
কন্ঠে দূর্বলতা নিয়ে বলল,
-” আ..আপনি এসেছেন ডাক্তার সাহেব। ”
নিস্তব্ধ তাসফির হাতখানা মুঠোপুরে বলল,
-” এই তো, এই আমি দেখো।কিছু হবে না তোমার বোকা মেয়ে।”
তাসফি আরো কি যেন বলতে চাইলো।নিস্তব্ধ মুখ নিচু করলো।
তাসফি ভয়ংকর কিছু অযাচিত বাক্য ছুঁড়ে দিল নিস্তব্ধ’র কর্ণে।তা শুনে নিস্তব্ধ একদম দীর্ঘ শীতল নদীর মতো শান্ত হয়ে গেল।
নিস্তব্ধ’র মুখে হাসি ফুটলো।তৃপ্তির হাসি।
এই বাক্যই বুঝি শুনবার জন্য সে এতজমন কাল অপেক্ষায় ছিল।
নিস্তব্ধ ফিসফিস করে বলল,

-” কথা দিলাম আমার বোকা পাখি।”
সুজন পানি নিয়ে এলো।
মাহীন আর সুজন দুজনে তাসফি আর নিস্তব্ধ কে দেখছে অদ্ভুত চোখে।
কেউ কারো প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ না করে সারাক্ষণ ভালোবাসি না বলে মুখে ফেলা তোলার পরেও কি করে কতটা ভালোবাসা যায় তা বোধহয় এদের দুজনকে দেখলেই বোঝা যায়।
বিয়ের শুরু থেকে সারাক্ষণ যে পুরুষটিই বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছে।বউকে মানবে না বলে হাজারটা অযুহাত দিয়েছে।এমনকি নিজ রুমে থাকতে দেবেনা বলে বাহির করে দিয়েছে।সেই পুরুষটিই নিজ অর্ধাঙ্গিনীর বিপদে পাগলপাড়া হয়ে গিয়েছে। কেমন অদ্ভুত আচরণ করেছে দেখ।যা তার মতো একজন ম্যাচিউরড ডাক্তারে সঙ্গে একেবারেই বেমানান।

নিস্তব্ধ আর তাসফিকে দেখে মনে হচ্ছে তারা শত বছরের তৃষ্ণার্থ কপোত-কপোতী। সঙ্গে তাদের মধুর মিলন মুহুর্ত। হৃদয়ে থাকা গভীর তৃষ্ণা মিটানোর দীর্ঘ প্রয়াশ।
সুজন পানি নিয়ে এগিয়ে এলো।
কিন্তু তাসফি তা পান করার পূর্বেই জ্ঞান হারালো।
নিস্তব্ধ কয়বার তার গালে চাপর দিলো কিন্তু তাসফি আর কথা বলল না।
নিস্তব্ধ উত্তেজিত হয়ে সুজন কে বলল,
-” এই দেখনা ওও কথা বলছে না কেন। একটু আগেই তো কি সুন্দর করে কথা বলছিলো আমার সঙ্গে।দেখ না একটু।”

সুজন এই মুহুর্তে হাঁসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না। নিজে ডাক্তার হয়েও বুঝতে পারছে না বউ জ্ঞান হারিয়েছে।উল্টো তাকে জিজ্ঞেস করছে কেন কথা বলছে না।
বোঝ ঠেলা বউকে পেয়ে নিস্তব্ধ’র বোধবুদ্ধি কতটা লোভ পেয়েছে তা এই মুহুর্তে সুজন ও মাহীন দুজনেই বুঝতে পারলো। ওরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো।
সুজন নিস্তব্ধ কে অস্থির হতে নিষেধ করলো।তাসফির পালস রেট চেক করে বলল,।
-” রিল্যাক্স!দেখ দোস্ত ওও অসুস্থ। এত অস্থির হোসনা।ওর পালস খুব ধীর গতিতে চলছে। এখনি ওকে কেবিনে এডমিট করা দরকার।
মাহীন বলল,

-” নিস্তব্ধ কথা পরে বলবি ভাই।ওকে আগে এখান থেকে বের কর। তোর বউ তো পালিয়ে যাবে না ভাই।এখানেই থাকবে।এখন প্লিজ চল।”
নিস্তব্ধ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।
সুজন উঠাতে সাহায্য করতে গেলে নিস্তব্ধ তাকে থামিয়ে দিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
-” ছুবি না তুই।তোকে বলেছি আমার সাহায্য লাগবে হুম?মেয়ে মানুষ দেখলেই ধরতে ইচ্ছা করে তাইনা।
সালা ক্যারেক্টারলেশ।যা সর।”
মুহুর্তেই নিস্তব্ধ তাসফিকে কোলে তুলে নিলো।
সঙ্গে কদম বাঁড়ালো হসপিটালের ভেতরের দিকে।
সুজন কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকিয়ে রইলো নিস্তব্ধ’র গমন পথে।
মাহীনের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” ওও এভাবে আমাকে বলতে পারলো বল? হুহ।”
মাহীন মিটমিট করে হাসছে।ওর কান্ড দেখে।
পরক্ষণেই বউয়ের প্রতি নিস্তব্ধ’র কনসার্ন দেখে দুজনেই স্মিত হাসলো।
যাক তাদের বন্ধু নিস্তব্ধ এবার তার নিস্তব্ধতা ছেড়ে বাজে ভাবে ফেঁসেছে বউয়ের প্রেমে।
জেলাসির জ্বালা কত প্রকার ও কি কি তা সে হারে হারে টের পাবে।সালা… নাকি বউ কে ভালোবাসবেনা।
এবার বোঝো মজা।

