চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৬১ (২)

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৬১ (২)
ইশরাত জাহান জেরিন

ফারহাদ ছেলের দিকে ফিরেও তাকালেন না। তার কাঁধ থেকে বোঝা নেমেছে। বিয়ে-শাদীর ওপর কোনো আগ্রহ ছিলনা। এসব তো ফখরুল এলাহীর সামনে ভালো সাজার জন্য করা। দশটা বছর সহ্য করেছে সে সবকিছু। দশ দোকান থেকে পন্য কেনা ব্যক্তির কখনো এক দোকান পছন্দ হবে না এটাই স্বাভাবিক। এবার সে স্বাধীন ভাবে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। ওইদিন লতামণি ঘটনাস্থলে ছিল। তবে গোপনে। সাফিয়েকে না বাঁচাতে পারার ব্যর্থতার কারণে কেঁদেছিলেন সে নীরবে। মমতাজের সন্দেহ হয়েছিল অনেক আগেই।

সাফিয়ের সঙ্গে আগেই কথা বলেন তিনি। দলিলের একটা নকল কপি বানান। সেখানে সাফিয়ের নামে দলিল ছিল। সাফিয়ে জানতেন এই দলিল তার ছেলের জীবনটা শেষ করে দিবে। বাঁচতে দিবেনা ওরা। নিজের জীবনের পরোয়া করেননা সে। ছেলেটা বাঁচলে সে বাঁচতে পারবে। হয়তো মনে মনে অনেক কিছুই আন্দাজ করে ফেলেছিলেন। তবুও ছেলেটাকে ওরা বিক্রি করে দিল। জীবিত অবস্থায় জানতে পারলে হয়তো ওখানেই লাশ হয়ে যেত সাফিয়ে। সাফিয়ের সঙ্গে একটা আশ্রমের সম্পর্ক ভালো ছিল। প্রায় তার সেই বৃদ্ধাআশ্রমে যাওয়া হতো। লতামণির কাছেই আবদার করা হয়েছিল যদি সে মারা যায়,আর ফিরতে না পারে ওই আশ্রমেই যেন তাকে দাফন করা হয়। লতা তাই করল। তবে দেহের তো কিছুই পেলেন না। পেলেন হাড়গোড়, শাড়ির সঙ্গে লেগে থাকা চামড়া।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাটির নিচে তাই দাফন করা হয়। তাও বেওয়ারিশ কবর হিসেবে। এমন দিনও কখনো দেখতে হবে লতামণি ভাবেননি। দুধের মতো মেয়েটার এত ভয়ানক পরিণতি? এমন ভাবে দাফন করতে হলো যেন কেউ তাকে খুঁজে না পায়? জানতে না পারে এটা সেই অভাগী সাফিয়ে, এলাহী বাড়ির বড় বউ? সম্পত্তির দলিলটা রয়ে গেল লতামণির কাছেই। আগলে রাখলেন কোনো একদিন ফারাজ আসবে বলে। অনিশ্চিত একটা আশা নিয়ে অপেক্ষা করতেই থাকলেন। সাফিয়ের মৃত্যুর কিছুদিন পর জানা গেল দলিল ভুয়া। লতামণিকে মমতাজ আগেই দূরে কোথাও চলে যেতে বলেছেন। সে কখনো চায়নি একজন অসহায় বৃদ্ধা এসবে জড়াক। তবে শেষ বিদায়ে বললেন, ‘আমার নিজের সন্তান গুলোতো আমায় কখনো বুঝল না। মেয়েটা এখনো ছোট।

বুঝে না কিছু। আপনি দলিলটা আপনার কাছেই আগলে রাখুন। ফারাজ কোনো একদিন ফিরে এলে দলিলটা ওকে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। আপনাকে বাঁচতে হবে। ফারাজের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।’ মমতাজ জানতেন ফারাজকে যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছেন তারা ভালো মানুষ না। ফারাজের ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। তবুও…তবুও একটা আশায় লতামণিকে দূরে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর মমতাজের মৃত্যু হয়। কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বলে খুন। হয়তো সে ট্রমা থেকে বের হতে পারেননি। সাফিয়েকে বাধা না দেওয়ার আফসোস, ফারাজকে বাঁচাতে না পারার আফসোস তাকে বাঁচতে দেয়নি।

ইতালিতে ফারাজ প্রথম কয়েকমাস কথাই বলেনি কোনো। সেখানে তখন তার জাহান্নামের মতো এক একটি দিন কেটেছে। এক বেলা খেতে দিত। তাও শুঁকনো খাবার। সেই খাবার নিয়েও কারাকারি। কে কার খাবার ছিনিয়ে বেঁচে থাকতে পারে তার অসংখ্য লড়াই। ফারাজ একগুয়ে, চুপচাপ থাকত বলে তাকে অগুনিত নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এমন রাতও গেছে যখন শাস্তি স্বরূপ তাকে ভয়ানক সব পোকামাকড় আচ্ছাদিত ঘরে থাকতে হয়েছে। এমন রাত হয়েছে ক্ষুধার চোটে মাটি খুবলে খেয়েছে। ঘাস-পাতা খেয়ে বেঁচেছে। হাসি জিনিসটা কি ফারাজ তো তা পুরোই ভুলতে বসেছিল। ধীরে ধীরে সে কেমন যেন রুক্ষ, একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল। ওই রাতের পর কখনোই ফারাজ কান্না করেনি। তাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি।

হাসির সঙ্গে কান্নাটা গলায় আঁটকে হয়ে উঠেছিল সে এক অন্য মানুষ। কিছুদিন পর ফারাজ ইতালির বড় একজন স্মাগলারের হাতে পড়ে। সে কেবল অস্ত্র আর নেশাদ্রব্য পাচার করতেন। স্ত্রী সন্তান ছিল না। শোনা গেছে বোমা হামলায় তারা মারা গিয়েছিল বহু আগেই। ফারাজকে প্রথম দেখায় তার অনেক পছন্দ হয়। সেই থেকে রাখেন নিজের সঙ্গে। ফারাজের জীবনই বদলে যায়। লোকটির নাম এলেনসন। নিজের ছেলের মতো করে ফারাজকে মানুষ করেন। ফারাজ অস্ত্র চালানোতে তার থেকেও বেশি দক্ষ হয় ওঠে। এত তীক্ষ্ণ এই ছেলের বুদ্ধি। ব্যবসায় লাভ আর লাভ। এলেনের যোগ্য উত্তরসূরী ছিল ফারাজ এলাহী। ইতালিতে এলেনের থেকেও মানুষ ফারাজ এলাহীর নাম শুনে বেশি কাঁপত। আতঙ্কে পরিণত হয় সে মানুষের। তারপর সময় চলে যায়।

এগারোটা বছর পর দেশের মাটিতে পা রাখে ফারাজ। এই যে এগারোটা বছর কেটে গেল একটা রাতও ফারাজ ঘুমাতে পারেনি। মায়ের পোড়া মুখটার হাহাকার কানে এমন ভাবে আঘাত করত যে ফারাজ রাতে ঘুমাতে পারত না। এত হাই সিকিউরিটি, এত আলিশান জীবনও তাকে শান্তিতে কখনো চোখ বুজতে দেয়নি। নিজের বিশ বছর বয়সে দেশে ফিরে সবচেয়ে আনন্দ লাগে তখনই, যখন সে তার বাবাকেও একই ভাবে একই জায়গায় পুড়িয়ে মেরেছে। একই যন্ত্রণায় তার বাবা ছটফট করেছে। সেই রাতের কথা আজও মনে পড়লে শিহরণে মস্তিষ্ক পর্যন্ত শীতল হয়ে আসে। সেই রাতে ফারহাদ এলাহী তালুকদার বাড়িতেই উৎসব অনুষ্ঠানে মাতোয়ারা ছিলেন। মায়ের মতোই একটা মেয়ের গায়ে মদ ঢেলে ফূর্তি করছিল। চোখের সামনে এক মুহূর্তে পুরোনো অতীত ভেসে এলো। সেদিন বাবাকে ফারাজ এক চুলও ছাড় দেয়নি। বাবার আর্তনাদ সেদিন ফারাজের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তালুকদার বাড়ির সবাই যখন নেশা করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয় তখন বাড়ির উঠোনোর চৌকিতে পড়ে থাকা ফারহাদ এলাহী কি কল্পনা করতে পেরেছিল আজকেই তার শেষ দিন? আজকের পর সে আর কখনো পাপ করতে পারবে না?

সেদিন ফারাজ তার বাবাকেও একই ভাবে ওই পুড়িয়েছিল। পুরো বিয়ে বাড়িকে ফারাজ এলাহী জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়ল। নেশায় ফূর্তি করা মানুষগুলো জ্বলেপুড়ে পড়ল রাতের আঁধারে, হাহাকার করে বাঁচার জন্য আর্তনাদ করল তালুকদার বাড়ির বউ চৈতী মজুমদার, তার স্বামী তৌকির তালুকদার। যে কিনা ফারহাদ এলাহীর সবচেয়ে বড় পার্টনার ছিল। সবাই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু নিজের বাবাকে কি এত সহজে মারা যায়? বাবাকে সে মারল বিশেষ ভাবে। প্রথমে জ্যান্ত অবস্থায় তার চোখের সামনে কলিজাটা বের করে তার হাতের মুঠোয় রেখে সেদিন বলেছিল, চিনতে পারছ ফারহাদ এলাহী? আমি ভালো হতাম কি করে বলো? তোমার পাপের রক্ত যে এই শরীরে বইছে। অনেক কলিজার শখ ছিল না তোমার? প্রথম কলিজা বের করা তোমারটা দিয়েই শুরু করলাম। আজ থেকে যতবার কোনো পাপীর কলিজা বের করল ততবার আজকের দিনের কথা মনে করব। মনে করব ফারহাদ এলাহীর কলিজা বের করছি। আর ঠিক তখনোই কলিজা দিয়ে তৃপ্তি ভরে ভাতও খাবো। মনে মনে এই ভেবে নেব তোমার কলিজা খাচ্ছি। শান্তি করে।’

‘বাবা, আমি তো তোর বাবা হই। ছেড়ে দে।’
ফারাজ এলাহীর নয় বছরের সেই ছোট্ট ছেলেটার কথা মনে পড়ে। তার মায়ের কথা মনে পড়ে। সেদিন শরীরের কোনো অংশ বাদ নেই যেখান থেকে ফারাজ নিজ হাতে মাংশ তুলে নেয়নি। বাবা তার যখন পানির তৃষ্ণায় ব্যাকুল তখন সে সামনে এগিয়ে দিয়েছিল অ্যাসিড। ফারহাদের মাথা তখন ঠিক নেই। পানি ভেবে অ্যাসিড মুখে দিতেই কণ্ঠনালি থেকে শুরু করে সব পুড়ে যায়। সেই ব্যক্তির গায়েও ফারাজ একই ভাবে মদ ঢেলে একই গাছের সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে মেরেছিল। ওইদিন বিয়ে বাড়িতে ফারাজ আগুন লাগিয়ে একসঙ্গে তালুকদারের পুরো বংশকে শেষ করেছিল। ওরা এমন মৃত্যুরই যোগ্য ছিল।

আর ওদের তো মারতেই হতো। কারণ নয় বছর বয়সী ছেলেটাকে যেদিন টেনে হিঁচড়ে তার বাবা অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছিল, দহনে পুড়তে থাকা ছেলেটি তখন ঝলসে যাওয়ার মায়ের দেহটার দিকে শেষবার চেয়ে শপথ নিয়েছিল, প্রতিটি খুনিকে সে নিজ হাতে একদিন শেষ করবে। তবে ফারাজ সুলেমান এলাহী, রুমানা ওদের কাউকে মারেনি। ওদের মৃত্যুটা এত সহজে দিলে মজা লাগবে কি? প্রতিটি দিন ভয় আর আতঙ্কে জীবনের শেষ পর্যন্ত কাটাতে হবে ওদের। ফারাজ জানত যেই কারবার তার বাবা রেখে গেছেন তার সঙ্গে এখন এই বাড়ির ছেলেরাও জড়িত। যদিও রোশান, জোহান তখন এসবে জড়ায়নি। রোশান ভাইয়ের ছোট থেকেই মন মানসিকা ভিন্ন ছিল। ফারাজের একমাত্র খেলার সাথী, ভালো-মন্দের সহচর কেবলই সে ছিল। এগারো বছর পর ফারাজকে দেখে যেই মানুষটা বুকে জড়িয়ে

