মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৫

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৫
নওরিন কবির তিশা

নিকষ কালো আঁধারে ‌আচ্ছন্ন চারিধার। নির্জন,নিস্তব্ধ রাস্তায় ছুটে চলেছে একটি দামি প্রাইভেট কার। ভেতরে এসে চললেও, তাতে বসা লোকটির ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। রাত প্রায় দুইটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। এমনিতেই এত গভীর রাত তার ওপর শীতের তীব্রতাও নেহাতই কম নয়। তবুও এসি চলায় শীতে একপ্রকার কম্পন শুরু হয়েছে ড্রাইভার মজনুর।
ব্যাক সিটে বসা লোকটি তাড়া দিয়ে বলল,,
——“কইছি না তাড়াতাড়ি চালা। এত সময় লাগোন যাইতো না। যত দ্রুত সম্ভব,গাড়ির স্পিড যত বেশি হাই করা যায় ততটা কর!”
মজনু কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,,
——“গাড়ির স্পিড এমনিতেই ৯০ কিলোমিটার পার আওয়ার করা স্যার!”
লোকটি গুরুগম্ভীর তবে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,,
——“মাত্র ৯০ কিলোমিটার? তোরে না কইছি যতদূর উঠাতে পারবি ওঠা। তিনটার মধ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে বের হতে হবে আমাদের। বুঝেছিস আমার কথা?”
মজনু সায় জানিয়ে বলল,,

——“জ্বী!”
গাড়ি ফের চলতে শুরু করল;ভেতরে বসে এখনো ঘামছে প্রায় ৫৫ বছর বয়সী পুরুষটি। আজকে রাতের ভেতরেই যে করেই হোক বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে যেতে হবে তাকে। যদিও সে চেয়েছিল একবারই অস্ট্রেলিয়া,জাপান বা তুরস্কের মতো দেশে পাড়ি জমাতে। তবে সময়ের অভাবে কোনোমতে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরোতে চান তিনি।
কিছুদিন ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামে গাঁ ঢাকা দিয়ে থাকবেন, অতঃপর সিদ্ধান্ত নিবেন কোন দেশ তার জন্য নিরাপদ। তবে আপাতত বাংলাদেশ ত্যাগ করা তার জন্য অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।
লোকটি যখন এই সকল চিন্তায় মশগুল ঠিক তখনই,সজোরে ব্রেক কষায় কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন তিনি। রেগে গিয়ে মজনুকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

——“হা*রা*মি*র বা*চ্চা তোরে না কইলাম,গাড়ি না থামাইতে।”
মজনু ভয়ে ভয়ে কিছু বলার আগেই একসঙ্গে প্রায় ৭-৮ টা গাড়ি ঘিরে নিল তাদের। চারিদিক বীকন লাইটের নীলছে আলোয় আলোকিত, সেই সঙ্গে তীব্র তীক্ষ্ণ বেগে একটানা বেজে চলেছে সাইরেনের শব্দ। এমন ঘটনায় ঘাবড়ে যায় গাড়ির ব্যাকসিটে বসে থাকা লোকটি।
এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। তাহলে কি সিআইডি টিম সবকিছু বুঝে ফেলল। তবে সে তো বুদ্ধি করে আরো পাঁচ দিন আগে দেশ ছাড়ছে । তাহলে? ভয়ে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেল পরনের পাঞ্জাবিটা। তবে সে পাশ থেকে পিস্তলটা হাতে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে সামনে বের হতেই মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো এক সুঠামদেহী, তাগড়া যুবক।
বয়স হয়তোবা ২৮-২৯। লোকটিকে দেখে যুবকটি বাঁকা হেসে বলল,,

——“কি ব্যাপার মিস্টার ফরিদ আহমেদ ওরফে ইকরামুল হোসেন ওরফে এরশাদ শিকদার? এত রাতে কোথায় যাচ্ছিলেন? পালাচ্ছিলেন নাকি?”
ফরিদ আহমেদ কেঁপে উঠলো যুবকটির এমন কথায়। অন্যদিকে তাকে এমন ভয় পেতে দেখে নাহিয়ান ফের বাঁকা হাসলো।
নাহিয়ান: “কি ভাবছেন মিস্টার ক্রিমিনাল গ্যাংস্টার, কিভাবে আমি আপনার ঢেকে রাখা পরিচয়টা জানলাম?”
ফরিদ আহমেদ কোনো কিছু না বলে নিজের পিস্তলটা কিছুটা লুকিয়ে সেটাতে লোড দিতে গেলেই নাহিয়ান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,,

——“লাভ হবে না, মিস্টার গর্ত হারানো ইঁদুর। আপনার পিস্তল থেকে একটা গুলি ছোঁড়ার সাথে সাথে, এখানে আপনার র*ক্তে*র বন্যা বইবে! আর আপনি যদি ভেবে থাকেন আপনার দলবল আপনাকে বাঁচাবে তাহলে সে আশার গুড়েবালি। কারণ ইতিমধ্যেই আপনার দলবলের সদস্য;যারা আপনার পিছন পিছন আসছিল তাদেরকে আমার লোকজন যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।”
ফরিদ আহমেদ:“কে তুমি?”
নাহিয়ান:“সিআইডি অফিসার এ আর নাহিয়ান চৌধুরী!”
ফরিদ আহমেদ:“আরে ধুর! তোমার মত কত অফিসার এলো আর গেল। এই পেশায় কতই বা মাইনে পাও তুমি তার থেকে বরং তুমি আমার সাথে যোগ দাও তোমার সারা বছরের বেতন আমি তোমায় এক সপ্তাহে দিব। আর এই যে দলবল এনেছ এদের পাঠিয়ে দাও।”
নাহিয়ান কোনো কথা না বলে এমনভাবে হাসলো যেন মনে হলো সে ফরিদের সব কথা মেনে নিয়েছে। তা দেখে ফরিদ আহমেদ হেসে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নাহিয়ান সজরে এক ঘুষি বসালো ফরিদের বাঁ চোঁয়ালে। সঙ্গে সঙ্গে ত্বক ফেটে র*ক্ত গড়িয়ে পড়ল তার, বাঁ মাড়ির ছয়টা দাঁত একবারই ভেঙে বেরিয়ে আসলো। তা দেখে নাহিয়ান বলল,,

——“তোর কপাল হাজার গুন ভালো যে আজ তোর সামনে সিআইডি অফিসার নাহিয়ান চৌধুরী এসেছে, যদি নরশদ খানমের ভাগ্নে নাহিয়ান চৌধুরী আসতো না, তাহলে তোকে এইখানেই পু*তে রেখে দিতাম, শু***র বাচ্চা, তোকে যে এখনো আমি বাঁচিয়ে রেখেছি এটা তোর সাত জন্মের ভাগ্য!”
নাহিয়ান এর এক ঘুষি তেই ছিটকে পড়ল ফরিদ আহমেদ। চারিধারে আঁধার ঘনিয়ে এলো তার। তার মানে এই নরশদের ছোট বোনের ছেলে,এদের তো কত খুঁজেছে ফরিদ, কিন্তু কোথাও মেলেনি তাদের অস্তিত্ব, শেষমেষ একপ্রকার ফরিদ ভেবেই নিয়েছিল। হয়তো তারাও বিমান দুর্ঘটনায় নুরুজ্জামান খানম আর মাহেজাবিন মায়ার পুত্র নিহিল খানমের মতো মৃ*ত্যু*ব*র*ণ করেছে। কিন্তু এখনো বেঁচে আছে তারা। আর তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, নরশদের প্রাণপ্রিয় ভাগ্নেটা।

ফরিদ আহমেদ ওঠার আগেই নাহিয়ান তার শার্টের কলার ধরে টেনে তুললো। অতঃপর তাকে ফের মারার আগেই ছুটে আসলো তার টিমের অন্যান্য সদস্যরা। গোটা একমাস ব্যাপী বাংলাদেশে পরিচয় গোপন করে ছিলো তারা। সেদিন আল্লাহর রহমতে দুইটি গুলিই নাহিয়ানের হৃদপিন্ডের থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে লাগায় বেঁচে গিয়েছিল সে।
হসপিটাল থেকে ফিরেই বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে নাহিয়ান জানতে পারে। তার মামা-বাড়ির খু*নি*র আসল পরিচয়। তারপরের দিনই বাংলাদেশের ব্যাক করেছিল নাহিয়ান আর তার পুরো শ্যাডো টিম। বাংলাদেশ সিআইডি টিমের সহায়তায় এতদিন পরিচয় গোপন করেছিল তারা। তনয়া এগিয়ে এসে নাহিয়ানকে থামিয়ে বলে,,
——“ওকে ছাড়ো এ আর। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অনেক বড় অপরাধ;তুমি তো জানো?ছেড়ে দাও ওকে। ওকে ওর প্রাপ্ত সাজা এখন বাংলাদেশ আদালতই দিবে! ছাড়ো, ওকে।”

নাহিয়ান এর কাছ থেকে এই প্রথম ব্যর্থ হয় তনয়া। নাহিয়ানের চোখে মুখে অন্যরকম হিংস্রতা আজ। তবে এই মুহূর্তে তাকে থামানো প্রয়োজন না হলে এখানেই কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসবে সে। অবশেষে ইউনিটের সকল মেম্বার মিলে আটকালো তাকে। কিন্তু তখনো নাহিয়ানের চোখে আগ্নেয়গিরির রক্তিম লাভা স্পষ্ট। ফরিদ আহমেদকে অনেকটা আ*ধ*ম*রা অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হলো। যদি সুস্থ হয় তাহলে সেখান থেকেই তাকে তার যোগ্য স্থানে পাঠানো হবে, ফাঁসিই হবে তার শেষ পরিণতি!আর যদি মা*রা যায় তাহলে তো সেখানেই সব শেষ।

তিমির রাত্রি,আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়ির চারিধার। ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় তিনটা। বিছানার উপর উপুর হয়ে শুয়ে আছে রাকিব। পাশেই সাবিহা। সে মন ভরে রাকিবকে দেখছে। কেননা সে হয়তো জানতো এটাই তাদের শেষ দেখা হতে যাচ্ছে। ঠিক তখনই বিকট শব্দ করে দরজা ভেঙে বাড়িতে প্রবেশ করে সিআইডি ইউনিট।
তাদের গাড়ির সাইরেনের শব্দে ঘুম ছুটে যায় রাকিবের। বহুদিন পর আজ একটু ঘুমিয়ে ছিল সে। দলের প্রধান ইকরামুল হোসেনের চলে যাওয়ার ব্যাপারে সে আগে থেকেই অবগত ছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল আজ ইকরামুল হোসেন রাত তিনটার মধ্যে বাংলাদেশ বর্ডার পেরিয়ে যাবে। অতঃপর সপ্তাহখানেক বাদে দেশ থেকে নিজেদের সকল প্রমাণ লোপাট করে রাকিব আর দলীয় অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা বাংলাদেশ ছাড়বে।

তবে হুট করে সিআইডির এমন আক্রমণ হয়তো তাদের কল্পনাতীত ছিল। রাকিব সাবিহার হাত ধরে একটানে বিছানা থেকে নামিয়ে যেই না রুমের পিছন দরজা দিয়ে পালাতে যাবে। তক্ষুনি রুমের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে সিআইডির প্রায় ১০ জন সদস্য। রাকিব দ্রুত নিজের পিস্তলটা বের করে তাদের দিকে নিশানা করার আগেই বাতাসের বেগে একটা গুলি এসে তার ডান পা বিদ্ধ করে।
ব্যথায় কুঁকিয়ে যেই না সে পালাবার চেষ্টা করবে তার আগেই তাকে ধরে ফেলে বাংলাদেশ সিআইডির কিডন্যাপিং ইউনিটের প্রধান তেহরাব মাহিদ। অতঃপর সাবিহার দিকে ফিরে সে বলে,,

——“ব্রিলিয়ান্ট! ইউ আর রিয়েলি আ ব্রিলিয়ান্ট মেম্বার অফ আওয়ার ইউনিট, মিস সাম্মি শাহ!”
রাকিব নিজেকে ছড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়েও থেমে যায়। এইমাত্র কি বললেন এনি? মিস সাম্মি শাহ? এটাতো সাবিহা! তার স্ত্রী মিসেস সাবিহা শেখ! সে বিষ্ময় দৃষ্টিতে সাবিহার দিকে চেয়ে বলে,,
——“সাম্মি কে সাবিহা?”
পাশ থেকে একজন স্পেশাল অপারেটিভ বলে,,
——“উনি আমাদের স্পেশাল এজেন্ট মিস সাম্মি শাহ! যাকে এতদিন তুই সাবিহা আফরিন হিসেবে চিনতি!”
রাকিব যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারে না। তাহলে যে স্পেশাল এজেন্টের খোঁজে তাদের লোকজন সর্বদা তটস্ত ছিলো যে কোথায় কোন ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে সে? আর সেই কিনা রাকিবের মত একটা ধুরন্ধর লোকের ঘরে এত দিন ধরে…. কিন্তু রাকিব কখনো বুঝতে পর্যন্ত পারেনি? রাকিব সাবিহার দিকে ফিরে বলে,,

——“এগুলো কি সত্যি সাবিহা?”
পাশ থেকে একজন অফিসার তার উদরের সজোরে লাথি মেরে বলে,,
——“সত্যি কি মিথ্যা সেটা তো তোকে আমরাই বলবো।”
বুটের আঘাতে ব্যথায় পেটের নিচটা ছিঁ*ড়ে আসার মতো অবস্থা। তবুও রাকিব বারবার সাবিহার কাছে শুধাতে থাকে,,
——“বলোনা সাবিহা? সত্যিই কি তুমি সাম্মি? কি হলো কথা বলছো না কেন? বলো?”
হঠাৎই চোখ অশ্রু বাষ্পে ভরে উঠলো সাবিহা ওরুফে এজেন্ট সাম্মির! সে তো জানতো তাদের পরিণতি এটাই হবে তবুও কেন নিজেকে মানাতে পারছে না সে? কেন রাকিবের কথাগুলো বিষাক্ত তীরের মতো তার হৃদয়ে বিদ্ধছে? এদিকে রাকিবের এমন কথায় বিরক্ত হলো তেহরাব মাহিদ। সে সবাইকে অর্ডার দিলো রাকিবকে নিয়ে যেতে।
তার নির্দেশ মোতাবেক দলের অন্যান্য সদস্যরা রাকিবকে টেনে হিচরে বাইরে নিয়ে গেলো। তেহরাব সাবিহার দিকে ফিরে বলল,,

——“চলুন মিস সাম্মি!”
সাবিহা:“আম সরি টু সে স্যার বাট আম নট মিস,নাউ আম ম্যারিড। সো আমাকে মিসেস সাম্মি বললেই বেশি খুশি হবো।”
তার কথায় তেহরাব হেসে বলল,,
——“তুমি এখনো…বাই দ্যা ওয়ে হয়তো তুমি ভুলে যাচ্ছ ওটা নকল বিয়ে ছিল!”
সাবিহা:“বাঙ্গালি মেয়েদের বিয়ে একবারই হয় স্যার। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি তিন কবুলের মাধ্যমে তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছি। তাই এটা মিথ্যে বিয়ে নয় আর নয়তো ভুয়া।”
তেহরাব কিছু বলার আগেই সাবিহা ফের বলে,,
——“মাফ করবেন;আপনার মতো একটা সিনিয়র অফিসারের সাথে আমি এভাবে কথা বলছি। কিন্তু আমি এখন যেতে পারবো না, আমার শাশুড়ি আর ননদের খেয়াল আমাকেই রাখতে হবে। তাই আপনারা চলে যান আমি সময় হলে একবার গিয়ে এসিপি স্যারের সাথে দেখা করে আসবো।”
কথাটা বলেই সেখান থেকে দ্রুত চলে যায় সাবিহা। তেহরাব শুধু এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে সাবিহা ওরফে সাম্মির যাওয়ার পানে।

ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যা ছয়টার কিছু বেশি……
ড্রয়িং রুমে বসে ইমতিয়াজ চৌধুরীর সাথে সাংসারিক বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিল নওরিফা খানম।শীতটা এবার বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। হঠাৎই কলিংবেলের শব্দে তিনি তহুরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
——“তহু মা, গিয়ে একটু দেখতো এই অসময়ে কে আসলো?”
তহুরা কোন সাড়াশব্দ না দেওয়াই নওরিফা খানম বুঝলেন হয়তো সে আশে পাশে নেই। আর কোনো মেডকেও আপাতত আশেপাশে ‌দেখা যাচ্ছে না। উপায়ান্তু না পেয়ে নওরিফা খানম নিজেই গেলেন দরজার দিকে।
দরজা খুলতেই চক্ষু চড়ক গাছ তার! বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে নাহিয়ান, পরনে ব্লাক কালার বম্বার জ্যাকেট। দীর্ঘ পাঁচ মাস পর নিজের ছেলেকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন তিনি। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল আনন্দ অশ্রু ধারা। জাপ্টে ধরলেন নিজের নাড়িছেঁড়া ধন কে। নাহিয়ানও বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তার মাকে।
মা-ছেলের এমন সুন্দর মুহূর্তটা বিরাজমান হলো কয়েক মিনিট জুড়ে। অতঃপর রুমের ভেতর থেকে ইমতিয়াজ চৌধুরী নওরিফা খানমকে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে আসলেন,,

——“রিফা? কই তুমি? এত সময় কি করো,বাইরে দাঁড়িয়ে?”
বলতে বলতে বাইরে আসতেই তিনি দেখতে পান নিজের একমাত্র ছেলেকে। নাহিয়ান কে দেখে ইমতিয়াজ চৌধুরী হেসে বলেন,,
——“নাহিয়ান? বাবা তুই?”
নাহিয়ান কিছু বলার আগেই তার বক্ষদেশ থেকে মাথা তুলে নওরিফা খানম বলেন,,
——“ হ্যাঁ, আমার ছেলে আমার নাহিয়ান ফিরে এসেছে।”
নাহিয়ান নিজের মায়ের ললাটে চুমু দিয়ে বলে,,
——“হ্যাঁ মা, আমি এসেছি!”
ইমতিয়াজ চৌধুরী:“আসো আসো ভিতরে আসো। ঠান্ডা লেগে যাবে তো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে।”
নাহিয়ান তার বাবা মার সাথে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভিতরে ঢুকেই নাহিয়ান তার মায়ের দিকে ফিরে বলল,,
——“শিশির কোথায় মা?”
নওরিফা খানম আর ইমতিয়াজ চৌধুরী একে অপরের দিকে চেয়ে খানিক হাসেন। অতঃপর নাহিয়ানের দিকে ফিরে বলেন,,

——“দেখো, ছেলের অবস্থা দেখো, এতদিন পর বাড়ি আসলো কোথায় শুনবে আমাদের কি অবস্থা?তা না এসেই বউয়ের খবর নিচ্ছে।”
এদিকে বাবা মার কথার দিকে কোনো খেয়ালই নেই নাহিয়ানের। সে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে খুঁজছে শিশিরকে।
নাহিয়ান:“কি হলো মা বলছো না কেন? শিশির কই?”
নওরিফা খানম:“তোর বউ তার বাপের বাড়িতে!”
নাহিয়ান:“কি বলো? ও এখনো রোদেলা আন্টি আর সিকদার আঙ্কেলের কাছে?”
নওরিফা খানম হেসে বলেন,,
——“জ্বী”
নাহিয়ান আর কোনো কথা না বলে দ্রুত বাইরে যেতে গেলেই পিছন থেকে ইমতিয়াজ চৌধুরী আর নওরিফা খানম ডেকে বললেন,,
——“কই যাস?”
নাহিয়ান:“আমার বউয়ের কাছে!”
কথাটা বলেই বেরিয়ে যায় নাহিয়ান। নওরিফা খানম আর ইমতিয়াজ চৌধুরী একে অপরের দিকে ফিরে হাসেন। তারপর নওরিফা খানম বলেন,,
——“দেখেছো ছেলের অবস্থা? বাড়ি এসে পারল না; বউ বউ শুরু করে দিয়েছে!”
ইমতিয়াজ চৌধুরী:“দেখতে হবে না কার ছেলে?”
নওরিফা খানম:“হ্যাঁ দেখতেই তো পাচ্ছি তার নমুনা! যাইহোক রেডি হও।আর আমিন কে বলো গাড়ি বের করতে।”
ইমতিয়াজ চৌধুরী:“হঠাৎ গাড়ি কেন?”
নওরিফা খানম:“আমরাও যাচ্ছি শিশির কুঞ্জে।”

আজ এ যেন কোনো মায়ায় রাঙা নিশীথিনী! পৌষের শুভ্র আকাশখানা যেন তার সমস্ত দ্যুতি ঢেলে দিয়েছে পৃথিবীতে। জ্যোৎস্না তার স্নিগ্ধ পরশ দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে চারপাশ। গাছের পাতারা চিকচিক করছে, মনে হয় যেন অজস্র রূপালি তারা ঝরে পড়েছে তাদের ডালে ডালে। দূর থেকে ভেসে আসছে এক অচেনা সুর,হয়তো তা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, কিন্তু তাতেও কেমন এক বিষণ্ণ মধুরতা।
শীতের রাতগুলো যেন একটু বেশিই তাড়াতাড়ি নেমে আসে। এই যে ঘড়ির কাঁটায় সাতটা বাজতে না বাজতেই চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে রাতের আঁধার। দূর অন্তরীক্ষে দৃশ্যমান রুপালি থালার মত বৃহৎ চন্দ্র খানা। ছাদে দাঁড়িয়ে শিশির ভাব ছিলো, মাত্র দুইটা মাসে কিভাবে বদলে গেছে তার জীবনের গতিপথ।

সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। ভার্সিটিও বন্ধ, বন্ধুবান্ধবগুলোর সাথে সেভাবে আর দেখা হয় না। লিজার বিয়ে হয়েছে সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের সপ্তাহে। আনায়াও নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে সংসারে। বদলেছে শিশিরের জীবনের গতিপথ, এতদিন যাদের নিজের মা-বাবা হিসেবে জেনে আসলো তারা তার নিজের কেউ না,তবে শিশির কখনো এটা নিয়ে আফসোস করে না। বরং সে নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে করে যে,এমন দুইটা মানুষকে সে নিজের বাবা-মা হিসেবে পরিচয় দিতে পেরেছে।
রুপালি চাঁদটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সে। ইদানিং নাহিয়ানের শূন্যতা একটু বেশি অনুভব করছি সে। কেন যে সময়গুলো যাচ্ছে না? বিষন্ন হৃদয়ে আকাশের পানে চেয়ে হঠাৎই সে গেয়ে ওঠে,,

