মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪২
নওরিন কবির তিশা
বহুদিন পর আজ কলেজ ক্যাম্পাসে পা রেখেছে ফারিন। বিয়ের পর এই প্রথম কলেজে আসলো সে, হয়তোবা কেটেছে একটি সপ্তাহ। সামনের মাসেই তাদের ইয়ার চেঞ্জ এক্সাম যদিও নিয়ম অনুযায়ী এক্সাম হওয়ার কথা ছিল এই মাসেই,কিন্তু নোটিশ বোর্ডও আজকাল তার মতো ধীরে চলতে শিখেছে।এক মাস পিছিয়েছে পরীক্ষার দিনক্ষণ।আর তাই, নববধূ নামক অভিজ্ঞান পেছনে রেখে ফারিন আজ এসেছে কলেজে।
সে এসেছে নির্ঝরের সাথে,তবে তাদের গন্তব্য এক হলেও পথ আলাদা। গেটের বাইরেই গাড়ি পার্ক করে তারা দুজনেই চলে গেছে নিজেদের নিজস্ব পথে। নির্ঝর চলে গেছে টিচার্স রুমে, আর ফারিন যাচ্ছে তার ক্লাসরুমের দিকে। ফারিনের হাতে একখানা নোটপ্যাড আর একটা কলম, সাইড ব্যাগটা ভুল করে বাসায় ফেলে এসেছে সে।
সে হেটে যাচ্ছিল ভবনের পুরাতন করিডোরটির মাঝ দিয়ে, দুইপাশের দেয়ালগুলো লালচে রঙা যেন পঞ্চম শ্রেণীর কোনো শিক্ষার্থীর আঁকার খাতায় জলরঙ দিয়ে কেউ বৃষ্টির পরে মাটি আঁকতে গিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে একটু রং। হঠাৎই তার পাশ দিয়ে প্রচন্ড বেগে হেঁটে যায় কেউ, তার তীব্র বাতাসের টানেই ফারিনের হাত থেকে ছিটকে পড়ে মেঝেতে, ফারিন তার দৃষ্টি এক ঝলক সম্মুখ পানে রাখে তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একটা অপরিচিত মুখ, চোখে সানগ্লাস,পরনে লেমন কালার কুর্তি, সাথে ম্যাচিং করে লেমন কালার লেগিন্স, হিজাবি ওড়নাটা মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে সামনে রাখা, সানগ্লাসের কারণে মেয়েটির মুখটা ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফারিন নিচু হয়ে নোটপ্যাডটা তুলে কিছু কড়া কথা শোনাতে যাবে তার আগেই মেয়েটি একটু ভঙ্গিমা দেখিয়ে বলে,,
—”সরি সরি আই এম রিয়েলি সরি,একচুয়ালি আমি না তোমাকে নোটিশ করিনি!”
ফারিনের একদমই সহ্য হয় না মেয়েটির এমন ন্যাকামি বিশিষ্ট কথার ধরন। সে বেশ রেগে গিয়ে বলে,,
—”কেন চোখ কি কপালে তুলে হাঁটো যে সামনে থাকা একটা জল জ্যান্ত মানুষকে দেখতে পাওনি?”
মেয়েটি বাম ভ্রু উঁচিয়ে বলল,,
—”সরি? বাট আমি ঠিক বুঝলাম না?”
ফারিন:”কেন মামনি? তুমি বাংলা বোঝো না! এ বাবা! বাঙালি হয়ে বাংলা বোঝো না? তা কোন ইংলিশ মিডিয়াম থেকে পড়ে আসছ তুমি? যে এত ইংলিশে ফটর ফটর করছ?”
মেয়েটি আর কিছু বলার আগেই, পিছন থেকে ফারিনকে কেউ জোরে ডাক দেয়।
—”এই ফারুউউউ…”
ফারিন পিছন ঘুরতেই দেখতে পায় তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে ইমন,রায়ান,নেহা আর আরা। সপ্তাখানেক পর নিজের পরিচিত মুখ গুলো দেখে আনন্দের আর সীমা থাকেনা ফারিনের, সে এগিয়ে গিয়ে আলিঙ্গন করেন নেহা আর আরার সাথে ইমন স্বভাবসুলভ ফারিনের মাথায় একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে,,
—”কি ব্যাপার কেমন আছেন মিসেস নির্ঝর চৌধুরী?”
