অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮১

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮১
ইয়াসমিন খন্দকার

আমিনা তখন অসহায়ের মতো কাঁদছিল। তবুও জাঈদ সমানে তাকে দোষারোপ করে যাচ্ছিল। জাঈদ একপর্যায়ে বলে,”তুমি মা নও, তুমি একটা ডাইনি৷ তুমি খেয়ে ফেলেছ আমার ছেলেকে।”
কথাটা শুনে আরুশি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। সপাটে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন ছেলের গালে। জাঈদ অবাক চোখে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,”মাম্মা..তুমি!”

“হ্যাঁ, মারলাম। হয়তো একসময় তোমায় অনেক বেশি আদর দিয়ে ফেলেছিলাম তাই শাসন কিছু বাকি ছিল৷ সেটাই এখন করছি। তোমাদের বংশের পুরুষদের এত মেজাজ কেন বলতে পারো? তোমাদের এই মেজাজের জন্য কতগুলো জীবন বারবার নষ্ট হয়ে যায় জানো সেটা? এই যে তুমি আমিনাকে এতো দোষারোপ করছ, একবার ওর অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করছ না? মেয়েটা তোমাদের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের শরীর পুড়িয়ে ফেলেছে। তারপর নিজের মাকে বাঁচাতে ছুটে গেছে? এটা কি খুব ভুল করেছে? মানে এভাবে অচেনা কাউকে ভরসা করা ঠিক হয়নি কিন্তু ওর অবস্থাটাও একবার বোঝো। কোন মেয়ে কি তার মাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে? বিপদের সময় কারো এত হুঁশ থাকে? আর তুমি নিজেও বা কেমন বাবা? নিজের ছেলে হারিয়ে গেছে তাকে খোঁজার বদলে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের স্ত্রীকে দোষারোপ করছ।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জাঈদ রেগে বলে,”তুমিও আমাকে দোষ দিচ্ছ। এই আমিনার জন্য তোমাকে আর আরহাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। ওর জন্য আজ আমার ছেলেও হারালো তাও তুমি ওকে সাপোর্ট করবে। বেশ করো, তোমাদের কাছে যখন ও বেশি আপন তখন ওকে নিয়েই থাকো। আমি তো নিজের ছেলেকে হারিয়ে ফেলেছি। জানি না, আর কখনো ওকে ফেরত পাবো কিনা। কিন্তু তোমাদের সবার সাথে আজ থেকে আমার সব সম্পর্ক শেষ। আমি আর কখনো তোমাদের সামনে আসবো না।”
বলেই জাঈদ ছুটে চলে যায়। আরহাম খান ও আকাশ তাকে আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে সাড়া দেয় না। আরহাম খান দুঃখী চোখে আরুশি ও আরহার দিকে তাকান। নিজের ভুলে এখন তিনি অনুতপ্ত। তিনি বুঝতে পারছেন আজ, যেভাবে তিনি আরুশি ও আরহার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছেন সেভাবে আজ তার ছেলেও অনেকগুলো জীবন এলোমেলো করে দিল।

আমিনা পাগলের মতো করছিল নিজের সন্তানকে হারিয়ে। নিজের ছেলের একটা ছবি ছিল তার ফোনে। সে সেই ছবিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। যাকেই দেখছে তাকে দাঁড় করিয়ে নিজের ছেলের ছবি দেখাচ্ছে। আর একটাই কথা জিজ্ঞেস করছে,”ওকে দেখেছেন কোথাও আপনারা? ও আমার বাবু..ও হারিয়ে গেছে। ওকে দেখে থাকলে প্লিজ আমার কাছে আমার বাবুকে ফিরিয়ে দিন।”