সাত সাগর আর তেরো নদী….
পার হয়ে তুমি আসতে যদি…
রূপকথার রাজকুমার হয়ে…
আমায় তুমি ভালবাসতে যদি….
শব্দগুলো যেন হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে বের হয়ে এসেছে।নাহিয়ানের শূন্যতা তীব্র থেকে তীব্র হতে শুরু করল শিশিরের চারিধারে।এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে সে কিন্তু ঠিক তখনই ঘটে এক কল্পনাতীত ঘটনা। পিছন থেকে নাহিয়ান গেয়ে ওঠে,,
ভালোবাসি তোমায়….
পুরানো অনুভবে…
এই মনের জগতে…
রাজকুমারী তুমি….
শিশির ঘুরে দেখে তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ব্লাক কালার বম্বার জ্যাকেট পরিহিত,তার কাল্পনিক পুরুষ,নাহিয়ান। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারে না সে। সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যেতে শুরু করে, তবে পরক্ষণেই মলিন হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের কোণে। নিজেকে বোঝাতে সে নিজেই বলে ওঠে,,

——“আবার হ্যালোসুনেশন হচ্ছে তোর শিশির! নিজেকে বুঝা, এটা তোর ভ্রম বৈ অন্য কিছু নয়। এখনো এক মাস নিজেকে সামলাতে হবে তো তোর! বোঝা শিশির। বোঝা নিজেকে!”
কথাটা বলেই ফের আরেকবার সে তাকায় সামনের দিকে। তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে নাহিয়ান। তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা স্পষ্ট। এবার শিশির বেশ অবাক হয়, সাধারণত তার হ্যালুসুনেশন এতক্ষণব্যাপী স্থায়ী হয় না। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই মিলিয়ে যায় তা। কিন্তু আজ কেন সেরকম কিছু হচ্ছে না? তবে কি এটা সত্যিই নাহিয়ান? খুশিতে মুখ চিক চিক করে ওঠে শিশিরের।সে নাহিয়ানের দিকে চেয়ে বলে,,
——“এটা কি সত্যিই আপনি?”
নাহিয়ান মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই শিশিরের পুরো পৃথিবী যেনো থমকে যায়। নাহিয়ান, যার চিন্তায় শিশির দিনরাত মগ্ন থাকত, যার জন্য সে অপেক্ষার প্রহর গুনত সর্বক্ষণ।সেই আজ তার সামনে!! শিশির আর কিছু ভাবতে পারেনা ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে নাহিয়ান কে। নাহিয়ানের বক্ষদেশের মাঝ বরাবর পড়ে শিশিরের লাবণ্যময়ী মুখশ্রী।

এতদিন পর প্রিয় পুরুষের শরীরের সুঘ্রাণ উপভোগ করে শিশির। নাহিয়ানও শক্ত করে জাপটে ধরে শিশিরকে। যেন ছেড়ে দিলেই তার প্রাণনাশিনী ছুটে পালাবে। অথচ তার প্রাণনাশিনীও শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ করে রেখেছে তাকে!
অতিবাহিত হয় মুহূর্ত খানেক। আস্তে আস্তে নাহিয়ান নিজের বক্ষদেশ থেকে তার প্রাণনাশিনীর মুখশ্রী তুলে দুহাতে আলতো করে ধরে। অন্যদিকে নাহিয়ানের বুকে মুখ গুঁজেই এতক্ষণ যাবৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল শিশির। নাহিয়ান সেটা টের পেলেও বাধা দেয়নি তাকে।
এবার নাহিয়ান আলতো হাতে শিশিরের দুই চোয়ালে দুহাত রাখে। এতক্ষণ যাবৎ কান্নার দরুণ চোখ মুখের রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে শিশিরের। তা দেখে নাহিয়ান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,,
——“এই পাগলি এখনো কান্না করবে? দেখো আমি চলে এসেছি! গড প্রমিস আর কখনো তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। সত্যি বলছি আমার জান, আর কেঁদো না প্লিজ। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,বুকের বাঁ পাশটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। এই পাগলী?এই? আর কেঁদো না প্লিজ!”
কান্নার তোপে কোনো কথাই বলতে পারে না শিশির। নাহিয়ান ‌টুকরো টুকরো চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে শিশিরের র*ক্ত লাল মুখশ্রী। কিছুক্ষণ পর কোনো আগাম বার্তা ছাড়াই নাহিয়ান নিজের ওষ্টদ্বয় দিয়ে তীব্রভাবে দখল করে শিশিরের নরম কোমল অধরদ্বয়।
কিছুক্ষণ পর…..