ফারিন:”বা”ল আছি! আগে বল তুই আমার মাথায় মারলি কেন?”
ইমন:”ছিঃ ছিঃ নির্ঝর স্যারের মতো একটা ডিসিপ্লিনড স্যারের বউয়ের মুখের ভাষা কিনা এরকম!ছিঃ ফারু!”
ফারিন:”আজাইরা বকিস না তো!”
রায়ান:”হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো এগুলো আজাইরা লাগবেই স্যারের বউ হয়ে গেছ না!”
ফারিন:”রায়ান!”
নেহা তাদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলল,,
—”এই চুপ করবি তোরা! আর ফারু তুই ওই মেয়েটার সাথে কি নিয়ে বকাবকি করতে ছিলি রে?”
নেহার কথায় ফারিন একবার পিছনে ফিরে তাকায়, এতকিছুর মাঝে সে তো ভুলেই গিয়েছিল মেয়েটির কথা, কিন্তু না মেয়েটি আর সেখানে নেই, ফারিন নেহার দিকে ফিরে বলে,,
—”কে রে ভাই ওইটা? বেডি ন্যাকাষষ্ঠী, নিজেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল আবার পরে বলতিছে আমাকে নাকি দেখতে পারেনি কানার কানা!”
আরা:”ভাই কানা না ন্যাকামিতে বেস্ট! যে পরিমাণ ন্যাকামি করতে পারে আল্লাহ!”
ফারিন:”মানে তোরা চিনিস নাকি ওকে?”
আরা:”চিনবো না আবার! প্রথম দিনই যে ন্যাকামিটা করলো! স্টাইল দেখেছিস কলেজে এমন ভাবে আসে মনে হয় ও কলেজের স্টুডেন্ট না প্রফেসর!”
ফারিন:”কোন ইয়ার রে?”
আরা:”কোন ইয়ার আবার এসব ঢঙ্গী তো আমাদের ব্যাচেই জোটে!”
ফারিন:”কি বলিস আমাদের সাথে!নাম কিরে ওর?”
আরা:”মেহেনাজ,মেহেনাজ মালেক!”
ফারিন:”ও আই সি!”
তাদের কথার মাঝে হঠাৎই নেহা বলে,,,
—”তোরা কি এখানে দাঁড়িয়ে শুধু গল্পই করবি নাকি ক্লাসেও যাবি দেখছিস কয়টা বাজে!”
ফারিন নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ক্লাস শুরু হতে আর মাত্র ৫ মিনিট বাকি দেশে আর কথা না বাড়িয়ে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যায় ক্লাসরুমের দিকে!
সবে প্রথম ক্লাসটা শেষ হলো, ইংরেজি ক্লাসের হাপ ছেড়ে বাঁচতে না বাঁচতেই এখন শুরু হবে হায়ার ম্যাথের সূত্রের মেলা, এ যেন কাটা ঘায়ের উপর নুনের ছিটা, ফারিন এই নিয়ে কিছুটা বিরক্ত হলেও তার বন্ধু দলের সবার ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি। বিশেষ করে লিসার, আল্লাহই জানে এই মেয়েটাকে কি দিয়ে তৈরি করেছেন তিনি।
ফারিন এত বকে তারপরেও লিসা সেই দুষ্টুমি গুলো করতেই থাকে, কলেজে আসতে একটু দেরি হয়েছে তার তাই প্রথম ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে সে ফারিনের পিছনের এসে বসেছে। প্রথম সারির প্রথম বেঞ্চে বসেছে নেহা আর ফারিন, দ্বিতীয় বেঞ্চে আরা আর লিসা।
দ্বিতীয় সারির প্রথম বেঞ্চে মেহেনাজ আর তার কতিপয় সঙ্গী সাথীরা, হয়তো এই কিছুদিনে ওই মেয়েগুলোকেও নিজের সঙ্গী করতে পেরেছে সে। ফারিন একবার আড়চোখে তার দিকে তাকালো।
মিনিট কয়েক পরেই রুমে প্রবেশ করল নির্ঝর, পরনে অফ-হোয়াইট কালার শার্ট আর নেভি ব্লু জিন্স, চোখে সব সময়ের মতন চিকন ফ্রেমের চশমাটা।
তাকে দেখে ফারিনের আদলের অভিব্যক্তি যেন নিমিষেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে, আর তার বন্ধুগুলোর মুখে শয়তানি হাসির রেখাটা প্রসারিত হয়, কিছুটা লজ্জায় মাথাটা সামান্য নুইয়ে লতানো চারা গাছের ন্যায় হয়ে পড়ে ফারিন। পিছন থেকে লিসা তাকে সামান্য খোটা দিয়ে ফিসফিস করে বলে,,
—”দোস্ত! স্যার তো চলে আসলো কিন্তু কনফিউশনে আছি স্যার বলব নাকি জিজু বলবো?”
