একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৫৪ (২)

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৫৪ (২)
Mousumi Akter

দুই জোড়া পা, একজোড়া পা ধবধবে সাদা, আরেকজোড়া পা শ্যামলা কিছুটা। গোড়ালি থেকে প্যান্ট খানিকটা ওপরের দিকে ভাজ করে রাখা। সমুদ্রের তীরে পা ভিজিয়ে হেঁটে চলেছে। একজন খুব গুরুগম্ভীরভাবে হেঁটে চলেছে আরেকজন প্রচুর কথা বলছে। গুরু গম্ভীরভাবে তন্ময় ছাড়া আর কে থাকবে? প্রচুর কথা বলা ছেলেটি দ্বীপ ছাড়া আর কে হবে?.জীবনের অন্যতম সেরা মুহুর্তের মাঝে এই মুহুর্ত টা বোধহয় সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দর। নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ডের সাথে সমুদ্রে পা ভিজিয়ে হাঁটা। কিছু মুহুর্ত থাকে অন্যতম সুন্দর। কে বলেছে শুধু প্রেমিকার সাথে একান্তে সময় কাটাতে পারলে সেই সময় বিশেষ হয়। বন্ধুর মত বন্ধু থাকলেও সময়গুলো বিশেষ এর চেয়েও বিশেষ হয়। এই মুহুর্তে দ্বীপ সেই সময় দিয়ে অতিক্রম করছে। কিন্তু তন্ময় ওর মনে কি চলছে? সমুদ্রের ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাসের চেয়েও জজলোচ্ছ্বাস চলছে ওর মনে। কারণ একটাই,সেটা হল ছোঁয়া। ও কেন আসছে? কি উদ্দেশ্য আসছে? ভেঙে যাওয়া তন্ময় কে কি ভয়ানক কোনো আঘাত দিয়ে সমুদ্রে ভাষিয়ে দিতে চায়। নাকি মহাসমুদ্রে ডুবে যাওয়া তন্ময়’কে টেনে নতুন পৃথিবী দিতে চায়।

দ্বীপ হঠাৎ তন্ময়ের পায়ের দিকে তাকালো। দ্বীপের দৃষ্টি আটকে গেল তন্ময়ের পায়ে। ফর্সা ধবধবে পায়ে কালো পশমের আবরণ। কি দারুণ দেখাচ্ছে। দ্বীপ ছেলে হয়েও মুগ্ধ হল। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
” তন্ময় মাঝে মাঝে ভাবি, সৃষ্টিকর্তার যদি একটা নিঁখুত সৃষ্টি থাকে সেটা বোধহয় তুই। আমি একটা ছেলে হয়েও তোর পা জোড়া থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছি না। এত সুন্দর কোনো ছেলের পা হতে পারে?”
তন্ময় এতক্ষণ কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত ছিলো। দ্বীপের কথা শুনে কিঞ্চিৎ হেসে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” কি নিয়ে পিছে লাগবি সেটা ভাবছিস? ”
” না ভাবছি এত সেক্সি পা তোর। কতশত মেয়ে ক্রাশ খাচ্ছে।”
” ছেলেরাও সেক্সি হয়, জানতাম না। জানিয়ে বড় উপকার করলেন।”
দ্বীপ তন্ময়ের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল,
” দাঁড়া হালার পো মৃন্ময় রে কল লাগায়। ”
বলেই মৃন্ময় কে কল করল দ্বীপ।
তখন রাত বারোটা বাজে। দ্বীপ বার বার ভিডিও কল দিচ্ছে মৃন্ময়কে। মৃন্ময় নেটে নেই। দ্বীপ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,

” কীরে ভাই! মৃন্ময় নেট অফ করে রেখেছে কেন?”
তন্ময় সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” বুঝিস না ক্যান? ফিডার খাস। ”
দ্বীপ খুব হা হুতাস করে বলল,
” মৃন্ময় আজ বাসর করতেছে, সিরিয়াসলি ভাই মৃন্ময় আজ বাসর করতেছে আর আমি সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতেছি। বয়স্ক হোক, বুড়ি হোক, ছুডি হোক, কালো হোক, ল্যাড়া হোক কোনমতে শ্বাস নিঃশ্বাস চলছে এরুপ একটি মেয়ে এনে হলেও এই রাতে আমার বিবাহের ব্যবস্থা কর।”

