প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮০
আদ্রিতা নিশি
প্রায় তিনঘন্টা ধরে ফুল দিয়ে ইরফানের রুমটা চমৎকার ভাবে সাজিয়েছে আবির, সাদাত, ইশারা এবং অরিন। কাঁচা ফুলের গন্ধে ম-ম করছে চতুর্দিক। রুমের একপাশে চেয়ার টেনে গাম্ভীর্য ভাব এঁটে বসে আছে সারহান। সে ভ্রুযুগল গুটিয়ে সবার কান্ডকারখানা দেখছে। তার পাশে চোখ মুখ অন্ধকার এসে বসে আছে অরিত্রিকা। তার অভিমানী দৃষ্টি নিবদ্ধ পাশে বসা মানুষটার দিকে। সে সামান্য ইরফান ভাই আর রাহার বাসর সাজাতে চেয়েছিল, কতো আশা নিয়ে বলেছিল সেই কথা—ভেবেছিল বিনাবাক্যে অনুমতি পেয়ে যাবে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে অনুমতি না দিয়ে উল্টো রাগ দেখিয়ে বলেছে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিড়িংবিড়িং না করে চুপচাপ বসে থাকতে। এই নিয়ে মনে মনে একটু ক্ষিপ্ত!
“ইরফান কতো দূর সাদাত?”
সাদাত ডিভান থেকে উঠে এসে আবিরের পাশে দাঁড়াল। বলল;
“মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাড়িতে এসে পৌঁছাবে।”
আবির তাড়াহুড়ো করে বলল;
“সবাই রুম থেকে বের হও। ওরা লিভিং রুমে ঢুকতেই সাদাত তুমি ইরফানকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে তোমার রুমে নিয়ে যাবে। আমি আর তুমি মিলে পাঞ্জাবি পরিয়ে আনব। তার আগে অরিন, ইশরা, অরিত্রিকা রাহাকে সাজিয়ে গুজিয়ে আগেই রুমে নিয়ে এসে বাহির থেকে দরজা আঁটকে টাকা উসুল করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। মনে রেখো আজ লটারি পেলেও পেতে পারো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সবাই হন্তদন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। আবির বাহিরে যেতে গিয়েও থেমে গেল। নব আরেক দম্পত্তিকে বসে থাকতে দেখে রসিকতা করে বলল;
“দোস্ত!তোর জন্য বাসর সাজাইনি। বসে না থেকে চল।”
অরিত্রিকা লাফিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। লজ্জায় শশ্যব্যস্তের ন্যায় তাকাল। সারহান চ বর্গীয় শব্দ করে দাঁড়িয়ে গেল। অতঃপর অরিত্রিকার হাতটা ধরে বাহিরে যেতে যেতে বিরক্তিপ্রকাশ করে বলল;
“আমাকে না গুতালে তোর শান্তি হয় না তাই না!”
আবির পিছু ছুটে দাঁত কেলিয়ে বলল;
“একদম ঠিক ধরেছিস। তোকে না গুতালে আমার অশান্তি লাগে। কেমন যেন পেট গুরবগ করে।”
সারহান দাঁত পিষে বলল;
“ দাঁত কেলানো বন্ধ কর।”
দুই বন্ধুর এভাবেই কথার পিষ্ঠে কথা বলতে লাগল। লিভিং রুমে যেতেই দেখল ইরফান এবং রাহা এসেছে। প্ল্যান অনুযায়ী সাদাত এবং আবির ইরফানকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে এক প্রকার জোর সেখান থেকে নিয়ে গেল। রাহা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। এর মধ্যে অরিত্রিকা, ইশারা এবং অরিন রাহাকে ধরে ওপর তলায় নিয়ে গেল। বেচারা সারহান না পারল আবিরের সাথে, না পারল বউয়ের কাছে থাকতে। সে হতাশ হয়ে সোফায় বসে। কেমন যেন অদ্ভুত লাগে! তখুনি সারহানের পাশে এসে বসে লেভি। আদুরে ভঙ্গিতে শরীর ঘেষে ডেকে ওঠে। সারহান তড়িৎ বেগে তাকায়। ভ্রুযুগল কুঁচকে তির্যক চাহনিতে তাকায়। তার হঠাৎ মনে হয় বিড়ালটা তার সঙ্গ দিচ্ছে! সে একটু অবাক হয়। পরক্ষণে লেভির শরীরে হাত বলিয়ে হতাশামূলক ভাবে বলে;
“তোর মালকিন আমায় পাত্তা না দিয়ে ওদের সাথে চলে গেল। এতো অবুঝ হলে হয় বল?”