নাহিয়ান ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয় শিশিরের সদ্য ফোঁটা কমলের ন্যায় ওষ্টদ্বয়, যা এতক্ষণে রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার রূপ ধারণ করেছে‌।নাহিয়ান তার ওষ্টদ্বয় ছেড়েই কোনো কথা না বলে শিশিরকে করে তুলে নেয়। কিছুটা কেঁপে উঠে শিশির। তারপর নাহিয়ানের দিকে ফিরে দ্রুত বলে,,,
——“কি করছেন টা কি? নামান বলছি!”
নাহিয়ান:“নিজের বিয়ে করা বউকে কোলে নিচ্ছি। এর জন্য মনে হয় না আমি তোমার কাছে কোনোরকম কৈফিয়ত দিব!”
নাহিয়ান তাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেই,শিশির উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,,
——“আচ্ছা থাক আমাকে না হয় কৈফিয়ৎ দেওয়া লাগবে না।তবে এখন নামান প্লিজ। নিচে বাবা-মা সবাই আছে। তাদের সামনে….”
নাহিয়ান শিশিরের কথায় কোনো হেলদোল দেখায় না। একে একে সিঁড়ি ভেঙ্গে তাকে নিয়ে নামতে নামতে বলে,,
——“সো হোয়াট? আমি তোমাকে পুরো পৃথিবীর সামনেও কোলে নিতে পারি বিকজ ইউ আর ওয়ানলি মাইন!”
শিশির আর কিছু বলতে পারে না শুধু লজ্জায় মুখ লুকায় নাহিয়ানের প্রশস্ত বক্ষদেশে।
দুইতলায় নামতেই নাহিয়ানের দেখা হয় সিকদার শাহ, রোদেলা জামান, নওরিফা খানম আর ইমতিয়াজ চৌধুরীর সাথে। তাদের দুজনকে এমন অবস্থায় দেখে লজ্জায় পড়ে নাহিয়ান ব্যাতিত সকলে।সিকদার শাহ শুকনো কেশে অন্যদিকে ফিরে টেনে টেনে বলে,,

——“এখানেতো…আমরাও ছিলাম।”
নাহিয়ান:“আমায় কিছু বললেন আংকেল?যাই হোক বলেও লাভ নাই, বহুদিন পর আজ নিজের বউকে কাছে পেয়েছি।তাই আপাতত আশেপাশে কাউকেই চোখে পড়ছে না‌। তবে আপনাদের যদি সমস্যা হয় তাহলে চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেন! আমার কোনো আপত্তি নেই!”
নওরিফা খানম কটমট করে তাকান ছেলের দিকে।তা দেখে ইমতিয়াজ চৌধুরী বলে,,
——“এই না হলে আমার ছেলে?”
নওরিফা খানম:“হ্যাঁ হ্যাঁ আরেকটু আশকারা দাও!”
তার জবাবে ইমতিয়াজ চৌধুরী কিছু বলার আগেই নাহিয়ান বলল,,

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৪

——“বাবা,তোমাদের যা ঝগড়া করার নিচে গিয়ে করো।আর আমার পথ ছাড়ো দেখছো না বউটা কেমন লজ্জা পাচ্ছে?যাও যাও,দেখি পথ ছাড়ো।”
কথাটা বলেই নাহিয়ান শিশিরকে কোলে করে নিয়েই তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। উপস্থিত সবাই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে সেদিকে। নওরিফা খানম তো নিজেই চিন্তায় পড়ে যায়।এটা কি আসলেও তার ছেলে?এমন নির্লজ্জ ছেলেকে গর্ভে ধরেছিলেন তিনি?

মাঝরাতের রোদ্দুর পর্ব ৫৫ (২)