আরুশি আমিনার এই অবস্থা দেখে তাকে আগলে নিলো। বলল,”এমন পাগলামি কেন করছ আমিনা? আমরা তো পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেছি৷ তোমার বাবুকে তুমি আবার ফেরত পাবে, এত দুশ্চিন্তা করো না।”
আমিনা কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমি আসলেই অনেক খারাপ বড় আম্মু। না আমি ভালো স্ত্রী হতে পেরেছি না ভালো মা। তোমার ছেলে ঠিকই বলেছে, আমার জন্য ওর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার জন্য তুমি আর আরহা বাড়ি ছাড়া হয়েছ আর আজ আমার জন্য আমার ছেলে হারিয়ে গেছে।”

“নিজেকে এভাবে দোষ দিও না আমিনা। তুমি পরিস্থিতির স্বীকার ছিলে। তোমার পরিস্থিতিতে থাকলে যে কেউ এমনই করত। আর আমি বা আরহা কেউ তোমার প্রতি কোন ক্ষোভ রাখিনি। দেখবে, তুমি তোমার ছেলেকে ঠিক ফিরে পাবে। আর এখন আমার সাথে চলো, তোমার এই পোড়া স্থানের চিকিৎসা প্রয়োজন। ইশ, হাত-পা কি বাজেভাবে পুড়ে গেছে। বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে ইনফেকশন হয়ে যাবে।”
“না, আমার বাবুকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না।”
বলেই আমিনা পাগলের মতো ছুটতে থাকে।

জাঈদ তার ছেলের ছবি দিয়ে একটা পোস্টার বানিয়ে সেটা দেয়ালে দেয়ালে টাঙিয়ে দিচ্ছে। সেই পোস্টারে নিজের ফোন নাম্বারও এড করে দিয়েছে সে৷ যেন কেউ তার সন্তানকে খুঁজে পেলে তার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু মানুষকে ভাড়া করে সে এই পোস্টার লাগানোর কাজ করে যাচ্ছে। এভাবে পোস্টার লাগাতে লাগাতে একসময় তার ফোন আচমকা বেজে ওঠে। জাঈদ ফোনটা রিসিভ করে। বিপরীত দিক থেকে কেউ কিছু বলতেই সে যেন জান ফিরে পায়।

দ্রুত শহরের অপর প্রান্তে পৌঁছে যায় জাঈদ। সেখানে হাসপাতালের ঐ নার্স মর্জিনা বেগম তার জন্য অপেক্ষা করছিল৷ জাঈদ আসতেই মর্জিনা বেগম তার ছেলেকে তার কোলে তুলে দিয়ে বলে,”মাফ করবেন, আমার জন্য আপনাদের এত ভোগান্তি পোহাতে হলো। আমি কোন বাচ্চা চোর নই। আসলে তখন হাসপাতাল থেকে বের হবার পর এত পুলিশ, আর্মি দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম তাই আপনাদের বাচ্চাকে নিয়ে নিজের বাসায় চলে আসি। আমি ঠিক করেছিলাম কিছুক্ষণ পরই আপনাদের বাচ্চাকে ফিরিয়ে দেব কিন্তু বাসায় এসে কিছু পারিবারিক ঝামেলায় ব্যস্ত হয়ে যাই। আমি হাসপাতাল কতৃপক্ষকেও অনেকবার ফোন করেছি কিন্তু ব্যস্ততার জন্য মনে হয় তারা ফোন রিসিভ করে নি৷ তারপর আপনাদের বাচ্চাকে নিয়ে আমি হাসপাতালের দিকেই যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে পোস্টারটা দেখা আপনাকে কল দিলাম।”

জাঈদ নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে অসংখ্য চুমু খেয়ে বলে,”আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
এরপর হঠাৎ করে তার চোখের মনি লাল হয়ে আসে। জাঈদ মনে মনে ভাবে,”যদি আজ আমার সন্তান কোন খারাপ মানুষের হাতে পড়ত তাহলে কি হতো? যতোই আমি ওকে ফেরত পাই, আমিনার প্রতি আমার রাগ কমবে না। একজন মা হিসেবে ও এত দায়িত্বজ্ঞানহীন কিভাবে? নাহ, এমন একজন মায়ের তত্ত্বাবধানে আমি নিজের সন্তানকে কিছুতেই বড় হতে দেব না। প্রয়োজনে আমি নিজের ছেলেকে একা বড় করব। আমিনার জন্য আমার ছেলে আরো কোন বিপদে পড়ুক এটা আমি হতে দেব না।”

