তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৫১
ফারহানা নিঝুম
টিমটিমে লাইটের আলোয় আবছায়া শরীরটা যেন এক অনাবৃত হয়ে ওঠে, পাথরের মতো ঠান্ডা সিলিং থেকে নেমে আসা একা আলো ফারাহর পায়ের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। ছোটখাটো ফারাহ, টাওয়েল জড়ানো শরীরে যেন এক অদ্ভুত স্নিগ্ধ, জানালার কাছে বসে বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তার শরীরের মতোই নরম ও শান্ত, একে একে গড়িয়ে পড়ে জানালার কাচে। কিছুক্ষণ আগেই তো, সে মেয়েটির সাথে কত পাগলামী করল এই মুহূর্তটি যেন সেই উত্তাল আবেগের লুটিয়ে ছিলো।।তাশফিনের বুকের মধ্যে অস্থিরতা বাড়তে থাকে, যতই সে নিজেকে ধরে রাখতে চায়, ততই মনে হয় যেন এই অদ্ভুত শান্তির মাঝে একটা দুর্বার ঝড় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু ফারাহ, তাকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খায়।
কোলে করে রুমে এনেই বিছানায় শুইয়ে দিলো তাশফিন তাকে।ফারাহ, ভয় আর অস্থিরতায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। উন্মাদ, বেপরোয়া পুরুষ যখন খুব কাছ থেকে তাকে তীব্রভাবে অনুভব করে, তখন তাকে যেন এক অদ্ভুত যন্ত্রণা গ্রাস করে। তাশফিন অপ্রত্যাশিতভাবে এগিয়ে এসে, স্নিগ্ধভাবে এক দীর্ঘ ওড়না টেনে তার দু’হাত বেঁধে ফেললো। ফারাহ চমকে উঠে, চোখে বিভ্রান্তি আর দুশ্চিন্তা। বাঁধা দিতে গেলে, তাশফিন অপ্রতিরোধ্য হাসি টা ভেতরের কম্পন আরো বাড়িয়ে দিলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মুহূর্তের মধ্যে তাশফিনের অদ্ভুত শক্তি ফারাহর ভিতর এক নতুন প্রণয়ের ঢেউ তৈরি করল। সে কেঁপে উঠলো তাশফিনের প্রতিটি স্পর্শ যেন তার বক্ষভাগে গভীরভাবে মিশে যাচ্ছিল, যেন সে এক মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত। মুহূর্তের মধ্যে সেই শান্ত আর মিষ্টি ছোঁয়ার মধ্যে যেন এক আ’গুন জ্ব’লতে থাকে, আর ফারাহ অদ্ভুতভাবে নিজেকে সেই আ’গুনের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেখে। বিছানা ছেড়ে চাদর জড়িয়ে ফারাহর কাছে এগিয়ে গেল তাশফিন। চুপচাপ পিছনে গিয়ে বেতের সোফায় বসে দু’হাতে ফারাহ কে টেনে চাদরের ভেতরে নিয়ে নিল আলগোছে। হকচকিয়ে গেল ফারাহ,তবে তা ক্ষণিকের জন্য।শীত শীত করছে তার,তবে উঠে গিয়ে চাদর নিতে ইচ্ছে করছিল না। উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে সুড়সুড়ি লাগছে ফারাহর। কিন্তু মুখ ভার করে বসে রইল একই ভাবে ।
“সুখ হোয়্যাট হ্যাপেন্ড? মুখটা ভার কেনো?”
দুহাত মেলে ধরে তাশফিনের সামনে ফারাহ।লালচে দাগ পড়েছে হাতের দুধারে। ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত করে তাকালো তাশফিন। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠে ফারাহ।
“দেখুন কি করেছেন হাতের অবস্থা? আপনি এমন কেনো হুঁ?”
দু’হাতে পরপর উন্মাদের মত চুমু খেলো তাশফিন।গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো।
“সরি বাট নট সরি সুখ। আমি কিন্তু এমনি!”
“ছুঁবেন না ফাজিল লোক।আগে যদি জানতাম আপনি এমন তাহলে..