কান্না করেছিল সে ছিল ওই রোশান এলাহী। মমতাজের বিষয়ে জানতে পেরে ফারাজের খারাপ লাগে। তবে এখন আর তাকে কিছু ভাবায়না। ভাবার আগেই তো হাতে রক্ত,পাপ লেগে গিয়েছিল। যেখান থেকে ফেরার পথ সেই, মুক্তি নেই। লতামণিকে খুঁজতে ফারাজের ভালোই সময় লাগে। ফারাজ সবখানে খুঁজে-ফিরে তাকে। তবে একেবারে শেষে ওই আশ্রমে গিয়েই খুঁজে পায়। খুঁজে পায় মায়ের বেওয়ারিশ কবরটাও। একদিন এমন সময় আসবে যখন এই কবরের নাম হবে, পরিচয় হবে। ফারাজের এতটুকুই চাওয়া। লতামণি অসুস্থ হওয়ার পর তার ছেলেরা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। শেষে গিয়ে ওই আশ্রমেই তার জায়গায় হয়।

ফারাজ চিত্রার সঙ্গে এখন পর্যন্ত কি কি করেছে সবই খুলে বলে। বাড়ির মানুষগুলো সম্পর্কেও তো চিত্রা জানত না। এবার একেবারে সব জানল। গভীর ভাবে জানল। জানল আরো গভীরভাবে ফারাজকে। সম্পত্তির দলিলটা আগলে রেখেছিল লতা। সেটা ফারাজের হাতে যেদিন তুলে দেন সেদিন ফারাজ বেশ অনেক্ক্ষণ দলিলটা খুঁটিয়ে দেখেছিল। এই সম্পত্তি, লোভ কত খারাপ জিনিস। সব কেঁড়ে নিল। আবার দেখো এর কত ক্ষমতা, এক নিমিষেই গোটা বাড়ির মানুষকে এই ক্ষমতা দিয়ে হাতের মুঠোয় বন্দী করাও সম্ভব হয়ে দাঁড়াল। সেই থেকে ফারাজের দেশে যাওয়া-আসা হতো। এসেই আগে তিনতলার সেই বন্দী রুমটায় যাওয়া হতো।

যেখানে মায়ের পিয়ানোটা, টুকটাক জিনিস রাখা ছিল। কখনো কখনো মন খারাপ হলে সারা রাত পিয়ানো বাজাত সে। কেবল মায়ের শেষ স্মৃতি গুলো মায়ের খুনীর মেয়ের হাতের স্পর্শ পাবে বলেই ফারাজ চিত্রাকে কখনো তিনতলার ঘরটায় যেতে দেয়নি। ফারাজ অনেক পরে জানতে পেরছিল চিত্রার কথা। তালুকদার বাড়ির মেয়ের কথা। তারও তো কোনো বেঁচে থাকার অধিকার নেই। কারণ তার বাবা-মা কি করেছে ফারাজ কি তা ভুলে যাবে? অসম্ভব। বাড়ির কিছু মানুষ ছাড়া সবাই জেনেছে ফারাজও রুমানা-সুলেমানের ছেলে। আজও তাই জানছে। কেবল ফারাজ এলাহী চায় বলেই। ওইযে পরের বাড়ির মেয়েগুলো আছে না?

ওদের জানা নেই ফারাজ এলাহী কার ছেলে। চিত্রাকে ওই বিয়ের দিন ছাড়া ফারাজ আগে কখনো দেখেনি। ইচ্ছে হয়নি দেখার। কিন্তু প্রথম যেদিন দেখেছিল এক মুহূর্তের জন্য তার হৃদয়ের গতি কি ভয়ানক ভাবেই না বেড়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলাতে খানিকটা কষ্ট হয়। এলেনসনের মৃত্যুর পর তার সকল সম্পত্তি, ব্যবসায়ের মালিক হয় ফারাজ তবে সে জীবনে কখনো নির্দোষ কাউকে মারেনি। এই যে ফারাজ এখন প্রচুর হাসে, হেসে হেসে কথা বলে। তাকে দেখলে কেউ তার ভেতরের হালচাল বুঝে উঠতে পারেনা।

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৬১

হয়তো সে বোঝাতে চায় না বলেই কেউ বুঝেনা। সে চায় না তার অতীত কেউ জানুক। নয় বছর বয়সী ছেলেটির ব্যর্থতার গল্প কেউ জানুক। কিছু গল্প না জানাই ভালো। তবে চিত্রাকে বিয়ে করার পর এই বাড়িতে যতগুলো খুন হয়েছে তা সে তো করেনি। তবে কে করেছে জানার ইচ্ছে হয়নি। কে মরল, কে বাঁচল তাতে ফারাজের কিছুই আসে যায় না।

চিত্রাঙ্গনা শেষ পর্ব