তাই জাঈদ নিজের পকেট থেকে একটা চেক বের করতে মর্জিনা বেগমের হাতে দিয়ে বলে,”এই নিন, এখানে ৫ লাখ টাকার চেইক আছে। আপনি এই টাকাটা নিয়ে এই শহর থেকে দূরে কোথাও চলে যান। আর আমি যে আমার সন্তানকে ফেরত পেয়েছি সেটা যেন কেউ না জেনে।”
মর্জিনা বেগম বলেন,”কিন্তু..”
“কোন কিন্তু না। আপনার যদি আরো টাকা লাগে আমি দেব। আপনি চট্টগ্রামে চলে যান। সেখানে আপনার একটা চাকরির ব্যবস্থাও করে দেব। আপনি শুধু আমার কথাটা রাখুন।”
মর্জিনা বেগমের দুই মেয়েকে নিয়ে একার সংসার, স্বামী নেই। শ্বাশুড়ি আর ননদের জ্বালায় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাই এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে লুফে নিলেন।

‘বেশ, যেমনটা আপনি বলবেন।’
জাঈদ নিজের ছেলেকে বুকে আগলে বলে,”তুমি চিন্তা করো না বাবু। পাপা তোমায় একটা নতুন জীবন দেবে। ঐ পরিবারের কেউ তোমার বা আমার কারো পরোয়া করে না। তোমার জন্মদাত্রী মাও না। আর না আমার জন্মদাত্রী মা। তাই আমরা আর তাদের কাছে ফিরবো না। আমি এমনিতেও কানাডায় একটা ভালো কোম্পানিতে জবের অফার পেয়েছি। এবার আমি তোমাকে নিয়ে সেখানে চলে যাব। আমাদের দুই বাপ-ছেলের মাঝে আর কেউ থাকবে না।”

১ মাস পর,
১ মাস পেরিয়ে গেছে। এখনো আমিনা তার সন্তানের কোন খোঁজ পায়নি। শোকে মুহ্যমান হয়ে সে সবসময় ছুটে বেড়ায় এদিক ওদিক। জাঈদ সেই যে সেদিন বেরিয়েছে আর ফেরে নি। সায়রা খান সুস্থ হয়ে নিজেকেই দোষারোপ করে বলেন,”সব হয়েছে আমার জন্য। সেদিন যদি আমিনা আমাকে বাঁচাতে ছুটে না আসত তাহলে এসব কিছুই হতো না।”

এরমধ্যে আরুশি এসেছেন আমিনাকে সামলাতে। আরুশিকে দেখেই আমিনা আরো বেশি ভেঙে পড়ে। আরহাম খান জাঈদকে ফোন করেন। এতদিন রিসিভ না করলেও আজ জাঈদ ফোন রিসিভ করে। আরহাম জিজ্ঞেস করেন,”তুমি কবে ফিরবে জাঈদ? আমিনার অবস্থা অনেক খারাপ। একেই নিজের ছেলেকে হারিয়েছে ও। এই সময় তোমার ওর পাশে থাকা উচিত।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮০

জাঈদ বলে,”ছেলেকে ও একা হারায় নি আমিও হারিয়েছি। আমি আর ফিরব না পাপা। আমি এখন বিমানবন্দরে। আজকেই আমি কানাডা চলে যাচ্ছি। আর এই দেশে ফিরবো না। তোমরা সবাই আমিনাকে নিয়ে থাকো।”
বলে সে ফোন রেখে দেয়। নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে রওনা দেয় নতুন গন্তব্যে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮২