অরুণিকা পর্ব ৪১

অরুণিকা পর্ব ৪১
সামিয়া বিনতে হামিদ

হাতে কাচের চুড়ি পরে এদিক-ওদিক হাঁটছে অরুণিকা। চুড়ির টুংটাং শব্দ পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। আহনাফ ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। তার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছে আর আগামীকাল তাকে একটা প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। এখন সে ল্যাপটপে বসে সেই প্রেজেন্টেশনের জন্য স্লাইড তৈরী করছে। কিন্তু অরুণিকার চুড়ির শব্দে তার মনোযোগ অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। সে ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে অরুণিকার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কারো বিয়ে নেমেছে?”
অরুণিকা আহনাফের আজগুবি প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। আহনাফ তার হাতের দিকে ইশারা করে বলল,

“এসব কি শুরু করেছো? এতো রাতে সঙ সেজে বসে আছো কেন?”
অরুণিকা তার হাত ঝাঁকিয়ে তার চুড়িগুলোতে গুঞ্জন তুলে বলল,
“সঙ আবার কি?”
“জোকার!”
অরুণিকা কপালে হালকা চাপড় মেরে বলল,
“হায় আল্লাহ! এই ছেলে বলে কি? জোকররা কি চুড়ি পরে নাকি? চুড়ি তো মেয়েরা পরে। তুমি জোকারও চেনো না? জোকার হচ্ছে যার নাকে….”
আহনাফ অরুণিকাকে থামিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হয়েছে হয়েছে। আর ব্যাখ্যা দিতে হবে না। এখন চুড়িগুলো খুলে রাখো।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দিলো। কিছুক্ষণ পর আবার চুড়ির শব্দ হলো। অরুণিকা চুড়ি পরেই টেবিলের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছে। আহনাফ বিরক্ত হয়ে বলল,
“তোমাকে চুড়িগুলো খুলতে বলেছিলাম না?”
অরুণিকা এবার কোমরে হাত রেখে বলল,
“আমার হাত। আমার চুড়ি। তুমি খুলতে বলার কে?”
“তোমার হাত তোমার চুড়ি, কিন্তু এটা আমার রুম।”
“তো!”
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“রুম থেকে বের হও, যাও।”
“কোথায় যাবো? ড্রয়িংরুমে ইভান পড়ছে। রকস্টারের রুমে তাহমিদ আর আরাফ। আমার রুমে ইমন আর রকস্টার। আর এই রুমে তুমি একা।”
“আমি একা তাই তুমি আমাকে বিরক্ত করতে এসেছো?”
“আরেহ না না। সব রুমে দুইজন করে আছে। এই রুমে একজন হলে তো আর সমান হয় না। স্কুলে মাস্টারমশাই পড়িয়েছেন, সমান সমান সুযোগ সবাইকে দেওয়া উচিত। তাই আমি এই রুমে বসে সুযোগ দিচ্ছি।”
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কাকে সুযোগ দিচ্ছো, শুনি?”

“এই রুমকে। এখন এই রুমে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমতা হবে।”
“তুমি ইভানের পাশে বসে এই সমতা করে নাও।”
অরুণিকা চাপা কন্ঠে বলল,
“ওর ভয়ে আমি তো শ্বাস ত্যাগ করতেই ভুলে যাই। তখন তো সমতা হবে না। বুঝো নি তুমি?”
“আল্লাহর ওয়াস্তে চুড়িগুলো খুলে চুপচাপ যা করার করো। তোমার এসব উদ্ভট লেকচার শুনার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

অরুণিকা এবার আহনাফের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করেই চুড়িগুলো ঝাঁকাতে লাগলো। আহনাফ বসা থেকে উঠতেই সে পালাতে যাবে আহনাফ তাকে খপ করে ধরে ফেললো। অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আচ্ছা, আর শব্দ হবে না।”
আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে নিজেই জোর করে চুড়িগুলো খুলে তার আলমারিতে তুলে রাখলো। অরুণিকা আহনাফের পাশে বসে বলল,
“আমার চুড়িগুলো দাও না, প্লিজ। আমি আর শব্দ করবো না।”
“একদম কালই এই চুড়িগুলো পাবে।”

অরুণিকা মুখ ফুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। সে রুমে এসে দেখলো তূর্য আর ইমন খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করছে। সে আস্তে করে তার ড্রয়ার খুলে চুড়ির আরেকটা বক্স বের করে সেগুলো পরে নিলো। আর আহনাফের রুমে চলে এলো। রুমে এসে এবারও সে ইচ্ছে করেই চুড়িগুলো ঝাঁকাতে লাগলো। আহনাফ হাত মুঠো করে রাগী দৃষ্টিতে ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা ভাব নিয়ে বলল,
“আমার চুড়িগুলো দাও, তারপর আমি এগুলো খুলে ফেলবো”
“তুমি কিন্তু মারাত্মক বেয়াদবি করছো।”
অরুণিকা মুখ ফুলিয়ে বলল,
“আমার চুড়ি দাও আগে।”
আহনাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে অরুণিকার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“চুড়ি তো এতোক্ষণ আলমারিতে ছিল। এখন দেখো, তোমার এই চুড়িগুলোর স্থান কোথায় হয়!”
আহনাফ এবারও অরুণিকাকে শক্ত করে চেপে ধরে তার হাত থেকে চুড়িগুলো খুলে নিলো। আর অরুণিকার রুমে গিয়ে তার ড্রয়ার আর আলমারিতে থাকা সব চুড়ি বের করে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। অরুণিকা তার চুড়িগুলো নেওয়ার জন্য আহনাফের পিছে পিছে ঘুরছে। আহনাফ হুট করে রুমের জানালা খুলে চুড়িগুলো সব জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় অরুণিকা হতভম্ব হয়ে গেছে। আহনাফ এমন কিছু করবে সে কল্পনাও করে নি। অরুণিকা জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। সে এবার রাগী দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকালো। তারপর আরাফের কাছে গেলো।
আরাফ অরুণিকাকে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে, অরু? এভাবে গাল ফুলিয়ে বসে আছো কেন?”
অরুণিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আহনাফ আমার সব চুড়ি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে।”
অরুণিকার কথা শুনে তাহমিদ আর আরাফ তার দিকে তাকালো। আরাফ অরুণিকার অভিযোগ শুনে আহনাফের কাছে আসতেই আহনাফ নিজের যুক্তি দেখিয়ে বলল,
“ওর শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। এখন আর ভুলেও কখনো আমাকে বিরক্ত করতে আসবে না।”
আরাফ এরপর অরুণিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“থাক, আমি তোমার জন্য আরো চুড়ি এনে দেবো।”
অরুণিকা পা ধাপিয়ে কাঁদতে লাগলো, আর বলল,
“না, আমার ওই চুড়িগুলোই লাগবে।”

আরাফ আর তাহমিদ কোনোভাবে তাকে বুঝিয়ে অন্য দিকে মনোযোগ ফেরালো। তবে অরুণিকাও চুপ করে বসে থাকার মতো নয়৷ সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, সে আহনাফকেও শাস্তি দেবে৷
সকালে আহনাফ কলেজে যাওয়ার জন্য তার ড্রয়ার খুলে দেখলো, সেখানে তার হাত ঘড়িটা নেই৷ আশেপাশে খুঁজে যখন পেলো না, তখন সে আলমারি খুললো। আহনাফকে অনেকক্ষণ ধরে আলমারিতে ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখে তাহমিদ বলল,
“কলেজে যাবি না? আলমারিতে কি খুঁজছিস?”
“অদ্ভুত তো! আমার একটা ঘড়িও খুঁজে পাচ্ছি না।”

হঠাৎ তার টনক নড়লো। সে জোরে পা চালিয়ে অরুণিকার কাছে গেলো। গিয়ে দেখলো অরুণিকা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে দুই পা উপরে তুলে গালে হাত দিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফকে দেখে সে তাড়াতাড়ি উঠে পা দুইটা দুই পাশে মেলে বসলো, আর বলল,
“আসো, আসো তোমার অপেক্ষায় অরুণিকা চৌধুরী তার দুয়ার খুলে বসে আছে।”
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি দিন দিন খুব বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো। এখন বলো, আমার ঘড়িগুলো কোথায়?”
“আছে একটা জায়গায়। কিন্তু উত্তর পাবে এক ঘন্টা পর। যদি এখন উত্তরের অপেক্ষায় বসে থাকো, তাহলে তোমার পরীক্ষার বারোটা বেজে যাবে।”

আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে গেলো। এরপর বিকেলে আহনাফ বাসায় আসার পর অরুণিকা বলল,
“তোমার ঘড়ি কোথায় জানতে চাও?
“হ্যাঁ, কোথায়!”
অরুণিকা ডাস্টবিনের দিকে ইশারা করতেই আহনাফ দৌঁড়ে সেদিকে গেলো। গিয়ে দেখলো ডাস্টবিন খালি। আহনাফ বলল,
“কোথায়?”
অরুণিকা খালি ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওপস! রকস্টার তো কিছুক্ষণ আগেই ময়লাগুলো ফেলে এসেছিল। ইশ, তাহলে তোমার ঘড়িগুলো সব সামনের বড় ময়লার ঝুড়িতে চলে গেছে।”

অরুণিকা পর্ব ৪০

আহনাফ নিচে নেমে একটা কাঠি দিয়ে ময়লাগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো ঘড়িগুলো সেখানেই আছে। আহনাফের দামি ঘড়ির পরার শখ৷ সব’কটাই তার শখের ঘড়ি, আর ঘড়িগুলোর দামও অনেক বেশি। তাই সে বাধ্য হয়েই একটা ছেলেকে ডেকে এনে ঘড়িগুলো সব ডাস্টবিন থেকে তুলে আনলো। বাসায় আসার পর অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বলল,
“অরুণিকার সাথে পাঙ্গা নিলে গঙ্গায় পড়বে। বুঝেছ?”

অরুণিকা পর্ব ৪২