তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৩৬

তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৩৬
নওরিন মুনতাহা হিয়া

অরণ্যর প্রতিটা কথা ইনায়ার মনে ভয়ের সৃষ্টি করে, অরণ্যর কথার মধ্যে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। অরণ্য মানুষটা যতটা শান্ত, তার বলা প্রতিটা কথা ঠিক ততটা অশান্ত। ইনায়ার মনে ভয় জাগে অরণ্যকে হারানোর, জীবনে চলার পথে সে অনেক প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তার জীবনে আগন্তুক বা নতুন বসন্তের মতো আগমন হয়েছে অরণ্য নামে মানুষটার, যার আগমণ যদি ও হঠাৎ কিন্তু সে চাই যেনো মানুষটা হাজার বছর স্থায়ী থাকে তার জীবনে। ফোনের অপর পাশে অরণ্য ও শান্ত, যেনো কোনো নীরবতা অন্ধকার হয়ে ছেয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন। ইনায়া কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে

“- অরণ্য আমাকে ছেড়ে যাবেন না কখনো আপনি? কথা দেন যায় হয়ে যাক এই ইনায়ার থেকে দূরে চলে যাবেন না আপনি?
ইনায়ার ভীতু আর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ শুনে অরণ্য বুঝতে পারে ইনায়া ভয়ে পাচ্ছে, হয়তো তাকে হারানোর ভয়। মানুষ মূলত অভ্যাসের দাস, যার সাথে অল্প সময় থাকে তার মায়ায় পড়ে যায়। মনের মধ্যে তার প্রতি ভালোবাসার জন্ম না দিলে ও, তার মায়ায় সে জড়িয়ে যায়। অরণ্য দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে –
“- যদি দূরে চলে যায় আপনার থেকে, হারিয়ে যায় কোনো অজানা গন্তব্যে, তবে কি আমার জন্য আপনি কান্না করবেন ইনায়া। বলুন না ইনায়া কষ্ট হবে আপনার আমার জন্য?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরণ্যর কথা ইনায়ার মনে ভয়ের মাএা দিগুণ বাড়িয়ে দেয়, অরণ্য এমন করে কথা কখনো বলে নাই। আজ অরণ্যর প্রতিটা কথায় ইনায়ার কষ্ট হচ্ছে, অরণ্যকে হারিয়ে ফেললে সে বাঁচবে কি করে? অরণ্য তার সমগ্র অস্বস্তিতে মিশে রয়েছে, যাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকা তার দ্বারা অসম্ভব। ইনায়া বলে –
“- অরণ্য আপনি কোথাও যাবেন না? বিয়ে করেছেন আমাকে বউ হই আমি আপনার , যদি ছেড়ে চলে যাবেন তাহলে কবুল বলে বিয়ে করে ছিলেন কেনো?

ইনায়ার কথা শুনে অরণ্য হাসে, তবে বর্তমান পরিস্থিতির কথা অনুমান করে তার হাসি মিলিয়ে যায়। অরণ্য বলে –
“- হুম বউ আপনি আমার। যদি পুর্নজন্ম বলে পৃথিবীতে কোনো শব্দ থাকে, তাহলে হাজার জন্মে আমি শুধু আমাকে চাইব আমার জীবনে। তবে এই জন্মের জন্য আমাকে বিদায় নিতে হবে আপনার জীবন থেকে?
অরণ্যর কথা সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই ইনায়া বলে উঠে –
“- অরণ্য আপনাকে ছাড়া আমি বাচঁব না। এই ইনায়া মারা যাবে আপনাকে ছাড়া।
অরণ্য মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে –
“- ভালোবাসেন আমাকে ইনায়া?

অরণ্যর ছোট কথার উত্তর ইনায়ার জানা নেই, অরণ্যর প্রতি তার মায়া রয়েছে। অরণ্য তার সমস্ত অস্বস্তি জুড়ে মিশে রয়েছে, এইটাকে কি ভালোবাসা বলে। তবে কি ইনায়া অরণ্যকে ভালোবাসে? কিন্তু ইভানের জন্য তার হৃদয়ের এক কোণে ভালোবাসা রয়েছে, যা মিথ্যা হয়ে যাবে না। ইনায়াকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে অরণ্য বলে –
“- ওকে ইনায়া আমার অফিসের মিটিং রয়েছে বাই “।

অরণ্য কথাটা বলে ফোন রেখে দেয়, ইনায়া যখন অরণ্যর ফোন রাখার কথা শুনে কিছু বলতে যাবে। এর আগেই অরণ্য কল কেটে দেয়। ইনায়া আবার ফোন দেয় অরণ্যকে কিন্তু অরণ্য রিসিভ করে না। অফিসের মিটিং সে জয়েন করে, অন্যদিকে ইনায়ার মনে আর মাথায় অরণ্যর বলা কথাটা ঘুরতে থাকে। দুপুর প্রায় দুইটা বাজে, রান্না ঘরে থেকে এসেছে ইনায়া কিন্তু গোসল করা হয় নাই। ইনায়া বিছানা থেকে উঠে গোসল করে, এরপর ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে সায়মা আর রেহানা বেগম খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে তার জন্য।
রেহানা বেগম আজ প্রথম টেবিলে খাবার খেতে এসেছে, ইনায়া খাবার টেবিলে যায়। সায়মার সাথে অল্প সময় কথা বলে, এরপর সকলে খাওয়া দাওয়া শুরু করে। খাবার খাওয়ার মধ্যে সায়মা বলে –

“- ভাবী অরণ্য ভাইয়া কি দুপুরে খাবার খেয়েছে? ভাইয়া কখন আসবে অফিস থেকে?
“- অরণ্য অনেক দিন পর অফিসে গিয়েছে যার জন্য অনেক কাজ জমা রয়েছে। সব কাজ শেষ করতে প্রায় অনেক রাত হয়ে যাবে, আর দুপুরে একটা মিটিং রয়েছে যা শেষ করে খাবার খাবে “।
“- ওকে “।

সকলে দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ করে, রুমে চলে যায় রেহানা বেগম এখন তার মেয়ের অনেক খেয়াল রাখে। ইনায়ার সাথে সায়মার আগে অল্প কথা হতো, কিন্তু এখন সায়মার সাথে সে সায়মার প্রতিটা বিষয়ে খেয়াল রাখার চেষ্টা করে। রুমে গিয়ে ইনায়া বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, প্রায় রাত সাত টার সময় তার ঘুম ভাঙে। অন্যদিকে ইভান আর প্রভা মিটিং শেষ করে, অফিসের সকল কাজ করে বাড়িতে ফিরে। তারা এক গাড়িতে করে চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছায়, কিন্তু ইভান সবসময় চুপচাপ থাকে৷ প্রভা ইভানের মন খারাপ করে থাকার কারণ যানে, যার জন্য তাকে বিরক্ত করে নাই।
ইনায়ার সাথে ইভানের যে সম্পর্ক রয়েছে তা প্রভা অজানা। চৌধুরী বাড়িতে ফিরে ইভান রুমে চলে যায়, রাতের খাবার খাবে না আজ সে তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে দিয়েছে৷
[ রাত প্রায় : ০ ৭ টা ]

ইনায়া ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে, ওয়াশরুমে থেকে বের হয়ে আসে। ইনায়ার মন যেনো কেমন করছে, অরণ্যকে এতো কল দিয়েছে কিন্তু অরণ্য রিসিভ করে নাই। আর দুপুরে অরণ্যর বলা কথা সব ইনায়ার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ইনায়া ফোন হাতে নেয় অরণ্যকে কল দেওয়ার উদ্দেশ্য। অন্যদিকে অরণ্য গাড়ি ড্রাইভ করছে, আজ ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে আসে নাই। অফিসের সকল মিটিং বাদ দিয়ে দিয়েছে, কেনো জানি আজ ইনায়ার কথা বড্ড মনে পড়ছে। তার মায়ের মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে, ছোট বোনের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে।
অরণ্য যানে তার সাথে এখন কি হতে চলছে, তবুও তার প্রাণ বাঁচানোর বিন্দু মাএ চেষ্টা বা ইচ্ছা নাই। কারণ সে যানে একমাত্র তার মৃত্যুর মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হবে। তবে শেষ বারের মতো ইনায়ার সাথে কথার বলার জন্য অরণ্য ফোন দিব, এর আগেই ইনায়া তাকে ফোন। অরণ্য ফোন রিসিভ করে বলে –

“- ইনায়া “-
অরণ্যর কণ্ঠ শুনে ইনায়া তাড়াহুড়ো করে বলে –
“- অরণ্য আপনি কোথায়? বাড়ি ফিরবেন কখন?
ইনায়ার কথা শুনে অরণ্য জবাব দেয় –
“- ইনায়া আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিলো আমার?
“- কি?
“- আমি আপনাকে ভালোবাসি ইনায়া। অনেক বেশি ভালোবাসি, যদি আমি আজ এক্সিডেন্ট মারা যায় তবে আপনি ইভানকে বিয়ে করে নিবেন। কিন্তু আমি আপনাকে অন্য কারোর সাথে কি করে দেখব ইনায়া, আমি মারা গেলে ও কষ্ট হবে আমার। ইনায়া সারাজীবন কি আমার হয়ে থাকবেন?
অরণ্যর কথার মানে ইনায় বুঝতে পারে না, ইনায়া বলে –

‘- কি বলছেন আপনি অরণ্য? আর এক্সিডেন্ট মানে?
ইনায়ার কথা শুনে অরণ্য হাসে, হয়তো এইটা তার শেষ হাসি। ইনায়া অরণ্যকে ভিডিও কল দেয়, অরণ্য রিসিভ করে। অরণ্য ইনায়ার দিকে অল্প সময় তাকিয়ে থাকে, জীবনে এই মেয়ের প্রতি তার ঘৃণা সরে কখন ভালোবাসা জন্মেছে তা তার জানা নাই। বিয়ের পর যখন কবুল বলেছে তখন থেকে বউ নামক শব্দটার সাথে জড়িয়ে গিয়েছে। সময়ের সাথে ইনায়াকে ভালোবেসে ফেলেছে, তবে কষ্ট হচ্ছে আজ ইনায়ার জন্য। অরণ্যর জন্য তার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে, অরণ্য আবার বলে –

“- ভালোবাসি ইনায়া ভালোবাসি “।
ইনায়া অরণ্যর কথায় কোনেন উত্তর দিতে যাবে, এর আগেই একটা ট্রাক এসে অরণ্যর গাড়িকে ধাক্কা দেয়। অরণ্য মনে হয় যানতো এমন হবে, ট্রাকের ধাক্কার গাড়ি উল্টো যায় প্রায়। অরণ্য বলে –

তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৩৫

“- আমার মা আর বোনের খেয়াল রাখবেন। এই জন্মে আপনার সাথে সংসার করা হলো না। তবে শুধু একটা আপসোস রয়ে গেলো ভালোবাসি কথাটা আপনার মুখ থেকে শুনা হলো না।
অরণ্যর কথা বলার মধ্যেই গাড়ি ভেঙে তছনছ হয়ে যায়, ফোনের ডিসপ্লে ফেটে যায়। যার জন্য ইনায়া অরণ্যকে দেখতে পায় না। তবে অরণ্যর মাথা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, যা দেখে ইনায়া চিৎকার দিয়ে উঠে বলে –
“- অরণ্য “।

তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৩৭