অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৩৮
লিজা মনি
রাত তখন একটা বাজে দশ মিনিট। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ, নিঃশব্দ। শুধু নিশ্বাসের শব্দে ভারি হয়ে উঠে স্টাডি রুম।
জানালার বাইরে বাতাসে পাতার ফিসফাস। স্টাডি রুমটা অর্ধ-আলোয় আবৃত। টেবিলের কোণে রাখা ছোট্ট একটা শেডল্যাম্প মৃদু হালকা হলুদ আলো ছড়িয়ে রেখেছে ঘরের ভেতর। সেই আলোয় বুকশেলফের বইগুলো ছায়া ফেলেছে দেয়ালে। দেয়ালে ঝুলছে কিছু পুরোনো ফ্রেম। তার সামনেই কাউচের উপর রয়েছে দুই মানব- মানবী।
অগ্নির পাগলামো আর অবাধ্য হাতের বিচরনে ইয়ানা কম্পিত হয়ে পড়ে। আকস্মিক কিছু একটা মনে হতেই মস্তিষ্কের টনক নড়ে। কেঁপে উঠে শরীরটা। কিভাবে সামলাবে এখন? কিভাবে আটকাবে সে অগ্নিকে?
ভয়ে ঢোক গিলে কয়েকবার। অগ্নি ইয়ানার হাত ছেড়ে দিয়ে গলায় মুখ ডোবাতে যাবে এমন সময় ইয়ানা অগ্নিকে আচমকা ধাক্কা মারে। দ্রুত উঠে নিজের শরীরে কপড় জড়িয়ে নেয়। ইয়ানার ধাক্কার জন্য অগ্নি মোটে ও প্রস্তুত ছিলো না। সে তো অন্য জগতে চলে গিয়েছিলো। হঠাৎ এমন হওয়াতে মস্তিষ্কের রক্ত টগবগিয়ে ফুটতে শুরু করে। ইয়ানা অগ্নিকে ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে দিয়েছে ভাবতেই হাত দুটি মুষ্ঠি করে ফেলে। রাগে তিঁরতিঁর করে কাঁপছে পুরো শরীর। আবছা আলোতে রাগী চোখে ইয়ানার দিকে তাকায়। হালকা ব্রাউন চোখের কার্নিশে লাল হয়ে গেছে। সামান্য আলোতে অগ্নির চোখ দেখে ইয়ানা ভয়ে তটস্থ হয়ে দাঁড়ায়। অগ্নি ধীর পেয়ে ইয়ানার কাছে এসে দাঁড়ায়। ঘাড়ের পিছন দিকে ইয়ানার চুলগুলো শক্ত করে চেপে ধরে। ইয়ানা ব্যাথায় মুখ কুচকে ফেলে। চুলে টান অনুভব হচ্ছে প্রচুর। অগ্নি ইয়ানার চুলে শক্ত করে ধরে নিজের দিকে মুখ তুলে ধরে । ইয়ানার চোখে পানি চিকচিক করছে। অগ্নি ইয়ানার পুরো মুখে চোখ বুলিয়ে তিরিক্ষি মেজাজে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন,,,,,,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” ধাক্কা কেনো দিয়েছিস আমাকে? প্রথমবার তো নয় এইটা তাহলে? অগ্নি চৌধুরিকে ধাক্কা দেওয়ার সাহস হয় কি করে? বেশি আদর – ভালোবাসা দিয়ে ফেলেছিলাম ? ভয় পাস না আমাকে? উত্তর দে! ধৈর্য খুব কম আমার। যেকোনো সময় নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলব।
ইয়ানা অগ্নির রাগ দেখে ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে। অগ্নির এক একটা ধমকে কেঁপে উঠছে বার বার। আড়চোখে অগ্নির রাগান্বিত মুখে নজর দিয়ে অগ্নির বুকে মাথা রাখে। ইয়ানার এমন কান্ডে অগ্নি ভ্রু কুচকে তাকায়। রাগের মাত্রা আর ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক ঝটকায় ইয়ানাকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়। রাগ হচ্ছে প্রচুর তার। নিজে এসে সিডিউস করবে আবার নিজেই ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিবে। ইয়ানা অগ্নির একদম সম্মুখে দাঁড়ায়। এরপর তার দিকে তাকিয়ে মিহি সুরে বলে,,,,,,
“” ভুলে গিয়েছেন আমি অসুস্থ।
ইয়ানার এই বাক্য অগ্নির টনক নড়ে। রাগে কাঁপতে থাকা শরীরটা থম মেরে যায়। পুরো শরীর এক প্রকার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। ইয়ানার দিকে আর তাকায় না।মাথার চুল খামচে ধরে চেয়ারে বসে। বড় বড় শ্বাস টানছে। এত বড় ভুল! অগ্নির এমন অবস্থা দেখে ইয়ানা এগিয়ে গিয়ে অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে,,,,,
” কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে?
অগ্নি ইয়ানার দিকে তাকায়। তবে একদম শান্তভাবে। ইয়ানা অগ্নির চোখে নিজের দৃষ্টি রাখে। অগ্নি ঠান্ডা গলায় বলে,,,,,,
” তুমি আমার কাছে আসলে আমি না হয় নিজেকে হারিয়ে ফেলি। সবকিছু ভুলে যায়। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না। আমাকে বললে না কেনো তখন?