আরা:”হ্যাঁ রে ফারু দ্রুত বল কি বলবো? আচ্ছা থাক ক্লাসে না হয় স্যার বলব। আদার্স টাইমে জিজু ওকে?”
ফারিন:”চুপ করবি তোরা!”
লিসা আর আরা দুষ্টু হেসে সিটে বসলো, অন্যদিকে মেহেনাজ একদৃষ্টে চেয়ে আছে নির্ঝরের দিকে, ফারিন একবার সেদিকে তাকাতেই কপালের চামড়ায় কয়েকটি স্তর পড়ল তার।
ক্লাস চলমান বোর্ডে একগাদা সূত্রের মেলা বসিয়েছে নির্ঝর। এমনিতেই ফারিনের মাথায় কিছু ঢুকছে না তার ওপর লিসা পিছন থেকে ক্রমাগত খোটাতেই আছে, শেষমেষ বিরক্ত হয়ে পিছনে ঘুরে সে বলল,,
—”উফ লিসু!”
কথাটা কর্নকুহরে পৌঁছাতেই নির্ঝর গম্ভীর মুখে পিছনে ফিরে বলল,,
—”Whose voice was that?”
সবাই ফারিনের দিকে চাইল। কেননা পুরো ক্লাস জুড়ে ফারিন একাই কথা বলেছে আর তার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়েছে রুম জুড়ে। ফারিনও অপরাধী দৃষ্টিতে নির্ঝরের দিকে চাইল। লিসা আরা ইমন নেহারা ভাবলো হয়তো নির্ঝর কিছু বলবে না। কিন্তু তাদের সবার চিন্তাভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে নির্ঝর ফারিনকে কিছুটা ধমকের সুরে বলল,,
—”হেই ইউ স্ট্যান্ড আপ!”
ফারিন অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,,
—”জ্বী!”
নির্ঝর:”আই সে স্টান্ড আপ!”
ফারিন আর কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়ালো। সারা ক্লাস তাকে দাঁড় করিয়ে রাখল নির্ঝর। এদিকে তার বন্ধুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তারা অনিমেষ চেয়ে থাকলো ফারিন আর নির্ঝরের দিকে, এটা যে নতুন ঘটনা তা নয় এর আগেও বহুবার ফারিনকে কথার জন্য ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রেখেছে নির্ঝর, কিন্তু আজকের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা এখন তারা বিবাহিত তারপরও নির্ঝরের এরূপ ব্যবহারে কিছুটা স্তম্ভিত সাথে আশ্চর্য্যন্বিত হলো তারা।
রুদ্রকে রণে আবৃত করা এক উত্তপ্ত দুপুর।আজ সূর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে তার সমস্ত তেজটুকু।মনে হয়, দিনের হৃদয়ে যা তাপ সঞ্চিত ছিল তার সবটুকু অস্ত্রপাত ছুঁড়ে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে।দিগন্তজোড়া গরম বাতাস হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসছে,দেয়ালে দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে,ছায়া পর্যন্ত টিকতে পারছে না স্থির হয়ে।চিকচিকে পিচঢালা রাস্তাগুলো আজ যেন হেঁটে বেড়ানো আগুন।
নিস্তব্ধ রুমে যেন আলোর ক্ষীন রশিটুকুরও চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে, বিছানায় আনায়ার উরুর উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে শিশির, সুদীর্ঘ অক্ষিপল্লব আর মধুরঙ্গামনি বিশিষ্ট নয়নজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে, যেন সদ্য ফোঁটা কোনো কৃষ্ণচূড়া। নয়নের ডালিদ্বয় ফুঁলে আধা-ফোটা কচি পদ্মের ন্যায় জলের ভারে জবুথবু।আনায়া তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,
—”বেবি আর কত কাদঁবি বল? আর এরকম করলে কি ভাইয়া ফিরে আসবে? তুই এমন মত করছিস কেন বল? তুই তো জানিসই যে ভাইয়ার কাঁধে কত বড় দায়িত্ব! আমেরিকার মতো একটা দেশের সিআইডি ইউনিট উনার অনুপস্থিতিতে থমকে যায় তুইতো জানিসই!”