“তাহলে কি?”
ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে। ফারাহ তেতে উঠল,উঠে যেতে চাইলে কোমড় টেনে জড়িয়ে রাখে তাশফিন।
“তাহলে আপনাকে গু’লি করে দেবে।”
সশব্দে হেসে উঠলো তাশফিন।গালে নাক ঘষে ফিসফিসিয়ে বললো।
“করে দাও তাড়াতাড়ি।”
ম্লান মুখ করে তাকালো ফারাহ।মিহিয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে।
“ব্যথা পাই তো আমি।”
বুকের মধ্যখানে ছোট পাখিটাকে দুহাতে আগলে নিলো তাশফিন। কপালে উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে বলে।
“ভালোবেসে ভুলিয়ে দেব।”
চুপটি করে কবুতরের বাচ্চার মতো শুয়ে রইলো ফারাহ।
“আচ্ছা আমরা এখানে চলে এলাম, বাড়ির কেউ জানে?”
“হুঁ জানে!”
“ইস্ সবাই কি বলবে বলুনতো?”
লজ্জায় মাখা মুখ দেখে ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো তাশফিন।
“বলবে বউ নিয়ে হানিমুনে গেছি আবার।”
কিছু বলতে পারলো না ফারাহ।চুপ করে রইলো।
“আপনি এত ঠোঁটকাটা কেন? একটুও লজ্জা নেই?”
“বউয়ের সামনে কিসের লজ্জা?”
“ছিহ আপনার এই সবের জন্য আমার কি খারাপ অবস্থা!”
“উফ্ একেই বলে পুরুষ। মহা পুরুষ যে কিনা ঠিকঠাক বউ সেবা করছে।”
চট করে উঠে গেল ফারাহ,এক টুকরো সাদা কাপড় জড়ানো।নিজেকে যথাযথ ঢাকার চেষ্টা করলো। দূরে গিয়ে তাশফিন কে উদ্দেশ্য করে বললো।
“কচু পুরুষ।”
ক্লিন শেভ করা গালে হাত বুলায় তাশফিন, অদ্ভুত ভঙিমায় এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে বললো।
“আবারো বুঝাই পুরুষ কী না?”
চট করে দৌড়ে গিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল ফারাহ। ভেতর থেকেই গলা উঁচিয়ে বললো।
“ব্যাঙ করবেন আপনি।ধরে তো দেখান!”
দরজার কাছে দাঁড়ালো তাশফিন, দুর্বোধ্য হাসি খানা ঠোঁটে ঝুলছে।
“সুখ রে এবার তো তুই গেলি!”
ভেতরে থাকা ফারাহ খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।
টুকরো টুকরো মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশপৃষ্ঠে।সাদা তুলোর মত নরম।গাছপালার পাতাগুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে।দূরে মাঠের কিনারায় একটা পুরনো আমগাছ ছায়া ফেলেছে ধানখেতের গায়ে, যেখানে হলুদ হয়ে ওঠা শিষগুলো বাতাসে দুলছে ।
পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরেছে ঝুমুর।সব কিছু ইদানিং ঠিকঠাক চললেও মাঝে মধ্যে রুবেনা শেখ এবং রিজুয়ান শেখ তার আড়ালে তাকে নিয়ে আলোচনা করে।সে এসে পড়লেই দু’জনে মুখে কুলুপ এঁটে ফেলে। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেও না।তাতে ভীষণ বিরক্ত ঝুমুর। পরীক্ষা চলছে যার দরুন খুব একটা কথা বলতে পারে না নবীনের সাথে। এটাই ওর লাস্ট ইয়ার এরপর পড়াশোনার ঝামেলা শেষ।দেখা যাক পরে কি করা যায়। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিল ঝুমুর। আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে মাহির কে খুঁজে না পেয়ে রুবেনা শেখ কে জিজ্ঞেস করে।
“আম্মু মাহির আসেনি এখনো?”