এমন সময় তন্ময় খেয়াল করল সাদা জরজেট শাড়ি পরিহিত দু’জন নারী হেঁটে আসছে। তন্ময়ের চোখ জোড়া সবার আগে ঐশ্বরিয়ার মত গড়নের চিকন ফর্সা মেয়েটার দিকে গেল। কি ভয়ংকর সুন্দরী। যেন আসমানের চাঁদ সমুদ্রের তীরে নেমে এসেছে। সাথে সাথে তন্ময়ের হৃদস্পন্দনের মাঝে অস্বাভাবিকভাবে কম্পন শুরু হল। কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পে-টা-চ্ছে। তন্ময়ের সর্বাঙ্গ কাঁপছে। সারা দুনিয়া ধরে ঘুরছে। কোনো সাধারণ মেয়েকে দেখেতো তন্ময়ের এমন হবার কথা নয়। এটা সাধারণ কোনো মেয়ে নয়। এটা ছোঁয়া, তন্ময়ের ছোঁয়া। যে মেয়েকে প্রথমবার দেখে হৃদপিন্ড থমকে গিয়েছিলো তন্ময়ের। যে মেয়েকে দেখেই তীব্র প্রেমের নেশা জেগেছিলো।

তন্ময়ের ঠোঁট জোড়া থরথর করে কাঁপছে। ছোঁয়ার শাড়ির আঁচল বালু দিয়ে টানতে টানতে আসছে। সে ও দূর থেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তন্ময়ের দিকে। চোখ দু’টো ছলছল করছে। সারাহ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তন্ময় আর ছোঁয়ার দু’চোখের দৃষ্টির দিকে। দ্বীপ ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দু’জন দু’জনের কাছাকাছি যত আসছে ততই হৃদয়ের কম্পন বাড়ছে৷ দীর্ঘদিন পর ভালবাসার মানুষের সাথে দেখা হওয়ার অনুভূতি তীব্র অস্থির অনুভূতি সৃষ্টি করে। তাও যদি হয় না হওয়া হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার দেখা।তন্ময় আর ছোঁয়ার দূরত্ব আর মাত্র সামান্য। কিন্তু তন্ময়ের কাছে মনে হচ্ছে ছোঁয়া এখনো তার থেকে অনেক দূরে।

সে ছুঁতে গেলেই হারিয়ে যাবে। কি অদ্ভুত ভাবে হৃদয় আর শরীর কাঁপছে। এই কম্পনের নাম তন্ময়ের জানা নেই। ছোঁয়ার ও একই অনুভূতি। সারাজীবন ভীষণ ভালবাসা মানুষটার থেকে নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রেখে ভয়াবহ যন্ত্রণা ভোগ করছে। পৃথিবীর কেউ জানেনা ছোঁয়ার অপ্রকাশিত গভীর ভালবাসার কথা। ভাল বেসেও প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা বড্ড ভয়াবহ রকমের হয়। ছোঁয়ার বুকটা যেন ভেঙে যাচ্ছে৷ কি নিদারুণ যাতবা। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে অবশেষে দু’জন দু’জনের মুখোমুখি হল। দু’জনের চোখ জোড়া ই পানির সমুদ্র। দ্বীপ সারাহ কে ইশারা দিয়ে সাইডে নিয়ে গেল। তন্ময় আর ছোঁয়াকে স্পেস দিয়ে দিলো।

দু’জন দু’জনের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। দু’জনের চোখ দিয়েই পানি পড়ছে। দু’জনের ই ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। কতখানি সময় অতবাহিত হওয়ার পর ছোঁয়া আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না। নিজের সমস্ত আবেগ ভেতর থেকে বের করল, সে বিদ্যুৎ গতিতে তন্ময়কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে উঠল। কি ভয়ানক সেই কান্না। তন্ময় ছেলেটাকে বুঝি এবার ছোঁয়া মে-রে ফেলার ধান্দা করেছে। এমনিতেই ছোঁয়া সামনে এলে তন্ময়ের সব এলোমেলো হয়ে যায়। এইভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে তন্ময়ের হার্ট এ্যাটাক হয়ে যাবে। তন্ময় অবাক হল, ভীষণ অবাক হল! যে ছোঁয়া তার থেকে হাজার মাইল দূরে থাকতে চায় সে কীনা তাকে জড়িয়ে ধরেছে। তন্ময় আর কিছু ভাবল না। ছোঁয়া এসছে, তাকে জড়িয়ে ধরেছে এক জীবনে এটাই তার সব চেয়ে বড় পূর্ণতা। তন্ময় নিজের সবটা উজাড় করে ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরে ছোঁয়ার কপালে চুমু দিলো। ছোঁয়া হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