শিশির নাক টেনে বলল,,
—”আমি সে কারণে মন খারাপ করছি না আয়ু!”
আনায়া:”তাহলে কি কারন?”
শিশির:”উনি যদি আমাকে ভুলে যায়? যদি সম্পর্কের স্বীকৃতি না দেয়! একটা সম্পর্কে তো কেউ জানে না বল আয়ু! হাজার হাজার স্বীকৃতি না দেয় তাহলে আমার কি হবে? আমি ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি ওনায়! বিশ্বাস কর ভীষণ,ভীষণ!
আবারও কেঁদে দিল শিশির। আনায়া তাকে সামলাতে সামলাতে বলল,,
—”ধুর পাগলী! এসব ধরনের চিন্তাভাবনা হে? তুই এত দিনে চিনলি না নাহিয়ান ভাইয়াকে?উনি তোকে তোমাকে ভালোবাসে না বদ্ধ উন্মাদের মত ভালবাসে, মেয়ের জীবনে যতটুকু ভালোবাসা প্রয়োজন তার থেকে দ্বিগুন না হাজার গুণ ভালোবাসা তোকে। তুই অনেক ভাগ্যবতী শিশির! তুমি নিজেই তোমাকে বলেছিলে তনয়া আপুর কথা। তাহলে হঠাৎ কি হল এখনো বিশ্বাস করতে পারিস নি ভাইয়াকে?”
শিশির:”আমি তাকে বিশ্বাস করি নিজের থেকেও!”
আনায়া:”তবে আর কি? আর রইল বাকি পরিবারকে বিয়ের ব্যাপারে জানানোর কথা? সেটা তো ভাইয়া অনেক আগেই জানাতে চেয়েছিল তুই ই তো বাধা দিলি!”
শিশির:”আমি তো বাধা দিয়েছিলাম যাতে আন্টির সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ না হয়ে যায় আমি আন্টিকে অনেক ভালোবাসি,আর যদি এসব কারণে আন্টি কোনো ভাবে আমাকে ভুল বুঝে, আমি নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না!”
আনায়া:”এইযে তোর বেশি বেশি ভাবনা চিন্তা এই কারণেই তো ভাইয়া জানাতে পারলো না! যাই হোক ভাইয়া এবার দেশে ফিরলেই বলবো এই পাগলিটাকে সবার আগে ধুমধাম করে বিয়ে করে নিতে! নে এবার হ্যাপি?”
শিশির ক্রন্দনরত মুখে মলিনে হেঁসে আনায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,,
—”হবে!”
মুহূর্ত ক্ষণিকের জন্য রুম জুড়ে বিরাজমান হল পিনপতন নীরবতা, হঠাৎই নীরবতা ভেঙে শিশির উঠে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আনায়ার দিকে চেয়ে বলল,,
—”আয়ু?”
আনায়া:”হু!”
শিশির:”বেবি তোর কি রিদিত ভাইয়ের কথা মনে পড়ে না?”
এতক্ষণ স্বাভাবিক থাকলেও রিদিতের নাম কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আনায়ার আননে পরিলক্ষিত হল বিষন্নতার কালো ছায়া,ঠিক যেন অমাবস্যার নীরব রাত্রি। আনায়ার বিষন্ন মুখশ্রীরপানের চেয়ে ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল শিশির তারপর নিজেই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,,
—”দোস্ত জানিস নির্ঝর ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে না আরে ওই যে তোকে বলেছিলাম না ফারিনের কথা! মেয়েটা ভীষণ মিষ্টি জানিস প্রচন্ড মিশুকে, ও নাকি কোনদিন ঢাকায় আসেনি ভাবতেছি এবার ওদের ইয়ার চেঞ্জ এক্সাম টা শেষ হলেই একবার ওকে নিয়ে ঢাকায় আসতে বলব নির্ঝর ভাইয়াকে, আর তোর সাথেও একটু পরিচয় করিয়ে দিব, কি বলিস!”
