অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৪

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৪
ইয়াসমিন খন্দকার

আমিনা সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগে ওঠে৷ তার শরীরটা আজ বেশি ভালো নেই। কিন্তু এতে তার কাবু হলে চলবে না। কারণ সে এখন একজন শিক্ষিকা। তাই শত শরীর খারাপের মাঝেও তাকে স্কুলে যেতে হবে। আমিনা কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। এমন সময় আরুশি এসে তার সামনে রুটির থালা নিয়ে এসে বলল,”স্কুলে যাবার আগে এই খাবার টুকু খেয়ে নাও।”
আমিনা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”অনেক দেরি হয়ে গেছে বড় আম্মু। আমি স্কুলে গিয়ে নাহয় খেয়ে নেব।”
বলেই আমিনা বের হতে যাবে ঠিক তখনি নিজের এক বছর বয়সী মেয়েকে কোলে নিয়ে উপস্থিত হলো আরহা। তার পরনে ডাক্তারের পোশাক। সে এসেই বলল,”এভাবে না খেয়ে থাকা তো শরীরের জন্য ভালো নয় আপু। তুমি খেয়ে নাও।”

আমিনা আরহাকে দেখে অবাক হয়। মলিন চোখে তাকিয়ে থাকে আরহার মেয়ে নিঝুমের দিকে। নিঝুমের মুখটা ভীষণ মায়াবী। তাকে দেখলেই আমিনার নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে যায়। নিঝুম আমিনার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসে। আমিনার বুকে এক অদ্ভুত পীড়া শুরু হয়। আরহা এগিয়ে এসে বলে,”ও বুঝি তোমার কোলে যেতে চাইছে আপু। ওকে নেবে একটু।”
আমিনা বলে ওঠে,”নাহ..ওকে আমার থেকে দূরে নিয়ে যাও আরহা। আমি..আমি অভিশপ্ত। আমি নিজের বাবুকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার কাছে এলে তোমার মেয়েরও ক্ষতি হবে। যেই আমি নিজের বাবুকে সামলে রাখতে পারিনি সে অন্যের বাচ্চাকে কি সামলাবো। ওকে নিয়ে যাও।”
বলেই আমিনা নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে যায়। আরহা আমিনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দুঃখে মিইয়ে যায়। আরুশি বলে ওঠেন,”নিজের ছেলেকে হারানোর পর মেয়েটা নিজেকে অভিশপ্ত ভাবছে। ওকে আমি আর সামলাতে পারছি না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরহা বলে,”সব দোষ ব্রোর..ব্রো কেন এভাবে আমিনা আপুকে একা ছেড়ে গেল? আপু তো কোন অন্যায় করে নি। আপু এখানে একা একা তার হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে খুশি চলেছে আর ব্রো আমাদের সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে। বিগত ৬ বছরে একবার দেশে আসেনি, আমাদের সাথে যেন সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে। কেন এমন করছে ও? ও কি ভাবে? ও একাই নিজের ছেলেকে হারিয়ে কষ্ট পাচ্ছে? আর আমরা সবাই খুব ভালো আছি।”
আরুশি বলেন,”বাদ দেও এসব। তুমি নিজের কথা বলো। তোমার জীবন কেমন চলছে?”
আরহা হালকা হেসে বলে,”আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমি এখন অনেক ভালো আছি। মাশরাফি আর নিজের মেয়েকে নিয়ে এখন আমার সুখের সংসার। মাশরাফি তো এখন জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলে। বর্তমানে টেস্ট সিরিজের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় আছে। আর আমি তো মেয়েকে সামলাচ্ছি।”
“তোমার ক্যারিয়ার ভালো চলছে তো?”
“হুম।”

“নিজের ছেলেকে নিয়ে গর্ব করতে না পারলেও তোমাকে নিয়ে আমি গর্ব করি আরহা। তুমি এখন শহরের একজন বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট। তার উপর একজন ভালো মা তুমি, ভালো স্ত্রীও। এদিকে তোমার ভাই..ও না ভালো ছেলে হতে পারল না ভালো স্বামী। আসলে এই খান পরিবারের ছেলেরা ভীষণ অভিশপ্ত। যাদের জীবনে ওদের ছায়া পড়ে তারা একদম অভিশপ্ত হয়ে যায়। যেমন তোমার বাবার সাথে বিয়ে করে আমি কষ্ট পাচ্ছি সেভাবে আমিনাও কষ্ট পাচ্ছে। এসব আমি মেনে নিতে পারছি না।”
“কি আর করার মাম্মা। পাপা নিজেকে এখন সম্পন্ন গুটিয়ে নিয়েছে। দাদাও তো দুই বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। দাদি বেঁচে থাকলেও দুঃখে একদম মিইয়ে গেছেন। দাদার মৃত্যুর সময় আমরা কত চেষ্টা করলাম ব্রোর সাথে যোগাযোগ করে তাকে দেশে ফেরানোর কিন্তু সে আসল না৷ জানি না কিসের এত অভিমান।”
আরুশি বলেন,”আমি ভীষণ লজ্জিত এত স্বার্থপর একটা ছেলে জন্ম দেওয়ায়। আমি তো নিশ্চিত আমি মরে গেলেও ও দেখতে আসবে না।”