রুবেনা শেখ ছাদে যাচ্ছিলেন, ঝুমুরের প্রশ্নে থেমে বলেন।
“না এখনো আসেনি।”
নূপুর স্বাভাবিক ভাবেই চলেছে ইদানিং। নিজের প্রতি যত্নশীল হয়েছে সাথে ছেলেকেও খুব যত্ন করে সে। মাহির কে দুমাস হলো স্কুলে ভর্তি করিয়েছে।রোজ আনতে যায়,মাঝে মাঝে তাশফিনও আনতে যায়। মাহির ইদানিং দুষ্টু হচ্ছে। এখন আর আগের মতো বাবা বাবা করে না। তবে মাঝে মধ্যে হুট করেই নূপুর কে জিজ্ঞেস করবে “আব্বু কোথায় আম্মু?”
কথাটা শুনলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার।
স্কুল ছুটি হয়েছে সবে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে নূপুর, অপেক্ষা করছে ছেলের জন্য।দূরে ব্যাগ কাঁধে দৌড়ে আসছে মাহির, নূপুর কে দেখেই জাপটে ধরে।
“আম্মু আম্মু।”
ঘেমে যাওয়া মুখখানি ওড়না দিয়ে মুছে দিলো নূপুর।
“আমার বাবাটা।”
“আম্মু জানো আজকে আমি সবার আগে গণিত করে দিছি, ম্যাডাম আমাকে গুড বয় বলেছে।”
মুচকি হাসে নূপুর। প্রতিদিন ক্লাস শেষে সব কথা এসে নূপুর কে বলে মাহির। ছেলের আদুরে কথা গুলো শুনতেও বেশ লাগে তার।
“আচ্ছা মাহির বাসায় গিয়ে শুনবো ঠিক আছে। চলো এখন যাই।”
মা ছেলে দু’জনে হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে। হুট করেই একটা বাইক চলে আসে সামনে। আঁতকে উঠে নূপুর, কিঞ্চিৎ ভয় পেলো সে। হেলমেট খুলতেই পরিচিত মুখটা দেখতে পেলো।
হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে নিহাল।নিহাল কে দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেল নূপুর।সে রোজ আসে বাড়িতে, সবাই তাকে বরাবরই ভালোবাসে ।মাহির তো এখন আগের থেকে আরো বেশি ভালোবাসে।
“আঙ্কেল!”
মাহির নূপুরের হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে চট করে কোলে উঠে গেল নিহালের।
“ইয়া মাই চ্যাম্প কি অবস্থা?”
“খুব ভালো। আমি ক্লাসে ম্যাডামের থেকে গুড বয় পেয়েছি।”
“আচ্ছা তাই। তাহলে তো তুমি সত্যি গুড বয়।”
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো মাহির। নূপুর আইঢাঁই করে বলল।
“চলে এসো মাহির বাড়ি ফিরবো।”
মাহির মুখ কালো করে তাকালো।
“না আমি আঙ্কেলের সাথে বাইকে যাব্বো।বাইকে করেএএ।”
নিহাল হাসলো। নূপুর তোতলাতে তোতলাতে বললো।
“না,,চলে এসো।”
“না না না আমি আসবো না। আঙ্কেল আমাকে নিয়ে যাও।”
“থাকুক না নূপুর?চলো আমি পৌঁছে দেই বাড়িতে।”
নূপুর ফের চমকে উঠে। এভাবে বাইকে যাবে? না না কি লজ্জাজনক!
“না না নিহাল ভাইয়া আমরা পারব যেতে।”
“উফ্ জেদ ছাড়বে তুমি?উঠে এসো।”
ধমক খেয়ে চুপ করে যায় নূপুর,মাহির খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। চটজলদি নিহালের সামনে এসে বসলো। নূপুর কাঁপা দেহে ধীরে ধীরে উঠে বসে। বাতাস বইছে প্রবল বেগে। কপালের চুল গুলো উড়ছে অবলীলায়।বাইকের আয়নায় উঁকি দিচ্ছে নিহালের সুগভীর দৃষ্টি।সেই আগের মতই রয়েছে নূপুর, সুদীর্ঘ কেশ, ফর্সা সুন্দর মুখশ্রী। পাতলা ঠোঁট। শুধু সেই ঠোঁট দুটোর উপর থেকে সরে গেছে প্রাণবন্ত হাসি খানা ।আদতেও কি কখনো সে পারবে সেই প্রাণবন্ত স্বচ্ছ হাসিখানা ফিরিয়ে দিতে?
