মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩০

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩০
নওরিন কবির তিশা

গাড়ি ছুটছে আপন গতিতে। পিছন থেকে এখনো আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে আল্পসের কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা Spital Interlaken হাসপাতালের সাদা কাঁচের দেয়াল। নাহিয়ান নিজ মনে গাড়ি চালাচ্ছে। শিশির এখনো গম্ভীর মুখে তার পাশের সিটে বসে আছে। নাহিয়ান আর শিশির এসেছিল শিশিরের লাস্ট চেক-আপের জন্য। যদিও তার হাতের ব্যথাটা আর শরীরের অন্যান্য ক্ষত কিছুটা সেরে উঠেছে। তবুও ওই যে নাহিয়ান শিশিরের ব্যাপারে extra possessive তাই শিশিরের কোন কথাই কাজ হয়নি একপ্রকার জোর করেই তাকে আরেকবার হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল সে।

ডাক্তার বলেছে, শিশিরের শরীর আগের থেকে কিছুটা সুস্থ তবে এখনো তার রেস্টের প্রয়োজন। নাহিয়ান গাড়ি চালাতে চালাতে একবার শিশিরের দিকে তাকালো,অভিমানী দৃষ্টিতে জালনা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। নাহিয়ান খুব ভালো করেই জানে শিশিরের এই অভিমানের কারণ। কিন্তু এই মুহূর্তে সে যা বলছে তা মেনে নেওয়া নাহিয়ানের পক্ষে সম্ভব নয়।হঠাৎ সজোরে ব্রেক কষলো সে।গাড়ি থেমে গেল নির্জন এক পাহাড়ি রাস্তায়।শিশির সামনের দিকে হেলে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলো এরপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো নাহিয়ানের দিকে। নাহিয়ান তার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—”সিটবেল্ট বাঁধনি কেন?”
শিশির কোনো কথা না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নাহিয়ান আবারও বলল,,
—”কি বললাম?শুনতে পাওনি? সিটবেল্ট বাঁধনি কেন?”
শিশির এবার ফিরে তাকায়, কণ্ঠে চাপা ক্ষোভ:,,
—”লাগবে না! আপনি যা করতেছিলেন তাই করুন। গাড়ি চালান।”
—”হুমম..গাড়িতো চালাচ্ছিলাম।কিন্তু সিট বেল্ট না লাগালে তো আঘাত পাবেন ম্যাম…”
ম্যাম কথাটা যেন ‌এক অন্যরকম মাধুর্য নিয়ে বলল নাহিয়ান। যা শিশিরের হৃদ গহীনে সৃষ্টি ‌করল এক নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি।

—”ওকে নিজে যেহেতু লাগাবেন না তাহলে… কি আর করার? আমিই লাগিয়ে দেই..”
কথাটা বলতে বলতে নাহিয়ান ঝুঁকে পড়ে শিশিরের দিকে‌‌।হাতে তুলে নেয় সিটবেল্টটা।তার চোখে ছিল এক ধরনের প্রশ্রয় আর খুনসুটে মৃদুতা।ধীরে ধীরে শিশিরের বুক বরাবর সিটবেল্টটা টেনে নেয়।চামড়ার ওপর দিয়ে সরতে থাকা সিটবেল্টের ধাতব ক্লিপটা এসে থামে বুকের মাঝ বরাবর।একটানা স্পর্শে যেন মুহূর্তেই শিশিরের গলা ‌শুকিয়ে আসে,হৃদস্পন্দন ছন্দ হারায় ।সেই অদ্ভুত নীরবতার মাঝে, নাহিয়ানের মুখ তার এতটা কাছে যে সে শুনতে পায় শিশিরের বুকের ভিতর চলা হৃদপিণ্ডের অস্থির হুপহাপ শব্দ।নাহিয়ান সামান্য মাথা উঁচু করে উঠতেই,অসাবধানতাবশত ওর কপালের কোণটা এসে হালকা খোঁচা মেরে দেয় শিশিরের চিবুকে। আর সে সামান্য স্পর্শেই শ্বাস ভারী হয়ে আসে ‌শিশিরের।বুকটা হঠাৎই ‌হাপরের মতো উঠানামা করতে থাকে।তার সেই ভারী নিঃশ্বাস এসে লাগে নাহিয়ানের মুখে। শিশিরের এমন অস্থির নিঃশ্বাসে নাহিয়ান স্থির হয়ে যায় এক মুহূর্ত,তারপর চোখ নামিয়ে নিঃশব্দে হেসে ফেলে। ঠিক তখনই গাড়ির স্টেরিও সিস্টেমে হঠাৎ বেজে ওঠে—
“Pal… ek pal mein hi tham gaya
Tu haath mein haath jo de gaya…”

বাংলাদেশ সময় প্রায় সাতটা। প্রায় ঘন্টাখানেক হলো সাজিদ অফিস থেকে বাড়ি এসেছে। কিন্তু এখনো দেখা নেই ইলমার। সাধারণত ইলমাই এ সময় সাজিদের সব জিনিসপত্র রেডি করে রাখে। তার টাওয়াল থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি জিনিসই ইলমা সযত্নে বিছানার উপর গুছিয়ে রাখে। কিন্তু আজ যেন তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।সাজিদ গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েও ইলমাকে না দেখতে পেয়ে সামান্য চেঁচিয়ে বলল,,
—”ইলমা…”

এবারও কোন সাড়াশব্দ আসে না। সাজিদ আরো দুই তিনবার ডাকে। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয় না। অগত্যা, নিজের কাপড় নিজেই বের করার জন্য সে আলমারি খুলে।আলমারি খুলে কাপড় ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎই তার সামনে পড়ে একটা মেডিকেল রিপোর্ট। সেটা হাতে নিয়ে কাগজটা খুলতেই সাজিদের চক্ষু ছানা-বড়া হয়ে যায়।
প্রেগনেন্সি উপরে ইলমার নাম, আর তারিখ অনুযায়ী এক সপ্তাহ আগের রিপোর্ট।সাজিদ মুহূর্তে হাওয়াহীন হয়ে যায়। নিজেকে সামলাতে না পেরে জোরে চিৎকার করে বলে ওঠে,,

—”ইলমা….. কোথায় তুমি?এদিকে আসো এক্ষুনি…. ইলমা….!”
এক প্রকার ছুটে আসে ইলমা।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ‌হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলে,,
—”কি সমস্যা?এভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন?”
সাজিদ রেগে গিয়ে তার দিকে এগিয়ে এসে তাকে ঝাঁকিয়ে বলে,,
—”সমস্যা আমার নাকি তোমার?
—”মানে?”
—”মানে? এটা কি ইলমা?”
প্রেগনেন্সি রিপোর্টটা ওর সামনে তুলে ধরে ‌সাজিদ
ইলমা এক ঝলকে সেদিকে তাকিয়ে, নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,,

—”এটাতো প্রেগনেন্সির রিপোর্ট?”
—”এটা যে প্রেগনেন্সি রিপোর্ট সেটা আমিও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এখানে তোমার নাম কেন?”
—”ওমা রিপোর্ট আমার।তা নাম কি তোমার থাকবে? আজিব”
—”তোমার রিপোর্ট মানে কি? এটা প্রেগনেন্সি রিপোর্ট?”
—”হ্যাঁ তো যে প্রেগন্যান্ট তা রিপোর্টটা তো প্রেগনেন্সি রিপোর্টই হবে তাই না? নাকি প্রেগন্যান্ট হলে অন্য কিছুর রিপোর্ট আসে?আমার জানা নেই, তুমি কি জানো?”
তার এমন স্বাভাবিক অথচ খোঁচাধর্মী কথায় সাজিদের মেজাজ আরও চড়ে যায়—
— “আমি তোমার সাথে ইয়ার্কি করছি না, ইলমা। সিরিয়াসলি বলো, তুমি প্রেগন্যান্ট?!”
এবার ইলমার চোখে জমে থাকা অভিমান, ক্ষোভ, এবং অবহেলার ব্যথা সব একসাথে ছিটকে বেরিয়ে আসল
গলা ভারী হয়ে ওঠল,,

—”না তুমি ইয়ার্কি করবে কেন?ইয়ার্কি তো আমি করছি। ইয়ার্কি করার মত সময় কি তোমার আছে নাকি? এত বড় ব্যবসায়ী তুমি! তোমার আর এত সময় কথাই বলো আমার মত একটা সামান্য মেয়ের সাথে তর্ক করার,ইয়ার্কি করার?”
সাজিদ থমকে যায়।তার চোখে মুখে যেন মুহূর্তেই বোধোদয়ের ছায়া নামে। আসলেও তো গত এক মাসে সে একদমই সময় দিতে পারেনি ইলমাকে। প্রথম কিছুদিন সে শিশিরের জন্য উদ্বিগ্ন ছিল আর পরবর্তীতে নিজের ব্যবসার কারণে।সে ইলমার দিকে তাকিয়ে নরম কন্ঠে বলল,,

—”রাগ করেছো?”
ইলমা কোন উত্তর না দিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে গেল। সাজিদ এগিয়ে এসে পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,,
—”“দেখো জান, সত্যিই আমি ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এখন থেকে না, প্রতিদিন সন্ধ্যায় সময়মতো ফিরবো,
তোমার জন্য… তোমারই শহরটা তোমাকে নতুন করে চিনিয়ে দিবো।”
ইলমা তাকে হালকা ঠেলে বলল,,
—”লাগবে না..আমার তুমি যাও তোমার ব্যবসার কাজে আর ছাড়ো আমায়।”
সাজিদ ইলমাকে হালকা করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,,
—”ছাড়বো কি ছাড়বো না সেটা তো আমার নিজের ব্যাপার কিন্তু তার আগে তোমাকে তো শাস্তি পেতে হবে সাতদিন ধরে তুমি জানা সত্বেও এতবড় সুখবরের ব্যাপারে, আমায় কেন কিছু বলোনি?”
ইলমা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,,

—”সত্যি!! আমি বলিনি?! তুমি কি ঠিক বলছো?”
— “হ্যাঁ! তুমি তো আমাকে কিছু জানাওনি।”
—”মনে করে দেখ আমি তোমাকে অনেকবার বলেছি। দিন কালকে রাত্রেও বলেছি যে আমার প্রচুর পেটে ব্যথা, মাথা ঘুরাচ্ছে, কিছু খেতে ভালো লাগছে না,বমি আসতেছে!হাহ! কিন্তু তুমি?”

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ২৯

সাজিদের এবার নিজের মাথায় নিজেরই ঘুষি মারতে ইচ্ছা করলো। সত্যিই তো বিগত এক সপ্তাহ ধরে ইলমা প্রতিদিন রাত্রেই সাজিদকে একই উপসর্গের কথাগুলো বলতো। এমনকি সাজিদ নিজেও দেখেছে ইলমাকে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে অথবা খাওয়ার মাঝখানে দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে বমি করতে। সে তো ভেবেছিল… হয়তো বদহজমের জন্য। এমনকি সে তো আজকে সকালে ইলমাকে বদহজমের ওষুধ নিজের হাতে খাইয়ে দিতে যাচ্ছিল। আর তখনই ইলমা রাগ করে রুম থেকে বের হয়ে যায়। তাহলে তার কারণটা এটাই ছিল! নিজের বোকামির কথা ভেবে নিজের উপরি নিজের রাগ হলো সাজিদের।

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৩১