“এসব তুমি কি বলছ মাম্মা!”
“যা সত্য তাই বলছি। আমি তো তোমাদের দুই ভাই বোনকে সবসময় ভালোই শিক্ষা দিয়েছি। তবুও কেন আমার ছেলেটা এমন হলো?”
“বাদ দাও এসব। যা হবার হয়ে গেছে। এখন আমাদের চেষ্টা করতে হবে সবকিছু স্বাভাবিক করার।”
“কিভাবে স্বাভাবিক হবে সবকিছু? দীর্ঘ ৬ বছর থেকে কম তো খুঁজিনি আমার নাতিকে। এত খুঁজেও সেই নার্সের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না৷ না জানি আমার নাতিকে নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল সে। যতদিন না ও ফিরে আসছে ততদিন কিছু স্বাভাবিক হবে না৷ আমাদের জীবন এমন এলোমেলোই থাকবে।”
আরহা বলে,”আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, খুব শীঘ্রই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”

আরুশি বলেন,”দেখা যাক! তবে আমি চাই, আমিনা একটা স্বাভাবিক জীবন পাক। এই ৬ বছর আমি ওকে যেভাবে কষ্ট পেতে দেখেছি এটা ও ডিজার্ভ করে না। জাঈদকে এবার আমি ফেরাবোই। আর যদি ও না ফেরে তাহলে আমিনাকে মুক্তি দিক। অনেক হয়েছে আর না। এবার আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমিনার জীবনটা আবার নতুন করে সাজিয়ে দেব। প্রয়োজনে জাঈদের সাথে ওর ডিভোর্স করিয়ে নিয়ে ওর জন্য একটা ভালো ছেলে খুঁজে বের করব আমি। যে ওকে সুখী করতে পারবে।”
“এসব তুমি কি বলছ মাম্মা?”
“ঠিক বলছি। যে কষ্টের সময় পাশে থাকে না তার কোন যোগ্যতা নেই জীবনসঙ্গী হবার।”

“আমিনার কখনো যোগত্যা ছিল না আমার স্ত্রী হবার। ও আমার পুরো পরিবারকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিল। ওর জন্য নিজের ছেলেকেও আমি হারিয়ে ফেলতে ধরেছিলাম। এতকিছুর পর আমি আর কিভাবে নিজের ছেলেকে নিয়ে ওর কাছে ফিরতাম রিয়াশা?”
রিয়াশা বলে,”আমি আপনার কষ্টটা বুঝেছি। তবুও আমার মাঝে সবসময় একটা অপরাধবোধ কাজ করে জাঈদ ভাই। সেদিন যদি আপনি ওভাবে আমাকে সুই***সাইড করার ভয় না দেখাতেন তাহলে আমি কখনোই রাজি হতাম না সত্যটা সবার থেকে লুকিয়ে রাখতে।।”
জাঈদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। রিয়াশাকে মানানো তার জন্য সহজ ছিল না। অনেক কষ্টে সে রিয়াশাকে বুঝিয়েছিল। তখনো রিয়াশা বদ্ধপরিকর ছিল সবাইকে জানানোর যে জাঈদ ও তার ছেলে কানাডায় একসাথে আছে। তখন জাঈদ রিয়াশাকে ব্ল্যাকমেইল করে বলেছিল সে নিজেকে শেষ করে দেবে। এরপর আরো অনেক ইমোশনাল কথা বলেছিল যার ফলে সে নিরুপায় হয়ে গেছিল। এরপর থেকেই সে আবরাজকে স্নেহ করতে শুরু করে। আবরাজের মায়ের যায়গাটা সে পূরণ করে। এখন আবরাজ তাকেই মা হিসেবে মানে। যার ফলে এখন রিয়াশাও চায় না কাউকে সত্যটা জানাতে।

তবে রিয়াশা জানে, আবরাজ চায় রিয়াশাকে মা হিসেবে। কিন্তু জাঈদ ও রিয়াশার তো একে অপরের প্রতি তেমন কোন অনুভূতি নেই। তার থেকে বড় কথা, জাঈদের সাথে এখনো আমিনার সম্পর্ক আছে।
তাদের কথার মাঝেই আবরাজ এসে রিয়াশার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”রিয়ু এসো আমরা গেইম খেলি।”
জাঈদ তখন বলে,”এসব কি রাজ? রিয়াশা তোমার বড় ওকে নাম ধরে ডাকছ কেন?”
আবরাজ বিরক্তির স্বরে বলে,”রিয়ুকে মাম্মি ডাকলেও তুমি রাগ করো আবার রিয়ু বললেও রাগ করো। তাহলে আমি কি বলবো?”
“আন্টি বলবে।”
“নাহ, আমি রিয়ুকে আন্টি বলবো না।”
বলেই সে চলে যায়। জাঈদ, রিয়াশা অসহায় চোখে তাকায়।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৩

স্কুলে এসে আমিনার মন আরো খারাপ হয়ে যায়। বিভিন্ন বাচ্চাকে সে তাদের মা-বাবার সাথে আসতে দেখে। এসব দেখে সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আমার বাবু যদি আমার কাছে থাকত তাহলে আজ আমার সন্তানকেও আমি এভাবে স্কুলে নিয়ে আসতাম। কেন তুমি ওকে আমার থেকে আলাদা করলে আল্লাহ? কি দোষ করেছিলাম আমি।”
বলে সে আবারো কাঁদতে শুরু করে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৫