ইয়ানা কি বলবে। ভয়ে হাঁসফাঁস করছে। জামার এক টুকরো অংশ নিয়ে নিজের আঙ্গুলে পেচিয়ে নিচ্ছে বার বার। কিভাবে বলবে কথাটা যদি রেগে যায়। ইয়ানা নিরবতা ভেঙ্গে আমতা আমতা করে বলে,,,,,,
” মনে ছিলো না একদম। হঠাৎ মনে হয়েছে। আপনাকে থামানো ও আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিলো তাই ধ্বাক্কা দিয়েছি।
অগ্নি বিরক্ত হয় ইয়ানার কথায়। কেমন মেয়ে এইটা? নিজের অসুস্থতার কথা নিজের মনে নেই! যদি আজ ভুল কিছু হয়ে যেত ধারনা আছে এই মেয়েকে কতটুকু সাফার করতে হত। শুধু নিজে না আমাকে ও সাফার করাতো। অধৈর্য করে ফেলত আমাকে। নিজের তো কিছু হত না কিন্তু আমাকে ভিতর থেকে মেরে ফেলত। অগ্নিকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে ইয়ানা আওড়ায়,,,,,
” রেগে আছেন এখন ও? ”
ইয়ানার এমন বোকা কথায় অগ্নি দাঁত চেপে তাকায়। ইয়ানা হাসার চেষ্টা করে বলে,,,,,,,
” প্লিজ রাগ করবেন না। বুঝতে পারছি মনে মনে গালি দিচ্ছেন। সমস্যা নেই মনে মনেই গালি দিন প্রকাশ করার দরকার নেই। আপনার ধমক একটু বেশি শক্ত। আমার শরীর কেনো জানি মৃগী রোগীর মত কেঁপে উঠে।
ইয়ানার এমন কথায় অগ্নি ধমক দিয়ে বলে,,,,,,,
” স্টুপিড! , চুপ করবে? নাহলে আছাড় মেরে ছয় তালা থেকে নিচে ফেলে দিব। শান্ত হতে দাও আমাকে। আরেকটা কথা বের হলে থাপরিয়ে অজ্ঞান করব বিয়াদপ।
অগ্নির ধমকে ইয়ানা চুপসে যায়। আস্তে করে কাউচটার উপর গিয়ে বসে। এই স্টাডি রুমে সে কখনো আসে নি। এই প্রথম এসেছে সে আজ। ইয়ানা কাউচ থেকে উঠে গিয়ে বইয়ের তাকের কাছে যায়। এখানে অসংখ্য বই আছে। কিন্তু সব বইয়ের উপর ধুলোর আস্তরন জমে গিয়েছে। পরিষ্কার করা হয় না বইগুলোকে। কেমন অযত্নে – অবহেলায় পড়ে আছে। ইয়ানার ইচ্ছে হচ্ছে সবগুলো বই পরিষ্কার করে দিতে। কিন্তু এখন অনেক রাত তাই এইটা পরিষ্কার করার সময় নয়। একদিন আলিয়াকে নিয়ে এই পুরো স্টাডি রুম চকচকে করে দিয়ে যাবে। কিন্তু এইটা এমন পরিত্যক্ত পড়ে আছে কেনো? মনে তো হচ্ছে এইটা উনার পুরনো স্টাডি রুম। নিজের অতীতকে এইভাবে অযত্নে রেখে দিয়েছে। কেমন মানুষ উনি?
সুমু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মিসডকলের শব্দ বার বার কানে আওয়াজ তুলছে। কিন্তু গভীর ঘুমের কারনে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। মন চাইছে ফোনটা তুলতে কিন্ত শরীর বিন্দুমাত্র নড়ছে না। শরীরটা যেনো অবশ হয়ে আছে। ফোনের শব্দ ধীরে ধীরে প্রখঢ় হতে থাকে। আচমকা ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। সুমু ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত দুইটা বাজে। এত রাতে কে ফোন দিয়েছে। চিন্তা মাথায় এসে ভড় করে। অপরিচিত নাম্বার। ফোন কি রিসিভ করবে নাকি করবে না, এক প্রকার দ্বিধায় পড়ে যায়। যদি কোনো বাজে লোক ফোন দিয়ে থাকে? তাদের কাজ ওইত মেয়েদেরকে ডিস্ট্রাব করা। ফোন দিয়ে রং- তামাসা করা। কিন্তু যদি কোনো দরকারি ফোন হয়ে থাকে তাহলে? মনের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে ফোনটা রিসিভ করার ডিসিশন নেয়। মিসডকল কেটে যাওয়ার আগেই সুমু রিসিভ করে কানে চেপে ধরে বলে।,,,,,,,
” আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
সুমুর আওয়াজে ওই পাশে নিরবতা। শুধু নিশ্বাসের শব্দ শুনা যাচ্ছে। সুমুর শরীরে হালকা শিহরন দিয়ে উঠে। এত রাতে কে ফোন করেছে? কথা বলছে না কেনো? কোনো প্রতারক? প্রতারক ওই হবে তাই তো কথা বলছে না। সুমুর এইবার প্রচুর রাগ হয়। সুমু নিরবতা ভেঙ্গে রেগে বলে,,,,,,,,,
” কি সমস্যা বলোনতো আপনার? মেয়েদের এইভাবে মাঝ রাতে ফোন দিয়ে উত্যক্ত করতে খুব ভালো লাগে? এই তর ঘরে মা- বোন নেই? মেয়ে দেখলেই তার সাথে ঢলাঢলি করতে ইচ্ছে করে তাই না। মেয়েদের নাম্বার নিয়ে তাকে মাঝ রাস্তায় ফোন দেছ। তর নামে তো আমি যৌন হয়রানির মামলা করব। অসভ্য জানোয়ার একটা। শালা তকে যদি সামনে পেতোম তাহলে আমি আমার বিশ জোড়া জুতা দিয়ে তর গালে আঘাত করতে করতে লাল করে দিতাম। আর জীবনে যদি ফোন দিয়েছিস তাহলে তর ভবিষ্যত বাত্তির বারোটা বাজাবো। সাহস থাকলে আসিস আমার সামনে।