বিড়াল লেজ নাড়িয়ে ডেকে উঠল। সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“তোকেও পাত্তা দেয়নি,আমাকেও পাত্তা দেয়নি! তোর মালকিন আমাদের ভুলে যাচ্ছে। এর একটা বিহিত করা জরুরী।”
একঘন্টার মধ্যে রাহাকে সাজিয়ে ইরফানের রুমে বসিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা যখন জানতে পারলো সাজসজ্জা কেন করানো হচ্ছে তখন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে স্বাভাবিক হয়। লজ্জায়, অস্বস্তিতে নিশ্চুপ হয়ে যায়। রুমের বাহিরে অরিত্রিকা, অরিন এবং ইশরা দরজা আঁটকে বসে আছে। টাকা ছাড়া ঢুকতে দেবে না তারা। সারহান একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সবার উচ্ছসিত ভাব দেখছে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ইরফান উপস্থিত হলো। পিছু পিছু আবির মিটিমিটি হাসি নিয়ে এসে দাঁড়াল। অরিত্রিকা সারহানকে এদিকটায় ডাকল। কিন্তু মানুষটা না এসে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার রাগ হলো। ওষ্ঠ চেপে রাগ সংবরণ করল। হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি আসলো। সে হাসার ভাণ করে পাঞ্জাবি পরিহিত ইরফানের দিকে তাকাল। অতঃপর প্রশংসাসূচক বাক্য বলল;
“ইরফান ভাই আপনাকে হ্যান্ডসাম লাগছে। একদম হলিউডের হিরোদের মতো লাগছে।”
আচানক প্রশংসা শুনে খুকখুক করে কেশে উঠল। সে আড়চোখে তাকাল সারহানের দিকে। বন্ধুসম ভাইয়ের চোখ- মুখের অবস্থা দেখে খারাপ লাগল। আহারে! পুনরায় দৃষ্টি স্থির করে ওষ্ঠ ভিজিয়ে বলল;
“ধন্যবাদ।”
অরিত্রিকা সারহানের ভাবমূর্তি দেখে ওষ্ঠ এলিয়ে হাসল। আহ! জব্দ করে কেমন শান্তি লাগছে। সারহান চোখ মুখ শক্ত করে এগিয়ে আসে। কিন্তু অরিত্রিকা উপেক্ষা করে বলল;
“এবার ফটাফট পঞ্চাশ হাজার টাকা দিন নয়তো রুমে যেতে পারবেন না।”
সারহান বাদে উপস্থিত সবাই উৎফুল্লচিত্তে বলে উঠল;
“টাকা না দিলে রুমে যেতে দেওয়া হবে না। দ্রুত টাকা দিন, বউ নিন। ”
ইরফান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। এতোগুলো টাকা তো তার মানিব্যাগে নেই। সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল;
“এতো টাকা?”
আবির হাসল;
“বউ পেতে চাইলে টাকাটা দিয়ে দাও ইরফান। যদি টাকা না দাও বউয়ের আশা ভুলে যাও।”
“কিন্তু এতো টাকা?”
“হ্যা ছয়টা ভাগ হবে তো।”
“ছয়টা?”
“সারহান তোমার বাসর সাজানোর সময় বসে ছিলো। বেচারাকে যদি টাকার ভাগ না দেই তাহলে কেমন একটা দেখায় না। যতোই হোক, বন্ধু তো! একা একা টাকার ভাগ নিতে কেমন যেন লাগে।”
আবির দাঁত কেলিয়ে বলল। ইরফান শব্দ করে হেসে উঠল। সবাই জোরাজুরি শুরু করল আবারও। ইরফান উপায়ন্তর না পেয়ে ফোন বের করে ব্যাংক একাউন্ট থেকে সারহানের ব্যাংক একাউন্টে পঞ্চাশ হাজার টাকা সেন্ড করে দিয়ে বলল;
“সারহানের ব্যাংক একাউন্টে টাকা টান্সফার করে দিয়েছি। ”
সবাই লাফিয়ে উঠল। গদগদ দরজা খুলে সড়ে দাঁড়াল। অতঃপর উচ্চস্বরে বলে উঠল;
“থ্যাংকস।”
ইরফান এগিয়ে গেল রুমের দিকে। মৃদু হেসে বলল;
“তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য।”
তখুনি আবির গলা বাড়িয়ে বলল;
“স্পেশাল ভাবে আমাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত তোমার। কারণ আমি , আমার আর সারহানের মতো বিবাহিত সিঙ্গেল দেখতে না পেরে প্ল্যানটা করেছি।”
ইরফান সারহানের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো। সারহানের চোখ মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। ব্যাটা তাকে নিয়ে মজা নিচ্ছে! দুইদিন হয়নি বিয়ে হয়েছে অথচ ভোল পাল্টাতে সময় লাগেনি। পল্টিবাজ! ইরফান তাকায়। আবিরকে উদ্দেশ্য করে বলল;
“ধন্যবাদ আবির! ”
আবির গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল;
“সবাই চলো। আমাদের ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে।”
কথাটা বলে একপ্রকার সবাইকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। সারহান এগিয়ে এসে ইরফানের সামনে দাঁড়াল। শান্ত কন্ঠে শুভকামনা জানালো ;
“May the first night of your married life be filled with love and harmony. Best wishes to you.”
ইরফান শান্ত কন্ঠে বলল ;
“Thanks Bro.”
