চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৯ (২)

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৯ (২)
ইশরাত জাহান জেরিন

নদীর জীবনটা নদীর মতোই গতিশীল। এই যে কতদিন ধরে সে বাইরে যাচ্ছে। না নামে চিঠি আসছে, সে কাউকে চিঠি দিচ্ছে এই চিঠির বিশেষ মানুষগুলো তার বাড়ির লোক। হ্যাঁ দেখা করেছে সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে এখন রাজন সেই শাস্তি হিসেবে তাকে মারলেও সমস্যা নেই। তবে নদীকে এখন হয়তো আর মারবে না রাজন। সে তার গতি বদলে ফেলেছে। রাজন আর নদীর হয়েও হলো না। এই যে রাতে নেশা করে এসে যখন চলতে পারে না, যখন খাইয়ে দিতে হয়, এই যে মন কে শান্ত করার জন্য যখন গায়ে গাত তুলতে হয়। অসুখের রাতে যখন কাতরায় তখন তো ঘুরেফিরে এই নদীকেই রাজনের প্রয়োজন হয়।

এত প্রয়োজনের পরেও যে মানুষ কেন প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারেনা। হয়তো এটাই সৃষ্টির নিয়ম। তবে রাজন এখন অনেক দূরে যে হারিয়ে গেছে তা নদীর জানতে বাকি নেই। সেখান থেকে ফেরা মুশকিল। নদী কোথায় হারাবে? নুড়ি তার মেয়ে না তবুও তো নুড়িকে ঘিরেই তার সব। নদীর তো নুড়ির জন্য হলেও এখানেই ধুঁকে মরতে হবে। হারালে চলবে না। আর যদি কখনো হারিয়ে যায়, তখন না হয় মা মেয়ে একসঙ্গে হারাবে। নদী কখনো চিঠি কিংবা অনুভূতি লিখেনি। আজ লিখতে ইচ্ছে করছে। শরীরের গা কাঁপানো ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়েই লিখতে ভীষণ হচ্ছে করছে। সে লিখতে বসল।
আমার হয়েও না হওয়া ভালোবাসা,
২.২০.২২

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তীব্র জ্বর আমার গায়ে, কিন্তু তার থেকেও বেশি জ্বর তোমাকে দেখার। থার্মোমিটার বলছে ১০৩, কিন্তু মন বলছে, তুমি-হীন সুস্থতা আমার কাম্য নেই। ডাক্তারের কাছে গেলে সে কেবল ঘুমের ওষুধ দেয়, অথচ রোগ যে আমার একটাই—”তুমি”। তুমি চোখের আড়ালে, এইটুকুই আমার অসুখের কারণ। সারাদিনের দুর্বলতা, বমি, কাঁপুনি সবই যে তোমার অনুপস্থিতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তুমি কখনও জানবেও না যে,তুমি ভালোবাসোনি বিধায় একটা মানুষ রোজ কতখানি চাপা অসুস্থতা কুড়িয়েছে। শুধুই কোনো একদিন তুমি এসে চোখে চোখ রেখে মনের জানালায় হাত রেখে সুস্থ করে তুলবে বলে। তুমি আমার গা কাঁপানো সেই মনের জ্বর ছিলে যাকে আমি ভালোবেসে হেমলক হিসেবে পান করেছি প্রতি মুহূর্তে। এখন মৃত্যু তো আমার নিশ্চিত তাই না বলো?
ইতি ভালোবাসায় দগ্ধ হওয়া এক মৃত,
চাতক পাখি
নদীর শরীর কাঁপছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। সে আর লিখতে পারছে না। ইতি টানল। কেন চিঠিটা ভালোবাসায় সিক্ত হলো না? কেন এত আক্ষেপ জমা হলো নদীর লেখা প্রথম চিঠিতে। নদী চিঠি জড়িয়ে ধরে কাঁদল। শব্দহীন আর্তনাদে হাহাকার করল।

সোহান কাজে আসে না আজ অনেকদিন হলো। নেশা করে। ভয়ানক সব ডোজ নিয়ে কাত হয়ে পড়ে থাকে। কারণ একটাই তা কেবল চিত্রা। ইদানীং চিত্রা কলেজে গেলেও লুকিয়ে লুকিয়ে চিত্রাকে অনুসরণ করে সোহান পালোয়ান। ভালোবাসায় তার জীবন মজে গেছে। তাও ভালো সিফাত সোহানকে আগলে রেখেছে। তা না হলে যে কি হতো? তবে সিফাত ইদানীং বিরক্ত। বিরক্তের কারণ খালি যে সোহান পালোয়ানের অদ্ভুত কাজকর্ম তা নয় বরং চিত্রা। ওই মেয়ে থাকলে কি আর তার ভাই ঠিক হবে? ধ্বংস করবে ওই মেয়েসব। তাছাড়া তালুকদার বাড়ির মেয়ে। তালুকদার বাড়ির ইতিহাস কেউ ভুলেনি। ওই বাড়ির রক্ত ভালো তো হওয়ার নয়। কিছু একটা করা লাগবেই।
সকাল সকাল নাহিয়ান গোসল করে তৈরি হয়। ফারিয়া বিছানা ঘুছিয়ে নাহিয়ানের সামনে এসে দাঁড়ায়। নাহিয়ান যে গোয়েন্দা অফিসার সেটা ফারিয়া অনেক আগেই জানে। এই লোকটা নিজ থেকেই তাকে সব কিছু বলেছে। আর বলেছে দেখেই তো ফারিয়ার প্রতি মুহূর্তে একটা ভয় কাজ করত। যদি তার ভাইয়েদের কানে সব পৌঁছে যায়? তখন তো তারা তার স্বামীকে ছাড়বে না।

ফারিয়ার বিয়ের আগের একটা অতীত আছে। কলেজে থাকাকালীন সময় একটা ছেলে তাকে প্রায় বিরক্ত করত রাস্তায়। তারপর একদিন সেই ছেলে ফারিয়ার ছবি কিছু খারাপ নোংরা ছবির মধ্যে লাগিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে। এত নিখুঁত ভাবে ছবিগুলো বসানো যে কেউ ধরতেই পারবে না। কেবল ফারিয়া জানে এসব মিথ্যা। ছেলেটি তাকে একরাতের জন্য বিছানায় আহ্বান করে। তা না হলে নাকি ছবি সে ভাইরাল করে দিবে। ফারিয়া তার পরিবারের মানুষদের জানে। ওদের চোখে নারী এমনিতেই নিচুজাত। তার ওপর এসব দেখলে ভুল বুঝে ফারিয়াকে খুন করতে এক মুহূর্তে সময় নিবে না। ভয়ে ফারিয়া রাজি হয়ে যায় ওই ছেলের প্রস্তাবে। কিন্তু তবুও কোনো লাভ হয় না। ওই ছেলের দাবি,চাহিদা বাড়ে। টাকা চাওয়া শুরু হয়। একসময় ঘটনা এলাহী বাড়ির ছেলেদের কানে চলেই যায়। তারা তো ফারিয়াকে মেরেই ফেলত কিন্তু ওইসময় ফারাজ ভাই একটা কাজে বাংলাদেশ এসেছিল। সব জানার পর ফারিয়াকে সেই রক্ষা করে।

তবে ওই ছেলের লাশ পাওয়া যায়। রাজন ভাইদের দলে তখন নাহিয়ান নতুন যুক্ত হয়েছিল। ফারিয়া পরে জেনেছে সে উদ্দেশ্য পূরণ করতে দলে যুক্ত হয়েছে। তবে সে সত্যি ফারিয়াকে ভালোবাসেই ফেলে প্রথম দেখায়। ভালোবাসে বলেই তো ফারিয়ার মুখের দিকে চেয়ে এই বাড়ির কারোর সত্য সামনে আনেনি। ফারিয়া ঝামেলা যায় না। এসব আইন তাদের ভাইয়েদের কিছুই করতে পারবে না। তার চেয়ে বরং পাপের শাস্তি খোদার হাতে তুলে দেওয়া হোক। এই নাহিয়ান ছেলেটা আসলেই ভালো। ফারিয়াকে শর্তমতে ওই ছেলের সঙ্গেই বিয়ে বসতে হয়। ছেলেটা সব জানার পরেও ফারিয়াকে মেনে নিয়েছিল। কেবল এই কথা জানার পরই ফারিয়া হু হু করে কেঁদেছিল। নাহিয়ান এত যত্নশীল পুরুষ। তাকে আপন করে নিতে ফারিয়ার একটু কষ্ট হয়নি। কোনো জনমে হয়তো ভালো কিছু করেছিল তাইতো তার জীবনে নাহিয়ান এসেছে। তবে এখন সব ছেড়ে ফারিয়া আর নাহিয়ান বিদেশ চলে যাবে। খুব জলদিই। আর কখনোই দেশে ফিরবে না। পৃথিবী জানবে না এলাহী বাড়ির সঙ্গে কোনো এক কালে এই দুজন মানুষেরও গভীর সম্পর্ক ছিল।

ছাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে নিরুপমা। বজ্র ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। এখানে এসেছিল অন্য এক উদ্দেশ্য নিয়ে। খোদা এক উদ্দেশ্য পূরণ করতে পাঠিয়ে অন্য উদ্দেশ্যে জড়িয়ে ফেলেছে। খোদার পরিকল্পনার কোনো তুলনা হয়না। যাকে মন চায়নি তাকে বজ্রর আপন করতে হয়নি আর যাকে চেয়েছে সে তো আপাতত পাশেই আছে। তবে বাবাকে যে করেই হোক এবার বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে হবে। যেটা হওয়ার সেটা তো হয়েছেই। আর কায়সার বাড়িটা তো হাতছাড়া হয়েছে নিজেদের ভুলের কারণেই। কায়সারটা ডাকাত বংশের লোক ছিল। পূর্ব শত্রুর অভাব ছিল না। ভালো মানুষদেরই তো শত্রুর অভাব থাকে না আর তো খারাপ লোকেদের। বিদেশে সবাই ভালোই আছে। ওই ভাঙ্গা কায়সার বাড়ির প্রয়োজন নেই তার। আর ওই বাড়ির মেয়ে এখন ভালোই আছে। তারও বাড়ি ফেরার দরকার নেই। বজ্র নিরুকেই ভালোবাসে। বউ হয়ে নিরুই বজ্রর সঙ্গে যাবে। তবে এখন সময়ের অপেক্ষা। একবার সব ঝামেলা মিটুক। সব ক্লিয়ার হয়ে যাক তখন শান্তি। বজ্র নিরুকে কি বলবে না বলবে করতে করতে হঠাৎ পকেট থেকে আংটি বের করে। সেটা নিরুর সামনে ধরে বলে, “উইল ইউ ম্যারি মি?”

সুলেমান এলাহীর মৃত্যুর বিষয়ে বাড়ির কে জানে কিংবা জানে না এই বিষয়ে বাড়ির বাকিদের খবর তো রুমানা জানে না তবে এটা জানে খুনি আসলে কে? কথা হচ্ছে সবাই কপাল। পাপ করলে তার শাস্তি সবাইকেই পেতে হবে। অতীতের পাপের শাস্তি সব। রুমানা পাপ করার সময়ও জানত শাস্তি পেতেই হবে কিন্তু এমন ভাবে পেতে হবে তা জানত না। রুমানার হঠাৎ করেই চোখের সামনে তালুকদার বাড়ির একটা প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। রুমানা অনেক করে চেয়েছিল মোহনা আর নদী ঘরে যেন ছেলে হয়। বংশ তো সামনে এগিয়ে নিতে হবে। তার জন্য ছেলেই দরকার। আর এই বাড়িতে মেয়েদের তো কদর নেই তা সে জানেই। এসব জানার পরেও কখনো ইচ্ছে হয়নি নাতনিদের মুখ দেখার। তবে চিত্রার বিষয়ে আপাতত কিছুই বলতে পারছে না। সে যে চিত্রার সঙ্গে অন্যায় করেছে। অনেক বড় অন্যায় করেছে। এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর রুমানা প্রায় রাতেই তো চিত্রাকে রুমে ডাকতেন। গল্প করতেন। বাড়ির জন্য মিষ্টি বানালে চিত্রাকে রাতে একটা বেশি দিতেন। কেন দিতেন সে জানে ভালো। আসলে রুমানা কখনো চায়নি চিত্রার কোল আলো করে সন্তান আসুক। তাই তো খাবারের সঙ্গে মাসে একটা করে ঔষধ খাইয়েছে। যাতে আস্তে ধীরে মেয়েটা বাচ্চা নষ্ট করে ফেলতে পারে। তাই তো সারা মাসই চিত্রা একটু ভালো থাকলে বাকিটা অসুস্থ থাকে। সুলেমানও সব জানত। তবে আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। এই যে এত এত পাপ? এসবের কথা ভাবলেই ভয় করে। মৃত্যুটা তার কেমন করে হবে? সুলেমানের মতো ভয়ানক ভাবে? নাকি তার চেয়েও ভয়ানক ভাবে?