সুমু রাগে কি বলছে সে নিজে ও জানে না। এক হচ্ছে এত রাতে ঘুমটা ভেঙ্গেছে তার উপর এমন ড্রামা। পাশের ব্যাক্তিটাকে যদি সামনে পাইত সে কি করত নিজে ও জানে না। কত বড় অসভ্য আর বাদর মাঝ রাস্তায় ফোন দিয়ে বিরক্ত করে। ফোনের এই পাশ থেকে কাঁশির শব্দ শুনে সুমু চুপ হয়ে যায়। এই লোক কাঁশছে কেনো? যক্ষা রোগী নাকি? টাকা চাইতে এসেছে চিকিৎসা করাবে বলে? আরে ধুর! এইসব ওদের ধান্ধা। রোগের অভিনয় করে টাকা হাতাতে চাওয়া।
সুমু কিছুটা চিবিয়ে বলে,,,,,,,
“” বুঝেছি আপনি যক্ষা রোগে আক্রান্ত। আমাকে কেঁশে প্রমান দিতে হবে না। টাকা চাই তাইতো? আপনি যেহেতু আমাকে ফোন দিয়েছেন কষ্ট করে বাসার ঠিকানা ও জোগার করুন। আমার বাসার সামনে আসেন টাকা দিয়ে দিব নে। তাও প্লিজ ধান্ধা বাজি বন্ধ করেন।
সুমু ফোন কাটার জন্য কান থেকে নামাতেই শুনতে পায় এক আওয়াজ।
“” মিস রাগিনী আপনার অদ্ভুত বকা- ঝকা বন্ধ হয়েছে? না মানে আরও কিছু ঝাড়তে চাইলে ঝাড়তে পারেন। আগে থেকে অভ্যস্ত হওয়া ভালো। নাহলে পরবর্তীতে সব এক সাথে হজম করতে পারব না। একটু সমস্যা হাবে।
এই কন্ঠস্বর তার খুব পরিচিত। এইটাকে সে খুব ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারে। সুমু অবাক চোখ বড় বড় করে ফেলে। চোখ কচলিয়ে বার বার নাম্বারের দিকে তাকায়। এইটা উনার নাম্বার? ইয়া আল্লাহ কি লেভেলের ডাইরেক্ট সম্মানহানী। এতক্ষন উনাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছিলাম। কি ভাবছেন উনি এখন। সুমু লজ্জায় আরষ্ঠ হয়ে পড়ে। কিভাবে সামনে যাবে। জীবনে ও যেতে পারবে না রায়ানের সামনে। সুমু চোরের মত ফোন কেটে দিতে যাবে আবার ও ভেসে আসে………
” যদি ফোন কাটার কথা ভেবে থাকো তাহলে কাটবে না। কথা আছে তোমার সাথে আমার। আমার ঘুমের প্রয়োজন কিন্তু ঘুম হচ্ছে না।
সুমু চমকায় সাথে লজ্জা ও পায়। এই প্রথম কোনো ছেলের মুখে এইসব কথা শুনেছে। সে রিলেশন পছন্দ করে না। কি দরকার আছে একটা ছেলের কাছে নিজের ব্যক্তিত্ব নষ্ট করা। যদি ছেলেটা তার না হয় তখন? তখন সে ঠকে যাবে না। তার দিকে পরপুরুষ কেনো কামনার হাত বাড়িয়ে দিবে? সে তো একজনের আমানত। আর সেই আমানত সে কখনো ভাঙ্গেনি।
রায়ান — কথা বলবে না? চুপ করে আছো যে? এতক্ষন এতকিছু বলে হাঁপিয়ে উঠেছো?
সুমু নতজানু অপরাধীর ন্যায় বলে,,,,,,,,
” সরি কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আমি চিনতে পারি নি। ভেবেছিলাম কোনো প্রতারক ফোন দিয়েছে। আর আপনি ওত কথা বলছিলেন না। রেগে এইসব বলেছি। তবে সেগুলো আপনাকে নয় প্রতারকদের।
রায়ান হালকা হাসে। এই কন্ঠস্বর শুনার জন্য ওইত সে এতরাতে ফোন দিতে বাধ্য হয়েছে। ছটফট করছিলো বিছানায় একবার কথা বলবে বলে। এক প্রকার অধিকার দেখিয়ে ফোন দিয়েই দিলো। রায়ান সুমুর উদ্দ্যেশ্যে বলে,,,,,,
” আমাদের বিয়ের তারিখ হয়েছে সেটা জানো তুমি?
সুমু লজ্জায়া হাঁসফাঁশ করে বলে,,,,,
“হুম দুই দিন পর ।
রায়ান — তুমি খুশি তো?
রায়ানের কথায় সুমু থমকে যায়। চোখ উপরে তুলে তাকায়। ফোনের দিকে নিজের দৃষ্টি নেয়। আসলে কি সে খুশি? অবশ্যয় সে খুশি। খুশি হবে না কেনো? না হওয়ার তো কোনো কারন নেই তাহলে। কিন্তু এইটা কিভাবে বলব? লজ্জা লাগবে না আমার।
রায়ান — বলো তুমি খুশি?
সুমু নিশ্বাস ছেড়ে বলে,,,,,,
” হুম।
রায়ান হাসে। সুমুকে নিজের করে পাবে ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে। সুমু সংকোচ ভেদ করে বলে,,,,,,
” আপনারা ইয়ানাকে কিছু জানান নি তাই না? আজ ওর সাথে কথা বললাম কিছুই জানে না বিয়ের ব্যাপারে। ভাইয়া কিছু বলে নি?
রায়ান — তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম সেটা আমরা আর আরিফ ছাড়া কেউ জানে না। আঙ্কেল আন্টি ও না। কাল জানানো হবে তাদের।
সুমু — ওহহ আচ্ছা। আমি ফোন দিয়েছিলাম রাসেদ স্যারের এক্সিডেন্টের ঘটনা জানাতে। তখন আপনাদের কথা উঠে আসে।
রায়ান ভ্রুঁ কুচকে বলে,,,,,,
” কে এক্সিডেন্ট করেছে?