আনায়া:”আচ্ছা!”
শিশির আর কথা বাড়ালো না, তবে সে ঠিকই অনুভব করতে পেরেছে আনায়ার মনের মাঝে চলা এক নীরব প্রনয়ের আকুলতাকে, তার অব্যক্ত অনুরক্তিকে। শিশির ও মনে মনে সবটা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে এখন শুধু অপেক্ষা সময়ের যখন সে তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে তার জীবনের বেস্ট গিফটটা দিবে! এক অদ্ভুত রহস্যমন্ডিত হাসি দৃশ্যমান শিশিরের ঠোঁটের কোণে!
ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ হয়েছে জনজীবন, ঘড়ির কাঁটায় প্রায় দুইটা কিংবা তার বেশি, সূর্য যেন পুরোদমে তার তেজস্ক্রিয় রশ্মি ছড়াচ্ছে ধরণী জুড়ে, একদল অন্তরঙ্গ বন্ধুরা বসে আছে সিটি কলেজ ক্যাম্পাসে, অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবাই একটাই মানুষের দিকে-মানুষটি আর কেউ নয় ফারিন! কারো চোখে বিস্ময় কারো চোখে প্রশ্ন কারো চোখে বা অবাক হওয়ার ফলে প্রশ্ন করতেই ভুলে যাওয়ার ছাপ।
নীরবতা বিরাজমান তাদের মাঝে, হঠাৎই নীরবতা ভেঙে রায়ান কিছুটা সন্ধিহান কণ্ঠে বললো,,
—”দোস্ত তোদের বিয়েটা আদেও হয়েছিল তো?”
এতক্ষণ চুপ থাকলেও ইমন এবার বলল,,
—”আই অলসো হ্যাভ সেম কোশ্চন সত্যি তোদের বিয়ে হয়েছিল তো?”
ফারিন তাদের দিকে চেয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই লিসা বললো,,
—”আরে এসব কোনো প্রশ্ন হলো? বরং যে আমার কথা শোন ফারুক আই হ্যাভ এ গভীর কোশ্চেন!”
আরা:”কি প্রশ্ন?কি প্রশ্ন রে?”
লিসা ফারিন এর দিকে ফিরে বলল,,
—”দোস্ত তোদের বিয়ে হইছে এটা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই বিশ্বাস কর কোনো সন্দেহ নেই! কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে ওই জায়গায় যে, ভাই কিছু মনে না করিস বাসর রাতে কি কি করেছিলি যে?”
হঠাৎই ফারিনের হাতে থাকা ফোনটা নিচে পড়ে গেল, সকলে একসঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে দৃষ্টিপাত করল তার পানে, তবে তাদের এমন কথাই হয়তো সামান্য লজ্জা পেল ইমন, সে লিসা কে ধমকিয়ে বলল,,,
—”বেলাজ বেশরম মাইয়া! লজ্জা শরমের বালাই নাই তোর মধ্যে এ জায়গায় আমরা দুজন ছেলে বসে আছি ভাই! আসার সময় পানির সাথে গুলিয়ে খেয়ে এসেছিস নাকি?”
লিসা:”আইছে আমার লজ্জাবতারে! এত লজ্জা যখন তখন এখানে বসেছিস কেন তোরা?”
রায়ান:”আমরা কি আর জানি তোরা এরকম নির্লজ্জ মার্কা কথাবার্তা বলবি!”
আরা এবার রেগে গিয়ে বলল,,
—”জানতিস না এবার জেনেছিস তো তাহলে যা এখান থেকে!”
ফারিন:”থামবি তোরা! কি শুরু করলি টা কি?”
ইমন:”দেখছিস না কি ধরনের নির্লজ্জ কথাবার্তা বলছে তোর বান্ধবীরা!”
লিসা তার কথায় তীব্র প্রতিবাদী কন্ঠে বলল,,
—”একদম নির্লজ্জতার কোনো কথা বলছি না আমরা! আর তাদের যখন এতই লজ্জা তখন বায়োলজি নিয়েছিস কেন? এগ্রিকালচার নিলেই পারতিস!”