সারহান ইরফানের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে প্রস্থান করে। ইরফান সেদিকে তাকিয়ে দরজা বন্ধ করে। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এ মুহুর্ত থেকে তার জীবনে রাহা ব্যতিত অন্য কেউ থাকবে না । আগে যা ঘটেছে বা মনে ছিল তা এখন থেকে মূল্যহীন। তার হৃদয়ে অর্ধাঙ্গিনী ছাড়া আর কেউ থাকবে না। রাহাকে নিয়ে নতুন করে পথ চলবে। সারাজীবন একসাথে থাকবে। একে ওপরকে ভালোবাসবে, পাশাপাশি থেকে জীবনের সম্পূর্ণ পথ পাড়ি দিবে।
রাত পেরোতেই চৌধুরী বাড়িতে হৈ হুল্লোড়ে মেতে আছে। আজ রাহার বাবা-মা এবং চাচা, চাচী আসবেন। সবাই মেনে নিয়েছে ওদের। তারা এসে বাড়ির জামাই এবং মেয়েকে নিয়ে যাবেন তারপর এ বাড়ি থেকে দুইদিন পর সবাই গিয়ে নিয়ে আসবে। সকাল থেকে অরিত্রিকা, ইশরা রাহাকে জ্বালাচ্ছে। ওদিকে ইরফানকে আবির খোঁচাচ্ছে। নব দম্পতি পড়ছে বিপদে। দুজনে কুলুপ এঁটে বসে আছে। সারহান সেসব হৈ হুল্লোড়ে নিজেকে না জড়িয়ে ইলহামের সাথে দেখা করতে ওর বাড়িতে গিয়েছে। তার সাথে আছে ইনান।
“আমাকে ক্ষমা করে দিস সারহান! আমি তোকে তাজিয়ার মৃ*ত্যুর জন্য দোষী ভেবেছি, খারাপ ব্যবহার করেছি।”
ইলহামের চোখের কার্ণিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তার চক্ষুদ্বয় র*ক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। সারহানের দেওয়া প্রমাণ, নিশাদ এবং তার বাবার অপকর্ম, তাজিয়া হ*ত্যাসহ আরও অনেক প্রমাণাদি দেখে ভেঙে পড়েছিল। মানতে পারেনি এতো বড়ো সত্য। আপন মানুষ, নিজের র*ক্ত যখন বেইমানী করে তখন মানুষ ভেতর থেকে শেষ হয়ে যায়। এই তো সে ভেঙে পড়েছে আদরের ছোট বোনের মৃ*ত্যুতে। ইলহামের মা মুখে কাপড় গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদছে। মিহি উনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। সারহান এতোক্ষণ চুপচাপ সোফায় বসে ছিল। সে ভারী পরিবেশ দেখে রুদ্ধ শ্বাস ফেলে। সাবলীলভাবে বলল ;
“যা হওয়ার হয়ে গেছে। তুই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস এটাই অনেক। আন্টিকে শান্ত কর আমি আসছি।”
কথাটা শেষ করে সারহান উঠে দাঁড়াল। ইলহাম ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলল;
“তোকে আমি শত্রু হিসেবে দেখলেও তুই আমাদের বন্ধুত্ব ভুলিসনি। কতোটা অকৃতজ্ঞ আমি, বন্ধুত্বের মূল্য দিতে পারিনি। প্রতিশোধ পরান হয়ে অরিত্রিকার দিকে নজর দিয়েছিলাম। এসব ভেবে অনুশোচনা হচ্ছে। অনুতপ্ত আমি।”
সারহান শীতল চাহনিতে তাকাল। সংযত কন্ঠে বলল ;
“এখন থেকে বন্ধুত্বের মূল্য দিতে শেখ। পুরনো সব ভুলে যা।”
ইলহাম আবেগাপ্লুত হয়ে গেল। সে উঠে সারহানকে জড়িয়ে ধরে ভেজা কন্ঠে বলল;
“স্যরি দোস্ত!”