সুমু — আমাদের ভার্সিটির স্যার। আজ বিকেলে একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে আহত হয়। এরপর উনাকে হসপিটালে এডমিট করানো হয় দ্রুত।
রায়ানের হঠাৎ রাস্তার ঘটনা মনে পড়ে। তারা যখন যাচ্ছিলো তখন ও বিকেলে একটা এক্সিডেন্ট হয়। তাহলে উনি রাসেদ স্যার? হবে হয়ত।
রায়ান — ওকে ঘুমিয়ে পড়ো। রাতে ফোন দিয়ে ডিস্ট্রাব করলাম। আগামী কাল দেখা হবে বাই।
সুমু — আল্লাহ হাফেজ।
রায়ান হালকা হেসে ফোন কেটে দেয়। সুমু মুচকি হাসি দিয়ে বেড সাইড থেকে পানি খায় এক গ্লাস। লজ্জায় পুরো মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। রায়ানের সাথে কথা বলেছে কথাটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। কাল দিন পর এই লোকটা তার স্বামী হবে। এই শক্তপোক্ত দেহের ব্যক্তিটার সাথে সে পথ পার করবে। সুমুর শরীর হালকা কেঁপে উঠে।
রাতের আঁধার ঘন হয়ে নেমে এসেছে জঙ্গলের বুকে। আকাশ নিজেই নেমে এসে ঢেকে দিয়েছে গাছের মাথা। পাতার ছায়া আর মৃত মাটিকে। আকাশে কোনো চাঁদ নেই, তারা নেই,আলো যেন ভুলে গেছে এই জায়গার নাম। কেবল অন্ধকার। চিৎকার-ধরা, নিঃশব্দ অন্ধকার।
জঙ্গলের ভিতরে বাতাস বইছে ধীরে, নরম কিন্তু অস্থির। পাতার গায়ে তার স্পর্শ চামড়ায় ছুরি চালানোর মতো ধীরে, অথচ নিশ্চিত। ফস,,,, ফসসস,,,,,,প্রতিটি পাতার দুলে ওঠা মনে হচ্ছে কোনো দমবন্ধ নিঃশ্বাসের মতো শব্দ তোলে। গাছেরা কথা বলে না, কিন্তু তারা কাঁপে।
সেই জঙ্গলের ভিতরে টর্চারসেলে একটা পরিত্যাক্ত রুমে অগ্নি প্রবেশ করে। মূলত এখানে এসেছে কোনো কিছুর খুঁজে। রাত তখন তিনটা বেজে চল্লিশ মিনিট। তার সাথে আরিফ আছে। তাদের দুজনের পায়ের শব্দে ভারি হয়ে উঠে চারপাশ।
অগ্নি আর ইয়ানা যখন স্টাডি রুম থেকে গিয়ে নিজের রুমে চলে গিয়েছিলো ইয়ানা ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়ে। আর অগ্নি শাওয়ার নেয়। যেহেতু ছেলেটাকে মেরেছে শরীর কেমন করছে। কাউকে খুন করে এসে শাওয়ার না নিলে সে থাকতে পারে না। অগ্নি শাওয়ার শেষ করে ইয়ানার কপালে চুমু খায়। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে সেই সুযোগে সে রুম ত্যাগ করে সোজা টর্চার সেলে আসে। আরিফ জানিয়েছে আজ টর্চার সেলে কেউ একজন প্রবেশ করেছিলো। আর সেই সন্দেহের সূত্র ধরেই তার এখানে আসা।
ইয়ানা একবার ঘুমিয়ে পড়লে এত সহজে সজাগ হয় না। সেই আত্নবিশ্বাস নিয়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে পড়েছিলো। কিন্তু ইয়ানা ঘুমায় নি। ভেবেছিলো অগ্নি শাওয়ার নিয়ে আসলে তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে। তাই ঘুমের নাটক করে শুয়ে ছিলো। অগ্নি বাহিরে যেতেই ইয়ানা চোখ খুলে উঠে বসে। অগ্নিকে এত রাতে বাহিরে যেতে দেখে ইয়ানার সন্দেহে কপাল কুচকে আসে। আবার কাকে মারতে যাচ্ছেন উনি? এত রাতে মারাটা কি খুব বেশি প্রয়োজন। ইয়ানা বিছানা থেকে নেমে লিভিং রুমে যায়। ততক্ষনে অগ্নি দরজা থেকে বের হয়ে গাড়ির কাছে চলে যায়। ইয়ানা এক পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো। আজ আমি ও দেখব আপনি কোথায় যান। আর কাউকে খুন করতে দিব না আমি। ইয়ানা ইচ্ছে করে একটা ফুলদানি ফেলে দেয়।
ফুলদানিটা পড়ে গিয়ে বিকট আওয়াজের কম্পন সৃষ্টি করে। অগ্নি শব্দ পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে লিভিং রুমের দিকে তাকায়। সামান্য কপাল কুচকে সেদিকে আসে। চারদিকে ভালোভাবে চোখ ঘুরিয়ে দেখে কিন্তু কেউ নেই। কিন্তু ফুলদানিটা পড়লো কিভাবে? অগ্নি এইসব মাথা না ঘামিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠে। ইয়ানা ততক্ষনে অগ্নির গাড়ির দরজা খুলে ব্যাক সিটে গিয়ে নিচে হাটু ভাঁজ করে বসে।মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে। যদি একবার ধরা পড়ে তাহলে আজ মাইর নিশ্চিত। কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবেন উনি আমাকে। কিন্ত আমিও কম যায় না। আমি ও মাফিয়া অগ্নি চৌধুরির বউ। উনার সাহস যদি হয় ১০০% আমার কি ২০ % ও থাকবে না? অবশ্যয় থাকবে। কেনো থাকবে না?