সোহাগ সব ভুলে নতুন করে মায়ের জন্য বাঁচতে শুরু করেছে। মা এখন আগের থেকে সুস্থ। ফারাজ সোহাগকে একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছে। বিকেলে কাজ শেষ করে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যায়। অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরে। নিজের রাঁধে, মায়ের সেবা করে, নিজের কাজ শেষ করে। এভাবে ভালোই চলে যাচ্ছে তার দিনকাল।
ফারাজ এখন বাসায় নেই। চিত্রার বই পড়তে ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ ফোনে একটা গান শুনে কত কী ভাবল। ফারাজকে সে বিশ্বাস করে। তবে নাহিয়ান খানের কথাগুলো যে এখন পর্যন্ত শান্তি দিচ্ছে না তাকে। আর দিবেও না। এই বাড়ির কেউ সাধু না। মিতালি, নিলু সবাইকে ধ্বংস করেছে। তবুও চিত্রা চুপ করে আছে। কেবল ফারাজকে হারাতে চায় না বলেই। সে প্রতিবাদ করলে যদি ফারাজ আবার দূরত্বে উপহার দেয় তাকে? কিন্তু চিত্রার এই পরিবারে থাকতে এখন কষ্ট হয়। খুনিদের সঙ্গে একসাথে উঠছে, বসছে একই ছাদের নিচে। এর চেয়ে কষ্টের জীবনে কি আছে? তবুও মুখ বন্ধ করে বাঁচতে হচ্ছে। চিত্রা জলদি এখান থেকে চলে যেতে চায়৷ এই রক্তপাত, খুন তার বোধগম্য নয়। সে এবার এসব থেকে মুক্তি চায়। কেবল মুক্তি। চিত্রা কি ভেবে বজ্রকে কল করল। বজ্র প্রথম কলটা ধরল না। তবে ২য়টা ধরল। ধরেই ঘুমভাঙা কণ্ঠে বলল, ‘এই সময় চিত্রা?’

‘ভাবী হই।’
‘হ্যাঁ সেটাই। বলুন ভাবী কি জন্য কল করেছেন?’
‘আমার পাসপোর্টের ঝামেলা শেষ হয়নি কেন? আমি ইতালি যাব কেমন করে?’
‘আপনার স্বামী যাবে ডেনমার্ক আপনি ইতালি কেন?’
‘আরে ধ্যাৎ! একটু আগে একটা গল্পের বই পড়ছিলাম। সেখানে এতবার ইতালির নাম দেওয়া। তাই মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল। যাইহোক ঝামেলা কি ঠিক হবে না?’
‘হবে আমি ব্যবস্থা করেই তো রাখলাম। বিদেশ চলে যান আরামে সংসার করুন। বাকিদের কেউ ভালো থাকতে দেন।’

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৫৯

‘খারাপ আছেন বুঝি বজ্র কায়সার?’
‘ ভালো আর থাকলাম কই চিত্রা….. চিত্রা তালুকদার।’
‘সাবধানে। পাসপোর্টের বিষয়টা সুন্দর ভাবে দেখুন। আমি জলদি সব ছেড়ে ফারাজের সঙ্গে ডেনমার্ক চলে যাবো। আর ঘুমাচ্ছিলেন মনে হয়? আমি একটু দিলাম বলে আপনি পুরোটা নিয়ে নেবেন?’
‘কেন আপনি জানেন না কায়সারের রক্তে নেওয়া-দেওয়ার হিসাবটা কেমন?’
‘রক্তের বিষয়ে জানি বলেই সাবধান করছি। না হলে কবেই তো রক্তের হিসাবে সব ধ্বংস হতো তাই না বলুন মিস্টার বজ্র কায়সার?’

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৬০

1 COMMENT

Comments are closed.