সারহান পিঠ চাপড়ে দিয়ে নিঃশব্দে হাসল;
“ইটস্ ওকে।”
মনোমুগ্ধকর দৃশ্যর সাক্ষী হলো উপস্থিত সবাই। ইনান হাসল! তিনবছর পরে আবারও দুই বন্ধু মিলে গেল। সারহান স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে বলল;
“আজ আসি।পরে কথা হবে।”
ইলহাম মলিন হেসে বলল;
“আবার আসিস।”
সারহান ইলহামের মায়ের কাছে গিয়ে বিদায় নিয়ে পা বাড়াল বাড়ির উদ্দেশ্যে। মিহির মন খারাপ হলো এমপি তার সাথে কথা বলেনি তাই। সে বিরস মুখে তাকিয়ে থাকল চলে চলে যাওয়ার দিকে।
দুপুর দুইটা পেরিয়ে গেছে। সারহান বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেও না গিয়ে থানায় গিয়েছিল। তার ফুপুর সাথে দেখে করে এসেছে। ইসমা বেগম তাকে দেখে অনেক কান্নাকাটি করেন। জেল থেকে বের করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু সে ছিলো অনুভূতিশূন্য, নিরুদ্বেগ! শুধু একবার জেলে থাকা দুই অপরাধীর করুণ অবস্থা নিজের চোখে দেখতে গিয়েছিল। বাড়িতে ফিরতেই ইরফানের শ্বশুরবাড়ির সাথে দেখা হলো তার। সবার সাথে পরিচিত হয় এবং একসাথে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে। তারপর তারা রাহা এবং ইরফানকে নিজেদের সাথে দুইদিনের জন্য নিয়ে যান।
সারহান রুমে এসে পাঞ্জাবিটা খুলে টাউজার, টি- শার্ট পড়ে বিছানায় বসে ল্যাপটপ নিয়ে বসল। ইনান তার এলাকার কিছু এতিমখানার লিস্ট পাঠিয়েছে সেখানে টাকা ডোনেট করবে সে। সেই লিস্ট গুলো দেখছে। কিয়ৎ সময়ের মাঝে তার মনোযোগ বিঘ্নিত হলো নুপুরের ঝংকারে! ঝুনঝুন শব্দ নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রতিধ্বনিত হলো চতুর্দিক। পুরুষালি সত্তা থমকাল। সে বুঝতে পারলো অরিত্রিকা এসেছে। তবুও দৃষ্টি ল্যাপটপে স্থির করে গাম্ভীর্যতা এঁটে অনড় হয়ে বসে রইল। অরিত্রিকা দরজার বাহিরে আশাহত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ মুখে বিষন্নতা ভর করল। মানুষটা গতকাল রাত থেকে উপেক্ষা করছে। সে চপল পায়ে রুমে প্রবেশ করল। সরাসরি গিয়ে দাঁড়াল মানুষটার পাশে। মনে চলমান ভাবনা উগ্রে দিয়ে বিরস কন্ঠে বলল;
“আপনি আমাকে গতকাল রাত থেকে ইগনোর কেন করছেন সারহান ভা…”
“স্টপ।”
অরিত্রিকা থেমে গেল। সারহান এবার শীতল চাহনিতে তাকাল মেয়েলী মুখশ্রীতে। দম্ভক কন্ঠে বলল;
“তোর বিয়ে করা হাসবেন্ড হই বারবার ভাই ডেকে মেজাজ বিগড়ে দিস না।”
অরিত্রিকা থতমত খেয়ে গেল;
“তাহলে কি বলব?”
সারহানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“নাম ধরে ডাক বা অন্য কিছু বলে ডাক। তবুও ভাই বলে ডাকিস না। তোর মুখে ভাই ডাক শুনলে ডিজগাস্টিং ফিলিংস হয়।”
“তাহলে.. হ্যা গো, ওগো বলে ডাকবো নাকি নেতাসাহেব বলে ডাকবো?”
“হ্যা গো, ওগো এসব কি? নেতাসাহেব পারফেক্ট এটা বলে ডাকবি।”
“আচ্ছা সা.. নেতাসাহেব! এবার বলুন ইগনোর কেন করছেন?”
অরিত্রিকা গাল ফুলিয়ে বলল। সারহান পুনরায় ল্যাপটপে নজর রাখল। কোনো কথা বলল না আর। অরিত্রিকা এহেন আচরণে অবাক হলো। তার চোখ জ্বলে উঠল। কিছুক্ষণ মৌন থেকে ভেজা কন্ঠে বলল;
“ইরফান ভাইকে হ্যান্ডসাম বলেছিলাম তাই আপনি জেলাস হয়েছেন?”
সারহান বিমূঢ় চাহনিতে তাকাল। অরিত্রিকা পূর্বের ন্যায় বলল;
“আপনি উনার থেকেও হ্যান্ডসাম। হলিউডের হিরোরাও আপনার কাছে ফেল। এবার আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলুন। আমায় পাত্তা দিন।”
সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“তোকে কে বলেছে আমি জেলাস? ”
অরিত্রিকা মুখ ভার করে বলল;
“আমি বুঝেছি।”
“একটু বেশীই বুঝেছিস। এবার বের হো রুম থেকে। আমি ব্যস্ত আছি।”
“আপনি এমন কেন?”