ইয়ানা মনে মনে ভয়ে চোখমুখ বন্ধ করে রাখে। গাড়ি চলছে শাঁ শাঁ করে। এত জোড়ে গাড়ি চলছে দেখে ইয়ানা ভয়ে আরও সিটিয়ে যায়। যদি ওইদিনকার মত আবার এক্সিডেন্ট করে। কিন্ত আমি তো থামাতে ও পারব না। কথা বললেই ধরা পড়ে যাব। ঘন্টা খানেক পর গড়ি এসে ডুকে একটা ঘন – জঙ্গলের ভিতরে। চারদিকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। পেঁচা আর ও ভিবিন্ন পাখির ডাক। রাতের পরিবেশটা যেনো এক অদ্ভুত ঠেকাচ্ছে। ঘন জঙ্গলের শুকনো পাতা বিছিয়ে আছে মাটি জুড়ে। গাড়ি এগিয়ে যেতেই মড়মড় শব্দে এক বিচ্ছিরি পরিবেশ তৈরি করে। ইয়ানা কান চেপে ধরে। প্রচুর ভয় লাগছে তার। এমন ঘন জঙ্গলে একটা মানুষ রাতে কিভাবে আসে।
গাড়ি গিয়ে থামে একটা ঝোঁপের সামনে। ইয়ানা মথা উচু করে ঝুঁপটা দেখে নেয়। সাথে সাথে চোখ বড় বড় হয়ে যায়। কেঁপে উঠে পুরো শরীর। কি ভয়ানক এই ঝোঁপ। কিন্তু কি এখানে? ঝোঁপের আড়ালে তো কোনো পরিত্যক্ত বিল্ডিং মনে হচ্ছে। অগ্নি গাড়ি থেকে নেমে চলে যায় সেদিকে। এইবার ইয়ানার জান যায় যায় অবস্থা। এতক্ষন অগ্নি ছিলো তাই ভয়টা কাবু করতে পারে নি। কিন্তু এখন একদম শক্তভাবে জড়িয়ে ধরেছে। কি করবে এখন? বের হলে আমার পায়ের শব্দ পেয়ে যদি উনি বুঝে যায় তাহলে তো অনর্থ হয়ে যায়। কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না উনি কি করছে তা তো আমাকে দেখতে হবে।
এইদিকে অগ্নি আরিফকে নিয়ে পুরো টর্চার সেল দেখে বাট সন্দেহজনেক কিছু পায় নি। অগ্নি বিরক্তি নিয়ে টর্চার সেল থেকে বেরিয়ে সেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। কোমরে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে কিছু একটা ভাবে। তখন দেয়ালে একটা আলো দেখে সাথে সাথে সরে যায়। কেউ গান তাক করে রেখেছে। কোমরে গুঁজে থাকা বন্ধুকটা হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু কেউকে দেখতে পাচ্ছে না। আরিফ বাহিরে এসে অগ্নিকে বন্ধুক তাক করতে দেখে বলে,,,,,,,,
” কি হলো ভাই কিছু পেয়েছেন? বন্ধুক তাক করে রেখেছেন কেনো?
অগ্নি একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলে,,,,,,,,,,
” কেউ আছে এখানে গান লাইট দেখা গিয়েছে। গান তাক করেছিলো আমার দিকে। বাট বিচটা গেলো কোথায়?
কারোর পায়ের হালকা শব্দ পেয়ে অগ্নি কান ভালোভাবে পেতে রাখে। কোনদিক দিয়ে আসছে এই শব্দ?
আরিফ ধীর আওয়াজে বলে,,,,,
” ভাই শব্দ তো দুই দিক দিয়ে আসছে কিভাবে বুঝব এখন?
অগ্নি — তুই সামনে যা। দেখ সামনে কে আছে? আমার গাড়ি যেখানে রেখেছি সেখান থেকে শব্দটা আসছে।আমি এইদিকে যাচ্ছি।
আরিফ– ওকে ভাই।
অগ্নি আড়ালে গিয়ে বামদিকে যায়। সামনে এগিয়ে যেতেই কাউকে দৌড়াতে দেখে। অন্ধকারে মানব আকার স্পষ্ট। অগ্নি বাঁকা হাসি দিয়ে বলে,,,,,,
” হেই ? আমি তর সাথে দৌড়ের প্রতিযোগিতা করতে আসি নি। দৌড়ের প্রয়োজন নেই। চল কাটাছিড়ার প্রতিযোগিতা করি।
অন্ধকারে ব্যক্তিটি দৌড়েই যাচ্ছে। অগ্নি চোখ ছোট ছোট করে তাকায় সেদিকে। রক্ত ফুটতে থাকে শরীরের। লোমকূপ গুলো শিউরে উঠে হয়ত রাগের তাপ সহ্য করতে পারছে না। অগ্নি দক্ষ হাতে বন্ধুকটা লোকটার পায়ের ঘোড়ালিতে গিয়ে ডিল মারে। বন্ধুক গিয়ে সোজা ব্যক্তিটার পায়ে গিয়ে পড়ে। ব্যাথায় আহহহহ,,,, করে বসে যায়। কিন্ত জীবন হারানোর ভয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। বাঁচবে না সে জানে? জীবন বাজি রেখেই সে এই কাজ নিয়েছে মোটা টাকার বিনিময়ে। লোকটা দৌড়াতে চায় কিন্তু পায়ের রগ টান ধরে। অতিরিক্ত ব্যাথার ফলে লোকটা প্রান প্রন দৌড়ার চেষ্টা করে।
আরিফ ঝোঁপ থেকে বের হয়ে বন্ধুক তাক করে চারদিকে তাকায়। গাড়ির পিছন থেকে পাতার শব্দ পেয়ে বন্ধুকটা ধরে সেদিকে যায়। আরিফ ধীর পায়ে সেদিকে যায়। ফন্ট সিটের লাইটের আলোতে নারী অবয়ব ভেসে উঠে। আরিফের চোয়াল ঝুঁলে আসে। এ কাকে দেখছে সে? একবার দুরে থাকা অগ্নির দিকে তাকায় আরেকবার গাড়ির পিছনে থাকা ইয়ানার দিকে। অরিফ অবাক হয়ে বলে উঠে,,,,,,,
” ভাবি আপনি এখানে?