ইমন:”তুই তো চুপই থাক বেডি বিটিএস!”
লিসা এবার রেগে গিয়ে বলল,,
—”হ্যাঁ আমি বিটিএস তাতে তোর সমস্যা কি?”
ইমন:”আমার কোন সমস্যাই না!”
লিসা:”তাইলে চুপ থাক!”
ফারিন:”উফফস তোরা থামবি এবার!”
লিসা:”তুই যদি আমার প্রশ্নের উত্তরটা সেই সময়ই দিয়ে দিতিস তাহলে তার এত ক্যাচাল হতো না!”
ফারিন:”আচ্ছা বাবা মানলাম যে সব দোষ আমার এবার তো চুপ কর!”
লিসা:”আচ্ছা চুপ করলাম এবার বল!”
ফারিন:”কি বলবো?”
লিসা:”তোদের বাসর রাতের কথা!”
ফারিন:”শুনবি?”
লিসা আর আরা একযোগে বলল,,
—”হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই!”
ফারিন:”আগে থেকেই বলি এই বর্ণনা শোনার পর তোদের যদি মনে হয় কোনো ইতিহাসবিদ কে ডাকা প্রয়োজন তবে কিন্তু আমার দোষ নয়!”
এবার সবাই অবাক হয়ে বলল,,
—”মানে!”
বিস্ময়ে ছেয়ে গেল এক একটা চোখ। সেদিকে তাকিয়ে ফারিন বলল,,
—”কারণ ইটস মি ফারিন আর আমার বাসরও এত বেশি ইউনিক আর এথেন্টিক যে, যে শুনবে তারই ইচ্ছা করবে এত সুন্দর একটা বাসরকে ইতিহাসের পাতায় বদ্ধ করতে!”
লিসা উৎসুক হয়ে বলল,,
—”কেন যে দোস্ত স্যার কি ডার্ক রোমান্স লাভার নাকি?দেখেছো অবস্থা,আমাদের সামনে এমন একটা গাম্ভীর্য বজায় রেখে চলে যে মনে হয় উনি নিজের বুকেও বাসর রাতে হায়ার ম্যাথের সূত্র ব্যাতিত আর কিছুই বলতে পারবে না!আর দেখ তলে তলে!”
তার কথায় ফারিন মনে মনে বলল,,
—”এরই নাম বাঙালি! সন্দেহ কখনোই ভূল হবে না!”
তারপর তাদের দিকে ফিরে সে বলল,,
—”শুনি তো!”
আরা:”বলবি তো!”
ফারিন:”মোর জামাই মোরে হায়ার ম্যাথের সূত্রের মেলায় ঘুরাতে নিয়ে গিয়েছিল, মেলা থেকে এ স্কয়ার প্লাস বি স্কয়ারের একটা কম্বো কিনে দিছিল, দ্যান আমরা সারা মেলায় ঘুরলাম, তারপর বললাম কি চলো আর পছন্দ হচ্ছে না তাই বাসায় চলে আসলাম!”
রায়ান:”কি সব বলছিস এসব উল্টোপাল্টা!”
ফারিন:”উল্টাপাল্টা মানে কি ইহা একটা চিরন্তন সত্য কথা যে মোর বর মোরে বাসর রাতে হায়ার ম্যাথের ক্লাস করাইছে!”
লাস্টের কথা সময় ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো করে বলল ফারিন, আর এদিকে তার কথা শুনে তার বন্ধুদের চোখ যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসছিল, ইমন তখন সবে পকোড়াটাই কামড় দিতে যাবে ফারিন এর কাছ থেকে তার বাসরের বর্ণনা শোনার সাথে সাথে হাত থেকে পকোড়া টা পড়ে গেল তার, অন্যদিকে রায়ান বেচারা সবে মুখে এক ঢোক কোক নিয়েছে ফারিনের কথায় সঙ্গে সঙ্গে ভীষম লেগে কোক নাকে উঠে নাজেহাল অবস্থাতে।
ইমন রায়ানের পিঠে আলতো থাপ্পড় দিতে দিতে বলে,,
—”শান্ত হ ভাই শান্ত হ! ফারু তুই কি আসলে সত্যি কথা বললি?”