” তন্ময়, আমার তন্ময়। কেন আমার ভাগ্যতে, আমার কপালে বড় করে তোর নাম লেখা নেই। কেন বারবার তোর আমার মাঝে অনেক বড় দেওয়াল আসে? সেই দেয়াল টপকে আমি কেন তোর কাছে যেতে পারিনা। কেন এত বড় শাস্তি পাচ্ছি আজ আমি। কেন এক জীবনে তোকে ভালবাসার স্বাদ গ্রহন করতে পারলাম না। এত ভয়াবহ বাজে জীবন কেন আমার হল। আমি কি পাপ করেছি তন্ময়। কেন একটা স্বাধীন জীবন পেলাম না। যে জীবনে নিজের ইচ্ছামত উড়তে পারব৷ যাকে ইচ্ছা তাকে ভালবাসতে পারব৷ পৃথিবীর কেউ বাঁধা দিতে পারবে না।”

ছোঁয়ার কান্নায় দ্বীপ আর সারাহ’র চোখ টলমল করছে। ছোঁয়ার কান্নায় করুণ আর্তনাদ। ওর যে ভেতর থেকে হৃদয় চৌচির হয়ে যাচ্ছে, যন্ত্রণায় কাতর হয়ে কাঁদছে সেটা ওর হাউমাউ কান্না দেখে বোঝা যাচ্ছে। ব্যাথিত হৃদয়ের হাহাকার দেখছে সারাহ আর দ্বীপ। কিন্তু আশ্চর্য ছোঁয়া এত কাঁদছে কেন? ও তো তন্ময় কে একটু ওর সমস্যার কথা বুঝিয়ে বললেই তন্ময় বুঝবে। বোকা মেয়েটা কি জানেনা, তন্ময় ওকে একটুও ভুল বোঝেনি। তন্ময়ের বিশ্বাসের একটুও নড়চড় হয়নি। তন্ময় জানে ছোঁয়া হাজার বছর দূরে থাকলেও তার ভালবাসা থেকে দূরে থাকতে পারবে না।
ছোঁয়া আবার ও বেসামাল ভাবে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

” তন্ময় আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তন্ময়। আমি বোধহয় কষ্ট পেতে পেতে ম’রা যাবো। আমার বুকের ভেতর দারুণ যন্ত্রণা তন্ময়। অসহনীয় যন্ত্রণায় পু’ড়’ছে। কতরাত ঘুমোতে পারিনি, খেতে পারিনি, পৃথিবীর আলো বাতাস এ বের হইনি। একটা দম বন্ধ যন্ত্রণায় ম’রে যাচ্ছি। এ কীসের শাস্তি পাচ্ছি আমি। কেন পাচ্ছি তন্ময়? এই শাস্তির শেষ কোথায়?”
ছোঁয়াকে বেসামাল ভাবে কাঁদতে দেখে তন্ময় নিজেকে সামলে নিয়ে ব্যাথিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” কীসের শাস্তি?”
ছোঁয়া কাঁদতে কাঁদতে যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বলল,

” তোকে ভালবাসার শাস্তি৷ তোকে ভালবেসে প্রতিটা মুহুর্ত আমি ভয়ানক যন্ত্রণা পাচ্ছি। ”
” তাহলে আজ কেন এসছিস? আমাকে ভালবাসা যদি শাস্তির হয় তাহলে দূরেই চলে যেতি।”
” আমি আর পারিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। তালাবদ্ধ আমাকে আমি মুক্ত করে দিয়েছি। ”
তন্ময় চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা পানি ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন করল,
” আবার কখন হারিয়ে যাবি?”

ছোঁয়া তন্ময়ের বুক থেকে মাথা তুলল। কাঁদতে কাঁদতে লাল হওয়া চোখ দু’টো মেলে তন্ময়কে বলল,
“নিজের বাবাকে ছেড়ে চলে এসছি। প্লিজ!আমাকে ফিরিয়ে দিসনা তন্ময়। আমি সব ছেড়ে তোর কাছে চলে এসছি।”
তন্ময় চোখ দু’টো বড় বড় করে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভীষণ অবাক করা কণ্ঠে বলল,

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৫৪

” তুই এটা কি করেছিস ছোঁয়া? ভেবে করেছিস? ”
তন্ময়ের কণ্ঠস্বর শুনে মনে হল সে ছোঁয়ার এভাবে আসাতে খুশী নয়। ছোঁয়া যন্ত্রণা ভরা চোখ দু’টো নিয়ে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তন্ময় কি তাকে ফিরিয়ে দিবে?

একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৫৫