“আমি এমনই। রুমে গিয়ে রেস্ট কর।”
“আপনি আসলেই একটা পাষাণ হৃদয়ের পুরুষ! আমায় একটুও ভালোবাসেন না। শুধু রাগ দেখান। থাকুন আপনি আপনার কাজ নিয়ে।”
অরিত্রিকা ওষ্ঠ ফুলিয়ে নাক টেনে অভিমানী কন্ঠে অভিযোগ করল। সে রাগে, ক্ষোভে প্রস্থান করার জন্য পা বাড়াল। তখুনি ওড়নায় টান পড়তেই সে থেমে গেল। বিস্ময় ভাব নিয়ে তাকাল পেছনে — দেখল সারহান তার ওড়না ধরে আছে। সে কিছু বলবে তার আগেই মানুষটা আস্তেধীরে এগিয়ে আসলো।
“আমি তোকে ভালোবাসিনা — এতো বড় অভিযোগটা করতে পারলি ফাইরুজ।”
পুরুষালি কন্ঠস্বর অতি শীতল। অরিত্রিকা আবিষ্ট চাহনিতে চেয়ে রইল। সারহান দুরত্ব ঘোচালো। হাত দ্বারা মেয়েলী শরীরটা বেষ্টিত করে এগিয়ে নিয়ে আসলো তার অতি সন্নিকটে। ওড়নার কোণাটা ছেড়ে হাত রাখল মেয়েলী নরম গালে। অমসৃণ হাতের আলতো স্পর্শে অরিত্রিকার শরীর কাঁপল। চোখ মুখ খিঁচে নিল। তিরতির করে কাঁপল নেত্রপল্লব, গোলাপী ওষ্ঠপল্লব। সারহান ওষ্ঠ কামড়ে নিঃশব্দে হাসল। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখন কম্পনরত ওষ্ঠপল্লবে। সেই কম্পন বিমোহন ধরিয়ে দিলো। হঠাৎ তার ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিলো মেয়েলী ওষ্ঠের কোণে। অরিত্রিকা খামচে ধরল সারহানের টি- শার্ট। তখুনি পুরুষালি কন্ঠস্বর ফিসফিসিয়ে বলে গেল;
“রিসেপশনটা হতে দে তারপর তোর আক্ষেপ করার সুযোগটুকু দেব না।”
অরিত্রিকা চমকে গেল। লজ্জায় হাসফাস করে উঠল। সে তো এমনিই বলেছিল কথাটা। মানুষটা এমন সিরিয়াস ভাবে নেবে কে জানতো? সারহান পুনরায় নিচু স্বরে বলল;
“বিকেল পাঁচটায় রেডি থাকবি।”
অরিত্রিকা কুন্ঠা ঠেলে বলল;
“কোথায় নিয়ে যাবেন?”
সারহান জবাব দিলো;
“তোর পছন্দের জায়গায়।”
গোধূলি লগ্ন পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। নদীর আশেপাশের পরিবেশটা নিবিড় এবং শীতল। ঠান্ডা হাওয়ায় আবহাওয়াটা চমৎকার! সারহান এবং অরিত্রিকা কিছুক্ষণ পূর্বে পদ্মা গার্ডেনে এসেছে। নদীর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে এসে মাত্র নোঙরে ঢুকে বসে খাবার অর্ডার দিলো।
“আপনি এখনো মুখে মাস্ক পড়ে থাকবেন।”
অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় সংকুচিত করে প্রশ্ন করল। সারহান স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলল ;
“হুম। মাস্ক খুললে মানুষ আমায় চিনতে পারবে।”
অরিত্রিকা কৌতূহলী ভাব নিয়ে বলল;
“ চিনলে কী হবে?”
সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“আমাদের আর এখানে থাকা হবে না। সবাই তোর মতো কৌতূহলী হয়ে আমাদের দেখতে আসবে।”
“তাহলে চলুন অন্য কোথাও যাই।”
“যাওয়ার দরকার নেই।”
“মাস্ক পড়ে খাবেন কিভাবে?”
“সেটা তোকে ভাবতে হবে না।”
কথাটা বলে সারহান ফোনটা বের করে স্ক্রোল করতে লাগল। অরিত্রিকা ঠোঁট বাঁকিয়ে হালকা বিরক্তির সুরে ভাবল—হুহ্! আমাকে নাকি ভাব দেখাচ্ছে! সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল রেস্টুরেন্টের কোলাহল কেমন যেন মিলিয়ে গেছে। ভিড়ের বদলে এখন কেবল দু-এক টেবিলে তিন-চারজন বসে আছে। এতো তাড়াতাড়ি সবাই কোথায় মিলিয়ে গেল?হঠাৎই তার দৃষ্টি গিয়ে থামল পাশের কোণের এক টেবিলে বসা অপরিচিত নারীর দিকে। বয়সে হয়তো তিন-চার বছরের বড়। অপূর্ব সুন্দরী। কিন্তু সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি অরিত্রিকার মন কাড়ল তার কোলে বসে থাকা ছোট্ট শিশু। বয়স হবে মাত্র এক বছরের মতো। গোলগাল গাল, কচি হাত-পা নাড়িয়ে মায়ের সাথে খুনসুটি করছে, টুকটুক করে হাসছে। দৃশ্যটা এতটাই স্নিগ্ধ যে অরিত্রিকার বুকের ভেতর হঠাৎ উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল।তার ইচ্ছে হলো এই বাচ্চাটাকে একবার কোলে নিয়ে আদর করে দিতে। তার অজান্তেই ওষ্ঠকোণে ফুটে উঠল কোমল হাসি। মৃদু স্বরে উচ্চারণ করল—