লিসা আর আরা স্তম্ভিত, নিঃশব্দ-নির্বাক যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে তারা। এদিকে নেহা চুপচাপ যেন সে আগে থেকেই জানতো এরকমই কিছু একটা হবে! ফারিন তাদের কিছু বলার আগেই পিছন থেকে দারোয়ান ছুটে এসে ফারিনকে বলল,,
—”ফারিন মামনি তোমাকে নির্ঝর স্যার ডাকছে!”
ফারিন:”চাচ্চু তুমি যেতে লাগো আমি আসছি!”
দারোয়ানটি চলে যায়, ফারিন তার বন্ধু দলের দিকে তাকিয়ে বলে,,
—”বলেছিলাম আগে থেকেই এই শক তোরা সহ্য করতে পারবিনা! যেহেতু এতই শখ তোদের শোনার তাই বললাম এখন ম*র*লি কি বাঁচলি সেটা তোদের ব্যাপার! আর আমি যাই না হলে আমার আবার..”
সে কথা শেষ করার আগেই লিসা বলল,,
—”হায়ার ম্যাথ ক্লাস করা লাগবে!”
ফারিনি নিজের নোটপ্যাডটা লিসার হাত থেকে দ্রুত নিয়ে বলল,,
—”এইতো মেয়ের বুদ্ধি খুলছে!”
কথাটা বলেই সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করল ফারিন। তবে ইমন রায়ান আরা লিসা এখনো তাকিয়ে আছে তার যাওয়ার পানে বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে। লিসা সেদিকে তাকিয়েই অবাক কণ্ঠে বলল,,
—”সিরিয়াসলি রে দোস্ত! ফারু কি আমাদের সাথে জোক করল!”
আরা সেই দিকে তাকিয়ে লিসার কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে বলল,,
—”হয়তোবা!”
নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়া এক নির্জন ধরিত্রী, অন্তরীক্ষে জোৎস্নাপতিটি ছড়াচ্ছে এক এক রুপালী আলোর ছটা, চারিদিক শুনশান শুধুমাত্র নিজের রুমের স্টাডি টেবিলে বসে এক মনে পাকিস্তানি ড্রামা দেখছে ফারিন, এতক্ষণ নিঝুম ও তার পাশে ছিল শুধুমাত্র রাত গভীর হওয়ায় সে তন্দ্রাচ্ছন্নভাব নিয়ে উঠে গেছে মুহূর্ত দশেক আগে।
মোবাইলের স্ক্রিনে চলছে বিখ্যাত পাকিস্তানি ড্রামা তেরে বিন পাকিস্তানি ওয়াহাজ আলী অভিনীত পাকিস্তানের সবচেয়ে বিখ্যাত ড্রামা এটি, ড্রামা করলে ভুল হয় এটা ব্লকবাস্টার। ড্রামাটিতে যখন মু্রতাসিম সবে মিরাবের দিকে এক পা এক পা করে এগোচ্ছে আর মিরাব পিছোচ্ছে, সফট রোমান্সের এক অনবদ্য মুহূর্ত। হঠাৎই দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে কেউ,ফারিন সেদিকে না তাকিয়ে বলে,,
—”এসেছো নিঝুম! দেখো এটা বেস্ট সিন, আর তোমাকে বললাম না স্যার এত তাড়াতাড়ি বাসায় আসে না! তাই তুমি এই এপিসোড টা দেখে যেতেই পারো কোনো ভয় নেই ট্রাস্ট মি!”
কথাটা বলে সে নিঝুমের দিকে চেয়ারে গিয়ে দিতে গিয়ে এক ঝলক তাকায়, তৎক্ষণাৎ তড়িৎ বেগে তার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়, সামনে দাঁড়িয়ে আছে নির্ঝর! সে যাওয়ার আগে ফারিনকে বলে গিয়েছিল যেন ফারিন অন্য সাবজেক্টগুলো কমপ্লিট করে রাখে নির্ঝর এসে তাকে হায়ার ম্যাথ করাবে! কিন্তু অন্য সাবজেক্ট তো অন্য সাবজেক্ট।বইও মেলে নি ফারিন!