ভাবি ডাক শুনে ইয়ানা চমকে উঠে। চোখ বড় বড় কর ফেলে। আরিফের কন্ঠ তার আর বুঝার বাকি নেই। ইয়ানা শুকনো ঢুক গিলে পিছনে ফিরে তাকায়। আরিফ এখনও অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। স্বামীর খুন তার স্ত্রী লুকিয়ে দেখছে। ইয়ানা আরিফের হা করা মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা শান্ত হয়ে বলে,,,,
“” আমি এসেছি উনি জানেন না। প্লিজ বলবেন না কিছু? উনি ওইখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? মনে হচ্ছে সামনে কেউ আছে। কিন্ত ঝোঁপের কারনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। ভাইয়া কাউকে মারলে প্লিজ আটকান না।
আরিফ হাসি দিয়ে বলে,,,,,,,,,
” সেই ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই ভাবি। উনি অগ্নি চৌধুরি, এক কথার মানুষ। যা বলেন তাই করেন। আর উনার টর্চার সেলে কেউ আসলে সে জান নিয়ে ফিরতে পারে না। কখনো ফিরতে দেখিনি। কঠিন মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছি।
তাদের কথার মাঝে বন্ধুকের শব্দ ভেসে আসে। রাতের এই নিস্তব্দতায় এত বিকট আওয়াজ ইয়ানা কেঁপে উঠে। পর পর ছয়টা গুলি চলে গান থেকে। ইয়ানা সহ্য করতে না পেরে কান চেপে ধরে।
আরিফ আতঙ্কিত হয়ে বলেন,,,,,,,,
” ভাবি আপনি যেভাবে এসেছেন সেখানে চলে যান। ভাই আসবে এখন। উনি দেখলে রেগে যাবেন ভাবি।
ইয়ানা ঠোঁট চেপে কান্না আটকিয়ে বলে,,,,,,,
” কাকে মেরেছে উনি ভাইয়া?
আরিফ — সেটা আপনাকে পরে……..
আর বলতে পারে নি আবার ও দুইটা গুলির শব্দ আসে। আরিফ সেদিকে তাকায়। আরিফ সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে চাইবে এমন সময় আর ও দুইটি গুলির শব্দ আসে। অগ্নির দুই হাটু থেকে রক্ত ঝড়ছে। বুক থেকে অনবরত রক্ত পড়ছে। এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলে ও এখন হাটু গেড়ে বসে পড়ে। চোখ লাল করে সামনে কালো আবরনে থাকা ব্যক্তিটার দিকে তাকায়।
আরিফ এমন দৃশ্য দেখে বরফের ন্যায় জমে যায়। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে নোনা জল। ইয়ানা গুলির শব্দে ভয়ে সেদিকে তাকায় নি। আরিফের চোখে পানি দেখে ইয়ানার কপাল কুচকে আসে। কেমন মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ানা দৃষ্টি অনুসরন করে সেদিক তাকায়। মুহূর্তের চিৎকার দিয়ে দু কদম পিছিয়ে যায়।
আরিফ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি। ভাই করে চিৎকার দিয়ে দৌড় দেয়। কালো আবৃত লোকটি আরিফের দিকে তাকিয়ে গুলি করতে যাবে তার আগেই আরিফ দক্ষ হাতে লোকটার বক্ষ আর মাথার মধ্যে পর পর অনেকগুলো গুলি করে। লোকটার হাত থেকে বন্ধুক পড়ে যায়। রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। মাথায় গুলি করাতে গরগর করে মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে।
অরিফ এক দৌড়ে অগ্নির কাছে গিয়ে বসে। অগ্নি এখন ও ঙ্গান হারায় নি। কিন্তু অবস্থা খুব খারাপ। পিছন দিকে এসে আঘাত করেছে তাই সে বুঝতে পারে নি। বুঝার আগেই গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আরিফ চোখের পানি ছেড়ে দেয় অগ্নির অবস্থা দেখে। বুকে গুলি, হাটুতি গুলি।
ইয়ানা স্তব্দ হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। অতিরিক্ত শক পেলে যেমন যেমন হিতাহিত ঙ্গান শূন্য হয়ে পড়ে ইয়ানার সাথে ঠিক তাই হয়েছে। হুতুম পেঁচার ডাকে ইয়ানার মস্তিষ্ক নড়ে উঠে। মনে পড়ে যায় অগ্নি গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। ইয়ানা এক মুহূর্তে সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে যায় অগ্নির কাছে। অগ্নির রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ইয়ানা চিৎকার দিয়ে বলে,,,,
” এখানে বসে আছেন কেনো আরিফ ভাই? উনার গুলি লেগেছে। প্লিজ কিছু করুন। খুব কষ্ট হচ্ছে উনার ভাইয়া। গাড়ি ডাকুন ভাইয়া।
আরিফ– ভাইয়ের কিছু হবে না।
ইয়ানা চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে। মাটিতে বসে অগ্নির মাথাটা নিজের উড়ুর উপর নেয়। অগ্নি ইয়ানার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। ইয়ানার দিকে চোখ রেখে রাগান্বিত সুরে বলে,,,,,
“” কেনো এসেছো এখানে? কিভাবে এলে? এখানে কেনো এসেছো বলো। যদি কোনো বিপদ হয় কে রক্ষা করবে তোমাকে? এই মুহূর্তে কোনো গার্ড নেই। তুমি তো ড্রাইভিং জানো। আমার গাড়িটা চালাতে পারবে না জানি। দেখো ভিতরে একটা মার্সিডিজ গাড়ি আছে। এইটা হ্যান্ডেল করতে পারবে খুব ভালো ভাবে। চলে যাও।
ইয়ানা শক্ত করে চেপে ধরে অগ্নির মাথা নিজের বুকের সাথে। চুলগুলো ধরে মুখে অজস্র চুমু খায়। কান্না করতে করতে বলে,,, ,,,,,
” বেইমান মনে হয় আমাকে আপনার? আপনাকে এই অবস্থা রেখে আমি চলে যাব? বাঁচব আমি মনে করেন? মরে যাব না আপনার চিন্তায়। যদি একসাথে কবর হয় তাহলে দুজনের এক সাথে হবে। যাব না আমি। কোথাও যাব না।
অগ্নি ইয়ানার গালে হাত দিয়ে বলে,,,,,
” চলে যাও বউ। স্বামীর কথা শুনো। এখানে যে কোনো সময় বিপদ আসতে পারে। আমি মরে গেলে তোমাকে প্রটেক্ট কে করবে?