মাশাল্লাহ। মনের গভীরে খেলে গেল মধুর স্বপ্ন!তার আর নেতাসাহেবের কোনো একদিন এমনই এক ফুটফুটে বাচ্চা হবে। ছোট ছোট হাত ধরতে পারবে, আদরে ভরিয়ে দিতে পারবে এমন
ভাবনার স্রোতে হারিয়ে গেল অরিত্রিকা। খানিকটা লজ্জাও পেল। সারহান অরিত্রিকাকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল;
“কি দেখছিস।”
অরিত্রিকা দৃষ্টি ফিরিয়ে উৎফুল্লচিত্তে বলে উঠল;
“ওই দেখুন বাচ্চাটা কতো সুন্দর।”
সারহান অরিত্রিকার কথা শুনে তাকাল। দেখল বাচ্চাটি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“হুম।”
“বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু… ”
“থাক, মন খারাপ করতে হবে না। তোর বাচ্চা হলে তারপর আদর করতে হবে।”
“তাহলে তো অনেক দেরী।”
“হুম।”
সারহান ছোট্ট করে বলল। এসময়ে ওয়েটার খাবার নিয়ে এসে টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল। সারহান বলল;
“আমি একটু আসছি তুই এখানে বসে থাক।”
অরিত্রিকা মাথা দুলিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো বলল;
“আচ্ছা।”
সারহান উঠে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। অরিত্রিকা পাকনামী করে উঠে পাশের টেবিলের দিকে গেল। যদি একটু ভাব জমিয়ে বাচ্চাকে আদর করা করা যায়।
মীরাত সারিবের সাথে খুনসুটি করছিল। বাচ্চাটা মায়ের সাথে তাল মিলাচ্ছিল আর হাসছিল। সে অপেক্ষা করছিল আহিয়াদের জন্য। মানুষটা কখন বাহিরে গেছে এখনো আসার কোনো নাম নেই। হঠাৎ মেয়েলী কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে সে ভড়কে গেল। তৎক্ষনাৎ সামনে দৃষ্টি স্থির করল।
“হাই আপু। ”
মীরাত আঠারো – উনিশ বছর বয়সী অচেনা মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে তাকালো। সে নিবিড় চাহনিতে পরখ করল। মেয়েটা দেখতে ফর্সা এবং যথেষ্ট সুন্দরী। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে ভালো পরিবারের মেয়ে। সে একটু কৌতূহলী হলো। পরে তা দমিয়ে সৌজন্যতা রক্ষার্থে বলল;
“হাই।”
অরিত্রিকা একটু স্বস্তি পেল। সে তাড়াহুড়ল করে চেয়ার টেনে বসলো। সহালকা হেসে বলল;
“আমি অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরী।”
মীরাত বাচ্চা মেয়েটার ভাবসাব দেখে হাসল;
“ওয়াও নাইস নেইম।আমি মীরাতুল আযহা।”
অরিত্রিকা সারিবকে উদ্দেশ্য করে আদুরে কন্ঠে বলল;
“আপু আপনার পুচকুর নাম কি?”
মীরাত এবার বুঝল অরিত্রিকা কেন এসেছে। সে সারিবের কপালে চুমু দিল। অতঃপর হাসি বজায় রেখে বলল;
“আমার পুচকুর নাম সারিব আয়াশ।”
অরিত্রিকা একগাল হেসে বলল;
“কত্তো কিউট নাম। আপু কিছু মনে করলে একটা কথা বলি?”
“হুম বলো।”
“আমি পুচকুকে একটু কোলে নেই। আমি কিন্তু ছেলেধরা নই আগেই বললাম।”
মীরাত শব্দ করে হাসল। অরিত্রিকা বোকাসোকা চাহনিতে তাকাল। এখানে হাসার কি আছে? সে তো সত্যি কথা বলেছে। মীরাত বিনা দ্বিধায় সারিবকে অরিত্রিকার কোলে দিয়ে বলল;
“আমি আগেই বুঝতে পেরেছি তুমি সারিবকে দেখে এসেছো।”
অরিত্রিকা সারিবকে ভালোভাবে কোলে আগলে নিলো। সে এহেন কথায় লজ্জা পেল।কিন্তু বুঝতে দিলো না। বাচ্চাটার কপালে চুমু দিয়ে শুধু বলল;
“ পুচকু দেখতে মাশাল্লাহ। এখানে আসার পরেই ওকে দেখেছি। তখন থেকেই কোলে নেওয়ার জন্য মন আকুপাকু করছিল।”
“বুঝেছি। তোমার বাসা কোথায়?”
“রাজশাহী শহরে। আপনার বাসা কোথায় আপু?”
“ঢাকায়। ”
“ওহহ। ঘুরতে এসেছেন?”
অরিত্রিকার মনোযোগ ছোট্ট সারিবের দিকে। কেমন গোলগোল চোখ করে তার দিয়ে তাকিয়ে আছে। আবার মাঝে মাঝে হাসছে। তবুও প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। মীরাত বলল;
“হুমম ঘুরতে এসেছি। আহিয়াদের ভার্সিটিতে ছুটি চলছে তাই ভাবলাম রাজশাহী এসে ঘুরে যাই।”
অরিত্রিকা বলল;
“আহিয়াদ কে?”