নিজের উপর মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হয় নিহালের,সে যদি সেদিন জোর করেই নূপুর কে বিয়ে করে ফেলতো তাহলে বোধহয় এরকম করুণ অবস্থা হতো না মেয়েটার!
নূপুর আইঢাঁই করে শুধোয়।
“আপনি পৃথার ফোন ধরছেন না কেন নিহাল ভাইয়া?”
ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল নিহাল। কালকের পর থেকে পৃথার সঙ্গে কোনো কথা বলেনি নিহাল।
“এমনি।”
মলিন মুখ করে বলল নিহাল। নূপুর চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে।
“মেয়েটা কিন্তু সত্যি খুব ভালো। আপনি চাইলে ওকে একটা সুযোগ দিতে পারেন।”
নিহাল কি করবে জানে না।
“আমার এই জীবনে আমি কাউকে সুযোগ দিতে চাই না নূপুর।”
নূপুর কে সকাল বেলায় পৃথা ফোন করে অনেক কান্নাকাটি করেছে। নিহাল তার সাথে কথা বলছে না! সে সবটা মেনে নিতে পারলেও এরকম কথা না বলা অবহেলা টুকু মানতে পারবে না।
বাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো নিহালের বাইক। মাহির নেমেই দৌড় লাগালো ভেতরের উদ্দেশ্যে।
নূপুর চাপা স্বরে বলল।
“জানি না আপনি খুশি হবেন কিনা, কিন্তু আমি ভীষণ খুশি হবো যদি আপনি পৃথা কে একটা সুযোগ দেন। মেয়েটার ভালোবাসায় কোনো কমতি নেই। নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে আপনাকে।”
আর অপেক্ষা করলো না নূপুর ,গুটি পায়ে ভেতরে চলে গেল । নিহাল নিশ্চুপ , সে কি জানে না পৃথা কেমন মেয়ে? এত অবহেলা করার পরেও ভালোবেসে যাচ্ছে। একটুখানি ভালোবাসা আশা করছে,অথচ নিহাল দিতে পারছে না। সে এক ব্যর্থ পুরুষ।
শনিবার সকাল সাড়ে নয়টা ছুঁই ছুঁই।বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ফারাহ।হুট করেই মুখের উপর তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। ঝাঁপসা ঝাঁপসা দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করছে ফারাহ।মুখের সামনে আরো একটি মুখাবয়ব দেখে হকচকিয়ে গেল।
“ক..কি করছেন লেফটেন্যান্ট সাহেব?”
“চুমু চুমু ফিল পাচ্ছি তাই এসেছি।”
থতমত খেয়ে গেল ফারাহ, চকিতে উঠতে গিয়ে বুঝতে পারলো ভারী শরীরটা তার উপর বিচরণ করছে।
“ছিহ লেফটেন্যান্ট সাহেব আপনি এত লুচু হচ্ছেন কেন দিন দিন?”
ঠোঁট কা’মড়ে হাসলো তাশফিন, দুদিকে মাথা দুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো।
“দিন দিন আমার বউটা হট হচ্ছে তাই আমি লুচু হচ্ছি।”
“আপনার এই অশ্লীল কথার জন্য আপনাকে ভাইরাল করে দেওয়া উচিত। সবার উচিত আপনার লুচুগিরি দেখা।”
তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো তাশফিন।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৫০
“উফ্ সুখ আগে বলবা তো। তাড়াতাড়ি ভিডিও করো জান,দেখো আমি ঠিক কতটা অ’শ্লীল। এরপর দুজনেই ভাইরাল ঠিক আছে।”
শেষের কথাটা বলে চোখ টিপলো তাশফিন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ফারাহ। ঠোঁটকাটা জামাই তার, কোথায় পালাবে সে?