একদিকে নির্ঝর রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার পানে, অন্যদিকে মোবাইলের স্ক্রিনে তখন মিরাব মুরতাসিমের কেমিস্ট্রির সেরা এক মুহূর্ত! মুরতাসিম মিরাবের এগিয়ে এসে তার চোখে চোখ রেখে বলছে,,
—”সাফ সাফ কেহদো না ইস তারা সে মেরি আখমে নেহি দেখনা যাতা!”
নির্ঝর একবার আড়চোখে সেটিকে তাকালো। ব্যাস ফারিনের মান-সম্মানের ফালুদা!ফারিন দ্রুত মোবাইলটা তুলে অফ করে নির্ঝরের দিকে তাকালো, নির্ঝরের আননে তখনো গাম্ভীর্য বিদ্যমান। ফারিন আমতা আমতা করে বলল,,
—”স-স-স্যার!
নির্ঝর আর কোন কথা না বলে দ্রুত আলমারি থেকে ট্রায়েলটা নিয়ে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। ফারিন সেদিকে চেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে! কিছুক্ষণ পর গোসল ছেড়ে বের হয়ে আসে নির্ঝর, তার বাবরি চুলগুলো বেয়ে এখনো টুপটাপ গড়িয়ে পড়ছে জল বিন্দুরা। তামাটে আনন যেন পানি লেগে রুমের আলোতে চিক চিক করছে! অদ্ভুত রকম সুন্দর লাগছে শ্যাম পুরুষটিকে! ফারিন একবার সেদিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল!
নির্ঝরের পরনে সব সময়ের মতো একটা ব্ল্যাক ব্রাউজার আর সাদা শার্ট, হাতাটা কফফোল্ড করা, শাওয়ার নিয়ে বের হয়েই নির্ঝর এসে ফারিন এর স্টাডিটেবিলের পাশে দাঁড়ালো, নির্ঝরের শরীর থেকে ভেসে আসছে তীব্র মা”দ”কী”য় পুরুষালী ঘ্রাণ, যা ফারিনকে মা”তা”ল করে তুলছে!
কিছুক্ষণ আগের তেরে বিনের সেই রোমান্টিক মুহূর্ত আর এখন নিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন শ্যামপুরুষ, এযেন এক অদ্ভুত অনুভূতি! এর সংজ্ঞা কি দিবে ফারিন! সে যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত তখনই ভেসে আসে একটা শক্ত গম্ভীর কণ্ঠ,,
—”পড়া কমপ্লিট হইছে?”
ব্যাস তার কল্পনার উপর এক বালতি পানি ঢেলে দিল যেন কেউ, মেজাজটা প্রচন্ডরকম বিগড়ে গেল তার, দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল,,
—”হায় আল্লাহ সারা জীবন রোমান্টিক রোমান্টিক ড্রামা মুভি দেখলাম আর শেষ পর্যন্ত কিনা এরকম একটা খাইস্টা বেডা আমার কপালে দিলা! কেন আল্লাহ কেন?”
তার কথায় নির্ঝর ভ্রু সামান্য কুচকে বলল,
—”কি বিড়বিড় করছো?”
ফারিন:”স্যার আপনি কি জীবনে কখনো কোন ড্রামা বা সিনেমা দেখেছেন?”
নির্ঝর:”মানে?”
ফারিন:”না কিছু না ওই এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম আর কি?”
নির্ঝর:”ফাইজলামি বাদ দিয়ে পড়তে বসো আর এক মাস পরে যেয়ে তোমার ইয়ার চেঞ্জ এক্সাম তোমার ভেতরে তো কোনো টেনশনই দেখতে পাচ্ছি না!”
ফারিন:”এত টেনশন করে হবে কি স্যার? এত পড়াশোনা করে খাবে কে? তার থেকে বরং আসেন আপনি আর আমি মিলে তেরে বিনের এপিসোড গুলো শেষ করি! তবে আপনি যদি না চান তাহলে আমি একাই দেখি আপনি বরং ঘুমিয়ে পড়ুন”
মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৪১ (২)
নির্ঝর কোন কথা না বলে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ফারিনের দিকে।ফারিন আমতা আমতা করে বলল,,
—”আচ্ছা স্যার থাক লাগবে না দেখা!”
ফারিন স্টাডি টেবিলে বসতে বসতে দাঁতে দাঁত চেপে গজগজ করতে লাগলো, নির্ঝর এক রহস্যমণ্ডিত দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে!