ধূসর রংধনু পর্ব ৫১
মাহিরা ইসলাম
দীর্ঘ রজনী কেটে গিয়ে এসেছে নতুন ভোর,একটি নতুন সকাল, একটি নতুন দিন।
গতকালের দিনটা ভালো কেটে বিধায় যে আজকের দিনটা ভালো কাটবে এমন কোনো কথা নেই।হয়তো উদ্ভব হতে পারে কোনো নতুন কোনো বিপদের। হয়তো আগমন ঘটতে পারে নতুন কোনো আনন্দের।
তার সবই তো জানেন একমাত্র উপর ওয়ালা।
দেখাই যাক না কি হয়। সুখ দুঃখ দুই মিলিয়েই তো আমাদের এই মানব জীবন।
চোখের তন্দ্রা ভাব মিইয়ে যেতেই ঘুম ছুটে গেল তাসফির।
চোখ পিটপিট করে চাইলো সে।মুখে তার লাজুক হাঁসি।
শত চেষ্টার পরে প্রিয়তম কে নিজের করে পাওয়ার প্রাপ্তির হাঁসি।
চোখ মেলতেই চোখে সামনে দৃশ্যমান হলো তার ডাক্তার সাহেবের সুদর্শন মুখখানি।
চুলগুলো তার এলো মেলো।যা রাতে তাসফির হস্তের
দ্বারাই সৃষ্ট। দেখ কি নিষ্পাপ মুখভঙ্গি নিয়েই না ঘুমাচ্ছে পুরুষটা।
অথচ লোকটা তার নিকট এক নম্বরের লাগামহীন অসভ্য পুরুষ মানুষ। তার অতি প্রিয় ডাক্তার সাহেব।
অসভ্য লোকটা তাকে রাতে খাবার খাওয়ার সুযোগ টুকু দেয়নি। খিদেতে পেটে পাক দিচ্ছে।
ইশশ কত্ত মজার মজার খাবার গুলো সে সারাদিন খেটেখুটে রান্না করলো অথচ এখন কিনা সব ফেলে দিতে হবে। ভালো আছে কিনা কে জানে।
ভালো থাকলেই ভালো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তবুও আজ তাসফির দীর্ঘদিনের দেখা স্বপ্নটা পুরণ হলো।
এই যে নিস্তব্ধ’র আলিঙ্গনের সে আবদ্ধ। আর মানব ঘুমন্ত। মানবের ঘুম ছোটার আগেই সে জেগে গিয়েছে।
প্রতিবার তাকে বিছানায় রেখে লোকটা উধাও হয়।
আর আজ তাসফি তাকে রেখে উধাও হবে।
লজ্জা মিশ্রিত ভঙ্গিতে তাসফি আলতো করে চুমু খেল নিস্তব্ধ’র বক্ষমাঝে।
একদিকে সারারাত শুয়ে থাকার ফলে তার গাড় ব্যাথা হওয়ার জোগাড়।
তাসফি পাশ ফিরতে নিলে আঁতকে উঠে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিস্তব্ধকে আবারো শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।
ও গড,সে তো এখন সোফা থেকে পড়লে তার হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকতো তো।
সে যে সোফায় শুয়ে আছে তা তো তার খেয়ালই ছিল না।
ঘুমন্ত নিস্তব্ধ’র পানে তাসফি ভ্রু কুঁচকে চাইলো।
তার ডাক্তার সাহেবের বুদ্ধি জ্ঞান যে লোপ পেয়েছে তা ভালোই বোঝা যাচ্ছে।
তাসফির ভাবনার মাঝেই পরপর কয়েকবার কলিংবেল বেঁজে উঠলো।
তাসফি ভ্রু কুঁচকালো এই অসময়ে আবার কে এলো। ইয়ানা এলো না তো।কিন্তু তার তো আজ আসার কথা নয়। আর এমন অভদ্রের মত একনাগাড়ে এতবার কলিংবেল বাজানোর ওও বা কি আছে আশ্চর্য।
ঘড়ির দিকে চোখ পরতেই তাসফি আঁতকে উঠলো প্রায়। বেলা দুপুর তিনটা বাজে? অসম্ভব ব্যাপার স্যাপার। এতটা সময় কি করে ঘুমালো সে।
তাসফি কোনো রকমে নিস্তব্ধ কে ছাড়িয়ে উঠে বসলো।
দৃঢ় কদমে এগিয়ে গেল দরজার নিকট।
লুকিং গ্লাসে তাসফি যাকে দেখলো তাকে দেখে সে চমকে উঠলো। ওও মাই গড এই মহিলাকে সে বাড়ির এলবামে দেখেছে।
দৌঁড়ে এসে নিস্তব্ধ কে ঠেলতে লাগলো সে।
“শুনছেন উঠুন, আরে উঠুন না।”
” বউ আর একটু ঘুমাতে দাও না প্লিজ। রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি।”
” আরে রাখুন আপনার ঘুম। দ্রুত উঠুন।আরে উঠুন তো আপনার ফুপি এসেছে।
ফুপির এসেছে শুনতেই চমকে উঠে নিস্তব্ধ ঘুম ঘুম চোখেই দাঁড়িয়ে পরলো।
খানিকটা আতঙ্কিত স্বরে প্রত্যুত্তর করলো,
” ফুপি, কোথায় ফুপি?”
তাসফি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” বাহিরে।”
নিস্তব্ধ আর্তনাদ করে উঠলো।
-” ওও মাই গড! সীট,সীট।”
তাসফির পরনে নিস্তব্ধ’র শার্ট।
আর নিস্তব্ধ সে উদোম গায়ে। প্যান্ট পরিহিত।
তাসফি নিজের শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট দ্রুত গতিতে নিচ থেকে তুলে জড় করতে করতে বলল,
-” দাঁড়িয়ে আছেন কেন যান দরজা খুলুন আমি যাচ্ছি উপরে।”
তাসফি যে এই মুহুর্তে লজ্জা পাবে সেই সময়টাও পাচ্ছে না। আহারে।
নিস্তব্ধ হতভম্ব হয়ে সুধালো,
-” কি বলছো কি বউ এত বছর পর আমি ফুপির সামনে এভাবে উদোম গায়ে যাবো? অসম্ভব। ”
তাসফি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলল,
-” নো অপশন ডাক্তার সাহেব। ”
নিস্তব্ধ অসহায় মুখ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। শেষ পর্যন্ত এই ছিল তার কপালে।
নিস্তব্ধ তার ফুফুকে কিছুটা ভয় পায়। ছোট বেলা একদিন খাতায় হোমওয়ার্ক না করায় স্কুল থেকে বিচার পাঠিয়েছিল।ফুফু তা শুনে খুব মেরেছিলো তাকে। পরে আবার আদরও করেছিলেন খুব।সেই থেকে নিস্তব্ধ কখনো আর স্কুল কলেজ কোথায় হোমওয়ার্ক ব্যতীত বাসা থেকে বের হয়নি।
তবে এমনিতেই সবার থেকে ফুফু তাকে একটু বেশিই স্নেহ করেন।ফুফু তার একরোখা মানুষ। খানিকটা বাঁচাল প্রকৃতিরও। দাদুর নাকচ করা সত্ব্যেও নিজের পছন্দের ছেলে বিয়ে করে লন্ডনে স্যাটেল্ড হয়েছে।বিয়ের পর এই প্রথম ফুফু তাদের বাড়িতে পা রাখবে।অথচ তারা কিনা কেউ জানেই না আজ ফুফু আসবে।ফুফুতো কাউকে জানায় ওও নি।
নিস্তব্ধ খানিকটা ভয় ওও পাচ্ছে। ফুফু তার একটু থেকে আকটু উনিশ বিশ হতেই কাজে ভুল ধরতে শুরু করে আর শোনায় একগাদা ধারালো কথা।কথা তো নয় যেন এক এক টা বিষাক্ত বান।দাদা তার শখ করে নাম রেখেছিলো টুনি। এই টুনি ছোট্ট খাট্টো কোনো টুনি নয়,এই টুনিট শরীর বিশাল।
নিস্তব্ধ দুরুদুরু বুকে দরজা খুলে দিলো।
নিস্তব্ধ কে উদোম গায়ে দেখে ফুফু চোখ কপালে তুলে চাইলেন।
তীব্র আর্তনাদ করে বললেন,
-” ছিঃ ছিঃ ছিঃ অনুভব তোর এতটা অধঃপতন হয়েছে আমি তো জানতামই না। দেখলি এতদিন পর ফুফি এসেছে কই ফিটফাট হয়ে থাকবি তা না করে নির্লজ্জের মত উদোম গায়ে আমার সামনে চলে এলি।বলি বাপের মত কি লজ্জা শরম খেয়ে বসেছিস?
দাদার মতো হয়েছে।
আমার অবর্তমানে ওরা সবাই মিলে যে তোকে এই শিক্ষা দেবে আগে জানলে আমি তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম।তুই নাকি আবার ডাক্তার হয়েছিস।
তা এভাবে খালি গায়ে কি ডাক্তারী ওও সামলাস নাকি।ছিঃ ছিঃ।
নিস্তব্ধ লজ্জায় মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
কোনো রকমে বলল,
-” ফুপি তুমি ভেতরে এসে কথা বলো না। এসব বাদ দাও এতদিন পর এলে আগে কেমন আছো সেটা বলো। সলিল তিয়াশা কে নিয়ে আসো নি?”
-” কেমন আছি তা তো দেখতেই পাচ্ছিস রে অনুভব। আমিও দেখতে পাচ্ছি তুই কেমন নির্লজ্জের মতো সুস্থ সবল ভাবে দাঁড়িয়ে আছিস।আর হ্যাঁ ভেতরে তো ঢুকবোই।আমি তো চলে যাওয়ার জন্য আসি নি। তোর দাদা যতই আমাকে বাড়ি থেকে বার করুক আমি কেন যাবো। এই বাড়িতে আমার সমান অধিকার রয়েছে৷ দেখি সামনে থেকে সর আগে তোর বউ দেখে নেই আমি। বিয়ে করে এত্ত বড় হয়ে গেছিস যে বিয়ে করে বাসর সেরে ফেললি আর এই টুনি তা জানতে পর্যন্ত পারলো না। ড্রাইবার কে বল আমার লাগেজ ভেতরে দিয়ে যেতে।”
-” এই তো এখুনি যাচ্ছি ফুপি।”
ফুফু ভেতরে ঢুকে চারপাশ অবলোকন করে বলল,
-” কি ব্যাপারে চারপাশ এত ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো কেন।পার্টি করেছিস নাকি রাতে। আর বাকিরা সব কই। আমায় রেখে পার্টি করা হচ্ছে। ”
নিস্তব্ধ বোকা হাঁসার চেষ্টা করলো। বুঝতে পারলো ভীষণ রকম ভাবে ধরা খেয়েছে সে। আজ আর রক্ষে নেই।
প্রত্যুত্তরে নিস্তব্ধ কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিস্তব্ধ অবাক হয়ে গেল।
দেখতে পেল তাসফি কালো রংয়ের শাড়ি পড়ে ফুপি বলে দৌড়ে আসছে।
তাসফি চিৎকার করে ফুপি বলে দৌঁড়ে এসে টাইট করে ফুফু কে জরিয়ে ধরলো।
ফুফু খানিকটা হকচকালো।পড়তে নিলেও কোনো রকমে নিজেকে সামলালো।
ধমকে বলল,
-” এই মেয়ে কে তুমি। আশ্চর্য এভাবে কেউ জরিয়ে ধরে।এখনি তো তোমার চিৎকার শুনে আমার প্রাণটা যেত।”
তাসফি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
-” ফুপি আমি আপনার ভাতিজির একমাত্র বউ। আর এই যে ঝাড়বাতি গুলো দেখছেন এগুলো তো আমি নিজে হাতে আপনার জন্য সাজিয়েছি। আপনার তো কয়েকদিন পরে আসার কথা ছিল, কিন্তু আমি এগুলো আগেই সাজিয়ে ফেলেছি।ভালো হয়েছে না বলুন ফুপি? এই যে দেখুন টেবিলে উপর কেকটাও আমি আপনার জন্য আনিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু আপনার ভাতিজি কিছু বলার আগেই কতখানি সাবার করে দিয়েছে।
তাসফির এমন ঢপ মারার নাটকীয় ভঙ্গিমা দেখে নিস্তব্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। ওও মাই গড, ওও মাই গড তার বউ যে এভাবে, এত সুন্দর করে নাটক করতে পারে তার তো জানাই ছিল না।
ফুফু অবাক কন্ঠে বলল,
-” তুমি অনুভবের বউ? ”
তাসফি লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো।
তাসফির লজ্জার পাওয়ার ভাবভঙ্গিমা দেখে নিস্তব্ধ নিজে থতমত খেল।
ফুফু আগের থেকে দ্বিগুণ অবাক ঝরা কন্ঠে বললেন,
-” আর এগুলো তুমি আমার জন্য করেছো? সত্যিই?”
তাসফি এবারে জোড়ে জোড়ে মাথা নাড়লো।
ফুফুর চোখ ছলছল করে উঠলো।
তাসফিকে বুকে জরিয়ে ধরে বলল,
-” আহারে আমার সোনাটা। অনুভব রে এইবারে একখান কাজের কাজ করেছিস। এই শেখ বাড়ির যোগ্য বউমা খুঁজে নিয়েছিস।
এভাবে আমার জন্য এবাড়ির কেউ ভাবে নি রে কোনোদিন কেউনা।কেউ তো আমায় দেখতেই পারেনা। তুমিই এই প্রথম মেয়ে।”
আবেগে আপ্লুত হয়ে ফুফু নিজের গলায় পরা স্বর্ণের চেইন খুলে তাসফির গলায় পরিয়ে দিলো। তারপর আবারো জরিয়ে ধরলো বুকে।
তাসফি ওও ফুফু কে জরিয়ে ধরলো। নিস্তব্ধ’র দিকে তাকিয়ে চোখ চিপ মারলো।
নিস্তব্ধ রে এবারে বুঝি তোর শুধু জ্ঞান হারানোর পালা। আর তো কোনো রিয়াকশন দেওয়া বাকি নেই।
তার এমন কর্কশ ফুফুকে এই মেয়ে এক লহমায় হাত করে ফেলল।তা আবার বুকে জরিয়ে স্বর্ণের চেন আদায় করে।
ফুফু নিজের গলার আরো একটা চেন খুলে তাসফিকে পরিয়ে দিলো,
-” এই নাও, আমার আশির্বাদের গিফট।”
নিস্তব্ধ কোনোরকমে সোফায় গাঁ এলিয়ে দিলো।
তার যে উপরে গিয়ে ফ্রেস হওয়া প্রয়োজন কথাটা তার মস্তিষ্কে খেলছে না।
পরপর এত সারপ্রাইজে সে এবারে সত্যিই শকড।
সুজন রেডি হচ্ছিলো।তার বন্ধু জসিমের কাকার বিয়ে। জোড় করে সুজন কে নিচ্ছে ছেলেটা। হাজারবার না বলেও লাভ হয় নি।ছেলেটা একদম নাছর বান্দা। জসিম রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল বিয়েতে গেলে কিছু মজার কান্ড দেখতে পারবি।
সুজনের মাঝেও সামান্য কৌতূহল জাগলো।এমনিতেও চার পাঁচ দিন যাবত সে প্রচন্ড ডিস্টার্ব ফিল করছে। মজার কিছু কান্ড দেখেও যদি মনটা একটু ফুরফুরে হয়।
সুজনের মা ছেলের রুমে ঢুকতে ঢুলতে সুধালো ” এই অসময়ে যাচ্ছিস কখন আসবি বাবা? আজ ফিরবি তো?”
সুজন পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে করতে বলল,
-” ঠিক নেই মা যেতে মিনিমান একঘন্টা তো লাগবেই।তারপর খাওয়া দাওয়া বিয়ে পড়ানো।রাত তো কিছুটা হবেই।”
রাহেলা বেগম ছেলেকে মন দিয়ে দেখেন।
ছেলে তার উজ্জল ফর্সা।কি মায়াবী চেহারা। লাল পাঞ্জাবিতে আরো দেশ মানিয়েছে। গায়ের চামড়ার সঙ্গে কেমন ফুটে আছে দেখ।
মাঝে মাঝে মনে হয় তারই না নজর লেগে যায়।
ছেলেটা চাইলে শত শত মেয়ে তার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যাবে।অথচ ছেলেটাকে শত বোঝানোর পরেও ছেলেটা তার বিয়ে করতে নারাজ।
কবে যে ছেলের মতি হবে কে জানে।
ভদ্রমহিলা আফসোসের স্বরে বলল,
-” আর কত কাল অন্যের বিয়ে খাবে বাপ? এবারে নিজে বিয়েটা কর না।”
সুজন বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নেয়।
-” কি মা। তোমায় তো বলেছি মনের মতো মেয়ে পাচ্ছি না।পেলেই বিয়ে করে নেব। এত প্যারা দিও না তো।”
মুচকি হেঁসে মায়ের কাঁধ জরিয়ে বলে,
-” শোন মা জীবনে এত প্যারা নিতে নেই বুঝলে।সব সময় শুধু চিল করবা।আর বিয়ের মত একটা সাধারণ ব্যাপার নিয়ে এত বড় ইস্যু বানানোর তোমার কোনো দরকার নাই।দেখবে কখন না জানি হুট করে মেয়ে পছন্দ হলো আর তাকে সোজা বিয়ে করেই নিয়ে আসলাম।”
রাহেলা বেগম থমথমে কন্ঠে বলল,
-” তা হলে তো ভালোই হয়। তবুও মরনের আগে ছেলের বউয়ের মুখ তো দেখতে পাব।”