“আমার হাসবেন্ড আর সারিবের বাবা।”
“উনি কি স্টুডেন্ট? না মানে ছুটির কথা বললেন? ”
“উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার।”
“ওহহ আচ্ছা। ”
অরিত্রিকা জিভ কেটে বলল। মীরাত হাসল শুধু। তারপর দুজনের সম্পর্কে আরও কথোপকথন করতে শুরু করল।এর মাঝে উপস্থিত হলো আহিয়াদ। সারিবের জন্য কিনে আনা ফলগুলো টেবিলটায় রাখল। এসব কিনতে গিয়ে দেরী হয়ে গেছে তার। মীরাত শুধালো ;
“দেরী হলো কেনো? কতোবার কল করলাম অথচ ধরলেন না। আপনার জন্য টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।”
আহিয়াদ উদ্বিগ্ন মেয়েলী মুখপানে চাইল। মোলায়েম কন্ঠে বলল;
“এখানে ফল না পেয়ে বাজারে গিয়েছিলাম। তাই আসতে লেট হয়েছে। সরি! টেনশনে ফেলে দেওয়ার জন্য।”
“ইটস্ ওকে।”
“খাবার অর্ডার করোনি?”
কথাটি বলার সময় হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকালো অরিত্রিকার দিকে। অচেনা একটা মেয়ের কোলে সারিবকে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো। মীরাত সেই চাহনি দেখে বলল;
“ওর নাম অরিত্রিকা। এখানকার স্থানীয় আর আমার অল্প পরিচিত।”
আহিয়াদ দৃষ্টি সরিয়ে মীরাতের দিকে তাকাল। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। অরিত্রিকা ভদ্রতাসূচক বলল;
“ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”
আহিয়াদের গম্ভীর মুখ খানিকটা শিথিল হলো। স্বাভাবিকতা বজায় রেখে উত্তর দিলো ;
“ ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
অরিত্রিকা তড়িঘড়ি করে সারিবকে মীরাতের কোলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। অতঃপর বলল;
“আপু ভালো থাকবেন। পুচকুকে দেখে রাখবেন।”
বলেই চলে যেতে নিলেই মীরাত ডেকে উঠল ;
“অরিত্রিকা শোনো।”
অরিত্রিকা যেতে গিয়েও ফিরে এলো ;
“জি আপু।”
“তোমার নাম্বারটা দাও।”
“আমার নাম্বার কি করবেন আপু?”
“আবার যদি কখনো রাজশাহী আসি তখন সারিবের সাথে দেখা করার জন্য ডাকব।”
“আপু আমাদের পরিচয় মাত্র হলো এখনি? ”
অরিত্রিকা হতভম্ব হলো। মীরাত হাসল ;
“তোমার মতো মিষ্টি মেয়ে কম দেখেছি। যতটুকু কথা বলেছি তাতে তোমার সম্পর্কে ধারণা হয়ে গেছে। এবার নাম্বার দাও মেয়ে। ”
অরিত্রিকা অস্বস্তি কাটিয়ে নাম্বার দিলো। তারপর তার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলল সময় পেলে ঘুরে যেতে। আহিয়াদের ভাবমূর্তি পরিবর্তন হলো। সে বুঝতে পারল অরিত্রিকা ভালো মেয়ে এবং ভদ্র সভ্য।
“সারিব বাবু! সময় পেলে আমাদের বাসায় আসবে কিন্তু।”
কথাটি বলে অরিত্রিকা সারিবের গালে চু*মু খেল। বাচ্চাটি হেসে উঠল। মীরাত বলল;
“তোমায় বোধ হয় সারিবের পছন্দ হয়েছে।”
অরিত্রিকা বলল;
“ আমারও তাই মনে হচ্ছে।”
“ফাইরুজ!”
গুরুগম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকা কথা থামিয়ে দিয়ে পাশে তাকাল দেখল সারহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে এক ধরনের স্থিরতা। এই রে! এতোক্ষণ তো ভুলে বসেছিল মানুষটার কথা। দুই জোড়া কৌতূহলী দৃষ্টি নিবদ্ধ অচেনা পুরুষটির দিকে। সারহান মাস্কটা খুলে তখন এসে দাঁড়িয়েছে। অরিত্রিকা কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে ক্ষীণ কন্ঠে বলল;
“উনি আমার হাসবেন্ড।”
মীরাত চমকে উঠল। এতটুকু মেয়ের বিয়ে হয়েছে? সে বিস্মিত কন্ঠে বলল;
“কী তোমার হাসবেন্ড? এতটুকু বয়সে বিয়ে করে ফেলেছো? ”
সারহানের ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল এমন কথা শুনে। অরিত্রিকা অপ্রস্তুত হলো। আহিয়াদ মীরাতকে উদ্দেশ্য করে শান্ত কন্ঠে বলল;
“বিয়ে হতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নেই।”
“এইটুকু মেয়ে…”
“বাদ দাও।”
আহিয়াদ উঠে দাঁড়াল। সারহানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল;
“I am Ahiad Simanto, a lecturer at the University of Dhaka.”