ইয়ানা চিৎকার দিয়ে কান্না করে বলে,,,,,,,
” কিছু হবে না আপনার। আমার সাথে এমন বেইমানি করতে পারেন না।আপনি ছাড়া আমি অসহায় অগ্নি চৌধুরি।
অগ্নি হালকা হাসে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এরপর ও টেনে টেনে বলে,,,,,,,,
” পারলাম না আর কিছুদিন আমার পাপী বুকে তোমার মাথা রাখার সুযোগ করে দিতে বউ। তোমাকে নিয়ে সুখের সংসার সাজাতে। তোমাকে ভালোবেসে আগলে রাখতে। তোমার ঘৃনার দৃষ্টির পর্দা সরিয়ে ভালোবাসার দৃষ্টি দেখে যেতে।
ইয়ানা থামিয়ে দিয়ে কান্না করে বলে,,,,,,,,,,
” চুপ করুন আপনি। বুঝতে পারছেন না আমার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। ভিতরে এক অগ্নি কান্ড চলছে আমার দেহে। এতটা স্বার্থ পর কেনো আপনি? আপনি না বলেছিলান আমাকে সবসময় নিজের কাছে আগলে রাখবেন। আপনার কিছু হলে আমাকে কে দেখবে? আমি কার আশায় বাঁচব।
অগ্নিকে হাসতে দেখে ইয়ানা উচ্চস্বরে কেঁদে বলে,,,,
” এই বলুন আমাকে। কাকে নিয়ে বাঁচব আমি? আমার ভালোবাসাকে আমার তুচ্ছ মনে নয়। আমাকে একা রেখে চলে যাবেন বলছেন? সূচনা যদি ভালোবাসা দিয়ে শুরু হয়ে থাকে তাহলে উপসংহারে বিচ্ছেদের তকমা কেনো লাগাচ্ছেন?
ইয়ানার কান্নার শব্দে ভারী হয়ে উঠে চারপাশ। অন্ধকার আচ্ছন্ন ঘন জঙ্গলটা নিস্তব্দ হয়ে গিয়েছে। যে পাখিগুলো ভয়ানক আকারে শব্দ করছিলো তারাও নিশচুপ হয়ে গিয়েছে ইয়ানার চিৎকারের শব্দে। আরিফের মত ব্যক্তিও ভেঙ্গে পড়েছে।
অগ্নি মৃদু হেসে ইয়ানার চোখের পানির দিকে তাকিয়ে বলে ,,,, ,,,,,,
” এই চোখের পানি আমার এত সুখ কেনো হচ্ছে। আমার মৃত্যুতে বউ কাঁদছে। এই আকাশ, চন্দ্র, সূর্য ও সাক্ষী হচ্ছে তোমার কান্নার অনুভবের সেহজাদী। এই খারাপ জানোয়ারটা তোমার জীবন থেকে বিদায় নিচ্ছে। সে আর কখনো তোমাকে স্পর্শ করবে না। তোমাকে আর কারোর জন্য ভয়ে থাকতে হবে না। কিন্তু খবরদার আমি ব্যতীত কোনো পুরুষ যাতে তর জীবনে না আসে। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে আমি বলে যাচ্ছি আমার বউ আমি ব্যতীত আর কোনো পুরুষের স্পর্শ গায়ে লাগাবে না। যদি আমার অবাধ্য হও তাহলে হাশরের ময়দানে তোমার সাথে দেখা হবে।
অগ্নি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ইয়ানা কান্না হালকা করে বলে।,,,,,,,,
” যাবেন না,, যাবেন না আমাকে রেখে,,, আমি মরে যাব।
ইয়ানা চিৎকার করে বলে উঠে ,,,,,,,,
” না যাবেন না…….
পুরো শরীরে ঘাম ছুটে যায় ইয়ানার। ইয়ানা শুয়া থেকে উঠে বসে। ভয়ে কাঁপতে থাকে শরীর। বুঝতে পারে সপ্ন দেখছিলো। ইয়ানার চিৎকারে অগ্নির ঘুম ভেঙ্গে যায়। ইয়ানা চারদিকে তাকিয়ে দেখে সে রুমে। অধৈর্য হয়ে অগ্নির দিকে তাকায়। অগ্নিকে সুস্থ দেখে হামলে পড়ে তার বুকে। উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে। অগ্নির শরীরে কিছু জড়ানো ছিলো না। ইয়ানা অগ্নির উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে কান্না করতে থাকে আর বিরিবির করছে,,,,,
” যাবেন না আমাকে রেখে। আমি বাঁচব না।
অগ্নি কিছুটা অবাক হয় ইয়ানার ব্যবহারে। মাঝ রাতে ইয়ানার পাগলামো দেখে সে অনেকটায় আশ্চর্য হয়। এইভাবে চিৎকার করে উঠার মানে বুঝল না।
অগ্নি ইয়ানাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে বলে।,,,,
“” কি হয়েছে সোনা? বাজে সপ্ন দেখেছো?
ইয়ানা মাথা নাড়িয়ে বলে।,,,,,,,,
“” প্লিজ যাবেন না আমাকে রেখে। প্লিজ যাবেন না। আমি মরে যাব।
অগ্নি ইয়ানার মাথায় চুমু খেয়ে বলে,,,,,,,
” কোথাও যাব না আমি তোমাকে রেখে। প্লিজ শান্ত হও। বাজে সপ্ন দেখেছো?