আর দেরী না করে ওরা ওও চলল হসপিটালের ভিতরের দিকে।
তাসফি কে কোলে নিয়ে হসপিটালের ভেতরে এসে নার্স বলে চিৎকার করে ডাকতেই ওখানে উপস্থিত রাতের ডিউটিতে থাকা নার্সগন ভীষণ অবাক হলো।
তারা সবাই নিস্তব্ধ কে খুব ভালো করে চিনে। কেমন খিটখিটে তিরিক্ষি মেজাজের।তার উপর মেয়েদের থেকে একটু দুরুত্ব বজায় রেখেই চলে বলতে গেলে।

আর এখন তারা কিনা নিস্তব্ধ’র কোলের মাঝেই জরিয়ে তাকা একজন তরুণী কে দেখতে পাচ্ছে।
কিছু ইমার্জেন্সি রুগীর পরিবার গন কেবিনের বাহিরের বেঞ্চে বসে ছিল তারাও অবাক হলো কিছুটা।
কারণ রাত তখন একটার কাছাকাছি হঠাৎ এত রাতে কারো হঠাৎ চিৎকারে একটু ঘাবড়ে যাওয়ারই কথা সকলের।
নিস্তব্ধ’র ক্রমাগত ডাকে দুজন নার্স দ্রুত এগিয়ে গেল।
তাসফিকে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে কেবিনে দেওয়া হলো।
তাসফির শরীর খুব দর্বল।

তাসফির এক হাতে সেলাইন দেওয়া।
অপর হাত সে নিজের মুঠোয় পুরে তাতে মাথা থেকিয়ে বসে রইলো ওর পাশেই।
মাহীন ফোন করলো বাসন্তীর নম্বরে।
এতটা সময় সবাই ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলো।
মাহীনের ফোন পেতেই সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়লো।
শেষে আয়েশাই কলটা ধরলো।
তাসফি কে পাওয়া গিয়েছে শুনে সবার অশান্ত মন মুহুর্তে যেন শান্ত হলো।ঘারের উপর থেকে টনকে টনের বোঝা নেমে গেল এক নিমিষেই।
আয়েশা ছুটলো দাদুকে জানাতে।

সবাই এখনি বের হবে হসপিটালের উদ্দেশ্যে আর বসে থাকার কোনো মানে হয় না। অসুস্থ শরীরে দাদু ওও বায়না করলো যেতে।কিছুতেই তাকে মানানো গেল না।
অতঃপর শুধু রুম্পাকে রেখে যাওয়া হলো পান্নার কাছে।
মেয়েটা কাকিয়ার জন্য কান্না করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।তার উপর এমনিতেই সারাদিন কাকিয়া নাম জপ করতে থাকে কাকিয়া কে বাড়িতে আনো, বাড়িতে আনো বলে।
সবাই হসপিটালে আসতেই নিস্তব্ধ গম্ভীর নির্লিপ্ত স্বরে বলল,

-” তোমরা এমন জোট বেঁধে এসেছো কেন।এতজন তো একসঙ্গে কেবিনে থাকলে সমস্যা হবে।”
অনিমা বেগম ছেলের কথায় বেজায় বিরক্ত হলো।
দেখ ছেলের কান্ড।নিজে বউয়ের চিন্তায় চোখ মুখ কেমন পাংশুটে বর্ণ করে ফেলেছে আর তাদের বলছে জোট বেঁধে এসেছে কেন।
সুফিয়া বেগম এগিয়ে গিয়ে নাতির কান মলে দিয়ে বলল,

-” কেন রে হতচ্ছাড়া বউকি তোর একার নাকি।আমাদের নাতি বউ, মেয়ে সে বুঝলি।
দেখি সর তো তুই সর।যা বাইরে যা তোকে দিয়ে আর কোনো কাজ নেই।আমরা সবাই ঠিক আছি।তুই বেশি মানুষ হয়ে গিয়েছিস। যা বাইরে যা তো দেখি।অনেক দেখেছিস আর দেখোন লাগবো না। এত দেখে কি হবে।ওই তোর বাপের দেওয়া কাগজে সই করে দিস তইলেই সব শেষ। যা যাহ।”
নিস্তব্ধ পুনরায় ডিবোর্সে কথা শুনে রাগে চোয়াল শক্ত করে নিলো। সে যে মেয়েটাকে উদ্ধার করলো তাতে তার কোনো দামই নেই।এখন সে বাইরের মানুষ।
তাকে কোনো কাজেই দরকার নেই।

ফুঁসে উঠে কিছু বলতে নিবে তার আগেই পুনরায় নিজেকে শান্ত করে নিলো সে।
তাসফির আওড়ানো তখনকার বাক্যগুলো মনে করে বাঁকা হাসলো।
তবে সে জানেনা সেগুলো কতদুর সত্য। সুস্থ হলে সে নিশ্চিত বোকা মেয়েটা নিজে থেকে কিছুতে তখনকার বলা কথা গুলে স্বীকার করবে না যে সে বলেছে ওসব কথা।বজ্জাত মেয়েটাকে সে হারে হারে চেনে।মুহুর্তের মাঝে সব অস্বীকার করে নেবে।উহু এক সেকেন্ড ওও লাগবে না।
না বলুক সে ঠিক বলিয়ে নিবে।
তাসফির জ্ঞান ফিরলো প্রায় চারটার দিকে। হাতের সেলাইন ওও শেষ।
সবাই তার শিওরে বসা।

শুধুমাত্র নিস্তব্ধ কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।সে তাসফির সামনে যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারছে না। মেয়েটাও তাকে কেমন দেখেও না দেখার ভান করছে দেখ।
এমনি এমনি তো আর সে অভদ্র,অসভ্য বলে না।
তাসফি একবার আড়চোখে নিস্তব্ধকে দেখে গমগমে স্বরে বলল,
-” দাদু তোমার নাতি কে বলো কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে।আমি তাকে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই না।”
নিস্তব্ধ চোখ বড় বড় করে নিলো অসভ্য মেয়েটার কথা শুনে।

যে তাকে বাঁচালো তাকেই বেরিয়ে যেতে বলছে কত্তবড় সাহস কলিজায়।
কিছু বলতে এগিয়ে যাবে তার আগেই সুজন আর মাহীন ওকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরলো। নয়তো দেখা যাবে দুটো এখানেই আবার ঝগড়া করে লংকা কান্ড বাঁধিয়ে দেবে। ওরা ভেবে পাচ্ছে না কিছুক্ষণ আগেই কি মহব্বত দেখলো দুটোর মাঝে আর এখনি আবার শুরু হয়ে গেল।উফফ আর পারা গেল না এদের নিয়ে।
মাহীন সায় দিয়ে বলল,

-” হ্যা ভাই চল তোর এখন রেস্ট দরকার।একটু ফ্রেস হয়ে নে। তারপর আবার আসবি চল।
নিস্তব্ধ আর কোনো উত্তর না দিয়ে ওদের ছাড়িয়ে নিজে থেকেই হন হন করে হেঁটে চলল নিজের চেম্বারে।
সারারাত ধকলের ক্লান্তিতে নিস্তব্ধ ফ্রেস হয়ে চেয়ারে বসে চোখ বুঝতেই কখন ঘুমিয়ে পড়লো বুঝতে ও পারলো না।
নিস্তব্ধ যখন চোখ খুললো ঘড়িতে তখন আটটা বাজছে।
সে চট করে উঠে দাঁড়ালো।
এতটা সময় কখন ঘুমালো ও।
দ্রুত তাসফির কেবিনের নিকট পৌঁছালো।

দরজা খুলতেই যা দেখলো তাতে তার চোখ-মুখ লাল হতে শুধু করলো।
নিস্তব্ধ রাগে চোয়াল শক্ত করে চেয়ে রইলো তাসফি ব্যতীত খালি কেবিন দেখে।
রাগে চিরবিরিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
-” আমার বউ কোথায়?”
অনিমা বেগম নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
-” চলে গেছে।”
-” চলে গেছে মানে।”
বাসন্তী এবার বিরক্তি নিয়ে বলল,
,-” উফফ! চলে গেছে মানে চলে গেছে ভাই। তার বাড়িতে চলে গেছে।এত প্রশ্ন কেন করছিস ভাই।দেখছিস না গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করছি।”

নিস্তব্ধ ঝাঁড়ি মেরে চোয়াল শক্ত করে বলল,
-” সে চলে গেছে তো তোরা এখানে বসে থেকে কি করছিস। লুডু খেলছিস? কেত্তন হচ্ছে এখানে।সার্কাস চলছে? তোরাও পাঁজি মেয়েটার সঙ্গে ব্যাগ বুগছা গুছিয়ে তার সাথে চলে গেলেই পারতিস।অসভ্য মেয়েটার তার জীবন টা ত্যানা ত্যানা করে তবেই ছাড়বে সে যা দেখছে।”
আবারো চিৎকার করে বলল,
-” তোমরা এতটা অকৃতজ্ঞ কি করে বলোতো।ওও অসুস্থ কি করে যেতে দিলে।”
আয়েশা নির্লিপ্ত কন্ঠে টিপ্পনি কেটে বলল,

ধূসর রংধনু পর্ব ২৯

দেয়রজি তোমার বউ কোনো ছোট বাচ্চা নয় যে আমাদের কথা শুনে বসতে বললে বসবে আর চলতে বললে চলবে তার ইচ্ছে হয়েছে তাই গিয়েছে সিম্পল।”
এই সিম্পল কথা বুঝতে পারছো না আমার দেয়রজি।আহারে বেচারা।”

ধূসর রংধনু পর্ব ৩১