সুজন বুঝলো মা এবার ইমোশনাল মুডে চলে যাবে।
দ্রুত মানি ব্যাগ পকেটে ভরতে ভরতে বলল,
-” আমি আসছি মা।
থাকো।দেরী হয়ে যাবে।ফিরতে রাত হবে বোধহয়।”
বরযাত্রীর সঙ্গে বিয়ে বাড়িতে পৌঁছেছে সুজন অনেক ক্ষণ আগেই।
ধরণীর বুকে সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ আগেই খাওয়া দাওয়া শেষে সুজন বাইরে একটু হাঁটটে বের হয়েছিল।
বিয়ে পড়ানো হবে খানিকক্ষণ পরেই।
ভাবলো একটু হাঁটাহাটির পরে বিয়ের পড়ানোর ওখানে থাকা যাবে।
হঠাৎ অযাচিত কিছু কথা কানে বাজতেই সুজন থেমে গেল।এগিয়ে গিয়ে কথাগুলো স্পষ্ট শোনার চেষ্টা করলো।
এদিকটা কিছুটা নির্জন।সবাই বাড়ির ভেতরের দিকে।
একজন মহিলা কন্ঠ আর পুরুষ কন্ঠ শোনা গেল
-“টাকাতো অর্ধেক দিয়েছেন মশাই বাকিটা কবে পাবো। এমন কচি মাল জুটিয়ে দিলান আর পুরো টাকাটা দিলেন না।”
-” আগে মেয়েটাকে পাই। বিয়েটা সম্পূর্ণ হোক।তারপর সব টাকা পেয়ে যাবেন। বিয়েতে যেন কোনো জামেলা না হয় কমলি, আমি আগেই বলে রাখলাম। তাহলে কিন্তু ফল ভালো হবে না।”
-” চিন্তা করবেন না। মেয়ে বেশি তেরিবেরি করলে জায়গা মতো দিয়ে দেবেন সমস্যা কোথায় শিক্ষিত সুন্দরী মেয়ে দিচ্ছি। আর কি লাগে।”
-” এই জন্যই এতগুলো টাকা দিচ্ছি এমনি এমনি তো দিচ্ছি না।”
ওদের কথা শুনে সুজনের কপালের চিন্তার ভাজ পড়লো।বুঝতে পারলো এদের লক্ষন মোটেও ভালো নয়।
মহিলা আর পুরুষটির চেহারা দেখতে চেষ্টা করলো সুজন।
পর্দা একটু খানি ফাঁক করে দুজনের চেহারা দেখতেই সুজন আঁতকে উঠলো।
একি এত সয়ং বর আর কনের চাঁচি। খাবার দাবারের সময় মহিলা নিজে পরিচিত হয়েছিল। বিয়েটা বেশি বড় করে আয়োজন করা হয়নি একদম ছিমছাম।
সুজন সরে এলো এখান থেকে।
সুজন বেশ বুঝতে পারছে এদের লক্ষন খুব একটা ভালো নয়।
কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছে।
সুজন মানুষের মাঝে আসতেই হঠাৎ একটা দশ বারো বছরের ছেলে এসে সুজনের হাত আঁকড়ে ধরলো।
সুজন ছেলেটার দিকে চমকে তাকালো।
ছেলেটা সুজনের হাত চেপে ধরে বলল,
-” ভাইয়া আমার আপুকে বাঁচান প্লিজ। আমার মা ভালো আপুকে জোড় করে একটা বুইড়া ব্যাডার সাথে বিয়ে দিচ্ছে। ”
সুজন ছেলেটাকে একটু ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলো।
ছেলেটার মাথা ভর্তি চুল। সুজন তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-” কি হয়েছে বাবু আমায় সবটা খুলে বলো তো।”
ছেলেটা বলতে লাগলো,
“মা আপুকে আটকে রেখেছে। জোড় করে বিয়ে দিচ্ছে লোকটার সাথে। বাবা বাড়িতে নেই ব্যবসার কাজে অন্যত্র গিয়েছে , এই সুযোগে মা আমাদের এখানে এনে আপুকে আটকে রেখে ভয় দেখিয়ে বিয়ে দিচ্ছে লোকটার সাথে।”
প্লিজ ভাইয়া কিছু একটা করুন আমার আপুকে বাঁচান ভাইয়া। আমার মনে হলো আপনি আমায় সাহায্য করতে পারবেন।
সুজনের কপালে চিন্তার ভাজ দৃঢ় হলো।
সুজন ছেলেটা মিছে আশ্বাস দিয়ে বলল,
-” আচ্ছা তুমি যাও আমি দেখছি।”
এই জায়গায় সে কিইবা করতে পারে।
জসিমকে সামনে পেয়ে সুজন ওকে চেপে ধরলো।
-” সত্যি করে বল কি হচ্ছে। ”
-” কি হবে?”
-” তোর ষাট চাচা বুড়ো এটা জানতাম কিন্তু তাই বলে সে অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করবে?”
জসিম হেঁসে বলল,
-” এইটাই তো তোকে দেখাতে চেয়েছিলাম।শোন আসলে আমার কাকার একটা ব্যমো আছে কচি মেয়ে বিয়ে করার ব্যমো।”
সুজন আশ্চর্য স্বরে বলল,
-” এটা ব্যাপারটা তোর কাছে মজা মনে হচ্ছে জসিম?
আর ব্যমো আছে মানে? ব্যমো আছে মানেটা কি?
তোর চাচার এর আগে আরো বিয়ে করেছে নাকি?”
জসিম দাঁত কেলিয়ে হাঁসলো।
সুজন বলল,
-” এটা ফাজিলামির সময় নয় জসিম। মেয়েটা নাকি বিয়েতে রাজী না জোড় করে তাকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তুই আমায় এটা বল আগে যতগুলো বিয়ে করেছে তার সেই বউগুলো এখন কোথায়?”
জসিম চিন্তিত কন্ঠে বলল,
-“তাদের তো আমরা আর দেখিনি। বিয়ের পর চাচা তাদপর সাবইকে অন্য ফ্লাটে নিয়ে রাখতো।”
-” এক্সাক্টলি। দেখ জসিম ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না আমার। এই মুহুর্তে আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া প্রয়োজন।”
জসিমকেও কিছুটা চমকিত দেখালো। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
-” কিন্তু বিয়ে পড়ানো তো শুরু হয়ে গেছে।তাই তো আমি তোকে খুঁজতে এসেছিলাম। ”
“কিন্তু বিয়ে তো আরো পড় পড়ানোর কথা ছিল।”
“চাচা বললো দ্রুত বিয়ের কাজ সারতে।”
সুজন জসিমকে বলল,
-” তুই এখুনি পুলিশকে ফোন করে আসতে বল।আশা করি বিশ মিনিটের মাঝে ওনারা এসে পরবে।আমি দেখি বিয়েটা আটকানো যায় কিনা ততক্ষণে। ”
বলেই সুজন দৌঁড়ে ভেতরে গেল।
” এই বিয়ে এখুনি থামান।”
সুজনের কথায় ঘরের মাঝে সবাই চমকে তার দিকে তাকালো।
কাজী সাহেব কেবলি বর কনের নাম ধাম বলতে শুরু করেছিল। সুজনের কতায় সেও কিছুটা থমকালো।
চাচা বিরক্তির কন্ঠে বলল,
-” ফাজলামো করছো নাকি। বিয়ে পড়ানো কেন থামাবে?”
সুজন কোনো উত্তর দিলো না।
ধূসর রংধনু পর্ব ৫০
এগিয়ে গেল বসে থাকা কনের দিকে।
সুজন সেকেন্ডের মাঝে কনের গোমটা দেওয়া মুখশ্রীর গোমটা তুলে দিলো।
কনে সাঁজে কান্নারত অশ্রুভেজা মুখশ্রীতে রমণী ড্যাবড্যাব করে সুজনের দিকে চাইলো।
রমনীর চেহারা দেখতেই সুজন আঁতকে উঠলো। এই বুঝি তার পায়ের নিচের জমিনে ফাটল ধরবে।