সারহান অপরিচিতদের সঙ্গে পরিচিত হয় না। তবে আজ হলো। সে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে গম্ভীর কন্ঠে বলল;
“I am Sarhan Idayat Chowdhury, the Honorable Member of Parliament for Rajshahi-1 constituency.”
মীরাত সারিবকে কোলে নিয়ে চমকে উঠে দাঁড়াল। সে একবার সারহান, আরেকবার অরিত্রিকার দিকে গোলগোল করে তাকাল। এই পুঁচকে মেয়ে এমপির বউ! তার মাথা ঘুরে গেল। অরিত্রিকা সেই চাহনি দেখে ইতস্তত বোধ করল। আহিয়াদ হ্যান্ডশেক করে বলল;
“এই জন্য আপনাকে চেনা চেনা লাগছিলো। নির্বাচনের আগে,পরে এবং একমাস আগে নিউজ চ্যানেলে আপনাকে নিয়ে নিউজ দেখেছিলাম।”
সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“হুম।”
“আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালোলাগলো। ঢাকাতে আসলে অবশ্যই আমাদের বাসায় আসবেন।”
“হোয়াই নট। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে আমারও ভালো লাগলো।
এরপরে দুজন আরও কিছু আলাপচারিতা করল। সারহান মীরাত এবং আহিয়াদকে অফার করল তাদের সঙ্গে খাওয়ার জন্য। প্রথমে রাজি হয়নি পরবর্তীতে অরিত্রিকার জোরাজুরিতে রাজি হয়। দুই কাপল এক টেবিলে খাওয়ার জন্য বসে পড়ে। সারহান এবং আহিয়াদ রাজনীতি – ভার্সিটি নিয়ে গল্প করছে আর খাচ্ছে। মীরাতও অল্প করে খাচ্ছে। কিন্তু অরিত্রিকা একবার খাচ্ছে আরেকবার সারিবের সাথে খেলছে। মীরাত অনেকক্ষণ আগে খেয়াল করেছে অরিত্রিকার মুখের ক্ষ*তগুলো। সে কৌতূহল মেটাতে শুধালো ;
“তোমার মুখে কি হয়েছে অরিত্রিকা? ”
অরিত্রিকার হাস্যজ্জ্বল মুখে নিভে এলো। কিছুক্ষণ মৌন থেকে নিভু কন্ঠে বলল;
“কিড*ন্যাপ হয়েছিলাম আপু।”
পরে ছোট্ট করে কিড*ন্যাপের কাহিনী, সারহানের শত্রুতা সম্পর্কে বলল। কিন্তু আগের তিক্ত অতীত লুকিয়ে গেল। মীরাত স্তব্ধ হয়ে গেল। সে তপ্ত শ্বাস ফেলল। তার মনে পড়ল পুরনো ঘটনা। একটা মানুষ তাকে কতোটা যত্ন করে ঠকিয়েছিল। বাধ্য করেছিল আ*ত্নহত্যার পথ বেছে নিতে। সেদিন আহিয়াদ না আসলে সে বেঁচে থাকতো না। মেয়েদের জীবন আসলেই কোনো নিরাপত্তা নেই। বিরস কন্ঠে বলল;
“ওসব মনে রেখো না। ট্রমাটাইজড হয়ে যাবে। ”
অরিত্রিকা চমৎকার হাসল;
“ওসব মনে রাখতেও চাই না।”
“আপু তোমার বাড়িতে কে কে আছে?”
“আমার শ্বশুর – শাশুড়ী আর আমার ননদ ফাবিহা। তোমার মতোই সুন্দর। ও ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট। এবার বলো তোমার বাড়িতে কে কে আছে?”
“মা – বাবা, বড় মা – বড় বাবা, বড় বাবার ছোট ছেলে, ফুপাতো ভাই – বোন, ফুপাতো ভাইয়ের বউ মানে আমার ভাবী।”
“শ্বশুর বাড়িতে থাকোনা?”
“আসলে উনি আমার বড় বাবার ছেলে। আমি সম্পর্কে উনার চাচাতো বোন ছিলাম।”
অরিত্রিকা মিষ্টি হেসে বলল। মীরাত হেসে বলল;
“বাহ! বাড়ির মেয়ে বাড়ির বউ হয়ে গেছে।”
অরিত্রিকা লাজুক কন্ঠে বলল;
“হুম।”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৯ (২)
সারহান কথা বলার মাঝে তাকাল ওপর পাশে বসা অরিত্রিকার দিকে। মেয়েটা খাওয়া বাদ দিয়ে বাচ্চাটাকে আদর করতে ব্যস্ত! সে শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে ভাবে ; মেয়েটার যে বাচ্চা ভালোলাগে সে জানতো না।
“মিস্টার চৌধুরী আপনার স্ত্রীর মনে হয় বাচ্চা ভালোলাগে। দেখুন সারিবকে আদর করছে।”
আহিয়াদ খেতে খেতে বলল। সারহান সেদিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দিলো;
“আমি আজ জানলাম মিস্টার আহিয়াদ আমার স্ত্রীর বাচ্চা পছন্দের।”