ইয়ানা বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলে,,,,,,,
” আপনাকে কেউ গুলি করেছিলো। আপনি আমার কোলে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন।
ইয়ানার সপ্নের কথা শুনে অগ্নি হালকা হাসে। তার চলে যাওয়াতে মেয়েটা এত পাগলামো করছে। যাস্ট একটা সপ্ন দেখেই। তাহলে চোখের পানি এইটা বৃথা নয়। কাঁদুক আটকাব না।
অগ্নি — কিছু হয় নি আমার। মানসিক টেনশনে তুমি এমন সপ্ন দেখেছো। আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি তবে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয় নি। তুমি নিজেই তো আমাকে ব্যান্ডেজ করে দিলে। দেখো আমি একদম সুস্থ। এইসব ভেবেছো তাই এমন বাজে সপ্ন দেখেছো। কিছু হয় নি আমার। শান্ত হও।
অগ্নি বুক থেকে ইয়ানার মাথা তুলে ধরে। চোখমুখ কান্নার কারনে ফুলে গিয়েছে। অগ্নি বেড সাইড থেকে পানি এনে ইয়ানাকে খাওয়ায়। ইয়ানা এখন ভয়ে কাঁপছে। এমন সপ্নের মানে কি? এমন বাজে সপ্নে কেনো আসলো আমার চোখে?
অগ্নি ইয়ানাকে শান্ত হতে দেখে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। অগ্নি খাটে হেলান দেয় আর ইয়ানা তার বুকে। একটা পাতলা চাঁদর তাদের উপর দেয় কোমর পর্যন্ত।
অগ্নি — ভালো জিনিসগুলো মনে করো। খারাপ লাগা দুর হয়ে যাবে।
ইয়ানা বুক থেকে মাথা তুলে অগ্নির চোখে চোখ রেখে বলে,,,,,,,
” আমাকে ভালোবাসেন তো আপনি?
অগ্নি — আমার আসক্তি, অনুভব কি ভালোবাসার কাতারে দাঁড়ায় না?
ইয়ানা — পড়ে তো। কতটুকু ভালোবাসেন আমাকে?
অগ্নি — পরিমান নেই।
ইয়ানা — একটু বলুন না। আমার হৃদয়ের বয়ে চলে ঝড়কে শান্ত করুন যাস্ট কয়েকটা বাক্য উচ্চারন করে। নাহলে বুকের ভিতরের তান্ডব থামাতে আমি অক্ষম।
ইয়ানার কথায় অগ্নি ঠোঁট কামড়ে হাসে। এরপর গম্ভীর ভাব বজায় রেখে বলে,,,,,
” প্রিন্স ডায়নাকে যখন প্রশ্ন করেছিলো আপনাকে কে বেশি ভালোবাসে? তখন প্রিন্স ডায়নার উত্তর ছিলো,,,, আমি যাকে ভালোবাসি, আমার স্বামী ছাড়া পুরো পৃথিবী আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমার আবেগ, অনুভব তার উল্টো।
আমার ভালোবাসা অন্যরকম । কারন আমি যাকে ভালোবাসি তাকে আমি ছাড়া সবাই যাতে এড়িয়ে চলে। যদি বিধাতা আমাকে শক্তি দিত তাহলে তোমাকে এই হাহাকার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম। যাতে আমি ছাড়া কেউ তোমাকে দেখতে না পারে। শুধুই আমি তোমাকে অনুভব, স্পর্শ করতে পারি। তোমার দিকে কেউ তাকালে ও আমার বুক হিংসে জ্বলে যায়। তুমি নিজেও জানো না তুমি আমার জন্য কি।
ইয়ানা — এ কেমন আবেগ,, এ কেমন অনুভুতি আপনার?
অগ্নি ইয়ানার মুখটা নিজের মুখের কাছে এনে বলে,,,,,,
” এইটা অগ্নি চৌধুরির অনুভুতি শুধুমাত্র তার প্রিয়তমার জন্য। আমার জীবনের ৯০% জুড়ে আমার বউ আর বাকি দশ % আমার আপনজন।
ইয়ানা থমকে যায়। কম্পিত দৃষ্টিতে অগ্নির দিকে তাকায়। হঠাৎ করে ইয়ানা আবার ও ফুঁপিয়ে উঠে। ফুঁপিয়ে উঠার কারনে ঠোঁট উল্টে কান্না আসে। কেনো ভালোবাসা পেয়ে ও এমন পরিস্থিতির স্বীকার সে । উনি কি ভালো হতে পারত না।
ইয়ানার ঠোঁট উল্টা নো দেখে অগ্নি কিছুক্ষন ইয়ানার দিকে তাকায়। মনে হচ্ছে তার সামনে একটা বাচ্চা বসে আছে।
অগ্নি ইয়ানার গাল দুই পাশে স্পর্শ করে বলে,,,,,,
” কি হলো বউ কাঁদছিস কেনো? এইভাবে মায়া বাড়ালে কিন্তু আমি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলব।
অগ্নির কথায় ইয়ানা কান্না অফ করে দেয়। বালা যায় না আবার যদি হামলা করে। তখন কে বাঁচাবে? সাউন্ড প্রুফ রুম হাজার চিৎকার করলে ও কেউ শুনবে না।
ইয়ানা পুনরায় অগ্নির বুকে মাথা রেখে বিষন্ন কন্ঠে বলে,,,,,,,
” যখন আমার জীবনে প্রফেস্যার অগ্নি চৌধুরির হিসেবে আগমন করেছিলেন তাহলে মাফিয়া অগ্নি চৌধুরি হিসেবে কেনো ধরা দিলেন? সূচনা যদি এতটা মধুর হয় উপসংহার যাতে আমার – আপনার হাহাকার না হয়। সূচনার মত ওই যাতে সমাপ্তি ঘটে। না হলে সহ্য করার ক্ষমতা নেই।
অগ্নি গম্ভীর হয়ে পড়ে। ইয়ানাকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে বলে,,,,,,,
অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৩৭
” ঘুমিয়ে পড়ো।
ইয়ানা — ঘুমাব না আর।একটু পর আজান দিয়ে দিবে। যেহেতু আজান দিয়ে দিবে তাই এখন ঘুমাতে চাই না। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি আপনার বুকে শুয়ে থাকি।
অগ্নি ইয়ানাকে বাহুতে আবদ্ধ করে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইয়ানা শুধু সপ্নের কথা ভাবতেই যেনো আত্না কেঁপে উঠছে বার বার। এমন যাতে কিছু না হয়।